নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতি প্রসঙ্গে

হিরণ মিত্র

নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতি নিয়ে কিছু বলার আগে যে কথাটা স্পষ্ট করে দেওয়া জরুরি, তা হল, ‘নিম্নবর্গীয়’ এই অবস্থানের কোনো বৈজ্ঞানিক, যুক্তিসঙ্গত অস্তিত্ব নেই। ফলে নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতি প্রকৃত প্রস্তাবে তথাকথিত উচ্চবর্গীয় সংস্কৃতির তৈরি করা একটা আদ্যন্ত ভ্রান্ত ধারণা। একটা ভ্রান্ত, তৈরি করা ইতিহাসকে সামনে রেখে বলে চলা মনগড়া বৃত্তান্ত। ফলে আমাদের আলোচনায় নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতি প্রসঙ্গে আসতে পারে, উচ্চবর্গীয়রা কী কী প্রথা অবলম্বন করত, কী তাদের modus operandi ছিল, কেমন তাদের রূপ ইত্যাদি। 

একটা কুয়োর জল, একটা মায়ের পেট, একথালা ভাত, একটা বাসন, একটা উঠোন কী করে অশুদ্ধ হতে পারে? যদি না তা আরোপিত হয়! একটা মৃতদেহ কী করে অস্পৃশ্য হতে পারে? একটা আশ্চর্য নিষ্ঠুর সমাজ, কী অপরিসীম নিম্নচিন্তার সমাজ আর একজন ব্যক্তিমানুষ যে কতটা নীচু মনের হতে পারে তা একমাত্র হরিজন পরিবারে জন্মগ্রহণ করা একজন মানুষ তাঁর প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জেনে ফেলতে পারেন! ব্রাহ্মণ্য সমাজ তো তাকে বা তার কৌমভুক্তদের মানুষ বলেই ভাবে না! অথচ মুচি, মেথর, ডোম এগুলো তো মানুষের জীবিকা বা বৃত্তি, তা কী করে তার জাত, তার অভিজ্ঞান হতে পারে? যদি না কিছু স্বার্থান্বেষী নীচ কর্তৃত্বের জন্য, আত্মসুখের জন্য তাকে পায়ের তলায় রাখতে চেয়ে এমন করে বানায়। আচ্ছা, পা তো শরীরেরই অংশ, অঙ্গ প্রত্যঙ্গের আবার ছোটো বড়ো ভেদ হয় নাকি? সেই বিচারে হাত বড়ো আর পা নাকি ছোটো, কিন্তু পা তো চালিকা শক্তি, শরীরের প্রাণভোমরা। সে কী করে এত নীচু হয়? ক্ষুদ্ররাই তো নগর বানায়, মূর্তি খোদাই করে, চিত্র বানায়, সমস্ত শিল্পের মূলে তারাই, তারাই মন্দির গড়ে, কিন্তু মন্দির প্রতিষ্ঠার পর সেখানে তাদের প্রবেশাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এর থেকে বড় পাপ আর কিছু হতে পারে? দেবতা তো মানুষের বানানো একটা ভড়ংমাত্র, উচ্চবর্ণের সুবিধাজনক তত্ত্ব বা একতরফা ধারণা। যার দ্বারা বহু অপকর্ম সাধিত হয়, দেবস্পর্শে সেগুলো আর অপকর্ম থাকে না, হাস্যকরভাবে সব শুদ্ধ হয়ে যায়! আসলে ব্রাহ্মণ জাতটাই অশুদ্ধ, তারা তাদের সমস্ত অপকর্ম এই দৈবীমহিমার আড়ালে চালিয়ে গেছে, দেবতা নামক বস্তুর অধিষ্ঠান হিসেবে তাদের মন্দির বানাতে হয়েছে, নিজেদের আমোদ প্রমোদের জন্য সেই মন্দিরে দেবদাসী নামে সমাজ বহির্ভূত যৌনকর্মী রাখতে হয়েছে! সমাজের স্বার্থরক্ষা করতেই নাকি যৌনকর্মীর প্রয়োজন। অথচ যৌনতা তো জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম, অস্বাস্থ্যকর কিছু নয়। নিজেদের স্বার্থে তাকে অসুখ বলা হল, অসামাজিক বলা হল। 

নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতি এবং তার অভ্যাস একটি হাস্যকর প্রস্তাব। দেশের আপামর জনগণকে ভাঁড় ও অশিক্ষিত করে রাখা হয়েছে। অশিক্ষার কথা বলতে গেলে প্রথমে শিক্ষা কী তা জানা জরুরি। শিক্ষার প্রথম শর্তই হচ্ছে প্রশ্ন করতে শেখা, প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। হয়তো তার উত্তর কেউই এখনো জানে না। সেই শিক্ষার সংরক্ষণ নিয়েও আলোচনা করা দরকার। ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা’ চলচ্চিত্রে বাগদির ছেলে ব্রাহ্মণের পিঠে চড়ে যায় নতুন বাড়ির খোঁজে, সেই ব্রাহ্মণের নাম ঈশ্বর। সমাজজীবনের বাস্তবতায় দেখি যারা সৃষ্টি করে, তারা সকলেই ক্ষুদ্র, নীচুজাত। ব্রাহ্মণেরা শুধু মন্ত্র পড়ে সমাজের সবচেয়ে উঁচু আসনটিতে বসে, কারণ তারা নিজেদের আসন নির্বাচনের সুযোগ পায়। দেবদেবীর পুজোয় শরকাঠি দিয়ে সীমানা নির্দেশ করা হয়, সেখানে পুরোহিত ছাড়া অন্য কারোর স্পর্শ নিষিদ্ধ। স্বর্গ পাতাল, দেবতা রাক্ষস সবই মানুষের কল্পনা। অথচ পাহাড়ের তলদেশ না হলে যেমন পাহাড়ের অস্তিত্ব থাকে না, সেটাই তার ভিত্তি। ভূকম্পে চূড়ার ক্ষতি বেশি হয়, তেমনি নিম্নবর্গের সচেতনতায়, তাদের ক্রোধে বিক্ষোভে ব্রাহ্মণের আসন টলে যায়। তাই তাদের অশিক্ষিত নির্বোধ করে রেখে দেওয়ার নানারকম প্রয়াস ক্ষমতাবানেরা করে এসেছে। নারী পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে দেখলে চেনা যায় কিন্তু জাত চেনা যায় না। কারণ মানুষের গায়ে তার জাত লেখা থাকে না। তাই পদবি দিয়ে তাকে ও তার পরিবারকে চিহ্নিতকরণ করা হয়। সমাজে সাম্যপ্রতিষ্ঠায় জাতিভেদ প্রথার অবলুপ্তি ঘটানো প্রয়োজন। এমনকি বামপন্থী দলগুলোতেও ব্রাহ্মণ কায়স্থরাই নেতৃত্ব দখল করে রেখেছে। ‘পৈতে দিয়ে বামুন চিনি, বামনি চিনি কেমনে?’ আসলে নারীমাত্রই নীচুজাত। তার সমস্ত শরীরটাই অপবিত্র। আশ্চর্য এরপরও নিম্নবর্গীয় চিত্রকলা আছে, পটকথা আছে, ভাস্কর্য আছে, কাঠ খোদাই আছে, কাপড়ে ছাপাই আছে, বই সাজানো আছে, বই বাঁধাই আছে। একসময় বামুনের হুঁকো কড়ি দিয়ে আলাদা চিহ্নিত করা হত। দেবতাদের মধ্যেও উচ্চনীচ ভেদ আছে, অমার্জিত লৌকিক দেবতা ও শিষ্ট পৌরাণিক দেবতার সহাবস্থান দেখতে পাওয়া যায়। আসলে একদিন সমাজকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও শান্ত রাখতে, সমাজে অরাজকতা রুখতে দেবতার পরিকল্পনা করবার প্রয়োজন হয়েছিল। বিহারের মধুবনী, দক্ষিণের কৃষ্ণা গোদাবরী অববাহিকায় ভাইটাল চিত্র, বাংলার জড়ানো পট, কাঠের পাটায় চিত্র, কাঠ খোদাই— এ সবই তথাকথিত নিম্নবর্গীয়দের কাজ। এর কী কোনো ব্যাখ্যা হয়? সমাজে বসবাসকারী মানুষের খাদ্য, পোশাক, আসবাবপত্র সবই এদের সৃষ্টি, এমনকি জ্ঞানসৃষ্টিকারী পুঁথি, কলম, কালি এসবও এদেরই তৈরি। তবু সবশেষে যা শুনতে হয়, ‘তুই ছোটলোক, তুই কী বুঝবি?’ 

লোকজীবনে নানা সমস্যা ও অভাব অভিযোগের কারণে বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ আন্দোলনকে তথাকথিত উচ্চবর্গীয়রা সবসময়ই নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করে এসেছে, কখনো আবার ভুলপথে চালিত করেছে। ফলে এই মানুষগুলোর মূল সমস্যার কোনো সমাধান আজও হয়নি। যেমন ধরা যাক, নকশাল আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল গ্রামবাসীদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে পুলিশের গুলি চালনায়, প্রথমে সেখানে কম্যুনিস্ট পার্টির কোনো ভূমিকা ছিল না। বরং উত্তেজনার দিনগুলোতে পার্টির কৃষক ফ্রন্টের নেতৃত্ব গিয়ে মিটিং করেছিলেন জোতদারদের বাড়িতে, যাদের নির্দেশে পুলিশ গুলি চালিয়ে কৃষকরমণীদের খুন করেছিল। পার্টির এমনতর অবস্থানের বিরোধিতা করে শেষপর্যন্ত বেরিয়ে আসেন চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরীরা। 

মনে পড়ছে আমার প্রথম ছবি আঁকার গুরু ছিলেন একজন পটুয়া, তিনি পট তৈরি করতেন, আমাদের বাড়ির পুজোয় ঠাকুর গড়তেন, চালচিত্র আঁকতেন। আমাকে দিয়েও আঁকিয়েছিলেন। আর সেসময় যারা আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল, তারা মূলত বাংলার ঐতিহ্যমণ্ডিত জড়ানো পট আঁকত। তাদের মধ্যে একজন দুখুশ্যাম চিত্রকর ছিল আমারই বয়সী, অল্পদিন হল মারা গেছে, এরা ছিল আমার ঘরের লোক। আমি গয়াতে গিয়ে এদের সঙ্গে থেকেছি, কাজ করেছি। পটুয়ারা বেশির ভাগই ছিল ধর্মান্তরিত মুসলিম। তাদের মেয়েরা শাঁখা সিঁদুর পরত, আলতা পরত, কালীপুজো করত। অর্থাৎ হিন্দুয়ানির অভ্যাসগুলো তারা বজায় রেখেছিল। তবু হিন্দুসমাজের চোখে মুসলমান হওয়ায় তারা ছিল অচ্ছুত। আবার ইসলামধর্মে চিত্রাঙ্কন গোনাহ্‌, তাই মুসলিম সমাজ এদের অপাঙ্‌ক্তেয় করে রেখেছিল। মসজিদে সকলের সঙ্গে এদের নামাজ আদায় করার অধিকার ছিল না, ফলে নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় গোপন রাখতে পটুয়ারা ধর্মনিরপেক্ষ একটি পদবি নিল চিত্রকর।   

তথাকথিত নিম্নবর্গীয় চিত্রকলার শিল্পীরা উঠে এসেছেন পারিবারিক পরম্পরা থেকে, অন্যদিকে আমরা যারা শহুরে শিল্পী, আমাদের প্রায় সকলেরই কোনো পারিবারিক উত্তরাধিকার ছিল না, বরং ছবি আঁকার ব্যাপারে পরিবারের সবসময় বিরোধিতাই ছিল। এই ধরনের শিল্পসংস্কৃতিকে আমাদের বাড়িতে খাটো চোখে দেখা হত। এদের ছোটলোকই ভাবা হত, অন্দরে এদের প্রবেশাধিকার ছিল না। যেমন বাড়িতে আসতেন মুড়িওয়ালি, আমাদের থেকে চাল নিয়ে মুড়ি ভেজে দিতেন। একজন রোজ আমাদের মাছ এনে দিত, আর একজন মুসলিম আসতেন, তিনি পাটের দড়ি বানিয়ে দিতেন। আমার দেখভালের দায়িত্বে ছিল দশরথ, সে ছিল ওড়িশাবাসী, ছোটোবেলা থেকে তার কোলেপিঠে আমি বড়ো হয়েছি। আমার ‘ছবিলেখা’ বইয়ে এদের সকলের কথা আছে, এদের সকলের ছবি আমি এঁকেছি। যাত্রাদলের শিল্পী, যাঁরা আসতেন তাঁদের সঙ্গে আমি মিশেছি। মূর্তি গড়া হোক বা ছবি আঁকা হোক, তার পরিণতি হল শিল্পসামগ্রীর সংগ্রাহক বা ক্রেতা এককথায় যারা ভোক্তা। একজন পটুয়া একটা পট আঁকলে সেটার সংগ্রহমূল্য যা হবে, কোনো শহুরে শিল্পীর আঁকা পট সেই মূল্য পাবে না, কারণ সেই পট তাঁর পারিবারিক উত্তরাধিকার থেকে আসছে না। জয়নাল আবেদিন বা চিত্তপ্রসাদের কাজগুলির ভোক্তা কিন্তু শহুরে বাবুরা, যাঁরা তাঁদের ছবির subject, সেই অগণিত নিরন্ন মানুষেরা নন। লালনকে নিয়ে গৌতম ঘোষ ছবি বানালেন ‘মনের মানুষ’, সে ছবি শহরের প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হল, যাঁদের নিয়ে ছবি সেই বাউলের আখড়ায় দেখানো হয়নি। এই ভোক্তার সমস্যার কারণেই নিম্নবর্গীয় শিল্পীরা তাদের প্রাপ্য সম্মান বা স্বীকৃতি কিছু পায়নি। আবার পটুয়ারা যে রং ব্যবহার করে সেসব রং তারা প্রকৃতি থেকেই সংগ্রহ করে নেয়। যেমন ভুশোকালি থেকে কালো রং, গাছের পাতা থেকে সবুজ রং, বেলের আঠা দিয়ে সেগুলো তৈরি করা হচ্ছে। ফলে এগুলোর যে বাহ্যিক চেহারা, তার সঙ্গে শহুরে অভিব্যক্তির কোনো মিল ঘটছে না। জোর করে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সে একরকম হবে, যেমন উত্তর ভারতের একজন শিল্পী পট সংগ্রহ করে তাকে নানা ভাবে কেটেকুটে ক্যানভাসে লাগিয়ে একটা জাতীয়করণের চেষ্টা করেছিলেন। এর তীব্র বিরোধিতা করা হয়। দেখা যায়, দেশজ শিল্প যা কিছু, তাকে ধ্বংসের মাধ্যমে শহুরে মানুষ কৃতিত্ব দাবি করে থাকেন! যেমন চিনে আই উই নামে একজন বিপ্লবী শিল্পী শিল্পসৃষ্টিতে এমন বিপ্লব করেছেন যে চিনা কম্যুনিস্ট পার্টি তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তিনি প্রাচীন মৃৎপাত্রকে হাত থেকে ফেলে আছড়ে ভেঙে দিতেন, সেই ভাঙার ফটো তোলা হত। প্রথমে হয়তো হাজার বছরের পুরানো একটা পাত্র তিনি ভাঙলেন, কিন্তু ছবিটা ভালো উঠল না, তখন তিনি অমন প্রাচীন আর একটি পাত্র ফেলে ভাঙলেন, এবার ছবি ঠিকঠাক উঠল। এই যে হাজার বছরের পুরানো মৃৎপাত্র, যা অমূল্য, যাকে আর নতুন করে পাওয়া যাবে না, তাকে ধ্বংস করে যে বিপ্লব করলেন, এ তো শহুরে মানুষের বিপ্লব! আমরা যে জীবনের কথা বলছি, আর এঁরা যে জীবনের কথা বলেন, তাতে বিস্তর ফারাক আছে। প্রশ্ন উঠতে পারে এ জীবন কার? কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনে যে লাইফ টাইম গ্যারান্টির কথা বলা হয়, সেই জীবনটা কার? ঐ পণ্যের, না ভোক্তার? এটা যেমন পরিষ্কারভাবে উল্লেখিত থাকে না, তেমনই শিল্পটা কার জন্য এটা সবসময় ঊহ্য রাখা হয়। 

যে-কোনো বিক্ষোভ আন্দোলনে এই নিম্নবর্গীয় শিল্পীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে মেদিনীপুরের পটুয়া বা পটশিল্পীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাঁদের মধ্যে যেমন কেউ কেউ কারাবরণ করেছেন, আবার কেউ পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণও করেছেন। এঁরা স্বদেশিয়ানা প্রচারের জন্য যে বিশেষ ধরনের পট বানিয়েছিলেন, তাকে বলে সাহেব পট। এমনিতে সব পট Vertically Scroll বা unfold করা হয়, আর সাহেব পট খোলা হয় Horizontally, পটুয়ারা মূলত মাধুকরী বৃত্তি অবলম্বন করতেন, গ্রামে কেউ মারা গেলে তাঁরা যমপট নিয়ে এসে পট দেখাতে দেখাতে গান গেয়ে মৃত আত্মার শান্তিকামনা করতেন, বিনিময়ে চাল, আলু, আনাজপাতি টাকাপয়সা পেতেন, অনেকসময় অন্যের পট ভাড়া করেও আনতেন। তাঁরাই আবার ক্ষুদিরামের ফাঁসি নিয়ে পট তৈরি করে বিভিন্ন জায়গায় দেখানোর মধ্যে দিয়ে স্বাদেশিকতার প্রচার করতেন। স্বদেশি আন্দোলনের সময় এঁরা সংযোগকারী হিসেবে খবরের আদান-প্রদান করতেন, প্রয়োজনীয় গোপনীয়তা রক্ষা করতেন, একটা সাংস্কৃতিক আড়াল তৈরি করতে পেরেছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশ প্রথম প্রথম ধরতে পারেনি। কিন্তু একসময় তাঁরা পুলিশের নজরদারির মধ্যে চলে আসেন। বহু পটুয়া ধরা পড়েন, অত্যাচারিত হন, মারাও যান। অনেকে জেলবন্দি হন, কাউকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। 

লোকসংস্কৃতির অন্যতম উদাহরণ উত্তরবঙ্গে মালদা অঞ্চলের গম্ভীরা আর কলকাতার জেলেপাড়ার সঙ্, যেখানে তীব্র সমাজসমালোচনা উঠে এসেছে। এখানে একটা কথা মনে রাখা জরুরি, যেহেতু ব্রিটিশ আমলে জেলেপাড়ার সঙের মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ধনী জমিদার ও মুৎসুদ্দি শ্রেণি, যাঁরা ব্রিটিশদের পদলেহন করে বড়োলোক হয়েছিলেন, তাই তাঁরা ব্রিটিশ বিরোধী কিছু করতে দিতেন না। এসবই, এমনকি নাটক বা যাত্রার মতো Performing Art-এর ক্ষেত্রে স্থায়িত্ব যেখানে সাময়িক, কিন্তু ভাস্কর্য বা চিত্রকলার ক্ষেত্রে তা চিরকাল থেকে যায়, সেখানে তারকেশ্বরে মোহান্ত এলোকেশী বিষয়ক কিছু সামাজিক আলোড়নসৃষ্টিকারী ঘটনা নিয়ে ছবি আঁকা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলির কোনো বৃহত্তর তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায় না। চূয়াড় বিদ্রোহ বা বিদ্রোহী সাঁওতালদের ওপর যে নির্মম অত্যাচার হয়েছে, তার ছবি তারা এঁকে রাখার কোনো উৎসাহ পায়নি। ছবি যা পাওয়া যায় তা ক্ষমতার দিক থেকে আঁকা, সাহেব শিল্পীর আঁকা বনের মধ্যে গাছের ডালে বিদ্রোহীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর ছবি। বিদ্রোহের স্ফুরণ যেখান থেকে সেই উদ্দীপনাময় ছবি কখনো পটুয়ারা আঁকার সাহস পায়নি। তারা মূলত পৌরাণিক ও লৌকিক দেবদেবীদের মাহাত্ম্য বিষয়ে ছবি এঁকে এসেছে। পরবর্তীকালে তারা ফরাসি বিপ্লবকে কিংবা বিদ্যাসাগর বা নজরুলের মতো মণীষীদের জীবনীকে ছবির বিষয় করেছে। কিন্তু এই বিষয় তারা পেল কোথা থেকে? পেয়েছে শহুরে শিক্ষিত বাবুদের কাছ থেকে। 

উচ্চবর্গীয়রাই নিম্নবর্গীয়দের ধারণা তৈরি করেছে। শান্তিনিকেতনে একবার একজনকে এক সাঁওতাল তুই-তোকারি করে কথা বলায় তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করলেন— তুই আমায় তুই বলছিস কেন? তখন সাঁওতালটি বলল আমার ভাষায় তো তুই তুমি তারতম্য নেই। তুই আমায় তুই বলছিস বলে আমিও বলছি। সাঁওতাল মানুষটি সহজ সরল জীবনবোধসঞ্জাত সত্য বলেছে, কিন্তু অন্য পক্ষের ‘তুই আমায় তুই বলছিস কেন’ এই প্রশ্নের মধ্যে নিহিত রয়েছে উচ্চবর্গীয় অহংবোধ। সম্প্রতি ফেসবুকে দামি ঝলমলে শাড়ি ও গয়না পরা এক আধুনিকা মহিলার পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল। তিনি পুরুলিয়াবাসীর পক্ষ থেকে জানাচ্ছেন শহর থেকে, বিশেষ করে কলকাতা থেকে পুরুলিয়ায় বেড়াতে আসা মানুষজন পুরুলিয়াবাসীকে গাঁইয়া বলে থাকেন, আপনারা আমাদের গাঁইয়া বললে আমরাও আপনাদের ক্যালকেশিয়ান বলব। আপনারা ভালোবাসা দিলে ভালোবাসা পাবেন, অবজ্ঞা দিলে অবজ্ঞা। হয়তো এই ভদ্রমহিলার জন্ম পুরুলিয়ায়, সেই অধিকারে তিনি একথা বলছেন। কিন্তু তাঁর পোশাক, প্রসাধন, বাচনভঙ্গি কোনোটাই বেশিরভাগ পুরুলিয়াবাসীর সঙ্গে মেলে না, তাই তাঁকে প্রকৃতঅর্থে পুরুলিয়াবাসীর প্রতিনিধি বলা যায় না। 

অবন ঠাকুর ওরিয়েন্টাল স্কুল অফ আর্ট তৈরি করে নন্দলালকে চলে আসতে বললেন। রবীন্দ্রনাথ কলাভবন থেকে তাঁকে ছাড়তে রাজি হলেন না। নন্দলাল তখন অবনীন্দ্রনাথকে বললেন গুরুদেব, আমায় সাঁওতাল রমণীর স্তন দেখা থেকে বঞ্চিত করবেন না। একথা তিনি বলছেন উচ্চবর্গীয় ধারণা থেকে। তিনি কি অন্য কারো স্তন দেখেননি? তাঁর স্ত্রীর স্তন নেই? তাঁর সন্তান স্তন পান করেনি? তিনি ছোটোবেলায় মায়ের স্তন পান করেননি? নাকি সাঁওতাল রমণীরা ব্লাউজ পড়ত না, চাষের খেতে এক হাঁটু কাদায় দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয় বলে খাটোহাতি শাড়ি পড়ত, তাই এই ইঙ্গিত? পরিশ্রমী সাঁওতাল রমণীর নির্মেদ অপূর্ব সুষমামণ্ডিত শরীরের গঠন শিল্পী নন্দলালের দৃষ্টি আকৃষ্ট করত, তাঁর কামনাকে নয়। সম্প্রতি ইচ্ছাকৃতভাবে স্তন প্রদর্শন নিয়ে মমতাশংকরের করা মন্তব্য নিয়ে অনর্থক জোর বিতর্ক হয়ে গেল। মমতাশংকরের অভিমত ছিল ল্যাম্পপোস্টের ধারে দাঁড়িয়ে যে মেয়েদের শরীর বেচতে হয়, তাদের পুরুষকে আকর্ষণের জন্য স্তন প্রদর্শনের কারণ আছে, কিন্তু অকারণে তা করাটা নির্লজ্জতা! অর্থাৎ শরীর বেচছে যে মেয়ে তার আবরুর প্রয়োজন নেই, বাকিদের স্তন তো স্বামী, সন্তান ও প্রিয় পুরুষের জন্য, তার আবরুতার প্রয়োজন আছে। তসলিমা নাসরিন বললেন আমার স্তন আছে, তাই আমি দেখাই, পুরুষের স্তন থাকলে সেও দেখাত।

রামকিঙ্কর বেইজ যখন বিশ্বভারতীতে কলাভবনে পড়তে এলেন, তাঁকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছিল। প্রথমত তাঁর বেইজ পদবি ঘিরে ঔৎসুক্য, নন্দলাল সহ অনেকেরই মানসিক অস্বস্তি থেকে বিরাগ কাজ করেছিল। এরপর রামকিঙ্কর যখন ধানঝাড়ার মূর্তি গড়লেন, তখন অশ্লীলতার অভিযোগ উঠল, সে অভিযোগ ধূমায়িত অসন্তোষ হয়ে পৌঁছাল রবীন্দ্রনাথের কাছে, রবীন্দ্রনাথ নিজে সেই মূর্তি দেখে এসে রামকিঙ্করকে ডেকে পাঠালেন। রামকিঙ্কর ভেবেছিলেন এবার বুঝি তাঁর শান্তিনিকেতনের পাট উঠল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে বললেন তোর মনের মতো মূর্তি গড়ে আমার শান্তিনিকেতনকে ভরিয়ে তোল। আসলে রবীন্দ্রনাথ যাবতীয় উচ্চবর্গীয় সংকীর্ণতা থেকে আশ্চর্য রকম মুক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের লেখায়, তাঁর আঁকা ছবিতে তাঁর মুক্তমনের পরিচয়টি বড়ো হয়ে ওঠে। রামকিঙ্কর যে নিম্নবর্গীয় জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছেন, সেই জীবনকে আঁকড়ে শিল্প গড়েছেন, আমৃত্যু বেঁচেছেন। নিম্নবর্গীয় জগৎ থেকে তাঁর কলের বাঁশি বা সাঁওতাল পরিবার ভাস্কর্য বা অগুনতি ছবি। ভিন্ন শ্রেণিপরিচয় থেকে আসা চিত্তপ্রসাদ বা জয়নাল আবেদিনরা এই জগৎ থেকেই তাঁদের শিল্পের বিষয় আহরণ করলেও তাঁরা নিজেরা নিম্নবর্গীয় হয়ে যাননি। রামকিঙ্কর যখন ত্রিপুরার রাজকুমারীর ছবি আঁকেন, ভালোবেসে যাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, তাঁর ছবিতেও ফুটে ওঠে সাঁওতাল রমণীর আদল! শেষজীবনে তাঁর জীবনসঙ্গী রাধারানিকে নিয়ে যাবতীয় সমস্যা ছিল শান্তিনিকেতনের উচ্চবর্গীয় সমাজের, রামকিঙ্করের নয়। 

আমাদের এই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় যেমন নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের দিক থেকে কিংবা সংস্কৃতির দিক থেকে গ্রাম শহরের স্পষ্ট আড়াআড়ি বিভাজন আছে, ইউরোপের দেশগুলিতে তা দেখা যায় না। হতে পারে শিল্পবিপ্লব কিংবা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এর কারণ। মেক্সিকোর কিংবদন্তি ম্যুরাল শিল্পী দিয়েগো রিভেরা ছিলেন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য। অনুমান করা হয় ট্রটস্কি হত্যার ষড়যন্ত্রে তাঁর ও তাঁর স্ত্রী শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর অংশ ছিল। মার্কিন ধনকুবের রকফেলার, রিভেরাকে রকফেলার সেন্টারে একটি দেওয়ালে ম্যুরালের বরাত দেন। কাজ শেষ হলে রকফেলার দেখেন ছবিতে জনতার মধ্যে লেনিনের মুখ! অসন্তুষ্ট রকফেলার দেওয়াল ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিলে রিভেরা বলেন ছবিটা তো আমার! রকফেলার বলেন দেওয়ালটা তো আমার। পরে অবশ্য একে পুনঃনির্মাণ করা হয়। ফলে বোঝা যাচ্ছে যে রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে বাইরের শিল্পীরা কাজকর্ম করে থাকেন, ভারতীয় উপমহাদেশের নিম্নবর্গীয় শিল্পীদের থেকে সেটা আশা করা যায় না। এদের কখনো রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করে তোলা হয়নি। ফলে এদের আঁকা ছবিতে কি গড়া ভাস্কর্যে রাজনীতি কখনো প্রতিফলিত হয়নি। যদিও কোথাও হয়েও থাকে তাকে অবদমিত করে দেওয়ার প্রয়াস চলেছে বা অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাদের যা শেখানো হয়েছে সবই উচ্চবর্গীয়দের শিক্ষা, নিম্নবর্গীয়দের জীবনযাপন থেকে তার বহু যোজন দূরত্ব! 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান