শুভাশিস ভট্টাচার্য
গাঁও ছোড়ব নাহি জঙ্গল ছোড়ব নাহি মায় মাটি ছোড়ব নহি লড়াই ছোড়ব নাহি।। বাঁধ বনায়ে গাঁও ডুবোয়ে কারখানা বনায়ে জঙ্গল কাটে, খাদান খোদে, সেঙ্কচুরি (Sanctuary) বনায়ে জল জঙ্গল জমিন ছোড়ি হামিম কহা কহা যায়ে ৰিকাশ কে ভগবান বতা হম ক্যায়সে জান বচায়ে।। [...] ‘বিরসা’ পুকারে একজুট হোৰো ছোড়ো য়ে খামোশি মছৰারে আও, দলিত আয়ো, আয়ো আদিৰাসী খেত খালিহান সে জাগো, নগাড়া বজায়ো লড়াই ছোড়ি চারা নহি শুনো দেশবাসী।।
প্রায় বছর ১০-১২ আগে সামাজিক মাধ্যমে গানটির সন্ধান পাই। ওড়িশি মূল গানের ছত্তিশগড়ি তরজমা। এই শতকের গোড়ার দিকে এই গান হয়ে ওঠে খনি প্রভাবিত শোষিত, দুর্দশাগ্রস্ত, বাস্তুচ্যুত নিম্নবর্গের প্রান্তিক মানুষের প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহের অন্যতম হাতিয়ার। গানের একদম শেষ অংশে রয়েছে মুন্ডা বিদ্রোহের অন্যতম নেতা বিরসা মুন্ডার নামে শপথ নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নতুন করে একজোট হওয়ার উদাত্ত আহ্বান। একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।
ইতিহাস বলছে, আড়াই শতকেরও অধিককাল সময় জুড়ে এই বাংলায় বারবার শোনা গেছে বিদ্রোহের পদধ্বনি। একের পর এক আছড়ে পড়েছে বিদ্রোহের ঢেউ। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ (১৭৬৩ -১৮০০ খ্রিস্টাব্দ), রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ), চুয়াড় বিদ্রোহ (১৭৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দ), তিতুমীরের নেতৃত্বে বারাসাত বিদ্রোহ (১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ), নীল বিদ্রোহ (১৮৫৮-৬১ খ্রিস্টাব্দ) এবং পরবর্তী সময়ের তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দ)। শোষিত, নিপীড়িত, অত্যাচারিত প্রান্তিক নিম্নবর্গের মানুষ বারবার গড়ে তুলেছেন প্রতিরোধ, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন, শামিল হয়েছেন বিদ্রোহে। আর এই সকল বিদ্রোহেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে গান। ইতিহাস অনুসন্ধান করে সে সকল গানের যতটুকু উদ্ধার করা সম্ভব, সেখানে যেমন বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট, কারণ, সাফল্য-ব্যর্থতা, পন্থার বিবরণ পাওয়া যায়, তেমনই, নেতৃত্বের পক্ষে-বিপক্ষে, ইতিবাচক-নেতিবাচক সমালোচনারও হদিস মেলে।
পলাশীর যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ইংরেজ বণিকতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের বেলাগাম অত্যাচারে বাঙালী জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এইরকম এক ঘোর দুঃসময়ে, ১১৭৬ বঙ্গাব্দে (খ্রি. ১৭৭০) এল কালান্তক মন্বন্তরের নিষ্ঠুর আঘাত। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারালেন, কৃষি ও কারিগরি ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ ইংরেজের নিপীড়নের ইতি হল না বরং উত্তরোত্তর তা বেড়েই চলল। ৩/১১/১৭৭২ স্বয়ং হেস্টিংস জানিয়েছিলেন— যদিও দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোকের মৃত্যু হয়েছে, চাষের সর্বনাশা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তবুও ১৭৭১-তেই রাজস্ব আদায় ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দের থেকে-ও বেশি। এমনই এক ভাঙনের যুগে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের জন্ম এবং এই যুগ সন্ধিক্ষণেই সূচনা হয়েছিল গাথাকাব্য ধারার।
সমাজ জীবনের নানা আন্দোলন, প্রভাব, ঐতিহাসিক ছোটো-বড়ো ঘটনার চিত্র ফুটে উঠেছে গাথা কাব্যে। সবক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সত্যতা রক্ষিত হয়েছে একথা জোর দিয়ে বলা না গেলেও, এর সবটাই মিথ্যা বা কবির কল্পনার রঙে রাঙানো নয়। এবং এগুলি ছিল মৌখিক প্রচার নির্ভর। সংগীত ভিন্ন গাথা কাব্য অসম্পূর্ণ এবং এর সংগীতে পুনরাবৃত্তির গঠন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। কাব্যগুণে উন্নত না হলেও কবি জানতেন গ্রামের অধিকাংশ নিরক্ষর সাধারণ মানুষের কাছে ছন্দোবদ্ধ কবিতা, কাহিনিকাব্য, পাঁচালি বা ছড়ার গানের আবেদন অনেক বেশি, সেগুলির সহজবোধ্যতার কারণে। তাই কখনো কখনো কবি নিজেই অথবা গ্রামের কোনও কবিয়াল গায়েন গাথায় সুর দিতেন, সৃষ্টি হত গাথা-গান। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে মেদিনীপুর নিবাসী কবি মদনমোহন রচিত ‘রাস্তার কবিতা’ শীর্ষক গাথা গানের। যেখানে কবি হেস্টিংসের সময় কোম্পানি দ্বারা নির্মিত চণ্ডালগড় থেকে শালিখা পর্যন্ত রাস্তা তৈরির বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর গান শুরু করেছেন মেদিনীপুরের লৌকিক দেবী ‘রঙ্কিণী’-র নাম নিয়ে–
শুন শুন সর্ব্বজন একমন হঞা। রঙ্কিণী যখন আইল জাঙ্গার বাহিআ। চণ্ডালগড় হৈতে, চন্ডালগড় হৈতে
শেষ অংশে কবি বলছেন–
শীঘ্র গেল কাট্রাজুলা ধারে দিল তার থানা। সেখানে বান্ধিল বড়, সেখানে বান্ধিল বড়, কোরে দড় সাঁখারি খাটাআ মাঠে মাঠে শালিখাঘাটে উত্তরিল গিআ আড়পার কলিকাতাতে, আড়পার কলিকাতাতে, নৌকা পথে গঙ্গা পার হল্য। সহর দিআ হুজুর হআ কুর্নিশ করিল। শুনি সাহেব হর্ষ হোল, শুনি সাহেব হর্ষ হোল, পাঠাইল বহু সেনাগণ।
আবার ১২৮০ বঙ্গাব্দে ছদ্ম-ঐতিহাসিক পটভূমিতে, ‘অথ গোরার কবিতা’ নামে একটি গাথার সন্ধান মেলে, যেটির রচয়িতা ছিলেন দ্বিজ দ্বারকানাথ এবং এক্ষেত্রেও উপজীব্য বিষয় ছিল রাস্তা তৈরির কাহিনি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের নির্মম অভিঘাতে এই বাংলার ঘন বসতিপূর্ণ বহু অঞ্চলই পরিণত হয়েছিল শ্মশানে, মনুষ্যবসতি রূপ নিয়েছিল ঘন জঙ্গলের, বেড়ে উঠেছিল বন্য জন্তুর উপদ্রব। এমতাবস্থায় ইংরেজ ফৌজের প্রধান অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রয়োজনীয় উপযুক্ত রাজপথের অপ্রতুলতা এবং বিদ্যমান পথগুলির বেহাল দশা। গোরা সৈন্যরা অনতিক্রমণীয় পথকে সুগম করার কাজ শুরু করলে, বেগার খাটার জন্য, গোরা ফৌজের রসদ অর্থাৎ খাদ্য-পানীয়ের জোগান দিতে, তাঁদের যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্যের উপকরণ সরবরাহের বন্দোবস্ত করতে ডাক পড়ল অভুক্ত, অর্ধভুক্ত গ্রামবাসীদের। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে গান বাঁধলেন কবি–
শুন সবে একভাবে বিপত্তের কাজ জেনমতে লড়াই দিতে সাজিল ইংরাজ। থাকে সব বরমপুর ফোদ (বহরমপুর ফোর্ট) জুড়ে কি দিব তুলনা এক এক গোরার পেছু সেপাই তিনজনা। [...] বলে ভাই পড়ল দায়, হায় হায়, রৈইতে নারি ঘরে গরু জরু সকল লয়ে পালাও দেশান্তরে। পালায় সব কলু মালি তিলি তমালী মনে পেয়ে ভয় ব্রাহ্মণ কায়স্থ বৈদ্য কপাট দিয়ে রয়। [...] জমিদার গ্রামে গ্রামে পেয়াদা লয়ে আনে মণ্ডল ধরি খাবার ঘোরদানা দাও বেট (ভেট) আর বেগারি। [...] ইজারাদার কৈছে তারে মাছের তরে ঘনলাড়ি মাথা কেওট (জেলে) বলে এত জাড়ে (শীতে) মাছ পাব কোথা? সুনে উঠলো রেগে, মাছের লেগে রাখ বেটাকে ধরে দেখে দাপ্ (দর্প) বলে বাপ, জালে লাগল গিরে।
কবি কৌতুক করে বলছেন–
বৈরাগী কৈছে দেখ নবদ্বীপে হয়েছিল যে গোরা নিস্তার করিল জীব শচীর কিশোরা। দিয়ে হরিনাম কৈল ত্রাণ গৌরচন্দ্র রায় এবে বিলাতী গোরার হাতে পাছে প্রাণ যায়।
১১৯০ বঙ্গাব্দে রংপুরের কালেক্টর গুডল্যাড সাহেবের অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে যে জনজাগরণ এবং সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল তা রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রংপুরের রাজা ন-আনা অংশের জমিদার সীতারাম রায়কে দেওয়ান নিযুক্ত করার অভিপ্রায়ে কোম্পানির অনুমোদন চেয়ে কলকাতায় চিঠি পাঠালে গুডল্যাড সাহেব সে অনুমোদন না দিয়ে তাঁর প্রিয়পাত্র রামবল্লভকে ওই পদে বহাল করলেন। রাজা অসন্তুষ্ট হলেও সাহেবের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের পথে গেলেন না। এদিকে, দেওয়ান পদ লাভ করে চতুর রামবল্লভ শুরু করলেন চক্রান্ত, চাইলেন রাজার মহাল কিনে নিতে। সমস্ত বিষয়টি রাজা টের পাওয়ামাত্র প্রজাদের গোচরে আনলেন। ক্রোধোন্মত্ত প্রজারা গুডল্যাড সাহেবের কাছে রামবল্লভের পদচ্যুতি দাবি করলেন। গণশক্তির এই দাবি, তাঁদের বিদ্রোহ অবলম্বনে গাথা রচনা করেছিলেন কৃষ্ণ হরিদাস এবং তাঁর লিপিকার ছিলেন তাহের মামুদ। কয়েকটি পঙ্ক্তি এইরকম–
শুন শুন রামবল্লভ রায় রায়তে না ছাড়ে পিছু কি করি উপায়। [...] দেওয়ান বলে রায়ত সব করতে পারে কাকে ও স্বর্গে তোলে কাকে আছাড় মারে। রায়ত লইয়া সবার ঠাকুরালী যত দেখ সোনার বালা রায়তের কড়ি। [...] সাহেব বলে আজ হতে দেওয়ান খারিজ হইল শুনিয়া সকল প্রজা স্বর্গ হাতে পাইল। মহাশব্দ করি সবে ঝাকি দিয়া কয় জীয়া থাক সাহেব তোমার বিবির হউক জয়।
এই গুডল্যাড সাহেবেরই নিরন্তর প্রশ্রয়ে এবং অকৃপণ অনুগ্রহে কোম্পানির ইজারাদার রাজা দেবী সিং হয়ে উঠেছিলেন নির্মম, অত্যাচারী। রংপুরে তাঁর অত্যাচারে গৃহহারা হয় অসংখ্য প্রজা, প্রশস্ত হয় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পথ। রংপুর, ধুবড়ি, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি অঞ্চলে চৈত্র মাসের শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে কামদেবের পূজা উপলক্ষে ‘জাগ গান’ শোনা যেত। কিন্তু এই গানগুলি কুরুচিপূর্ণ এবং অশালীন বলে ভদ্র সমাজে গাওয়া হত না। রতিরাম দাস এইরকমই একটি জাগ গানের অনুকরণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রজাদের সম্মিলিত বিদ্রোহের বর্ণনা এবং শোষক দেবী সিং-এর চরিত্র চিত্রণ করেছিলেন অনবদ্যভাবে। খাজনা আদায়ের জন্য দেবী সিং-এর নির্মমতা কবির দৃষ্টি এড়ায় না। কবি বলেন–
কত যে খাজনা পাইবে তার লেখা নাই। যত পারে তত নেয় আরও বলে চাই।। দেও দেও যাই যাই একমাত্র বোল। মাইরের চোটেতে উঠে ক্রন্দনের রোল।। [...] পারে না ঘাটায় চল্তে ঝিউরি বউরি দেবী সিংহের লোক নেয় তাকে জোড় করি।। পূর্ণ কলি– অবতার দেবী সিংহ রাজা। দেবীসিং-এর উপদ্রবে প্রজা ভাজাভাজা।।
দেবী সিংহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানুষটি ছিলেন শিবচন্দ্র রায়। গানের শেষ অংশে দেখি শিবচন্দ্র প্রজাদের উদ্দেশ্যে বার্তা দিচ্ছেন–
শিবচন্দ্র নন্দী কয় শুন প্রজাগণ। রাজার তোমরা অন্ন, তোমরাই ধন।। রংপুরে যাও সবে হাজার হাজার। দেবী সিংহের বাড়ি লুটো, বাড়ি ভাঙ্গ তার।। পারিষদ বর্গ সহ তারে ধরি আন। আপন হস্তেতে তার কাটিয়া দিমো কান।। [...] শিবচন্দ্রের হুকুমেতে সব প্রজা ক্ষ্যাপে (উত্তেজিত হয়)। হাজার হাজার প্রজা ধায় এক ক্ষ্যাপে (একবারে)।। লাঠি নিল, খন্তি নিল, নিল কাচি দাও। আপত্য করিতে আর না থাকিল কাঁও।। ঘাড়েতে বাঁকুয়া নিল হালের জোয়াল। জাঙ্গাল (বাঁধ / উঁচু পথ) বলিয়া সব চলিল কাঙ্গাল।।
কিন্তু এই বিদ্রোহ অভিযানেও ভদ্রলোকেদের অসহযোগিতা, তাদের নীরবতার প্রসঙ্গে কবির খেদোক্তি–
চারিভিতি হইতে আইল রংপুরের প্রজা। ভদ্রগুলা আইল কেবল দেখিবারে মজা।। ইটা দিয়া পাইট্কা দিয়া পাটকিলায় খুব। চারিভিতি হতে পড়ে করিয়া ঝুপঝুপ।। ইটার ঢেলের চোটে ভাঙ্গিল কারও হাড়। দেবীসিং- এর বাড়ি হইল ইটার পাহাড়।। খিড়কির দুয়ার দিয়া পালাইল দেবী সিং। সাথে সাথে পালেয়ে গেল সেই বার ঢিং।। [...] ইংরাজের হাতে রাজ্য দিলেন চক্রপাণি। সুবিচার করি গেল আপনি কোম্পানী।। ইংরাজ বিচার করি এজলাস করি। একে একে ফাটকেতে রাখে ঢিং-এ করি।।
উনিশ শতকের ত্রিশের দশকে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন তিতুমীর (প্রকৃত নাম মির নিশার আলি)। বাল্যকালেই বিদ্যাশিক্ষার পাশাপাশি শরীরচর্চা এবং হায়দারপুর মাদ্রাসা প্রধান হাফিজ নিয়ামতুল্লাহ্-র সান্নিধ্যে তিনি নানাপ্রকার অস্ত্রচালনার কৌশল ও রাজনীতির শিক্ষা পেয়েছিলেন। নদিয়ার কোনও এক জমিদারের লাঠিয়াল হিসাবে কর্মজীবন শুরু করে, ওই জমিদারের প্ররোচনায় দাঙ্গায় লিপ্ত হয়ে পড়লে, কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। কারাবাসের পর্ব সাঙ্গ হলে তিনি মক্কায় যান এবং সেখানে ভারতের ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ সৈয়দ আহ্মদের সান্নিধ্যে এসে ওয়াহাবি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। এরপর, বাংলায়, নিজের গ্রামে ফিরে এসে দরিদ্র ও নির্যাতিত মুসলিমদের একত্রিত করে, জোটবদ্ধ করে, জমিদার, মহাজন ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে কলকাতা, চাঁদপুর, হায়দারপুর ও সরফরাজপুরে সভা করেন। এই প্রত্যেকটি সভার মূল বক্তব্য ছিল– ইসলাম ধর্মে পূর্ণ আস্থা রেখে হিন্দুদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নীলকরদের অত্যাচার দমন ও ইংরেজ বিতাড়ন করতে হবে।
তিতুমীরের পরিকল্পনার বিষয়ে ওয়াকিবহাল হলে পুঁড়ো-র অত্যাচারী জমিদার কৃষ্ণদেব রায় পাঁচদফা হুকুম জারি করে, তিতু অনুগামী ধর্মপ্রাণ মুসলমান প্রজার দাড়ি রাখা এবং গোঁফ ছেটে ফেলার উপর উচ্চহারে কর চাপিয়ে দেন। অনেক মুসলমান দাড়ি কেটে অব্যাহতি পেতে চাইলেন। আবার এই সুযোগে ক্ষৌরকারেরা তাঁদের মজুরি ইচ্ছেমত বাড়িয়ে দিল। এই বিষয় নিয়েই অজ্ঞাত রচয়িতা বেঁধেছিলেন এই গান–
জোলানী উঠিয়া বলে উঠরে জোলা ঝাট। হাজাম বাড়ি গিয়া শীঘ্র গোঁপদাড়ি কাট।। তিতুমীরের গলা ধরি নসরদ্দি কয়। তোমার বুদ্ধিতে মামা ঠেকিলাম একি দায়।
সাজন গাজির গান বা ‘সায়রি’ নামে তিতুমীরের নামে রচিত একটি গানের পুঁথিতে এই একই বিষয় অবলম্বনে অপর একটি গানের সন্ধান মেলে। যেখানে, সাজন লিখছেন– প্রজারা রুষ্ট এবং বিদ্রোহী। কারণ পুঁড়ো-র জমিদার কৃষ্ণদেব রায় মুসলমান প্রজার দাড়িপিছু আড়াই টাকা কর ধার্য করেছেন। গানটি এইরকম–
নামাজ পড়ে দিবারাতি কি তোমার করিল খেতি কেন কল্লে দাড়ির জরিপানা। খেপেছে যতেক দেড়ে কেষ্টদেবের লক্ষ্মী ছেড়ে পুড়োয় কল্লে পীরির কারখানা।
আবার, তিতুর জীবনকাহিনি নিন্দার্থে বর্ণনা করে, হরু নামে জনৈক অজ্ঞাত ব্যক্তি রচিত একটি গাথা গানের সন্ধান মেলে। যে গানের কিছু পঙ্ক্তি নিম্নরূপ–
শুন সবে ভক্তিভাবে করি নিবেদন। হজরত আলি লড়ায়ের শুনো বিবরণ।। কৃষ্টদেব রায় হতে, লড়ায়েতে মেতে গেল ন্যাড়া। ফকিরের বুজরুগীতে লোক হোল পুঁড়াছাড়া।। [...] এইরূপ লোটে দেশ, অবশেষ, নারিকেলবেড়ে গিয়ে। বলে আল্লা, বানায় কেল্লা, বাঁশের বেড়া দিয়ে।।
আঠারো শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকে আদিবাসী সাঁওতালরা ছোটোনাগপুর, পালামৌ, মানভূম, রাঁচি, হাজারিবাগ, বীরভূম, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর প্রভৃতি এলাকা ছেড়ে রাজমহলের পার্বত্য অঞ্চল ও মুর্শিদাবাদ জেলার একাংশে এসে কঠোর পরিশ্রমে জঙ্গল কেটে, পাথর সরিয়ে চাষবাস শুরু করে এবং তাঁদের নতুন বাসভূমি এই অঞ্চলের নাম দেয় ‘দামিন-ই-কো’। কিন্তু এখানেও তাঁরা ইংরেজ ও শ্বেতাঙ্গ বণিকের সহযোগী জমিদার, মহাজন প্রমুখের লাগামহীন শোষণ ও অত্যাচারের শিকার হয়ে অবশেষে বিদ্রোহের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়। তাঁদের ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার পিছনে যে কারণগুলি মুখ্য হয়ে উঠেছিল সেগুলির মধ্যে প্রধান কয়েকটি হল– যে সকল পতিত জমি উদ্ধার করে তাঁরা চাষবাস শুরু করেছিল সেই জমির উপরে বিপুল রাজস্বের ভার চাপিয়ে দেওয়া, ভূমিরাজস্ব ছাড়াও অন্যান্য করের বোঝা ও ঋণের ভারে তাঁদের সর্বস্বান্ত অবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া, বহিরাগত ব্যবসায়ী ও মহাজন কর্তৃক সাঁওতালদের থেকে চড়া হারে সুদ আদায় এবং সারল্যের সুযোগ নিয়ে বিভিন্নভাবে তাঁদের ঠকানো, রেলপথ তৈরির কাজে নিযুক্ত সাঁওতালদের উপর অত্যাচার এবং পরিশ্রমের তুলনায় সামান্য মজুরি প্রদান, সাঁওতালদের প্রথাগত আইন ও বিচার ব্যবস্থা বাতিল করে জটিল ব্রিটিশ আইন চাপিয়ে দেওয়া, খ্রিস্টান মিশনারিগণ কর্তৃক সাঁওতালদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার অপপ্রয়াস এবং নীলকর সাহেবদের বলপূর্বক সাঁওতাল কৃষকদের খাদ্যশস্যের পরিবর্তে নীলচাষে বাধ্য করা।
শুরু হল সাঁওতালদের গণসংগ্রাম— ‘হুল’। বিদ্রোহের নেতৃত্বে রইলেন একই পরিবারের চার বীর সন্তান সিধো, কানু, চাঁদ ও ভৈরব। সাঁওতাল সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত গীত এবং নৃত্য। সরল জীবনচর্যায় জীবন এগিয়ে চলে সংগীতের হাত ধরে। অতএব তাঁদের সংগীতেও যে এই বিদ্রোহ এবং সিধো-কানুর বীরত্বের গাথা জায়গা করে নেবে তা বলাই বাহুল্য। এমনই অসংখ্য গানের মধ্যে থেকে কয়েকটি—
১) দেলায়া বিরিদ্পে দেলায়া তিঙ্গুন পে, জানাম দিশম লৌগিৎতে হো, দেলায়া পায়ারঃক’ তাবোন পে। (অর্থাৎ— ওঠো, জাগো। এসো জন্মভূমির জন্য আমরা এগিয়ে যাই।)
২) বাকো লুতুরা ক্’খান বাকো হেতওয়া ক্’খান, [...] নোয়ারাবোন নুসৌসাবোন বাংগেকো তেঙেগান, দঃক্’ বোন দানাংবোন বাংগেকো রেবেন, তবে দো বোন হুল গেয়া হো। (অর্থাৎ— কেউ না শুনলে, কেউ না গ্রাহ্য করলে, আমরা নিজেরাই বাঁচব। কেউ পাশে দাঁড়ায় না। আমাদের আশ্রয় দিতে কেউ রাজি নয়। তবে আমরা বিদ্রোহ করব।)
৩) সিদু কানু হুল দয় মায়াম গাডা আতুয়েন ইংরাজ সরকার আবো দিশম, মেতাবোন কো সাঁওতাল বিদিন। (অর্থাৎ— সিদু, কানু বিদ্রোহ করেছে। রক্তের নদী বয়ে গেল। ইংরাজ সরকার বলে আমাদের দেশ। আমাদের বলে সাঁওতাল নাস্তিক।)
৪) ও শিধো, শিধো ভাই, তোর কিসের তরে রক্ত ঝরে? কি কথা রইল গাঁথা, ও কানহু তোর ‘হুল’ ‘হুল’ স্বরে? দেশের লেগে অংগে মোদের রক্তে রাঙা বেশ। জান না কি দস্যু বণিক লুটলো সোনার দেশ।
বিদ্রোহী সাঁওতাল কৃষক গানে-গানে বলছেন বিদ্রোহের মর্মবাণী–
৫) আমরা প্রজা, সাহেব রাজা দুঃখ দেবার যম তাদের ভয়ে হঠবো মোরা এমনই নরাধম? মোরা শুধু ভুখবো? না, না মোরা রুখবো।
বাংলাদেশে নীলবিদ্রোহেও পাওয়া যাবে এই একই কথার রেশ। সরকারের প্রকাশ্য সমর্থনে বর্বর নীলকরের অত্যাচার, উৎপীড়ন হয়ে উঠেছিল মাত্রাছাড়া এবং এই অমানুষিক শোষণের প্রধান হাতিয়ার ছিল দাদন ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থায় দাদন গ্রহণকারী কৃষক সম্পূর্ণভাবে তাঁর স্বাধীনতা হারিয়ে, অপরিশোধ্য ঋণের জালে জড়িয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ত দাসত্বের শৃঙ্খলে। প্রত্যেক গণবিদ্রোহই প্রয়োজন অনুসারে জন্ম দিয়েছে গান, কবিতা-ছড়া, নাটক ইত্যাদির। নীলবিদ্রোহও এই ধারার ব্যতিক্রম নয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-য়, ‘পাদ্রী লং ও নীলদর্পণ’ অংশে বলছেন— ‘প্রকৃত বাঁদুরে হ্যাঙ্গামে বাজারে নানা রকম গান উঠল; চাষার ছেলেরা লাঙল ধরে মুলো ও মুড়ি খেতে খেতে ক্ষেতে ক্ষেতে গান’—
উঠ্লো সে সুখ, ঘটলো অসুখ মনে, এত দিনে। মহারাণীর পুণ্যে মোরা, ছিলাম সুখে এই স্থানে।। উঠ্লো খামার ভিটে ধান, গ্যাল মানী লোকের মান। হ্যান সোনার বাংলা খান, পোড়ালে নীল হনুমানে।
বিদ্যাভুনী রচিত একটি গানেও শুনি অত্যাচারিত কৃষকের মর্মবেদনার করুণ কথা—
হে নিরদয় নীলকরগণ আর সহেনা প্রাণে এ নীল দহন।। কৃষকের ধনে প্রাণে, দহিলে নীল আগুনে, গুণরাশি কি কুদিনে, কল্লে হেথা পদার্পণ। দাদনের সুকৌশলে, শ্বেত সমাজের বলে, লুটেছ সকল তো হে কি আর আছে এখন।।
নীলকরের এই বর্বর উৎপীড়নের কথা স্থান করে নিল বাউল গানের কলিতেও–
এবার নীল এসে নীলকন্ঠ বেশে ব্রহ্মাণ্ড বশ করে নিলে। নীলের জ্বালায় যাবো কোথায় নীল সব ভিটেয় ঘুঘু চড়িয়ে নিলে। নীলের অনুষঙ্গী যারা শমনের দূত যেমন ধারা পায় যারে তারে করে সারা ডুবায় মারে বেন্দে হাতে গলে।।
অপর একটি গানে প্রকাশ পেয়েছিল নীলকরদের প্রতি তীব্র ঘৃণা–
জাত মাল্লে পাদ্রী ধরে ভাত মাল্লে নীল বাঁদরে ব্যাড়াল চোখো হাঁদা হেমদো নীল কুঠির নীল মেমদো।
যশোহরের এক কুখ্যাত নীলকর মরেল, নগর স্থাপন করে নিজের নামে নাম দিলেন ‘মরেলগঞ্জ’। এই সাহেবের বিপুল ঐশ্বর্য, চার ঘোড়ার গাড়ি এবং রাজকীয় ঠাটবাট দেখে গ্রামের কবি বিদ্রুপ করে গান বাঁধলেন–
বজরা চড়ে এলো মেলো (মরেল) ডিঙ্গা চলে সাথে দেবী সাহেবের নীল ঘোড়া (ডেভিস) চলে ভাঙ্গা পথে।
আরও এক অত্যাচারী নীলকর সাহেব ছিলেন খুলনার রেনি। ইনি আবার অন্যান্য দুষ্কর্ম ছাড়াও নিরীহ, সাধারণ পথচারীকে গ্রেপ্তার করে নিজের কাজ করিয়ে নিতেন। রেনির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন শ্রীরামপুর-নৈহাটির তালুকদার শিবনাথ ঘোষ, বাহিরদিয়ার চন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। এঁদের প্রয়াস এবং বিরাট নিবাসী লাঠিয়াল সর্দার সাদেক মোল্লার সক্রিয় সহযোগিতায় রেনির দর্পচূর্ণ হলে, গ্রাম্য কবির গানে উঠে এল সেই বীরগাথা–
চন্দ্র দত্ত, রণে মত্ত, শিব সেনাপতি […] গুলি গোল্যা সাদেক মোল্যা, রেণীর দর্প করল চূর বাজিল শিবনাথের ডঙ্কা, ধন্য বাংলা বাঙালি বাহাদুর!
নীলকর প্রসঙ্গে অবধারিতভাবে এসে পড়ে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম। অত্যাচারিত কৃষক শ্রেণির পক্ষ অবলম্বন করে, যে অকৃত্রিম সহানুভূতির সাথে পাশে থেকেছিলেন, সেই কথা স্মরণে রেখে বাঁধা হয়েছিল গান—
ভাসছে মন মনের হরিষে (আগে) লুটে খেত এক হরিশে (এখন) বাঁচালে এক হরিশে! বুনে বুনে নীল কত জমি খীল (এখন) হতেছে তায় অঢ়র কলাই সরিষে।
এই গানে দুজন হরিশের উল্লেখ আছে। প্রথমে উল্লিখিত হরিশ নীলকুঠির এক অত্যাচারী আমলা এবং দ্বিতীয় হরিশ কৃষকবন্ধু হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। নীল বিদ্রোহের সময় চরম কর্মব্যস্ততা এবং নিদারুণ পরিশ্রমে, হরিশচন্দ্রের শরীর ভেঙে পড়ে। অবশেষে মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে, ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রয়াত হলে, প্রিয়জন হারানোর বেদনা নিয়েই গান বাঁধা হল–
নীল বাঁদরে সোনার বাংলা করলে এবার ছারখার! অসময়ে হরিশ ম’লো, লং-এর হোল কারাগার প্রজার আর প্রাণ বাঁচানো ভার।
নীল বিদ্রোহের পরবর্তী কালে ‘তেভাগা’-র মতো বড়ো কৃষক আন্দোলন বাংলার ইতিহাসে আর দেখা যায়নি৷ ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ১৯৩৯-৪০ সালে উত্তরবঙ্গের মাটিতে ভূমিহীন এবং স্বল্প জমির অধিকারী কৃষকদের দ্বারা সংঘটিত আধিয়ার আন্দোলনকে তার সূচনাপর্ব বললে অত্যুক্তি হবে না। তেভাগা আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দু-ভাগের মালিক হবে কৃষক এবং জমিদার পাবে একভাগ। আন্দোলনের তীব্রতা, দ্রুত বিস্তার লাভ, শিল্পী-সাহিত্যিকদের কবিতা-গান রচনার মাধ্যমে ও সক্রিয়ভাবে কৃষকদের পাশে থাকা সত্ত্বেও তেভাগা আন্দোলন সফল হতে পারেনি। কিন্তু আজও রয়ে গেছে তেভাগার বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসের কাহিনি এবং অবশ্যই তেভাগার কবিতা ও গান।
আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন খাঁপুরে একরাতে পুলিশের সাথে কৃষকদের ভয়াবহ সংঘর্ষে মরণপণ লড়াই করে পুলিশের গুলিতে বীরের মৃত্যু বরণ করেন চিয়ারসাই নামের দুঃসাহসী এক কৃষক। তাঁকে নিয়ে গান বাঁধেন কালি সরকার–
ছুটিল চিয়ার সাই হস্তে মোটা লাঠি জোয়ানমর্দ বাপের বেটা আটত্রিশ ইঞ্চি ছাতি দোহাতিয়া বাড়ি মারে সৈন্যের মাথায় বাপ ডাক ছাড়ি সৈন্য টলে পড়ে যায়... আর এক গুলি চিয়ার সাইয়ের বুকেতে ফোটে আন্ধার হইল দুনিয়াদারি চেতন গেল টুটে ক্ষণে অচেতন মর্দ মনেতে চেতন লাফ দিয়া ট্রাকে ওঠে সিংহের মতন দুশমনের গুলি ফের লাগিল কপালে বেহুঁশ হৈল মর্দ রুহু ছেড়ে দিল।
ডুয়ার্সের লাল শুকরা ওরাওঁ, একজন লোককবি ও গায়ক, রচিত গানগুলি নিয়মিতভাবে তেভাগার প্রতিটি সভা-সমাবেশে গাওয়া হত। তেমনই একটি গান–
হাওয়া চলে সরসর লাল ঝান্ডা উড়ে ফর ফর চলু কৃষাণ চলু মজদুর নিকালিনা যাব্ কিরে লড়াইকে ময়দান।
আবার, খুলনা বিভাগের নড়াইলে বামনেতা নূরজালালের যোগ্য নেতৃত্বে হিন্দু-মুসলমান চাষির মিলিত শক্তি তেভাগা আন্দোলনকে তীব্র করে তোলে। পঞ্চানন দাস নামে এক লোককবি একটি সুদীর্ঘ গান রচনা করেছিলেন তাঁকে নিয়ে। গানটির কিছু অংশ–
তেভাগার আন্দোলনে নড়াইল হল অগ্রণী ----------------------- এই আন্দোলন গড়ে তোলার প্রধান নেতা নূরজালাল এই দলেরই মন ভাঙ্গিতে জুটে গেছে কয় দালাল হোস না তোরা বিমর্ষ তোদের এই আদর্শ ভারত জুড়ে বেড়াক উড়ে মজুর চাষীর জয় নিশান হওরে সবে আগুয়ান।
মালদহ জেলার গোবিন্দ শেঠ রচিত একটি গানও উল্লেখনীয়–
ওরে জমিদারের চর আইস্যাছে কাড়ইয়া নিতে ধান ছাইড়বো না ভাই ঘরের লক্ষ্মী দ্যাহে থাকিতে প্রাণ এ ধান দিমু না, এ লক্ষ্মী ছাড়মু না দ্যাহে থাকিতে প্রাণ।
মালদহ জেলারই বনমালী কুন্ডু রচিত গানগুলিতেও উদ্দীপ্ত হয়েছিল তেভাগার আন্দোলনকারীরা–
শোনরে ভোলা নানা মাঠে নাইকো দানা ক্যানে দিলি এমন সাজারে তোর ভূতের বেগার খাটা ভাত নাই আধ পেটা হামার খাঁচা হয়্যাছে বুকের পাঁজারে।
বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী, গণনাট্যের অক্লান্ত কর্মী হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখলেন গান—
কাস্তেটারে দিয়ো জোরে শান। কৃষাণ ভাই রে ফসল কাটার সময় হলে কাটবে সোনার ধান দস্যু যদি লুটতে আসে কাটবে তাহার জান রে।
এই গানটি ছাড়াও তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিকায় তাঁর কথা ও সুরে আরও কিছু গান— ১) ‘আমরা তো ভুলি নাই শহিদ’, ২) ‘তোর মরা গাঙে এবার আইলা এবার বান’, ৩) ‘বাঁচব বাঁচব রে আমরা’।
তবে তেভাগা নিয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও সার্থক গানগুলোর রচয়িতা নিঃসন্দেহে গণসংগীতের প্রবাদপুরুষ সলিল চৌধুরী। রচিত হয়েছিল কালজয়ী, রক্তে দোলা দেওয়া, অবিস্মরণীয় বহু গান। তারই কয়েকটি–
১) হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো জান কবুল আর মান কবুল আর দেবো না আর দেবো না রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।
২) ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে জীবন মরণে তোমায় চাই না ভুলিতে। হিমালয় আর নিদ্রা নয় কোটি প্রাণ চেতনায় বরাভয় জাগো ক্রান্তির হয়েছে সময় আনো মুক্তির খরবন্যা।
৩) ও আয়রে ও আয়রে ও ভাইরে ও ভাইরে ভাই বন্ধু, চলো যাই রে৷ ও রাম রহিমের বাছা– ও বাঁচা আপন বাঁচা চলো ধান কাটি আর কাকে ডরি– নিজ খামার নিজ ভরি, কাস্তেটা শানাইরে।
৪) ও ভাই চাষী ক্ষেতের মজুর যতেক কিষাণ কিষাণী (সজনী) এই বেলা নাও তেলেঙ্গানার পথের নিশানী। আর এই মোরা রক্ত ঢেলে জমিন চষে পরগাছা পুষিলাম, সেই পরগাছা হইল যে রাজা, আর আমরা তারি গোলাম, (মরি হায় হায় হায় হায় রে)! এই দেশ জমিনের থেকে এবার আগাছা দাও নিড়ানি (সজনী)
৫) গুরু গুরু মেঘের মাদল বাজে তা তা থৈ থৈ মনের ময়ূর নাচে আষাঢ়ের বরষা এলো পরশে তারি রুক্ষ মাটি সরস হলরে আয় লাঙ্গল ধরি মোরা লাঙ্গল চালাই আয় ফসল বুনি মোরা ফসল ফলাই আয় আয়রে আয়।
সলিল চৌধুরীর পাশাপাশি বহু কৃতী সংগীত রচয়িতা তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিকায় সৃষ্টি করেছিলেন বহু গান যে গানগুলির কথা স্মরণ না করলে স্রষ্টার প্রতি অবিচার করা হয়। তেমনই কিছু গান–
১) বিনয় রায়ের কথা ও সুরে– আর কতকাল বল কতকাল সইব এ মৃত্যু অপমান। ২) অনিল ঘোষের কথা ও সুরে– হোই রে হোই আবার বুঝি মরণ আসেরে ঘরে ঘরে। ৩) নিবারণ পণ্ডিত-এর কথা ও সুরে– শুনেন যত দেশবাসী শুনেন ভাই গরীব চাষী। ৪) সাধন গুহ-র কথা ও সুরে– শোনো কাকদ্বীপ রে। ৫) বাসুদেব দাশগুপ্তের কথা ও সুরে– হুঁশিয়ার ও সাথী কিষাণ মজদুর। ৬) অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে– ঘুমাস না আর খোকা আমার বর্গি এলো দেশে। ৭) অনল চট্টোপাধ্যায়ের কথা এবং অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে– অনেক ভুলের মাশুল তো ভাই দিলাম জীবন ভরে। ৮) ভাস্কর বসুর কথা এবং নির্মলেন্দু চৌধুরীর সুরে– ধন্য তুমি জন্মভূমি। ৯) কালী সরকার রচিত দুটি গান– সম্মুখে ফাঁকা জায়গায় মোটরগাড়ী ধুইয়া ও রণে বাজিল রে, রণ পা’য় রণডংকা সাজিল রে। ১০) প্রবীর মজুমদারের কথা এবং কৃষ্ণা বসুর সুরে– শোন গো দূরের পথিক।
সময় বদলালেও বদলায় না নিম্নবর্গের প্রান্তিক মানুষের প্রতি বঞ্চনার ইতিহাস। ন্যায্য অধিকার বুঝে নিতে তাই বারবার এই মানুষগুলিকে জীবনকে বাজি রেখে সক্রিয় প্রতিবাদে নেমে আসতে হয় পথে, শাসকের বিরুদ্ধে তুলতে হয় প্রতিবাদ গর্জন, সম্মিলিত কণ্ঠ মুখর হয় প্রতিবাদের গানে। সার কথাটা তো বলা হয়েই গেছে সর্বপ্রথমে উল্লিখিত ছত্তিশগড়ি গানের শেষ পংঙক্তিতে–
লড়াই ছোড়ি চারা নহি শুনো দেশবাসী।
তথ্যসূত্র:
১) ‘বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে স্থানীয় বিদ্রোহের প্রভাব’ – রণজিৎ সমাদ্দার। প্রকাশক– শ্রী স্বপন কুমার চট্টোপাধ্যায়, বনমালী বিশ্বনাথ প্রকাশন, ২২ পঞ্চাননতলা রোড, কলকাতা- ৪১।
২) ‘সাঁওতাল গণযুদ্ধ ও বাংলা সাহিত্য’ – রণজিৎ সমাদ্দার। চ্যাটার্জী পাবলিশার্স, ৪৯ এ, ব্যানার্জীপাড়া রোড, কলকাতা– ৭০০০৪১।
৩) ‘ঔপনিবেশিক ভারতে বিদ্রোহ সাহিত্য সমাজ’ – শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়। পূর্বালোক পাবলিকেশন, ১১বি, মনোহরপুকুর রোড, কলকাতা– ২৬।
৪) ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা ও অন্যান্য সমাজচিত্র’। সম্পাদক: ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীসজনীকান্ত দাস, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ২৪৩১, আপার সারকুলার রোড, কলিকাতা- ৬।
৫) ‘তেভাগা আন্দোলন ও সলিল চৌধুরীর গান’ – লিখেছেন সমীর কুমার গুপ্ত, বাঙালনামা। Posted by bangalnama on September 13, 2010
৬) ‘তেভাগা আন্দোলন ও সলিল চৌধুরীর গান’ – আখতার হামিদ খান, দৈনিক সংগ্রাম। প্রকাশিত: শনিবার ২৫ জুলাই ২০১৫
৭) ‘তেভাগা’র কবিতা ও গান’– শরিফ আতিকুজ্জামান
[বি.দ্র. — লেখাতে উদ্ধৃত গানগুলির মূল উৎসের বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।]