বাংলায় নীলকরদের অত্যাচার ও নীল বিদ্রোহ

সুভাষ বিশ্বাস

প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত নীল রঙের অন্যতম উৎস হল নীল গাছ বা ‘ইন্ডিগোফেরা টিনক্টোরিয়া’ নামক উদ্ভিদ প্রজাতি। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ জামাকাপড় রং করতে গাছ থেকে উৎপাদিত এই নীল ব্যবহার করে আসছে। শিল্পবিপ্লবের যুগে ইউরোপের কলকারখানায় উৎপাদিত সুতিবস্ত্র রং করার জন্য নীলের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। তাই ব্রিটিশ নীলকররা বাংলায় উৎপাদিত উৎকৃষ্টমানের নীল ইংল্যান্ডের বাজারে চড়া দামে বিক্রি করে অধিক মুনাফা লাভের উদ্যোগ নেয়। তারা বাংলার নীলচাষিদের বলপূর্বক নীলচাষ করতে বাধ্য করে। ফলে শোষিত ও অত্যাচারিত নীলচাষিরা ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহই ইতিহাসে ‘নীল বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘বেদনার প্রতীক হিসেবে কবিতায়ও নীলের ব্যবহার আছে, অবশ্য তা বস্তুগত নীল নয়, আলঙ্কারিক।’

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে নীলের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। ভারতীয় ভেষজ বিজ্ঞানের নানা গ্রন্থে, প্রাচীন প্রতিমূর্তির বর্ণে এবং বিভিন্ন চিত্রকর্মে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এজন্য ধারণা করা হয় যে, এদেশেই নীলচাষের উৎপত্তি। লুই বোনার্ড নামের একজন ফরাসি বণিকের মাধ্যমে এদেশে আধুনিক পদ্ধতিতে নীলচাষের প্রচলন ঘটে। তিনি 1777 খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা থেকে উন্নতজাতের নীলবীজ ও আধুনিক চাষের পদ্ধতি এদেশে নিয়ে আসেন। একই বছরে হুগলির চন্দননগরের নিকটবর্তী গোয়ালপাড়া ও তালডাঙ্গা গ্রামে তিনি নীলের চাষ শুরু করেন এবং নীলকুঠি স্থাপন করেন। এজন্য তাকে বাংলার প্রথম নীলকর বলা যায়। এরপর তিনি মালদা, যশোরের নহাটা ও বর্ধমানের কালনাতে নীলকুঠি স্থাপন করেন। 1778 খ্রিস্টাব্দে ক্যারল ব্লুম নামে একজন ইংরেজ বণিক বাংলার কুষ্টিয়ায় একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। তিনি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নীলচাষে বিপুল মুনাফার কথা জানিয়ে দ্রুত নীলের ব্যবসা শুরু করার আহ্বান জানান। 1778 খ্রিস্টাব্দে তিনি তৎকালীন ইংরেজ গভর্নর জেনারেলের কাছে এই বিষয়ে একটি চিঠিও প্রেরণ করেন। উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব শুরু হলে বস্ত্রশিল্পে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে এবং বস্ত্র রং করার জন্য নীলের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে যায়। ফলে নীলের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক বুঝতে পেরে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শীঘ্রই নীলের ব্যবসা শুরু করে দেয়। এদেশের মাটি নীলচাষের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় উৎকৃষ্ট গুণমান সম্পন্ন নীল উৎপাদিত হত। এজন্য ইংরেজ কোম্পানি নীলচাষে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে। নদিয়া, যশোর, বগুড়া, রঙপুর প্রভৃতি জেলায় নীলচাষ শুরু হয়। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, 1803 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নীলচাষে যে খরচ হয়, তার পুরোটাই কোম্পানি স্বল্প সুদে অগ্রিম (দাদন) হিসেবে প্রদান করে। আর এতে উৎপন্ন নীলের সবটাই ইংল্যান্ডে বিক্রয় করে কোম্পানি বহুগুণ লাভ করে। নীলের প্রতি পাউন্ডে ছয় টাকার মতো লাভ করে কোম্পানির সম্পত্তি ফুলেফেঁপে ওঠে। এই ব্যবসায় আরও লাভের আশায় কোম্পানি 1815 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলার চব্বিশ পরগনা, মালদা, খুলনা, রাজশাহী, পাবনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল প্রভৃতি জেলায় বৃহৎ পরিসরে নীলচাষ শুরু করে এবং অসংখ্য নীলকুঠি গড়ে তোলে। এই নীলকুঠিগুলি ছিল নীলগাছ থেকে নীল রং তৈরি করার কারখানা এবং এগুলির পরিচালনার দায়িত্বে ছিল অত্যাচারী নীলকররা। কোম্পানির এই বৃহৎ উদ্যোগ গ্রহণের ফলে 1815-16 খ্রিস্টাব্দে বাংলায় 1 লক্ষ 28 হাজার মন নীল তৈরি হয়। এরপর মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যেই বাংলার নীল সমগ্র পৃথিবীর নীলের বাজারে একচেটিয়া অধিকার কায়েম করে। ফলে লাভজনক নীলের ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ফরাসি, ডাচ, পর্তুগিজ, দিনেমার প্রভৃতি দেশের ধনিক গোষ্ঠীও দলে দলে বাংলায় পাড়ি জমায়।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলায় 628টি সদর কুঠির অধীনে সর্বমোট 7452টি নীলকুঠি ছিল (দেশীয় জমিদার-মহাজনদের কুঠি বাদে)। এই নীলকুঠিগুলি থেকে উৎপন্ন হাজার হাজার মন নীল ইংল্যান্ডে প্রেরণ করে কোম্পানি প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। এসময় নীলচাষে কর্মরত ছিল 1 কোটি 12 লক্ষ 36 হাজার জন চাষি এবং নীলকুঠিগুলিতে নিযুক্ত কর্মচারীর সংখ্যা ছিল 2 লক্ষ 18 হাজার 482 জন। ইংরেজ কোম্পানির মূলধনের শতকরা 73 ভাগ নীলের ব্যবসায় লগ্নিকৃত ছিল। সে সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোন পণ্য নীলের মত এত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেনি। 1820-র দশকে কেবল নীল বিক্রি করে ইংরেজ কোম্পানি বছরে দশ-বারো লক্ষ টাকা লাভ করত।১০

প্রথমদিকে নীলচাষ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারে ছিল। 1833 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনের ফলে তাদের একচেটিয়া অধিকার লোপ পায় এবং ব্রিটেন থেকে দলে দলে ইংরেজ নীলকররা বাংলায় এসে নিজেদের ইচ্ছামত এখানকার চাষিদের দিয়ে নীলের চাষ শুরু করে। এদিকে বাংলায় উৎপাদিত নীল উৎকৃষ্ট গুণমান সম্পন্ন হলেও এর চাষ করে বাংলার কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছিল না। ফলে তারা ক্রমেই লাভজনক ধান ও পাট চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যেহেতু বাংলায় উৎপাদিত নীলের অর্ধেক উৎপন্ন হত অবিভক্ত বাংলার যশোর ও নদীয়া জেলায়, তাই এইসব অঞ্চলের নীলচাষ করতে অনিচ্ছুক চাষিদের ব্রিটিশ নীলকররা অত্যাচার ও নির্যাতন করে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। 1859 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সমগ্র বাংলায় এই ধরণের অত্যাচারী নীলকরের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচশ জন, যার মধ্যে ঢাকা ও আশেপাশের জেলাগুলির নীলের চাষ এককভাবে জে পি ওয়াইজ নামক অত্যাচারী নীলকরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বাংলার এরূপ কয়েকজন অত্যাচারী নীল কুঠিয়াল ও  নিয়ন্ত্রিত নীলকুঠিগুলির নাম হল১১ — 

এছাড়াও পরবর্তীকালের কয়েকজন অত্যাচারী কুখ্যাত নীল কুঠিয়াল হলেন মিস্টার টেলর, মিস্টার ন্যুটসন, মিস্টার রিজেন্ট, মিস্টার স্টিভেনশন, মিস্টার জেঙ্কিনসন, মিস্টার ম্যাকেঞ্জি, মিস্টার ওয়াটস, মিস্টার ডেভারেল।১৩ 

লর্ড কর্নওয়ালিস 1793 খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব প্রদানের শর্তে বাংলার উচ্চবিত্ত ব্যক্তিদের জমির মালিকানা প্রদান করেন। এরা সাধারণত বংশানুক্রমে জমিদারি ভোগ করত। ইংরেজ নীলকররা এদেশে নীলচাষ করার সময় এই জমিদার শ্রেণীকে তাদের সামনে একটি বড় বাধা হিসেবে দেখতে পেল। কেননা, নীলকররা  কোনো জমি কেনার পর ওই জমির কৃষকরা আগের জমিদারদের অধীনেই থাকত। ফলে জমিদারের অধীন কৃষককে দিয়ে নীলকররা ইচ্ছেমত কাজ করিয়ে নিতে পারত না। তাদের এই সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ 1819 খ্রিস্টাব্দে ‘অষ্টম আইন’ (Eight regulation of 1819) পাস করে। এই আইনে জমিদার নিজের জমির ভেতর ‘পত্তনি তালুক’ দেওয়ার সুযোগ পায়। জমিদাররা অধিক মুনাফার লোভে নীলকরদের কাছে বড় বড় পত্তনি দিতে শুরু করে। প্রসন্নকুমার ঠাকুর বলেছেন, “আলস্য, অনভিজ্ঞতা ও ঋণের জন্য দেশীয় জমিদারগণ জমি পত্তনি দিতে উদগ্রীব হন, কারণ ইহাতে তাহারা জমিদারি চালাইবার ভার হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন এবং জমি পত্তনিদানের মত একটি নিশ্চিত আয়ের সাহায্যে রাজধানী কিংবা কোন একটা বড় শহরে বাস করিতে পারেন।”১৪ কিন্তু তবুও ইংরেজদের সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হয়নি। কারণ পত্তনি ব্যবস্থায় জমিদারকে উচ্চহারে রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে পাঁচ বছরের জন্য জমির স্বত্ব এবং দৈনিক মজুরির বিনিময়ে কৃষকদের সেবা পাওয়া যেত, যা ছিল অত্যন্ত খরচসাধ্য। তাই খরচ কমাতে নীলকরদের বাঁকুড়া, বীরভূম, সিংভূম, মানভূম প্রভৃতি দূরবর্তী এলাকা থেকে শ্রমিক এনে কাজ করাতে হত। নীলকররা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে জমিদারি হস্তগত করার চেষ্টা করে। 1833 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ দ্বারা ‘চতুর্থ আইন’ (Fourth regulation of 1833) পাস হলে নীলকররা বাংলায় জমিদারি ক্রয়ের সুযোগ পায়। এরপর নীলকররা ছলে-বলে-কৌশলে অসংখ্য জমিদারদের কাছ থেকে জমিদারি ক্রয় করে এবং পত্তনি নেওয়া জমিগুলিও আত্মসাৎ করে। এভাবে বাংলার সর্ববৃহৎ নীল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘বেঙ্গল নীল কোম্পানি’ কেবল চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর ও রানাঘাট থেকেই 594টি গ্রামের জমিদারি ক্রয় করে এবং এইসব জমিদারির অন্তর্গত নীলচাষিদের বলপূর্বক নীলচাষ করতে বাধ্য করে।১৫  

সমগ্র বাংলায় নীলচাষকে ছড়িয়ে দিতে নীলকররা প্রথমে ‘নিজ আবাদ পদ্ধতি’ এবং পরে ‘রায়তি পদ্ধতি’ অবলম্বন করে। নিজ আবাদ পদ্ধতিতে জমিদারদেরর কাছ থেকে নীলকরদের জমি কিনতে হত বা লিজ নিতে হত। কৃষক-শ্রমিকদের জোগাড় করে তাদের দিয়ে নীলচাষ করাতে হত। নীলকরদের কাছে এই পদ্ধতি খুব একটা লাভজনক ছিল না। কেননা, নীলচাষের জন্য জরুরি ছিল নীলকুঠি সংলগ্ন উর্বর জমি। কিন্তু ব্যাপক পরিমাণ উর্বর জমি জোগাড় করা ছিল কঠিন কাজ। নীলচাষের জন্য যে প্রচুর সংখ্যায় কৃষক-শ্রমিক প্রয়োজন ছিল তা জোগাড় করাও ছিল বেশ কঠিন কাজ। মোটামুটি হিসেব অনুযায়ী, 1000 বিঘা নীলচাষের জন্য 2000টি লাঙল এবং প্রচুর ষাঁড়ের প্রয়োজন ছিল, যা জোগাড় করা ছিল বেশ সমস্যার। এইজন্য নিজ আবাদ পদ্ধতি জনপ্রিয় হতে পারেনি। প্রায় 25 শতাংশ নীলচাষের জমি ছিল নিজ আবাদ-এর আওতায়। অন্যদিকে, রায়তি পদ্ধতিতে নীলকরদের সঙ্গে নীলচাষি বা রায়তদের চুক্তি হত। নীলকররা নীলচাষের জন্য রায়তকে সামান্য পরিমাণে অগ্রিম অর্থ বা ‘দাদন’ প্রদান করত। নীলচাষি তার মোট জমির কমপক্ষে পঁচিশ শতাংশ জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য থাকত। তবে পরবর্তীকালে নীলচাষিকে তাঁর সমগ্র জমিতেই নীলচাষ করতে বাধ্য করা হত। এই পদ্ধতিতে নীলচাষ সম্পূর্ণ করার পর নীলচাষিদের পুনরায় দাদন প্রদান করা হত। নগদ টাকা বা দাদনের টানে চাষিরা শুরুর দিকে নীলচাষে আকৃষ্ট হয়। কিন্তু শীঘ্রই তারা নীলচাষের সর্বগ্রাসী রূপের পরিচয় পায় এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

বিদ্রোহের সূচনা ও প্রসার

1859 খ্রিস্টাব্দে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী চৌগাছা গ্রামে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম নীল বিদ্রোহের সূচনা হয়।১৭ তাদের নেতৃত্বে ওই বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে চৌগাছা গ্রামের চাষিরা সকলে একত্রিত হয়ে নীলচাষ করতে অস্বীকার করে। চাঁদপুরে এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাজি মোল্লা। তিনি কৃষকদের নীলচাষ না করতে উৎসাহিত করেন এবং ঘোষণা করেন ‘নীলচাষ থেকে ভিক্ষা উত্তম।’১৮ প্রথম দিকে এই আন্দোলন অহিংস ছিল। কিন্তু নীলচাষ না করার কারণে চাষিদের ওপর ভয়ানক নির্যাতন শুরু হলে এই আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়। এরপর এই বিদ্রোহ দ্রুত বাংলার অন্যান্য নীল উৎপাদিত জেলা, যেমন— মুর্শিদাবাদ, চব্বিশ পরগনা, বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, পাবনা, যশোর, ফরিদপুর, খুলনা প্রভৃতি জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। নীলচাষিরা বহু নীলকুঠি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয় এবং নীলকরদের পণ্যসামগ্রী বহনের যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। তারা সরকারি অফিস, থানা, স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস প্রভৃতির ওপরও আক্রমণ চালায়। এই বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলিম কৃষকরা ঐক্যবদ্ধভাবে যোগ দিয়েছিল। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে গ্রামীণ অঞ্চলের সকল জনগণ বিদ্রোহীদের খাদ্য, অর্থ ও আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করে। কিছু কিছু জমিদার এবং ধনী ব্যক্তি কৃষকদের পক্ষ থেকে নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে। এদের মধ্যে বিখ্যাত হলেন সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য ও দিকপতি আচার্য, নদিয়া জেলার জমিদার শ্রীহরি রায় এবং নড়াইলের জমিদার রামরতন রায়।১৯ 

নীলচাষ বিরোধী এই আন্দোলন সমগ্র বাংলায় আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। নদিয়ার দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ছাড়াও পাবনার কাদের মোল্লা, মালদার রফিক মণ্ডল এই বিদ্রোহের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। বর্ধমানের কালনায় এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন শ্যামল মণ্ডল। তৎকালীন সময়ে তিনি ‘মৃত্তিকা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং তাতে নীলকরদের অত্যাচার ও নীলচাষিদের দুরাবস্থার কথা সকলের সামনে তুলে ধরেন।২০ বাংলার নদীয়া জেলার নীল বিদ্রোহের অপর এক বীর নেতা ছিলেন বিশ্বনাথ সর্দার। স্যামুয়েল ফেডি নামক অত্যাচারী নীলকরের বিরুদ্ধে গ্রামের হিন্দু ও মুসলিম চাষিদের একত্রিত করে তিনি বৃহৎ আন্দোলনের আকার দেন।২১ শান্তিপুর এলাকার নীলচাষিদের ওপর অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে বিশ্বনাথ শান্তিপুরের নীলকুঠি আক্রমণ করে লুঠ করেন। নীলকর দ্বারা শোষিত চাষিদের জন্য তিনি রাজনৈতিক ডাকাতির পথ অবলম্বন করেন। এজন্য ইংরেজরা তাঁকে ‘বিশে ডাকাত’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। অনেকের কাছে তিনি নীল বিদ্রোহের প্রথম শহীদ হিসেবে গণ্য হন। 1808 খ্রিস্টাব্দের 27 সেপ্টেম্বর তিনি নীলকর স্যামুয়েল ফেডির নীলকুঠি আক্রমণ করেন। স্যামুয়েল ফেডির কুঠি ধ্বংস করার পর নীলকর গোষ্ঠী আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। বিশ্বনাথের একের পর এক সুসংগঠিত আক্রমণে ধূলিসাৎ হয়ে যায় খালিবোয়ালিয়া, নিশ্চিন্তপুর ও বাঁশবেড়িয়ার নীলকুঠি। নীল বিদ্রোহের সময় গোপাল মণ্ডল নামে একজন কৃষক নেতা তার একশত পঞ্চাশজন কৃষকের দল নিয়ে লাঠিয়ালদের আক্রমণ করেন। নীলকর লারমৌর নীলচাষের জন্য কৃষকদের বাধ্য করতে এই লাঠিয়ালদের পাঠিয়েছিলেন।২২ গোপাল মণ্ডলের নেতৃত্বে কিছু নীলকরকে পাকড়াও করে গণধোলাই দেওয়া হয়। নীলকুঠি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ধরা পড়া আটকাতে অনেক নীলকর পালিয়ে যায়। 

এসময় বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে নীলচাষিদের উপর হওয়া অন্যায়-অত্যাচারের কাহিনি বাংলার আপামর জনগণের সামনে তুলে ধরেন। ফলে এই বিদ্রোহ অতি দ্রুত সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ এবং অক্ষয় কুমার দত্ত সম্পাদিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকাদ্বয়ে নীলচাষিদের দুঃখ-দুর্দশার করুণ চিত্র নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হত। নড়াইলের বিশ্বেশ্বর মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কল্যাণী’ পত্রিকাতে নীল বিদ্রোহ সম্পর্কে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটকে প্রকাশিত নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনি বাংলার প্রতিটি প্রান্তিক চাষিকে ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহ যোগায়। শিশির কুমার ঘোষ, মনমোহন ঘোষ, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখ মানব দরদী ব্যক্তিগণও মন প্রাণ দিয়ে অসহায় নীলচাষিদের পাশে দাঁড়ান এবং নীল বিদ্রোহে শক্তি সঞ্চার করেন। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং খ্রিস্টান মিশনারী রেভারেন্ড জেমস লঙ-এর নামে এটি প্রকাশিত হয়। ফলে ইংল্যান্ডের মানুষরাও নীলচাষিদের উপর হওয়া নীলকরদের ভয়াবহ অত্যাচার সম্পর্কে জানতে পারে। নাটকটি প্রকাশ করার অপরাধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ জেমস লঙ-কে বিচারের সম্মুখীন করে। বিচারে তাঁকে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং 1000 টাকা জরিমানা করা হয়। লঙ-এর বন্ধু কালীপ্রসন্ন সিংহ এই জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন। ‘নীল দর্পণ’ নাটকটি প্রথম প্রকাশিত ও মঞ্চস্থ হয় ঢাকায়। শীঘ্রই নাটকটি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চস্থ হয়। এতে বাংলার মানুষ নীলচাষিদের দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারে এবং তারাও নীল বিদ্রোহকে সমর্থন জানায়। কলকাতায় মঞ্চায়নের সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই নাটকের একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। চরিত্রটি ছিল নীলকর সাহেবের। বিদ্যাসাগর যখন মঞ্চে তখন কুঠিয়াল নীলকরকে দেখে একজন ক্ষুব্ধ দর্শক তাঁর দিকে জুতো ছুড়ে মারেন। এর থেকেই বোঝা যায় নীলকরদের প্রতি বাংলার মানুষদের ক্ষোভ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল। 

নীল বিদ্রোহ এক বছরেরও বেশি সময় স্থায়ী হয়েছিল। বিদ্রোহের সময় কিছু ক্ষেত্রে নীলকুঠির প্রাক্তন দেশীয় কর্মচারী বা গোমস্তারা নীলকরদের বিরুদ্ধে নীলচাষিদের সংঘবদ্ধ করেন।২৪ এসময় নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে নীলচাষিরা কয়েকটি অভিনব পন্থা গ্রহণ করে। প্রতিটি গ্রামের সীমানায় এক জায়গায় একটি করে ঢাক থাকত। নীলকর সাহেবরা গ্রামে ঢুকে অত্যাচার শুরু করলেই কেউ না কেউ সেই ঢাক বাজিয়ে বাকিদের জানিয়ে দিত। হাতের কাছে যাই-ই থাকত তাই-ই কৃষকরা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। ভাত খাবার থালাকে তারা এক মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করত। এছাড়াও বল্লম, ইট, পাটকেল, তীর-ধনুক এবং লাঠি কৃষকদের অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। 1859 খ্রিস্টাব্দে ‘দশম আইন’ প্রয়োগের মাধ্যমে নীলকররা খাজনা বৃদ্ধি করতে শুরু করলে কৃষকরা খাজনা প্রদান করা বন্ধ করে দেয়। 1860 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নদিয়া, যশোহর, ফরিদপুর, পাবনা, বারাসাত প্রভৃতি জেলা থেকে কৃষকরা এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে এবং নীল কুঠিগুলিতে আক্রমণ শুরু করে। এসময় খুলনার নীলকর রেনি সাহেবের লাঠিয়ালদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয় শিবনাথ ও সাদেক মোল্লা। স্থানীয় লোকেদের কথায় তা প্রকাশ পেয়েছে—

গুলি গোল্লা সাদেক মোল্লা, রেনির দর্প করল চুর,                                                                                  বাজিল শিবনাথের ডঙ্কা, ধন্য বাঙ্গালা বাহাদুর।২৫

নীল বিদ্রোহের সময় নদীয়ার মোল্লাহাটির নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায় এবং নীলকুঠির লাঠিয়ালদের বড় বড় লাঠি বেকার হয়ে পড়ে থাকে। স্থানীয় লোকেদের কথায় তা প্রকাশ পেয়েছে —

মোল্লাহাটির লম্বা লাঠি রইল পড়ে হুদোর আটি,                                                                             কলকাতার বাবু ভেয়ে এল সব বজরা চেপে লড়াই দেখবে বলে।২৬

নীলকরদের বিরুদ্ধে নীলচাষিরা যেভাবে একজোট হয়ে একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলে, তাতে নীলকররা শঙ্কিত হয়ে ওঠে। আসলে নীলকর-বিরোধী এই আন্দোলনের পিছনে প্রধান কারণ ছিল অর্ধ শতক ধরে নীলচাষিদের উপর হওয়া নির্মম অত্যাচার।২৭ নীলকররা নীলচাষিদের উপর নানাভাবে শোষণ ও নির্যাতন চালাত। নির্যাতনের প্রকারগুলি দেখলে শিহরিত হতে হয়। এর কয়েকটি নমুনা নীচে দেওয়া হল—

নীলকররা নীলচাষের জন্য চাষিদের দাদন বা অগ্রিম অর্থ প্রদান করত। দাদনের টাকা নেওয়ার সময় নীলচাষিদের শর্তসাপেক্ষে চুক্তিপত্রে টিপ সই দিতে হত। প্রথমদিকে দাদনের লোভে চাষিরা নীলচাষ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই সময় প্রতি বিঘায় 2 টাকা করে দাদন দিয়ে চাষির সবচেয়ে উর্বর জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য করা হত। পরবর্তীকালে অনেক চাষি অলাভজনক নীলের চাষ করতে অস্বীকার করলে নীলকররা চুক্তিভঙ্গের কারণ দেখিয়ে তাদের পুনরায় নীলচাষ করতে বাধ্য করত। অর্থাৎ একবার কেউ দাদন নিলে সে আর নীলচাষের ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে পারত না। কেউ এই ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে চাইলে তাদের কপালে জুটত নীলকরদের অকথ্য অত্যাচার। যেসব কৃষক নির্যাতনের ভয়ে তারা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেত এবং তাদের ফেলে যাওয়া ভিটে-মাটিতে নীলচাষ করা হত।

কোনো নীলচাষি নীলচাষ করতে না চাইলে অথবা দাদন নিতে অস্বীকার করলে নীলকররা ওই চাষিকে কুঠিতে আটকে রেখে নির্বিচারে বেত্রাঘাত করত। জমিবাড়ি, গবাদি পশু, চাষের সরঞ্জাম সব কেড়ে নিত। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত এবং পরিবারের মহিলা সদস্যদের উপরও নির্যাতন করত। অত্যাচারিত নীলচাষিরা আদালতে গিয়েও সুবিচার পেত না। কেননা, নীলকররা অর্থ দিয়ে বেশিরভাগ ম্যাজিস্ট্রেটদের কিনে নিয়েছিল। তখন আইন ছিল নীলকরদের স্বার্থরক্ষার জন্য, চাষিদের সুবিচার প্রদানের জন্য নয়। তাছাড়া পুলিশ, প্রশাসন সবই ছিল নীলকরদের পক্ষে। এইভাবে কত কৃষককে যে ভিটেবাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে এবং নীলকুঠির গুদামে অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে সকরুণ মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ডেলাতুর তাঁর সাক্ষ্য-প্রমাণে নীল কমিশনকে বলেছিলেন, ‘এমন একটা নীলের বাক্স ইংল্যান্ডে পৌঁছায় না যেটা মানুষের রক্তে রঞ্জিত নয়।’ ডেলাতুর আরও বলেছেন, “ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বহু রায়তকে আমার কাছে পাঠাতে দেখেছি যাদের এপিঠ-ওপিঠ বর্শাবিদ্ধ। অন্যদেরকেও বর্শাবিদ্ধ করে গুম করা হয়েছে। এরকম নীল পদ্ধতিকে আমি রক্তপাত পদ্ধতি মনে করি।” জোর করে নীলচাষে বাধ্য করার জন্য কৃষকদের শুধু যে গুদামে বন্দি করা হত তাই নয়, তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা যাতে এই হতভাগ্যদের কোনো খোঁজ খবর না পায়, সেজন্য তাদের এক কুঠি থেকে অন্য কুঠিতে ঘোরানো হত। চাষিদেরকে নীলকররা চৌদ্দ কুঠির জল খাওয়ানোর ভয় দেখাত। কেদারনাথ মজুমদার তাঁর ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, “1843 খ্রিস্টাব্দে বাগমারী নীলকুঠির অধ্যক্ষ কিং সাহেব নীল বুনতে অস্বীকার করায় একজন নীলচাষির মাথা মুড়িয়ে তাতে কাদা মেখে নীলের বীজ বুনে দিয়েছিলেন। নীলের চারা বেরোনো পর্যন্ত তাকে সেভাবেই থাকতে হয়েছিল।”

নীলকররা নীলচাষিদের অত্যাচার করার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে প্রতারিত করত। নীল কেনার সময় নীলের ওজন কম দেখাত এবং কম দামে নীল বিক্রি করতে বাধ্য করত। তারা অবুঝ ও নিরীহ চাষিদের ভুল বুঝিয়ে তাদের জমিবাড়ি নিজেদের নামে লিখিয়ে নিত। নীলচাষের লাভের টাকা বণ্টনের ক্ষেত্রেও নীলকররা চাষিদের ঠকিয়ে যেত। বিঘা প্রতি মাত্র 2 টাকা খরচ করে নীলকর তুলে নিত 12 টাকা। তার থেকে চাষিরা পেতেন মাত্র 2 টাকা 50 পয়সা। নীলচাষ করতে রাজি হওয়া চাষিদের জমি পরিমাপের সময়ও নীলকররা কারচুপি করত। তারা গড়ে আড়াই বিঘা জমিকে এক বিঘা হিসেবে গণ্য করত, যাতে বেশি জায়গা জুড়ে নীলচাষ করা যায়। আবার দাদন প্রদান করার সময় একটি চুক্তিপত্রে নীলকররা চাষিদের স্বাক্ষর করিয়ে নিত। তাতে উল্লেখ থাকত, কতটা জমিতে নীল বোনা হবে এবং চাষিরা কত শতাংশ টাকা পাবে তা ঠিক করবে নীলকররা। কিছু কিছু চুক্তিপত্রে এও লেখা থাকত যে, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত চাষিকে নীলচাষ করে যেতে হবে।

নীলচাষ অপেক্ষাকৃত উর্বর জমিতে ভালো হয়। তাই যেসব উর্বর জমিতে ধান চাষ হয়, সেই সব জমিতে নীলকররা চাষিদের নীলচাষ করতে বাধ্য করে। ফলস্বরূপ যেখানে চাষিরা ধান চাষ করে জমিদারের প্রাপ্য রাজস্ব মিটিয়েও বাকি অংশ খোরাকি হিসেবে ব্যবহার করত বা বাজারে বিক্রি করতে পারত, সেখানে নীলচাষ করে চাষিদের রাজস্ব প্রদানের টাকাই উঠত না। ব্লেয়ার কিং তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, 1850 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করলে চাষির আয় হত 7 টাকা। অন্যদিকে নীলচাষ করলে আয় হত এক-তৃতীয়াংশের কম। এদিকে ধান চাষ না হওয়ায় বাজারে ধানের দাম বৃদ্ধি পায়। ফলে চাষিদের খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকাটাই দুষ্কর হয়ে ওঠে। তাছাড়া বেশ কয়েক বছর নীলচাষ করলে উর্বর জমি ক্রমে অনুর্বর হয়ে পড়ে। এইসব কারণে চাষিরা নীলচাষ করতে রাজি না হলে তাদেরকে লাঠিয়াল দিয়ে ধরে এনে নীলচুক্তিতে জোর করে সই করানো হত এবং সামান্য অর্থ দাদন হিসেবে দেওয়া হত। এরপরেও চাষিরা না মানলে তাদের জমি থেকে ধানের চারা উপড়ে ফেলা হয়।

নীলচাষ প্রক্রিয়াকে নিরবচ্ছিন্ন রাখতে নীলকররা ইংরেজ সরকারকে একটি নতুন আইন পাস করতে প্ররোচিত করে। তাদের সহায়তা করতে ইংরেজ সরকারও 1830 খ্রিস্টাব্দে কুখ্যাত ‘পঞ্চম আইন’ পাস করে। এই আইনে ঘোষণা করা হয় যে, দাদন গ্রহণকারী কোনো চাষি নীলচাষ করতে অসম্মতি জানালে তার বিরুদ্ধে নীলকররা ফৌজদারি মামলা করতে পারবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত নীলচাষির দীর্ঘ কারাবাস হবে এবং তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। এই আইনের অপপ্রয়োগ করে নীলকররা নীলচাষে অনিচ্ছুক কৃষকদের নামে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এতে নীলচাষিদের উপর অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। 

নীলকরদের অত্যাচার সইতে না পেরে নীলচাষিরা করুণ সুরে আক্ষেপ প্রকাশ করত। উর্বর জমিতে আউশ ধানের পরিবর্তে নীলচাষ করতে বাধ্য করা হলে কৃষকরা যে আক্ষেপ প্রকাশ করত, তা স্থানীয় মানুষদের কথায় ফুটে উঠেছে—

মুল্লুকের গুড়াগুড়ি, কবিতার শুরু করি,                                                                                                   যা’ করেন গুরু।                                                                                                                                  শুন কুঠালের সমাচার, কালিদহে কুঠি যার,                                                                                          ক্যানি সাহেব ক্যাজার করলো শুরু॥                                                                                                     সে আউশের জমিতে বুনে নীল, সব রায়তের হলো মুস্কিল                                                                              সব রায়তের মনে অবিস্তর।                                                                                                            দিলেতে পাইয়া ব্যথা, নালিশ করে কলকাতা,                                                                                        দরখাস্ত ছিল তিন সয়াল।                                                                                                            দরখাস্ত হল স্পষ্ট, লাট সাহেব হলো ব্যস্ত,                                                                                       বাঙ্গালাতে পাঠাল গবনাল॥২৮                                                                                                (সংক্ষেপিত)

নীলকরদের অত্যাচারে ক্রমেই অতিষ্ট হয়ে নীলচাষিদের সহ্যের সীমা ভাঙে। তারা নিজেদের উপর হওয়া অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদে নীলকরদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তাদের সমর্থনে সে সকল বুদ্ধিজীবী আওয়াজ তুলেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। তিনি নীলচাষিদের দুঃখ-যন্ত্রণার জন্য দায়ী ইংরেজ কর্তৃপক্ষকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বলেছেন—

নীলকরের হদ্ধ নীলে, নীলে নিলে সকল নিলে                                                                                   এইদেশে উঠেছে এইভাষ                                                                                                                     যত প্রজার সর্বনাশ।                                                                                                                     কুটিয়াল বিচারকারী লাঠিয়াল সরকারি                                                                                         বানরের হাতে কালের খোন্তা                                                                                                            খোন্তা জলে চাষ।                                                                                                                            হল ডাইনের কোলে ছেলে সোপা                                                                                                      চীলের বাসায় মাচ।                                                                                                                          হবে বাঘের হাতে ছাগের রক্ষে                                                                                                          শুনেনি কেউ শুনবে না।।                                                                                                                 হোলে ভক্ষকেতে রক্ষাকর্তা ঘটে সর্বনাশ।২৯

এই নীল বিদ্রোহের সময় আইনজীবী যদুনাথ মজুমদার নীলচাষিদের পক্ষ নিয়ে অসীম সাহসের পরিচয় দেন। তৎকালীন ঝিনাইদহের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেনসন ম্যুরের আদালতে অসংখ্য নীলচাষির নামে নীলকর সাহেবরা মামলা দায়ের করে। এসব মামলায় বিনাখরচে নিঃস্বার্থভাবে প্রজাদের পক্ষে ওকালতি করেন যদুনাথ মজুমদার। এরপর তিনি মাগুরার উকিল পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় বিলেতে কৃষকদের পক্ষে একটি আবেদনপত্র প্রেরণ করেন। ব্র্যাডলি সাহেব সেই আবেদনপত্র ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তুলে ধরেন। বিষয়টি পার্লামেন্টে প্রকাশিত হওয়ায় সেখানে এক দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ফলে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বাংলার চাষিদের দুরবস্থার বিষয় নিয়ে এদেশের ইংরেজ শাসকদের কাছে কৈফিয়ত তলব করে। বাংলার ছোটলাট এই বিষয়ে মীমাংসা করার জন্য যদুনাথ মজুমদারকে ডেকে পাঠান। অবশেষে নীলচাষিদের বিদ্রোহ ও অসন্তোষের কারণ অনুসন্ধানের জন্য ইংরেজ সরকার 1860 খ্রিস্টাব্দের 31 ডিসেম্বর ‘নীল কমিশন’ গঠন করে। এই কমিশন দীর্ঘ তিন মাস ধরে সরেজমিনে তদন্ত করে চাষিদের অভিযোগ যথার্থ বলে অভিমত দেয়। কমিশন চাষিদের উপর অন্যায় ও অত্যাচার করার জন্য নীলকরদের দোষারোপ করে। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী নীলচাষ সম্পূর্ণভাবে চাষিদের ইচ্ছাধীন হয় এবং কৃষক-বিরোধী কার্যাবলি নিষিদ্ধ হয়। ফলে 1860-62 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। অবশ্য এরপর রাসায়নিকভাবে প্রস্তুত নীল বাজারে আসায় প্রাকৃতিক নীলের চাহিদা কমে যায়। এজন্য 1895 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নীলকররা বাংলা থেকে নীলের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়।৩০

তথ্যসূত্র:

১. হোসেন, মোহম্মদ ইউসুফ (1990), ‘নীল বিদ্রোহের নানাকথা’, ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, পৃ. 17

২. https://www.getbengal.com/details/bengal-paved-the-way-for-the-first-peasant-revolution-in-india

৩. https://onushilonedu.com/history-of-indigo-revolt-in-bengal/

৪. রায়, সুপ্রকাশ (1972), ‘ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’, কলকাতা: ডিএনবিএ ব্রাদার্স, পৃ. 86

৫. রায়, সুপ্রকাশ (1972), ‘ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’, কলকাতা: ডিএনবিএ ব্রাদার্স, পৃ. 87

৬. রায়, সুপ্রকাশ (1972), ‘ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’, কলকাতা: ডিএনবিএ ব্রাদার্স, পৃ. 87

৭. রায়, সুপ্রকাশ (1972), ‘ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’, কলকাতা: ডিএনবিএ ব্রাদার্স, পৃ. 88

৮. হোসেন, মোহম্মদ ইউসুফ (1990), ‘নীল বিদ্রোহের নানাকথা’, ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, পৃ. 19

৯. Hunter, William Wilson (1881), ‘The imperial gazetteer of India’

১০. https://onushilonedu.com/history-of-indigo-revolt-in-bengal/

১১. https://www.tbsnews.net/bangla/ইজেল/নীল-ও-নীল-বিদ্রোহ

১৩. https://www.tbsnews.net/bangla/ইজেল/নীল-ও-নীল-বিদ্রোহ

১৪. রায়, সুপ্রকাশ (1972), ‘ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’, কলকাতা: ডিএনবিএ ব্রাদার্স, পৃ. 244

১৫. হোসেন, মোহম্মদ ইউসুফ, ‘ভুলে যাওয়া নীল রক্তে রাঙ্গানো বিপ্লব’, ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, পৃ. 42

১৭. হোসেন, মোহম্মদ ইউসুফ, ‘ভুলে যাওয়া নীল রক্তে রাঙ্গানো বিপ্লব’, ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, পৃ. 42

১৮. রায়, সুপ্রকাশ (1972), ‘ভারতের কৃষক-বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’, কলকাতা: ডিএনবিএ ব্রাদার্স, পৃ. 203

১৯. https://eyecopedia.com/causes-spread-characteristics-and-consequences-of-indigo-revolt/

২০. ‘নীলবিদ্রোহ এবং অম্বিকা কালনা’, www.anandabazar.com, 1 আগস্ট, 2022

২১. ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে নদিয়া’, নদিয়া জেলা নাগরিক পরিষদ: নদিয়া জেলা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা সমিতি (1973)

২২. ভট্টাচার্য, সুভাষ (জুলাই 1977), ‘বাংলার নীল বিদ্রোহ’, সমাজ বিজ্ঞানী. 5 (60): 17

২৪. Kling, Blair B. (2016-11-11), ‘The Blue Mutiny: The Indigo Disturbances in Bengal, 1859-1862’, University of Pennsylvania Press, পৃ. 85, 97

২৫. দৈনিক জনকণ্ঠ, 29 ডিসেম্বর 2023

২৬. দৈনিক জনকণ্ঠ, 29 ডিসেম্বর 2023

২৭. ‘Nildarpan’ (play by Mitra), Britannica Online Encyclopedia

২৮. দৈনিক জনকণ্ঠ, 29 ডিসেম্বর 2023

২৯. https://www.tbsnews.net/bangla/ইজেল/নীল-ও-নীল-বিদ্রোহ

৩০. ‘নীল বিদ্রোহ’, দৈনিক সমকাল পত্রিকা, 31 মে 2012

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান