সাঁওতাল বিদ্রোহ 

সৌম্য মুখোপাধ্যায় 

ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন প্রবর্তনের পর দেশীয় সমাজে দুটি ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। একদিকে নগরাশ্রয়ী বুদ্ধিজীবীরা সমাজকে ভেতর থেকে পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের কাজে মনোনিবেশ করেছিল। অন্যদিকে দেশীয় গ্রামীণ অংশ ঔপনিবেশিকতাকে অস্বীকার করে ও তার বিরুদ্ধে হিংসাশ্রয়ী প্রতিবাদ জানায়। বস্তুতপক্ষে, এই দ্বিতীয় ধরনের প্রতিক্রিয়াটিই ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তিকে বেশ ভালোরকম নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। ঔপনিবেশিকতার সূচনালগ্নে গ্রামীণ সমাজের এই প্রতিক্রিয়াটিকে এরিক স্ট্রোক্স সহ অনেকেই ‘প্রাথমিক প্রতিরোধ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। 

এই প্রাথমিক প্রতিরোধের কারণ হিসাবে ঐতিহাসিক ড্যানিয়েল থর্নার এবং ডি এন ধনাগারে অষ্টাদশ শতকের শেষ ও ঊনবিংশ শতকের শুরুতে কোম্পানি সরকার কর্তৃক রাজস্ব সংস্কারের বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁদের মতে, এদেশে ঔপনিবেশিকতা আরোপের পর এক পিরামিড আকৃতি গ্রামীণ সমাজের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। আলোচ্য পিরামিডের উপরের অংশে ছিল সম্পন্ন জমিদারেরা, এবং পরবর্তী ধাপগুলিতে যথাক্রমে অনুপস্থিত মধ্যস্বত্বভোগী, ক্ষুদ্র জমির মালিক ও ভূমিহীন কৃষক। আবার ডেভিড হার্ডিম্যান জানাচ্ছেন ১৮৫৭-র পূর্বে ভারতীয় কৃষি সমাজ মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল; যথা, সম্পন্ন কৃষক বা ভূস্বামী, কৃষি খামারের মালিক এবং অসম্পন্ন কৃষক। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঔপনিবেশিক পর্বের সূচনায় এদেশে প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ কৃষকের কাছে জমির মালিকানা ছিল না। অথচ, এদের উপরই ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাত বেশি করে পড়েছিল ও তারই প্রতিক্রিয়ায় গড়ে উঠেছিল প্রাথমিক প্রতিরোধগুলি। মূলত এই বৃহত্তর প্রেক্ষিতেই মহাবিদ্রোহের অব্যবহিত পূর্বে সাঁওতাল বিদ্রোহের গতি-প্রকৃতি আলোচ্য। 

ভারতের ছ-টি বড়ো উপজাতি জনগোষ্ঠীর অন্যতম সাঁওতাল। জাতি হিসাবে এরা শ্রমপটু, দক্ষ শিকারি, সরলমতি ও শান্তিপ্রিয়। এদের আদি বাসভূমি নিয়ে নানা মত ও প্রবাদ থাকলেও ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কের ভাষ্য অনুযায়ী, পলাশির যুদ্ধের সমকালে এই উপজাতিগোষ্ঠীর বাস ছিল রাজমহল থেকে শুরু করে হাজারিবাগ ও মুঙ্গেরের সীমানার মধ্যবর্তী শ্বাপদসংকুল গভীর অরণ্যে। এই অরণ্য বিস্তৃত ছিল ভাগলপুর থেকে শুরু করে দক্ষিণে বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের পশ্চিমাংশ হয়ে উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ পর্যন্ত। তবে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে অগাস্টাস ক্লিভল্যান্ড রাজমহলের সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হয়ে এলে তিনি সাঁওতালদের সমতলে নেমে আসার আহ্বান জানালেন। পাহাড়ের প্রান্ত দেশে তাদের জন্য এক নতুন উপনিবেশ দামিন-ই-কো স্থাপনের চেষ্টা শুরু হল। কিন্তু তিলকা মাঝির মতো প্রতিবাদী সাঁওতালি জনগোষ্ঠী তাদের চিরাচরিত বাসভূমি ছেড়ে আসতে চায়নি। ফলে শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিবাদ। 

নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তিলকা মাঝিকে। পৈশাচিক অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকায় সাঁওতালরা তাদের পুরুষানুক্রমিক ভিটে ছেড়ে ধানবাদ, ঢাকা, পুরুলিয়া, মালদহ, দিনাজপুর, ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ, বারিপদা, কেওনঝড় ইত্যাদি স্থানে, এমনকি আসামের শিবসাগর, ডিব্রুগড়েও পালিয়ে আসে। কিন্তু এখানেও তাদের বসবাস নিরুপদ্রব ছিল না। সরকার ও জমিদারদের অত্যাচার ক্রমান্বয়ে বাড়ছিল। ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সাঁওতালদের দিয়েই জঙ্গল সাফাই করে নতুন বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা পুনরায় করা হল। নতুন দামিন-ই-কো প্রতিষ্ঠায় কোম্পানি সরকারের পক্ষ থেকে নানান প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়েছিল। কোম্পানি সরকার ঘোষণা করল যে, হাসিল করা জমির উপর প্রথম তিন বছর আর কর ধার্য করা হবে না, পরেও ধার্য করা হবে নামমাত্র কর, কৃষক যত খুশি জমি চাষ করতে পারবে। ১৮৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে জন পেটি ওয়ার্ড এবং তাঁর সার্ভেয়ার মি: ট্যনারের নেতৃত্বে দামিন-ই-কোর সীমানা নির্দিষ্ট হল। এই সীমানার মধ্যে ছিল ভাগলপুর, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমের ১৩৬৬.০১ বর্গমাইল জমি। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সেখানে প্রতিষ্ঠা হল ৪২৭ খানি সাঁওতালি গ্রাম। সচ্ছলতা না আসুক তাদের এই নতুন বাসভূমে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছিল।

তবে সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগেনি। ১৮৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে দামিন-ই-কো থেকে খাজনা সংগ্রহের পরিমাণ যেখানে ছিল ৬৬৮২ টাকা, সেখানে ১৮৫৪-৫৫ খ্রিস্টাব্দে তা বেড়ে দাঁড়াল ৫৮,০৩৩ টাকায়। এর পাশাপাশি খাজনা আদায়কারী নায়েব সুজোয়ালরা সাঁওতালদের কাছ থেকে নানা রকম সেস দাবি করত। বাড়তি খাজনা আর সেসের বোঝা চাপার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর বিস্তৃত হল মহাজনি জাল। অচিরেই এই অঞ্চলে থানা, আদালত বসল, সঙ্গে এল আমলা আর পুলিশ। সার্বিক অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার আশায় সাঁওতালরা সরকারের কাছে আবেদন করল। কিন্তু আবেদন নিবেদনে কোনও ফল হয়নি। এরপর সাঁওতালরা ডাকাতির পথ ধরল। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় দামিন-ই-কোর ছয়জন মহাজনের বাড়িতে পরপর ডাকাতি হল। সরকারপক্ষ এ নিয়ে আশঙ্কিত হয় এবং কিছু সুরাহার ব্যবস্থা অবলম্বন করে। কিন্তু এসব কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে সাঁওতালদের অবস্থা অপরিবর্তিতই রইল। বরং স্থানীয় দারোগা মহেশলালের প্রতাপও এসময় মাত্রা ছাড়া হয়েছিল। সাঁওতালদের ক্রোধের আগুনে এসবই ইন্ধনের কাজ করে।

সুতরাং ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের প্রাক্কালেই সার্বিক ঔপনিবেশিক অবস্থা সাঁওতালদের পক্ষে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সমসাময়িক ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকায় লেখা হয়, “Zamindars, the police, the revenue and court amlas has exercised a combined system of extortions, oppressive exactions, forcible dispossesion of property, abuse and personal violence and a variety of petty tyrannies upon the timid and yielding Santhals.” এমতাবস্থায় প্রতিবাদ জ্ঞাপন ব্যতীত সাঁওতালদের কাছে আর কোনও পথ খোলা ছিল না। ফলত, ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা শান্ত প্রদেশটিতে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। বিদ্রোহ নিজের মতো করেই তার নেতা নির্বাচন করে নেয়। যে সীমাহীন শোষণ ও উৎপীড়নের সাক্ষী ছিল সাঁওতালি সমাজ তাদের মধ্য থেকেই নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন দুই ভাই সিধু ও কানু। তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন যে সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে সাঁওতালদের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হবে না। সশস্ত্র বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই এই সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা পাবে। এই কর্মকাণ্ডে গোটা সাঁওতাল সমাজকে শামিল করতে তাঁরা উদ্যোগী হলেন।

সিধু ও কানু ঘোষণা করলেন যে ঈশ্বর স্বয়ং তাঁদের দেখা দিয়েছেন। ঈশ্বর সিধু ও কানুকে সাঁওতালদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে সরাসরি সরকারকে জমা দিতে বলেছেন। বলদের লাঙলের জন্য দু-আনা আর মোষের লাঙলের জন্য চার আনা খাজনা ধার্য করা হয়েছে। দামিন-ই-কোর সকল জমি সমস্ত সাঁওতালদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করতে হবে, মহাজনদের অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করতে হবে এবং জমিদারদের বসতবাড়ি ছাড়া অন্য সব সম্পত্তি কেড়ে নিতে হবে। গ্রামে গ্রামে তারা ঐতিহ্যগত শাল গাছের ডাল ‘গিরা’ পাঠালেন, জানালেন ঈশ্বরের আদেশ পেয়েই তাঁরা এ কাজে নেমেছেন। 

এ কারণেই কোনও কোনও ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের মধ্যে ধর্মের প্রত্যক্ষ ভূমিকা লক্ষ করেছেন। ক্যাথলিন গফ জানিয়েছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদ্রোহীদের যুক্তিনির্ভর করে তুলত ধর্ম। ধর্মই বিদ্রোহের ভাবাদর্শ গঠন করত। যেমন, বিদ্রোহ চলাকালে সিধু ও কানু ঘোষণা করলেন যে তাদের যুদ্ধ হল পাপের বিরুদ্ধে পুণ্যের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ঠাকুর নিজেই অবতীর্ণ হবেন এবং ফিরিঙ্গিদের মুণ্ডু কেটে ফেলবেন। ঠাকুরের দয়ায় ইংরেজদের বুলেট নিষ্ফল হবে, তাদের বুলেট থেকে জল বেরিয়ে আসবে। যারা এই যুদ্ধে নিহত হবে তারা ঠাকুরের দয়ায় আবার জীবন্ত হয়ে উঠবে। স্টিফেন ফুক্স সাঁওতাল বিদ্রোহকে ‘Messianic Movement’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং সিধু ও কানুকে ‘Rebellious Prophets’ বলেছেন। তবে রণজিৎ গুহ এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না। তাঁর মতে সিধু ও কানুর ঘোষণায় কতগুলি প্রতীক বারবার ব্যবহৃত হয়েছিল ঠিকই, আবার বিদ্রোহ শুরুর আগে ও ঠিক পরে গোটা সাঁওতাল পরগনা জুড়ে নানা ধরনের জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়েছিল যা কিনা বিদ্রোহের মানসিকতাকে বিপুলভাবে প্রসারিত করে। কিন্তু সিধু-কানুর আহ্বানকে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় বাণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যথাযথ নয়, বরং কীভাবে তা সাঁওতালদের অনুপ্রাণিত করেছিল সেটাই বিচার্য। যাইহোক, ধর্মীয় আবেগ সাঁওতালদের সমবেত হতে সাহায্য করল। সিধু কানুর আহ্বানে দলে দলে সাঁওতাল ভগনাডিহির উদ্দেশে রওনা হল। তাদের আশা এবার তাদের দুঃখ কষ্ট নির্মূল হবে। 

১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন। ভগনাডিহি গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এক বটগাছের তলায় সভা হল। প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল এই সভায় যোগ দিয়েছিল, এসেছিল দূরদূরান্তের অঞ্চল থেকে, যার মধ্যে ছিল প্রায় ৪০০ গ্রামের প্রতিনিধি। সভায় ঠিক হয় বহিরাগত ‘দিকু’-দের দামিন-ই-কো থেকে বহিষ্কার করা হবে। তবে কুমোর, তাঁতি, তেলি, কামার, ডোম, এদের সঙ্গে যেমন সহযোগিতার সম্পর্ক আগে থেকেই ছিল তা বজায় থাকবে। এখানেই রণজিৎ গুহ বিদ্রোহীদের সচেতনতার ও স্ব-কর্তৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্যস্বরূপ সামাজিক সংহতিবোধের উল্লেখ করেছেন। সাঁওতালরা বিদ্রোহের মুখ্য শক্তি হলেও সমগ্র নিম্নবর্গের মানুষকে বিদ্রোহে শামিল করার চেষ্টা এখানে দেখা যাচ্ছে। রণজিৎ গুহের মতে, আবার বিদ্রোহকালে যে কলাকৌশল বিদ্রোহীরা অবলম্বন করেছিল যেমন, ঢাক-ঢোল, শিঙার ব্যবহার, সিঁদুর মাখানো শাল গুঁড়ির ব্যবহার তা থেকে বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক চেতনার পূর্ণ আভাস পাওয়া যায়। এভাবেই সাঁওতাল বিদ্রোহ হয়ে উঠেছে সকল সম্প্রদায়ের গরিব মানুষের মুক্তিযুদ্ধ। 

যাইহোক, সভার আলোচ্য বিষয় সংবলিত একটি পত্র লেখার ব্যবস্থা হয়। কির্তা, ভাদু ও সুন্নো মাঝির লেখা সেই পত্র পাঠানো হয় ইংরেজ সরকার, ভাগলপুরের কমিশনার, কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট, বীরভূমের কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট, দিঘি ও টিকরি থানার দারোগা এবং বেশ কিছু সংখ্যক অত্যাচারী জমিদারের কাছে। চিঠির উত্তর দেওয়ার জন্য ১৫ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেউই চিঠির উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। 

এরপর সাঁওতাল বিদ্রোহীরা তাদের বাহিনী নিয়ে কলকাতা অভিমুখে যাত্রার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের ধারণা ছিল কলকাতায় গিয়ে গভর্নর জেনারেলদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেই তাদের সব সমস্যার সুরাহা হবে। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে এটাই সম্ভবত প্রথম গণপদযাত্রা। দারোগা মহেশ দত্ত এই অভিযানের খবর নিতে আসছিলেন। তাঁর সঙ্গী ছিল মানিকরাম মহাজন এবং বরকন্দাজ বাহিনী। ভগনাডিহির তিন মাইল দূরে পাঁচকাঠিতে সিধু ও কানুর বাহিনীর সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ ঘটে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর দারোগা সিধু ও কানুকে বাঁধবার হুকুম দিলেন। এতে আগুনে ঘৃতাহতি পড়ল। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারালেন দারোগা, মানিকরাম মহাজন, দুজন বরকন্দাজ ও কয়েকজন চৌকিদার। সব মিলিয়ে উনিশ জন অত্যাচারী সেদিন প্রাণ হারিয়েছিল। 

তারাপদ রায় সাঁওতাল বিদ্রোহের রোজনামচায় লিখছেন, রক্তপাত দিয়ে শুরু হওয়া সাঁওতাল বিদ্রোহ অচিরেই ভয়াবহ আকার নিয়ে ছড়িয়ে পড়ল। দারোগা হত্যার খবর পেয়ে প্রাথমিকভাবে ভাগলপুরের জেলাশাসক রিচার্ডসন কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়েন। তবে সেনাবাহিনী ডাকতে তিনি দেরি করেননি। জেনারেল লয়েডের নেতৃত্বে কোম্পানির সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাঁওতালদের মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু হয়। তির, ধনুক, টাঙ্গি, তরোয়ালের মতো সামান্য অস্ত্র নিয়ে বিশাল ব্রিটিশ বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের সঙ্গে তাদের লড়াই হয়। বিদ্রোহীদের অগ্রগতি ছিল বাঁধভাঙ্গা বন্যার মতো। গ্রামের পর গ্রাম তাদের দখলে চলে আসে। বিদ্রোহে সাঁওতালদের সঙ্গ দিয়েছিল স্থানীয় অসহায় বাঙালি ও বিহারি হিন্দু মুসলমান গরিব কৃষক ও কারিগরেরা। কারণ, জমিদার মহাজন ও ব্যাপারিদের শোষণ ও জুলুম তাদেরও কমবেশি ভোগ করতে হত। লড়াইয়ে তাদের স্বার্থ ও সাঁওতালদের স্বার্থ ছিল প্রায় অভিন্ন।  

সাঁওতালদের এই লড়াই শুধু কোম্পানির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই ছিল না। কোম্পানি সরকারকে সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন মুর্শিদাবাদে নবাব থেকে রানি রাসমণি পর্যন্ত সকলেই। এছাড়া স্থানীয় জমিদার মহাজনেরা তো ছিলই। ডাবলু ডাবলু হান্টারের ‘দি অ্যানালস অফ রুরাল বেঙ্গল’ গ্রন্থে এদেরকে ‘দেশভক্ত’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এইসব দেশ ভক্তদের যৌথ প্রয়াস সত্ত্বেও বিদ্রোহ অচিরেই বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও ভাগলপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি সৈন্য সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ আগস্ট বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের জন্য স্পেশাল কমিশনার এ সি বিডলয়েল একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করেন। এর দুদিন পর ১৯ আগস্ট মুনিয়া মাঝির বিশ্বাসঘাতকতায় সিধু মেজর সাকবার্গের হাতে ধরা পড়েন। 

তথাপি বিদ্রোহ চলতে থাকে। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর সমগ্র বীরভূম জেলা, ভাগলপুর, মুর্শিদাবাদের কিছু অংশ সামরিক আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। সেনাবাহিনীর অত্যাচার ভয়ানক হয়ে ওঠে। পরপর সাঁওতাল গ্রামগুলিকে পুড়িয়ে ফেলা হয়, নষ্ট করে ফেলা হয় তাদের খাদ্যশস্য নুন ও মাটির পাত্র। দলে দলে সাঁওতালকে বন্দি করা হয়। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে কানু ও তার দুই ভাই চাঁদ ও ভৈরবও ধরা পড়েন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর সরকারি ঘোষণা করা হয় যে, বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে দমন করা হয়েছে। ৩ জানুয়ারি ১৮৫৬-তে সামরিক আইন তুলে নেওয়া হয়। তথাপি সাঁওতাল যোদ্ধারা আত্মসমর্পণ করেননি। মেজর ভিনসেন্ট জারভিসের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, আত্মসমর্পণ কী, তা তারা জানে না, যতক্ষণ তাদের মাদল বাজতে থাকবে তারা সবাই মিলে দাঁড়িয়ে থাকবে, গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে না পড়া পর্যন্ত। 

এই বিদ্রোহের মূল শক্তি ছিল সাঁওতাল যুবকেরা। এমনকি কিশোর ও বৃদ্ধরাও অসীম সাহসের সঙ্গে ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। এদের পাশাপাশি সাঁওতাল রমণীদের কথা না বললেই নয়। ছেলে কোলে নিয়ে হাসিমুখে তারা জেল বরণ করেছিল। কোনও কোনও সাঁওতাল রমণী আবার নেতৃত্ব ভারও নিয়েছিল এবং সাঁওতাল সমাজে ‘ঠাকুরানির’ উচ্চ সম্মান লাভ করেছিল। এদের পাশাপাশি ছিল কামার, কুমোর, তেলি, তাঁতি, গোয়ালা প্রভৃতি অ-সাঁওতাল জাতির অংশগ্রহণ। কামারেরা ছিল সাঁওতালদের নিত্য সহচর। তাদের কারখানাগুলিতে সাঁওতালদের যুদ্ধাস্ত্র তৈরি হত। মুসলমান তাঁতিরাও সাঁওতালদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল। বীরভূমের কালেক্টরের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মহম্মদবাজারের গরিব বাঙালিরা সাঁওতালদের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল; তারা সাঁওতালদের লবণ, তামাক প্রভৃতি সরবরাহ করত।  

পরাধীন ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসনের সামন্ততান্ত্রিক শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ যে প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিল, তা বলাই বাহুল্য। বিদ্রোহের ব্যাপ্তির কারণে ব্রিটিশ পার্লামেন্টও তা নিয়ে আলোচনা করতে বাধ্য হয়। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, এমনকি আমেরিকাতেও সাঁওতাল বিদ্রোহের কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছিল। কার্ল মার্কসও তাঁর ‘নোটস অন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’-তে এই বিদ্রোহের কথা উল্লেখ করেছেন— “১৮৫৫-৫৬ বাংলার রাজমহল পর্বতমালায় অর্ধ আদিম অবস্থায় অবস্থিত সাঁওতালদের বিদ্রোহ; গেরিলা যুদ্ধের পর ১৮৫৬-এর ফেব্রুয়ারিতে দমন”।

সাঁওতাল বিদ্রোহ থামল ঠিকই, কিন্তু সাঁওতাল বিদ্রোহীরা কিছু মৌলিক প্রশ্ন তুলে ধরল। জমি যারা হাসিল করেছে, তাকে চাষযোগ্য করেছে, সেই জমি ও সেই ফসলের মালিক তারাই। যে দেশে তারা বাস করে, যার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিবিড়, সেই দেশের মালিকও তারা; এই দেশের সম্পদ ভোগ করার পূর্ণ অধিকার তাদেরই। ডি এন ধানাগড়ে বা নরহরি কবিরাজ এই বিদ্রোহকে প্রাক্-রাজনৈতিক বললেও সাঁওতাল বিদ্রোহে যে রাজনৈতিক চেতনা একেবারে ছিল না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। রণজিৎ গুহ এই বিদ্রোহের মধ্যে দ্ব্যর্থকতা, সংঘবদ্ধতা লক্ষ করেছেন এবং তারই ভিত্তিতে সাঁওতাল বিদ্রোহের সচেতনতা ও স্ব-কর্তৃত্ব বিশদে বিধৃত করেছেন। 

পাশাপাশি এ কথাও বলা প্রয়োজন যে, বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক বিপ্লব আনার পরিপক্কতা ছিল না। ঔপনিবেশিক আধা সামন্ততান্ত্রিক সমাজে এই পরিপক্কতা আশা করা অবান্তর। লেনিন তাঁর ঔপনিবেশিক থিসিসে লিখছেন, পরাধীন দেশের অধিকাংশ মানুষ যেহেতু কৃষক তাই এই দেশের মুক্তি আন্দোলন হবে মূলত কৃষকদের আন্দোলন। তবে এই কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করা, তাকে বৈজ্ঞানিক চেতনায় সমৃদ্ধ করা সহজ কাজ নয়। লেনিন লিখেছেন, এইসব দেশের ইতিহাসে অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ ঘটেছে, কিন্তু এগুলি স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করতে পারেনি। এইসব দেশের মুক্তি আন্দোলনকে জয়যুক্ত করতে হলে এই সব দেশের কৃষক আন্দোলনকে আদিম স্বতঃস্ফূর্ত চেতনা থেকে উন্নীত করে তাকে বৈজ্ঞানিক বৈপ্লবিক চেতনায় সঞ্জীবিত করে তুলতে হবে। 

সামগ্রিক বিচারে এ কথা বলা সংগত যে, সাঁওতাল কৃষক বিদ্রোহ সামগ্রিক সাফল্য লাভ না করলেও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায়নি। এরপর বিদ্রোহীদের দাবির অনেকটা অংশ সরকারকে মেনে নিতে হয়েছিল। বিদ্রোহের পর সরকার সংখ্যালঘু জাতি বলে সাঁওতালদের স্বীকৃতি দেয়। তাদের বসবাসের জন্য রাজমহল পর্বত সহ ভাগলপুর জেলার বিস্তীর্ণ অংশ নিয়ে সাঁওতাল পরগনা নামে এক নতুন জেলা গঠন করে, যেখানে সাঁওতালদের চাষাবাদের জমি দেওয়া হয়। পাশাপাশি, সাঁওতাল বিদ্রোহীরা যে আগুন প্রজ্বলিত করল, সেই আগুনের শিখা সারা ভারতের বহু স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ থেকে শুরু করে নীল চাষিদের বিদ্রোহ (১৮৬০-৬১), পাবনা ও বগুড়ার রায়ত অভ্যুত্থান (১৮৭২), দাক্ষিণাত্যের কৃষক অভ্যুত্থান (১৮৭৫-৭৬), বাংলার তেভাগা আন্দোলনেও (১৯৪৬-৪৭) এর উত্তাপ কমবেশি অনুভূত হয়েছে। আজও শোষিত মানুষের সংগ্রামে সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রেরণা অনস্বীকার্য। 

গ্রন্থ সহায়তা:

১) রণজিৎ গুহ, ‘এলিমেন্টারি আস্পেক্টস্ অফ পিসান্ট ইন্সার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া’

২) নরহরি কবিরাজ, ‘সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি’ 

৩) ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে, ‘সাঁওতাল গণ সংগ্রামের ইতিহাস’ 

৪) অরুণ চৌধুরী, ‘সাঁওতাল অভ্যুত্থান’ 

৫) পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা, ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ সংখ্যা’, ১৪০২

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান