‘টংক’ প্রথা-বিরোধী জনজাতি কৃষক আন্দোলন এবং নিম্নবর্গীয় ইতিহাসের অনুসন্ধান 

মুরারি মোহন রায়

ঔপনিবেশিক যুগে, পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলার গারো পার্বত্য উপত্যকা ছিল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধিশালী অনুন্নত কৃষিপ্রধান অঞ্চল। এখানকার সুসুং জমিদাররা উচ্চবর্ণের হিন্দু হলেও, কৃষকেরা ছিলেন জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ। হাজং, গারো, ডালু, বানাই, কোচ এবং হাদি সম্প্রদায়ের মানুষ এখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন যাদের প্রধান উপজীবিকা ছিল প্রধানত কৃষিকাজ, তাছাড়াও কিছু মুসলমান কৃষকও সংলগ্ন অঞ্চলে চাষাবাদ করতেন, কিন্তু হাজংরাই ছিলেন এই অঞ্চলে মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই সমস্ত কৃষকেরা দীর্ঘদিন ধরে নিষ্কর খাস জমিতে চাষাবাদ করতেন এবং বিনিময়ে জমিদারদের বিভিন্ন কাজে আবশ্যিকভাবে শ্রমদান (বেগার) করতে বাধ্য থাকতেন। কিন্তু ঔপনিবেশিক আধিপত্যের চাপে যখন স্থানীয় জমিদারদের এই পার্বত্য উপত্যকায় আয়ের উৎস ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে, তখন তাঁরা জনজাতির কৃষকদের শোষণ করে আয় বৃদ্ধির জন্য উচ্চহারে খাজনা আদায়ের বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন, যার অন্যতম একটি ছিল টংক প্রথা। এই প্রথা অনুসারে অতিরিক্ত হারে উৎপাদিত ফসল খাজনা হিসাবে আদায় করা হত, যার পরিণতি ১৯৩০ এবং ৪০’র দশকের টংক প্রথাবিরোধী কৃষক আন্দোলন। সমসাময়িক কালে বর্গাদার কৃষকদের তেভাগা আন্দোলন নিয়ে বিস্তর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ করা হলেও, অনুরূপভাবে বামপন্থীদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই জনজাতি কৃষক আন্দোলনের প্রতি ঐতিহাসিক ও গবেষকদের উদাসীনতা লক্ষণীয়। প্রমথ গুপ্ত, আবদুল্লাহ রসুল, সুশীল সেন, সত্যেন সেন এবং মণি সিংহ কমিউনিস্ট চিন্তাধারার আলোকে এই আন্দোলনের উপর প্রাথমিক চর্চার সূত্রপাত করেছেন, পরবর্তীকালে এই সব বামপন্থী রচনার ওপর মূলত নির্ভর করেই জ্ঞানব্রত ভট্টাচার্য, ডি এন ধানাগাড়ে এবং তাজ উল-ইসলাম হাসিম-এর মতো কয়েকজন গবেষক এই আন্দোলনের উপর আংশিকভাবে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন। উত্তর-উপনিবেশবাদের যুগে, ১৯৮০-এর দশক থেকে অবহেলিত জনজাতি এবং বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে নিম্নবর্গীয় চৈতন্যের অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন সাবঅল্টার্ন বিশ্লেষকরা, কিন্তু তাঁরাও এই আন্দোলনের ওপর কোনও আলোকপাত করেননি। এই পরিস্থিতিতে, টংক বিরোধী জনজাতি কৃষক আন্দোলনের মধ্যে নিম্নবর্গীয় চৈতন্যের অনুসন্ধান করতে হলে, এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, প্রসার এবং পরিণতির উপর পুনরালোচনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে হয়।

জনজাতি বিদ্রোহের প্রাক্-ঐতিহ্য ও প্রেক্ষাপট

আঠারো শতকের শেষ থেকে বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে ভাগচাষিদের উপর স্থানীয় জমিদারদের নিয়ন্ত্রণের সুযোগ ছিল প্রবল; আর এই আধিপত্য কায়েম রাখতে রাজস্ব আদায় এবং অতিরিক্ত অর্থ সংগ্রহের নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে বিভিন্ন সময়, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে যার কম-বেশি সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া দুরূহ নয়। পূর্ব বঙ্গের ময়মনসিংহ জেলায় শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং সহিংস সংগ্রামের সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারা রয়েছে, বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনাকাল থেকেই যা বহমান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলার এই অংশেও (উঃ ময়মনসিংহ) অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হয়েছিল [শেরপুর, সুসং এবং আলাপসিং পরগণা] (Sachse, 1917, p.100), যার ফলে ভূমি রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব স্থানীয় জমিদারদের হাতেই ছিল, আর আইন-শৃঙ্খলা ছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। এই সময় স্থানীয় জমিদাররা ভেতরে-বাহিরে, স্থানীয় কৃষকদের ওপর চাপ দিয়ে, তাঁদের ক্ষমতা ও আয় বর্ধনে সচেষ্ট ছিল বলে মনে করা হয়; এবং তাঁদের এই অভ্যন্তরীণ আয়ের একটি অন্যতম উৎস ছিল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধিশালী গারো পাহাড়, যা পরে(১৮৬৯) বিশেষ আইন প্রণয়ন করে ব্রিটিশরা নিজেদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে (Ellen, 2007, p.177)। ১৭৭০ থেকে ৯০’র দশকের মধ্যে ঐ অঞ্চলে যেমন সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের উত্তাপ ছড়িয়েছিল স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে (Schendel, 1985, p. 143), তেমনি পরবর্তী দুই শতকে ক্রমান্বয়ে একাধিক জনজাতি কৃষক বিদ্রোহ ছোট বড়ো আকার ধারণ করে। সুসং পরগণায় জোরপূর্বক-দিনমজুরি করানো জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকেরা প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল উনিশ শতকের প্রথমের দিকেই, যার একটি রূপ হাতিখেদা বিদ্রোহ। সুসং জমিদারদের একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা ছিল— পাহাড়ের পাদদেশ থেকে হাতি ধরে এনে অন্যত্র চালান করা; আর হাতি ধরার এই বিপজ্জনক বেগার কাজে তাঁরা হাজং উপজাতির মানুষদেরকে বাধ্য করতেন। ১৮২০’র দশকে মনা সরকারের (মতান্তরে সর্দার) নেতৃত্বে হাজং’রা এই বেগার প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, গারো জনজাতির মানুষেরাও তাঁদের সাথে এই আন্দোলনে যোগ দেন বলে জানা যায়। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই আন্দোলন চলার অনেক পরে এই বেগার (corvée) প্রথার বিলোপ ঘটে (Schendel, 1985, p.11)।

এই অঞ্চলে যে সমষ্টিগত হিংসার বিস্ফোরণ হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল—, ১৮২৫-৩৩’র বিদ্রোহ; যা সম্প্রসারিত উপনিবেশিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্থানীয় কৃষকদের চূড়ান্ত সম্মিলিত অবস্থানকে চিহ্নিত করেছিল বলে গবেষকদের অভিমত। উনিশ শতকের প্রথমের দিকে সংগঠিত এই অসন্তোষ পাগলপন্থী বিদ্রোহ হিসাবে চিহ্নিত, যা মূলত স্থানীয় জমিদারি শোষণের বিরুদ্ধে পরিচালিত হলেও উপনিবেশিক শাসনকে অগ্রাহ্য করার স্পর্ধা দেখিয়ে ছিল। উপনিবেশিক সরকার যুদ্ধের অজুহাতে (অ্যাংলো-বার্মা যুদ্ধ ১৮২৪-২৬) স্থানীয় শেরপুরের জমিদারদের মাধ্যমে নানা কর এবং অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের চেষ্টা করলে টিপুর নেতৃত্বে পাগলপন্থী ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়, আরও পরে ১৮৩৩’এ এই সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জানকু পাথর আর দুবরাজ পাথর। এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল শোষণ এবং নিপীড়ন থেকে অব্যাহতি; বিদ্রোহী কৃষকেরা তখনও জমিদারি প্রথার সম্পূর্ণ বিলোপের দাবি করেনি, তাঁরা চেয়েছিলেন উদ্বৃত্ত নিষ্কাশনের যে নিপীড়নমূলক পদ্ধতি সেটা শিথিল করা হোক, অধিকন্তু তাঁরা টিপুর মতো এক জন জমিদারের প্রতি আনুগত্য প্রদানে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু উপনিবেশিক শাসক আর স্থানীয় শোষক জমিদার কেউ তা সমর্থন করেনি, বরং সামরিক উপায়ে তাঁদের ইচ্ছা এবং অসন্তোষকে শেষপর্যন্ত দমন করা হয় (Schendel, 1985)।

পাগলপন্থী বিদ্রোহের পর, অর্থাৎ ১৮৩০’র দশক থেকে ময়মনসিংহের এই উত্তরাঞ্চলে স্থানীয় বিষয়ে উপনিবেশিক রাষ্ট্রের আধিপত্য ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে, ফলে স্থানীয় জমিদারদের আয়ের উৎস হ্রাস পাওয়ার মতো পরিস্থিতি উদ্ভূত হয় । ১৮৬৯’এ গারো পার্বত্য আইন (Garo Hills Act XXII) প্রণয়ন করে প্রাকৃতিক প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ গারো পার্বত্য অঞ্চলকে সরাসরি উপনিবেশিক রাষ্ট্রের অধীনে এনে অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন বিশেষ অঞ্চলে রূপান্তরিত করা হলে জমিদারদের অভ্যন্তরীণ আয়ের উৎস কমে যায়, এবং তারপর স্থানীয় ভূস্বামীরা সাধারণ জমিদারে রূপান্তরিত হন (Ellen, 2007, p.177)। তখন তাঁরা স্থানীয় কৃষক ও জনজাতির উপর থেকে অধিক রাজস্ব এবং অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের বিভিন্ন সামন্ততান্ত্রিক উপায় অবলম্বন করতে শুরু করেন। সুসং জমিদারিতে টংক প্রথা, শেরপুর পরগণায় নানকর ও ভাওয়ালী, এছাড়াও খামার প্রথার মাধ্যমে জনজাতির কৃষকদের ওপর শোষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জমিদারি আয় সুনিশ্চিত করা হয়। তাছাড়া এই অঞ্চলে বেগার শ্রম আদায়ের প্রচলন ছিল বহুকাল থেকেই (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৫৭-৬৬)। তবে নিবন্ধের প্রাসঙ্গিকতায় টংক প্রথার ওপরেই আলোচনা সীমাবদ্ধ করা বাঞ্ছনীয় হবে। 

গারো পার্বত্য আইন (১৮৬৯) প্রণয়নের পর, জনজাতির কৃষকদের উপর স্থানীয় জমিদাররা খাজনা আরোপে উদ্যোগী হন; সুসুং পরগণায় উৎপাদিত ফলনের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা হিসাবে দিতে বাধ্য করা হয়, যা টংক বা ‘ধান কাড়ারি’ নামে পরিচিত। এর পাশাপাশি হাজং জনজাতির পুরুষদের জমিদারের লাঠিয়াল হিসাবে কাজ করানো হত এবং তাঁদের বিপজ্জনক হাতি ধরার কাজেও বাধ্য করা হত। টংক বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা মণি সিংহ জানাচ্ছেন— ইতিপূর্বে উপজাতিদের কোনও খাজনা ছিল না, কারণ তাঁরা জমিদারদের জন্য জঙ্গল থেকে হাতি ধরে এনে দিত; কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এই ‘হাতি-খেদা’ বন্ধ করে দিলে জমিদাররা ১৮৯০ থেকে টংক প্রথার মাধ্যমে খাজনা আদায় শুরু করে (সিংহ, ২০১৫, পৃ.২৬)। এই প্রথা অনুসারে, নগদ অর্থের পরিবর্তে পূর্বনির্ধারিত নির্দিষ্ট পরিমাণ উৎপাদিত শস্যে জমিদারকে খাজনা মেটাতে বাধ্য হতেন কৃষকেরা, যার পরিমাণ ছিল একর প্রতি ৬ থেকে ১০ মন (মতান্তরে আরও বেশি) (Sachse, 1917, p.75)। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কীট-পতঙ্গের বা বন্যপশুর আক্রমণ অথবা অন্য কোন কারণে শস্যহানি হলেও ধার্য খাজনা পরিশোধে তাঁদের দায়বদ্ধ থাকতে হত, এমন পরিস্থিতিতে তাঁদের শস্য ক্রয় কিংবা কর্জ করে জমিদারকে তা শোধ দিতে হত, অথচ জমিদাররা এই কৃষিকার্যের কোন সাহায্য কিংবা ব্যয়ভার বহন করতেন না। এই প্রথায় জমিদাররা প্রতিবছর নতুন করে ক্রমাগত উচ্চহারে খাজনা নির্ধারণ করতেন এবং ইচ্ছে মতো একজনের থেকে অপরজন কৃষকের কাছে জমির পত্তনি হস্তান্তর করে দিতেন, ফলে জমিতে কৃষকদের কোন দখলদারি বা রায়তি সত্ত্ব ছিলনা; এমনকি এই বার্ষিক খাজনা নিরূপণ একসময় নিলামের পর্যায়ে পোঁছে গিয়েছিল বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। এই টংক প্রথা–বিরোধী আন্দোলনের একজন বামপন্থী নেতা প্রমথ গুপ্ত জানিয়েছেন, ‘এই টংক প্রথার শোষণের তীব্রতা কতটা গভীর ছিল তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে লেঙ্গুরা মৌজায়। শুরুতে এই মৌজার স্থিত ছিল মাত্র ৬৩ টাকা, তাহাই ১৯৪০ সালে দাঁড়ায় ৫ হাজার টাকায়।’ (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৫৯) তাঁর মতে, টংক চাষিদের উৎপাদিত শস্যের অর্ধেকই জমিদারকে খাজনা বাবদ দিয়ে দিতে হত, এমনকি বকেয়া টংক ধান পরের বৎসর আদায় করা হত সুদ সহ, অক্ষম চাষিদের গবাদি পশু সহ ঘর গৃহস্থের সামগ্রী ক্রোক করে নেওয়া হত। সুসং পরগণার মূলত হাজং, এছাড়া ডালু ,গারো এবং মুসলমান কৃষকেরা এই প্রথার শিকার হয়েছিলেন বলে জানা যায়। মণি সিংহ জানাচ্ছেন, টংকাদারদের সোয়া একর জমির জন্য বছরে ৭ থেকে ১৫ মন ধান দিতে হত, অথচ জোত-জমির খাজনা ছিল ৫-৭ টাকা মাত্র, আর ধানের দর ছিল মন প্রতি সোয়া ২ টাকা; ফলে টংক চাষিদের ১১-১৭ টাকা পর্যন্ত বাড়তি খাজনা দিতে হত (সিংহ, ১৯৮৬, পৃ.৩৫২)। ১৮৯০ থেকেই হাজংরা এই সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরোধিতা করে এসেছিলেন, কিন্তু ১৯৩০’র দশকের আগে তাঁদের সেই প্রতিবাদ সেভাবে জোরালো হয়ে ওঠেনি। একদিকে গারো পাহাড়ের ওপর লাভজনক অধিকার খর্ব হওয়া, ওপর দিকে হাতি খেদার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া— এই দ্বৈত আর্থিক ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে উত্তর ময়মনসিংহের সুসুং জমিদাররা টংক প্রথাকেই তাঁদের আয়ের অন্যতম উৎসে পরিণত করেন, যার ফলে তাঁদের শোষণ ও নিপীড়নের অন্যতম প্রধান শিকার হয়ে ওঠেন জনজাতির কৃষকেরা। এই শোষণের চরম পরিণতি, টংক প্রথার বিরুদ্ধে হাজংদের আবার এক কৃষক আন্দোলন, যা এই আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয়। 

বিদ্রোহ, বিস্তার ও বিন্যাস 

পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাংশে, সুসুং দুর্গাপুরকে কেন্দ্র করে, গারো পাহাড়ের পাদদেশে ৭০মাইল লম্বা ৫০ মাইল প্রশস্ত এলাকা জুড়ে টংক প্রথা বিরোধী আন্দোলন চলেছিল। আন্দোলনকারী সংখ্যা গরিষ্ঠ জনজাতির মানুষেরা ছিলেন হাজং কৃষক, তাই একে ‘হাজং বিদ্রোহ’ বলা অসংগত হবে না। এই অভ্যুত্থানে যোগ দিয়েছিলেন– স্থানীয় মুসলমান কৃষক এবং কিছু সংখ্যক গারো ও ডালু সম্প্রদায়ের মানুষেরাও। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতা মণি সিংহ এবং প্রমথ গুপ্তের রচনা এবং সাক্ষাৎকার থেকে এই আন্দোলনের বিস্তারিত ধারাবিবরণী পাওয়া যায়, যা পরবর্তীকালে কয়েকজন ঐতিহাসিক ও গবেষক তাঁদের বিশ্লেষণে তুলে ধরেছেন। কিন্তু একথা আশ্চর্যের হলেও সত্য যে, হাজং জনজাতির মধ্যে তাঁদের এই সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস রচনার প্রয়াস আজও বিশেষ লক্ষ করা যায় না। ১৯৩৭’এ এই বিদ্রোহ সংগঠিত হলেও চলেছিল ব্রিটিশদের ক্ষমতা হস্তান্তরের পরেও ১৯৫০ পর্যন্ত এবং এই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ধারা শেষপর্যন্ত সমবেগ সম্পন্ন ছিল না। কমরেড মণি সিংহ এই আন্দোলনকে ত্রিস্তরীয় পর্যায়ে বর্ণনা করেছেন, যথা, প্রথম পর্যায়(১৯৩৭-৪৫) নিয়মতান্ত্রিক, দ্বিতীয় পর্যায়(১৯৪৬-৪৭) সশস্ত্র সংগ্রামী, এবং তৃতীয় বা শেষ পর্যায় (১৯৪৮-৫০) জঙ্গিবাদী। অধ্যাপক জ্ঞানব্রত ভট্টাচার্য টংক বিরোধী আন্দোলনের প্রথম আট বছরকে ত্রিধা–বিভক্ত করেছেন; ১) সংস্করণ পর্ব ১৯৩৭-৩৯,(reformist phase) ২) প্রতিরোধ পর্ব ১৯৩৯-৪২, (resistance phase) ৩) বিদ্রোহী পর্ব ১৯৪২-৪৫ (insurrectionist phase)। (Bhattacharyya, 1978, p.613) ১৯৩৭’র নভেম্বরে মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব অতিক্রম করে কমরেড মণি সিংহ, বামপন্থী ভাবাবেগে স্থানীয় টংকাদার কৃষকদের সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করে একটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করেন, যিনি একাধারে ছিলেন বাংলার বামপন্থী কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন অন্যতম শরিক এবং শ্রমিক আন্দোলনের নেতা, অপরদিকে তিনি নিজেই ছিলেন সুসং জমিদার বংশেরই একজন। তিনি প্রাথমিক ভাবে ‘অহিংস– আইনসংগত’ উপায়ে এই আন্দোলন পরিচালনার পরিকল্পনা করেন, এবং স্থানীয় চাষিদের জমিদারকে টংক ধান দিতে বন্ধ করার নির্দেশ দেন। তাঁর নেতৃত্বে আন্দোলনের দাবিগুলি ছিল নিম্নরূপ—

১। টংক প্রথার অবসান, ২। টংক জমিতে রায়তি স্বত্ব প্রতিষ্ঠা, ৩। জোত জমির নিরিখে টংক জমির খাজনা নিরূপণ, ৪। বকেয়া টংক খাজনা মকুব, ৫। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, এবং সর্বোপরি ৬। সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসসাধন। (সিংহ, ১৯৮৬, পৃ. ৩৫৪)

আন্দোলনকারীরা ডেপুটেশনের মাধ্যমে তাঁদের দাবিদাওয়া নবনির্বাচিত হক-মন্ত্রীসভার (ফজলুল হক) কাছে প্রেরণ করে। খাজনা দেওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এলাকায় পুলিশ আসে, তথাপি নেতৃত্বের নির্দেশ মেনে, টংক প্রথা বিরোধী চাষিরা কেউ খাজনা মেটাতে সম্মত হয়নি। কমরেড সিংহ জানিয়েছেন, শেষপর্যন্ত জমিদাররা এক-চতুর্থাংশের বেশি ধান আদায় করতে পারেনি (সিংহ, ২০১৫, পৃ.৫৮)। জনজাতি অধ্যুষিত এই পার্বত্য উপত্যকায় কমিউনিস্টদের ক্রমশ প্রভাব বৃদ্ধি সরকারকে হয়তো কিছুটা উদ্বিগ্ন করেছিল, তাই অনতিবিলম্বে ১৯৩৮’র এপ্রিল নাগাদ সরকার জরিপ করে টংক খাজনা পুনর্নির্ধারণে উদ্যোগী হয়। জমি জরিপের পর টংক খাজনা অর্ধেক বা তারও কম করে দেওয়া হয়। এই ভাবে টংক প্রথার কিছুটা সংশোধন করা হলেও, এই প্রথা একেবারে রদ করা হলনা, তাই জ্ঞানব্রত ভট্টাচার্য ১৯৩৭-৩৯ সময়কালকে ‘সংস্করণ’ পর্ব হিসাবে বর্ণনা করেছেন। (Bhattacharyya, 1978)

টংক খাজনা কিছুটা হ্রাস করে পুনঃনির্ধারণ করা হলেও নগদ অর্থে খাজনার তুলনায় তার হার অনেকটাই বেশি ছিল এমনটাই দাবি করা হয়, তবে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এলাকায় কমিউনিস্টদের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ব্রিটিশদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কমিউনিস্টরা ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ’ হিসাবে সর্বত্র বিরুদ্ধ প্রচার চালায়, এবং এই পরিস্থিতি টংক আন্দোলনকে ‘প্রতিরোধ’ পর্বের দিকে এগিয়ে দেয়। উঃ ময়মনসিংহেও কৃষকেরা ‘যুদ্ধ তহবিলে’ চাঁদা দিতে অস্বীকার করে এবং তাঁরা সামরিক বাহিনীতে যোগদানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। (Bhattacharyya, 1978) কিন্তু ১৯৪১’এ সোভিয়েত রাশিয়া বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে অংশগ্রহণের পর, এই যুদ্ধকে কমিউনিস্টরাই ‘জনযুদ্ধের’ আখ্যা দেয়। বিশ্বযুদ্ধের প্রতি কমিউনিস্টদের এই অবস্থান বদল নিয়ে হয়তো অনেক বিতর্কের অবকাশ রয়েছে, তবে তা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। তারপর বামপন্থীরা বিশ্বযুদ্ধের সমর্থনে জনমত আদায় করতে শুরু করে এবং বিভিন্ন আর্থিক সহযোগিতা সহ সামরিক বাহিনীতে জনগণকে যোগ দিতে উৎসাহিত করে। জ্ঞানব্রত ভট্টাচার্য মনে করেন কমিউনিস্টদের সাথে সরকারের এই আপাত বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই আন্দোলনের তৃতীয় পর্ব অর্থাৎ ‘বিদ্রোহের’ পথ প্রশস্ত হয়; কারণ এই সময় বামপন্থীরা বিনা বাধায় তাদের সংগঠনকে আরও বলিষ্ঠ এবং সুপ্রশস্ত করার সুযোগ পেয়েছিল (Bhattacharyya, 1978, p.614)। টংক আন্দোলনের নেতা প্রমথ গুপ্ত জানাচ্ছেন, ১৯৪২’র মার্চ থেকে ১৯৪৫’র জানুয়ারির মধ্যে ময়মনসিংহের এই পার্বত্য উপত্যকায় বিস্তৃত বৈপ্লবিক প্রশাসন সহ একটি ‘মুক্তাঞ্চল’ গঠিত হয়, যাদের নিজস্ব গণ-আদালত এবং গণবাহিনী ছিল। এই মুক্তাঞ্চলে টংক খাজনা দেওয়া কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪০’র দশকে এই অঞ্চলে কমিউনিস্টদের অধীনে পূর্ব (সুসং), পশ্চিম (নালিতাবাড়ি) এবং মধ্য (হালুয়াঘাট) এই তিনটি আঞ্চলিক কমিটি গঠিত হয়, এবং সমগ্র অঞ্চলের জন্য সাত জন সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চতর কমিটি ছিল। সামরিক এবং অসামরিক উভয় ক্ষেত্রে সামগ্রিক ভাবে এই সংগঠনকে প্রস্তুত করা হয়েছিল আন্দোলনের জন্য, এমনকি তাঁদের নিজস্ব আগ্নেয়াস্ত্রের গুপ্ত কারখানা ছিল বলেও জানা যায় (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ. ১০৫)। এইভাবে উত্তর ময়মনসিংহের পাঁচটি থানার উত্তরাংশে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে জনগণ পরিচালিত স্বাধীন, স্বতন্ত্র এবং একটি সমান্তরাল সরকার গঠিত হয়েছিল ওই মুক্তাঞ্চল’কে কেন্দ্র করে। কমরেড গুপ্ত লিখছেন, ‘এই অঞ্চলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও জনগণের সমস্ত রকম কাজকর্মে বিপ্লবী কমিটিগুলি কর্তৃত্ব করিতে লাগিল। সরকারের থানা পুলিশ সাক্ষীগোপালের মতো দাঁড়াইয়া রহিল। অনেক ক্ষেত্রে জনগণের নির্বাচিত কমিটিগুলির নিকট আত্মসমর্পণ করিল এবং তাহাদের নির্দেশ মানিয়া চলিতে বাধ্য হইল।’ (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৬৪-৭৩)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯৪৬ থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে পুনরায় টংক আন্দোলন শুরু হয়। ব্রিটিশ সরকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ব্যাস্টিনের নেতৃত্বে পুনরায় ঐ মুক্তাঞ্চলে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়ে ওঠে। এলাকায় বিভিন্ন সামরিক ছাউনি ছাড়াও থানায় সামরিক বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বকেয়া টংক খাজনা আদায়ের জন্য নোটিশ জারি করা হয় এবং বিভিন্ন বামপন্থী নেতৃত্বের নামে পুনরায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এলাকার টংকাদার কৃষকদের বামপন্থী নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য এতটাই জোরদার ছিল যে, তাঁরা সরকারকে পুনরায় টংক খাজনা পরিশোধ করতে অস্বীকার করে। এরপর আন্দোলন তার নিয়মতান্ত্রিক পথ পরিত্যাগ করে সশস্ত্র প্রতিরোধের পথে অগ্রসর হয়। বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতিপূর্বে তাঁরা সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়েছিলেন যা এই আন্দোলনে তাঁদের মনোবল বৃদ্ধি করে। এই সময় ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে সেনাদল গ্রামের আন্দোলনরত এবং সাধারণ কৃষকদের সম্পত্তি লুট করে এবং কোথাও গ্রাম ধ্বংস করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, এমনকি বাড়ির মহিলাদের সম্মানের উপরেও এই নৃশংস অত্যাচারের আঁচ এসে পড়ে। কমরেড গুপ্ত বলছেন, “ভয়াবহ ধ্বংসলীলা ও অত্যাচারের তাণ্ডবের মধ্যেও কিন্তু বিপ্লবী চেতনা সম্পন্ন চাষিরা গ্রাম ত্যাগ করিল না। সুযোগ সুবিধা মতো তির-ধনুক, চেওয়ার, বল্লম ও দা লইয়া ইংরেজ শক্তিকে প্রতিরোধ করিতে লাগিল।” (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৮২) এই আন্দোলনে হাজং নারীরাও পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে এগিয়ে আসে। রাসমণি হাজং এর বীরত্বের কাহিনি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে, যিনি এক হাজং রমণীকে বাঁচাতে গিয়ে পুলিসের হাতে শহিদ হয়েছিলেন। 

এরপর থেকে হাজং আন্দোলনে আন্দোলনরত কৃষকদের সাথে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর একাধিক খণ্ডযুদ্ধ হয়। কখনও সম্মুখ সংগ্রাম, কখনো–বা পুলিশের ওপর গেরিলা কায়দায় অতর্কিত হামলা চালানো হয়, এবং এতে উভয়পক্ষের মানুষজনই হতাহত হলেও বিপ্লবী কৃষকদের প্রাণ যায় অনেক বেশি। সরকারী পুলিশ ও সেনাবাহিনী অত্যন্ত নৃশংস উপায়ে বিপ্লবীদের ওপর আক্রমণ চালাত, আর বিপ্লবীরাও সশস্ত্র উপায়েই তাঁদের জবাব ফিরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তাঁরা কখনো আত্মরক্ষার জন্য আক্রমণ করতেন, কখনো–বা আক্রমণাত্মক হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালাতেন, ফলে সমগ্র এলাকা জুড়ে সর্বত্র একটি সন্ত্রাসের আবহ তৈরি হয়েছিল। কমরেড মণি সিংহ এবং কমরেড প্রমথ গুপ্তের লেখায় সশস্ত্র সংগ্রামের সেই রক্তাক্ত দিনগুলি লিপিবদ্ধ আছে। তবে নৃশংস হত্যা, লুটতরাজ, গ্রেপ্তারি চালিয়েও ব্রিটিশ সরকার শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনকে দমন করতে ব্যর্থ হয়েছিল।   

১৯৪৭-এ ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ময়মনসিংহ তথা পূর্ববঙ্গের এই এলাকাটি পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত হয়। বিপ্লবী এবং কৃষকেরা আশা করেছিলেন এবার সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে, অর্থাৎ জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ সহ টংক প্রথার অবসান হবে। কিন্তু “লীগ সরকার জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ তো করলই না বরং ঐক্যবদ্ধ কৃষকদের দাবি উপেক্ষা করিয়া বলপূর্বক পুলিশের সাহায্যে টংক ধান এবং লেভি আদায়ের নির্দেশ দিল”। (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৮৯) এরপরে আরও অনেক কৃষক এবং বিপ্লবীদের আত্মবলিদান দিতে হয় তাঁদের কাঙ্ক্ষিত দাবি আদায় করতে। এই তৃতীয় বা শেষ পর্যায়ে বিদ্রোহ আরও আক্রমণাত্মক এবং জঙ্গি আকার ধারণ করে। এবার বিপ্লবী কৃষকেরা কেবলমাত্র তাঁদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করেই থেমে রইল না, তাঁরা সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে জমিদারের কাছারি এবং পুলিশের থানাগুলো ক্রমশ দখল করে নিতে শুরু করল। চৈতন্যগড়ের জমিদার কাছারি যেমন বিদ্রোহী কৃষকরা দখল করে নেয়, তেমনই কলমাকান্দা থানার ছয় নাম্বার লেঙ্গুর ইউনিয়নও বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায় (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৯২)। বিদ্রোহী কৃষকেরা জমিদারদের আদায়কৃত ধান লুট করে সাধারণ জনতার মধ্যে বিলিয়ে দিত। পূর্ববঙ্গের এই টংক প্রথাবিরোধী হাজং বিদ্রোহ তেভাগা আন্দোলনের সাথে এই সময় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, কারণ উভয় আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল কমিউনিস্টদের দ্বারা। ১৯৪৯-৫০ নাগাদ এই আন্দোলন একটি অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। একদিকে পূর্ব–বঙ্গ জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আন্দোলনরত কৃষকদের ঐক্য কে দুর্বল করে দেয়, অপরদিকে লীগ সরকার উত্তর ময়মনসিংহের ওই অঞ্চলে মুসলমান অনুপ্রবেশকারী (মোহাজের) ঢুকিয়ে জনজাতির মানুষদের ক্রমশ উৎখাত করতে থাকে। কমরেড গুপ্ত জানাচ্ছেন, সীমান্তবর্তী ইউনিয়নগুলির দেড়শটি গ্রাম থেকে উপজাতি কৃষকদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা হয় (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.১১৬)। পাকিস্তানের নুরুল আমিন সরকার মনে করেছিল, কমিউনিস্টের আন্দোলন সরকারকে উচ্ছেদ করার আন্দোলন, তাঁরা পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলতে চায়; কিন্তু কমরেড সিংহের মতে, তাঁদের আন্দোলন ছিল সামন্ত প্রথার বিরুদ্ধে, টংক প্রথা উচ্ছেদের জন্য এবং জমিদার প্রথার অবসানের উদ্দেশ্যে। তাঁরা যখন বুঝতে পারেন, জনগণকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, পার্টির সাথে জনগণের সম্পর্ক ছিন্ন হচ্ছে, তখন আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া হয়। এইভাবে নারকীয় হত্যা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং সুপরিকল্পিত উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি সুদীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটে (সিংহ, ১৯৮৬, পৃ. ৩৭৭), এবং সেই সঙ্গে সাংবিধানিকভাবে জমিদারি প্রথার অবসানও ঘটে ঐ বছর। 

কমিউনিস্টদের ভূমিকা

আন্দোলনের সংগঠক, পরিচালক এবং নিয়ন্ত্রক ছিলেন একমাত্র কমিউনিস্টরা। প্রথমের দিকে নানা দ্বিধা দ্বন্দ্ব, এবং মানসিক সংকোচের মধ্যে থেকেই মুষ্টিমেয় কিছু কমিউনিস্ট নেতা এগিয়ে এসেছিলেন কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য, আবার বিরোধিতাও করেছিলেন কেউ কেউ। সময়টা তখন ১৯৩০ দশকের মাঝামাঝি, কলকাতার বাইরে তখনও কমিউনিস্টদের সাংগঠনিক বিস্তার ঘটেনি; সেই সময় প্রভাত চক্রবর্তী, উপেন সান্যাল এবং মণি সিংহের মতো গুটিকয়েক কমিউনিস্ট নেতা এগিয়ে এসেছিলেন সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে এবং পরে রাজনৈতিক ভাবে হাজং কৃষকদের সংগঠিত করতে (সিংহ, ২০১৫, পৃ.৩২-৩৫)। ১৯৩৮ নাগাদ পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা হয়, যদিও রাজনৈতিক ভাবে জনসংযোগ গড়ে তোলার জন্য জেলা কমিটি গঠন করতে সময় লেগে গিয়েছিল আরও কয়েক বছর, সেই সময়টা ছিল ১৯৪২ (সিংহ, ২০১৫, পৃ.৬০, ৬৬)। এই ভাবে ওই এলাকায় কমিউনিস্টদের প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে, এবং সেই সাথে বাড়তে থাকে তাঁদের উপর সাধারণ টংকাদার কৃষকদের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং রাজনৈতিক আস্থা। ১৯৪৩ এবং ১৯৪৫এ একটি প্রাদেশিক এবং অপরটি সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলন হয় ওই অঞ্চলে। এই বিপুল এবং বর্ণাঢ্য জনসমাগমে কমিউনিস্টরা তাদের প্রতি স্থানীয় জনজাতি কৃষকদের বিপুল সক্রিয় সমর্থন প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নারী পুরুষ নির্বিশেষে হাজং উপজাতির মানুষেরা এই এই সম্মেলনগুলিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৭৫-৭৯) (সিংহ, ২০১৫, পৃ.৬৮-৬৯, ৭০-৭৫)। আন্দোলনকারী কৃষকদের উপর কমিউনিস্টের নিয়ন্ত্রণ ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ়। কমরেড মণি সিংহ ১৯৪৬ সালের একটি ঘটনায়, তিনি কীভাবে একদল উন্মত্ত জনতার গণরোষ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তা নিজের রচনায় তুলে ধরেছেন (সিংহ, ২০১৫, পৃ.৭৯-৮৪)। ১৯৪০ দশকের মাঝামাঝি অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে ময়মনসিংহে তাঁরা যে মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলেছিলেন সেখানে সামরিক ও অসামরিক ভাবে একটি স্বনির্ভর ও সুসংহত পরিচালন ব্যবস্থাও গড়ে তুলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর একদিকে ছিল গণ আদালত, ধর্মগোলা, খাদ্য সরবরাহ–সহ জন পরিষেবা প্রদানকারী বিভিন্ন পরিকাঠামো, অপরদিকে গেরিলা কায়দায় প্রশিক্ষিত –একটি সুবিশাল সামরিক বাহিনীও তাঁরা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৬৭-৭২); এমনকি ১৯৪৩’র দুর্ভিক্ষের সময় তাঁরা এই অঞ্চলে খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সফল হয়েছিলেন বলে দাবি করেন (সিংহ, ২০১৫, পৃ.৬৭)। মূলত তিনটি পর্যায়ে তাঁরা সমগ্র আন্দোলনটি-কে পরিচালনা করেছিলেন; বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত তাঁদের এই আন্দোলন ছিল সুনিয়ন্ত্রিত ও নিয়মতান্ত্রিক পথে পরিচালিত, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের পর এই আন্দোলন সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। আরও পরে অর্থাৎ ১৯৪৮ থেকে এই বিদ্রোহ জঙ্গি রূপ ধারণ করেছিল। বি. টি. রণদিভের নীতি অনুসরণ করে এই সশস্ত্র জঙ্গিবাদের পথ অনুসরণের জন্য কমরেড মণি সিংহ পরে অনেক আফসোস করেছেন এবং তিনি স্বয়ং এই নীতির সমালোচনাও করেছেন তাঁর রচনায়। তিনি মনে করেন, ভারত কিংবা পাকিস্তানের জনগণ এই জঙ্গিবাদী আন্দোলনের জন্য তখনও সেভাবে প্রস্তুত ছিল না, যার পরিণামে আন্দোলনকারীরা পাকিস্তানির সরকারের দ্বারা নির্মম অত্যাচারের শিকার হন এবং শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন বন্ধ করে দিতে তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন। তাই তিনি একে একটি নীতিগত ভুল পথ হিসাবেই মনে করেন (সিংহ, ২০১৫, পৃ.১০০-০২, ১১৬-১৮)।

টংক আন্দোলনে উপজাতি কৃষকদের পাশাপাশি গৃহস্থের সাধারণ মহিলারাও এগিয়ে এসেছিলেন এবং বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। পুলিশি গ্রেফতারের আশঙ্কায় বাড়ির পুরুষেরা যখন আত্মগোপন করতে বাধ্য হতেন, তখন পুলিশি অত্যাচারের সামনে হাজং নারীরা অতি সাধারণ অস্ত্র নিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এগিয়ে এসেছিলেন, এবং কখনও কখনও তাঁরা এই আন্দোলনে শহিদও হয়েছেন। রাসমণি, শঙ্খমণি, রেবতীর মতো অতি সাধারণ রমণীরাও এই আন্দোলনে বীরাঙ্গনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। কমিউনিস্টরা এই অঞ্চলে ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ গঠন করেছিলেন আন্দোলন এবং প্রচারের স্বার্থে, যা জনজাতি মহিলাদের মধ্যে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল। ১৯৪৩’র অক্টোবর মাস নাগাদ ময়মনসিংহের প্রায় সকল মহকুমায় এই মহিলা সমিতির শাখা কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। আন্দোলন ছাড়াও মহিলাদের অধিকার, বিবাহ এবং ‘হিন্দু কোড বিল’ নিয়ে এই মহিলা সমিতি প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত বৈঠক করত বলে জানা যায়। বীরাঙ্গনা রাসমণি ও শঙ্খমনিরা ছিলেন এই সমিতির অন্যতম সদস্য। কমরেড প্রমথ গুপ্ত লিখেছেন- ‘…এই টঙ্ক আন্দোলনের মধ্য দিয়াই হাজং মেয়েদের মনে সর্বপ্রথম সংগ্রামী চেতনা দেখা দেয়। তাহারা যে কেবল দলে দলে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল তাহাই নহে, বহু বীরত্ব প্রদর্শন ও বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহন করেছিল।’ তিনি এই আন্দোলনের যে সব বিপ্লবী নেতা, নেত্রী ও শহিদদের নাম তালিকাবদ্ধ করেছেন সেখানে হাজং ছাড়া আর অন্য কোনও উপজাতি রমণীর নাম পাওয়া যায় না। (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৫০, শেষ ১-৯)

সামাজিক প্রসঙ্গ 

এই আন্দোলনের বিভিন্ন সামাজিক প্রেক্ষিতের ওপর যে সব বিশ্লেষক ও গবেষকরা সতর্ক দৃষ্টিপাত করেছেন তাঁরা হলেন, জ্ঞানব্রত ভট্টাচার্য এবং তাজ উল-ইসলাম হাসিম। সামাজিক ভাবে নিম্নজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত বিদ্রোহী কৃষকদের সামাজিক মর্যাদার সহজ স্বীকৃতি অর্জনের আকাঙ্ক্ষার উপর জোর দিয়েছেন জ্ঞানব্রত ভট্টাচার্য। তিনি লিখছেন- ‘In the areas of revolt, these communities were in the process of becoming Hindus; they had, in varying measures, adopted a Hindu code of conduct, and they had aspirations for a “proper” rank in the Hindu social order.’ (Bhattacharyya, 1978, p.621) আর এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই কৃষকেরা সেই সুযোগ লাভ করেছিলেন। নিম্নবর্গীয় কৃষক আন্দোলনের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে, ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ বর্ণিত ‘বর্জন’ (Negation)-এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যেখানে নিম্নবর্গের ওপর উচ্চবর্গের আরোপিত সামাজিক বৈষম্যকে অস্বীকার করার একটি প্রবৃত্তি ও প্রক্রিয়াকে তিনি সংজ্ঞায়িত করেছেন (Guha, 1999, pp.18-76)। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য হাজংরা জনজাতি শ্রেণিভুক্ত হয়েও হিন্দু ধর্মকে সামাজিক ভাবে গ্রহণ করেছিলেন, এবং তাঁরা তাঁদের আন্দোলনের নেতা হিসাবে নির্বাচিত করেছিলেন উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত কমিউনিস্ট নেতাদের। ভূপেন ভট্টাচার্য, সুকুমার ভাওয়াল এবং জমিদার বংশীয় মণি সিংহ, এঁদের মতো উচ্চবর্ণের নেতারা ১৯৩০’র দশক থেকে হাজং কৃষকদের সংগঠিত করেন এবং ১৯৪০’র দশকের মাঝামাঝি নাগাদ তাঁদের পূর্ণ আস্থা এবং সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। আর এর জন্য, পাকিস্তানি গবেষক তাজ উল-ইসলাম হাসিম, বাংলার মতো একটি শ্রেণিবদ্ধ সমাজে “সামাজিক উর্ধ্বতনদের নির্দেশ মেনে চলার প্রথাগত পদ্ধতি” কেই দায়ী করেছেন, এবং উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন জমিদার এবং সমাজের ভদ্রলোকদের ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে নিজেদের নিরাপদে রাখতে তাঁদেরকেই হাজংরা তাঁদের নেতা নির্বাচিত করেছিলেন বলে তাঁর অভিমত। তিনি এখানে উচ্চবর্ণের সাথে নিম্নবর্ণের মধ্যে অসম আচার অনুষ্ঠান দ্বারা উভয়ের মধ্যে একটি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের আশঙ্কাও করছেন (Hashmi, 2019, pp. 198-99)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কমরেড মণি সিংহ নিজেই জানিয়েছেন হাজং কৃষকেরা স্থানীয় জমিদারদের ভগবানের অংশ বলে মনে করতেন; ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সমাজের উচ্চবর্গের প্রতি তাদের একটি হীনম্মন্যতা কাজ করত বলেই মনে হয় যাকে বিশ্লেষক হাসিম ফ্রয়েডীয় inferiority complex সাথে তুলনা করেছেন।

নিম্নবর্গীয় চৈতন্যের সন্ধানে

টংক প্রথা বিরোধী আন্দোলনে নিম্নবর্গীয়দের চৈতন্যের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নানা বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা প্রবল। সরকারি নথি ও দলিল দস্তাবেজ ব্যতীত এই আন্দোলনের একমাত্র তথ্যসূত্র হল, বামপন্থী নেতৃবর্গের বিভিন্ন রচনা ও তাদের সাক্ষাৎকার; ফলে সেখানে জনজাতির মানুষের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়া একটি অত্যন্ত দুরূহ বিষয়। অধিকন্তু মাত্র শেষ দুই দশকের আন্দোলনের উপর বিশ্লেষণ করে নিম্নবর্গীয়দের চৈতন্যের অনুসন্ধান একটি অনৈতিহাসিক প্রক্রিয়া হতে পারে, এজন্য উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিংশ শতকের মধ্যকাল পর্যন্ত আর্থ-সামাজিক ও মনোবৃত্তি’র ইতিহাসের বিভিন্ন গতিপ্রকৃতির বিশ্লেষণ করা আবশ্যিক, যা এই নিবন্ধের সীমিত পরিসরে প্রায় অসম্ভব। তথাপি জ্ঞাত ঘটনাবলীর ওপর নির্ভর করেই প্রকল্পিতভাবে (hypothetical) এ বিষয়ে আংশিক আলোচনা করা যেতে পারে।

ক। উঃ ময়মনসিংহের এই অঞ্চলে নিম্নবর্গ কারা? এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে কেবলমাত্র জনজাতির মানুষদেরকে আপাতভাবে চিহ্নিত করা হয়তো সহজ হবে, কিন্তু ঐতিহাসিক গুহ বলছেন, ‘উপনিবেশিক যুগে ভূস্বামীদের মধ্যে যারা নিঃস্ব হয়ে পড়েন…এরা সকলেই আমার সংজ্ঞার শুদ্ধ অর্থে নিম্ন বর্গের অন্তর্গত হলেও বহু ক্ষেত্রেই অবস্থার চাপে চৈতন্যের অন্তর্দ্বন্দ্বে উচ্চবর্গের সপক্ষে কাজ করে।’… ‘এদের ভূমিকা স্পষ্ট নয় বরং দোটানায় জটিল এবং বাস্তবে এঁরা অনেকক্ষেত্রেই নিজেদের সামাজিক সত্তার নিয়ম অনুযায়ী কাজ না করে উচ্চবর্গের স্বার্থ অনুযায়ী চলে।’ (গুহ, ১৯৯৮, পৃ.৩৩) সুতরাং এখানে উপনিবেশিক শাসক হলেন একমাত্র যথার্থ উচ্চবর্গের প্রতিনিধি। ঔপনিবেশিক আধিপত্য বিস্তারের চাপে সুসুং জমিদাররা তাদের আর্থিক প্রতিপত্তি হারিয়ে ‘সংজ্ঞার শুদ্ধ অর্থে’ এখানে নিম্নবর্গ ভুক্ত হয়ে পড়েছেন জনজাতির কৃষকদের সঙ্গে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুটি প্রতর্কের উদ্ভব হতে পারে—                 

১। নিম্নবর্গীয় স্থানীয় ভূস্বামীরা তাদের আধিপত্য পুনরুদ্ধারের জন্য উচ্চবর্গের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন সংগঠিত করার পরিবর্তে, একদিকে দুর্বল জনজাতির উপর সামন্ততান্ত্রিক শোষণের, অপরদিকে উচ্চবর্গীয় ঔপনিবেশিক শাসককে সমর্থন— এই দুইয়ের মাধ্যমেই তাদের আধিপত্যের বৈধতা প্রমাণ করতে অধিক আগ্রহী ছিল, যাকে ‘চেতনার অন্তর্দ্বন্দ্ব’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।

২। আন্দোলনের অন্যতম মুখ্য নেতৃত্ব মণি সিংহ ছিলেন এই ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বংশের এক প্রতিনিধি, যিনি স্থানীয় জনজাতির মানুষকে উচ্চবর্গের বিরুদ্ধে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে সফল হয়েছিলেন। তাঁর এই সংগ্রামী উদ্যোগ স্থানীয় ভূস্বামীদের হৃত আধিপত্য পুনরুদ্ধারের পরোক্ষ সংগ্রাম হিসাবে বিবেচনা করা কতটা সঙ্গত হবে? —সে বিষয়ে একটি ভিন্ন বিতর্কের অবকাশ আছে বলে মনে হয়, যা নিম্নবর্গীয় চৈতন্যের একটি সুসংহত রূপ হিসাবে বর্ণিত হতে পারে।

খ। এই অঞ্চলের জনজাতির মানুষেরা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যখন স্থানীয় ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সে আন্দোলন ছিল অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত এবং বিদ্রোহী চেতনা বিস্তারের প্রক্রিয়াটি সমান্তরাল ছিল বলে মনে হয়; কারণ তাঁদের ধর্মবিশ্বাস (পাগলপন্থী) ও পারস্পরিক বন্ধন বিদ্রোহের প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল এবং তাঁরা নিজেদের মধ্যে থেকেই তাঁদের আন্দোলনের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও ঐ অঞ্চলে তখনো উপনিবেশিক শাসন পুরোপুরি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু বিশ শতকের চিত্রটি ছিল অনেকখানি আলাদা। স্থানীয় হাজং জনজাতির মানুষেরা হিন্দু ধর্মের প্রতি তখন অনেক বেশি অনুগত এবং তাঁরা তাঁদের আন্দোলনের জন্য নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়ে অনেকখানি হীনম্মন্য ও দ্বিধাগ্রস্ত; এবং এই সময়ে এই অঞ্চলে উপনিবেশিক শাসন ছিল অনেক বেশি সুদৃঢ়। ফলে প্রাথমিক ভাবে তাঁদের আন্দোলন স্থানীয় ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হলেও শেষ পর্যন্ত তা উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধেও সম্প্রসারিত হয়। এই সময় তাঁরা সমাজের উচ্চবর্গীয় নেতৃত্বের উপর যেমন নির্ভরশীল ছিলেন, তেমনই তাঁদের মধ্যে বহিরাগত বামপন্থী চিন্তাভাবনার অনুপ্রবেশ করানো হয়েছিল সংগঠিতভাবে এবং উপর থেকে(from above)। সম্ভবত এমন প্রসঙ্গেই অধ্যাপক গুহ বলেছেন— ‘নিম্নবর্গের সামাজিক সত্তা যে সব উপাদানে তৈরি তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা, চৈতন্যের স্তর ও রাজনৈতিক লক্ষ্য সব ক্ষেত্রে সমান নয়। তাই তাদের আদর্শ গুলির মধ্যে অমিল, এমনকি পরস্পর বিরোধিতাও ছিল, এবং তার ফলে সেই রাজনীতির সামগ্রিক আদর্শের চেহারাটা অবস্থাভেদে একএক রকম হয়ে দেখা দিত।’ (গুহ , ১৯৯৮, পৃ. ৩৬) নিম্নবর্গীয় কৃষক চৈতন্যের এই স্ববিরোধী বৈশিষ্ট্যটিকে ঐতিহাসিক গুহ ‘অস্পষ্টতা’র (ambiguity) মধ্যেই সংজ্ঞায়িত করেছেন বলে মনে হয়। (Guha, 1999, pp.76-108)

গ। প্রচলিত ধর্ম ও বিশ্বাস নিম্নবর্গীয়দের মধ্যে চৈতন্য বিস্তারে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করে। হাজংরা সুসুং জমিদারদের ভগবানের অংশ হিসাবে মনে করতেন। তাই তাঁরা তাদের অত্যন্ত অনুগত ছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁরা যখন সেই জমিদারদের বিরুদ্ধেই আন্দোলন শুরু করেন, তখন জমিদার বংশীয় মণি সিংহকেই তাঁদের নেতা নির্বাচন করেন। এই মণি সিংহ এবং তাঁর একটি সাদা ঘোড়া কে কেন্দ্র করে তাঁদের মধ্যে কিছু অতিলৌকিক কাহিনিও প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। হাজং কৃষকদের কাছে মণি সিংহ ছিলেন এক কিংবদন্তি চরিত্র, যিনি কখনো কখনো ‘মণিরাজ’ হিসাবে অভিহিত হতেন এবং কৃষকরা মনে করতেন– তাঁর সাদা ঘোড়াটি পুলিশের নজর এড়িয়ে চলাচল করতে সক্ষম। (Hashmi, 2019, p.234) আর এইসব ঘটনা ও রটনা নেতৃত্বের প্রতি নিম্নবর্গের আস্থা ও বিশ্বাসকে আরও অনেক বেশি সুদৃঢ় করেছিল বলে মনে হয়।

ঘ। নিম্নবর্গীয় চৈতন্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সর্বজনীন হিংসার বহিঃপ্রকাশ এবং গণসংগ্রামের মাধ্যমে তার বৈধতা অর্জনের একটি প্রচেষ্টা, যাকে ঐতিহাসিক গুহ নিম্নবর্গীয় আন্দোলনের ‘পদ্ধতি’ (modality) হিসাবে বর্ণনা করেছেন (Guha, 1999, pp.109-66)। টংক আন্দোলনে ১৯৪৬ থেকে এই সর্বজনীন হিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ক্রমাগত, কখনও পুলিশের ওপর গেরিলা আক্রমণ কিংবা জমিদারের কাছারি লুট, কখনোবা গৃহস্থের মহিলারা অতি সাধারণ অস্ত্র নিয়ে পুলিশকে মুখোমুখি আক্রমণ করেছেন। কমরেড মণি সিংহ এবং কমরেড প্রমথ গুপ্তের রচনায় এমন ঘটনার অনেক নিদর্শন লিপিবদ্ধ রয়েছে। যেমন পুলিশের কাছে অত্যাচারিতা গ্রাম্য রমণী কুমুদিনীর আর্তনাদ শুনে রাসমণির নেতৃত্বে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্যরা হাতে তুলে নেন দা, চেওয়ার এবং রক্ত পতাকা। রাসমণি তাঁর সঙ্গীদের উদ্দেশে বলেন- ‘মই তিমাৎ, তিমাতের ইজ্জত রক্ষা করিব, নাতে মরিব, তরা নীতি লইয়া বইয়া থাক।’ (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৮৩) অর্থাৎ সংগঠনের নিয়ম নীতিকে উপেক্ষা করেই স্বতঃস্ফূর্ত হিংসার বহিঃপ্রকাশ এখানে ঘটেছে। ১৯৪৮’এর জঙ্গিবাদী আন্দোলনের সময় সশস্ত্র সিপাহিদের সামনে নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও আন্দোলনকারী অগেন্দ্র’র চিৎকার, ‘মঙ্গল’দার রক্তের প্রতিশোধ লইতে অগ্রসর হও।’ (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৯৭) আবার পুলিশের গুলিতে আহত হাজং বধূ শঙ্খমণি তার স্বামীর উদ্দেশে বলছেন— ‘মাকে না চা, শত্রুকে মার, ওলা রক্ত লা’। (আমার দিকে তাকিও না, শত্রুকে মারো, তাঁর রক্ত আনো)। (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৯৯) এই উন্মত্ত হিংসার প্রকাশ যা উচ্চবর্গের কাছে অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়, তাঁর মাধ্যমেই নিম্নবর্গের চৈতন্য গণসংগ্রামের আকার নেয় এবং তাদের দাবির সপক্ষে বৈধতা আদায়ের চেষ্টা করে।

টংক বিরোধী এই জনজাতি কৃষক বিদ্রোহের প্রশস্ত আলোচনায় যে বিষয়টি তর্কাতীতভাবে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হল শাসক এবং শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের সুদীর্ঘ সংগ্রাম, যা কখনও নিয়ন্ত্রিত, কখনও সশস্ত্র কখনও–বা জঙ্গি আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময় এবং পরিস্থিতিতে এই নিম্নবর্গীয় আন্দোলন তার চরিত্র বদল করলেও শেষ পর্যন্ত ঘোড়ার লাগাম ছিল বহিরাগত বামপন্থী নেতৃত্বের হাতেই। একদিকে পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিক শাসকের আধিপত্য বিস্তার, অপরদিকে তাঁদের সহযোগী ক্ষয়িষ্ণু ভূস্বামীদের আধিপত্য রক্ষার সামন্ততান্ত্রিক কৌশল, আর এই দ্বৈত শাসন ও শোষণের মাঝে জনজাতি কৃষকদের অধিকার আদায় ও মুক্তির সংগ্রাম আরও জটিল এবং কণ্টকাকীর্ণ হয়ে উঠেছিল। ফলে নানা কারণে এই নিম্নবর্গের বিদ্রোহ আঞ্চলিকভাবে ছিল সীমাবদ্ধ, তা কখনো জনজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চল অতিক্রম করেনি; তাই ডি এন ধানাগাড়ে সংগত কারণে একে ছোট আকারের বিদ্রোহ (‘small-scale uprising’) বলে মনে করেন, এবং তিনি ফ্রান্সের জ্যাকরি বিদ্রোহের (jacquerie) সাথে এর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন (Dhanagare, 1983, p.169)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিদ্রোহে হাজংদের অংশগ্রহণ সর্বাত্মক হলেও, ডালু ও গারো’দের যোগদান ছিল নগণ্য, নিকটবর্তী মুসলমান কৃষকেরা এই বিদ্রোহকে সমর্থন করলেও তাঁরা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি, বরং শেষের দিকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত এই সুদীর্ঘ সংগ্রামকে দুর্বল করে দিয়েছিল। অধিকন্তু বামপন্থী নেতৃত্বের নীতিগত অন্তর্দ্বন্দ্বের (সংস্কার পন্থা বনাম জঙ্গিবাদ) কারণে শেষপর্যন্ত শাসকের স্বৈরাচারের সম্মুখে এই আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যায়। 

সূত্র নির্দেশ: 

১) প্রমথ গুপ্ত— ‘মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী’; আবদুল্লাহ রসুল— ‘কৃষকসভার ইতিহাস’; Sunil Sen— ‘Peasant Movement in India: Mid-nineteenth and Twentieth Century’ এবং ‘Agrarian Struggle in Bengal, 1946-47’; সত্যেন সেন— ‘বাংলাদেশের কৃষক সংগ্রাম’, এবং মণি সিংহ— ‘জীবন সংগ্রাম’।

২) হাজংদের নিজস্ব রচিত একখানি গ্রন্থের বিষয়ে জানা যায়, তবে তা বিশেষ উপলব্ধ নয়— B. Hajong (2002), ‘The Hajongs and their Struggle’।

তথ্যসূত্র:

Bhattacharyya, J. (1978, Aug.). ‘An Examination of Leadership Entry in Bengal Peasant Revolts, 1937-1947’. The Journal of Asian Studies, 37(4), 611-35.

Dhanagare, D. N. (1983). ‘Peasant Movements in India 1920-1950’ (1st ed.). Bombay, Calcutta, Madras: Oxford University Press.

Ellen, B. (2007). ‘They ask if we eat frogs: Garo ethnicity in Bangladesh’ (1st ed.). ISEAS Publishing.

Guha, R. (1999). ‘Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India’ (1st ed.). Durham and London: Duke University Press.

Hashmi, T.u.-I. (2019). ‘Pakistan as a Peasant Utopia: The Communalization of Class Politics in East Bengal, 1920-1947’ (2nd ed.). Londan & New York: Routledge Taylor & Francis Group.

Sachse, F. A. (1917). ‘Bengal District Gazetteers: Mymensingha’ (1st ed.). Calcutta: Bengal Secretariat Book Depot.

Schendel, W. V. (1985). ‘’Madmen’ of Mymensingh: Peasant resistance and the colonial process in eastern India, 1824 to 1833’. The Indian Economic and Social History Review, 22(2), 139-73.

প্রমথ গুপ্ত (১৯৬৯), ‘মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী’ (ময়মনসিংহ) (সং. ১ম ). কলিকাতা: মনীষা।

মণি সিংহ (১৯৮৬), ‘টংক আন্দোলন’; সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও মুনতাসীর মামুন (সম্পা.)-এর, “বাংলাদেশে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন” (সং. ১ম, পৃ.৩৪৯-৭৭). ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি । 

— (২০১৫), ‘জীবন-সংগ্রাম’ (সং. ১ম, অখণ্ড). ঢাকা, বাংলাদেশ: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী।

রণজিৎ গুহ (১৯৯৮), ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’; গৌতম ভদ্র (সম্পা.)-এর, “নিম্নবর্গের ইতিহাস” (সং. ১ম, পৃ.২২-৬৬). কলকাতা: প্রতিভাস।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান