নীলবিদ্রোহে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা : প্রাসঙ্গিক বিতর্ক

দেবনারায়ণ মোদক

ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের অনতিকাল পরেই— মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে— ১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দে— নীলকরদের অত্যাচারের প্রতিবাদে তার সূচনা ঘটে এবং কালক্রমে তা সশস্ত্র বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করে। বাংলার কৃষক সমাজই ছিল এই বিদ্রোহের প্রাণশক্তি। প্রাথমিক পর্বে আন্দোলন কিছুটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠলেও ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন এলাকায় কৃষক সাধারণের মধ্যে থেকেই প্রয়োজন-মাফিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। বিদ্রোহের বিস্তৃতির সঙ্গে বাংলার শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যেও কমবেশি আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং সরকারও যেন বেশ কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। শিক্ষিত সমাজের একটি অংশ আপন সংবেদনশীলতায় আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়ায়। তৎকালীন সময়ের বেশ কিছু সাময়িক পত্রে তার প্রতিফলন ঘটতে থাকে। পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি নাটকে-গানে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মাধ্যমেও তার লক্ষণ স্পষ্টতর হয়। মধ্যশ্রেণির অবচেতন বিবেক যেন নীল-বিদ্রোহের ধাক্কায় কিছুটা সজাগ হয়ে ওঠে। সরকারী স্তরে কমিশন গঠন করে ব্যবস্থা গ্রহণের তৎপরতা লক্ষণীয় হয়। এতদসত্ত্বেও, এই বিদ্রোহে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়।  নীল-বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে একথাও কমবেশি স্পষ্ট হয় যে, বিদেশী শাসকগোষ্ঠীর এবং নীলকর সাহেবদের দেশীয় সহযোগীরা ছিলেন সামন্ততান্ত্রিক মধ্যশ্রেণি ও জমিদারগোষ্ঠী। শহুরে মধ্যবিত্তরাও তখন সশস্ত্র সংগ্রাম এড়িয়ে ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে নিজেদের ব্যস্ত রাখার পক্ষপাতী। অবশ্য ঔপনিবেশিক শাসনে সৃষ্ট আর্থিক সংকটে এবং নীল-বিদ্রোহসহ বিভিন্ন গণসংগ্রামের আবর্তে তারা যেন কিছুটা দোদুল্যমান। এমনতরো এক দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষিতে নীল-বিদ্রোহে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা বেশ কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত এবং সেকারণেই বিতর্কিতও বটে। বর্তমান নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাই এ-বিষয়ে কোনও ঐতিহাসিক ধারাভাষ্যের মধ্যে না গিয়েও নীল-বিদ্রোহে মধ্যশ্রেণির বিতর্কিত অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাতের এক বিনম্র প্রয়াস গৃহীত হয়েছে।

এক

প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, ঐতিহাসিক নীল-বিদ্রোহের সূচনা, ব্যাপ্তি বা ঘটনাক্রম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এই প্রবন্ধের উপজীব্য নয়। নীল-বিদ্রোহকে ঘিরে সমকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত যে অসংখ্য লেখা-পত্র আত্মপ্রকাশ করেছে, সেগুলির সামগ্রিক পর্যালোচনাও এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। সামগ্রিক বিচারে বাংলার কৃষক আন্দোলনে মধ্যশ্রেণি সমূহের ভূমিকা এবং তৎপ্রেক্ষিতে নীল-বিদ্রোহে তাদের শ্রেণিগত অবস্থান সম্পর্কে সাধারণ ধারণালাভের অভিপ্রায়েই বর্তমান রচনাটির অবতারণা। লেখাটির উদ্দেশ্য আরও পরিস্ফূট করতে বলি যে, বঙ্গদেশের কৃষিনির্ভরতার ইতিহাস আমরা সকলেই কমবেশি জানি। কৃষিপ্রধান দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষকজীবনে তার প্রভাব সম্পর্কে— বিশেষত রাষ্ট্রের সঙ্গে কৃষকের সম্পর্ক বিষয়ে— একটা ধারণাও আমাদের রয়েছে। বিস্তারিত কথনে না গিয়েও বলি যে, এদেশে ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ানী লাভ একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘প্রস্তরফলক’ (milestone)। এ-কথা সুবিদিত যে মুঘল যুগেও রাষ্ট্রের রাজস্ব আদায়ের মূল উৎস ছিল ভূমি।  ব্রিটিশ অধিকারেও তার কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। কেবল শুরু হয়েছিল নতুনতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এই প্রক্রিয়ায় ১৭৯৩ সালের লর্ড কর্নওয়ালিশের হাত ধরে গড়ে উঠেছিল ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। যাকে নিঃসন্দেহে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ‘প্রস্তর-ফলক’ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। এভাবেই ভূমি ব্যবস্থায় অনিবার্যভাবেই সৃষ্টি হয় মধ্যস্বত্বভোগী বিভিন্ন শ্রেণির আধিপত্য। কৃষকজীবনে তার দুর্বিষহ প্রভাব অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়াতেই হাত ধরাধরি করে এসেছে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের বিভিন্ন প্রকরণ। পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বাংলার কৃষি ও কৃষকের ভবিতব্য। এসবের পরিণতিতেই বাংলার কৃষক একাধারে সরকার, জমিদার ও বিভিন্ন স্তরের আধিপত্যবাদী শক্তির কবলে নিষ্পেষিত হতে শুরু করেছে— যার অনিবার্য ফল হিসেবেই শুরু হয়েছে একের পর এক কৃষক অভ্যুত্থান। এরকম এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে বাংলার ভূমি ব্যবস্থার রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় কৃষক বিদ্রোহে শ্রেণিসমূহের আন্তঃসম্পর্কের বিশ্লেষণ বেশ জরুরি বলেই মনে হয়। এক্ষেত্রে আমরা এরকম এক সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে নীলবিদ্রোহে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবস্থান বিশ্লেষণে নিজেদের সীমায়িত রাখতে প্রয়াসী।

প্রসঙ্গত বলি যে, ঔপনিবেশিক আমলেই যে বাংলার কৃষকদের চরম সংকটের সূচনা— বিভিন্ন ঐতিহাসিক সমাজতাত্ত্বিকদের গবেষণায় তার প্রমাণ মেলে। সে-সব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও বলি যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে উনিশ শতকের বাংলায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের জীবন ঔপনিবেশিক অর্থনীতির কবলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ-সবের পরিণামে কৃষক-সমাজ মূলত সরকার, জমিদার ও নানা ধরনের মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সামিল হতে থাকে। এই বিদ্রোহগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ (১৭৬০-১৮০০), ‘শমসের গাজীর বিদ্রোহ’ (১৭৬০-৬৩), পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘চাকমা বিদ্রোহ’ (১৭৭৬-৮৭), ‘রংপুর কৃষক বিদ্রোহ’ (১৭৮৩), ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’ (১৭৯৮-৯৯), ময়মনসিংহের ‘পাগলপন্থী বিদ্রোহ’ (১৮০২-১৮৩৩), তিতুমীরের বিদ্রোহ (১৮৩১), ‘ফরাজী বিদ্রোহ’ (১৮৩৮-৫৭), ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ (১৮৫৫-৫৭), আরও কত ছোট-বড় আন্দোলন। এ-সব আন্দোলনগুলি পর্যালোচনায় কয়েকটি বিষয় বেশ স্পষ্ট হয়।  সেগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি হল :  ১) সংশ্লিষ্ট আন্দোলনগুলিকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ক্রমপ্রসারের প্রেক্ষিতেই বিবেচনা করা উচিত। ২) আন্দোলনগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানিক হলেও নিঃসন্দেহে গণভিত্তিক। ৩) প্রত্যক্ষভাবে না হলেও আন্দোলনগুলি কার্যত ব্রিটিশ বিরোধী এবং সেই অর্থে ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছেদই সেগুলির লক্ষ্য। ৪) ক্ষেত্রবিশেষে আন্দোলনগুলির স্থানিক মাত্রার কারণে জমিদার বা অন্যান্য শ্রেণির মদতপুষ্ট হলেও সেগুলি প্রধানত দরিদ্র কৃষকদেরই আন্দোলন। ৫) কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশিষ্টতা নিয়ে আন্দোলনের সূচনা হলেও অনতিকালের মধ্যে তার গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে এবং আন্দোলনের অর্থনৈতিক দিকটিই প্রকটিত হয়েছে। বর্তমান আলোচনার প্রসঙ্গে এসে বলি যে, নীল-বিদ্রোহ এগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। তাই, সামগ্রিক প্রেক্ষিতেই তা বিচার্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। 

ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব প্রসঙ্গে বলি যে, এটিকে এক সুদীর্ঘ সামাজিক ক্রমবিকাশের প্রক্রিয়াতেই অনুধাবন করতে হয়। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।  বস্তুতপক্ষে, ১৭৫৭-১৮৫৭ সালের মধ্যে এ দেশে ব্রিটিশ শাসকের গৃহীত প্রশাসনিক পদক্ষেপের মধ্যে ভূমি ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস, পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ, কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ, রপ্তানী-নির্ভর আর্থিক ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থা, ইংরাজী শিক্ষার বিস্তার, আইন-আদালত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ইত্যাদি এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ-সব কিছুর ফলেই কালপ্রবাহে বাংলায় আধুনিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশ অনিবার্য হয়ে ওঠে। তবে, এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, ব্রিটিশ শাসনকালে উদ্ভূত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সমজাতীয় (homogeneous) বলে মনে করার কোন কারণ নেই। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গবেষক আব্দুল বাছির এ ক্ষেত্রে চার ধরনের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উল্লেখ করেছেন। সেগুলি যথাক্রমে: ক) ব্যবসা নির্ভর খ) শিল্প নির্ভর গ) ভূমি নির্ভর এবং ঘ) শিক্ষা নির্ভর মধ্যবিত্ত। স্বাভাবিক কারণেই ভূমিনির্ভর মধ্যবিত্তের কথাই বর্তমান আলোচনায় বেশি করে প্রাসঙ্গিক; যদিও অন্যান্য ধরনের মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথাও বিভিন্নভাবে উঠে আসবে।

প্রসঙ্গত এসেই পড়ে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে কৃষক আন্দোলনের ধরন-ধারন ও প্রকৃতি সম্পর্কে নানা কথা। বর্তমান আলোচনার প্রেক্ষিতে সে-সব নিয়ে আলোচনার শুরুতেই যে কথাটা মনে রাখা দরকার যে, কৃষকসমাজ বস্তুতপক্ষে একটি শ্রেণি (class) নয়; একটি সামাজিক বর্গ (social category) যা অন্তর্নিহিত ভাবে সমগোত্রীয় নয়।  তাই, জোতদার-জমিদার বা মধ্যসত্বভোগী বিভিন্ন অংশ এবং প্রান্তিক চাষী, ক্ষুদ্র চাষি এবং নিতান্তই ভূমিহীন কৃষককে এক পংক্তিতে রেখে বিচার করাটা বোধ করি সঙ্গত হবে না। আবার চরিত্রগত বিচারে কৃষকদের নিজেদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন বা রাজনৈতিক প্রভাবাধীন সংগঠিত আন্দোলনের মধ্যেও পার্থক্য নিরূপণ করাটাও বোধ করি বেশ জরুরি।  বলা বাহুল্য যে, রাজনৈতিক দল বা মতের দ্বারা প্রভাবিত আন্দোলনে কৃষক-সমাজ বহির্ভূত প্রবর-শ্রেণি (Elite)-র নেতৃত্ব অধিকতর প্রাধান্য বিস্তার করে এবং তার ফলে কৃষকদের আশু দাবী-দাওয়ার আন্দোলন কার্যত রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের আন্দোলনে পরিণত হওয়ার প্রবণতাটি জোরদার হয়।  অবশ্য অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্বের প্রশ্নটি মোটেই সরলীকৃত ছিল না। বিদ্রোহগুলি আকারে ও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও সমগোত্রীয় ছিল না।  সে-কারণে তৎকালীন সময়ের কৃষক বিদ্রোহগুলিকে কোন নির্দিষ্ট ছকে ফেলে বোঝা কার্যত প্রায় অসম্ভব।  এতদসত্বেও আলোচনার সুবিধার্থে কোন নির্দিষ্ট আন্দোলন নিয়ে পর্যালোচনার শুরুতেই এ’বিষয়ে গড়ে ওঠা তাত্ত্বিক কাঠামো বা বিশ্লেষণধারা সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা আবশ্যক হয়ে পড়ে।

বাংলার কৃষক-সংগ্রামের আলোচনার অধিকাংশই নির্দিষ্ট আন্দোলনের পর্যালোচনা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। সামগ্রিক আলোচনার ক্ষেত্রে বিশেষত একটি তাত্ত্বিক রূপরেখা প্রদানের প্রশ্নে দু-চারটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা-পত্রের উল্লেখ করতে গেলেই রমেশচন্দ্র দত্তের ‘Peasantry in Bengal’ বইটির কথা মনে পড়ে। এখানে অবশ্য ব্রিটিশ-শাসনে কৃষক সাধারণের সামগ্রিক দুঃখ-দুর্দশার কথা বা তার প্রতিকারের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত হলেও একই সঙ্গে ইংরেজ শাসনের অধীনে কৃষকের পক্ষে কল্যানকর দিকগুলিকেও তুলে ধরা হয়েছে। সুপ্রকাশ রায়ের ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ এবং নরহরি কবিরাজের ‘Peasant Uprising in Bengal’ এ ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। উল্লিখিত দুটি গ্রন্থের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে মার্কসীয় চিন্তাধারার প্রভাব লক্ষণীয়। রনজিত গুহের ‘The Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India’ গ্রন্থটি এ-বিষয়ে আলাপ-আলোচনায় যেন একটি নতুন দিগন্তকে প্রসারিত করেছে। কৃষক আন্দোলনের ব্যাখ্যায় ‘নিম্নবর্গ’ (subaltern)-এর ধারণাকে সামনে এনে তিনি রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও শ্রেণিচেতনার বিকাশের এক ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। কৃষক-আন্দোলনের রকমফের বা শ্রেণিবিন্যাসের আলোচনাতেও বেশ কিছু লেখা-পত্র নজরে আসে। সেগুলির মধ্যে থিওডোর সামীমের ‘Peasant and Peasant Societies’ গ্রন্থটি আমাদের সহায়ক বলে মনে হতে পারে। বলা বাহুল্য যে, ভারতে কৃষক-আন্দোলন সম্পর্কে লেখালেখি অনেক হয়েছে এবং এখানে উল্লিখিত কয়েকটি বইকে এ বিষয়ে প্রতিনিধিস্থানীয় রচনা বা প্রাসঙ্গিক গ্রন্থ পর্যালোচনা (Overview) হিসেবে ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। কোনও নির্দিষ্ট আন্দোলনে শ্রেণিবিশেষের ভূমিকা পর্যালোচনার শুরুতে বিষয়টি সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা গড়ে তোলার অভিপ্রায়েই এমনতরো এক উল্লেখপঞ্জি। 

দুই

সুনির্দিষ্ট ভাবে নীল বিদ্রোহের কথায় এসে বলি যে, সিপাহী বিদ্রোহের অনতিকাল পরেই ১৮৫৯ খ্রীস্টাব্দে ইউরোপীয় নীলকরদের বিরুদ্ধে বাংলায় একটি ব্যাপক কৃষক-বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। নীলচাষ বর্জনের এই আন্দোলন সাফল্যের সঙ্গে ইংরেজদের নীলভিত্তিক অর্থনীতিকে আঘাত করতে সমর্থ হয়; বাংলায় নীল-শিল্প কার্যত ধ্বংস হয়ে যায় এবং নীলকর সাহেবরা তাদের কুঠি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।  এই আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও গভীরতা নিয়ে আলোচনার শুরুতে তার প্রেক্ষিত সম্পর্কে দু-চার কথা বলা যেতেই পারে।  সেক্ষেত্রে বলা চলে যে, উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে ইংল্যান্ডের শিল্প-বিপ্লব দ্রুতগতিতে বিকশিত হতে থাকে এবং সেই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে ভারতকে কাঁচামাল সরবরাহ এবং শিল্পজাত পণ্যের বাজার হিসেবে গড়ে তুলতে তৎপরতা পরিলক্ষিত হতে থাকে।  ইংল্যান্ডে বস্ত্র-শিল্পের বিস্ময়কর অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র রং করার জন্য নীলের চাহিদা বেড়ে চলে। এ রকম পরিস্থিতিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংল্যান্ডে নীল সরবরাহ করে বিপুল মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলায় নীলের ব্যবসা সম্প্রসারিত করতে থাকে। কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় বাণিজ্যিকভাবে নীল-চাষের সূচনা হয় এবং অচিরেই তা বিপুলভাবে সম্প্রসারিত হয় এবং কালক্রমে তা জবরদস্তির পর্যায়ে চলে যায়। উল্লেখ্য যে, নীল-চাষীরা অধিকাংশই ছিলেন সাধারণ কৃষক।  আইন অনুসারে তারা জমিতে যে কোনও ফসল চাষের অধিকারী ছিলেন। প্রথম দিকে কৃষকেরা আর্থিক লাভের আশায় নীল-চাষ বেছে নিলেও পরে আশাহত হয়ে তারা নীল-চাষে অনীহা প্রদর্শন করতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে অলাভজনক চাষাবাদ, দাদন-প্রথার কুফল, কৃষকের ঋণগ্রস্ততা ইত্যাদি কারণসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এরকম প্রেক্ষিতেই এসে পড়ে জবরদস্তির নানা প্রকরণ। লাঠিয়াল দিয়ে শায়েস্তা করা থেকে লুঠপাট, অপহরণ, নারী-নির্যাতন, খুন-জখম ইত্যাদি অভিযোগ সামনে আসতে থাকে। নীলকরদের এমনতর নিপীড়নের প্রতিবাদেই সংগঠিত হয় নীল বিদ্রোহ। প্রাথমিকভাবে এলাকাভিত্তিক স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের স্ফূরণ ঘটতে থাকে এবং কালক্রমে এই আন্দোলন একটি সামগ্রিক বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করে।

প্রসঙ্গত বলি যে, দীর্ঘদিন নীল-চাষ করতে করতে কৃষকদের মনে এমন ধারণা জন্মেছিল যে নীল-চাষ বোধ করি তাদের পক্ষে বাধ্যতামূলক। কিন্তু ঘটনা প্রবাহে যখনই তারা বুঝতে পারে যে, নীল-চাষ করা বা না করাটা তাদের ইচ্ছাধীন— তখনই তারা বেঁকে বসেন এবং আন্দোলনে সামিল হন। কার্যত নীল-বিদ্রোহের দুটি দিক ছিল— একটি হল অসহযোগিতার দিক, এবং অপরটি হল প্রতিরোধের দিক। কালক্রমে দেখা গেল যে, কৃষকেরা কেবলমাত্র অসহযোগিতাতেই ক্ষান্ত না হয়ে জবরদস্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।  নীলকর সাহেবরা অবশ্যই তা নীরবে হজম করেনি। তারাও কৃষকদের বিরুদ্ধে নানাধরনের দমনপীড়নের আশ্রয় গ্রহণ করে তাদেরকে নীল-চাষে বাধ্য করতে প্রয়াসী হয়েছিল। এমতাবস্থায় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে স্পষ্টভাবেই বলা চলে যে, প্রথমাবধি সরকার পুরোদস্তুর নীলকরদের পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে। কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া সরকারী সমর্থন তাদেরকে পুষ্ট করেছে। কিন্তু, নীলকরদের ক্রমবর্ধমান অত্যাচারের কাহিনী যতই সামনে এসেছে, সরকারী স্তরে অস্বস্তিও ততই বেড়েছে। এতদসত্ত্বেও ১৮৬০-এ নীল-চাষীরা যখন পণ করলেন যে তারা কিছুতেই নীল-চাষ করবেন না, তখন সরকার অবস্থা সামাল দিতে Indigo Bill পাশ করে এবং Indigo Commission গঠনের কথা ঘোষণা করে। এ-ধরনের আইনী ব্যবস্থা কৃষকদের মধ্যে নানা ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে; নীলকর সাহেবরাও এই আইনকে রায়তদের বিরুদ্ধে ভয় দেখানোর কাজে ব্যবহার করতে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে চুক্তিভঙ্গের মামলা রুজু করেও কৃষকদের নতুনভাবে হয়রানি করা শুরু হয়। সব মিলিয়ে কৃষকদের মধ্যে গড়ে ওঠা এক ব্যাপক গণ-অসন্তোষ নীল বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করে।

এখন প্রশ্ন হল এই যে, এ-ধরনের ব্যাপক গণ-অসন্তোষের নেতৃত্বের স্বরূপটি কেমন ছিল? এই প্রশ্নের জবাবটা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। বস্তুতপক্ষে, এই প্রসঙ্গে যে নানা কথা উঠে আসে, সেগুলি অনুসরণেই আমরা এই নিবন্ধের মূল বিষয়ে পৌঁছে যেতে পারি। প্রাথমিকভাবে অবশ্য একথা বলতে কোনও অসুবিধা নেই যে, নীল বিদ্রোহের নেতৃত্ব কোনও ব্যক্তি বিশেষের হাতে ছিল না। আগেই বলেছি যে, প্রথম দিকে আন্দোলন অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল এবং বিভিন্ন এলাকায় প্রয়োজন মাফিক কৃষকদের মধ্য থেকেই নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল। অবশ্য আঞ্চলিক বিভিন্নতা অনুসারে নেতৃত্বের রকমফেরও লক্ষণীয় ছিল। স্বপন বসু তাঁর ‘গণঅসন্তোষ ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ’ গ্রন্থে বিশদ আলোচনায় মত প্রকাশ করেছেন যে, “নীল বিদ্রোহে কোন কোন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ছোট বড় জমিদারদের হাতে ছিল।” তিনি অবশ্য এ-সব ঘটনাকে ব্যতিক্রমী হিসেবে গণ্য করে এবং সেগুলিকে স্থানীয় নানারকম সমীকরণের ফল হিসাবে গণ্য করে নিয়েই লিখেছেন যে, “গোটা নীল বিদ্রোহকে জমিদারদের স্নেহচ্ছায়ায় গড়ে ওঠা এক আন্দোলন বললে এর উপর অবিচার করা হবে।” বিপরীত নানা উদাহরণ উপস্থাপিত করে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমিদারদের সঙ্গে নীলকরদের সঙ্গে সম্পর্ক বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল এবং সেক্ষেত্রে স্বার্থগত ঐক্যের দিকটি ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলি প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য এই যে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে ‘পরোক্ষ সহযোগিতা’ থাকলেও ‘প্রজাদের ঐক্যবদ্ধ হবার বিপদ সম্পর্কেও তারা ছিল সচেতন।’ এ ক্ষেত্রে শ্রেণিগত অবস্থান এবং তৎসম্পর্কিত ভাবনাকে তিনি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন এবং নিজের বক্তব্যের সমর্থনে নীল কমিশনের সিদ্ধান্তেরও উল্লেখ করেছেন।কমিশনের সিদ্ধান্ত—

We are of opinion that all zemindars are much too fearful of any general combination of ryots, as well as too jealous of any sign of independence as likely to affect themselves, to have given any secret impulse or instigation to the peasantry.

উল্লেখ্য যে, ১৮৬০ সালের ৩১ মার্চের সরকারী ঘোষণা অনুসারে নীল কমিশন গঠিত হয়েছিল এবং সামগ্রিক বিচারে এতে বাংলার জমিদাররা বেশ খুশি হয়েছিলেন। বস্তুতপক্ষে, এটি তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। কমিশন ছিল পাঁচ সদস্যের— যার মধ্যে সরকার পক্ষে ছিলেন সিটন কার (সভাপতি) ও আর টেম্পল, নীলকরদের পক্ষে ফার্গুসন, ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’-এর পক্ষে চন্দ্রমোহন চ্যাটার্জী এবং প্রজাস্বার্থের দিকটি দেখার জন্য রেফারেণ্ড সেল। লক্ষণীয় যে, এই কমিশন যাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন ব্যতীত সকলেই ইংরেজ।  যে একজন ভারতীয় মনোনীত হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন বঙ্গীয় জমিদার সভার প্রতিনিধি। কৃষকদের কোনও প্রতিনিধিকে কমিশনে স্থান দেওয়া হয়নি। এতদসত্ত্বেও আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও গভীরতার প্রেক্ষিতে কমিশন নীলকরদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলির অধিকাংশ স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং স্পষ্টভাবেই মন্তব্য করে, ‘নীলকরদের ব্যবসা পদ্ধতির উদ্দেশ্য পাপ-জনক, কার্যত ক্ষতিকারক এবং মূলত ভ্রম-সংকুল।’ এতদসত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার নীলকরদের দমনে কোনও ব্যবস্থা অবলম্বন করেনি। তারা কেবলই নীলকর ও কৃষকদের এই বিরোধে নিরপেক্ষতার ভান করে দায় সেরেছিল। প্রত্যুত্তরে নীল-চাষীদের বিদ্রোহ এগিয়ে চলেছে আপন গতিতে এবং তা দমনের প্রশাসনিক ব্যবস্থাও জারি থেকেছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সরকার নতিস্বীকারে বাধ্য হয় এবং বিধিবদ্ধ আইন মাফিক ঘোষণা জারি হয় যে, কোনও নীলকরই আর কৃষকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের দিয়ে বলপূর্বক নীল-চাষ করাতে পারবে না। এই ঘোষণার মাধ্যমে ইংরেজ সরকার কার্যত নীল-বিদ্রোহের বিজয় ঘোষণা করে এবং নীলকর সাহেবরাও তাদের ব্যবসা ক্রমান্বয়ে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। সে-সবের বিস্তারিত বিবরণীতে না গিয়ে আমরা এ ক্ষেত্রে এই বিদ্রোহে শ্রেণিগত অবস্থান— বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা— সম্পর্কে মনোনিবেশ করতে পারি।

তিন

আগেই বলেছি যে, নীল-বিদ্রোহের নেতৃত্বে কৃষক সমাজের— বিশেষত সাধারণ কৃষকের— ভূমিকা ছিল অবিসংবাদিত।  বাইরে থেকে কোনও নেতা এসে এই বিদ্রোহ সংগঠিত করে নি। প্রয়োজন-মাফিক গড়ে ওঠা কৃষক সমাজের গণ-নেতৃত্বই এই আন্দোলন পরিচালনা করেছিল। প্রসঙ্গত এসেছে এই আন্দোলনে দেশীয় জমিদারদের ভূমিকা সম্পর্কিত আলোচনা।সেক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে একথা বলা চলে যে, জমিদারদের মধ্যে কেউ কেউ কৃষক বিদ্রোহে সহানুভূতিসম্পন্ন থাকলেও বা পরোক্ষভাবে সহায়তা দিলেও কার্যত তারা বিদ্রোহের বাইরেই ছিলেন।  সহানুভূতির প্রশ্নটি বাদ দিলেও স্থানিক নানা কারণে— কোথাও বা জমিদারদের পরোক্ষ সহযোগিতা কমবেশি পাওয়া গেলেও সেগুলিকে ব্যতিক্রমী বলেই ধরে নেওয়া সঙ্গত হবে। বড় বড় জমিদারেরা বিদ্রোহ দমনে নীলকরদের সাহায্যেই এগিয়ে গিয়েছিল। বস্তুতপক্ষে, নীল-বিদ্রোহের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, বিদেশী শাসককুলের দেশীয় মিত্র হিসেবে আপন স্বার্থবোধের হিসেব-নিকেশে জোতদার-জমিদার ও মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের বিপুল অংশ বিদ্রোহে সহযোগিতা তো দূরস্থান; বরং বিরোধিতাই করেছিল। ক্ষেত্র-বিশেষে ‘কৌশলী’ নানা অবস্থানকে ব্যতিক্রমী হিসেবেই চিহ্নিত করা যেতে পারে। 

নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে এমনতরো আলোচনায় এরপরে অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা, এবং শ্রেণি হিসেবে নীল-বিদ্রোহে তাদের অবস্থানের কথা। শ্রেণি হিসেবে বাংলার ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে নীল-বিদ্রোহে যোগদান করেনি— এ কথা প্রমান করতে বিশেষ অসুবিধা নেই। তবে, এ-কথাও অনস্বীকার্য যে, তৎকালীন বাংলার উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বেশ কিছু মানুষ মানবিক মূল্যবোধের প্রেরণায় বিদ্রোহী কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকাকে কোনও অংশে খাটো না করেই বলা চলে যে, শ্রেণিগত অবস্থানের বিচারধারাকে মনে রেখেও এটিকে তাঁদের ‘ব্যক্তিগত নৈতিক অবস্থান’ হিসেবে চিহ্নিত করাই বোধ করি সঙ্গত হবে। এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকভাবে এসেই পড়ে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শিশিরকুমার ঘোষ প্রমূখ বঙ্গসন্তানদের কথা—  নীল-বিদ্রোহে যাঁদের অবস্থান ছিল প্রশ্নাতীত।  তৎকালীন সময়ের কয়েকটি সাময়িক পত্রের ভূমিকা যে এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বলাই বাহুল্য। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ এবং তার ইংরেজি অনুবাদের সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথাও সুবিদিত। স্বাভাবিকভাবেই নীল-বিদ্রোহের শ্রেণিগত অবস্থানের প্রশ্নে— বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা অনুধাবনে এ-সব নিয়ে কমবেশি আলোচনা অপরিহার্য বলেই মনে হয়। 

প্রাসঙ্গিক আলোচনায় প্রথমেই এসে পড়ে শিশিরকুমারের ভূমিকার কথা।  ১৮৫৮ খ্রীস্টাব্দে যশোহরের নীলকরদের অত্যাচার যখন চরমসীমায়, তখন উৎপীড়িত প্রজারা যুবক শিশিরকুমারের প্রেরণায় দলবদ্ধ হয়ে নীলের চাষ বন্ধ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।  তাঁর ভাতৃদ্বয়— বসন্ত ও হেমন্ত— এ-কাজে শিশিরের সঙ্গী ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই শিশিরকুমার-কে কৃষকেরা দেবতাজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন। কেবল যশোরেই নয়— নদীয়া, রাজশাহী, পাবনা প্রভৃতি জেলাতেও— যেখানে নীলকরদের প্রাদুর্ভাব ছিল— সেখানকার কৃষকেরাও প্রত্যক্ষভাবে শিশিরকুমারের সান্নিধ্য না পেলেও তারই প্রদর্শিত পথে আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।  উল্লেখ্য যে, শিশিরকুমারের অপর নাম ছিল মন্মথলাল ঘোষ।  এ কথা মনে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণেই যে, তিনি এই নামে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় নীলকরদের অত্যাচার বিবৃত করে পত্র লিখতেন এবং সেগুলির নিচে MLG লিখে স্বাক্ষর করতেন।  মুদ্রাকরের ভুলে অথবা অন্য কোনও কারণে অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে MLL ছাপা হতো। নীল-বিদ্রোহে শিশিরকুমারের অবদান বিবৃত করতে গিয়ে অনাথনাথ বসু লিখেছেন, “(আপন) স্বার্থকে পদদলিত করিয়া যাঁহারা সমাজের মঙ্গলজনক কার্যে আপনাকে নিয়োগ করিতে পারেন, তাঁহারাই প্রকৃত জননায়ক বলিয়া দেশবাসীর আন্তরিক ভক্তি ও শ্রদ্ধা অর্জন করিতে সমর্থ হন।”

‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’-এর কথা যখন এসেই গেল, তখন এর সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কথা তো বলতেই হয়, কারণ নীল-বিদ্রোহে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রবাদোপম। পত্রিকাটি প্রথমাবধি নীলকর-বিরোধী। বস্তুতপক্ষে, নীলকর বিরোধী আন্দোলনে এই পত্রিকা ধারাবাহিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান প্রতিবেদনে অবশ্য সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। এখানে কেবল এটুকুই বলি যে, শিশিরকুমার ও হরিশচন্দ্রের পাশাপাশি মিস্টার জেমস্ লঙ, স্যার এসলি ইডেন প্রমূখ কয়েকজন ইংরেজ কর্মকর্তাও নীলকর বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।  লঙ সাহেব প্রায়শই ‘হরকরা’ পত্রিকায় নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কথা বিবৃত করতেন। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের কথা আমরা সকলেই জানি। লঙ্‌ সাহেব দীনবন্ধু মিত্রের এই বিখ্যাত নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ করিয়েছিলেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত সেই অনুবাদ করেছেন বলে প্রসিদ্ধি আছে। লঙ্ সাহেবকে এ-জন্য বিচারালয়ে দণ্ডিত হতে হয়েছিল এবং তিনিই মাইকেলের জরিমানার প্রায় পুরো টাকাটা পরিশোধ করেছিলেন। মহাভারতের অনুবাদক কালীপ্রসন্ন সিংহ পুরো টাকাটাই শোধ করেছিলেন বলে জানা যায়। সে-সময়ে ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড’ নামক সংবাদপত্রেও নীলকরদের অত্যাচারের কথা কম-বেশি প্রকাশিত হয়েছিল।  প্রসঙ্গক্রমে এসেই পড়ে দু-চারজন ইংরেজ সরকারী পদাধিকারীর কথাও, যারা ক্ষেত্রবিশেষে নীলচাষীদের প্রতি কম-বেশি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছিলেন। অবশ্যই এ-ধরনের সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল একান্তভাবেই ব্যতিক্রমী এবং তা কোনও বিশেষ প্রবণতার সূচক নয়।

এক্ষেত্রে মূল প্রশ্ন হল নীল-বিদ্রোহের শ্রেণিচরিত্রকে ঘিরে। ব্যক্তিগত নৈতিক অবস্থান থেকে যারা এই আন্দোলনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের কৃত্যের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেও এ-বিষয়ে প্রাসঙ্গিক বিতর্কের উল্লেখ অপরিহার্য। উল্লেখ্য যে, শিশিরকুমার ছিলেন মাগুরা-র জমিদার।  তিনি যে নীলকরদের ঘোর বিরোধী ছিলেন সে কথা আমরা আগেই বলেছি।  তিনি এই বিদ্রোহের নেতৃত্বের গৌরব চৌগাছার বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস-কে দিয়েছেন। এই দু’জনই ছিলেন ছোট জমিদার। মহাজনী কারবারেও কমবেশি তারা জড়িত ছিলেন। এ রকম ছোট-বড় অনেক জমিদারও নানা কারণে নীল-আন্দোলনে অংশভাগী হয়েছিলেন। এমনকি হরিশচন্দ্রের ভূমিকাকেও অনেকেই রেয়াৎ করেননি। প্রসঙ্গত এসেছে ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’-এর ভূমিকার কথাও। এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, হরিশ ছিলেন অ্যাসোসিয়েশনের একজন উৎসাহী সদস্য— একসময়ে তিনি এর সহকারী সম্পাদকও ছিলেন। এ-কথা অনস্বীকার্য যে, নীল প্রশ্নে এই ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ একটি বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। সে-সব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে এসোসিয়েশনের সাথে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’-এর সম্পর্কের কথা।  ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ সংগঠনের মুখপত্র ছিল কিনা— তা নিয়েও বিতর্ক যথেষ্ট।  সে-সব আলোচনার গভীরে না গিয়ে বলি যে, স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নানা কারণে দেশীয় জমিদারদের একটি অংশ বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন কারণে— বিশেষত স্থানিক নানা হিসাব-নিকেশে— নীলবিদ্রোহের সমর্থন যুগিয়ে ছিল এ-কথা সত্য। কিন্তু এই আন্দোলন ছিল প্রধানত কৃষকদেরই আন্দোলন এবং কোনও অর্থেই জমিদারদের স্নেহছায়ায় পরিপুষ্ট আন্দোলন নয়। স্বপন বসু সুনির্দিষ্ট ভাবে লিখেছেন: “ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভ্যদের একটি ভগ্নাংশ মাত্র নীল-বিদ্রোহ সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। এই সব জমিদাররা বোধ হয় এতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন ছিলেন না যে, প্রজাদের স্বাধীন চিন্তায় ও কর্মে তারা উদ্বুদ্ধ করবেন।  হরিশচন্দ্র কিন্তু তা করেছিলেন।’’১০ এ-প্রসঙ্গে অতীশ দাশগুপ্ত অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন: 

বাংলার তৎকালীন উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধি— যেমন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও শিশিরকুমার ঘোষ মানবতাবোধের প্রেরণায় বিদ্রোহী কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সংগ্রামকে সাহায্য করলেও তা ছিল তাদের ব্যক্তিগত নৈতিক অবস্থান।শ্রেণি হিসেবে বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি নীল-বিদ্রোহে যোগদান করেননি।১১

প্রসঙ্গত বলতেই হয় যে, এক অর্থে নীল বিদ্রোহের কোনও নেতা ছিল না। বাইরের থেকে কোনও নেতা এসে এই বিদ্রোহ সংগঠিত করেননি। এই বিদ্রোহ স্থানিক বা সাময়িকও ছিল না। নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষক সাধারণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রথমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হলেও ক্রমান্বয়ে তা বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হতে থাকে এবং সেই প্রক্রিয়ায় এমন সব নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটে যা নিতান্তই প্রয়োজন মাফিক। ইংরেজ সরকারের অবশ্য ধারণা ছিল যে, এর পিছনে তেমন কোনও নেতা বা ষড়যন্ত্রকারীর হাত রয়েছে।  নীল কমিশনের কর্ম-প্রক্রিয়াতেও এমন কথা উঠে এসেছে। কৃষ্ণনগরের ম্যাজিস্ট্রেট হার্সেলকে কমিশন প্রশ্ন করেছিলেন যে, এমন কোন মোড়লকে তিনি জানেন কিনা, যে গ্রামের রায়তদের উত্তেজিত করে এবং অন্য গ্রামের মানুষদের একতাবদ্ধ করে। উত্তরে হার্সেল জানান যে, এরকম শতখানেক লোকের নাম তাঁর জানা আছে। এক গ্রামেই বহু নেতা আছে, যাদের পাশের গ্রামেও অসীম প্রভাব।  ষড়যন্ত্রকারী বা তার প্রতিনিধি প্রসঙ্গে হার্সেলের উত্তর ছিল এই যে, নীলকরদের দ্বারা নির্যাতিত ও বঞ্চিত জমিদার এবং তাদের কর্মচারী ব্যতিরেকে অন্য কোনও চক্রান্তকারীর কথা তিনি জানেন না। এ রকম পরিস্থিতিতে কমিশনকে স্বীকার করতে হয় যে, নীলচাষের ত্রুটিপূর্ণ অবস্থাই বিদ্রোহের জন্য দায়ী; কৃষকেরা তাদের দুরবস্থার প্রতিকারের জন্য নিজেরাই নিজেদের সংগঠিত করেছিল এবং এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে গিয়ে পরস্পরকে সাহায্য করেছিল।১২ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে :

In fact there is no real evidence to show that the ryots were acting at the bidding of stronger and more influential parties, or that they have combined together in villages, as they certainly did combine, under the guidance of any but the head ryots of each place, or with any ulterior political object than that of vindicating their own rights.  It is quite true however, that men of one village went to another village, keeping up the general excitement.১৩

নীল বিদ্রোহের অন্যতম ‘বৌদ্ধিক কারিগর’ হিসেবে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং তার ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’-এর কথা আমরা অনেক বলেছি।  হরিশচন্দ্র এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে নিজেই লিখেছেন: “বাংলা তার কৃষকদের জন্য গর্ব করতে পারে। নীল-আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার পর বাংলার রায়ত এমন নৈতিক শক্তির পরিচয় দিয়েছিল, যা অন্য কোন দেশে সম্ভব হয়নি।  দরিদ্র, রাজনৈতিক জ্ঞান ও ক্ষমতাবিহীন এবং নেতৃত্ব ছাড়াই এসব কৃষক একটা বিপ্লব ঘটিয়েছে যার গুরুত্ব ও মহত্ব কোনও দেশের সামাজিক ইতিহাসের বিপ্লব থেকে কোনও অংশে কম নয়।’’১৪ ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’-এ প্রকাশিত শিশিরকুমার ঘোষের পত্র-সমূহেও নীলচাষীদের এই মরণপণ সংগ্রামের প্রত্যক্ষ বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানেও কার্যত কৃষক সাধারণের নেতৃত্বকারী ভূমিকার পরিচয় লক্ষণীয়।১৫

চার

নীল বিদ্রোহে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা অনুধাবনে অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে উনিশ শতকের বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও বৃত্তিজীবীদের কথা— বিশেষত তাদের দোদুল্যমান অবস্থানের কথা।  ধর্ম ও সমাজসংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই তাদের সে-সময়কালের অবস্থান পরিস্ফূট হয়।  এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নব্যশিক্ষিত বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই সে-সময়ে একদিকে যেমন ব্রিটিশ শাসনের ‘ইতিবাচক’ দিকগুলি সম্পর্কে উছ্বসিত; অন্যদিকে তেমনই ‘নেতিবাচক’ দিকগুলি সম্পর্কে বিভিন্ন মাত্রায় বিব্রতও বটে। সুনির্দিষ্টভাবে নীলবিদ্রোহের কথায় এসে বলি যে, রাজা রামমোহন রায় বা দ্বারকানাথ ঠাকুরের মতো বিশিষ্টজনেরাও ইংরেজ শাসনের সামগ্রিক প্রেক্ষিতে প্রকারান্তরে নীলকরদের প্রশংসাই করতেন।  উল্লেখ্য যে, দ্বারকানাথের তো বিভিন্ন জেলাতে নীলকুঠিও ছিল এবং তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি নীলকর প্রীতির পরিচয় রেখেছেন।  অবশ্য রামমোহন-দ্বারকানাথের মতো দু-চারজনকে বাদ দিলে এ-সময়ের বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই নিজেদের নানাধরনের দোলাচলতা সত্ত্বেও নীলকরদের বিরুদ্ধে কমবেশি সরব হন।  এ দের মধ্যে শিশিরকুমার ঘোষ, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং দীনবন্ধু মিত্রের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এঁদের পাশাপাশি অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, প্যারীচাঁদ মিত্র, গিরিশচন্দ্র বসু, রামগোপাল ঘোষ, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, কিশোরীচাঁদ মিত্র এবং মীর মশারফ হোসেন প্রমূখ বিশিষ্টজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।১৬

একইভাবে এসে পড়ে উনিশ শতকের বাংলার সাময়িক পত্রের প্রতিবাদী ভূমিকার কথা।  শিশিরকুমার ঘোষ-এর ভূমিকা প্রসঙ্গে ইতিমধ্যেই হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’-এর কথা আমরা উল্লেখ করেছি, যেখানে প্রায় ধারাবাহিকভাবেই নীলকরদের অত্যাচারী ভূমিকা বিবৃত হয়েছে।  ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর মুখপত্র ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকায় রামগোপাল ঘোষের লেখাপত্র এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপিত করা চলে। অক্ষয়কুমার দত্তের ‘তত্ত্ববোধিনী’-তেও নীলকরদের অত্যাচারের কথা সবিস্তারে প্রকাশিত হয়। ‘সংবাদ-প্রভাকর’ সম্পাদক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রথম থেকেই নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ঈশ্বর গুপ্তের পরেও ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর নীলকর বিরোধী চরিত্রটি অক্ষুন্ন ছিল বলেই জানা যায়। ‘সংবাদ ভাস্কর’ পত্রিকার সম্পাদক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যের নীলকর বিরোধী ভূমিকা সুপ্রকাশিত। দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ-এর ‘সোমপ্রকাশ’ও নীলকরদের অত্যাচারের কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে থাকে। তৎকালীন সময়ের পত্র-পত্রিকার এ-ধরনের নীলকর-বিরোধী অবস্থানের প্রেক্ষিতে বলা চলে যে, ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে যে-কোনও বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থানে সাড়া দিতে বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের যে জড়তা প্রথমাবধি লক্ষনীয় ছিল, নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে তা যেন বেশ কিছুটা কেটে যেতে শুরু করে।  উল্লেখ্য যে, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকে বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা মুক্তকণ্ঠে স্বাগত জানাননি বা তেমনভাবে সমর্থন জোগাননি। সেসময়ের সাময়িক পত্র-পত্রিকাগুলিও বিদ্রোহীদের পক্ষে তেমনভাবে কলম ধরেননি। কিন্তু নীলবিদ্রোহের প্রেক্ষিতে বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা যেন তাঁদের দ্বিধা সংকোচ থেকে বেশ কিছুটা বেরিয়ে এসে নীলকরদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠতে থাকেন। তদানীন্তন সময়ের সাময়িক পত্রের ইতিহাস এ’কথাই বোধ করি প্রমাণ করে।১৭

অবশ্য এ ক্ষেত্রে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কথা অথবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট অবস্থানের কথাও উপেক্ষা করা সঙ্গত হবে না।  এ কথা সুবিদিত যে, এক অর্থে নীলচাষ কোনও সরকারী উদ্যোগ ছিল না; এর সঙ্গে সেদিক থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীরও প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল না।  ইংরেজ নীলকর সাহেবদের সঙ্গে ব্রিটিশ প্রশাসনের উচ্চস্তরে ‘গোপন সম্পর্ক’ বা ‘পরোক্ষ যোগাযোগ’ ছিল গুরুত্বপূর্ণ।  দেশীয় জমিদারদের একটা বড় অংশ এই প্রক্রিয়ার বাইরে ছিল না।  নীলচাষে তারাও খুব একটা পিছিয়ে ছিল না। তারা এই নীলগাছ নীলকর সাহেবদের সরবরাহ করতো।তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই, নীল-বিদ্রোহে দেশীয় জমিদারদের ভূমিকা যে যথেষ্ট বিতর্কিত সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।  নীল প্রশ্নে ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’-এর ভূমিকা যে এ ক্ষেত্রে সবিশেষ প্রাসঙ্গিক সেকথা আগেই বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলি যে, নীলচাষকে বাঙালী বুদ্ধিজীবীরা কী চোখে দেখতেন তার পরিচয় পাওয়া যাবে প্রসন্নকুমার ঠাকুরের বক্তব্যে। নীল কমিশনে সাক্ষ্যদান করতে গিয়ে তিনি বলেন যে,“নীলচাষের পদ্ধতি নিপীড়নমূলক। নীলচাষীকে দাদন নিতে বাধ্য করা হয়। একবার কুঠি-র অর্থ স্পর্শ করলে তার জের চলে পুরুষানুক্রমে…।” প্রসন্নকুমার একসময়ে নীলচাষ করতেন। নীলকর প্রীতিও তার যথেষ্ট ছিল।  কিন্তু দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝেছিলেন যে, নীলচাষ কৃষকের স্বার্থ-বিরোধী এবং নানা অত্যাচারের উৎস।  তাই তিনি ১৮৫৬-৫৭ সাল নাগাদ নীলচাষ ত্যাগ করেন।১৮ বস্তুতপক্ষে, নীলবিদ্রোহে বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির অবস্থান এ রকম একটি প্রেক্ষিতেই অনুসন্ধান করতে হয়।  প্রাসঙ্গিকভাবে এসে পড়ে নীল কমিশনে রিপোর্ট প্রকাশের পরে ১৮৬১-এর সেপ্টেম্বরে রাধাকান্ত দেব প্রদত্ত এবং বহুজনের স্বাক্ষরিত অভিনন্দনপত্রের কথা।  সেখানে লেখা হয়েছিল—

Your Honor has been the first Governor during the last fifty years who had the moral courage to face boldly the evils of this iniquitous system, to assert in respect to it the supremacy of the Law, and to vindicate the rights… of innocent Ryot, who (were) toiling under its galling thraldom, had hitherto vainly pined for Justice.১৯

সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নীলবিদ্রোহের প্রভাব সম্পর্কিত আলোচনাও এ ক্ষেত্রে কমবেশি প্রাসঙ্গিক এ কারণেই যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসবের স্রষ্টাও যেমন মধ্যবিত্ত, তেমনি এগুলির আবেদনও বেশিরভাগ সমাজের মধ্যবিত্ত অংশের মধ্যেই পরিব্যাপ্ত। মধ্যবিত্তের ক্রিয়াকাণ্ডের নগর-কেন্দ্রিকতা মনে রেখেও বলতে হয় যে, এ-ক্ষেত্রে বিশেষত গান-কবিতা-নাটক ইত্যাদির আবেদন সবসময়ই শহরে সীমাবদ্ধ থাকেনি— গ্রামাঞ্চলেও তার ঢেউ সীমাবদ্ধ আকারে হলেও পৌঁছে গেছে। উদাহরণ হিসেবে ঈশ্বর গুপ্তের রচিত গানগুলির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে২০। ঈশ্বর গুপ্তের গানের আবেদন নিয়ে অবশ্য প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে।  স্বপন বসু লিখেছেন: “ঈশ্বর গুপ্তের বর্ণনায় ব্যাপারটা এত তরল হয়ে উঠেছে যে, অত্যাচারের জ্বালা গানগুলির মধ্যে অনুভব করা মুশকিল।” সে-দিক থেকে বিচার করলে কবিয়াল-দের কন্ঠে গীত গানগুলি অনেক বেশি মর্মস্পর্শী এবং উদ্দীপক। আবার, শুধু গানই নয়, নীলকরদের অত্যাচারের বিবরণ সম্বলিত পুস্তিকাগুলিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত এসেই পড়ে প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ শীর্ষক রচনার কথা, যেখানে নীলকরদের জুলুমের কথা— বিশেষত দাদন-প্রথার কুফলের কথা বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে।২১

বলা বাহুল্য যে, নীল বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে সৃষ্ট সাহিত্যকর্মের বিচারে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের কথাই সর্বাধিক আলোচিত। নীলকরদের অত্যাচারের মর্মান্তিক বিবরণই নাটকটির মূল উপজীব্য। এই নাটকের বাস্তবভিত্তি নিয়েও বেশ কিছু আলোচনা হয়েছে। অনুমিত হয় যে, নাটকের চরিত্রগুলি যেন ‘জীবন থেকে নেওয়া’। নাটকটি প্রকাশের পরই জেমস লঙ্-এর তত্ত্বাবধানে বইটি ইংরেজিতে অনূদিত হয় এবং কেবল বাংলা তথা ভারতেই নয় বিলেতেও প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ‘নীলদর্পণ’ ইংরেজিতে অনুবাদের পশ্চাতে ক্রিয়াশীল বিষয়সমূহের গভীরে না গিয়েও বলি যে, এর ফলে নীলকরদের অত্যাচারের বৃত্তান্ত এমনভাবে প্রচারিত হলো, যা সামগ্রিকভাবেই নীলবিদ্রোহের ইতিহাসে স্থায়ী প্রভাব সৃষ্টিতেও সমর্থ হল। অবশ্য এই নাটকের মূল্যায়নে অন্যকথাও এসেছে যা এই প্রসঙ্গে সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। অতীশ দাশগুপ্ত লিখেছেন:

দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ কোন কৃষক বিদ্রোহের নাটক নয়। এতে দুই একটি কৃষককে (তোরাপ চরিত্র) ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহী রূপে অঙ্কিত করা হলেও যে বিরাট নীলবিদ্রোহের ঝড় বাংলার বিভিন্ন জেলার উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল তার চিত্র এই নাটকে স্থান পায় নি। তথাপি বাংলার অবহেলিত কৃষক সমাজকে নিয়ে একটি সাহিত্য গ্রন্থ, বিশেষত নাট্যসাহিত্য গ্রন্থ রচিত হ’ল এটি এক যুগান্তকারী ঘটনা।২২

প্রসঙ্গত এসেই পড়ে মীর মশার্‌রফ হোসেনের এ-বিষয়ে প্রতিক্রিয়ার কথা। দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘নীলদর্পণ’-এ যে-ভাবে ইংরেজদের চরিত্র চিত্রণ করেছেন, মীর মশার্‌রফ-এর তা ভালো লাগেনি। ‘আমার জীবনী’-তে সে কথা বেশ স্পষ্টভাবেই তিনি উল্লেখ করেছেন। অবশ্য নীলকরদের অত্যাচার বিষয়ে তিনি কতখানি সচেতন ছিলেন তার পরিচয় আমরা পাই তার লেখা ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’-য় (১৮৯০)। নীলকরদের দৌরাত্মের কথা উভয়ের রচনায় কমবেশি প্রতিফলিত হলেও তাঁদের মধ্যেকার পার্থক্যগুলি লক্ষণীয়।  দীনবন্ধু যে-ভাবে নীলকরদের সম্পর্কে পাঠকদের মনে অবিমিশ্র ঘৃণা সঞ্চারে প্রবৃত্ত হয়েছেন, মীর কিন্তু ততখানি নীলকর-বিদ্বেষী ছিলেন না। মীর সাহেবের মনে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বোধ করি প্রকটভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। তার ‘জমিদার দর্পণ’-এও তার কমবেশি প্রতিফলন লক্ষ্য করা যেতে পারে।  এ-বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অবস্থানের কথা বিভিন্ন সময়ে উল্লিখিত হয়ে থাকে। এখানে কেবলমাত্র এটুকুই বলার যে, নীল-বিদ্রোহের ইতিহাস লেখার বাসনা মীর সাহেবের ছিল; তিনি এ-বিষয়ে প্রয়োজনীয় নোটও নিয়েছিলেন।  কিন্তু সে সুযোগ তার হয়নি।জলধর সেনকে তিনি এ-বিষয়ে কলম ধরতে অনুরোধ করেছিলেন। এ-সব নিয়ে আরও অনেক গবেষণার অবকাশ রয়েছে।২৩

এই প্রসঙ্গে অবধারিতভাবেই এসে পড়ে গিরিশ দারোগা ও তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘সেকালের দারোগার কাহিনী’-র কথা, যা প্রথমে অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত ‘নবজীবন’ মাসিক পত্রে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় (১২৯৩-৯৪) এবং পরবর্তী সময়ে (১২৯৫) ঢাকা থেকে গ্রন্থাকারে আত্মপ্রকাশ করে। কলকাতার হিন্দু কলেজের কৃতী ছাত্র গিরিশচন্দ্র বসু ১৮৫৩-তে পুলিশে যোগ দেন নবদ্বীপের দারোগা হিসেবে এবং আপন কর্মতৎপরতায় জেলার ‘সেরা দারোগা’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত তার এই গ্রন্থ নীল বিদ্রোহের ও এক অমূল্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।  তাঁর এই গ্রন্থকে অনেকেই নীল বিদ্রোহের ‘নিরপেক্ষ ইতিহাস’ বলে মনে করেন। এই দাবির সারবত্তা নিয়ে গভীর আলোচনায় না গিয়েও বলি যে, গিরিশচন্দ্র তার লেখায় একদিকে যেমন নীলকরদের অত্যাচারকে উন্মোচিত করে শাসকদের রোষানলে পড়ে কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে অপদস্থ হয়েছিলেন এবং পদাবনতির শাস্তি পেয়েছিলেন, অন্যদিকে তেমনই ক্ষেত্রবিশেষে নীলকরদের প্রশংসায়ও পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। “নীলকরদের দোষও ছিল, গুণও ছিল, দেশের তারা অনেক উপকার করেছিলেন।  অনেক নীলকর যেমন নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর ছিলেন, তেমনই অনেককে খুব দয়াশীল এবং ধর্মভীরু ছিলেন।”— গিরিশচন্দ্রের এরূপ অবস্থান যে নিছক ‘স্মৃতিবিভ্রম’ নয়, বরং মধ্যবিত্তসুলভ দোদুল্যমানতা তা বলাই বাহুল্য।২৪

পাঁচ

নীলবিদ্রোহে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা শীর্ষক এই আলোচনায় তৎকালীন বাংলা তথা ভারতের সামগ্রিক সমাজচিত্রের পটভূমিতে নীলচাষীদের আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানের স্বরূপ উদঘাটনের প্রয়াস গৃহীত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এই আন্দোলনের ক্রমবিকাশের তিনটি সুস্পষ্ট স্তর ছিল। প্রথম পর্যায়টি ছিল গণ-দরখাস্ত বা আবেদন নিবেদনের স্তর; দ্বিতীয়টি ধর্মঘট এবং অর্থনৈতিক অসহযোগিতার পর্যায়; এবং তৃতীয়টি ছিল কৃষক বিদ্রোহ বা প্রতিরোধের পর্যায়।২৫ বর্তমান আলোচনায় এই স্তরগুলির বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও বিদ্রোহের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা প্রদানের ভিত্তিতে আলোচ্য বিষয়ের মূল ভরকেন্দ্রে প্রবৃত্ত হওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষণীয় হয়েছে। এমনতরো আলোচনায় একথা বেশ স্পষ্ট হয়েছে যে, নীলকরদের অত্যাচারের প্রতিবাদে কৃষক সাধারণ ক্রমশই আন্দোলনমুখী হয়ে পড়েছে এবং নীলচাষকে কেন্দ্র করে একটি বিদ্রোহ যেন সমাসন্ন হয়েছে। বস্তুতপক্ষে আইনগত দিক থেকে নীলচাষ যে কৃষকদের পক্ষে বাধ্যবাধকতা নয়, নিতান্তই স্বেচ্ছাধীন— এই বার্তা রটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষক সাধারণের নীলচাষে অনীহা প্রকটিত হয়ে ওঠে এবং সেক্ষেত্রে জবরদস্তির যে কোনও প্রয়াস প্রত্যক্ষ প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। এ-রকম একটা বাস্তবতার স্বীকৃতি ক্রমশ সর্বস্তরেই স্পষ্ট হতে থাকে। ‘ক্যালকাটা রিভিউ’-এর মতো পত্রিকা এ-বিষয়ে গ্রামবাসীদের মনে আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকা তো খোলাখুলিই জানিয়েছে যে, বাংলায় কৃষক বিদ্রোহের সূচনা ঘটেছে। ‘ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়া’ এ-বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক বার্তা শুনিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ১৮৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে নীলবিদ্রোহ কার্যত একটি সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছে।২৬

বাংলায় নীলবিদ্রোহের প্রেক্ষিতে কৃষক সমাজের এমনতরো ক্রমবিকশিত চেতনা একদিকে যেমন ব্রিটিশ ভারতে বিশেষত বাংলায় আরোপিত ভূমিব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি ফল, তেমনই আবার নীলকর সাহেবদের ক্রমবর্ধমান অত্যাচারের আশু পরিণতি বলেই মনে হয়। বস্তুতপক্ষে ঔপনিবেশিক শাসনে বাংলার কৃষিক্ষেত্রে বড় ধরনের রদবদল— চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং তৎপরবর্তী নানা ধরনের ব্যবস্থাপনা— নব্য জমিদারশ্রেণিসহ বিভিন্ন প্রকারের মধ্যসত্বভোগী শ্রেণি সমূহের উদ্ভব— সে-সবের বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই— তবে সেসবের প্রভাবের কথা এক্ষেত্রে মনে রাখতেই হয়।  বলাবাহুল্য যে, কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে কৃষি ও কৃষকের জীবনের সংযুক্তিকরণ এবং তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল সম্পর্কিত আলোচনা ব্যতিরেকে এ দেশে নীলচাষের সূচনা, ব্যাপ্তি ও ফলাফল এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণিসমূহের অবস্থান পর্যালোচনা একান্তভাবেই অসম্ভব।  সুনির্দিষ্টভাবে, নীল বিদ্রোহে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকা নির্ণয় সম্পর্কিত এই আলোচনাতেও তাই অনিবার্যভাবেই এসে পড়েছে বাংলার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির পটভূমিতে দেশীয় জমিদার এবং মধ্যসত্বভোগী বিভিন্ন শ্রেণিসমূহের অবস্থানের কথা— যার থেকে শিক্ষিত ও পেশাজীবী মানুষদের ভূমিকার পৃথকীকরণ কার্যত অসম্ভব। দেশীয় জমিদারদের একটা বড় অংশ যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নীল চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল— এ-কথাও এই প্রসঙ্গে বিবেচনায় রাখাটা বিশেষ প্রয়োজনীয়।  নীল বিদ্রোহে তাদের ‘ইতিবাচক’ ভূমিকার কথা যতই সবিস্তারে বলা হোক না কেন, এ-কথাও বোধ করি জোরের সঙ্গেই বলতে হয় যে, এক্ষেত্রে অতি সরলীকরনের কোন অবকাশ নেই।

প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এসে পড়ে ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে গড়ে ওঠা শিক্ষা-কাঠামোর কথা এবং বিশেষত পাশ্চাত্য শিক্ষার আয়োজনে বাংলা তথা ভারতের সমাজ-সংস্কৃতির রূপান্তরের কথা।  ইউরোপীয় নবজাগরণ ও তার প্রভাবে নবচেতনার উন্মেষের কথা এবং ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন প্রবাহের কথাও এক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। উল্লেখ্য যে, এই সময়কালেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, তারও বেশ কিছুটা আগেই হুগলী মহসিন কলেজ (১৮৩৬), কৃষ্ণনগর কলেজ (১৮৪৬) এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ (১৮৫৩)-এর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিও গড়ে উঠেছে। বাংলায় নব্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশের এমনতরো পরিমণ্ডলটি এক্ষেত্রে মনে রাখতেই হয়। কথা উঠতেই পারে যে, নীলবিদ্রোহ বা অনুরূপ কৃষক-সংগ্রামের আলোচনায় এসবের প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? এরকম বেয়াড়া প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের অবগাহন করতে হয় সমাজ-সংস্কৃতির বিকাশের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় যেখানে ঘোষিত উদ্দেশ্য ও ফলাফলের তারতম্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। বস্তুতপক্ষে, এদেশে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য যাই হয়ে থাকুক না কেন, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশমান চেতনা এবং সমাজ-সংস্কৃতিতে তার ইতিবাচক প্রভাবগুলিকে অস্বীকার করা অসম্ভব। সে-সব আলোচনায় না গিয়েও বলি যে, ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই যেমন আমরা স্বাধীনতার দাবির স্ফুরণ লক্ষ্য করেছি, তেমনভাবেই মানুষের অধিকার চেতনা এই প্রক্রিয়াতেই কমবেশি বিকশিত হয়েছে সে-কথাও একেবারে অস্বীকার করা চলে না। তবে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের ফলে এ দেশে মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে যে জাগরণ ঘটেছে তার ঢেউ কতখানি বঞ্চিত কৃষকদের উজ্জীবিত করেছে তা নিশ্চয়ই আমাদের পৃথকভাবে বিচার্য হওয়া উচিত। নীলবিদ্রোহের প্রেক্ষিতে পত্র-পত্রিকার ভূমিকা এবং বিবিধ সাংস্কৃতিক উপাচারের প্রভাব নিয়ে আমাদের আলোচনা এ ক্ষেত্রে তাই নিশ্চিতভাবেই দিক নির্দেশক। 

এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির দ্বান্দ্বিকতা অনুসরণ করাটা বোধ করি অত্যন্ত জরুরী। কার্যত ঔপনিবেশিক শাসনের বহুমাত্রিকতার মধ্যেই তার শিকড় নিহিত রয়েছে। একথাটা মনে রাখা দরকার যে, শ্রেণি হিসেবে মধ্যবিত্ত ঔপনিবেশিক শাসনেরই সৃষ্টি। মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ঔপনিবেশিক শাসনের  সর্বাধিক সুবিধা লাভে সমর্থ হয়েছে।  সে-কারণে, ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত কৃষক আন্দোলনে তাদের নেতিবাচক অবস্থান থাকাটা স্বাভাবিক ছিল।  আবার, শ্রেণি হিসেবে তাদের আর্থিক  ও সামাজিক নির্ভরতার ক্ষেত্রটিও ছিল কৃষক-শোষণ।  বস্তুতপক্ষে, কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পর্কহীন— অথচ কৃষিই তাদের আর্থিক সমৃদ্ধির উৎস।  ঔপনিবেশিক শাসনেরও ভিত্তিও ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তাই কৃষক-বিদ্রোহে তাদের অগ্রনী ভূমিকা না থাকার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এতদসত্ত্বেও আধুনিক শিক্ষা ও চেতনা এবং এক ধরণের নৈতিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ এই শ্রেণির মধ্যেকার স্বাধীনতার ও অধিকারবোধের দিকটিকেও অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। এরকম এক দ্বিধাদ্বন্দ্ব তাই এই শ্রেণির মধ্যে থাকাটা অবশ্যাম্ভাবী।

অন্যদিকে, কৃষকের কথায় এসে বলি যে, আর্থ-সামাজিক অবস্থানগত কারণেই বাংলার কৃষকের উদাসীনতা, নিঃসঙ্গতা এবং ভবিতব্য বা ভাগ্য-নির্ভরতা প্রায় মজ্জাগত বলা চলে।  কোনও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় যে মতাদর্শগত অনুশীলনের প্রয়োজন হয়, শিক্ষার অভাব এবং সামাজিক পশ্চাৎপদতার কারণে তা তাদের উপলব্ধ নয়।  এছাড়াও কৃষকের শ্রেণি-ভিত্তি নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও সমস্যা রয়েছে একারণেই যে, তাদের মধ্যে রয়েছে অনেক স্তর— এবং শোষক ও শোষিত অংশের সহাবস্থানে তারা কার্যত একটি বর্গ (Category)  মাত্র।  এমতাবস্থায়, তাদের প্রয়োজন বাইরের থেকে সহায়তা ও প্রেরণার।  সে-কাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণিই অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে পারে।  অথচ এই শ্রেণি তো কার্যত ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা অনুগৃহীত এবং সে-কারণে তাদেরই পরিচর্যাকারী।  বাংলার তৎকালীন প্রেক্ষিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাই সামগ্রিক বিচারে নীল বিদ্রোহে সহযোগী হতে পারেনি। এখানে অবশ্য প্রাসঙ্গিকভাবেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির রূপান্তরের কথাও এসে পড়ে এবং এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় দোলাচলতা সত্ত্বেও তাদের কমবেশি ‘প্রগতিশীল’ ভূমিকার স্ফূরণ লক্ষনীয় হয়। তাই, নীল আন্দোলনে ব্যক্তিগত নৈতিক অবস্থান মধ্যবিত্তের অংশবিশেষের ‘ইতিবাচক’ ভূমিকার কথা এসেই পড়ে।

পরিশেষে বলি যে, নীলবিদ্রোহ তো বটেই, উনিশ শতকের বাংলার কৃষক বিদ্রোহ সমূহের গতিপ্রকৃতি অনুসরণ করলে এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সেগুলি কার্যত ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধেই পরিচালিত। এখানে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কথাটিকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় এই অর্থে যে, এই বৃত্তে একদিকে যেমন তাবৎ সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ অন্তর্ভুক্ত, তেমনই তাদের অনুগৃহীত বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি বা বর্গও কম-বেশি তার অন্তর্গত। সেই অর্থে ব্রিটিশ সরকার, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী, প্রশাসনিক কাঠামো, আইন-আদালত ইত্যাদি তো বটেই এমনকি দেশীয় জমিদার, ইজারাদার ইত্যাদিও তার উপরই নির্ভরশীল। নীল বিদ্রোহের বিশিষ্টতা প্রসঙ্গে বলি যে, নীলকর সাহেবরাই এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে ‘অত্যাচারী’-র ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও সামগ্রিক বিচারে রাষ্ট্রব্যবস্থাই তার পৃষ্ঠপোষক। মনে রাখা দরকার যে, এদেশে জমিদারদের একটা বড় অংশও নীলের কারবারে যুক্ত ছিলেন। এমনকি শ্রেণিগত বিচারে মধ্যবিত্ত প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এ-কথাটা বলে নেওয়া ভালো যে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় কৃষি উৎপাদনের ভাগাভাগিও একদিকে শাসককূল ও তাদের অনুগৃহীত বিভিন্ন অংশ এবং অন্যদিকে কৃষক সমাজ।  কৃষকের উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ প্রক্রিয়ায় তার স্থানীয় প্রতিভূ হন জমিদার শ্রেণি।  মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশ কিন্তু এক জটিল প্রক্রিয়ায়— যা কার্যত ব্রিটিশ শাসক এবং জমিদার শ্রেণির প্রয়োজনেই সৃষ্ট। এদের শ্রেণিগত অবস্থানেই দোদুল্যমানতা অবশ্যাম্ভাবী এবং সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের হিসেব-নিকেশ বেশ স্পষ্ট।  তাই, শ্রেণি হিসেবে কৃষকবিদ্রোহে তাদের নেতৃত্বকারী ভূমিকার প্রশ্ন ওঠে না। তবে, ঐতিহাসিক বিচারে শিক্ষা ও নৈতিকতার প্রভাবে তাদের মধ্যেকার কমবেশি ‘প্রগতিশীল’ চেতনার অস্তিত্বের কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হয়।  সেই প্রেরণা যে নীল বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও কমবেশি পরিস্ফুট উপরের আলোচনাতেই তা প্রতীয়মান। এক্ষেত্রে একদিকে যেমন জমিদারদের যে অংশটি ঘটনাচক্রে কৃষকদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন এবং কম-বেশি ‘ইতিবাচক’ অবস্থান গ্রহণ করেছেন, বিভিন্ন ধরনের স্থানিক মাত্রায় তা বিচার-সাপেক্ষ হলেও তার গুরুত্ব অপরিসীম।  অন্যদিকে, বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি বা বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশের অগ্রবর্তী অবস্থানের কথাও শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্বীকার করতে হয়, উল্লেখ করতে হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির সেই অগ্রণী অংশের কথা যাঁরা ব্যক্তিগত নৈতিক অবস্থান থেকে কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রাণপাত পরিশ্রম করেছেন।  একই সঙ্গে অবশ্য মনে রাখতে হয় শ্রেণি হিসেবে তাঁদের সামগ্রিক অবস্থানের কথা, হিসেব-নিকাশের কথা এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা।  সব মিলিয়ে বলতে হয় যে, শ্রেণি হিসেবে নীলবিদ্রোহে মধ্যবিত্তের ভূমিকা দ্বান্দ্বিকতায় পরিপূর্ণ এবং সে-কারণেই বিতর্কিতও বটে।

সূত্রনির্দেশ :

১. ঔপনিবেশিক শাসনকালে বাংলার কৃষি ব্যবস্থার রূপান্তর এবং কৃষক সাধারণের জীবনে তার প্রভাব নিয়ে অসংখ্য লেখাপত্র রয়েছে। বর্তমান আলোচনার প্রেক্ষিতে দ্রষ্টব্য : সুপ্রকাশ রায়, ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’, ১৯৬৬, কলকাতা; বদরুদ্দিন উমর, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক’, Narahari Kaviraj, ‘Peasant uprising in Bengal’, People’s Publishing House, Kolkata, 1972; মুনতাসির মামুন (সম্পাদিত) ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাঙলী সমাজ’, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা,  ২০০২

২. বাংলার কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস এবং তার সামগ্রিক প্রভাব সম্পর্কিত আলোচনার জন্য দেখুন :  স্বপন বসু, ‘গণ অসন্তোষ ও  উনিশ  শতকের বাঙালী সমাজ’, পুস্তক বিপনী, কলকাতা, ১৯৮৪/১৯৮৭;  রনজিৎ কুমার সমাদ্দার, ‘বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে  স্থানীয়  বিদ্রোহের প্রভাব’, বনমালী বিশ্বনাথ প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৮২ ; আবদুল বাছির, ‘বাংলার কৃষক বিদ্রোহ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি’, বাংলা  একাডেমি, ঢাকা, ২০১২

৩. আবদুল বাছির, পূর্বোক্ত, পৃ.-৮ ; আরও দেখুন B.B. Misra, ‘The India Middle Class: Their Growth in Modern Time’,  Oxford University Press, London, 1961

৪.  বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, Ramesh Chunder Dutt, ‘Peasantry of Bengal’, The University of Michigan, Calcutta and London, 1875 (Reprinted by Manisha, Kolkata, 1980, with an  introduction by Narahari  Kaviraj); সুপ্রকাশ রায়, প্রাগুক্ত, Narahari Kaviraj op. cit; Ranajit Guha, ‘The Elementary Aspects of Peasant  Insurgency in Colonial India’, Oxford University Press, 1983; Theodor Shamim (Ed.) ‘Peasant and Peasant Societies : Selected Readings’, Penguin Books, London, 1976 

৫. স্বপন বসু, প্রাগুক্ত, পৃ. – ৬৮-৭৩

৬. উদ্ধৃত : পূর্বোক্ত, পৃ.-৭৩ (নীল কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের জন্য দেখুন : ‘Report of the Indigo Commission, 1860’, (Edited and Compiled by Dr. Pulin Das, University of North Bengal, 1992)

৭. অতীশ দাশগুপ্ত, ‘নীল বিদ্রোহ’, কমল চৌধুরী, ‘নীল বিদ্রোহ ও সমকালীন বঙ্গসমাজ’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১০, পৃ. –  ৪৩৪

৮. অনাথনাথ বসু, ‘নীলবিদ্রোহ ও শিশিরকুমার ঘোষ’, কমল চৌধুরী (সংগৃহীত ও সম্পাদিত) প্রাগুক্ত, পৃ. – ৩০০-৩০১

৯. পূর্বোক্ত, পৃ. ৩০২-৩০৩

১০. স্বপন বসু, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১-৭২ এবং ১৩৫ (আরো দেখুন : কমল চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০০-৩০৫)

১১. অতীশ দাশগুপ্ত, ‘নীলবিদ্রোহ’, কমল চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩৩

১২. কমল চৌধুরী’র পূর্বোক্ত গ্রন্থের ভূমিকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৩২-৩৩

১৩. ‘Report of the Indigo Commission, 1860’ (Pulin Das ed.), University of North Bengal, Darjeeling, 1992, p – 67

১৪. ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ১৯মে, ১৮৬০ (আরও দেখুন, প্রমোদ সেনগুপ্ত, ‘নীলবিদ্রোহ’, পৃষ্ঠা – ৯৬-৯৭)

১৫. কমল চৌধুরী’র পূর্বোক্ত গ্রন্থে যোগেশচন্দ্র বাগল সংগৃহীত MLL স্বাক্ষরিত এ’রকম বেশ কয়েকটি চিঠি সংকলিত হয়েছে। আগেই বলেছি যে, শিশিরকুমার ঘোষের অপর নাম ছিল মন্মথলাল ঘোষ। তিনি MLG লিখে পত্রের নীচে স্বাক্ষর করতেন। মুদ্রণ প্রমাদে তা MLL ছাপা হোত।

১৬. স্বপন বসু, প্রাগুক্ত, পৃ. ১২৮ (আরও দ্রষ্টব্য : Chittabrata Palit, ‘Transitions in Bengal Rural  Society’, Kolkata, 1975,  p -114)

১৭. পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৮-৩৩ (কমল চৌধুরী সংকলিত পূর্বোল্লিখিত গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশে এ-বিষয়ে বেশ কিছু নমুনা সংকলিত হয়েছে।  আগ্রহী পাঠকেরা দেখতে পারেন।)

১৮. পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৭ (২৬.০৭.১৯৬০-এ নীল কমিশনে প্রসন্নকুমারের প্রদত্ত বয়ান দ্রষ্টব্য)

১৯. নীল কমিশনের প্রতি রাধাকান্ত দেব প্রদত্ত স্মারকলিপি, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৭-৩৮

২০. দ্রষ্টব্য : কমল চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. – ৪৪৩-৪৫ 

[পরিশিষ্ট অংশে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত রচিত বেশ কয়েকটি গান— ‘নীলকর’ শিরোনামে সংকলিত হয়েছে]

২১. স্বপন বসু, প্রাগুক্ত, পৃ.  ১৪১

২২. অতীশ দাশগুপ্ত, ‘নীলবিদ্রোহ’, কমল চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩৭

২৩. স্বপন বসু, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৬-১৫১

২৪. গিরিশচন্দ্র বসু, ‘সেকালের দারোগা কাহিনী’, কাঞ্চন বসু (সম্পাদিত) দুষ্প্রাপ্য সাহিত্য সংগ্রহ, তৃতীয় খণ্ড, রিফ্লেক্ট  পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯২/২০০৪, পৃ. -২০৯-৩৫৮; স্বপন বসু, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫০-৫৩

২৫. নীল বিদ্রোহের বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে আলোচনার জন্য দেখুন : প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্ত, ‘নীলবিদ্রোহ ও বাঙালী সমাজ’, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৪৮, পৃ. ১৪৮; আরও দেখুন, রণজিৎকুমার সমাদ্দার, ‘বাংলার গণসংগ্রামের পটভূমিকা’, বনমালী বিশ্বনাথ প্রকাশন, কলকাতা, ১৯৯১, পৃ. ১২৩

২৬. রণজিৎকুমার সমাদ্দার, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৪-২৬

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান