দর্পণ-নাটকে বাংলার মুখ

চন্দন সেন


আমাদের হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে নানাভাবে চর্চিত অভিনয় কর্মের পুরাণ, মহাকাব্য কিংবা ধর্মীয় আখ্যান সর্বস্বতায় সমকাল কিংবা সমকালীন সমাজ এসেছে খুব কম এবং এসেছে প্রক্ষিপ্তভাবে। লিবিয়েদেভ নামক রুশ নাট্যপ্রেমীর হাত ধরে যে ইউরোপীয় মঞ্চধারা আমাদের বঙ্গনাট্যে এক স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক নাট্যচর্চার অভিমুখ খুলে দিল সেখানেও দেড়শো বছরের বেশি সময়ের প্রতীক্ষা ছিল সমকালীন সমাজকে নিয়ে মঞ্চ ভাবনার। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম নাটক রচিত হল, নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্ন লিখলেন কৌলীন্য প্রথার বীভৎসতা নিয়ে নাটক ‘কুলীন কুলসর্বস্ব’। তারপর বেশ কটি সমধর্মী নকশা বা প্রহসন লেখা হলেও সমাজ সমস্যার সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার সফল মিশ্রণের প্রথম ফসল দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক যা লেখা হয়েছিল ১৮৬০ সালে, প্রথম টিকিট কাটা দর্শকদের নিয়ে অভিনয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হল কলকাতায় ১৮৭১-এ ঢাকায় আরও আগে। ‘দর্পণ’ নাটকের পথিকৃৎ এই যুগান্তকারী নাটকের সফল অভিনয়ের সমকালে অন্তত তেরো-চোদ্দটি দর্পণ-নাটকের মিছিল দেখা গেল বাংলার নাট্যজগতে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত মোট নটি নাটকের খোঁজ মিলেছে, বাকি চার-পাঁচটি নাটকের খোঁজই পাওয়া যায়নি। ১৯৬০ সালে, আধুনিক থিয়েটারের জনপ্রিয়তার তুঙ্গলগ্নে সলিল সেনের লেখা ‘দর্পণ’ নামের নাটকটিকে আমরা এই আলোচনায় আনছি না। তবে বাকি তেরোটি নাটক ও নাট্যকারের নাম ইতিমধ্যেই বিশেষজ্ঞরা হতিমধ্যেই বিশেষজ্ঞরা আমাদের নজরে এনেছেন। উনিশ শতকের ছয় থেকে নয়ের দশকের মধ্যে লেখা এই রচনাগুলির সব কটিকে নাটক পদবাচ্য হয়তো বলা চলে না, তবে অধিকাংশকেই প্রহসন লেখার চেষ্টা তো বলাই যায়। প্রহসন মানে সামাজিক কোনো অন্যায় বা সুবিচারের সরস আখ্যান। ‘নীলদর্পণ’ উদ্দেশ্যমূলক নাটক হলেও প্রহসন নয়, দুর্বল নাট্যরস সমৃদ্ধ সামাজিক নাটক।— মীর মশারফ হোসেনের ‘জমীদার দর্পণ’ আর দক্ষিণারঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের ‘চা-কর দর্পণ’ নাটকও খানিকটাই তাই। কিন্তু বাকিগুলোর মধ্যে প্রাপ্ত কটি নাটক নাট্যরস সমৃদ্ধ তাই নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নাট্যবিদরা। তিরিশ বছর ধরে লেখা ওই নাটকগুলির (প্রাপ্ত ও নিখোঁজ) নাম আর প্রকাশকাল নীচে উল্লেখ করা হল —

১। ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০)— দীনবন্ধু মিত্র
২। ‘সাক্ষাৎদর্পণ’ (১৮৭১)— অজ্ঞাত লেখক
৩। ‘ভারত দর্পণ’ (১৮৭২)— প্রিয়লাল দত্ত ও ললিতমোহন শীল
৪। ‘পল্লীগ্রাম দর্পণ’ (১৮৭৩)— প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়
৫। ‘জমীদার দর্পণ’ (১৮৭৩)— মীর মশারফ হোসেন
৬। ‘কেরাণী দর্পণ’ (১৮৭৪)— যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ
৭। ‘চা-কর দর্পণ’ (১৮৭৫)— দক্ষিণারঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
৮। ‘জেল দর্পণ’ (১৮৭৫)— দক্ষিণারঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
৯। ‘দর্পণ’ (১৮৭৮)— অজ্ঞাত লেখক
১০। ‘টাইটেল দর্পণ’ বা সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় (১৮৮৪)— প্রিয়নাথ পালিত
১১। ‘বঙ্গদর্পণ’ (১৮৮৪)— গোপালকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়
১২। ‘গৃহ দর্পণ’ (সাজার কাজে হাজার গোল) (১৮৮৭)— কালীকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়
১৩। ‘মিউনিসিপ্যাল দর্পণ’ (১৮৯২)— সুন্দরী মোহন দাস।


এই তেরোটি দর্পণ নাটকের মধ্যে ‘ভারতদর্পণ’, ‘কেরাণী দর্পণ’, ‘দর্পণ’, ‘গৃহদর্পণ’ আর ‘মিউনিসিপ্যাল দর্পণে’র কোনো পাণ্ডুলিপি কিংবা মুদ্রিত বই পাওয়া যায়নি।

আর্থসামাজিক সমস্যার দর্পণ হিসাবে দীনবন্ধু যে বাস্তবতা নির্ভর নাট্যধারার বোধন করলেন, উনিশ শতকের সেই ধারা পরবর্তীকালে আরও বিকশিত, আরও বহুবর্ণী ও বহুস্পর্শী হয়ে নাট্য নির্মাণে নতুন প্রকৃতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আর গণনাট্যের উদ্বোধনকেও প্রভাবিত করেছিল। —ভাবতে অবাক লাগে, যে ইউরোপীয় মঞ্চকর্মের অনুসরণে বাংলার মঞ্চনাট্য বা থিয়েটার গড়ে উঠেছিল লেবিয়েদভ সাহেবের হাত ধরে, সেই ইউরোপীয় নাটকের মহত্তম প্রতিভা শেকসপিয়রের কালজয়ী নাটকগুলো তো সমকালীন আর্থসামাজিক দর্পণ। তাঁর লেখায় নশ্বর মানুষের অবিনশ্বর জীবন দর্পণের আবিষ্কার করেছেন উত্তরকালের নাট্যবিদরা। কৃষকের যন্ত্রণা, ক্রীতদাসের লাঞ্ছনা, ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির লোভ বল্গাহীন অর্থের কিংবা সোনার লালসা এবং এসবের অভিঘাতে রাজতন্ত্র কিংবা সামন্ততন্ত্রের অবাধ ব্যভিচার— এতসব বহমান জটিল সমস্যার দর্পণ হিসাবে শেকসপিয়রের রচনাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন উত্তরকালের সমাজবিজ্ঞানীরা আর বেশ কিছু আধুনিক নাট্যবিদ। বাংলার ‘দর্পণ’ নাটকের দুশো বছর আগে লেখা শেকসপিয়রের নাটকের কৃষক (ক্রীতদাস) আর রাজতন্ত্র সামন্ততন্ত্র সামাজিক দৃশ্যপটের কমবেশি সমধর্মিতার আলোয় আমরা দর্পণ নাটকগুলিতে বর্ণিত গ্রামীণ অবিচার ও অবক্ষয়ের চিত্রগুলোকে আলোচনা করতে আগ্রহী হতে পারি।

মনে রাখা দরকার, ‘দর্পণ’ নাটকের পথিকৃৎ ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ভাবনার পিছনে বহমান ধর্মীয় চেতনা কিংবা দূর ইতিহাসের কল্পনাশ্রয়ী আখ্যান কিন্তু দীনবন্ধুকে প্রভাবিত করেনি। ঢাকায় ডাকবিভাগের চাকরি নেওয়ার আগে দীনবন্ধু নীলকরদের অত্যাচারের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন,— তাঁর আন্তরিক সহানুভূতি ও প্রতিবাদী চেতনার অব্যক্ত অভিঘাতের বিস্ফোরণমুখী যন্ত্রণাকে বাঙ্ময় করার সুযোগ দিল ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ সরকার নিয়োজিত ইন্ডিগো কমিশন। এদেশকে লুণ্ঠন করতে আসা ইংরেজ ব্যবসায়ীরা যখন নীলের চাষ শুরু করল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পুরো মদত দিচ্ছিল প্রচুর মুনাফার সুযোগ করে দেওয়া এই নীলচাষের পাশবিক বাধ্যতায়। তবে অন্য ফসল উৎপাদন বন্ধ করে কৃষকের পক্ষে অলাভজনক নীলচাষকে যে শাসক কিংবা শোষক ছাড়া বাকি মানুষ, বিশেষ করে আক্রান্ত কৃষিজীবী সম্প্রদায় বেশিদিন মানবে না এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি চতুরতা ব্রিটিশ বেনিয়াদের অবশ্যই ছিল। তাই এদের অলিখিত বোঝাপড়াটা ছিল, যত দ্রুত সম্ভব প্রবল অত্যাচার, উৎকোচ, দেশীয় বৃহৎ সামন্ত প্রভুদের তোষামোদ ও অনুগ্রহ দিয়ে অসংগঠিত কৃষকদের জোর করে নীলচাষে বাধ্য করা। যথেষ্ট উর্বরা, প্রচুর ফলনশীল বঙ্গদেশের মাটি চিরকালই কুলাক শ্রেণির আর দেশি-বিদেশি লুঠেরাদের প্রিয় মৃগয়া ভূমি। লুটেরা ‘ছোটো’ ইংরেজদের একতরফা আক্রমণ, নির্যাতন, নারীধর্ষণ, অনিচ্ছুক কৃষকদের উপর বেপরোয়া অত্যাচারের খবর মানবতাবাদী বড়ো ইংরেজদের কানে পৌঁছোবার বিশেষ কোনো মিডিয়া তখন ছিল না। যে কটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংবাদপত্র ছিল, তাদের নীলকররা প্রাপ্ত বিপুল মুনাফা থেকে কিছু আর্থিক উৎকোচ ও অন্যান্য প্রমোদ-উপকরণ উপহার দিয়ে একদিকে আইন বা বিচার ব্যবস্থা অন্যদিকে শহুরে বিবেকবান বুর্জোয়াদের নীলচাষের নামে এই বীভৎস অত্যাচার সম্পর্কে জ্ঞানত বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। অবাধ অত্যাচার আর লুণ্ঠনের একতরফা পেষণে বাংলা জুড়ে যখন নীলচাষিরা গর্জে উঠল, সেই তীব্র গর্জন কোনো কৌশলী দেওয়াল দিয়ে চেপে রাখা যাচ্ছিল না। লেফটেন্যান্ট গর্ভনর স্যার পিটার গ্র্যান্টের বিবরণী, স্যার আসলি ইডেনের দেওয়া সাক্ষাৎকার আর ইন্ডিগো কমিশনের রিপোর্ট অবলম্বনে ১৯০৫ সালে প্রকাশিত সমাজবিজ্ঞানী এইচ. সি. চাকলাদার লিখলেন, “To carryout this system of compulsion, troops of extortionate servants and overseers were retained, licention clubmen were hired, the police were heavily bribed and gagged, the magistrates, the protectors of the people were frequently wheeled into sacrificing justice to favour the planters, some of the leading Anglo Indian papers were persuaded and perhaps subsidised to fight for them in the metropolis….”

নীল চাষে নারাজ রায়তদের গুলি করে কিংবা বর্শা বিঁধিয়ে মারা, অস্বাস্থ্যকর নোংরা সংকীর্ণ গুদামঘরে আটকে রাখা, মেয়েদের নীলকরদের কুঠিতে ধরে এনে ধর্ষণ করা— এইসব অবাধ বীভৎসা অনিবার্যভাবেই চাষিদের ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। ব্রিটিশরা যে দেশকে পুরোপুরি লুণ্ঠন করতে এসেছিল, সূচনালগ্নেই সেই দেশের বৃহত্তম শ্রেণির একটা অংশের এই প্রবল বিক্ষোভের মুখে এতদিনে ব্রিটিশ শাসকদের বুদ্ধিদীপ্ত মানবিক মুখ দেখা গেল। স্যার পিটার গ্রান্ট, স্যার আসলি ইডেন, হার্সেল, স্টিনকার প্রমুখ ‘বড়ো’ ইংরেজরাও অবস্থা সামলাতে এগিয়ে এলেন। বৃহত্তর শ্রেণিস্বার্থ ক্ষুদ্রতর শ্রেণিঅন্যায়কে ভর্ৎসনা কিংবা তিরস্কার করাটাও এক ধরনের চতুর রাজধর্ম। ইন্ডিগো কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে রেভারেন্ড জেমস লঙ বললেন, “….of all the obstacles of the spread of Christianity in India one of the greatest in the irreligious conduct of many of my own countrymen.”

গর্ভনর স্যার পিটার গ্র্যান্ট নদিয়া আর যশোহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত কুমার ও কালীগঙ্গার তীরবর্তী উত্তেজিত জনতাকে নদীর দুই ধারে দাঁড়িয়ে “প্রাণ দেব কিন্তু নীল বুনব না”— বলে চিৎকার করতে দেখেছিলেন তাঁর নদীপথে যাবার সময় এবং একই স্লোগান শুনেছিলেন ফেরার সময়। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত Hindu Patriot-এ এসব নীলচাষির দুর্দশা ও নীলকরদের অমানুষিক অত্যাচার নিয়ে তীব্র মসীযুদ্ধ শুরু করলেন। এসবের ফলেই বুদ্ধিমান ব্রিটিশ শাসকদের তৈরি করা ‘ইন্ডিগো কমিশন’ ‘বড়ো’ ইংরেজদের সঙ্গে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়ল। তার আগে এতদিন ধরে মার খাওয়া রায়তরা আত্মরক্ষার জন্য সহিংস লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করে ফেলেছে এবং নীলকরদের লাঠিয়ালের মোকাবিলায় প্রস্তুত হয়েছে। এই উত্তেজক নাটকীয় বাস্তব দেখতে কোলকাতা থেকে বাবুরা বজরায় চেপে আসছেন। বাংলার কবিরা গান বাঁধলেন— “মোল্লাহাটির লম্বা লাঠি, রইল আর সব হুদার হাটি/কলকাতার বাবুসব ভয়ে এলে বজরা চেপে/লড়াই দেখবে বলে/রাইয়তেরা তৈরি এবার মুখ বুজে মার খাবে না/লাঠিয়ালের সঙ্গে লড়াই, না মেরে জান দেবে না।”

১৮৬০ সালের ইন্ডিগো কমিশনের প্রকাশিত রিপোর্টে নীলকরদের নীলচাষ পদ্ধতিকে “Coercive system” বলা হল এবং দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’ নাটক মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হল পরের মাসে, মানে সেপ্টেম্বরে। নাটক লেখার স্বভাবজাত দক্ষতার সঙ্গে নীলচাষিদের বিষয়ে এত দিনের বোবাকান্না দীনবন্ধুকে এই অতিবাস্তব সমকালীন সমাজ-রাজনীতির নাটক লিখতে প্রেরণা দিয়েছিল। অভিনয়ের আগেই এই নাটক অভূতপূর্ব গণউম্মাদনা তৈরি করতে পেরেছিল। ডাকবিভাগের কর্মী দীনবন্ধু প্রথমে স্বনামে এই নাটক প্রকাশ করতে পারেননি। কিন্তু প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে শুধু পাঠ থেকেই (অভিনয় তো অনেক পরের কথা) যে আলোড়ন তৈরি হল এই নাটককে ঘিরে তার আংশিক বিবরণ পাওয়া যায় শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখায়: ‘হঠাৎ যেন বঙ্গ সমাজ ক্ষেত্রে উল্কাপাত হইল।… নীলদর্পণ কে লিখিল জানিতে পারা গেল না। কিন্তু বাসাতে বাসাতে “ময়রাণী লো সই/নীল গেঁজেছো কই?”— ইত্যাদি দৃশ্যের অভিনয় চলিল।’ ঘরে ঘরে ঘরোয়া অভিনয় তবু সাবধানী থিয়েটার ব্যবসায়ীরা বারো বছর অপেক্ষার পর নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে লেখা এই নাটকের মঞ্চায়নের সাহস পেয়েছিল কলকাতায়। কিন্তু ন্যাশনাল থিয়েটারে এই নাট্যাভিনয়কে সমর্থন করেননি গিরিশচন্দ্র,— বরং প্রবাদপ্রতিম নাট্যকার নাট্যপরিচালক যেভাবে তীব্র ব্যঙ্গমিশ্রিত ভাষায় সমালোচনা করে ওই অভিনয়ের বিরোধিতা করলেন, তা আমাদের বিস্মিত করে বই-কি। হয়তো ন্যাশনাল থিয়েটারের নাম বা গুডউইল, মালিকানা আর সংগঠন বিষয়ক দ্বন্দ্ব বা আধিপত্যের নিরাপত্তাবোধই তৎকালীন বাংলার শ্রেষ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্বকে ক্ষুদ্র স্বার্থে বৃহত্তর নাট্যঘটনাকে প্রাপ্য মর্যাদা ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কুণ্ঠিত করে রেখেছিল। বৃহৎ জমিদার, ব্রিটিশভক্ত দেশীয় ধনিক শ্রেণি যারা দেশের মানুষের ও সমাজ সংস্কৃতির কোনো কথা না ভেবে শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থেই চিরকাল অন্ধ ব্রিটিশপ্রেমী রয়ে গেল, দেশের কোনো গণ আন্দোলন, দেশবাসীর পক্ষে কোনো অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করল না, তাদের বাদ দিয়ে দীনবন্ধু ছোটোখাটো জমির মালিক কায়স্থ ‘বসু’ পরিবারকে কেন তাঁর ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মুখ্য ভূমিকায় আনলেন কেনই বা গিরিশবাবুকে বা তার থিয়েটারকে কলকাতার মুৎসুদ্দি ধনিক মহাজনদের চটাতে সাধারণ মানুষ, ছোটখাটো জমিজোতের মালিক, মধ্যবিত্ত শ্রেণি আর সহজসরল গ্রামীণ নাট্যদর্শক ভালোবেসে বাঁচিয়ে রেখেছিল— এই বাস্তব শ্রেণি অবস্থানকে একটু বিশ্লেষণ করলে অবশ্যই নীলদর্পণকে গিরিশচন্দ্র স্বাগত জানাতেন এবং সবরকম সাহায্য করতেন। রাজতন্ত্র সামন্ততন্ত্রের সমার্থক কিংবা সমস্বার্থ বিলাসী ধর্ম ব্যবসায়ীকে বড়ো বড়ো জোতদার জমিদার থেকে রাজা-মহারাজারা শ্রেণিঅবস্থানের স্বার্থেই সক্রিয় সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষণা দিয়ে আসছেন দীর্ঘকাল ধরে, কিন্তু দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’ থেকে গিরিশচন্দ্রের ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’ বা ‘প্রফুল্ল’-কে ‘বড়োরা’ পৃষ্ঠপোষণা করতে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি। বরং ছোটোখাটো জমিমালিক, মধ্যবিত্ত দর্শক, সামন্ততন্ত্রের জোয়ালভাঙা নতুন আলোয় অভিষিক্ত যৌবন তাঁকে যেভাবে সমর্থন জানিয়েছেন সেটাও তো শ্রেণিঅবস্থানের যুক্তিতেই সহজবোধ্য। গ্রামীণ কৃষিজীবী আর নিম্নবর্গীয় মানুষদের সবরকম আর্থিক সামাজিক ও যৌনপীড়নে অভ্যস্ত কুলাকশ্রেণি কী করে নীলদর্পণ-এর দৃশ্য নিরপেক্ষভাবে উপভোগ করবেন?—

১। গোপী : ধর্মাবতার যে লোকসানে জমি পড়ে আছে, তাহা হইতে ৯ বিঘা কেন, ২০ বিঘা পাট্টা করিয়ে দিতে পারি।

সাধু : (স্বগত) হে ভগবান! শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল! (প্রকাশ্যে) হুজুর যে ৯ বিঘা নীলের জন্য চিহ্নিত হইয়াছে তাহা যদি কুটির লাঙ্গল, গরু ও মাইন্দার দিয়া আবাদ হয়, তবে আমি আর ৯ বিঘা নতুন করিয়া ধানের জন্য লইতে পারি। ধানের জমিতে যে কারকিত করিতে হয়, তার চারগুণ কারকিত নীলের জমিতে দরকার পড়ে; সুতরাং যদি ও ৯ বিঘা আমায় চাষ দিতে হয়, তবে বাকি ১১ বিঘাই আমার পড়ে থাকবে, তা আবার নূতন জমি আবাদ করব।

উড : শালা বড়ো হারামজাদা, দাদনের টাকা নিবি তুই, চাষ দিতে হবে আমি; শালা বড়ো বজ্জাত (জুতোর গুঁতো প্রহার), শ্যামচাঁদকা সাৎ মুলাকাৎ হোনেসে হারামজাদাকি সব ছেড়ে যাগা। (দেওয়াল হইতে শ্যামচাঁদ গ্রহণ)

২ : (কিংবা তৃতীয় গর্ভাংকের রোগ সাহেবের কামরায় সেই ভয়াবহ দৃশ্যটি যেখানে সন্তানসম্ভবা ক্ষেত্রমণি ও রোগ মুখোমুখি)

ক্ষেত্র : ও…. সাহেব। তুমি মোর বাবা ও সাহেব তুমি মোর বাবা, মোরে ছেড়ে দাও, পদী পিসির সঙ্গে দিয়ে মোরে বাড়ি পেটায়ে দাও, আঁদার রাত, মুই একা যাতি পারব না (হস্ত ধরিয়া টানল) ও সাহেব, তুমি মোর বাবা, ও সাহেব তুমি মোর বাবা, হাত ধল্লি জাত যায়, ছেড়ে দেও, তুমি মোর বাবা।

রোগ : তোর ছেলিয়ার বাবা হইতে ইচ্ছা হইয়াছে। আমি কোনো কথায় ভুলিতে পারি না, বিছানায় আইস, নচেৎ পদাঘাতে পেট ভাঙিয়া দিব।


এই দুই আংশিক কৃষিজীবীদের উপর নীলচাষের জন্য নীলকরদের নির্মম অত্যাচার আর জমির মালিকের পরিবারের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ক্ষেত্রমণির উপর রোগ সাহেবের বীভৎস যৌনপীড়ন আসলে বিন্দুতে সিন্ধু-দর্শন। চাবুকের (শ্যামচাঁদের) আস্ফালন থেকে ঘরের বউকে ধরে এনে ধর্ষণ— নীলকরদের অত্যাচারের এমন সব খণ্ডচিত্রগুলির পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হয়, গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজের উপর প্রতিরোধহীন একবগ্না অত্যাচার আর মহিলাদের সর্বাত্মক নির্যাতন-এর মুখেও দুর্মর সংস্কার। অন্যজাতের লোক হাত ধরলে জাত যাবে বলে ক্ষেত্রমণি যখন আতঙ্কে ভেঙে পড়ে, তখন চরম অত্যাচারের মুখে দাঁড়িয়ে শতাব্দী স্বীকৃত সংস্কারকেও (জাতপাতের) ভুলতে না পারার যন্ত্রণা শরীর আর মনের আতঙ্ককে ছাপিয়ে যায়। অত্যাচারী বিটিশ বিরোধী ঘৃণাকে প্রবলতর করেছিল ধর্মীয় সংস্কার। রাজনৈতিক চেতনায় আলোকিত সূতিকাগারে সামাজিক সংস্কারের দুরপনেয় একটা ভূমিকাও সক্রিয় ছিল। নীলদর্পণ-এর অনুকরণে পরবর্তী দর্পণ-নাটক ‘সাক্ষাৎ দর্পণ’ (১৮৭২) (লেখক অজ্ঞাত)-এর প্রকৃতিগত পার্থক্য স্পষ্ট। বাল্য বিবাহ, বিধবা বিবাহ, প্রশাসনের দুর্বলতার পাশাপাশি এ নাটকে শহুরে ইয়ংবেঙ্গলদের মদ্যপানজনিত সমস্যা আর বেশ্যাসক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। নাটক হিসাবে অক্ষম রচনা, তবে ১৮৭২ সালের নাটকে সুবোধ ও কামিনীর নিষ্ফল প্রেমের চিত্রটি যে দুঃসাহসিকতায় চিত্রিত হয়েছে (সুবোধ ও কামিনীর প্রকাশ্য চুম্বন দৃশ্যসহ) তাতে একটা নতুন শেকলভাঙা অনুভবের স্পর্শ পাওয়া যায়। এ নাটকে কেদার তাই নতুন আবেগে বলে ওঠে— ‘… আমরা কি চেষ্টা করলে এর নিবারণ করতে পারি নে? স্বাধীন হোতে পারি নে? রাজকীয় স্বাধীনতার কথা আমি বলছি নে। আমাদের নিজের “ইনডিভিজুয়াল” স্বাধীনতা বজায় রেখে যদি চলতে পারি তাহলেও যে দেশের অনেকটা মান থাকে।’

কিংবা এ নাটকের শেষ দৃশ্যে সুবোধ যখন কামিনীকে কর্মক্লান্ত হতভাগা চাষির সুখের সাময়িক ছবিটি তুলে ধরে তখন সমকালীন কৃষিজীবীদের সম্পর্কে নাট্যকারের দরদী মন গোপন থাকে না। সুবোধ বলে, ‘মনে কর একজন চাষা সমস্তদিন রোদে তেতে পুড়ে যখন বাড়ি আসে, আর তার ছেলে তাকে এক ছিলিম তামাক সেজে দেয়, তার স্ত্রী তাকে এক ঘোরা পান্তা ভাত দেয় তখন যদিও চাষার স্ত্রী আর ছেলে তাকে দেখে সুখী হয় বটে, কিন্তু তামাক খেয়েই হোক, পান্তাভাত খেয়েই হোক আর সমস্ত দিনের পর স্ত্রী আর ছেলের মুখ দেখেই হোক, চাষা যে তখন সকলের চেয়েও সুখী হয়, এ স্বীকার করতেই হবে।”

১৮৭৩ সালে প্রসন্নচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লিখলেন, ‘পল্লীগ্রাম দর্পণ’। এ নাটকে জমিদার শ্রেণির স্বার্থপরতা, অশিক্ষা আর কুসংস্কারে ডুবে থাকা পল্লীসমাজ, জমিদারদের শিক্ষাবিস্তারে আগ্রহের বদলে নেশায় আর ধর্মীয় উৎসব আড়ম্বরে ডুবে থাকার প্রবণতা, মিথ্যা মামলার জন্য দেদার খরচের মানসিকতা, গ্রাম্য দলাদলি আর কোন্দল এবং কৌলীন্য প্রথার ট্র্যাজেডি ইত্যাদি বহু প্রসঙ্গ এলেও নাট্যরস আদৌ দানা বেঁধে ওঠে না কোথাও। অতি নিম্নমানের রচনাটি শুধু দর্পণ রচনার দৃষ্টান্ত হিসেবেই হয়তো নামে বেঁচে আছে। এই নাটকে চাষিদের চরিত্র বা সংলাপ অন্য চরিত্রের মতোই বাস্তবানুগ নয়। কোনো চরিত্রকেই রক্তমাংসের মানুষ বলে মনে হয় না। লম্বা সংলাপের মধ্য দিয়ে নাট্যকারের বিদ্যে আর উপলব্ধি হাজির করে তারা প্রায়শই অপ্রাসঙ্গিকভাবে। ভগবান রায় নামক চরিত্রটি বিশাল গদ্য সংলাপ উচ্চারণ শেষে হঠাৎ প্রায় ৫০ লাইনের কবিতা পাঁচালির মতো বলতে থাকে, যেখানে গ্রামীণ দুরবস্থার ভাসাভাসা খণ্ডচিত্র পাওয়া যায়।


ভগবান রায়: …..বসিয়াছে বন গাঁয়ে হয়ে শ্যাল রাজা।
করিতেছে দুঃখীদের হাড় ভাজা ভাজা।
বালীশেতে ভুড়ি কাত মুখে আলবোলা। হুকুম সাদের যেন নবাবের পোলা।। এইরূপ হরিতেছে ভরিতেছে থলে।
মরণ সময়ে নাহি বেঁধে দিবে গলে।।……
(৭ম অঙ্ক ৫ম দৃশ্য)


তুলনায় ‘জমীদার দর্পণ’ অনেক বেশি নাট্যগুণ সমৃদ্ধ। মীর মশারফ হোসেন ছিলেন জমিদার বংশের ছেলে। অথচ ১৮৭৩ সালে তার সাহসী রচনা ‘জমীদার দর্পণ’ সেই জমিদার শ্রেণির লাম্পট্য, অমানুষিকতার বিশ্বস্ত দলিল হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। নীলকরদের অত্যাচারকে তুলে ধরেছিল ‘নীলদর্পণ’ নাটক, তারই অনুসরণে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ তদানীন্তন বাংলার ভূস্বামীদের অনুরূপ অত্যাচারের এক জ্বলন্ত কাহিনি বর্ণনা করিয়া মীর মশারফ হোসেন তাঁহার দ্বিতীয় নাটক ‘জমীদার দর্পণ’ রচনা করেন।

(‘বাংলা নাট্য ইতিহাস’— আশুতোষ ভট্টাচার্য)

হিন্দু কিংবা মুসলমান-জমিদার শ্রেণির অত্যাচারে, লাম্পট্যে আর নিষ্ঠুরতায় এবং খেয়ালখুশি মত প্রজাপীড়নে কোনও বিশেষ ভেদরেখা দেখা যায়নি। অত্যাচারী জমিদার হায়ওয়ান আলী (‘জানোয়ার’ নামে পরিচিত) তার অধীনস্থ প্রজা আবু মোল্লার সুন্দরী রূপবতী স্ত্রী নূরন্নেহারকে দেখে লালসা আর কামনার আগুনে পুড়ে মরছে, তাকে ভোগ করতে উন্মাদপ্রায়। শতরকম লোভের সামনে হায়ওয়ানের প্রস্তাবে নারাজ নুরুন্নেহারকে জোরপূর্বক পীড়ন করা হল। আবু মোল্লাকে জরিমানা করা হয়, জরিমানা দিতে অক্ষম ওই চাষিকে পরে নির্যাতন করা হয়। একই সঙ্গে বিচার-ব্যবস্থার প্রহসনও নাটকটিকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। নিজের জমিদার বংশীয় অভিজ্ঞতার সূত্রে নাট্যকার মীর মশারফ অনুধাবন করেছিলেন যে, বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষিজীবীরা প্রায় সবক্ষেত্রেই শোষণ আর নির্যাতনের প্রতিকারহীন দুরবস্থার শিকার, সেখানে ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।’ তাই বলা হয় সন্তানসম্ভবা নুরুন্নেহারের করুণ মৃত্যু হলে জমিদার অনুগত ডাক্তার পরীক্ষা করে রিপোর্টে লেখেন, “No Marks of external violence except on the genetal profuse discharge of blood from the said part” এবং শেষে নির্লজ্জ হাস্যকর সিদ্ধান্ত— “In my opinion she must have died of Sanguinous apolexy of the brain.” (তৃতীয় অংক/পাঠদৃশ্য) আবু মোল্যা আদালতের শরণ নিলে জমিদারের হাতের পুতুল বিচারক মামলা খারিজ করে দেন। শেষ পর্যন্ত আবু মোল্যার ঘর-বাড়ি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে জমিদার তাকে গ্রামছাড়া করে।

দৃশ্য রচনায় বিশেষ করে কৃষকদের নির্যাতনদৃশ্যে এ নাটকে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের প্রভাব স্পষ্ট। তবে সংলাপের প্রাঞ্জল ভাষায়, তৎসম শব্দের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে এবং স্বাভাবিকতায় মীর মশারফ অনেক ক্ষেত্রেই দীনবন্ধুকে ছাপিয়ে গেছেন।

আবু মোল্লার স্ত্রী খুন হবার পর প্রথম চাষি ও দ্বিতীয় চাষির সঙ্গে পুলিশের সংলাপ অংশটি দৃষ্টান্ত হিসাবে মনে করা যাক।


(ইন্সপেক্‌টরের সহিত আবু মোল্লার প্রবেশ)

দ্বিতীয় চাষা : …..ও মামুদি, ওই সাএব (পলাইতে উদ্যত)
ইনস্পেকটর : খাড়া রও, কাঁহা যাতা হ্যায়?
প্রথম চাষা : (হুকা ফেলিয়া করজোড়ে) কর্তা! আমরা কিছু জানিনে।
ইনস্পেকটর : (শবের নিকট যাইয়া) এই মেয়েলোকটি কে? কি হয়েছে? এরকম এখানে পড়ে কেন?

প্রথম চাষা : মরে গেছে, শুনিছি খুন হয়েছে।
আবু : ধর্মাবতার আমার সর্বনাশ হয়েছে, আমার মাথায় বাড়ি হয়েছে। হুজুর আমার জাত-কুল-মান সকলি গেল (সক্রন্দনে) হায় আমার কি হবে?


শেষে সংস্কৃত নাটকের অনুসরণে এ নাটকে নট-নটী আসেন। নটী উচ্চারণ করে সময়ের ট্র্যাজিক সত্য।


অবলা অমূল্য রত্ন সতীত্ব রতন, হরিল দুৰ্ম্মতি পাপ পাষণ্ড বর্বর জমীদার। ধৰ্ম্মাসনে হল না বিচার।....

দর্পণ নাটক হিসাবে মীর মশারফের এই নাট্যরস সমৃদ্ধ রচনাটিও সময়ের দলিল হিসাবে স্মরণীয়।

দক্ষিণারঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের ‘চা-কর দর্পণ’ নাটক (১৮৭৫) চা-কুলি কামিনদের দুঃসহ অবর্ণনীয় কষ্ট আর যন্ত্রণার বিশ্বস্ত মুকুর। দেওয়ান চমনলাল-এর সাম্প্রতিক গবেষণা গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘চা-বাগানের কুলিরা জেলের কয়েদি অপেক্ষাও অধম……।’ ‘চা-কর দর্পণ’ নাটকে দেখা যায় এই কুলিদের অধিকাংশ প্রাক্তন চাষি। নাটকে খরা ও অজন্মার ক্রমাগত আক্রমণে চাষিদের মরণ-বাঁচনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। তবু ভয়ে কিংবা বংশানুক্রমিক ভক্তিতে জমিদারকে ছেড়ে সারদা ও বরদা এবং তাদের স্ত্রী দুজন (নৃত্যকালী ও সরমা) যখন বাইরে অন্নের খোঁজে যেতে পারছে না, তখনই চা-বাগানে কুলি জোগানোর আড়কাঠি হরিদাস চক্রবর্তীর আবির্ভাব এবং সপরিবার দুই বিপন্ন চাষিকে কাছাড়-সিলেটে কাজ করার জন্য নিয়ে যায়। তাদের উপর নতুন নির্যাতন আর পেষণ বুভুক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়। গাঁয়ের বিপন্ন অনাহারী চাষি পরিণত হয় চা-বাগানের শৃঙ্খলিত শ্রমদাসে। মাঝখানে ভাগ্যান্বেষী হয়ে অন্যত্র যাবার পথও রুদ্ধ। সেই সময় এক জমিদারের রাজত্ব ছেড়ে অন্য জমিদারের রাজত্বে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ‘জমিদার একেবারে প্রাণে মেরে ফেলবে।‘ ফলে আড়কাঠির সাহায্য নিয়ে চা-বাগানে পালিয়ে আসা।

এ নাটকে গ্রামীণ কৃষক সমাজের বৈশিষ্ট্য চমৎকারভাবে সারদা ও বরদার চরিত্রচিত্রণে প্রতিভাত হয়েছে। যদিও বরদা চরিত্রটি বেশি প্রাণবন্ত। ১৮৭৫ সালে লেখা এই নাটকটির বাস্তব চিত্রগুলি এতই সজীব ও অব্যর্থ ছিল যে পরবর্তীকালে ১৮৮৫-তে সঞ্জীবনী পত্রিকায় লেখা হয়েছিল যে চা-কুলিদের উপর অত্যাচারের বিবরণ প্রকাশে ভীত ও ক্ষিপ্ত হয়ে পত্রিকাটির লেখকরাই চা-কর সাহেবদের বন্দুকের প্রথম বলি হতে চলেছিল। নির্মল কুমারী মহলানবীশ চা-কর সাহেবদের অত্যাচারের প্রেক্ষিতে লিখেছিলেন, ‘চা পান না কুলির রক্তপান।….’ এখানেও বিচারহীন বল্গাহীন শোষণের দৃশ্য। নীলদর্পণ-এর পর ‘চা-কর দর্পণ’ নাটকটি সামাজিক স্তরে যথেষ্ট প্রভাব সৃষ্টি করেছিল।


(ম্যাকলিন সাহেব কুকুর সমভিব্যাহারে প্রবেশ।)
ম্যাকলিন : এ শালা, লোক সব আয়া?
নিধু : খোদা বন্দ, সকলেই এসেছে।
ম্যাকলিন : ও শালা লোক কো চাবুক দিয়া?
নিধু : হুজুর দেওয়া হয় নাই।
ম্যাক : তব্‌ তোমকো চাবুক দেগা! (চাবুকের দ্বারা প্রহার)

(চতুর্থ অংক, প্রথম দৃশ্য)


অথবা ওই দৃশ্যেই নির্যাতিত বরদা যখন সাহেবের মুখের পর সত্যি কথা বলে এবং সাহেবের জুতোশুদ্ধ লাথি খায় তখনও নাট্যকারের ভায় ও বর্ণনা চমৎকারভাবে স্বাভাবিক।

বরদা : তোমার কাজ মানুষে করে? আমরা তোমরা কাজ করতেও চাই না, আমাদের মাইনে চুকিয়ে দাও, আমরা চলে যাব।
ম্যাক : আমার কাজ কেন মানুষে করবে না?
বরদা : কেন করবে না আবার কি? তুমি আমার বউয়ের জাত মেরেছো কেন? আহা! সেই দুঃখে প্রাণত্যাগ করেছে। (ক্রন্দন)
ম্যাক : (হাসিতে হাসিতে) তোমার বউয়ের তো আমি জাত মারি নাই, আমি তাহাকে সভ্য সিভিলাইজড করিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। সে আমার কথা শুনিল না, প্রাণে মরিয়া গেল। (দৃশ্য ৪/১)


শুধু কৃষকরা নয়, ওই সময় কৃষকদের পাশাপাশি কর্ষণত্যাগী চা-বাগানের শ্রমজীবীরাও কীভাবে নির্যাতিত হত তার আবেগতপ্ত দৃশ্য রচনা করেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন। পরিমিতি বোধের অভাব এবং শেষ দৃশ্যে দুর্বল সংলাপে ও কাঁচা ঘটনা প্রকল্পে পরিবর্তিত করুণরস ছাড়া নাটকটি মোটামুটি সুখপাঠ্য আর সুঅভিনয়যোগ্য।

‘চা-কর দর্পণ’-এর নাট্যকারের আর এক উল্লেখযোগ্য নাটক ‘জেল-দর্পণ’ (১৮৭৫)। এই নাটকের পটভূমি অন্য দর্পণ নাটকগুলো থেকে অনেক বেশি প্রসারিত। এই সময়ে যে কোনো সাধারণ মানুষকে যে কোনো কারণে জেলবন্দি করা হত। ‘নীলদর্পণ’ থেকে ‘চা-কর দর্পণ’ নাটক পর্যন্ত সামাজিক নাটকগুলোতে সাধারণভাবে বিশেষ একটি শ্রেণি (মূলত কৃষিজীবী)-র উপর অত্যাচার যেখানে মূল ‘প্রেমিস’, সেখানে এ নাটকে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত শহর ঘেঁষা মানুষের অন্যায় পীড়ন এ নাটকের বিষয়বস্তু। ফলে বাবু-কালচার, ধনী জমিদার-নন্দনদের বেলেল্লাপনা আর এসবের বিপ্রতীপে অন্তঃপুরবাসিনীদের দুঃখ হাহাকার এ নাটকের বাস্তব প্রেক্ষাপট, মূলত জেলখানার দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার আসামিদের উপর কারা কর্তৃপক্ষের অমানুষিক পীড়নের দৃশ্যগুলো একটু বেশি আবেগপ্রবণ ও দীর্ঘ। চরিত্রগুলোও কৃত্রিম ও বৈচিত্র্যহীন। চা-কর দর্পণের তুলনায় এ নাটক গঠন ও নাটকীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে অনেক দুর্বল। পঞ্চম অংশে পনেরোটি দৃশ্য রচনায় শুধু জেলখানার অভ্যন্তরীণ পীড়ন দৃশ্য পৌনঃপুনিকতার জন্য মনে দাগ কাটে না। একটি ছোটো দৃষ্টান্তই নাট্যরস সৃজনে ব্যর্থতার প্রমাণ।

চতুর্থ অংশে তৃতীয় গর্ভাঙ্কে পাগলা গারদে কেষ্ট ও বেস্টর দীর্ঘ সংলাপ চলেছে।

বেস্ট : ….ভারতবাসীগণ… তোমাদের অনৈক্যতায় বাঙ্গালী নাম অন্তর্হিত হইবার উদ্যোগ হইল। তোমাদের অনৈক্যতায় ছোটো বড়ো লাট সাহেবরা যখন যে আইন কানুন ইচ্ছা করেন, তাহাই করিতেছেন। তোমরা কি এইসব দেখিয়া অন্ধ প্রায় হইয়া থাকিবে। তোমাদের স্বাধীন হইতে বলি না, সে আশা তোমাদের পক্ষে দুরাশা, সে তোমাদের পক্ষে বিড়ম্বনা। আমার ইচ্ছা, তোমরা ঐক্যতা স্থাপনে যত্নবান হও, বাণিজ্যে উন্নতি কর, কৃষিকার্যের উন্নতি বিষয়ে সচেষ্ট হও।…..

দুর্বল নাট্যগঠন সত্ত্বেও এ ধরনের সংলাপ রচনার মধ্য দিয়ে উনিশ শতকের এক নাট্যকার পরাধীন দেশের সামাজিক দুরবস্থা আর ব্রিটিশ পোষিত বাবু কালচারের বিপ্রতীপে আন্তরিকভাবেই মুমুক্ষা প্রকাশ করেছেন।

প্রিয়নাথ পালিতের ‘টাইটেল দর্পণ বা সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়’ (১৮৮৫) নাটকটি আর একটি অক্ষম রচনা। এক জমিদারের ‘রাজা রায় বাহাদুর’ টাইটেল পাওয়ার উন্মত্ত লোভ যে ব্যর্থতা ও দুরবস্থা ডেকে আনে দুই অংশের এই প্রহসনধর্মী রচনায় তাই প্রকাশ পেয়েছে। সামন্ততান্ত্রিক পরিবারের অভ্যন্তরীণ বিবর্ণ ছবি, অবৈধ সম্পর্কের গোপন সত্য— এসব উন্মোচনের পাশাপাশি ইংরেজ তোষণ আর সর্বনাশা উপাধি (টাইটেল) আসক্তি— সেই সময়ের জমিদারদের এই সাধারণ প্রবণতা নিয়েই এই নিম্নমানের নাটক।

১৮৮৪-তে প্রকাশিত গোপালকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদর্পণ’ নাটকও এমনই এক ব্যর্থ রচনা। সমকালীন সমাজে চাকুরি করেও গ্রাসাচ্ছাদন সম্ভব হত না এই তথ্যটি তুলে ধরার পাশাপাশি বাণিজ্যে বাঙালির মনোনিবেশ দরকার (ভূমিকায় ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’-প্রবন্ধটি লেখা) এই উদ্দেশ্য নিয়েই নাটকটি লেখা। ইংরেজরা যেখানে বাণিজ্য করেই ভুবনজয়ী, বাঙালি সেখানে পিছিয়ে থাকবে কেন— এমন ভাবনা থেকেই নাট্যকার শ্রেণিসমাজ দ্বন্দ্ব বিষয়ে পুরোপুরি অচেতন অবস্থায় এই অবাস্তব চাহিদার নাটক লিখেছেন। এ নাটকটি কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জীবন ও ঔপনিবেশিক অভিঘাতে বিপন্ন নগর জীবন— কোনো জীবনেরই দর্পণ হয়ে ওঠে না। সমাজ সমস্যার বহির্মুখ ও আন্তর অবস্থার অনুধাবনে তিন দশকের এইসব দর্পণ-নাটকের ভূমিকাকে নাট্যবিদগণ ও সমাজতাত্ত্বিকরা গুরুত্ব দিয়েছেন। ‘নীলদর্পণ’ ও তার প্রভাবে ও সাফল্যে অনুপ্রাণিত ‘দর্পণ’ নাটকগুলির মধ্যে ‘জমীদার দর্পণ’, ‘চা-কর দর্পণ’ উনিশ শতকের বাংলায় সামন্ততান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী যৌথ আক্রমণে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে অজ্ঞ অশিক্ষিত সংস্কারাচ্ছন্ন কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের বাস্তব অবস্থা কিংবা জীবন-যন্ত্রণা এই সব নাটকগুলোর মধ্যে দিয়ে কম বেশি প্রকট হয়েছে। এইখানে দর্পণ-নাটকগুলোর তাৎপর্য।

উৎপল দত্ত তাঁর বিখ্যাত ‘শেক্সপিয়রের সমাজ চেতনা’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন বুর্জোয়া বণিকসভ্যতা সামন্ততন্ত্রের চেয়ে প্রগতিশীল হলেও শেকসপিয়রকে কোনো অবস্থাতেই বুর্জোয়া প্রগতিশীলতার সমর্থক বলা যায় না ভারতবর্ষ কিংবা একটু ছোটো করে দেখলে উনিশ শতকের বঙ্গদেশ সম্পর্কেও বলা যায়। বণিকের মানদণ্ডের অভিঘাতে দেশ কতটা এগিয়েছিল তার হিসেব পরে। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের যে প্রবল নিপীড়ন আর বল্গাহীন শোষণের অভিঘাত সহ্য করতে হয়েছিল তারই জীবন্ত দৃশ্যকাব্য দর্পণ-নাটক। শেকসপিয়রের চোখের সামনেই ষোড়শ শতকের উদ্‌বাস্তু থেকে সপ্তদশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত এই শোষণ নির্বিবাদে সংঘটিত হচ্ছিল। শেকসপিয়রের চোখের সামনে বণিক বুর্জোয়াদের যে লুঠতরাজ চলছিল, সে সম্পর্কে মার্কস বলছেন— ‘প্রত্যেক উৎপাদককে লুণ্ঠন করা হয়েছিল নির্মম বর্বরতায় (vandalism)। সেই লুণ্ঠনের পিছনে ছিল এমন সব রিপুর উত্তেজনা, যেগুলি সবচেয়ে ঘৃণ্য, সবচেয়ে নীচ, সবচেয়ে নিকৃষ্ট, সবচেয়ে জঘন্য ও ন্যক্কারজনক।’


(‘Capital’-P.835-836)

শেকসপিয়র প্রায় এই ভাষাতেই তাঁর ‘Timon of Athens’-এ আক্রমণ করেছেন বণিকসভ্যতাকে।

আপেমাস্তুস : আপনি না বণিক?
বণিক : হ্যাঁ, আপাদমস্তক।
আপেমাস্তুস : তাহলে দেবতারা যদি আপনার সর্বনাশ না করেন, তবে আপনার পণ্য ব্যবসা যেন তা করে।
বণিক : ব্যবসা যদি আমার সর্বনাশ করে সে-ও তো দেবতাদেরই করা হল।
আপেমাস্তুস : ব্যবসাই আপনার দেবতা, তাই আপনার ঈশ্বর আপনার সর্বনাশ করুক।


উনিশ শতকের আমাদের দেশ লুণ্ঠনকারী ব্রিটিশ বণিকরা গ্রামগঞ্জের সামন্ততান্ত্রিক প্রতিবেশে যে ভাগ্যবান শিক্ষিত শহুরেদের উপভোক্ত নতুন সভ্যতার আলোককে ছাপিয়ে হিংস্র লুণ্ঠন নির্যাতনকেই নির্বিবাদে সামনে আনছিল, তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশের জন্য আমাদের কোনো শেকসপিয়র ছিলেন না, ছিলেন শুধুমাত্র দীনবন্ধু মিত্র কিংবা মীর মশারফ হোসেনের মতো মধ্যমেধার নাট্যকার। আর তাঁদের আলোড়ন-তোলা নাটকের কিছু অক্ষম ছানাপোনা। দর্পণ-নাটকগুলো সীমিত সাধ্যে সময়ের নাট্যবিম্বন হবার চেষ্টা করেছে। সময়কে আংশিকভাবে বিম্বিত করেছে মাত্র, সময়ের সংকটের ইঙ্গিত দিয়েছে মাত্র, নিষ্ফল আক্রোশে অত্যাচারিতরা দর্পণ-নাটকে মাথা খুটেছে, ঈশ্বরের কাছে দুর্ভাগ্যের জন্য হাহাকার করেছে, কিন্তু কালের রাখাল শেকস‌পিয়রের মতো একটি চরিত্রও বলতে পারেনি:


যে ধনীর আছে উদ্‌বৃত্ত, যার লালসায় ক্ষুন্নিবৃত্তি, তোমার নির্দেশকে যারা পদতলে দলে, তারা দেখতে পায় না, কেননা তাদের অনুভূতি নেই! তারা দ্রুত অনুভব করুক তোমার শক্তি! যাতে সুবন্টন এসে উদ্‌বৃত্ত জমানার অসাম্যকে ধবংস করে (“Distribution should undo excess”) সাধারণ মানুষকে দেয় যথেষ্ট।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান