কোয়েল দত্ত
‘যে আন্দোলন (তেভাগা) গোটা ভারতের গণতান্ত্রিক বিপ্লব বা সাম্রাজ্যবাদী–সামন্তবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কৃষিবিপ্লবের রূপ ধারণ করতে পারত, সে আন্দোলন নিজেই হল দেশভাগের বলি! আর সেই সঙ্গে বলি হল লক্ষ ভিটেমাটি ছাড়া উদ্বাস্তু। বাংলার জাতিসত্তায় যে গভীর ক্ষতচিহ্ন সৃষ্টি হল তা কবে নিরাময় হবে কেউ জানে না।’ (গোলাম কুদ্দুস, ‘বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে তেভাগা সংগ্রাম’, পশ্চিমবঙ্গ, তেভাগা সংখ্যা)। তেভাগা (১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দ) এবং স্বাধীনতা বড়োই ঘনিষ্ঠ সময়ের আলিঙ্গনে আবদ্ধ। স্বাধীনতা যে দেশভাগের যন্ত্রণা বয়ে আনল তা মানুষের অস্তিত্বকেই প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। ফলে ফসলের দুই তৃতীয়াংশের অধিকারের জন্য তেভাগার দাবি অভিবক্ত বাংলার শেষ বড়ো কৃষক আন্দোলন তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারল না। তবুও বলা যায় তেভাগাকে কেন্দ্র করে কৃষকেরা প্রতিরোধ করেছেন, করাটাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার লড়াইটা তাদেরকেই করতে হয়েছে প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে। জমিদারি প্রথার শোষণ, খাজনার ক্রমবর্ধমান হার, ঋণের বোঝা, বে-আইনি আদায় এবং এর সঙ্গে মন্বন্তরের রক্তচক্ষু। প্রাণধারণের ন্যূনতম সুযোগটুকুও যখন অপসৃয়মান তখন লড়াই করাটাই স্বাভাবিক। এই আন্দোলন গভীর একটি শ্রেণিচেতনার জন্ম দিয়েছিল, কিন্তু পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাব ছিল। সার্বিক গণচেতনা জাগ্রত হয়নি। ফলে এই আন্দোলনের যে বিরাট প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারত কার্যত তা ঘটেনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে দ্রুত পটভূমি পরিবর্তিত হতে শুরু করল, সেই পরিবর্তনের ইতিহাসই সাহিত্যের বিষয় হয়ে উঠল। নির্মল ঘোষ তাঁর ‘নকশালবাদী আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে বলেছেন— ‘তেভাগা আন্দোলন, কাকদ্বীপের লড়াই ইত্যাদি কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইতিপূর্বেও কবিতা–গান-গল্প লেখা হয়েছে, কিন্তু সেগুলি শেষপর্যন্ত ছিল মধ্যবিত্তের রচিত মধ্যবিত্ত চেতনার সাহিত্য। কোনদিন যথার্থ অর্থে কৃষক চেতনার সাহিত্য হয়ে উঠতে পারেনি’। মূলত বামপন্থী ভাবনায় বিশ্বাসী লেখকেরাই তেভাগা কেন্দ্রিক সাহিত্যের জনক। বামপন্থী ভাবনার সঙ্গে সংযোগ থাকলেও কৃষক চেতনার সঙ্গে কতটা সংযোগ ছিল তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। তবে একটা কথা বলা জরুরি তেভাগার লড়াইয়ের পিছনে বামপন্থী রাজনীতির ভূমিকা অসীম। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে দগ্ধ হিন্দু ও মুসলমান কৃষক সম্প্রদায়কে সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে একই লড়াইয়ের ময়দানে নামানোর কৃতিত্ব নিশ্চিতভাবেই বামপন্থী রাজনীতির। আর শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষের মনে এই আন্দোলন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা গড়ে তোলার দায়িত্ব এইসব গল্প লেখকদের সেটা স্বীকার করতেই হবে। ‘তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কে কলকাতা সহ শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত মানুষজনের (বিশেষত ভূমিস্বত্বভোগী নাগরিকদের) বিরূপ মনোভাব। বাংলার গ্রামাঞ্চলের এই তীব্র শ্রেণিসংগ্রাম সম্পর্কে দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা বিরূপ মানসিকতা কাটাতে তেভাগা প্রভাবিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকাণ্ডের অবদান কোনোমতেই অস্বীকার করা বোধহয় চলে না’। (সুস্নাত দাশ সম্পাদিত, ‘তেভাগার গল্প’)
আমাদের আলোচনার পরিসরে রয়েছে তেভাগার উপন্যাস। কোনও বিশেষ আন্দোলন কেন্দ্রিক সাহিত্যের সন্ধান করতে গেলে আমরা লক্ষ করেছি কবিতা, ছোটোগল্পের মাধ্যমে যত তাড়াতাড়ি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা যায়, উপন্যাসে তত দ্রুততার সাথে বক্তব্য উপস্থাপন করা যায় না। এটি একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। স্বাভাবিকভাবেই তেভাগা কেন্দ্রিক ছোটোগল্প যত সংখ্যায় এবং দ্রুততার সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে, উপন্যাস সে সুযোগ পায়নি। উপন্যাসের সংখ্যাও অপ্রতুল এবং প্রকাশিত হয়েছে আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার অনেক পরে। তবুও অতিক্রান্ত সময়কে অনুভবের আলোকে শাশ্বত করে রাখার ক্ষেত্রে এই উপন্যাসগুলির ভূমিকা উপেক্ষণীয় নয়।
প্রথমেই যে উপন্যাসটির কথা নিয়ে আলোচনা করা হবে সেটি হল গুণময় মান্নার প্রথম উপন্যাস ‘লখীন্দর দিগার’ (১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) গুণময় মান্নার প্রধান উপন্যাসগুলি মূলত কৃষক, শ্রমিকদের নিয়েই রচিত হয়েছে। আমাদের আলোচ্য উপন্যাসটিও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। তবে তেভাগার প্রত্যক্ষ প্রভাব যদি আমরা এই উপন্যাসে খুঁজতে যাই, তাহলে আমরা ব্যর্থ হব। এই উপন্যাসের সময়কাল স্বাধীনতার পরবর্তী কাল। উপন্যাসের সময়কাল সুস্পষ্ট। ‘তেরশো পঞ্চান্ন সালের সতেরোই অগ্রহায়ণ’ উপন্যাসের ঘটনাক্রম শুরু হচ্ছে। তেভাগার প্রত্যক্ষ প্রভাব বাংলা উপন্যাসে বিরল। কিন্তু এই আন্দোলনের পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া বাংলা উপন্যাসে স্বল্প হলেও বিরল নয়। এই উপন্যাসটি তার একটি দৃষ্টান্ত। তেভাগার আন্দোলন হয়তো সফল হয়নি, কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে পশ্চিমবাংলার কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এর প্রভাব এক নবচেতনার জন্ম দেয়। পরবর্তী কৃষক আন্দোলনকে সার্থক করে তোলার ক্ষেত্রে কৃষক বর্গের যৌথ প্রচেষ্টা এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে আবেগ বর্জিত থেকে বুদ্ধিগ্রাহ্য সংগ্রাম এবং দাবির পরিসর নির্মাণ করার প্রয়াসে পূর্ববর্তী আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা শিক্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।
একজন সাধারণ কৃষক লখীন্দর দিগার। তার মধ্যে রয়েছে আত্মমর্যাদা এবং সততা। স্বার্থশূন্যভাবে পরিবার ও সমাজের অন্যান্যদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতি তার নিবিড় ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতা। রাজনীতির সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ সে বোঝেনা। সে শুধু বোঝে মানুষের দুর্দশা। সমাজের বৈষম্য, অন্যায় তাকে হতাশ করে, আহত করে, কিন্তু জীবনের প্রতি সদর্থক মনোভাব থেকে সে বিচ্যুত হয় না। নিজের জমিতে চাষ করে যেটুকু অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যায় তাতেই সে তুষ্ট। কোনও অতৃপ্তিকে প্রশ্রয় দিতে সে চায় না। একজন সাধারণ মানুষের মতো পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত থাকাটাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করে। কিন্তু পরিস্থিতি তো সবসময় সুস্থিত থাকে না। ক্ষমতাশালী ধনলোভী মানুষের সীমাহীন লোভ এবং ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আগ্রাসী মনোভাব জীবনকে এক নিরাপত্তাহীনতার ঘেরাটোপে নিয়ে ফেলে। ফলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়। ধানগাছিয়া গ্রামের জমিদার অজয় রায় এবং তার স্ত্রী সাবিত্রীর মামা হরি চৌধুরীর সীমাহীন লোভ এবং ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আগ্রাসী মনোভাব গ্রামের মানুষকে বঞ্চিত করে তোলে। তারা তাদের কঠোর পরিশ্রমের কোনও মূল্য পায় না। সর্বগ্রাসী জমিদারের সহায় প্রশাসন। ফলে কৃষক সমাজ অর্থনৈতিক বঞ্চনার পাশাপাশি প্রশাসনিক অত্যাচারও সহ্য করতে বাধ্য হয়। এই অত্যাচারের চিত্রটাকেই পাল্টাতে চায় কৃষক সভার নেতা গোবিন্দ। আর গোবিন্দের নির্দেশে অঞ্চলের সমস্ত কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার কাজ করে সতীশ। সতীশ ফেরারি কৃষক এবং শিক্ষিত যুবক। তবে তার প্রতি গ্রামের অন্যান্য কৃষকরা কিছুটা সন্দেহপ্রবণ। কারণ স্বাধীনতার পরে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই কৃষকদের উন্নয়নের কথা শোনালেও বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। কিন্তু সতীশের প্রতি লখীন্দরের ষোলোআনা বিশ্বাস। মেদিনীপুরের মনসাখালি-কেচঁকাপুর-ঝাঁকরা-ঘাটালের কৃষকদের সতীশ, গোবিন্দ নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার কথা বলে। গোবিন্দ চাষীদের বলে— ‘গেল বারের তেভাগা আন্দোলনের কথা মনে পড়ে আপনাদের? আমরা ধানের ভাগা নিয়ে লড়েছিলুম, এবার আমরা জমি নিয়ে লড়ব। যে চাষী, যে চাষ করবে, জমি হবে তারই। আর কাউকে আমরা মানিনে’। কৃষক সভার কর্মসূচীর কথা গোবিন্দ চাষীদের বোঝায়। কৃষকদের নিয়ে দল গঠন করতে চায়। একটা নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখায়। যেখানে মানুষ মানুষকে ঠকিয়ে ধনী হয় না। তাই এই জমিদার–মহাজনদের চক্র উচ্ছেদ করতে হবে। গোবিন্দর নেতৃত্ব আমাদের মাণিক বন্দ্যোপাধ্যারের ‘হারাণের নাতজামাই’ গল্পের ভুবন মণ্ডলকে মনে করায়। ভুবনের মত গোবিন্দও ফেরার। পুলিশ তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, আর গ্রামের মানুষ তাকে সযত্নে আড়াল করে রেখেছে। গোবিন্দর কৃষকদের প্রতি ব্যবহার লখীন্দরকে আকৃষ্ট করে। গোবিন্দর কথায় লখীন্দর পড়াশোনা শুরু করে। গোবিন্দ আর সতীশ কৃষকদের মধ্য থেকেই নেতা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করে দেয় আর লখীন্দর হয় সেই নেতা। লখীন্দর পড়াশোনা করে জানতে পারে অবিচার আর বঞ্চনার ইতিহাস সর্বব্যাপী। তবে গোবিন্দ লখীন্দরদাদাকে জানিয়েছে এবার তাদের জয় সুনিশ্চিত। ‘আমরা জানি আমরা জিতবই! আজ যদি ওরা বন্দুক ছুঁড়ে থামিয়ে দেয় কেশপুর–ঝাঁকরাকে, কাল লড়াই চলবে কলকাতায়। বাংলাদেশকে ঠাণ্ডা করলে চলবে ব্রহ্মদেশে’। তেভাগা আন্দোলন পরবর্তী কালে কৃষক নেতারা এই শিক্ষা নিয়েছিলেন যে আন্দোলনকে স্থানীয় স্তরে আটকে রাখলে চলবে না এর বিস্তার দরকার। ফলত কৃষক সমাজ জেগে ওঠে। সরকারের কম দামে ধান কেনার প্রতিবাদে ধানগাছিয়ার চাষীরা নব মল্লিকের ধান লুঠ করতে যায়। মারমুখী কৃষকের দল পুলিশের কাছ থেকে বন্দুক কেড়ে নেয়। আমনপুর, ধানগাছিয়া, শীরষে, শ্যামগঞ্জ সর্বত্র শুরু হয় কৃষক বিদ্রোহ। এই আন্দোলনের মুখ হয় লখীন্দর। তার ছেলে সুধীর গ্রেপ্তার হয়, লখীন্দরকে বাড়িতে বন্দি করে রাখা হয়। বিদ্রোহি কৃষকদের বিরুদ্ধে প্রশাসন পুলিশের পাশাপাশি সেনাদের ব্যবহার করতে শুরু করে। কিন্তু বিদ্রোহের আগুন আরও প্রজ্জ্বলিত হয়। কৃষক বধূরাও আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সর্বব্যাপী এই আন্দোলনের গরিমা কৃষক সমাজকে উন্নততর জীবনের স্বপ্ন দেখায়। লখীন্দর চায় কৃষকের উন্নয়নের কাজেই সে তার বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে। ঔপন্যাসিক লখীন্দরকে শুধুমাত্র একজন কৃষকনেতা হিসাবেই গড়ে তুলতে চাননি একজন উন্নততর উদার জীবনবোধের মানুষ হিসাবেও নির্মাণ করতে চেয়েছেন। তার মুখেই আমরা শুনতে পাই এই পৃথিবীর মূল অসুখের কারণটিকে— ‘শান্তি আপনারা করবেন কি করে? মানুষের মনেই শান্তি নাই … মানুষ যদি মানুষকে না ভালবাসতে পারল, থালে এ পিথেমী শ্মশান হয়ে গেল। আজ মানুষের একটুও আনন্দ নাই, মানুষ শুকি যাচ্ছে’। ছাব্বিশে জানুয়ারী গোবিন্দর নেতৃত্বে কৃষকসভা স্বাধীনতা দিবস পালন করতে চায়। গোবিন্দ লখীন্দরকে স্বাধীনতার দাবি বুঝিয়ে দেয়। ‘আমাদের ভাগ্য আমরা নিয়ন্ত্রণ করব, তার স্বাধীনতা চাই। চাই, মানে কারো কাছে ভিক্ষে করে নয়। সেটা আমরা সৃষ্টি করে তুলব। আমরা রক্ষা করব’। কৃষকসভার স্বাধীনতা দিবসে দলে দলে কৃষকরা উপস্থিত হয়। গোবিন্দ এবং সতীশের কথায় লখীন্দর গৃহবন্দি থাকার আদেশ অমান্য করে প্রকাশ্য সভায় বক্তৃতা দেয়। সে বলে “সতীশ ভাই বলল, আমাদের সব জিনিস আমরা দেখব। ই অতি উত্তম কথা। আমাদের ধান আমরা দেখব বই কি’ …আমাদের মান ইজ্জৎ ভাল–মন্দ আমাদিকে দেখতে হবে। কিন্তু ভাই, আমার ক্ষুদ্দ বুদ্ধিতে এই লেয়, যে ও তে অহংকার করলে চলবেনি। লোভ করলে চলবেনি। সবই আমরা করলম, তবু আমরা করলম এই কথা বললে চলবেনি”। লখীন্দর তার উদার মানসিকতা দিয়ে উপলব্ধি করেছে ক্ষুদ্র স্বার্থের উপর উঠতেই হবে। মানুষকে ভালোবাসার কোনও সীমা নেই। আর সেখানে অহংকারের কোনও স্থান নেই। গোবিন্দ লখীন্দরকে বলে পুলিশ তার উপর চরম অত্যাচার করবে। কিন্তু লখীন্দরের তাতে ভয় নেই— সে বলেছে— ‘একথা কেনে বলছ ভাই। আমার কী মিত্যু – ভয় আর আছে? মিত্যু মাহা শান্তি,— মাহা পরিণাম’। এই উপন্যাসে লখীন্দর ধীরে ধীরে পরিণত হয়ে উঠেছে— স্বার্থশূন্য, সততা ও নীতিবোধের এক নতুন জীবনদর্শন নির্মাণ করেছে যার সংস্পর্শে গোবিন্দ ও উপলব্ধি করেছে— ‘আমাদের শক্তি যে অপরাজেয় তা আগে বুদ্ধি দিয়ে জেনেছিলাম, আজ হৃদয় দিয়ে অনুভব করছি’। এই উপন্যাসে গুণময় মান্না আমাদের উপলব্ধি করান অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতেই হয়, কিন্তু পাশাপাশি আত্মিক প্রতিরোধেরও প্রয়োজন রয়েছে। অন্যকে আঘাত দিয়ে, অহংকে তৃপ্ত করে প্রতিরোধ করা যায় না। তাই লখীন্দর তার সহসৈনিকদের ভালোবাসা ও সমমর্যাদা দিয়ে পথ চলতে চায়— সেখানেও বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। তবেই আন্দোলন সামগ্রিক প্রতিষ্ঠা পাবে।
সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দীর্ঘ প্রোথিত যে সংস্কার আমাদের চেতনার শিকড়ে লালিত হয়ে এসেছে তা থেকে মুক্তির পথটা তত সহজসাধ্য ছিল না। শোষিত হওয়ার অভ্যাসটা আমাদের এতটাই মজ্জাগত যে তার থেকে মুক্তির পথ খোঁজার চেষ্টাও আমরা করি না। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘লালমাটি’ (১৯৫১ খ্রিস্টাব্দ) উপন্যাসে কৈবর্ত বিদ্রোহের নবজন্ম ঘটেছে। সাম্প্রদায়িক বিভেদের আগুনকে উস্কে দিয়ে জমিদার ও মহাজনরা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করে এসেছে। এই উপন্যাসের নায়ক রঞ্জন, কমিউনিস্ট কর্মী। বরেন্দ্রভূমি অঞ্চলের কালাপুখরি এবং আশেপাশের আরো প্রায় পনেরোখানা গ্রাম নিয়ে তুরীদের এলাকা। এই গ্রামগুলির দুপাশে রয়েছে প্রায় দুহাজার বিঘে ধানী জমি। নদীর বন্যায় কালাপুখরি অঞ্চলের হাজার হাজার বিঘে ধানী জমি প্রতিবছর নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু জমিদার ভৈরব নারায়ণ জলকরের লোভে বাঁধ দিতে রাজি নয়। তাই স্থির করা হয় বর্ষার আগেই বাঁধ দিতে হবে। এই ব্যাপারে আদিবাসী সাঁওতাল কৃষক, বড়ো কৃষক, বর্গাদার, খেতমজুররাও সংঘবদ্ধ হয়। ফসল রক্ষার জন্য তারা রুখে দাঁড়ায়। কৃষক সমিতির মিটিং–এ রঞ্জন বলে— ‘এবার রুখে দাঁড়াতে হবে আপনাদের— সকলে হাতে হাত মিলিয়ে বাঁধ বাঁধতে হবে। হয়তো জমিদারের লাঠিয়াল আসবে— পুলিশও আসতে পারে। কিন্তু সেই জন্য আপনারা পিছিয়ে যাবেন কিনা সে বিচারের ভার আপনাদের ওপর’। ফসলের দুই তৃতীয়াংশ অধিকারের জন্য তেভাগার দাবি গড়ে উঠেছিল। সে দাবি পূরণ হয়নি। তবে তেভাগা কৃষকদের মধ্যে আত্মসচেতনতা এবং আত্মমর্যাদার বোধকে জাগ্রত করেছিল। তেভাগা পরবর্তীকালে রচিত উপন্যাসগুলিতে তার প্রতিফলন সুস্পষ্ট। কৃষক নেতারা কৃষকদের অর্থনৈতিক সুবিধা কতটুকু আদায় করে দিতে পেরেছিল সে নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সামাজিক মর্যাদা বোধের জায়গাটা মজবুত করে দিয়েছিল। পাশাপাশি হিন্দু–মুসলমান কৃষকদের মধ্যে সম্প্রদায়গত মেলবন্ধন গড়তেও সাহায্য করেছিল। কৃষক নেতা রঞ্জনের মুখে এই বার্তাই ঘোষিত হয়— ‘যতদিন আপনারা ফারাক হয়েছিলেন, ততদিন আপনাদের ক্ষেতের ফসল লুটে নিয়েছে জমিদার, ঘরবাড়ি, গোরু-হাল নীলামে তুলেছে মহাজন। আজ যে যেখানে আছেন, যদি এককাট্টা হয়ে দাঁড়ান তাহলে দেখবেন দুদিনেই সব জুলুমবাজি বন্ধ হয়ে গেছে। রামের স্বার্থ রাখবার জন্য যদি রহিম দাঁড়ায়, আলিকে বাঁচাবার জন্য যদি যদু ছুটে যায়— তাহলে সবাই বুঝতে পারবে তামাম পৃথিবীর ভুখা মানুষেরা আজ একদলে’। এই শ্রেণিচেতনা জাগ্রত করার পিছনে রয়েছে তেভাগার পরোক্ষ প্রভাব। তেভাগার ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই বিশ্বাস করতে হবে— ‘তবু চেষ্টা করতেই হবে। যতটা পারি— যতখানি সম্ভব। চেষ্টার ফাঁক না থাকে, ফাঁক না থাকে আন্তরিকতার। আগামী দিনের ইতিহাসের কাছে আমাদের সপক্ষে এই তো দলিল’। কারণ অধিকার আদায়ের লড়াইটা কখনও থেমে থাকে না।
মধ্যচল্লিশের সাড়া জাগানো কৃষক আন্দোলন ‘তেভাগা’–কে বিশাল ক্যানভাসে তুলে ধরে তিন খণ্ডে সাবিত্রী রায় রচনা করেছেন ‘পাকা ধানের গান’ উপন্যাস। (প্রথম খণ্ড: ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ, দ্বিতীয় খণ্ড: ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ, তৃতীয় খণ্ড: ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ)
তিরিশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উপন্যাসের শুরু এবং গারো পাহাড়ের পাদপীঠে তেভাগা আন্দোলন দিয়ে শেষ। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে দুর্ভিক্ষ, কালোবাজারী, স্বাধীনতার সংগ্রাম সবকিছুই এই উপন্যাসে উঠে এসেছে। বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত মার্কসবাদী ভাবনায় বিশ্বাসী কলেজে পড়া কৃষক সন্তান পার্থ গ্রামে এসেছে, গ্রামের কৃষকদের সংগঠিত করতে। সে কৃষকদের বোঝাতে চায় জমিদার শ্রেণি আমাদের মিত্র নয়। ‘জমিদার আর কৃষক দুটো জাত। তাদের মধ্যে সম্পর্ক হল সাপ আর বেজির। শুধু এদেশে নয়— সারা দুনিয়ায়’। পার্থ কৃষকদের সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখাতে চায়। তাদের মধ্যে জাগ্রত করতে চায় শ্রেণিচেতনার বীজ। পার্টির নির্দেশে কৃষক আন্দোলনকে মানুষের মনে ছড়িয়ে দিতে ‘চাষি’ পত্রিকা প্রকাশনার দায়িত্ব পায় পার্থ। সারা বাংলার কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে তার ধারণা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। পার্টির নেতা গণেশ দাস পার্থকে হাজংদের এলাকা পাহাড়পুরে কৃষক আন্দোলনকে সংগঠিত করার দায়িত্ব দেন। পাহাড়পুরের পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হয়ে ওঠে। জমিদারের নায়েবের অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা সংঘবদ্ধ হয়। জমির উপর তাদের অধিকার দাবি করে। কিন্তু জমিদাররা স্বাভাবিক ভাবেই রাজি হয় না। জঙ্গলে কাঠ কাটার উপরও নিষেধাজ্ঞা চাপায়। সশস্ত্র পাহারা বসায়। সাতদিনের মধ্যে খামারে ধান পৌঁছানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশ অমান্য করে হাজংরা লড়াইতে অংশগ্রহণ করে। রক্তক্ষয়ী এই সংগ্রাম তীব্র হয়ে ওঠে। তারা অনুভব করে ‘জমি যার নামেই থাক জমির আসল মালিক হল চাষি! লাঙল যার জমি তার’। ফলে মেহনতের ধান তারা কোনওভাবেই জমিদারের হাতে তুলে দেবে না। “মাঝরাতে কাস্তে নিয়ে খেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাহাড়পুরের এক হাজার চাষী। একসঙ্গে হাত চলছে সবার।… সহস্র চাষী কন্ঠের মিলিত দোহার গৃহস্থ বধূর নিকানো আঙ্গিনায় ভেসে চলে— ‘চাষীর মরা গাঙে আইল এবার বানরে, আইল এবার বান”।
প্রতিপক্ষ জমিদার চুপ করে বসে থাকে না। গারো পাহাড়ের বিদ্রোহী হাজংদের গ্রামে তাই নেমে আসে মিলিটারি সন্ত্রাস। সন্ত্রাস–হত্যা-প্রতিরোধ তেভাগা-র একটি বাস্তব চিত্র সাবিত্রী রায় তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে। পার্থ গুলিবদ্ধ হয়। ‘তাকিয়ে দেখে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে তার বাঁ কাঁধ দিয়ে।… সমস্ত রক্তকণিকা দিয়ে শোনে পার্থ অরণ্য প্রান্তের সে শিক্ষার প্রতিধ্বনি। স্নিগ্ধ একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে অধর প্রান্তে’। শেষপর্যন্ত মৃত্যু ঘটে পার্থর। পার্থর মৃত্যু নতুন করে জাগিয়ে তোলে আদিবাসী পল্লিকে। লড়াইটা শুরু হয়ে যায়। এই খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র ‘হাজং অঞ্চলে তে-ভাগা আন্দোলন তো জোর চলেছে। খুব লড়াই করছে চাষীরা’। এই সংঘবদ্ধ প্রতিরোধে পিছু হটতে বাধ্য করায় মিলিটারি সৈন্যদের। সৈন্যদের ঘাঁটি তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পার্থর অসমাপ্ত আন্দোলন এগিয়ে চলে নতুন অভিমুখে নতুন শপথ নিয়ে। সাবিত্রী রায় তাঁর দীর্ঘ এই উপন্যাসে ময়মনসিংহ জেলার উত্তর সীমান্তে গারো পাহাড়ের পাদমূলে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে হাজং, গারো, ডালু, কোচ প্রভৃতি আদিবাসী কৃষকদের তেভাগার লড়াইকে শাশ্বত করে রেখেছেন। কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষিত তরুণদের এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা কিংবা কৃষকের ছেলের শ্রমিক নেতা হয়ে ওঠা আমাদের পরিচিত চেতনারই অংশ। তাই তেভাগা কেন্দ্রিক উপন্যাসে এই চিত্রই নানাভাবে উঠে এসেছে।
মহাশ্বেতা দেবীর ‘বন্দোবস্তি’ (১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ) উপন্যাসে ‘তেভাগা’ আন্দোলন স্মৃতির পথ বেয়ে উপস্থাপিত হয়েছে। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সোমনাথ দত্ত বা সোম একজন চল্লিশ অনুত্তীর্ণ যুবক। সংসারের প্রতি উদাসীন সোমের কমিউনিস্ট বাবা অশোকবরণের মৃত্যুর সময় সোমের বয়স ছিল তিন বছর। তার মা সোমকে রাজনীতির সমস্ত সংস্পর্শ থেকে দূরে রেখে মানুষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সোম এই নিশ্চিন্ততায় সন্তুষ্ট হতে চায়নি। আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে সমীক্ষার কাজ করতে গিয়ে সে দেখেছে কিভাবে সংরক্ষিত টোটো উপজাতিদের জন্য নির্দিষ্ট যোজনার বরাদ্দ টাকা ও জমি লুঠ হয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রদেশেরও আদিবাসী প্রধান গ্রাম গাঢ়িয়াতে অনাহারে আদিবাসীদের মৃত্যু হচ্ছে। মহাজন ফসল দখল করে নিচ্ছে। ফলে তাদের বুনো অখাদ্য কন্দ খেতে হচ্ছে। অথচ ব্লক অফিসারের বাড়িতে পাঁচ কিলো ঘি ঢেলে যজ্ঞ হয়। সোমের স্ত্রী জয়ি সোমকে এই অন্যায় সম্পর্কে চুপ করে থাকতে বলে। কাজের ক্ষেত্রে হৃদয়ের কোনও স্থান নেই। পেশাদারি দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিবেচনা করতে বলে।
অথচ সোম এই ‘বন্দোবস্তি’–তে স্বচ্ছন্দ হতে পারে না। তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে বাবার সহকর্মী, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য রাম সেনের সঙ্গে। তিনি সোমকে বাম আন্দোলনের প্রকৃত সহায়ক লোক কবি ও গণ কবিয়ালদের নিয়ে কাজ করতে বলেন। রাম সেনের নির্দেশে সোম যায় চব্বিশ পরগণার বনগাঁ মহকুমার ভিতরগাছি গ্রামে ভোলানাথ দত্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তেভাগা আন্দোলনের মেদিনীপুর জেলার কৃষক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ভোলানাথ বলেন ১৯৪৪ সাল থেকে কৃষক আন্দোলনের অঙ্গ হিসাবে লোকশিল্পীদের সহযোগিতায় কৃষ্টি বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। ভোলানাথের স্মৃতিচারণার সোম সন্ধান পায় গণ–কবিয়াল রামলাল খাটুয়ার। পরাধীন ভারতের লবণ আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন কিংবা তেভাগা সব আন্দোলনের কথাই তিনি গানের আকারে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। ভোলানাথ চেয়েছিলেন তার গানকে সংকলিত করতে। তেভাগার গানের পাণ্ডুলিপি রামলাল ভোলানাথের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই গানের সংকলনের বই প্রকাশ করেন ভোলানাথ। সোমের হাত দিয়ে সেই বই তিনি পাঠাতে চান রামলালের কাছে। বহু অনুসন্ধানের সোম রামলালের খোঁজ পায় খড়গপুরের বেলদার প্রত্যন্ত গ্রাম মগনাদিতে। সোম গানের বই তার হাতে তুলে দেয়। এই গ্রামের মানুষদের সঙ্গে সোম নতুন করে বাঁচতে চায়। গ্রামীণ মুণ্ডাদের সরল জীবন, আন্তরিকতা তাকে মুগ্ধ করে। তার মনে হয় এখানেই সে তার হারিয়ে যাওয়া সত্তাকে খুঁজে পাবে। কারণ ‘এসব ঘাস মাটি, এসব এখন বন্দোবস্তির বাইরে, খালি পা ঘাসে ডোবাও, জানতে পারবে। মাটিতে পা রেখে চলো। হারিয়ে যাওয়া নিজেকেও একটু একটু করে কণায় কণায় ফিরে পাবে’।
এই উপন্যাসটিতে আধুনিক ব্যক্তি মানুষের আত্মিক সংকটের কথা উপস্থাপন করা হলেও, পাশাপাশি ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের লড়াই, প্রতিরোধ, আত্মবলিদানের ইতিহাসকেও তুলে ধরা হয়েছে। ইতিহাসের শুষ্ক পাতায় কোনও আন্দোলনই বেঁচে থাকতে পারে না। তাকে প্রবাহিত হতে হবে জাতীয় চেতনার মধ্য দিয়ে। আর লোকসংস্কৃতি আমাদের সেই চেতনারই ফসল। কোনও বন্দোবস্তিই তাকে নস্যাৎ করতে পারে না। কারণ এই সংস্কৃতিই আমাদের অস্তিত্ব। একে ভুলে থাকা মানে নিজের পরিচয়কেই ভুলে থাকা।
১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের ‘স্বজনভূমি’ উপন্যাসে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে ঘটে যাওয়া ‘তেভাগা’ আন্দোলনের প্রতিরোধের স্মৃতির কোনও অস্তিত্ব আছে কিনা সেটাই সন্ধান করা হয়েছে। কালের গতিতে একটি আন্দোলন শুরু হয়, শেষও হয়ে যায়। তার রেশ কি রয়ে যায় আমাদের চেতনায়, আমাদের মননে? এই প্রশ্নই ঘুরে ফিরে এসেছে এই উপন্যাসে। আশির দশকের শক্তিশালী লেখক ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায় কাকদ্বীপ অঞ্চলের তেভাগা আন্দোলনের কথা, সংগ্রামী কৃষক নেতা অতুল কামিল্যার স্মৃতি রোমন্থনের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। দক্ষিণবঙ্গের কাকদ্বীপ, সোনারপুর ও ভাঙরের লক্ষ লক্ষ বর্গা চাষি ও ক্ষেতমজুররা দীর্ঘদিন ধরে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়েছিল। কামিল্যার এই আন্দোলন গ্রামের পুরোনো সাধারণ মানুষের কাছে আজও স্মরণীয়। গ্রামের মানুষকে সংগঠিত করে পুলিশের আক্রমণের বিরুদ্ধে যে সংগঠন তৈরি হয়েছিল লালঝাণ্ডা নিয়ে কৃষকেরা যে লড়াই করেছিল তার কথা আজও শোনা যায়। এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র কুড়ালী তাই বলে– ‘মামা বাউয় তুমি সে তেরশ তিপান্ন সালের আন্দোলনের নেতা লোক। পুলিশের তাম্বু পুড়ানো কমনিস্ট’। সময় বদলে যায়, নতুন প্রজন্মের কাছে এই আন্দোলনের গৌরব অস্তমিত। তাই চন্দনপিঁড়ির অহল্যা দাসীর এই আন্দোলনের জন্য আত্মত্যাগের কাহিনি তার নিজের নাতনির কাছেও অজানা। সে তার বাবা রতিকান্তর কাছে জানতে চায় ‘ঠাকমা ওই গুলিগালাজ বন্দুকের সামনে গেল কেনি? ঘরে থাকলেই তো পারিত? তেরো– চোদ্দবছরের মেয়েটার সামনে বোবা মেরে যায় রতিকান্ত। সত্যি তো মা কেনি গেছিল? আরও কত মানুষ যে এগিয়েছিল। কাদের কথায়। কাদের উপদেশে?’ এই মানুষগুলির জন্য শহীদবেদী হয়েছিল। কিন্তু সেই শহীদবেদী উত্তর প্রজন্মের কাছে পরিচয়হীনতার আবরণে ঢেকে গেছে। নতুন সরকারি নীতি বা দুর্নীতি আজ আর সেইদিনের লড়াকু মানুষগুলির প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে না। তাই সরকারি নির্দেশে ফ্রিডম ফাইটাররা সাড়ে সাতশো টাকা করে পেনশন পেলেও তেভাগা-র বীর সংগ্রামীরা পান মাসিক তিনশত টাকা। এই ব্যবধানের কারণ অজ্ঞাত। কামিল্যার ছেলে এই নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলে ধমকে ওঠে অতুল কামিল্যা। ছেলেটাকে তার নিজের ছেলে মনে হয় না। মনে হয় কোন জোতদারের ছেলে। তার এতদিনকার একটু একটু করে গড়ে ওঠা অতীতের সুখস্মৃতি থেকে তাকে যেন বিযুক্ত করে দিচ্ছে। ‘স্বজনভূমি’–র জন্য আত্মত্যাগের মূল্য নির্ধারিত হতে পারে না সরকারি নীতির দ্বারা। লড়াইটা একদিন হয়েছিল সে সত্য মিথ্যা হতে পারে না। সেই লড়াইয়ের প্রতিটি অনুভবই এখন বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।
তাই বোধহয় আটাত্তর বছরের ব্যবধানে আবার জমি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। “১৯৪৬ সাল থেকে সন্দেশখালির বেড়মজুরে ‘তেভাগার লড়াই’ দেখেছিলেন সেখানকার মানুষজন। ২০২৪–এ শেখ শাহজাহান ও তাঁর দলবলের বিরুদ্ধেও এমনই আন্দোলনে নেমেছেন ওই বেড়মজুরের বাসিন্দারাই। এখানেও অভিযোগ শোষণ, অত্যাচার, দাদাগিরির। এমনকি, তেভাগা আন্দোলনের স্মৃতিবাহী গ্রামের শহিদ বেদি আর উদ্যানও লুট করার অভিযোগে কদিন ধরে তপ্ত ওই গ্রাম…এক বৃদ্ধের কন্ঠে প্রত্যয়, ‘তেভাগার স্মৃতি রয়েছে এই গ্রামের মাটিতে। তা-ও লুট হয়েছে। একজোট হয়ে প্রতিবাদ করলে কী হয়, তা এ গ্রামের মানুষ জানেন”। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭ শে ফ্রেবুয়ারি, ২০২৪)
সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার রক্ষণশীল আদর্শ থেকে মুক্তি ঘটিয়েছিল তেভাগা। কৃষকদের সমানাধিকারের প্রশ্নে সচেতন করেছিল। শুধু অর্থনৈতিক অধিকার নয়, সামাজিক অধিকার ও আত্মসম্মানের প্রশ্নে কৃষক তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে প্রত্যয়ী হয়ে উঠেছিল। তেভাগার ছায়া আশ্রিত উপন্যাসে তাই এই ভাবনারই প্রতিফলন সর্বত্র। তবে বলা যায় অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে পুঁজির বিনিয়োগ, উৎপাদন ও বণ্টন সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ এই উপন্যাসগুলিতে লক্ষ করা যায় না। ঔপন্যাসিকরা মূলত রাজনৈতিক মতাদর্শের উপর জোর দিয়ে কৃষক–শ্রমিক শ্রেণির অধিকার ও মানবিক সম্পর্কগুলির বিন্যাসকেই প্রকাশ করেছেন।