সৌম্যব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়
২০২৪ সালের ২৭ এপ্রিল, এক আনন্দঘন মুহূর্তে এবারের আনন্দ পুরস্কার প্রাপক ‘নকশালনামা’ গ্রন্থের লেখক নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় বলেন, “চলার পথে জেনেছি পার্টি বা নেতা নয়, আসলে জনগণই ইতিহাস তৈরি করে।” নানান রঙে তবু ইতিহাস লেখা হয়। পরে সে ইতিহাসের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাসের নির্মাতা যে জনগণই, সময় বারে বারেই তা প্রমাণ করে। আলোচ্য প্রবন্ধের শিরোনাম যে ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করে, সময় প্রমাণ করেছে তা জনসাধারণের নির্মাণ। বিশ্বযুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ-দাঙ্গা বিশ শতকের চারের দশকে প্রস্তুত করে রেখেছিল পটভূমি। যে প্রেক্ষাপটে চেতনার জাগরণ ঘটেছিল অবহেলিত উপেক্ষিত মাটিলগ্ন মানুষগুলির। উৎপাদিত ফসলের তিনভাগের দুভাগ প্রাপ্য আদায় করে নিতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একজোট হয়েছিল অবিভক্ত বাংলার অগণিত কর্ষণজীবী মানুষ, ১৯৪৬-এর সেপ্টেম্বরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা ডাক দিয়েছিল ‘তেভাগা’-র। সাম্যবাদে দীক্ষিত বিদ্রোহী মধ্যবিত্ত মন মেট্রোপলিটন শহর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিল, নিম্নবর্গের জাগরিত চৈতন্যকে চালিত করতে চেয়েছিল সুসংগঠিতভাবে। কিন্তু তার আগেই জমিদার জোতদারের মাত্রা ছাড়া শোষণ শক্তি জুগিয়েছিল প্রতিবাদের। প্রতিরোধের আগুনে তপ্ত হয়ে উঠেছিল তেভাগা আন্দোলন। নির্দিষ্ট কোনও পার্টি বা নেতার ইন্ধনে এ বৃহৎ জনজাগরণ সম্ভব ছিল না। অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনে,পরিকল্পনায় ও কতক পরিচালনায় আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল তেভাগা। অস্তিত্ব রক্ষার অনিবার্যতায় নিম্নবর্গ নিজেই রচনা করেছিল তেভাগার ইতিহাস!
তেভাগা কৃষক আন্দোলনের অনুপুঙ্খ ইতিহাস আজ বিরল নয়। স্বাধীনতার আগে পরের কয়েকটি বছরে নিম্নবর্গের অধিকার আদায়ের দাবিতে তেভাগা আন্দোলন যে উত্তাপ ছড়িয়েছিল, শুধু ইতিহাসে নয় তার আঁচ পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্যের আনাচেকানাচে। আসলে বাঙালির সাংস্কৃতিক চৈতন্য দারুণ নাড়া খেয়েছিল এই ব্যাপক কৃষক আলোড়নের তীব্রতায়। অন্য অনেকের মতো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মার্কসবাদী মন একই সঙ্গে আর্দ্র ও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল তেভাগার দিনগুলিতে। আন্দোলনের ইতিবাচক দিকগুলি অনুপ্রাণিত করেছিল মানিককে। ‘হারাণের নাতজামাই’, ‘চৈতালী আশা’, ‘মাটির মাশুল’, ‘গায়েন’, ‘বাগদিপাড়া দিয়ে’, ‘মেজাজ’, ‘পেরানটা’, ‘ছোটোবকুলপুরের যাত্রী’ প্রভৃতি গল্পে প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তেভাগা আন্দোলনের বিবিধ অভিমুখ। আপাতত তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে লেখা ‘হারাণের নাতজামাই ‘এবং ‘ছোটোবকুলপুরের যাত্রী’ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই দুটি গল্পে নিম্নবর্গের প্রতিবাদী স্বর ও প্রতিরোধের স্বরূপটি বুঝে নেওয়া যাক।
১৯৪৭-এর ৪ জানুয়ারি ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘হারাণের নাতজামাই’। তেভাগা আন্দোলনের যাবতীয় উত্তাপে উষ্ণ এ গল্পের শরীর। শুরুতেই মানিক স্পষ্ট করেছেন আলোচ্য গল্পের প্রেক্ষাপট। প্রথমেই আঁচ পাওয়া গেছে সালিগঞ্জ গাঁয়ের তেভাগা আন্দোলনের আবহাওয়া। জোতদার চণ্ডী ঘোষের দোর্দণ্ড প্রতাপের বিপরীতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জাত-ধর্ম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গ্রামের নিম্নবর্গ কর্ষণজীবী মানুষগুলির সংঘবদ্ধ অবস্থান। ‘গ্রেফতারি ওয়ারেন্টকে কলা দেখিয়ে’ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে কৃষক নেতা ভুবন মন্ডল দেড় মাস ধরে ‘এ গাঁ ও গাঁ’ করে দিব্যি গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পেরেছে আন্দোলনকারী কৃষকদেরই তৎপরতায়। অথচ যেদিন বিকেলে সে সালিগঞ্জে এসেছে এবং আশ্রয় নিয়েছে হারাণের বাড়িতে, সেদিন গ্রামের সংঘবদ্ধ কৃষকদের আত্মসম্মানে আঘাত করে কোনও এক বিশ্বাসঘাতক খবর পৌঁছে দিয়েছে জোতদারের কানে। পরক্ষণেই আন্দোলন প্রশমনের অনিবার্যতায় সশস্ত্র পুলিশ, দেশি বন্দুক আর লেঠেলে লেঠেলে ঘেরা হয়েছে হাঁসখালি পাড়া। প্রতিরোধ সংকল্পে পরিশ্রান্ত দেহগুলি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে নিমেষে; ‘লাঠি-সড়কি-দা-কুড়ুল বাগিয়ে’ দল বেঁধেছে চাষিরা। ‘শীতের তে-ভাগা চাঁদের আবছা আলোয়’ তাদের চোখে প্রতিফলিত হয়েছে অসম্ভব প্রতিহিংসা, বিশ্বাসঘাতককে চিনে নেবেই তারা। আগেই তারা জোতদারকে ‘ধান দেবে না বলে কবুল করেছে জান, সে জানটা দেবে এই আপনজনটার জন্যে।’ নিজেদের অধিকার আদায়ের প্রয়োজনে কেবল সালিগঞ্জ গাঁয়ের বিদ্রোহী কৃষকরাই নয়, অবিভক্ত বাংলার কমবেশি উনিশটা জেলার অগণিত গ্রামের প্রায় ৬০ লক্ষ কৃষক প্রিয়জন মেনেছিল ভুবন মন্ডলদের, সম্মিলিত ভাবে আগলে রাখতে চেয়েছিল জান দিয়ে।
প্রগতি লেখক সংঘ তথা ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের সক্রিয় সমর্থক ও কর্মী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আলোচ্য গল্পে দেখান,—
শ’দেড়েক চাষি চাষাড়ে অস্ত্র হাতে এসে দাঁড়িয়েছে দল বেঁধে। ওদের আওয়াজ পেয়ে মন্মথ জড়ো করেছে তার ফৌজ হারাণের ঘরের সামনে– দু’চারজন শুধু পাহারায় আছে বাড়ির পাশে পিছনে, বেড়া ডিঙিয়ে ওদিক দিয়ে ভুবন না পালায়। দশটি বন্দুকের জোর মন্মথের, তার নিজের রিভলভার আছে। তবু চাষিদের মরিয়া ভাব দেখে সে অস্বস্তি বোধ করছে স্পষ্টই বোঝা যায়। তার সুরটা রীতিমতো নরম শোনায়– স্রেফ হুকুমজারির বদলে সে যেন একটু বুঝিয়ে দিতে চায় সকলকে উচিত আর অনুচিত কাজের পার্থক্যটা, পরিণামটাও।
সহৃদয় পাঠক বোঝেন আসলে সময়ের পার্থক্যটা মন্মথকে বুঝিয়ে দেয় জনতার জেদ। বোঝা যায় পরিণামটা আন্দাজ করতে পেরেই শাসকের সুর নরম হয়। সে রাতেই সালিগঞ্জের চাষিদের সম্মিলিত প্রতিরোধ প্রবণতা থেকে মন্মথ উপলব্ধি করে, “গাঁয়ে গাঁয়ে চাষাগুলোর কেমন যেন উগ্র মরিয়া ভাব, ভয়-ডর নেই।”
হারাণের মেয়ে ময়নার মা কৃষক নেতা ভুবনকে অতিথি করে ঘরে নিয়ে এসেছিল। মন্মথ দলবল নিয়ে হারাণের ঘর ঘিরে ফেললে দারুণ তৎপরতায়, তুখোড় অভিনয়ে, অসম্ভব বুদ্ধিমত্তায় ময়নার মা-ই সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দেয় ভুবনকে। মান রক্ষা হয় সালিগঞ্জ গাঁয়ের কৃষকদের। এক লহমায় সমূহ সামাজিক সংস্কার ভেঙে দিয়ে পোড়খাওয়া এই বিধবা মহিলা এক রাতের জন্য ভুবনকে বানিয়ে নেয় জামাই জগমোহন। মেয়ে ময়নার গায়ে একখানা রঙিন শাড়ি জড়িয়ে দিয়ে তাকে শিখিয়ে দেয় দাম্পত্য অভিনয়ের অ আ ক খ! স্বার্থ চিন্তার সংকীর্ণ গণ্ডি কেটে বেরিয়ে এসে অপরিসীম সাহসে সে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি। ময়নার মায়ের চিত্রনাট্য জমে ওঠে ভুবনের মানানসই অভিনয়ে। সংগ্রাম থেকেই যে এই সাহস সঞ্চয় করে নিয়েছে প্রত্যন্ত গাঁয়ের ছাপোষা বধূটি, তেভাগা আন্দোলনের তপ্ত ইতিহাসের পাতা ওলটালেই তার বিস্তর প্রমাণ পাওয়া যায়।
বোঝা যায় বোবা-হাবা চাষাগুলোর এই বেপরোয়া হয়ে ওঠা, তেভাগা আন্দোলনের আবহে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বুদ্ধিমত্তায় এতখানি তুখোড় হয়ে ওঠা যতখানি না ভুবন মন্ডলদের ইন্ধনে, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে। শোষণ যত মাত্রা ছাড়া হয়েছে, ততই গনগনে হয়েছে প্রতিরোধের আগুন। শোষিত মানুষ খুঁজে নিয়েছে প্রতিবাদের ভাষা। মানিক জানিয়ে রেখেছেন, “কদিন আগে দুপুরবেলা পুরুষশূন্য গাঁয়ে পুলিশ এলে ঝাঁটা বঁটি হাতে মেয়ের দল নিয়ে ময়নার মা তাদের তাড়া করে পার করে দিয়েছিল গাঁয়ের সীমানা”। তেভাগার দাবিতে যাবতীয় মেকি সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়ে নারীরাও যে পুরুষদের সঙ্গে সমান উন্মাদনায় পথে নেমে এসেছিলেন তার নিদর্শন এ গল্পের ছত্রে ছত্রে ছড়ানো রয়েছে। ময়নার মায়ের সাহসিকতার নিদর্শন গ্রামের মানুষ আগেই দেখেছিল। গতরাতে তার রসিকতার অস্ত্রে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার মুখরোচক কাহিনিটি স্বাভাবিক কারণেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অচিরেই আসল জামাই জগমোহন হাজির হয় এবং বচসা বাধে ময়নার মায়ের সঙ্গে। সেখানেও সে বিগত রাতের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত বা অনুতপ্ত হয় না। বরং জামাইকে বোঝাতে পৌঁছে যায় এক দার্শনিক প্রত্যয়ে,—”মন্ডল দশটা গাঁয়ের বাপ। খালি জম্ম দিলেই বাপ হয় না, অন্ন দিলেও হয়। মন্ডল আমাগো অন্ন দিছে। আমাগো বুঝাইছে, সাহস দিছে, একসাথ করছে, ধান কাটাইছে। না তো চণ্ডী ঘোষ নিত বেবাক ধান।” ময়নার মায়ের এই সকৃতজ্ঞ সাহসিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে জগমোহন। শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর সম্ভ্রম রক্ষার্থে মন্মথর লাম্পট্যর সামনে সেও রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেখিয়েছে। ঘটনার অনিবার্যতায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে হারাণের পরিবারের সকলকে। ভুবন হলে মানা যেত, কিন্তু অতি সাধারণ হারাণের পরিবারের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আশপাশের গ্রাম থেকে নিমেষে জড়ো হয়েছে অগণিত জনগণ। জোতদারের দালাল মন্মথ রীতিমতো ভয় পেয়েছে চাষাভুসা মানুষের এই চেতনার জাগরণে! কোনও সিদ্ধান্ত নয়, স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সাবলটার্ন শ্রেণির উত্তরণের ইঙ্গিত দিয়ে এখানেই শেষ করেছেন গল্প।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মার্কসবাদী মন তাঁর সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে সত্য, কিন্তু তার চেয়ে বড়ো সত্য তাঁর সৃষ্টি চিরন্তন হয়েছে শিল্পীমনের স্পর্শে। প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থেকেছেন মানিক। কিন্তু সংঘের অন্যান্য সঙ্গীর মতকে সবসময় প্রগতির অনিবার্য পথ বলে মেনে নেননি তিনি। সৃষ্টির ক্ষেত্রে মানিক শিল্পীর চিন্তা,অভিজ্ঞতা এবং স্বাধীনতাকেই গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন সর্বাগ্রে। ১৯৪৮ সালে প্রগতি লেখক সংঘের পঞ্চম সম্মেলনে সংঘের অন্যতম মুখ চিন্মোহন সেহানবীশ ‘সাহিত্য ও গণসংগ্রাম’ নামে একটি প্রবন্ধ পড়েন। যেখানে বলা হয়, “শিল্পী বা সাহিত্যিকের উচিত ট্রেড ইউনিয়ন বা কৃষাণ সমিতির কর্মী হিসাবে মজুর বা কৃষাণের মধ্যে কাজে নামা। তার ফলে যদি লেখা বা শিল্প সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় তাতে ক্ষতি নেই। যে অভিজ্ঞতা তাঁরা অর্জন করবেন তার ফলে ভবিষ্যতে নতুন শক্তিশালী শিল্প সাহিত্য গড়ে উঠবেই ইত্যাদি।” সেদিন সভাপতির চেয়ারে বসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় চিন্মোহন বাবুর এই কথাগুলিকে আপাতভাবে সমর্থন করলেও সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি সযত্নে এড়িয়ে গেছেন এই বেপরোয়ানা। পরে পরে ‘পরিচয়’ পত্রিকার পাতায় ‘বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা’ প্রসঙ্গে তিনি যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন এই ধরনের নীতি-নির্দেশ।
চিন্মোহনবাবু মানিককে একপ্রকার পীড়াপীড়ি করেছিলেন পুলিশি সন্ত্রাস জর্জরিত হুগলির বড়া কমলাপুরে যাওয়ার জন্য। কিছুটা উদ্ধতভাবেই বলেছিলেন, “লেখক হিসেবে না হয় নাই গেলেন কমিউনিস্ট হিসাবেই যান।” অথচ এ নির্দেশের বেশ কিছু আগেই মানিক ডায়রিতে লিখে ফেলেছিলেন ‘পদাতিক’ নামে একটি গল্পের প্লট! আর ডায়রিতে লেখা এই ‘পদাতিক’ গল্পের প্লট হুবহু অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছে ‘ছোটোবকুলপুরের যাত্রী’! গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘শারদীয় সংবাদ’ পত্রিকায় ১৯৪৮ সালে। সত্যিই সেসময় মানিক বড়া কমলাপুরে গিয়েছিলেন কিনা সে তথ্য আজ রহস্যাবৃত! যদিও সে তথ্যের অস্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে কৃষক নেতা কমল চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায়, তবু তা খুব বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা এই যে, সেই সন্ত্রাস জর্জরিত বড়া কমলাপুরই মানিকের চিন্তা, অভিজ্ঞতা আর স্বাধীনতায় তেভাগার যাবতীয় উত্তাপ নিয়ে হাজির হয়েছে ‘ছোটোবকুলপুরের যাত্রী’ গল্পে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কিংবা সংবেদনশীল অনুভব আলোচ্য গল্পটির নির্মাণে অনুঘটক যাই হোক, মানিকের শিল্পী মনের সজাগ উপস্থিতিতেই গল্পটি সময়োত্তীর্ণ হতে পরেছে। প্রত্যক্ষ সংগ্রামের বাস্তবোচিত বর্ণনায় নয়, বরং সন্ত্রাসের ছমছমে প্রতিবেশ নির্মাণের অসাধারণত্বে এ গল্প তেভাগার তপ্ত ইতিহাসকে ধারণ করেছে।
বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাস্টার স্ট্রোক ‘ছোটোবকুলপুরের যাত্রী’। আবেগের আতিশয্য একেবারেই নেই, এ গল্পে মানিক অনেক পরিণত। মেদহীন স্মার্ট গদ্যে গল্পের শুরুতেই মানিক ‘আধা-চাষি আধা-মজুর’ দিবাকর আর তার স্ত্রী আন্নার সঙ্গে পাঠককেও পৌঁছে দিয়েছেন নির্দিষ্ট গন্তব্যে। গন্তব্য যদিও ছোটোবকুলপুর, স্টেশন থেকে মাত্র তিন মাইল রাস্তা, তবে সন্ধ্যা নাগাদ স্টেশনে পৌঁছেই আন্দাজ করে নেওয়া গেছে যে-কোনও সময় জ্বলে উঠতে পারে আন্দোলনের আগুন! জনগণকে আর দাবিয়ে রাখা অসম্ভব বুঝে সন্ত্রাস তৈরির অনিবার্য প্রয়োজনে সশস্ত্র সিপাইয়ের দল দখল নিয়েছে প্লাটফর্মের। কারখানার ধর্মঘট নিয়ে স্টেশন চত্বরে গতদিনের হাঙ্গামার খবর ট্রেনেই পেয়েছিল দিবাকর। শুনেছিল “তিনজন নেতাকে ধরে ট্রেনে চালান দেবার সময় কয়েকশো’ মজুর তাদের ছিনিয়ে নিতে এসেছিল। তখন গুলি চলে, রক্তপাত ঘটে।”
এখানে ওখানে এই গণজাগরণের খবরে খবরে তখন উদ্দীপিত হচ্ছিল অগণন নিম্নবর্গ। রক্তপাতের ভয় আর পাচ্ছিল না কেউ। সাব-অলর্টান জেগে উঠছিল শ্রেণিচেতনায়! কারখানার শ্রমিক কিংবা চিরদুর্ভাগা বাংলার কৃষক বুঝে নিতে চাইছিল নিজেদের অধিকার। তারা যত না সন্ত্রস্ত হচ্ছিল, তাদের সংঘবদ্ধ অবস্থান তার চেয়ে বেশি শঙ্কিত করছিল সন্ত্রাসবাদী জমিদার-জোতদার আর তাদেরই পেটোয়া পুলিশ-প্রশাসনকে। তাই আঁটোসাঁটো নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছিল প্লাটফর্ম। সকলকেই দেখা হচ্ছিল সন্দেহের চোখে। স্বাভাবিক কারণেই প্লাটফর্মে নেমে দিবাকর আর আন্নাকে সামলাতে হয়েছে পাহারাদারদের অবাঞ্ছিত উৎপাত। আত্মীয়ের জন্য দুশ্চিন্তা থাকলেও ভয় তারা পায়নি কোনও অবস্থাতেই, প্রতিপক্ষের যাবতীয় প্রশ্নের সামনে নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়েছে দিবাকর। উত্তর দিয়েছে সাহসের সঙ্গে। মাঝেমধ্যে ব্যঙ্গের খোঁচায় বুঝিয়ে দিয়েছে চৈতন্যের জাগরণ ঘটছে, কথা ফুটছে এই চির অবহেলিত উপেক্ষিত নিম্নবর্গের!
স্টেশন থেকে মাত্র তিন মাইল পথ ছোটোবকুলপুর। কিন্তু রাতের চেয়েও বেশি অন্ধকার নেমেছে সেখানে অরাজকতার। যুদ্ধ বেধেছে রাজায় প্রজায়। “সেখানে সৈন্য-পুলিশ গ্রাম ঘিরে আছে, রীতিমতো লড়াই চলছে।” পদে পদে পুলিশি উপদ্রবের ভয়ে সে পথে কেউ যেতে চায় না। তাই অনেক উপরোধ অনুরোধ করে গগন ঘোষকে রাজি করাতে হয় গোরুর গাড়ি নিয়ে খানিক পথ এগিয়ে দিতে। ছোটোবকুলপুরের অতি শোচনীয় অবস্থার কথা পথেই শুনেছিল দিবাকর-আন্না। শুনেছিল, “প্রচণ্ড আঘাতে গাঁয়ের গেরস্থ জীবন তছনছ চুরমার হয়ে গেছে।” কিন্তু গগনের মুখে শোনে, “ব্যাপার ঠিক তা নয়। গোড়ায় গাঁয়ের মধ্যে খুব খানিকটা অত্যাচার হয়েছিল, কিন্তু তারপর গাঁয়ের লোক এমন আঁটসাঁট বেঁধে তৈরি হয়ে জেঁকে বসেছে যে চৌধুরী বা ঘোষদের কোনো লোক অন্তত দু-ডজন রাইফেল ছাড়া গাঁয়ের ভেতরে ঢুকতেই সাহস পায় না।” এত অন্ধকারের মধ্যও গগনের উচ্চারণে ফুটে বেরোয় আশার আলো! সত্যিই যেন যুগ বদলের ইঙ্গিত উপলব্ধি করা যায়।
মার্কসীয় আদর্শে দীক্ষিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বাস করতেন এই শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের হাত ধরেই সূচনা হবে নতুন যুগের। স্বপ্নের ছায়াছবিতে এতকাল মশগুল হয়েছিল যাদের চেতনা, তাদেরই যে দুর্দিন আসছে এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন কমিউনিস্টরা। উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত তেভাগা আন্দোলনের উত্তাপে সকলেই টের পেয়েছে জাগবার দিন সত্যিই চুপি চুপি এসে পৌঁছেছে। তবু স্বপ্নের ইমারতটিকে অক্ষত রাখার অনিঃশেষ প্রয়াসে জমিদার-জোতদাররা মরিয়া হয়ে লেলিয়ে দিয়েছে পুলিশ আর পোষা লেঠেল বাহিনি। কিন্তু দিনকাল বদলেছে। হাওড়ার ঘনশ্যাম-বেটেনট কারখানার সামান্য মজুর দিবাকরও বুঝতে পেরেছে যে ধর্মঘটে তারা শামিল হয়েছে তা দু-দশ দিনে মেটার নয়। বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েও ছোটোবকুলপুরের বিদ্রোহী জনতাকে বাগে আনা যায়নি। তেভাগার ব্যাপকতা প্রভাবিত করেছে শ্রমজীবীদের। সম্মিলিত জনতার সংগত দাবি থেকে সর্বস্তরেই গৃহীত হয়েছে প্রতিরোধ সংকল্প।
আন্দোলনের আবহাওয়ায় ছোটোবকুলপুরে যাওয়ার জন্য দুটি মানুষের আচমকা আগমনে প্রশাসন রীতিমতো বিব্রত হয়েছে। দিবাকরের নিরুদ্বেগ আচরণে বিভ্রান্ত হয়েছে বন্দুক বাগিয়ে বসে থাকা পাহারাদাররা। তাছাড়া চারদিকে বিস্তর বন্দুক-রাইফেলের সমারোহ দেখেও ভড়কে না যাওয়াটা, দিবাকরের ‘দিব্যি নির্ভয় নিশ্চিন্ত ভাব’-টা চিন্তায় ফেলেছে তাদের। গভীর সমাজতাত্ত্বিক প্রজ্ঞা নিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আলোচ্য গল্পে স্পষ্ট করেছেন কালচারাল হেজেমনিক পরিবর্তনটি। দেখিয়েছেন উচ্চবর্গের আধিপত্যের দুর্গটি ক্রমেই টলছে, সার্বিক সামাজিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে পাতিবুর্জোয়া। সাবলটার্ন শ্রেণির প্রতিরোধ ক্ষমতাশীল সম্প্রদায়কে বিপদে ফেলতে সক্ষম হচ্ছে।
বহমান কাল ধরে বানিয়ে তোলা শাসনতন্ত্রের বাঁধা ছকে দিবাকরকে মিসফিট মনে হয়েছে। স্পষ্টবাদী দিবাকরের কথায় তার যে প্রতিবাদী মানসিকতা প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে তাদেরকে ‘সত্যিকারের নিরীহ, সাধারণ, গোবেচারী চাষামজুর, মাগভাতার’ বলে মানতে অসুবিধে হয়েছে বেনিয়াতন্ত্রের পোষ্যদের। তিল তিল করে জমে ওঠা সন্দেহ থেকে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালিয়েও সন্দেহজনক কিছু মেলেনি আগন্তুক মানুষ দুটির কাছ থেকে। তবে দিবাকরের শার্টের পকেট থেকে পাওয়া পানের মোড়কটি যেন শাসকের কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউরেকা! চুন আর পানের রসে মাখামাখি দোমড়ানো মোচড়ানো মোড়কটা আসলে ‘ছোটোবকুলপুরের সংগ্রামী বীরদের প্রতি’ উৎসর্গীকৃত একটি ‘বিপজ্জনক ইশতেহার’! আবিষ্কারের আনন্দে, উত্তেজনায় আপাতত স্বস্তি মিলেছে। “আর শূন্যে হাতড়াতে হবে না, মনগড়া সন্দেহ সংশয়ে জর্জরিত হতে হবে না, একেবারে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে হাতের মুঠোয়। এবার ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাবে।” শাসকের এই আত্মবিশ্বাস কি সত্যি বজায় থাকবে! দিবাকর-আন্নার আসন্ন আগামী তলিয়ে যাবে আরও গাঢ় অন্ধকারে! থেমে যাবে বিপ্লব? কী হবে সম্ভাব্য পরিণাম! হাজারো জিজ্ঞাসা আর বিস্ময়ে পাঠককে উত্তর খুঁজে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে গল্প শেষ করে দেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুনির্দিষ্ট কোনও সিদ্ধান্তে গল্পের পরিণতি নির্দিষ্ট করে দেন না তিনি। তাই তেভাগার প্রেক্ষিতে লেখা তাঁর কোনও গল্পই পার্টির প্যামফলেট হয়ে দাঁড়ায় না।
সাম্প্রতিককালে সাবলটার্ন সাহিত্য বিচারের কোনও কোনও মাপকাঠিতে অবশ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বহিরাগত’। শিল্পের মহৎ বিশ্বাসযোগ্যতাকে স্বার্থের বাস্তবতা অথবা রাজনীতির সীমাবদ্ধতা দিয়ে সংকুচিত করার চেষ্টা শেষ বিচারে শাস্তিযোগ্য সাংস্কৃতিক অপরাধ। তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে লেখা এই গল্পগুলির মার্জিত পরিসর, কাহিনি ও চরিত্রের গভীর রসায়ন আমাদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। সর্বোপরি ময়নার মা, ভুবন মন্ডল, জগমোহন, আন্না, দিবাকরের মতো চরিত্র সৃজনের ক্ষেত্রে অথবা তাদের সংগ্রামকে সম্মান জানানোর প্রশ্নে লেখকের নন-সাবলটার্ন ব্যক্তি পরিচয় কোথাও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি। মনে প্রাণে মার্কসবাদী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেতনায় তেভাগা আন্দোলন নিশ্চিতভাবেই খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়ে ছিল। কিন্তু সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিস্পৃহ উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গি সেই আন্দোলনের উত্তাপ আর প্রতিরোধ সংকল্পকে সাহিত্যের প্রেক্ষিত হিসাবে ব্যবহার করেছে মাত্র। শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের চিরন্তন জীবন সংগ্রামের কাহিনিই তাঁর গল্পে মুখ্য হয়ে উঠেছে।