মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাসে নিম্নবর্গের প্রতিরোধ

নমিতা চক্রবর্তী

বিংশ শতাব্দীতে বাংলার উপন্যাস সাহিত্যে বিষয়বস্তু নির্বাচনে বৈচিত্র্য এবং স্বাতন্ত্র্য এনেছিলেন যে সকল ঔপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাসে বিষয়ের বৈচিত্র্য দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। পারিবারিক জীবনের বাইরে ইতিহাস এবং রাজনীতি তাঁর উপন্যাসের উপাদান হিসেবে গৃহীত হয়। যুগ সংকট এবং যুগ যন্ত্রণাকে এড়িয়ে যাওয়া কোনও সচেতন সাহিত্য স্রষ্টার পক্ষেই সম্ভব নয়। মহাশ্বেতা দেবীর মতো সমাজকর্মী সাহিত্য স্রষ্টার পক্ষে তা অকল্পনীয়। তাঁর উপন্যাসের বিষয় এবং চরিত্র পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। স্থাপিত হয়েছে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে। ঔপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবী অপরাজেয় প্রতিবাদী মুখ। কিন্তু শুধুমাত্র প্রতিবাদের জন্যই কলম ধরেননি মহাশ্বেতা, এক সমাজতাত্ত্বিকের দৃষ্টিতে সমাজকে দেখেছিলেন তিনি। সামাজিক নানা অসংগতির কারণ অনুসন্ধান করেছিলেন। দেখেছেন স্বাধীনতার পূর্বে যেখানে শাসক এবং শোষক ছিল ইংরেজ সেইসঙ্গে ইংরেজের তোষণকারী জমিদার শ্রেণি, স্বাধীনতার পরবর্তীকালে সেই জায়গা নিয়েছে দেশীয় শোষক শ্রেণি। তাই তাঁর উপন্যাসে শোষক শ্রেণির কথা আছে এবং শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের প্রতিবাদের কথা আছে। বিদ্রোহের কথা আছে উলগুলানের কথা আছে। সে কারণে প্রথম গ্রন্থে ‘ঝাঁসির রানি’-র রানি লক্ষ্মী বাই সম্পৃক্ত হয়ে যান গণনায়কে। মধ্যবিত্ত জীবনের পাশাপাশি আদিবাসী জীবনকে তিনি খুঁজেছেন ইতিহাসের পটভূমিতে। মেদিনীপুরে বাসকালে সেখানকার তপশিলি আদিবাসীদের সঙ্গে পরিচিত হন। এরপর বিহার উড়িষ্যা অঞ্চলের আদিবাসী জীবনের সঙ্গে পরিচিত হন এবং প্রাথমিক পর্বের পরিচয়ের পর ক্রমশ তাদের জীবন যাপনের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উপলব্ধি করেছেন তাদের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা। দিনের পর দিন কাটিয়েছেন খেড়িয়া, শবর প্রমুখ মানুষজনদের সঙ্গে তাদের একজন হয়েই। মহাশ্বেতা যখন এই আদিবাসী সমাজ জীবনের কথা বলেন, তখন তা ইতিহাসের জীবন্ত দলিল হিসাবেই পাঠকের দরবারে হাজির হয়। আদিবাসী জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে জেনেছিলেন তাদের জীবন যাপনের সংকট। তপশিলি ভুক্ত এবং আদিবাসী সমাজের প্রতি সভ্য সমাজের উন্নাসিক মনোভাব মহাশ্বেতাকে পীড়িত করেছিল। তাদের প্রতি উপেক্ষা এবং অত্যাচার তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে প্রতি মুহূর্তে। যাদের তিনি নিজে ‘the voiceless section of Indian society’ বলে মনে করেছেন তাদের হয়েই তিনি অভিযোগ দাখিল করেছেন। বঞ্চিত অবহেলিত পিছিয়ে পড়া মানুষেরাই মহাশ্বেতা দেবীর সমাজকর্মের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে। শুধু সমাজকর্মী নন মহাশ্বেতা, তিনি একজন ঔপন্যাসিকও, তাই লেখার মাধ্যমে তিনি সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি হওয়া অন্যায় অবিচারের চিত্রের পাশাপাশি তাদের প্রতিরোধের কথাও তুলে ধরেছিলেন। অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তীর মতে, ব্যক্তি ও সমাজ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ব্যক্তিবর্গ নিয়ে তৈরি হয় সমাজ। আর সমাজ তৈরি হলে সেই সমাজে একটি প্রশাসন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। কালভেদে, দেশভেদে এবং ব্যক্তিভেদে সেই প্রশাসনের পরিচালকেরা কখনো ব্রাহ্মণ পুরোহিত, কখনো ক্ষত্রিয় রাজা, কখনো আদিবাসী ধর্মগুরু, কখনো নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, কখনো বাহুবলে বলীয়ান দুর্বৃত্ত। ব্যক্তির মধ্যে থাকে স্বজন পোষণ স্তাবকপ্রীতি এবং অনুসারীদের প্রতি পক্ষপাত। তিনি আরও বলেছেন, সমাজ ও ব্যক্তির দ্বন্দ্বময় সম্পর্কটাই উপন্যাসের অন্তরের উপাদান।

মহাশ্বেতা দেবীর প্রথম গ্রন্থ ‘ঝাঁসির রানি’ রচনার পটভূমি ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহ এবং রচনাকাল সিপাহি বিদ্রোহের শতবর্ষ পরবর্তী সময়। স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতবর্ষে আত্মক্ষয়ী সংগ্রামের পরে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা এলেও, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের ইতিহাস ছিল অতি জীবন্ত। সেই কারণে ৫৭-র বিদ্রোহের পটভূমি উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হিসেবে যথোপযুক্ত হয়েছিল। ৫৭-র বিদ্রোহকে প্রেক্ষাপট হিসেবে ব্যবহার করা অন্যতম প্রধান কারণ লেখিকার নিজের বক্তব্যে—

১/ আমি গণবৃত্তের ইতিহাসে বিশ্বাসী; ২/ সিপাহি বিদ্রোহ বা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম মূলত কৃষকদের সংগ্রাম; ৩/ ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে লোকবৃত্তের গানগাথা এসব মূল্যবান সম্পদ; ৪/ লক্ষ্মীবাই একজন স্মরণীয়, ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা স্বীকার করেছেন যে রানিকে কেন্দ্র করে মধ্য ভারতে এক ব্যাপক গণ অভ্যুত্থান গড়ে উঠেছিল।  

সেদিনের সচেতন বিদ্রোহে রানির ভূমিকা যে অনস্বীকার্য তাই অনুপ্রাণিত করেছিল মহাশ্বেতা দেবীকে। সিপাহি বিদ্রোহের পটভূমিকায় মোতি ও খুদাবক্সকে কেন্দ্র করে মহাশ্বেতা দেবীর প্রথম উপন্যাস ‘নটী’। উনিশ শতকের ইংরেজ সাহেবদের নিষ্ঠুর অত্যাচার, গরিব চাষিদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, সুযোগ সন্ধানী কিছু ব্যক্তির সহায়তায় গ্রামের কৃষকদের সিপাহীতে পরিণত করা এবং নির্মম অত্যাচারীর বিরুদ্ধে নির্মম ভাবে লড়াইয়ের চিত্র উঠে এসেছে উপন্যাসটিতে।

‘অমৃত সঞ্চয়’ উপন্যাসটি শুরু হয়েছে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে এবং শেষ হয়েছে এর তেত্রিশ বছর পরে। ১৮৫৭-র বিদ্রোহ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ ‘প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’, কেউ ‘প্রথম জাতীয় বিদ্রোহ’ বলে মনে করেছেন। আবার কেউ মনে করেছেন সিপাহিদের ক্ষোভের হেতু নিহিত ছিল ঋণ-রিক্ত এবং দারিদ্র্য-পীড়িত কৃষক সম্প্রদায়ের জীবনে, তাই তারা civil rebellion আখ্যা দিয়ে সমাজের অপরাপর স্তরের বিভিন্ন বিক্ষোভগুলোর সঙ্গে এই বিদ্রোহের একটি ঐক্য ও যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। লর্ড ক্যানিং ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে যখন নিযুক্ত হলেন তখন উপন্যাসের সূচনা। ডালহৌসি ‘Doctrin of Lapse’ নীতিকে নতুন করে চালু করার ফলে অযোধ্যা ইংরেজ শাসিত ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। যার ফলস্বরূপ যেখানকার তালুকদার ভূস্বামী সহ অসংখ্য কৃষক ও সিপাহি বিদ্রোহী হয়। ১৮৫৫-৫৬ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহ ঘটে গেছে, বাংলা ও বিহারে নীলকরদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশোন্মুখ। শাসিত শাসককে বিশ্বাস করে না। শাসকও বিশ্বাস অর্জনে ব্যস্ত নয়। কারণ এই দেশ ও দেশবাসী সম্পর্কে তাদের অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য ও ঘৃণার অন্ত নেই। তাই এদেশের উন্নয়ন নিয়ে তাদের খুব একটা মাথাব্যথাও ছিল না (ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল কেরি-ডাফ-বেথুন প্রমুখ)। বিশাল ভারতের সামগ্রিক রূপটি দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন মনে হয়। একদিকে আত্নকেন্দ্রিক মানুষেরা নিজেদের মধ্যে নিজেরা মগ্ন থাকার ফলে অশিক্ষা ও কুসংস্কারের নাগপাশে আবদ্ধ হয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতার লোভে, ঐশ্বর্যের আতিশয্য এবং তারই মাঝখানে হিন্দু-মুসলমান ও ইঙ্গ সমাজের পাঁচমিশেলি সভ্যতার কোলাহল। এরকম সময়ে উপন্যাসটির সূচনা।

‘অমৃত সঞ্চয়’ উপন্যাসটিতে প্রায় একশো চরিত্র রয়েছে। সিপাহি বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান সেনানায়ক নানাসাহেবের কাহিনি দিয়ে উপন্যাসের সূচনা। সেখানেই সম্পূরণের উপস্থিতি একজন জ্যোতিষী রূপে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে আসলে ধর্মোন্মাদ এবং সিপাহি বিদ্রোহের একজন সংগঠক। সংগঠক হিসেবে সে কিছু যুবক-যুবতিকে কাজে লাগায়। চম্পা এবং চন্দন তাদের অন্যতম। গ্রাম্য আশ্রয়হীন চম্পাকে সম্পূরণ বাইজি হবার প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োগ করে। ঘটনাচক্রে সেখানে এসে পৌঁছায় চম্পার প্রেমিক চন্দন। তাকে নিয়োগ করা হয়েছিল অস্ত্র সংগ্রহের কাজে। চম্পা বা চন্দন কেউই ষড়যন্ত্রীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ইতিমধ্যে সিপাহি বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলে তা দমন করতে ভয়ংকর হয়ে ওঠে ব্রিটিশ প্রশাসন। বীভৎস মৃত্যু ও ধ্বংসের অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে, লড়াই করে চন্দন ফিরে আসতে চায় চম্পার কাছে। কিন্তু ব্রিটিশ ফোর্সের হাতে ধরা পড়ে যায় সে। সেইসঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার ইভান্স তাকে ফাঁসি দেয়। সেই দিনই ঘটনাচক্রে চম্পা শিবিরে উপস্থিত হলে তাকে বলপূর্বক ধর্ষণ করে। প্রবল ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রতিশোধস্পৃহা জেগে ওঠে চম্পার। তাই সুকৌশলে ইভান্সকে মৃত্যু ফাঁদের দিকে নিয়ে যায়— সেখানে দুজনেই মারা যায়। ব্রাইটের রক্ষিতা ব্রিজদুলারি প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত এবং অপমানিত হয়েও দীর্ঘদিন মরে বেঁচে ছিল। সম্পূরণের সাহায্যে চম্পা তাকে পালাতে সাহায্য করেছিল। বিদ্রোহের সুযোগে সে ব্রাইটকে হত্যা করে এবং প্রণয়াস্পদ ভবানীশংকরের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করে। পরে ব্রিজদুলারির মৃত্যু হলে ভবানীশংকরের প্রধান আশ্রয় হয়ে ওঠে তাঁর লেখা— ‘আমি, আমার ষাট বছরের জীবনে কোম্পানির রাজত্ব এবং মহারানির শাসন দেখেছি। আমি ভারতের জীবন যাত্রার বহু পরিবর্তন লক্ষ করেছি। সে সম্পর্কে আমার ডায়েরি থেকে এই পরিবর্তনের মোটামুটি একটি বিবরণ লিখেছি। হ্যাঁ, তার মধ্যে ১৮৫৭ তো আছে বই-কি। ভারতীয়দের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ককে আমি যেমন বুঝেছি তার রূপ দিতে চেষ্টা করেছি।’

অষ্টাদশ শতকের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা ‘আঁধার মানিক’ উপন্যাসটি। ইতিহাস সম্পর্কে মহাশ্বেতা দেবীর আগ্রহ চিরকালের। কিন্তু সে ইতিহাস রাজবৃত্তের নয়, গণবৃত্তের। কারণ তিনি মনে করেছেন— ‘ইতিহাসের রাজপথ ও রাজা বাদশার কীর্তিকলাপ সম্পর্কিত কাহিনি ইতিহাস থেকে সংগ্রহ করা সহজ, কিন্তু ইতিহাসে যেসব অন্ধকার গলিপথ আছে, যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনাচরণ ও আনন্দ বেদনার বহু ইতিহাস ছড়িয়ে আছে, তাকে আবিষ্কার করা সহজ নয়।’ ঔপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবীও মনে করতেন কাগজ ও নথিপত্র গবেষণার মাধ্যমে কোনও ব্যাপারের যথার্থ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত পাওয়া যায় না। তাই লোকগাথা-গীতি- কবিতায় অর্থাৎ লোকবৃত্তে সে ব্যাপারটির যতটা পরিচয় মেলে, তাকেও তিনি মর্যাদা দেওয়ার কথা বলেছেন। তিনি নিজে এই ব্যাপারটি অন্তরে উপলব্ধি করেছিলেন বলে লোকবৃত্তের উপাদান সংগ্রহ, সংকলন এবং ব্যবহার করেছিলেন। লোকবৃত্তের ইতিহাস ব্যবহারের প্রসঙ্গে ‘আঁধার মানিক’ গ্রন্থে নতুন সংস্করণের ভূমিকায় মহাশ্বেতা দেবী জানিয়েছিলেন— ‘ষাটের দশকের কয়েকটি লেখাই গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়ের অঙ্গুলি নির্দেশ দেশের ইতিহাসের দিকে, গণবৃত্তের ইতিহাস। বস্তুত আমরা লেখার জগৎ যতই পরিক্রমা করি, একটা কথাই বুঝি— আমার সব লেখা (যা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য) তা মূলত গণবৃত্তের ইতিহাসের দলিলিকরণ। রাজবৃত্তের ইতিহাস থেকে অনুল্লেখিত গণবৃত্তের ইতিহাস বেরিয়ে আসত। গণবৃত্তের ইতিহাস এই তো আমার মূল আগ্রহ।’

ইতিহাস বলতে মহাশ্বেতা দেবী বুঝতেন একটি দেশের, একটি জাতির রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সম্পর্কের দলিল। তাই ইতিহাসবিদদের প্রদত্ত তথ্যের ওপর নির্ভর না করে মহাশ্বেতার মতো ঔপন্যাসিক প্রকৃত ইতিহাসের সন্ধানে রত হন। সেই অনুসন্ধানে উঠে আসে লোকাচার, লোকসংস্কৃতি, লৌকিক জীবনব্যবস্থা। ইতিহাসের একনিষ্ঠ পাঠক মহাশ্বেতা দেবীর ইতিহাস সম্পর্কিত ভাবনা ব্যক্ত হয়েছে ‘আঁধার মানিক’ উপন্যাসের ভূমিকায় (বিনীত নিবেদন অংশে)— ‘ইতিহাসের মুখ্য কাজগুলি হচ্ছে একই সঙ্গে বাইরের গোলমাল সংগ্রাম ও সমারোহের আবর্জনা এবং ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে জনবৃত্তকে অন্বেষণ করা, অর্থ ও তাৎপর্য দেওয়া। আর তখনই এই ভিতরপানে চোখ মেলার দরুনই অনিবার্যভাবে বেরিয়ে আসে সমাজনীতি ও অর্থনীতি বেরিয়ে আসতে বাধ্য। কেননা সমাজনীতি ও অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত রাজনীতির পটভূমি তৈরি করে, তার সিদ্ধি ও সাফল্য এনে দেয়। এই সমাজনীতি ও অর্থনীতির মানে হল লোকাচার, লোকসংস্কৃতি, লৌকিক জীবনব্যবস্থা।’ স্বাধীনতার পরবর্তী কালে লোক-চলাচলের ইতিহাস মহাশ্বেতাকে ভাবিত করেছিল। তিনি অন্তরে উপলব্ধি করেছিলেন আজ যারা শরণার্থী হয়ে ফিরে আসছে তারাই হয়তো একদিন বর্গির আক্রমণের হাতে থেকে প্রাণ রক্ষা করার তাগিদে পূর্ববঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিল। তাই ‘আঁধার মানিক’ উপন্যাসে তুলে আনলেন বর্গি আক্রমণের সময়কালকে। তুলে আনলেন বাংলার শতাধিক গ্রামের লোক-চলাচলের ইতিহাসকে, তাদের ভাগ্য বিপর্যয়কে। সেই সঙ্গে বাংলার যুগান্তরের সূচনাকেও লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে বর্গি আক্রমণ বাংলাদেশে সমাজ রাজনীতি অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। যার ফলে দলে দলে মানুষ গৃহত্যাগী হয়েছে। গৃহস্থের উঠান পরিণত হয়েছিল চলার রাস্তায়। যে রাস্তায় বর্গিরা অনায়াসে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে পারত। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা কেউই রেহাই পায়নি বর্গিদের হাত থেকে। মুখে ‘হর হর মহাদেব’ বলে তারা উড়িষ্যার পথ ধরে মেদিনীপুর আক্রমণ করে এসে পৌঁছায় বর্ধমানের আঁধার মানিক গ্রামে। অপরিচিত দস্যু দলের আক্রমণে এক ধাক্কায় তছনছ হয়ে যায় মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বাঁকুড়া, নদিয়ার গ্রামগুলি। আক্রমণের ভয়াবহতায় তারা বিভ্রান্ত। তাই তাদের নিজস্ব সংস্কারেই তারা আবদ্ধ থাকতে চায়। যে সমাজ একদিন নরপতির বোনকে বেদেরা ছুঁয়েছিল বলে জিভে তপ্ত ঘি ঢালার নির্দেশ দিয়েছিল, সেই সমাজ এখনও সেখানেই অচল, অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শত বর্গি আক্রমণেও তাই সমাজ স্থবির। সে কারণে বর্গিরা ছুঁয়েছে বলে সমাজপতির মেয়ে নির্মলা এবং বাগদি রমণী পারিকে সমাজ থেকে নির্বাসন দেওয়া হয়। উচ্চবর্ণের মানুষ বড়ো আচার্য সমাজ রক্ষার্থে নিষ্ঠুর বিধান মেনে নেয় কিন্তু রামাই বাগদি সে তো সমাজের প্রান্তে বসবাসকারী অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ। সামাজিক নিয়ম-কানুন, বিধি-নিষেধের বাধা সে মানে না তাই সে জানিয়ে দেয় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী পারিকে সে ত্যাগ করতে পারবে না। বাংলাদেশের সমাজে নারীদের কোনও মর্যাদা নেই, তা বুঝিয়েছিলেন সুরকন্ঠ কিন্তু তার মতো করে তো আর কেউ ভাবেনি। তাই সুরকণ্ঠকে উপলক্ষ্য করে ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের উদ্দেশ্যে রামাই ঘোষণা করেছিল— ‘না ঠাকুর পারিকে ত্যাগ করতে পারব না। দরকার হয় গ্রাম ছেড়ে যাব। দরকার হয় ভিন্ন গায়ে গিয়ে কলমা পড়ে সেখপাড়ায় ঘর বাঁধব। পারিকে ছাড়তে পারব না।’ যে সমাজ কৌলীন্য প্রথা মেনে ব্রাহ্মণত্বের বড়াই করছিল সে ব্রাহ্মণত্বকেই লজ্জা দিয়ে গেল রামাই বাগদি। সবার ওপরে যে মনুষ্যত্ব সে মনুষ্যত্ব আয়ত্ত করতে পেরেছিল রামাই বাগদি। কিন্তু সমাজপতিরা তা পারেনি তাই সম্মান প্রদর্শনও করতে পারেনি স্ত্রী জাতির প্রতি। স্ত্রী জাতির সম্মান রক্ষার দায় তাদের নেই। আছে কথায় কথায় তাদের ত্যাগ করার সংকল্প। রামাই-এর মতো অন্ত্যজ বাগদি পুরুষ বুঝেছিল, ‘সব গলে পচে গেছে হে, থুকথুক করছে, তাইতে আমার পারি আর থাকল না।’ ঔপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবীও সমাজের এই পচা গলা দিকের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন এবং বুঝেছেন এ কালের অন্ত এসেছে। রামাই-এর প্রতি প্রতিবাদী চরিত্র কাশীশ্বর। নরপতির প্রতিহিংসার বলি হয় বড়ো আচার্যের চেয়ে নির্মলা। নরপতির তেরো বছরের বোন পুনিকে বেদেরা ছুঁয়েছিল বলে তার জিভে তপ্ত ঘি ঢালার নির্দেশ দিয়েছিলেন বড়ো আচার্য। তাই তার মেয়ে নির্মলাকে বর্গিরা ছুঁয়েছে বলে তাকেও শাস্তি পেতে হবে। ছাড় পায়নি নির্মলা। তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল। উদার শিবকালির বাড়িতে ঠাই পেলেও ভাগ্য দোষে কুট্টিনীর হাতে পড়ে বিক্রি হয়ে যায় বাঁদিহাটে এবং সেখান থেকে মুক্তির উপায় না পেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। এই নির্মলাকেই সমাজের শাসানি উপেক্ষা করে মুক্ত করতে চেয়েছিল কাশীশ্বর। কাশীশ্বর এবং নির্মলা পরস্পরকে ভালবাসত। সেই ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে কাশীশ্বরেরও উপলব্ধি হয় রামাই-এর মতো। বর্গিদের চেয়েও নিষ্ঠুর ভয়ংকর এই গ্রাম সমাজ। তাই রামাই বাগদি গ্রাম ছেড়ে মিশনে চলে যায় খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয় এবং কাশীশ্বরও এমন সমাজ ছেড়ে অন্য সমাজে যেতে চায় যার ভিত্তি শিক্ষা। উচ্চবর্ণ এবং পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের কানাকড়িও দাম ছিল না। সমাজে অন্ত্যজ মানুষদেরও প্রতিনিয়ত সমাজপতিদের নিগ্রহ সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু ঔপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবী দেখিয়েছেন অন্ত্যজ মানুষেরাও এক সময় যখন সমাজপতিদের বিধান মেনে নিতে অস্বীকৃত হয়েছে তেমনি শুধু নবাবের ওপর নির্ভর না করে বর্গি আক্রমণের বিরুদ্ধেও গর্জে উঠেছে। সামন্ত রাজা (ভূমিপতি রায়)-র বিরুদ্ধে লোড় আদিবাসীরা বিদ্রোহ করেছিল। ঔপন্যাসিক বিস্মিত হয়েছেন সেই বিদ্রোহের ইতিহাস কোথাও লেখা নেই কারণ সাঁওতালদের তখনও লেখার ভাষা ছিল না।

জীবন সংগ্রামে বিশ্বাসী মহাশ্বেতা দেবী উপলব্ধি করেছিলেন আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অবমাননা, লাঞ্ছনা, নির্যাতনের ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে তাকে কোনও তথ্য বা বিবৃতি দানের মধ্যে রূপ দেওয়া যায় না। জীবনের রক্তাক্ত ইতিহাস রূপায়ণ করতে হয় চরিত্রের বাস্তব উপস্থিতির মধ্যে দিয়ে। যে সংগ্রামের ফলে রচিত হয় রক্তাক্ত ইতিহাস সে সংগ্রামে কোনও ফাঁক নেই, ফাঁকি নেই। বিশেষত নির্যাতিত উপেক্ষিত মানুষগুলি যখন শোষণ এবং নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সংগ্রাম করে সে সংগ্রামে কোনও ফাঁকি থাকে না। বরং সেখানে উঠে আসে এমন এক দাবি, যে দাবি জীবনের স্বাধিকার চেতনার। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য, অস্তিত্ব গড়ে নেবার জন্য জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয় মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাসের চরিত্রেরা। তাই কোনও বিশেষ একটি কাল প্রবাহের চেতনার মধ্যে স্থাপন করা যায় না বিরসা মুন্ডা, বসাই টুঢু, চোট্টি মুন্ডা, মাস্টার সাব, হরিরাম মাহাতো, তিতুমির, সিধু-কানু, সুরজ গাগড়াই, মহানাম দত্ত, ভীমের মতো ঐতিহাসিক চরিত্রদের। যারা কোনও-না-কোনও গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং নিজস্ব কালসীমায় সীমাবদ্ধ না থেকে এই চরিত্ররা হয়ে ওঠে আবহমান কাল ধরে চলে আসা সংগ্রামী মানুষের প্রতিনিধি।

বীরসা মুন্ডার জীবন ও সংগ্রামের কাহিনি নিয়ে লিখলেন ‘অরণ্যের অধিকার’ (১৯৭৭)। কারাগারে অত্যাচারে বিরসা মুন্ডার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে উপন্যাসের সূচনা। এরপর ধীরে ধীরে ঔপন্যাসিক ফ্লাশব্যাক-এর মধ্যে দিয়ে ফিরে গেছেন বিরসার ছেলেবেলায়। বিরসা মুন্ডা কীভাবে বিরসা ভগবানে রূপায়ণ হল— চিত্রিত করেছিলেন সেই ইতিহাস। অরণ্য যখন ক্রমে ক্রমে দিকুদের দ্বারা দখলের ফলে হাতছাড়া হতে থাকে তখন মুন্ডাদের জীবন ও জীবিকা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। মুন্ডার জীবনে ভাত একটা স্বপ্ন হয়েই থেকে যায়। ঘাটো একমাত্র খাদ্য যা মুন্ডারা খেতে পায়, তাই ভাত একটা স্বপ্ন। কোনও-না-কোনও ভাবে ভাত বিরসার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। বিরসা উদ্ধত হয়ে ঘোষণা করেছেন— ‘মুন্ডা শুধা ঘাটো খাবে কেন? সে দিকুদের মতো ভাত খাবে না?’ ভাতের স্বপ্ন মুন্ডারা সবসময় দেখে। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত। যে ভাতের কারণে ধরা পড়ে বিরসা। পাঁচশো টাকা পুরস্কারের লোভে বিশ্বাসঘাতক ধরিয়ে দিয়েছিল বিরসাকে। মুন্ডা জীবনে চাহিদা বড়ো কম। দু’বেলা দু’থালা ঘাটো, বছরে চারখানা গড়া কাপড়, ঘাটো খেতে কালো নুন, আলো জ্বালাবার মহুয়া তেল, বনের পশু পাখির মাংস এবং মহাজনের হাত থেকে রেহাই পেলেই রাজা হওয়া যায়। তাদের এই সামান্য চাহিদাটুকু পূরণ হত না। উপরন্তু তাদের নিজস্ব অরণ্যভূমিতে ঘটে বহিরাগতদের আগমন। ফলে বাস্তুহারা হতে হয় মুন্ডাদের। মুন্ডারা এমন এক জীবনের আকাঙ্ক্ষা করেছিল, যে জীবনে দিকু নেই, মহাজন নেই। বিরসা এমন এক অরণ্যের অধিকার পেতে চেয়েছিল। অরণ্য মুন্ডাদের মা, আর দিকুরা মুন্ডাদের জননীকে অপবিত্র করে রেখেছে। উলগুলানের আগুন জ্বেলে বিরসা অরণ্য জননী-কে শুদ্ধ করতে চেয়েছিল। ক্রমাগত বহিরাগতদের অনুপ্রবেশে মুন্ডাদের জীবনে অনিবার্য হয় শোষণ এবং নিপীড়ন। মুন্ডার জীবনে ঢুকে পড়েছিল মহাজন, জমিদার, মিশনারি, জেল, কাছারি, বাঁধানো রাস্তা, রেললাইন, বেয়নেট, বন্দুক, খরা, অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষ, আড়কাঠি, বেঠবেগারি-এর ফলে বদলে যেতে থাকে মুন্ডাদের জীবন। বিরসা মুন্ডাদের এই অত্যাচারের জীবন থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। মুন্ডাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছে। লড়াই করে বাঁচতে শেখাতে চেয়েছিল। তির-ধনুক নিয়ে মুন্ডারা বিরসার কাছে দীক্ষা নিয়ে হয়েছিল বিরসাইত। বিরসাকে কেন্দ্র করে তারা স্বাধীন মুন্ডারি রাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিল। ১৮৯৫-১৯০১ সালে যে উলগুলান তা তো একদিনে ঘটেনি। দীর্ঘদিন ধরে জমির লোভে এ অঞ্চলে অনধিকার প্রবেশ করে দিকুরা। বিহারের সিংভূম অঞ্চলে রাঁচিতে দিকুদের এবং ইংরেজ প্রভুদের অত্যাচারের দিনের পর দিন শুদ্ধ ও বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল মুন্ডারা। শেষ পর্যন্ত বিরসার নেতৃত্বে তারা উলগুলান করে। ১৮৯৫ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত উলগুলানের আগুন জ্বলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরা পরে বিরসা এবং পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু মহাশ্বেতা দেবী মনে করেন কোনও কালে, কোনও দেশে, কোনও নেতার মৃত্যুতে বিদ্রোহ শেষ হয় না। কালে কালান্তরে উত্তরাধিকারের ধারাপথে অব্যাহত থাকে তার অগ্রগতি। বিদ্রোহ থেকে জন্ম নেয় বিপ্লব। বিরসা মুন্ডা মুন্ডাদের মনে এই বিশ্বাসের বীজ বপন করে দিতে পেরেছিল যে— ‘উলগুলানের শেষ নাই, বীরসার মরণ নাই।’ অরণ্যের অধিকার নিয়ে যে লড়াইয়ের সূচনা করেছিলেন বিরসা তাই অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে ‘চোট্টি মুন্ডা এবং তার তির’ গ্রন্থে। বিরসা থেকে ধানী, ধানী থেকে চোট্টি, চোট্টি থেকে হরমু এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। পালামৌ জেলার আদিবাসী অঞ্চলে তির খেলার প্রধান বিচারক হিসাবে একজন বৃদ্ধ তিরন্দাজকে দেখেন এবং তাকেই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে কল্পনা করেন। এই উপন্যাসটি ‘ Best beloved book’ বলে গায়ত্রী দেবীকে জানিয়েছিলেন মহাশ্বেতা। চোট্টিকে মহাশ্বেতা বর্ণনা করেছেন গান্ধি বলে, কারণ সে শান্ত অহিংস আন্দোলনকারী। নদীকে কেন্দ্র করে যেমন জনজীবন গড়ে ওঠে, তেমনি চোট্টিকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয় দুসাদ, ধোবি, ওরাওঁ প্রভৃতি নদীর তীরবর্তী জনজাতি। চোট্টি নদীকে ঘিরে যে বনরাজি সেই বনে পশু-পাখি শিকার করেই জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে আদিবাসী জনসাধারণ। কিন্তু সেই জীবনে ঢুকে পড়ে বেঠবেগার, কর্জ, হাটতোলা ইত্যাদি, যে বিষয়গুলি চোট্টি তীরবর্তী মুন্ডাদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। অনুর্বর জমি বন্দোবস্তি নিয়ে তারা উর্বর করে, ফেলনা জমিকে করে তোলে ফলনা, তখন ভাগ নিতে চলে আসে মালিক, মহাজন, জোতদার। এভাবে মুন্ডাদের জীবনে বহিরাগতের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। চোট্টির তীরবর্তী অঞ্চলে অন্যান্য তপশিলিরাও বাস করে। তারাও বেঠবেগার। কিন্তু ধানী মুন্ডার শিষ্য চোট্টিকে সবাই মান্য করে। ধানীর কাছে তিরচালনা শিখেছিল চোট্টি। ধানীর মতোই তির চালনায় সিদ্ধি লাভ করেছিল সে। এমনকি ধানী মুন্ডার মতো চোট্টিও কিংবদন্তিতে পরিণত হয় মুন্ডাদের গল্পে-গানে। চোট্টির কারণে ঐক্যবদ্ধ হয় তপশিলি এবং মুন্ডারা। ফলে আতঙ্কিত হয় দিকু সমাজের প্রতিনিধি লালা তীরথনাথ, ইটভাটার মালিক হরবংশ; হাটতোলা, কর্জ, বেঠবেগারি নিয়ে মুন্ডাদের জীবন যেখানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় খ্রিস্টান মিশনারি সম্প্রদায়। দলে দলে মুন্ডা চলে যায় গ্রাম ছেড়ে মিশনের দিকে। জোতদার এবং নতুন বণিকরা ঘাবড়ে যায়। চলে যাওয়ার সময় জোতদারের কাছ থেকে কর্জ নিয়ে যায় আর প্রবল ঘৃণায় গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। তারা এমন এক জীবনে পৌঁছাতে চায় যেখানে হাটতোলা নেই, কর্জ নেই, বেঠবেগার নেই। তারা মিশনের পথে পা বাড়ায়। যেন কোনও জমিদার তাদের স্পর্শ না করতে পারে। কিন্তু মিশনে যেতেও কষ্ট এবং সেখানে গিয়ে পৌঁছেও কোনও সুখ নেই। কারণ— ‘মুন্ডার মুখ দেখতে কেউ তারে নেয় না, কুনো না কুনো ফায়দা উঠাতে নেয়। রাজা, জমিদার, দিকু সবাই সে কারণে সহন করে। মিশনের সাহেবও কুনো না কুনো ফায়দা উঠাবে।’

তাই বারে বারে ফিরে আসে মুন্ডাদের ঘর ছাড়ার কাহিনি। অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাহিনি। অতীত থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত একই চিত্র। যে কালে প্রশাসন চলে যায় রোমিওদের হাতে, ‘মিসা’ চালু হয় মুন্ডা দমনের জন্য ও আরও শক্তিধর ‘ইয়াড’ (Investigate Aprehend-Destroy ) আসে সকলকে শায়েস্তা করার জন্য। যদিও কার্যক্ষেত্রে এর বিপরীতটাই ঘটে। অন্যদিকে আদিবাসীদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভারত সরকার যেসব বুদ্ধিজীবীদের পাঠায় তারা শুধুমাত্র তথ্য এবং পরিসংখ্যানে ব্যস্ত থাকে। ১৮৭৫ সালে ২৪ অক্টোবর বেঠবেগারি প্রথা বন্ধ করার অর্ডিন্যান্স জারি হয়। কিন্তু কার্যত কোনও লাভ হয় না। মুন্ডাদের ওপর অত্যাচার বেড়েই চলে, মেয়েরা লাঞ্ছিত হয়, কর্তারা নিজ নিজ স্বার্থে মস্তান রোমিয়োদের প্রশ্রয় দেয়। কিন্তু চোট্টির তিরকে তারা ভয় পায়। মুন্ডা, ওরাওঁ, দুসাদ, ধোবিরা সম্মিলিত প্রতিশোধ স্পৃহায় এবং প্রচেষ্টায় নিঃশেষ করে দেয় রোমিও ও পহলোয়ানকে। থানা পুলিশ আসে। উন্মত্ত প্রশাসন আদিবাসীদের মধ্যে খুনিকে খুঁজতে থাকে। তখন মুন্ডা সমাজকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে চোট্টি। মুন্ডা সমাজকে সে রক্ষা করবেই। চোট্টি তির ছুড়লেও তা কখনো মানুষ মারার জন্য নয়। তাই বিস্মিত হয় সকলে। সকল মুন্ডাকে অভয় দিয়ে ধানী মুন্ডার নাম নিয়ে তির ছোড়ে চোট্টি। যে তির লক্ষ্যভেদ করে। তারপর সে দাঁড়িয়ে থাকে নিরস্ত্র। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চোট্টি চিরকালের সঙ্গে মিলেমিশে যায়, নদী, কিংবদন্তি, অবিনশ্বরতায়। চোট্টিকে কেন্দ্র করে সকল আদিবাসী আন্দোলন চলে আসে বর্তমানে, আদিবাসী এবং তপশিলির মুক্ত আন্দোলনে। বিরসা মুন্ডার কালে যা সম্ভব ছিল না, তাই সম্ভব হয় চোট্টি মুন্ডার কালে। মুণ্ডা, ওরাওঁ, দুসাদ, ধোবি সকলকে নিয়ে একটি আন্দোলনে জোট বাঁধা। এভাবেই সমাজের অবহেলিত মানুষেরা একটা মুক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে এবং যে মুক্ত আন্দোলনের ছবি অনেক বেশি গতিময়। তাই উপন্যাসের শেষে চোট্টির তির যখন নিশানা বিদ্ধ করে, তারপর— ‘এস. ডি. ও যেন জাদু মন্ত্রের আবেশ কাটিয়ে উঠে দাঁড়ান, এগোন। কিন্তু তখনই শূন্যে ধনুক শুদ্ধ হাত তুলে হাজার আদিবাসী চেঁচিয়ে ওঠে, না। যারা আদিবাসী নয় তারাও নিষেধের হাত তোলে।’ এ ভাবেই একটা আন্দোলনের সংঘবদ্ধতা ভাষা পায়।

‘অপারেশন বসাই টুডু’ ও ‘অক্লান্ত কৌরব’ দুটি উপন্যাসের প্রেক্ষাপট একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, নকশাল আন্দোলন। কাহিনির নায়ক বসাই ১৯৭০ থেকে ৭৬-এর মধ্যে চারবার মারা যায় আর তাকে শনাক্ত করতে ডাকা হয়েছিল কালী সাঁতরা-কে, যে কালী সাঁতরা বসাই-এর রাজনৈতিক সহকর্মী। চারবারই কালী সাঁতরা মৃত ব্যক্তিকে বসাই বলে শনাক্ত করে কিন্তু এরপরে কোনও জোতদারের হত্যার মাধ্যমে বসাই-এর পুনর্জন্ম হয়। বসাই-এর প্রথম অপারেশনের লক্ষ ছিল প্রতাপ গোলদার। এরপর পুলিশ একজনকে বিদ্রোহী বলে হত্যা করে, যাকে কালী সাঁতরা বসাই বলে শনাক্ত করে। কিন্তু তারপরেও বসাই ফিরে আসে। দ্বিতীয়বার হত্যা করে কাঁকড়াসোলের বানেশ্বর ভূইঞাকে। তৃতীয় বারে সূর্য সাউ এবং চতুর্থ বারে মহাজন জগত্তারণক হত্যা করে বসাই টুডুর অপারেশন সফল হয়। এই হত্যার পরে পরে বিদ্রোহ দমনে করতে বসাই-কেও হত্যা করা হয়। কিন্তু বসাই ফিরে আসে। পঞ্চম বার হরিধন সর্দারকে হত্যা করার পর বসাই-এরও মৃত্যু ঘটে। পঞ্চম মৃত্যুতে বসাই মৃত এবং সমাহিত— ‘পঞ্চম মৃত্যুতে কোনো পুলিশ, কোনো কালী সাঁতরা, কোনো অন্য লোক ছিল না। অন্ধকার। কয়েকজন সঙ্গের সাথী। যে অন্ধকারে কোনো সাঁওতাল বাতাসের গলা মোচড়ালে দেখতে পাবার কথা নয়, তবু কালী জানে, বসাই এবারও অন্ধকারের গলা মুচড়ে পিষে দিয়েছিল। বাতাসকে মুচড়ে বাতাসকে অবয়ব দেবে একদিন। অন্ধকারের গলা মুচড়ে তাকে আগুন বানাবে। যে রাতে পঞ্চম বসাইকে গোর দিয়ে ষষ্ঠ বসাই হয়ে চলে গেল, সে কী রকম? খুব সুন্দর হোক সে।’১০

পঞ্চম মৃত্যুতেও বসাই নিঃশেষ হয় না। চিরকালীন সংগ্রামী মানুষের চেতনার মতো, চেতনার মধ্য দিয়ে বসাই বারে বারে ফিরে আসে।

‘অগ্নিগর্ভ’ গল্পগ্রন্থের ভূমিকায় মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন— ‘আমার লেখায় চিহ্নিত রাজনীতি খোঁজা নিরর্থক। শোষিত এবং নির্যাতিত মানুষ, তাদের প্রতি সংবেদী মানুষই আমার লেখার প্রধান ভূমিকায়।… আমি বর্তমান সমাজব্যবস্থার বদলে আকাঙ্ক্ষিত, নিছক দলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। স্বাধীনতা একত্রিশ বছরে আমি অন্ন, জল, জমি, ঋণ, বেঠবেগারি, কোনোটি থেকে দেশের মানুষকে মুক্তি পেতে দেখলাম না। তার বিরুদ্ধে নিরঞ্জন, শুভ্র ও সূর্যসমান ক্রোধ আমার সকল লেখার প্রেরণা।’১১ 

সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ওয়াহাবি আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ থেকে শুরু করে আধুনিক কালের নকশালবাড়ি আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন— এইসব আন্দোলনেরই প্রায় একই মৌলিক দাবি। ‘আঁধিয়ার’ ব্যবস্থায জোতদার জমিহীন কৃষক-চাষিদের ওপর নিজেদের শোষণ অব্যাহত রাখে। খাদ্য এবং নামমাত্র মজুরি দিয়ে চাষিদের নিজেদের ক্ষেতে কাজে লাগায় এবং ফসলের সিংহভাগ নিজেদের ঘরে তোলে। এর বিরুদ্ধে চাষির ক্ষোভ ও প্রতিবাদ। ‘এস্টেট অ্যাকইমিশন আইন’ হলেও কার্যকালে দেখা যায় বেনামে জমি জোতদারের অধীনেই থাকে। বিক্ষোভের আরও একটি কারণ চা-বাগানের মালিকদের হাতের অতিরিক্ত জমি বন্দোবস্তির মাধ্যমে সরকারের হাতে নেওয়ার কথা থাকলেও কার্যক্ষেত্রে তা হয় না। চা-বাগানের আধিয়ারদের মধ্যে জমি বণ্টন করার দাবি জানায় চা-শ্রমিকেরা। কিন্তু মালিকেরা তাদের উচ্ছেদ করে এবং হাতি দিয়ে তাদের কুঁড়েঘরগুলি গুঁড়িয়ে দেয়। ফলে ১৯৫৯-এর আন্দোলন ভয়ংকর রূপ নেয়। এই ধরনের অত্যাচার ও অনাচারের বিরুদ্ধে নকশালবাড়ির কৃষকশ্রেণি সংগঠিত শক্তি নিয়ে বিদ্রোহে নামে। সেই সঙ্গে ক্ষেতমজুর ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে। এরকম নানা প্রকারের কৃষক চাষিদের ওপর হয়ে আসা নির্যাতনের প্রতিবাদে কলম ধরেছেন মহাশ্বেতা।

‘মাস্টার সাব’ (১৯৭৯) উপন্যাসে আমরা দেখি একোয়ারি গ্রামের নিরন্ন চাষির ছেলে জগদীশ মাহাতো লেখাপড়া শেখার ইচ্ছাকে সমাজের উচ্চবৃত্তের মানুষেরা ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু তবুও কোয়ারি জাতের জগদীশ মাহাতো শুধু স্কুল মাস্টার হয় না, হয় হরিজন সম্প্রদায়ের এক আবিসংবাদী নেতা। হরিজন হয়ে জন্মানো একটা অভিশাপ, তারা লেখাপড়া শিখতে পারে না, শিখলেও মালিকদের চোখে ওরা হরিজনই থাকে। জগু দেখছে ওদের মেয়েদের প্রতিদিনের লাঞ্ছনার ছবি— ‘শালারা আমাদের পুরুষদের জানোয়ার মনে করে যে স্বামীর পাশে স্ত্রী আছে, তাকে টেনে নেয়।’১২ জগুর বাবা বহু বছরের অভিজ্ঞতায় বেদনার্ত গলায় বলেছে— ‘রাতে তো ভালো ছেলেপুলে ঘুমায় দিন দুপুর মানে না।’১৩ একোয়ারি গ্রামের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের মনে সাহস জোগাতে জগদীশ মাস্টার চাকরি ছেড়ে, এলাকার জনগণকে সংগঠিত করে। ভোজপুরের মাস্টারসাবের নেতৃত্বে শ্রেণিশত্রু দমনের কাজ শুরু হয়। মাস্টারসাব ‘নকশালি’ বলে অভিহিত হয়। জমি মালিকেরা ষড়যন্ত্র করে তাকে ‘ডাকু’ বলে চিহ্নিত করে এবং সাধারণ মানুষ তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে, পরে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং মাস্টারসাবকে অমর করে লোকগানে। হরিরাম মাহাতো মাস্টার সাবের মতো যাদের হয়ে লড়তে চেয়েছিল তারাই তাকে হত্যা করে। মিশনের দরজায় পড়ে থাকা শিশু শিক্ষিত ও উদ্যমী হয়ে উঠলে মিশন তাকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে চায়। সে কাজে সফল হতে না পারলে তার নামে মিথ্যা রটনা করে। মিশনের হাতের পুতুল না হয়ে এক আদিবাসী যুবক মানুষের মনে স্থায়ী পরিচয় তৈরি করতে চেয়েছিল। কিন্তু মিশনের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বেহুলাতে, ভোজপুরে হরিরাম এতদিন যেত মিশনের দালাল হয়ে। কিন্তু আর সে মিশনের হয়ে কাজ করতে চায়নি। জনগণের বন্ধু হয়ে সে গিয়েছিল বেহুলাতে। সে তাদের লড়াই করতে শেখাবে, শেখাবে বন্দুক ওঠাতে। কিন্তু তার আগেই বিদেশি শক্তির চর হিসেবে হরিরাম প্রচারিত হয় বেহুলায়। তারপরেই বেহুলার নদীর পাড়েই পাওয়া যায় হরিরাম মাহাতোর লাশ।

১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘সিধু কানুর ডাকে’ নামক দুটি কাহিনির সংকলন গ্রন্থের শিরোনামহীন প্রথম রচনা ‘হুলমাহা’ এবং দ্বিতীয় রচনা ‘ঘণ্টা বাজে’। অত্যাচারী ইংরেজ শাসক এবং জমিদারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল শান্ত সাঁওতালরা। ইতিহাসে যা সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত। সেই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিল সিধু এবং কানু নামে দুই ভাই— ‘জমিদার আর তার আমলাগোমস্তা, মহাজন আর ব্যবসায়ী, আরকাঠি আর পিশাচ নীলকর, সাঁওতাল জীবনে সকল অভিশাপ আনল যারা, সেই কোম্পানি সরকার শুধু খাজনা বুঝে। এই যে শুনি কোম্পানির বাজ্যে অবিচার নাই, তাহলে থানা-পুলিশ-দারোগা এমন জুলুম করে কেন? আদালতে নিলে বাঙালি উকিল পেশকার মঞ্জুরি আমাদের রক্ত খায়। হাকিম জুলুমবাজকে ছাড়ি দেয়, আমাদের জেলে পাঠায়। আর নয়, সাঁওতাল দেশে সাঁওতালরাজ চাই। সকল সাহেব। সকল দিকুর উচ্ছেদ চাই। সকল সাহেব। সকল দিকুর উচ্ছেদ চাই।’… ‘এই জমিদারগুলো কোম্পানি সরকারের তৈরি। তারা সাঁওতাল মহলগুলি জমা দেয় দিকুদের। কে সে সব দিকু? যারা আমাদের রক্তে বিষের শাঁ ফেলে। মহাজন-আড়তদার-কারবারি, সব দিকু।’১৪ 

সাঁওতালরা সহজ সরল হলেও অত্যন্ত স্বাধীনচেতা এক জাতি। তারা কারোর বশ্যতা স্বীকার করে না। ক্যাপ্টেন ব্রুকের নেতৃত্বে সাঁওতাল দমন শুরু হলে সাঁওতালদের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ চরমে উঠেছিল। কিন্তু ইংরেজ সরকার কৌশলের আশ্রয় নিয়ে সাঁওতালদের প্রতারণা করে, যে জমির জন্য খাজনা দিতে হবে না বলেছিল, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল খাজনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এবং খাজনা আদায়ের জন্য অত্যাচারের মাত্রাও যায় বেড়ে। সিধু বলে— ‘আমাদের জমি, আমাদের জঙ্গল, আমাদের সমাজ। আমরা কারো মুখের ভাত কাড়ি নাই। ঘর হাতি দিয়া মাড়াই নাই। কারেও ঋণের মিছা দায়ে দড়িতে বেন্ধে লয়ে যেয়ে বান্ধাবেগার বানাই নাই। ঝুটা মিছা জানি না, দিকু বুলি বুঝি না। হুলমাহা করছিল বাবা তিলকা মাঝি। হুলমাহা করি আমরা। করলাম। বলি সাহেবেরা যেমন ঘুম ভাঙি জানতেছে যে সন্তাল বলি একটা জাত আছে।’১৫

১৮৫৫ সালে ১৫ জুন, সিধু কানু সাঁওতাল গ্রামে ‘গিরা’ পাঠায় অর্থাৎ দেবতার নামে সকল সাঁওতালকে ডাক দিল। এই ডাকে সাড়া দিয়ে ভগনাডি গ্রামে প্রায় ১৫ হাজার সাঁওতাল জড়ো হয় এবং পায়ে হেঁটেই কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতের ইতিহাসে এটাই প্রথম গণ-পদযাত্রা। সিধু কানুর নেতৃত্বে সাঁওতালরা স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্যের স্বপ্ন দেখছিল। কর্নওয়ালিসি ব্যবস্থার সন্তান জমিদার, নীলকুঠি ও অন্যান্য বাণিজ্যিক কুঠির মালিক, এদের ওপরেই তো সাঁওতালদের রাগ— ‘সেই জন্যই তো হুলমাহার ডাক দিতে হল, আগুন জ্বালতে হল ভগনাডিতে। বাবা তিলকা মাঝি তুমি হুল করেছিলে, পাঁচ বছর লড়েছিলে সাহেবদের সঙ্গে। তোমার হুলের পরেই আমরা অত্যাচারে-অবিচারে এই পাহাড় জঙ্গল দেশে এলাম। আবার হুল ঘোষণা করতে হল। তুমি আশীর্বাদ করো যে সন্তাল জাতির ওপর জুলুম এবার শেষ হোক। যেন তারা এক দেশে, স্বাধীন রাজ্যে থাকতে পারে।’১৬ কিন্তু বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ নৃশংস ভূমিকা নিয়েছিল। সিধু কানু দুই ভাই সহ কয়েক হাজার সাঁওতালকে হত্যা করা হয়েছিল।

হায়দরপুরের নিসার ও রোকেয়ার ছেলে তিতুকে নিয়ে লেখেন ‘তিতুমীর’। যে পরবর্তী কালে কৃষক আন্দোলনের এক নেতা রূপে পরিচিত হয়েছিল। চাষবাস করে শান্ত, নিরুপদ্রব জীবন কাটানো তিতুমীরের পছন্দ ছিল না। তাই তাজুদ্দিনের কাছে সে লাঠি খেলা এবং তির ছোড়া শেখে। লাঠি খেলায় তার মত পারদর্শিতা কেউ দেখাতে পারেনি। বাবা নিসার বুঝেছিলেন ‘এ ছেলে সংসারী হবে না।’ কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় তিতু ধীরে ধীরে কৃষক নেতায় পরিণত হয়। তিতুর কাছে অত্যন্ত আশ্চর্যজনক মনে হয়েছিল শহর কলকাতার মানুষজনকে— ‘কলকাতার লোকেরা চাষ করে না, ধান কাটেনা ডিঙি বায় না, বর্ষার জল বাড়লে বাঁধের ধস আটকাতে ছুটে যায় না। তারা কোনো রকম দেহের পরিশ্রমই করে না, তবু এত এত খায়।’১৭ মিস্কিন শাহের সংস্পর্শে এসে তিতু জেনেছে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের কথা। দেখেছে নীলকুঠির পেয়াদারা কীভাবে প্রজাহিতৈষী জমিদার এবং কৃষকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে নীলকরদের সুবিধা করে দিচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে বিশাল বাহিনী গড়ে তোলে। ‘লাঠি ও বেয়নেট, কলম ও বন্দুক। চল ভাই সব সেয়াদ আহম্মদের নাম উঠিয়ে চল। হাফিজরে, তাজুদ্দিন চাচার নাম উঠা। সেই তো আমাদের লাঠি ধরতে শেখায়। মাসুম, তোরা সব নারকেল বেড়িয়ার নাম উঠা। নারকেলবেড়িয়া আজ বালাকোট হতে যাচ্ছে দেখিস না তোরা, মার, মার দুশমনদের। বাংলার মাটিতে ওরা জমিদার-মহাজন-নীলকুঠি বুনে দিয়েছে। মার ওদের।’১৮ তিতুর আক্রমণের ভয়াবহতায় ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে থাকে নীলকররা। জমিদার- তালুকদার-ধনী-মুসলমান সকলেই পালিয়ে যেতে থাকে। প্রজাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নীল চাষ বন্ধ হয়। কিন্তু ইংরেজ কোম্পানি তিতুমিরের বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে এবং তিতু মৃত্যুবরণ করে।

‘বন্দোবস্তি’ উপন্যাস মহাশ্বেতা উৎসর্গ করেছেন— ‘রামলাল খাটুয়াদের, যাঁরা আছেন এবং সোমদের যাঁরা ওদের খুঁজছে।’ উপন্যাসের ভূমিকায় বলেছেন— ‘বন্দোবস্তি চলছে এখন, রাষ্ট্রযন্ত্র যা চায়। মানুষ ভাবছে সে স্বাধীন মতে কাজ করছে। তা তো নয়, রাষ্ট্রযন্ত্র পিছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বলে দিচ্ছে, জীবন একটা বন্দোবস্তি বা অ্যারেঞ্জমেন্ট মাত্র। সে যার শ্রেণি স্বার্থের কথা ভাবো। ভোগবাদী মূল্যবোধ ঢুকে যাক মাটির গভীরে যা সুস্থ, যা দেশজ, যা দেশ, যা মানুষ, তাকে শুকিয়ে মারো। অথচ এমন সংকট কালেও দেশ ও মানুষকে বাঁচাতে পারে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, নিরন্তর আত্মত্যাগ।’১৯

মহাশ্বেতা দেবী বিশ্বাস করেন এমন মানুষ আছেন, তিনি নিজে তাঁদের দেখেছেন এবং উপন্যাসে তাঁদের তুলে এনেছেন। ভোলানাথ, লেঠেল রাম, গজানন, কালীপদ রামলাল প্রমুখ চরিত্রদের সঙ্গে পাঠকের যোগাযোগ ঘটিয়েছেন সোমের মাধ্যমে। সোম সন্ধান করেছে রামলাল খাটুয়াকে, কাকদ্বীপ-তেভাগার কৃষি সংগ্রামে যার গণসংগীত আন্দোলনকারীদের উদ্বুদ্ধ করত। ঔপন্যাসিক আক্ষেপ করেছেন— এখানকার গণসংগীতে গণও নেই, সংগীতও নেই। তেভাগা কোথাও হল না বলে আক্ষেপের সুর শোনা যায় রামলাল খাটুয়ার গলায়। কিন্তু রামলালের জমি চাষ করে যেসব চাষি, তারা দুই ভাগ পায় এক ভাগ থাকে রামলালের। অন্যত্র তেভাগা না হলেও এখানে তেভাগা হয়েছে। দেশ ও সমাজ সর্বত্র বন্দোবস্তির প্যাটার্ন ছাড়ানো থাকলেও এই ব্যবস্থার বাইরেও কিছু মানুষ এখনও আছে। তাই তিনি বিশ্বাস করেন বীজ ছিটানোতে। সব বীজ বালিতে পড়ে না, কিছু মাটিতেও পড়ে, সেগুলিই অঙ্কুরিত হবে। রামলাল এবং সোমের মতো মানুষেরা সেই অঙ্কুরিত বীজ।

সমাজকর্মী ঔপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবী। সামাজিক নানা অসংগতি তাঁকে পীড়িত করেছে প্রতিনিয়ত। মানুষের প্রতি সংবেদী মহাশ্বেতা নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের হয়ে কলম ধরেছেন। সেই নিপীড়িত, নির্যাতিত জনসাধারণের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন।

তথ্যসূত্র:

১. মহাশ্বেতা দেবী, ‘লেখালেখি নিয়ে’, “অন্যলেখা”, কলকাতা, আজকাল পাবলিশার্স লিমিটেড, ২০০৩, পৃ-১৩১

২. ‘মহাশ্বেতা দেবী রচনা সমগ্র’, চতুর্থ খণ্ড, কলকাতা, দে’জ পাবলিজিং, পৃ-২৫২

৩. অমৃত সাপ্তাহিক পত্রিকা (বর্ষ ৭, সংখ্যা ৯, শুক্রবার, ১৫ই আষাঢ়, ১৩৭৪, ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ, পৃ- ৬৬৪-৬৫) ‘ইতিহাস ও লোকজীবন’ শিরোনামে রবীন্দ্রনাথ রায় ‘আঁধারমানিক’ উপন্যাসের সমালোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন।

৪. ‘মহাশ্বেতা দেবী রচনা সমগ্র’, ৫ম খণ্ড, পৃ-১৭

৫. ঐ, পৃ-১৯

৬. ঐ, পৃ-২৩১

৭. ‘মহাশ্বেতা দেবী রচনা সমগ্র’, ৮ম খণ্ড, পৃ-৪১ 

৮. ‘মহাশ্বেতা দেবী রচনা সমগ্র’, ৯ম খণ্ড, পৃ- ৮৮

৯. ঐ, পৃ-২৪৪ 

১০. ‘মহাশ্বেতা দেবী রচনা সমগ্র’, ৮ম খণ্ড, পৃ-৪০৯

১১. ঐ, পৃ-৩২৫

১২. ‘মহাশ্বেতা দেবী রচনা সমগ্র’ ১১, পৃ-২৩

১৩. ঐ 

১৪. ‘মহাশ্বেতা দেবী রচনা সমগ্র’ ১১, পৃ-৯৭

১৫. ঐ, পৃ-১০৯

১৬. ঐ, পৃ-১১০

১৭. ‘মহাশ্বেতা দেবী রচনা সমগ্র’ ১২, পৃ-২২৩

১৮. ঐ, পৃ-২৫৯

১৯. ‘মহাশ্বেতা দেবী রচনা সমগ্র’ ১৫, পৃ-১২২

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান