লীনা চাকী
‘অন্ত্যজ’, ‘দলিত’– এই শব্দদুটির যে ভয়ংকর ভার, তা জানেন তাঁরাই, যাঁরা ওই ভারের ওজনে হেঁটমুণ্ড হয়েও ঘাড় সোজা করতে চান। চুনি কোটালকে তাঁর জন্মপরিচয়ের কারণে হারিয়ে যেতে হল, পাশে তো কাউকেই পাননি, যিনি সাহস জোগাতেন। কোনও আশ্রয় তো পাননি, যা পায়ের তলার মাটি হত। (তাঁর কথা মনে না থাকলে পড়ে নিতে পারেন গুগল-এ) কিন্তু পেলেও কি কারও জন্মপরিচয় মুছে যায়? যায় না। চারধারের মানুষ মুছতে দেয় না, বরং আঘাত করার চেষ্টা করতেই থাকে। বেঁচে থাকতেই দেশে ও বিদেশে খ্যাত চিত্রকর-ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ তাঁর যাবতীয় শিল্পকর্ম দিয়েও ‘অন্ত্যজ’ পরিচয় থেকে মুক্ত হতে পারেননি। বিশ্বভারতী-র স্বঘোষিত ‘অভিজাতরা’ তাঁকে সেটা ভুলতে দেননি।
বাঁকুড়া শহরের যুগীপাড়ায় ১৯০৬ সালে ২৬ মে জন্ম হল রামকিঙ্করের। পরামানিক পরিবার। বংশগত পেশা ক্ষৌরকর্ম। সে পেশায় রামকিঙ্কর গেলেন না। ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া তাঁর স্বপ্ন, বাস্তবায়িত হতে থাকল নিজের গ্রামে। সেখানেই এক প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি চোখে পড়ে গেল ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি রতন চিনেছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে রামকিঙ্কর এসে পৌঁছোলেন শিল্পচর্চার পীঠস্থান শান্তিনিকেতনে। সাল ১৯২৫। কাঁধের ঝোলায় আঁকা কিছু ছবি। শিল্পী নন্দলাল বসু জহুরির চোখ দিয়ে মেপে নিলেন তাঁর প্রতিভাকে। তারপর রামকিঙ্করের এগিয়ে চলা। রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ও প্রশ্রয় পেলেন। রবীন্দ্রনাথ বললেন, শান্তিনিকেতনের প্রাঙ্গণ তোর কাজ দিয়ে ভরিয়ে দে। রামকিঙ্করকে নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের অসমাপ্ত তথ্যচিত্রে ধরা আছে তাঁকে বলা রবীন্দ্রনাথের কথা, ‘ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘের টুঁটি চেপে ধরার মতো ধরবি, আর পিছনে ফিরে তাকাবি না।’ তাঁর কাছ থেকেই পেলেন নব নব সৃষ্টির শক্তি। শিক্ষক নন্দলাল বসুর স্নেহ পেলেন। এরপর তাঁর দুরন্ত গতিতে আধুনিক শিল্প-ভাস্কর্যের দিকে এগিয়ে চলার চেষ্টা শুরু হল। তাঁর তৈরি করা নিজস্ব পথ। ভারতের প্রথম বিমূর্ত ভাস্কর্যের পথিকৃৎ হলেন তিনি। সঠিক বোদ্ধাদের প্রশংসা পেতে থাকলেন, তার সঙ্গে প্রতিবন্ধকতাও। নিজের ভাবনাকে নিয়ে এলেন সিমেন্টের কাজে, এখানেও তিনি আবিষ্কারক। তেল রঙের কাজ, যা বিশ্বভারতী-অনুমোদিত নয়, সেক্ষেত্রেও রামকিঙ্কর নিয়ম ভাঙলেন। আসলে তিনি সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর ছবি বিভিন্ন জায়গার প্রদর্শনীতে যেত। ১৯২৫ সালেই, যে বছরে শান্তিনিকেতনে পা রাখলেন, লক্ষ্ণৌ নিখিল ভারত শিল্প প্রদর্শনীতে তাঁর ছবির জন্য রৌপ্যপদক পান! ১৯৪৬, ১৯৫০ ও ৫১ সালে পরপর তিনবার প্যারিসে প্রদর্শনীতে বিশ্বের বহু শহরের তাবড় শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর ছবি জায়গা পায়। পিকাসো, মাতিসের মতো শিল্পীদের ছবির পাশে রামকিঙ্করের ছবি! জাপানের ফুকুওকার প্রদর্শনীতে তাঁর দুটি কাজ ছবি ও ভাস্কর্য জায়গা পায়।
পুরস্কার-প্রত্যাশী তিনি ছিলেন না, বরং এসব ব্যাপারে তাঁর উদাসীনতা প্রকট হয়ে থাকত। বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম উপাধি পান। ১৯৭০ সালে পান পদ্মভূষণ পুরস্কার। ১৯৭৯-তে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি লিট সম্মানে ভূষিত করেন। ১৯৬৮ সালে ইউনেস্কোর আমন্ত্রণে বিশ্বভারতীর কলাভবনে বক্তৃতা দেন। ১৯৬৯-এ বিশ্বভারতীতে স্থায়ী অধ্যাপকের পদ পান। আরও সম্মান প্রাপ্তির কথা এখানে আর দিচ্ছি না। বেঁচে থাকতেই কিংবদন্তিপ্রায়, মহান মানুষটি তাঁর যাবতীয় শিল্পকর্মের জন্য সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু, কী আশ্চর্য, প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতো তাঁর জাতপরিচয় স্থায়ী হয়ে থেকে গেছে। আরও লজ্জার যে তাঁর চারপাশের ‘শিক্ষিত’-দের কাছ থেকেই ঘৃণিত হয়েছেন। চুনি অসহনীয় হয়ে উঠলে প্রতিবাদ করে গেছেন, বোঝাতে চেয়েছেন, কিন্তু রামকিঙ্কর নির্বাক থেকেছেন। তাঁর জবাব, প্রত্যাঘাত ধরা আছে নাট্যঘরে লালনের রিলিফের কাজে, আর ক্রমে মানসিকভাবে নিভৃতে চলে যাওয়ায়।
আঘাত, অপমান কাদের দিক থেকে আসত? বিশ্বভারতীর উন্নাসিক ‘কুলীনদের’ দিক থেকে। তিনি যে নাপিতের ঘরের ছেলে, তাঁরা যে অন্ত্যজ, ছোটো জাত, পাড়ার ব্রাহ্মণ, কায়স্থরা যে তাঁদের ঘেন্না করেন, এ তিনি জানতে জানতে বড়ো হয়েছেন। তাঁর বাবা চণ্ডীচরণকে দেখেছেন সমবয়সী ব্রাহ্মণকে প্রণাম করতে। একবার চিত্তরঞ্জন দাশ এসেছিলেন বাঁকুড়াতে, উদ্দেশ্য, স্বরাজ্য পার্টির প্রচার। সেখানেই রামকিঙ্কর তাঁর একটি স্কেচ করে দেন। উনি খুশি হয়ে নাম জিজ্ঞাসা করলেন। বললেন। মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর ‘রং কাঁকর রামকিঙ্কর’ বইতে লিখছেন, ”শিল্পীর মুরুব্বি, স্বরাজ পার্টির স্থানীয় নেতা, ক্রিশ্চান কলেজের অধ্যাপক অনিলবরণ রায় বাকি পরিচয়টুকু দিলেন ইংরেজিতে— ‘ওরা সত্যিই নাপিত। ওর বাবা মা দাদা সত্যিই নাপিতের কাজ করে। ও-ই শুধু অন্যরকম।” বুঝতে পেরেছিলেন রামকিঙ্কর। আশ্চর্য হননি, তবে স্থায়ী ক্ষত একটা তো তৈরি হয়েছিলই, যে ক্ষতটা শান্তিনিকেতনে এসে আরও গভীর হয়েছিল।
তিনি শিল্পী হয়ে ওঠার পরও যুগীপাড়ার বামুনরা সেই একই মানসিকতা আগলে রেখেছিলেন, তারও প্রমাণ পেয়েছিলেন। বিশ্বভারতীর কলেজের বন্ধু সুজিত মুখোপাধ্যায়ের বিয়ে হয়েছিল যুগীপাড়ার কাছে গোস্বামীপাড়ায়। সুজিত সস্ত্রীক এসেছেন শ্বশুরবাড়িতে। রামকিঙ্করও সেই ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন। বন্ধু তাঁকে ডেকে নিয়ে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে। সুজিত ভেতরবাড়িতে গেছেন, রামকিঙ্কর বসে আছেন বাইরের ঘরে। এরপরের ঘটনা মণীন্দ্র গুপ্তের ‘রং কাঁকর রামকিঙ্কর’ বইটি থেকে দিই। লেখক জেনেছিলেন সমরেশ বসুর রামকিঙ্করের জীবনভিত্তিক অসম্পূর্ণ উপন্যাস ‘দেখি নাই ফিরে’ থেকে। আনানোবানানো নয়, সমরেশ বসু রামকিঙ্করের মুখ থেকেই শুনেছিলেন। লেখার জন্য তিনি তখন রামকিঙ্করের কাছে ঘনঘন যেতেন। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল ‘দেখি নাই ফিরে’। লেখকের হঠাৎ-প্রয়াণে ধারাবাহিকে যতি পড়ে যায়। শুনতাম, লেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শান্তিনিকেতনের অনেকে নাকি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। কারণ তাঁর জমানো ক্ষোভ ক্রমশ প্রকাশ করছিলেন যে! লেখক লিখছেন, ‘এমন সময় সুজিতের শ্বশুর এসে ঢুকলেন। রামকিঙ্কর হয়তো তাঁকে দেখে ভদ্রতাবশতই উঠে দাঁড়াতেন। কিন্তু তার আর সুযোগ পাওয়া গেল না। তার আগেই গৃহকর্তা গর্জন করে উঠলেন— তুই? তুই চণ্ডে নাপতের ছেলে না? উঠে দাঁড়া। তুই আমার বাড়ির চেয়ারে বসেছিস! ওঠ, উঠে দাঁড়া।’ বন্ধুটি তখনই রামকিঙ্করকে নিয়ে ফিরে আসেন শান্তিনিকেতনে।
কিন্তু শান্তিনিকেতনেও কি তিনি ‘নাপিত’ পরিচয় থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন? প্রথম আসার পর ভাবতেও পারেননি তাঁর জন্য অমনই মানুষরা খাঁড়া হাতে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর পদবিতেই ছিল জাত-পেশার পরিচয়। সেটা তাঁকে কতজনে যে মনে করিয়ে দিতেন! তাঁরা শিক্ষাগত যোগ্যতায় অনেকটা ওপরে, কিন্তু জাতপাতের ব্যাপারে চরম অন্ধকার মনোভাবকে সরাতে চাইতেন না। আধুনিক, কিন্তু জাতের ব্যাপারে উগ্রপন্থী। বারবার এই মানুষগুলি রামকিঙ্করকে তাঁর জাতের কথা মনে করিয়ে দিতে সংকোচবোধ করেননি। তাঁর পদবি নিয়ে ঠাট্টা করার হাত থেকে বাঁচতে সংকুচিত, অসহায় রামকিঙ্কর তাঁর ‘প্রামাণিক’ পদবিটা বদলে নিয়েছিলেন। মণীন্দ্র গুপ্তের ওই বইতেই পাচ্ছি, ‘পূজারী’ নামের ছবিতে সই ছিল রামকিঙ্কর পরামানিক, উনি পরামানিকটা কালো রং দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন। পরে রঙের প্রলেপ খসে যেতে পরামানিক বেরিয়ে পড়ে। পদবি নিয়ে কম যায়নি বিশ্বভারতী পত্রিকা, শান্তিনিকেতন পত্রিকা। লক্ষ্ণৌ-বরোদা প্রদর্শনীতে তাঁর ছবি রৌপ্য পদক পেল। দুটি পত্রিকার একটিতে নাম-পদবি ছাপল, অন্যটিতে শুধু নাম! তাঁর প্রতি তাচ্ছিল্যের প্রকাশ আর কি। আবার ঠাট্টা, হাসাহাসি। ‘বিরক্ত রামকিঙ্কর “শান্তিনিকেতন”-এর সম্পাদককে গিয়ে বললেন, তাঁর পদবি প্রামাণিক নয়, বেজ।’ ‘ক্ষিতিমোহন সেন বেজ পদবির ব্যাখ্যা দিলেন, বেজ–বৈজ্য–বৈদ্য। হতে পারে ক্ষৌরকার। কারণ ক্ষৌরকাররাই এদেশে আদি শল্য চিকিৎসক।’ ব্যস, এটা জানার পরে নতুন করে শুরু হল টিটকারি, হাসাহাসি। ‘কেউ বলতে লাগল রামকিঙ্কর বৈজ্য, কেউ রামকিঙ্কর ভিষগরত্ন, কেউ ডাকত বদ্যি।’ এসব থেকে মুক্তি পেতে তিনি রামপ্রসাদ দাস হলেন! তারপর বন্ধুদের পরামর্শে স্থিত হলেন বেজ নয়, বেইজ-এ। তাঁর মনে হল অপরিচিত ‘বেইজ’ শব্দটির নীচে ঢাকা পড়ে যাবে তাঁর পরামানিক পরিচয়। তা আর হল কই? সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের বোন রমা, সবার নুটুদি। বাড়িতে গান শেখাতেন। সেখানেই রামকিঙ্করের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল চন্দ্রার, যার মধ্যে ‘এর সঙ্গে একটু ফষ্টিনষ্টি করা যাক’ গোছের ইচ্ছা জেগেছিল। রামকিঙ্কর বোঝেননি। আর বোঝেননি এই কারণে নুটুদি তাঁকে মনে করিয়ে দেবেন তাঁর অন্ত্যজ-পরিচয়! একঘর ছাত্রছাত্রীর সামনে নুটুদি বললেন, ‘কিঙ্কর তুমি আর কোনোদিন এ বাড়িতে আসবে না। কোনোদিন চন্দ্রাকে আজেবাজে কথা বলবে না। মনে রেখো তুমি কে। তুমি কী’। রামকিঙ্করের বুকের ভেতরে কি ধ্বস নেমেছিল? নেমেছিল তো বটেই, নিশ্চয় আশ্চর্যও হয়েছিলেন। মাথা নীচু করে বেরিয়ে এসেছিলেন। নিজেই নিজেকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন উষাগ্রামের মিশনারি স্কুলে, সেখানে ছবি আঁকার শিক্ষক হলেন। শান্তিনিকেতন ছেড়ে থাকতে না পেরে ফিরেও এলেন। ফিরে এসেও তিনি তাঁর শিকড়ের পরিচয় থেকে মুক্ত হতে পারেননি। আসামান্য সব ভাস্কর্যের কাজ করছিলেন, যা বিশ্বের নামী শিল্পীদের কাজের সঙ্গে তুলনা করা যায়, সে সবও সেই মানুষদের চেতনা আনেনি। মণীন্দ্র গুপ্ত খেদ করে সত্য উন্মোচিত করেছেন, ‘শান্তিনিকেতনের ওপরের হাওয়ায় সারাদিন ভাসে গান, আনন্দ, সমতা, উদারতা, সহমর্মিতা— এর টান ছাড়ানো অসম্ভব। কিন্তু মহর্ষির “তিনি আমার প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি”-র শ্বেত পাথরের উপাসনা বেদিটির তলার গাঁথনিতে অমর হয়ে জমাট বেঁধে আছে ব্রাহ্মণ্য জাতিভেদ, উঁচু-নীচুর অমানুষিক জাতিভেদ। রামকিঙ্কর শুরু থেকেই এই হিংস্রতার শিকার। স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত একটা জীবন পেলে ওই অসামান্য প্রতিভা নিয়ে তিনি যেখানে যেতে পারতেন সেখানে আর তাঁর যাওয়া হল না।’
বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষও কি তাঁর কাজের প্রতি উদার ছিলেন? ছিলেন না। দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছিলেন রামকিঙ্কর, আরও অনেকেই সে সময় তুলি ধরেছিলেন। নন্দলাল বসুও এঁকেছিলেন। সবার ছবি সামনে এল, এল না শুধু রামকিঙ্করের ছবিদুটি। সময়ের থেকে এগিয়ে, একেবারে নতুন আঙ্গিকে আঁকা— বিশ্বভারতীর না-পসন্দ হল। মণীন্দ্র গুপ্তের বই থেকেই জানছি এ ব্যাপারে শঙ্খ চৌধুরীর বক্তব্য ‘এ ধরনের ছবি শান্তিনিকেতনের এক অভিনব ঘটনা।…অবশ্য ওঁর করা কোনও ছবিই ঘরের বাইরে আসত না। কলাভবনেও দেখানো হত না। তাই নিয়ে কোনও আলোড়নও হয়নি। তবে তখনও ওঁর বন্ধুমহলে ও গুণগ্রাহীদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা হত।’ কেন তাঁর ছবি বাইরে আসত না? শুধু একটিই নমুনা তো নয়, কতবার যে তাঁর নতুন ভাবনাকে রূপান্তরে আসতে দেওয়া হয়নি। নানা অজুহাত সামনে এসে পথ অবরোধ করেছে। তাঁর সাধের, স্বপ্নের কত যে ম্যাকেট ঘরের কোণে, খাটের তলায় পড়ে থেকেছে! কেনই বা তিনি মনের তাগিদে ভাস্কর্য তৈরি করতে গিয়ে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন? রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর সঙ্গে যুক্তরা ‘কৌলীন্য’ ও ‘ঐতিহ্য’ রক্ষা করতে বড়োই তৎপর হয়ে পড়েছিলেন, অভিশাপের মতো হয়েছিল রামকিঙ্করের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথ যে রামকিঙ্করকে মুক্ত বাতাসের স্পর্শ দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর অবর্তমানে অন্ত্যজ যুবকটির ক্ষেত্রে বদ্ধতার নির্মম রূপ তাঁরা ক্রমাগত দেখিয়ে গেছেন। এটা শিষ্ট নয়, ওটা করতে পারবে না,— বাধার পর বাধা। আধুনিক বিশ্বের শিল্পকর্মের প্রতি তাঁদের বড়োই অনীহা ছিল! অথচ রবীন্দ্রনাথ বিদেশে যেখানেই গেছেন, চিত্রকলা, ভাস্কর্যের বই নিয়ে এসে লাইব্রেরি ভরিয়ে দিতেন। রামকিঙ্কর সেসব পড়ে সমৃদ্ধ হতেন। রামকিঙ্কর সেই পথেই এগোচ্ছিলেন যে! তাঁর সৃষ্টির ভাবনা সময়ের থেকে আরও বিশ বছর এগিয়ে ছিল। সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘শিল্পী রামকিঙ্কর আলাপচারি’ বইতে লিখেছেন ‘একদিকে এই স্বীকৃতি যেমন পেয়েছেন অন্যদিকে শেষ পর্যায়ে কাজে বাধাও পেয়েছেন অবাঞ্ছিতভাবে মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবানের প্রতিবন্ধকতায়।…কিন্তু মহাশিল্পীর রূপতপস্যায় এই বিঘ্ন শুধু শিল্পীকেই আঘাত করেনি, প্রতিষ্ঠানকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।’ মণীন্দ্র গুপ্তের ওই বই থেকেই পাচ্ছি শঙ্খ চৌধুরীর খেদোক্তি,— কিঙ্করদা প্রচুর কাজ করেছেন।…একজন বড়ো মাপের শিল্পী, একজন বড়ো হৃদয়ের মানুষ ছিলেন কিঙ্করদা। কিন্তু কিঙ্করদার কি যেন ছিল না। ওই যাকে বলে কৌলীন্যের অভাব। ওই জন্য কি যে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়েছে কিঙ্করদাকে।’ কি যে লাঞ্ছনা!! তারমানে ধারাবাহিকভাবে নানা দিক থেকে তাঁকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। হায়!
জাতপরিচয়ের কারণে এই যে লাঞ্ছনা সারাটা জীবন তাঁকে বইতে হয়েছে, সেটাই যেন তাঁর মধ্যে মহাশক্তির জোগান দিয়ে গেছে। মুখে তো প্রতিবাদ করেননি, আগেই বলেছি একটিই স্থায়ী প্রতিবাদ তিনি রেখে গেছেন লালনের রিলিফের মূর্তিতে। পাশে ওভাবেই লিখে দিয়েছিলেন লালন ফকিরের জাতপাতবিরোধী গানের লাইন,— ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ লালন কয় জাতের ফাতা বিকিয়েছি সাত বাজারে।’ সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই বই থেকে জানছি বিচিত্রায় ওই রিলিফের (১৯৬৫ সালে করা) কাজটি দেখতে লেখক প্রায় রোজই যেতেন। উনি দেখেছেন প্রথমে লালনের দুটি পা-ই ভূমি স্পর্শ করা ছিল, পরে শিল্পী একটি পা নাচের ভঙ্গিতে তুলে দিয়েছিলেন। অনেক পরে, রামকিঙ্কর তখন জীবন-সায়াহ্নে, লেখক এর কারণটা জানতে চেয়েছিলেন। উনি প্রথমে বললেন, ‘হুঁ বদলেছি। কেন বদলালাম জানো? নাচটা জোর পাচ্ছিল না আগের পোজিশনে। যেই পা-টা তুলে দিলাম নাচের স্পিরিটটা এসে গেল। দেহের ভারটা গেলো হালকা হয়ে। মানুষটা তখন মাটি থেকে আকাশে। উড়ছে প্রায়।’ সোমেন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন ধরে জাতের কারণে যন্ত্রণাবিদ্ধ রামকিঙ্করকে দেখেছেন, জেনেছেন। তাই তাঁর এই ব্যাখ্যার আড়ালে কী ছিল, সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই ধরতাইয়ের মতো বললেন, ‘…..এই যেমন নিরর্থক আচারের বাড়াবাড়ি, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ— এর বিরুদ্ধে তার (লালনের) প্রতিবাদ বেশ জোরালো আর একেবারে সোজাসুজি। বাউলের এই ভাবটি আপনি রিলিফে লালনের নাচের ঐ ভঙ্গিটিতে— দর্শকের প্রায় নাকের ডগায় পা তুলে দেওয়ায় দারুণ ফুটেছে।’ এবারে রামকিঙ্কর গোপন কথাটি বললেন,” ‘হুঁ বেঠিক বলোনি কথাটা। আমার মনে ভিতরে— ভিতরেই ওটা ছিল। লাথি। লালনের পা-টা তাই সোজা উঠে গেছে, দেখা যাচ্ছে পায়ের পাতা।’ তারপরেই প্রকাশ করলেন তাঁর মনের ভিতরে থাকা দহন, ক্ষোভ, শ্লেষ। ‘কত দেখেছি এসব নোংরামো— ভাবতে পারবে না। শিক্ষিতের মধ্যেও। লেখাপড়া শিখেছে, পোশাকে সভ্যভব্য— বুঝলে— কিন্তু ওই। নজরুল বলেছিলেন না জাতির নামে বজ্জাতি। বাউল গানে কিছু হল না হে। কে শোনে লালনের কথা।…… তবে ঐ লাথিই আসবে একদিন আরও সাংঘাতিক হয়ে তখন হয়তো হুঁশ হবে সমাজের।’
‘অন্ত্যজ’ রামকিঙ্কর তাঁর যাবতীয় অপমানের মধ্যে থেকেই শিল্পসৃষ্টির শক্তি তৈরি করে নিয়েছিলেন। প্রবল শক্তি, যা কেউ আটকাতে পারেননি। ধানঝাড়া, সুজাতা, কলের বাঁশি, সাঁওতাল পরিবার, বিমূর্ত রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি, দিল্লির রিজার্ভ ব্যাংকের সামনে যক্ষ-যক্ষী, হাঙ্গেরির বালাতন হ্রদের ধারে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ ব্রোঞ্জ প্রতিলিপি,— আরও যত ভাস্কর্য গড়েছেন, প্রতিটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নির্মাণের প্রবল রূপ, তথাকথিত শান্তিনিকেতনের গণ্ডিবদ্ধ মানুষগুলির দিকে নিজেরই অজ্ঞাতে ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ। প্রতিটির মধ্যেই জড়িয়ে আছে ভাঙা-গড়ার ইতিহাস, যা এখন পড়লে একজন যথার্থ শিল্পী-ভাস্করকে কিছুটা চেনা যায়।
ব্যক্তিজীবনেও তিনি উলটো স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন। শ্রীপল্লীর কোয়ার্টারে থাকতেই তাঁর দেখভাল করার জন্য সঙ্গিনী করলেন আর এক অন্ত্যজ-নারী রাধারানিকে। আবার নিন্দে, তীব্র আক্রমণ। উনি চলে এলেন ছাত্র শঙ্খ চৌধুরীর রতনপল্লির মাটির বাড়িতে, সঙ্গে রাধারানি, যাঁকে আমৃত্যু তিনি কাছে রেখেছিলেন। যে কোনও অনুষ্ঠানে যেতেন, মঞ্চে উঠতেন তাঁকে নিয়ে। বলেছিলেন, ওই যক্ষ আমি, আর যক্ষী রাধারানি। এসবই সেই জাত্যভিমানী বদ্ধ মানসিকতার পণ্ডিতদের জন্য তাঁর অনুচ্চারিত জবাব। নির্জনাবাসে ভালো থাকতেন ছাত্র, বন্ধুদের সঙ্গ নিয়ে, ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথের গান। গাইতেনও। আর গাইতে ভালবাসতেন লালনের গান। বিশেষ করে ওই গানটি,— সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে। লালনের জীবন তিনি জেনেছিলেন, একই মেরুতে তো তাঁদের অবস্থান ছিল। লালন জাতপাতহীন সমাজ সৃষ্টির স্বপ্ন দেখতেন। রামকিঙ্কর শেষ বয়সেও আশা রেখেছিলেন একদিন ওই জাতের ধ্বজাধারীরা মোক্ষম ধাক্কা খাবে, লালনের ‘লাথি’ সত্য হবে। কিন্তু হল কোথায়? আরও অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। জাতপাতহীন একটিই সমাজ এ পোড়া দেশে আর হবে না।