সনুপ খাঁ
ইতিহাস ইতিহাসই, তাকে কাল্পনিক বলা চলে না। যখনই তাতে কল্পনার ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে, তখন থেকে তা আর ইতিহাস হয়ে থাকতে পারেনি, হয়েছে সাহিত্যের অংশ। সেখানে ঐতিহাসিক চরিত্রের সঙ্গে লেখকের কল্পনায় আঁকা চরিত্রগুলি হয়ে উঠেছে সক্রিয়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের রচনার মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা গেছে। ইতিহাস ও কল্পনার সংমিশ্রণে তাঁদের উপন্যাসগুলি কখনও হয়ে উঠেছে ঐতিহাসিক উপন্যাস, কখনওবা ঐতিহাসিক রোমান্স। অথবা সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক উপন্যাসের মধ্যে দেখা গেছে কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র ও ঐতিহাসিক আবহ তৈরির চেষ্টা। বাংলার ইতিহাসের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল— রাজা, রাজ্যশাসন, যুদ্ধ ও প্রজাবিদ্রোহ। আমার আলোচনা এগুলির কোনওটিকেই বাদ দিয়ে নয়। এ প্রসঙ্গে পাল আমল তথা একাদশ থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া কৈবর্ত বিদ্রোহ, কৈবর্তদের উত্থান ও পতনের কাহিনি নিয়ে রচিত ‘মোহনা’ উপন্যাসটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
রাধাগোবিন্দ বসাকের ‘গৌড়কবি-সন্ধ্যাকরনন্দী-বিরচিত রামচরিত (বাঙ্গালা সংস্করণ)’, রমেশচন্দ্র মজুমদারের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব)’ রজনীকান্ত চক্রবর্তীর ‘গৌড়ের ইতিহাস’ (১ম খণ্ড) ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে জানা যায় বাংলাদেশের প্রথম সফল অন্ত্যজ শ্রেণির বিদ্রোহ হল ‘কৈবর্ত বিদ্রোহ’। এই বিদ্রোহের সত্যতার বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ গ্রন্থ ছাড়া এই বিষয়ে প্রামাণিক কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। যেটুকু যা পাওয়া যায়, তা পাল রাজন্যবর্গদের রচনার মধ্যেই পাওয়া যায়। যেমন— কুমারপালের মন্ত্রী বৈদ্যদেব রচিত ‘কামাউলিপট্ট’, মদনপাল বিরচিত ‘মানাউলিপট্ট’ ও ভোজবর্মের ‘বেলবাপট্ট’। কিন্তু গ্রন্থগুলির রচয়িতারা যেহেতু কৈবর্ত বিরোধী, তাই তাঁদের রচনার ষোলআনা সত্যতা নিয়ে প্রবল সংশয় হয় বৈকি। তবে দিব্যক, রুদক, ভীম, দ্বিতীয় মহীপাল, রামপাল প্রমুখের কথা ইতিহাস যেভাবেই বলুক না কেন, বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকরা তার দেহকে কাল্পনিক মোড়কে মুড়িয়ে দিতে কসুর করলেন না। একে একে রচিত হল— অনুরূপা দেবীর ‘ত্রিবেণী’, সত্যেন সেনের ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘কৈবর্ত খণ্ড’ হরিশংকর জলদাসের ‘মোহনা’, জাকির তালুকদারের ‘পিতৃগণ’, অমরজ্যোতি মুখোপাধ্যায়ের ‘সেদিন বরেন্দ্রভূমিতে রক্তক্ষয়ী কৈবর্ত বিদ্রোহ’ ইত্যাদি উপন্যাস।
বাংলা কথাসাহিত্যে অন্ত্যজ শ্রেণির রূপকার হিসাবে একাধিক ঔপন্যাসিকের নাম করা যায়। যেমন— তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, হরিশংকর জলদাস প্রমুখ। আমার আলোচ্য নিবন্ধের মুখ্য বিষয় হরিশংকর জলদাসের ‘মোহনা’ উপন্যাসে আঁকা অন্ত্যজ শ্রেণির ইতিহাস অন্বেষণ। ঔপন্যাসিক অন্ত্যজ শ্রেণি হিসেবে কৈবর্ত জনগোষ্ঠীকে বেছে নিয়েছেন এ-উপন্যাসে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন যে, পাল রাজন্যবর্গদের দ্বারা রচিত কৈবর্তদের বিদ্রোহ বা কৈবর্তদের তৎকালীন কার্যকলাপের, কিংবা পাল রাজাদের কাহিনি যেমন সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য নয়, তেমনই হরিশংকর জলদাস, যিনি কৈবর্ত জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, তাঁর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত ‘মোহনা’ উপন্যাসের ঐতিহাসিক সত্যতা বিষয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই পক্ষপাতিত্ব থাকবেই। এ ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব বাদ দিয়ে মূল উপন্যাসের প্রতিই আমাদের দৃষ্টি দিতে হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণিকে প্রতিষ্ঠা দিতে যেমন সত্যেন সেন, মহাশ্বেতা দেবী, জাকির তালুকদার প্রমুখেরা ইতিহাসের ঘটনাকে আশ্রয় করে কৈবর্তদের জয়গান গেয়েছেন, হরিশংকর জলদাসও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে ‘মোহনা’র লেখক যেহেতু নিজেও কৈবর্ত জাতির মানুষ, তাই তাঁর দিব্যক, রুদক, ভীম তথা কৈবর্ত জনজাতির প্রতি কিছু বেশি আবেগ প্রকাশিত হয়েছে। যেমন— ঔপন্যাসিক দিব্যকের সাতাশ বছরের রাজত্ব এবং দিব্যকের উত্থানের কথা, ভীমের পরাক্রম, ভীমের কীর্তি ইত্যাদির কথা বার বার আওরেছেন। কখনও কখনও চণ্ডকের মধ্যে দিয়ে যেন নিজের মনের অভিব্যক্তিই প্রকাশ করেছেন। যেমন— কৃতঘ্ন চণ্ডকের আদেশে যখন বদ্ধভূমিতে ভীম, তাঁর পরিবার ও রাজন্যবর্গের মুণ্ডচ্ছেদ হচ্ছিল, তখন ‘সমবেত কৈবর্ত জনজাতি একত্র হয়ে পাল সৈন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে না পড়ে’, এই আশঙ্কা জেগেছিল চণ্ডকের মনে। কিন্তু সমবেত কৈবর্ত জনতা কেবল— ‘জয়, বরেন্দ্রি সূর্য ভীমের জয়’ এই জয়ধ্বনি দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছিল। লেখকের মধ্যে থেকে তখন বেরিয়ে আসে কৈবর্ত রক্তের প্রবল আক্ষেপ—
আরে ব্যাটারা, কিসের জয়, কার জয়? যার জয় চাইছিস, সে তো এক পল পরে খড়েগর নিচে মাথা দিতে বাধ্য হবে।১
রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ গ্রন্থে সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিতম্’ কাব্যের বর্ণনা অনুযায়ী দিব্যককে ‘দস্যু’ বলে স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে—
রামচরিতে দিব্যককে দস্যু ও ‘উপধিব্রতী’ বলা হইয়াছে। টীকাকার উপধিব্রতীর অর্থ করিয়াছেন ‘ছদ্মনিব্রতী’। কেহ কেহ ইহা হইতে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে দিব্য কর্ত্তব্যবশে বিদ্রোহী সাজিয়া মহীপালকে হত্যা করিয়াছিলেন। কিন্তু এরূপ অর্থ সঙ্গত মনে হয় না। দস্যু ও উপধিব্রতী হইতে ইহাই মনে হয় যে রামচরিতকারের মতে দিব্য প্রকৃতই দস্যু ছিলেন, কিন্তু দেশহিতের ভান করিয়া রাজাকে হত্যা করিয়াছিলেন।২
উপন্যাসে দেখা গেল— রামপাল, শূরপাল ও দিব্যক দ্বিতীয় মহীপালকে বড়ো কোনও যুদ্ধে লিপ্ত হতে নিষেধ করছেন, কারণ রাজকোষে সংকট রয়েছে এবং সৈন্যসংখ্যাও কম ও অপ্রশিক্ষিত। কিন্তু তাঁকে যুদ্ধে বিরত করবার কারণ স্বরূপ— ‘নিজের ভাইদের সঙ্গে দিব্যকের মিলিত চক্রান্ত’ এমন সন্দেহ প্রকাশ করে শূরপাল ও রামপালকে কারাগারে নিক্ষেপ করছেন সম্রাট দ্বিতীয় মহীপাল। একইসঙ্গে দিব্যককে দমন করতে তাঁর বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করছেন। উপন্যাসে দিব্যক সম্পর্কে যে কতকগুলি বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি বিশেষণ হল— দিব্যক পাল সাম্রাজ্যের হিতকরী এবং তিনি দূরদর্শী ও বুদ্ধিমান। এই কারণেই আত্মরক্ষার্থে কৈবর্ত সেনাদের প্রস্তুত করেন এবং যুদ্ধে দ্বিতীয় মহীপালকে পরাজিত করেন ও নিহত করেন।
ইতিহাস একেই বলল ‘হত্যা করা’, সন্ধ্যাকর নন্দী বললেন— ‘অনীকম্ ধর্মবিপ্লবম’, আবার—
অস্য সীতাবাস-অলংকৃতিঃ কান্তা জনকভূঃ, দিব্ব্যাহ্বয়েন মা-অসংভুজা উচ্চৈঃ দশকেন উপধিব্রতা দস্যুনা অহারি।।৩
অর্থাৎ,
লাঙ্গল-পদ্ধতি ও বসতিদ্বারা অলংকৃতা (অর্থাৎ কৃশিজাত ও বসতিবহুলা) রমণীয়া তাঁহার (রামপালের) পৈতৃকভূমি বা জন্মভূমি (বরেন্দ্রী), দিব্য বা দিব্বোক-নামক রাজলক্ষ্মীভাক (রাজকর্ম্মচারী) অত্যুন্নত-দশাবস্থিত ছলব্রতধারী শত্রুদ্বারা গৃহীত হইয়াছিল।৪
উপন্যাসে রামপালের মামা মথনদেব এ বিষয়ে দিব্যককে দায়ী করতে চান না। দিব্যক যে পাল রাজকর্মচারী ছিলেন এবং কৈবর্ত প্রদেশের সামন্ত রাজা ছিলেন তা সন্ধ্যাকর নন্দীতে এবং হরিশংকর জলদাসসহ কৈবর্ত বিদ্রোহমূলক অন্যান্য আখ্যানেও দেখা গেছে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই দেখা গেছে দিব্যক প্রথমে পাল সাম্রাজ্যের হিতকরী চিন্তকই ছিলেন এবং শূরপাল ও রামপালের কারাগারজীবনের মুক্তিতে দিব্যকের হাত ছিল। তবে এখানে মথনদেবের একটি উক্তি স্বয়ং মথনদেবের না হয়ে স্বয়ং লেখকের মনগড়া কথা বলে মনে হয়েছে, এবং হওয়ার কারণ হল— লেখক নিজের জনগোষ্ঠীর প্রশংসা করতে কোথাও কার্পণ্য করেননি। রামপাল দিব্যককে বারবার আক্রমণ করলেন, দ্বিতীয় মহীপালের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে দিব্যকসহ কৈবর্তদের নিঃশেষ করে দিতে চাইলেন এবং পরে ভীমসহ ডমরনগর নিধনের মন্ত্রণা করলে মথনদেব যা বললেন তা নিম্নরূপ।—
ভাগিনেয়, তুমি ভুল বলছ, এক অর্থে এই কৈবর্তরা তোমার শত্রু নয়। কৈবর্তরাজ দিব্যোক তোমার ভাইকে হত্যা না করলে তুমি কোথায় থাকতে? অন্ধকার কারাগারে অথবা পরলোকে। তার কল্যাণেই তুমি পাল রাজা হতে পেরেছ। সেই অর্থে তুমি কৃতঘ্ন। যে দিব্যোক তোমার উপকার করেছে, তার বংশ নিপাত করার জন্য তুমি আজ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছ।৫
কৈবর্ত বিদ্রোহের কাহিনির নির্মাতারা সকলেই কৈবর্তদের কমবেশি প্রশংসা করেছেন এ কথা সত্য, এবং একটা পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীর উত্থান সত্যিই প্রশংসনীয়। যদি ‘মোহনা’ উপন্যাসের কাহিনির গভীরে গিয়ে ভীমের নেওয়া পদক্ষেপগুলি পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে এই প্রশংসার কারণগুলি নির্বাচন করা সম্ভব হবে।
উপন্যাসের ঘটনা বর্ণনার মধ্যে কল্পনার ঘনঘটা থাকলেও, চরিত্র, স্থান ইত্যাদি এগুলির সত্যতা রয়েছে। সেইসঙ্গে সহজ সরল কৈবর্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিভূ হিসাবে ভীমের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপগুলির মধ্যে মানবতার ছবিও ধরা পড়েছে। যেমন— বৌদ্ধ সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিতা কৌশিল্যার অসহায় সন্তান চণ্ডককে নিজের সন্তান পরিচয় দিয়ে মানুষ করা, নিজের বড়ো সন্তান শর্বদেবের বিয়ের প্রসঙ্গ উঠতে চণ্ডকের বিয়ে দেবার ভাবনার মধ্যে দিয়ে একজন দায়িত্বশীল এবং নিজের সন্তান ও চণ্ডকের প্রতি নিরপেক্ষ মানসিকতার পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। একইসঙ্গে ঔপন্যাসিকের বর্ণনায় রামপালের সঙ্গে যুদ্ধ প্রস্তুতিতে ভীমের বিচক্ষণতা, প্রধান সেনাপতি কঙ্কনদেব ও অন্যান্যদের সঙ্গে বারবার আলচনাসভায় বসা, চণ্ডকের প্রতি বিরক্ত হয়েও তার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া, সবকিছুর মধ্যে ভীমের রাজনৈতিক বুদ্ধি প্রশংসিত হয়েছে, একথা বলতেই হয়। মথনদেবের মুখ থেকে শোনা ভীমের শাসনকালের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের বিষয়গুলিও প্রশংসার যোগ্য। যেমন— প্রজাকল্যাণ, গ্রামে গ্রামে শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা, সে মন্দিরে সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, জলাশয় খনন, সড়ক নির্মাণ ইত্যাদি—
আজ ভীমের সুশাসনে হালিক-জালিকরা, মাঝি-মাল্লারা, তন্তুবায়-কর্মকাররা, কংস্যকার-সূত্রধাররা বরেন্দ্রভূমিতে অসীম সুখে জীবন যাপন করছে।৬
সেইসঙ্গে প্রজাদের সম্পর্কেও রামপালের মামা মথনদেব বললেন—
প্রাণের চেয়ে কৈবর্তদের কাছে স্বাধীনতার মর্যাদা অনেক বড়ো।৭
‘মোহনা’ উপন্যাসের বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে চণ্ডকের কৃতঘ্ন রক্তকে দেখানো হলেও, সেইসঙ্গে আরও একটি বিষয় এখানে নজর কাড়ে, তা হল কৈবর্ত বারাঙ্গনাদের ছবি। উপন্যাসের নামকরণও এক বারাঙ্গনার নামেই। বারাঙ্গনাপল্লির জীবনযাপন সম্পর্কে ঔপন্যাসিক তাঁর ‘কসবি’ উপন্যাসে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন, কিন্তু ‘মোহনা’ উপন্যাসে বারাঙ্গনাদের উপস্থিতি কিছু বিশেষ প্রয়োজন সিদ্ধ করবার জন্য বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। কারণ, ঔপন্যাসিক বৌদ্ধযুগে অম্বপালি নগরকন্যা, বারাণসীর বারাঙ্গনা শ্যামা, বাসবদত্তা, রাজগৃহের গণিকা শালবতী প্রমুখের উল্লেখ করে বলেছেন নগরে বারাঙ্গনার অবস্থান বাঞ্ছনীয়। এদিক থেকে কৈবর্ত রাজধানী ডমরনগরে বারাঙ্গনা পল্লীর উপস্থিতি যেমন স্বাভাবিক তেমন বাঞ্ছনীয়। বাঞ্ছনীয় এই কারণে যে, মানুষের জৈবিক বৃত্তির এক বিকল্প স্থান এই পল্লি। দ্বিতীয়ত, ‘মোহনা’ উপন্যাসের নামকরণের সঙ্গে মোহনা চরিত্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ, কৃতঘ্ন চণ্ডকের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য এক গণিকা রমণীর হাতকে বেছে নেওয়াই যেন ঔপন্যাসিকের অভিপ্রায় ছিল।
চণ্ডক চরিত্রটিকে ঔপন্যাসিক বলা যায় একপ্রকার চতুরতার সঙ্গেই এঁকেছেন। প্রথমত, চণ্ডকের শরীরে কৈবর্ত রক্ত নেই, দ্বিতীয়ত, ভীমের রাজ্যে রাজন্যবর্গদের বারাঙ্গনাবিলাস নিষিদ্ধ ছিল, তৃতীয়ত, ভীমের নিজের তিন ছেলে, যাদের রক্তে কৈবর্ত রক্ত প্রবাহিত, তারা কখনও বারাঙ্গনা পাড়ায় যায়নি, চতুর্থত, ভীমের পারিষদবর্গের কেউ বারাঙ্গনা পাড়ায় যায়নি, পঞ্চমত, চণ্ডকের গণিকা বিলাসের সংবাদ ভীম জানা সত্তেও তাকে আটকায়নি। তার পারিষদবর্গ ও বড় ছেলে শর্বদেব চণ্ডককে গণিকা বিলাস নিয়ে অপমান করলেও ভীম চণ্ডককে বিশেষভাবে নিষেধ করেননি। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, চণ্ডকের শরীরের পাল রক্তের সঙ্গে ঔপন্যাসিক যেন কৈবর্ত রক্তকে পৃথক করে দেখেছেন এবং চণ্ডককে নিকৃষ্ট করে দেখাতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে এরকম ভাবনাও মনে জেগে ওঠে— ক্ষমতার লোভে জীবনদাতা, প্রীতিপালক ও স্নেহাস্পদের সঙ্গে পাল রক্তই বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। নইলে বৌদ্ধ সৈন্যরা কেবল কৌশিল্যাকেই ধর্ষণ করেনি, করেছিল আরও অনেক কৈবর্ত নারীকে। তাদের মধ্যে থেকে আরও কারও কারও চণ্ডকের মতো সন্তানের জন্ম হয়েছিল, কিন্তু সেসব লেখক উল্লেখ করেননি, নিতান্ত কৃতঘ্ন পাল রক্তকে প্রকট করতেই যেন চণ্ডক কাহিনির অবতারণা। পাল রক্ত কৃতঘ্ন কারণ, মথনদেবও রামপালের দ্বারা— তাঁর কারাগার মুক্তির প্রধান সহায়ক দিব্যককে আক্রমণ, তাঁর কৃতঘ্নতার পরিচয় বলেই রামপালকে জানিয়েছেন। কিন্তু তবুও রামপাল আক্রমণ থেকে ক্ষান্ত হননি। প্রবল জাতিবিদ্বেষ এবং তথাকথিত নিম্নজাতির প্রতি ঘৃণাপ্রসূত মনোভাবের পরিচয় এখানে পাওয়া যায়। ক্রমে ক্রমে চণ্ডকের মুখ থেকেও একই কথা শুনতে পাই আমরা। ভীম হত্যার পরে মোহনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জেলে রমণী মোহনার সামনেই কৈবর্তদের সম্পর্কে চণ্ডক যে অপমানজনক কথাগুলি বলেছে তা এখানে উল্লেখ করা হল—
সমস্ত জীবনটাই কেটে গেল কৈবর্তদের দাসত্ব করতে করতে। কৈবর্তরা নীচ জাত। এই হীন জাতটার সামান্য সমরনায়ক ছিলাম আমি।৮
এর পরেই কৈবর্ত নারী মোহনার চণ্ডী মূর্তি চণ্ডক বধে অগ্রসর হয় এবং বধ করে।
আলোচ্য উপন্যাসে গণিকাদের জীবনের একটি নিয়মিত রুটিনের উল্লেখ করেছেন। কানা, খোঁড়া, চোর, ডাকাত ইত্যাদি বিভিন্ন মানুষকে টাকার বিনিময়ে নিয়মিত দেহ দানের মধ্যে দিয়েই তাদের জীবন অতিবাহিত হয়। বলা ভালো— প্রকাশ্যে গণিকাদের ঘৃণার চোখেই দেখা হয় অথচ অপ্রকাশ্যে তাদেরই দোরে টোকা মারতে হয় মানুষকে দেহতৃষ্ণা মেটাবার জন্য। হরিশংকর জলদাস দেখালেন, কৈবর্ত গণিকাদের এবং তাদের গণিকাবৃত্তির আগের জীবনকেও। মোহনা দরিদ্র জেলে কন্যা, কিন্তু শরীর দানে অক্ষম সনকা তাকে চুরি করে বারাঙ্গনা পল্লীতে নিয়ে আসে। এরকম কারও স্বামী মদ খেয়ে মাতাল হয়ে মারা গেছে, তাই পেট চালানোর জন্য গণিকাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য রমণীকেও দেখা যায় ডমরনগরের বারাঙ্গনা পল্লীতে। কৈবর্ত নারীদের এ এক বিচিত্র জীবন সংগ্রামের ছবি দেখালেন ঔপন্যাসিক। গণিকাবৃত্তি গ্রহণের এক বিচিত্র প্রথার কথাও এখানে দেখা গেল। কুমারী মেয়ে রজঃস্বলা হওয়ার পরেই নাপিতানি ডেকে নখ খুটে দেওয়া, দৈহিক সাজসজ্জায় সজিত করে বঁটি বা গাছের সঙ্গে বিয়ের দেওয়ার এক বিচিত্র লোক প্রথা ডমরনগরের নিকটবর্তী বারাঙ্গনাপল্লিতে দেখা গেল। ঔপন্যাসিকের বর্ণনায় তাদের লোকভাবনা হল— বঁটি লোহার তৈরি তাই তা অক্ষয়, গাছের ফল থেকে বীজ পড়ে নতুন গাছ হয় তাই গাছও চিরায়ুষ্মতী, তেমনই গণিকারাও চিরায়ুষ্মতী, তাদের শেষ নেই। কারণ, এক গণিকা বৃদ্ধা হলে সে নিযুক্ত হয় নতুন মেয়ের সন্ধানের কাজে। এইভাবে ক্রমপরম্পরায় পুরুষের দেহক্ষুধার সার জাগিয়ে চলে গণিকারা। তাই তাদের বিয়ে দেওয়া হয় বঁটি কিংবা গাছের সঙ্গে।
ঔপন্যাসিক এই সংগ্রামী নারীদের মধ্যে থেকে দৈহিক কলঙ্কের রেখাটুকু স্পষ্ট করলেও তাদের মধ্যে স্বাজাত্যবোধটুকু কেড়ে নেননি। কৈবর্তরাজ ভীমের প্রতি তাদের আন্তরিক শ্রদ্ধার কথাও ঔপন্যাসিক জানিয়েছেন। তাই পাল সম্রাটের সঙ্গে চক্রান্তে লিপ্ত চণ্ডকের প্রতি জটিলা, কুন্তি প্রমুখ কেবল ঘৃণার মনোভাব পোষণ করে। এ প্রসঙ্গে কুন্তীর সংলাপটি উল্লেখ্য—
মূর্খ তুই। বিশ্বাসঘাতককে শরীর দিবি তুই?৯
বিজয়ী রামপালের রাজ্যে কৈবর্ত গণিকাদের নিরাপত্তার অভাব তারা নিজেরাই বুঝতে পেরে বারাঙ্গনা পল্লি ছেড়ে পালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু মোহনা যেতে চায় না। ঔপন্যাসিক এখানে মোহনার মধ্যে রহস্যসুলভ বৈশিষ্ট্য দিতে চেয়েছেন। মোহনা চণ্ডকের পরম আদরের। তাই মোহনার স্বজাতীয়ের সঙ্গে চরম বেইমানির কারণে ঔপন্যাসিক মোহনার হাত দিয়েই চণ্ডকের নিধন এবং বিশ্বাসঘতকতার চরম শাস্তি দেওয়ালেন। কৈবর্ত বারনারীদের দেহ কলুষিত হলেও তাদের অন্তরাত্মাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে চাইলেন যেন ঔপন্যাসিক। এখানেই ‘মোহনা’ হয়ে ওঠে এক প্রতিবাদী কৈবর্ত নারীসত্তা, যে কি না পেশায় দেহজীবী।
উপন্যাসে ইতিহাস যতটুকু রয়েছে, তা থেকে ঔপন্যাসিক সম্পূর্ণ বেরিয়ে যাননি। তিনি তুলে ধরেছেন পাল সম্রাট ধর্মপাল, বিগ্রহপাল, ন্যায়পাল প্রমুখের শাসনকালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। কলচুরিরাজ লক্ষ্মীকর্ণের সঙ্গে ন্যায়পালের তিক্ত সম্পর্কের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ উপন্যাসেও এই দুই রাজার মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ককে প্রকট হয়ে উঠতে দেখা গেছে। কিন্তু বর্ণনা যেখানে ইতিহাসকে ছাড়িয়ে বাস্তবের মাটিতে এসে উপস্থিত হয়েছে, সেখানে এসেছে ঔপন্যাসিকের কাল্পনিক যুদ্ধ বর্ণনার গল্প। বিচক্ষণ ভীমের বিচক্ষণতার প্রমাণ স্বরূপ তাঁর নৌযুদ্ধের পরিকল্পনা, যুদ্ধ ভূমিতে সশস্ত্র পরাক্রম, বদ্ধভূমিতে আত্মীয়পরিজনের মৃত্যুতে ভীমের স্থৈর্যতা, সবকিছুর মধ্যেই কৈবর্তরাজের প্রতি ঔপন্যাসিকের গভীর স্নেহের ছাপ দেখা যায় যেন। সেইসঙ্গে মহাভারতের সত্যবতী উপাখ্যানের বর্ণনায় পরাশরের মতো সাধু মুনির প্রতি ভণ্ডামির কটাক্ষও বর্ষিত হয়েছে। সত্যবতী দেহ দিতে না চাইলে পরাশরের অভিশাপ দেওয়ার কথা উল্লেখ করে, সমাজের ক্ষমতাধর ও তথাকথিত উচ্চবিত্ত মানুষদের শোষক রূপে চিহ্নিত করতেও লেখক ছাড়েননি। উপন্যাসের দৃষ্টিতে সত্যবতী অসহায়।
আলোচনার শেষাংশে এসে বলা যায়, সত্যেন সেনের উপন্যাসে কৈবর্তরা বিদ্রোহী, কিন্তু এখানে যেন রামপাল বিদ্রোহী। দিব্যক এখানে সৈন্যদের প্রস্তুত রেখেছিলেন মাত্র, দ্বিতীয় মহীপাল ব্যুহে প্রবেশ করে বেঘোরে প্রাণ দিলেন। কিন্তু ‘বিদ্রোহী কৈবর্তে’ দেখা গেল কৈবর্তরা আক্রমণ করে অপ্রস্তুত দ্বিতীয় মহীপালকে। আবার অনুরূপা দেবী বললেন, দ্বিতীয় মহীপাল দিব্যকের হাতে নয়, ভীমের হাতে নিহত হয়েছেন। চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রেও অসঙ্গতি দেখা যায়। ‘ত্রিবেণী’তে ভীমের স্ত্রী উজ্জ্বলা, হরিশংকর জলদাসে ভীমের স্ত্রী ‘দেবলা’। মোটের ওপর বলা যায়, হরিশংকর জলদাসের ‘মোহনা’ উপন্যাসে রামপালের ভীম প্রদেশ আক্রমণ কৈবর্তদের দিক থেকে অনৈতিক কিন্তু রামপাল ও তথাকথিত উচ্চবিত্তদের দিক থেকে একেবারে উপযুক্ত। তবে ইতিহাসের তথ্যকে নির্ভর করলে বলতে হয়— যেহেতু দিব্যক, রুদক ও ভীমের শাসনকালে বরেন্দ্রিতে সুশাসন বজায় ছিল, সেহেতু রামপালের ভীমপ্রদেশ আক্রমণ এবং ভীম হত্যা অনৈতিক। কারণ, শুধুমাত্র পারিবারিক বা ধার্মিক বা জাতীয় আভিজাত্যের অহংকারে সুশাসন নষ্ট করা কোনও গর্হিত কাজ নয়। এই অভিমত হরিশংকর জলদাসের ‘মোহনা’ উপন্যাসে বর্ণিত রামপালের চরিত্র বৈশিষ্ট্যের নিরিখে। এসব দিক বিচার করে ‘মোহনা’ উপন্যাসে কৈবর্ত সূর্য ভীমের মৃত্যু হলেও বলতে হয়— ঔপন্যাসিক ‘মোহনা’র মধ্যে দিয়ে যেন বুঝিয়ে দিলেন, চক্রান্তের জালে পড়ে একটা জনগোষ্ঠীর একজন বা কয়েকজন মানুষের দেহবিনাশ হলেও সমগ্র জাতিটির মধ্যে প্রতিবাদী সত্তা ও প্রতিশোধ প্রবৃত্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় না। বঁটি দিয়ে চণ্ডকের মাথায় আঘাত করার সময় তাই ‘মোহনা’কে দিয়ে ঔপন্যাসিক বলালেন—
তোর আসল পুরস্কারটা নিয়ে যা রে চণ্ডক। তোরে এই পুরস্কার দেওয়ার জন্য আমি পালিয়ে যাই নাই। অধীর আগ্রহে তোর জন্য প্রতীক্ষা করছি।১০
সহায়কপঞ্জি:
১) অনুরূপা দেবী। ‘ত্রিবেণী’। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স্।
২) নীহাররঞ্জন রায়। ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব’ (প্রথম খন্ড)। কলিকাতা: পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি। মাঘ, ১৩৫৬।
৩) মহাশ্বেতা দেবী। ‘কৈবর্ত খণ্ড’। ‘মহাশ্বেতা দেবী রচনাসমগ্র’ (একবিংশ খণ্ড)। সম্পা. অজয় গুপ্ত। কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং। ডিসেম্বর ২০১৬, অগ্রহায়ণ ১৪২৩।
৪) রমেশচন্দ্র মজুমদার। ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’। কলকাতা: জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাব্লিশার্স লিমিটেড। প্রথম প্রকাশ, ফাল্গুন ১৩৫২।
৫) রাধাগোবিন্দ বসাক। ‘গৌড়কবি-সন্ধ্যাকরনন্দি-বিরচিত রামচরিত’ (বাঙ্গালা সংস্করণ)। কলকাতা: জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাব্লিশার্স লিমিটেড। ভাদ্র ১৩৬০
৬) সত্যেন সেন। ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’। ঢাকা: খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানি। নভেম্বর ২০১৬।
তথ্যসূত্র:
১) হরিশংকর জলদাস। ‘মোহনা’। ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন। ২০১৩। পৃ.১২৭
২) রমেশচন্দ্র মজুমদার। ‘তৃতীয় পাল সাম্রাজ্য’। ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’। কলকাতা: জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাব্লিশার্স লিমিটেড। প্রথম প্রকাশ, ফাল্গুন ১৩৫২। পৃ.৬২
৩) রাধাগোবিন্দ বসাক। ‘গৌড়কবি-সন্ধ্যাকরনন্দি-বিরচিত রামচরিত’ (বাঙ্গালা সংস্করণ)। কলকাতা: জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাব্লিশার্স লিমিটেড। ভাদ্র ১৩৬০। পৃ.২৯
৪) রাধাগোবিন্দ বসাক। ‘গৌড়কবি-সন্ধ্যাকরনন্দি-বিরচিত রামচরিত’ (বাঙ্গালা সংস্করণ)। কলকাতা: জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাব্লিশার্স লিমিটেড। ভাদ্র ১৩৬০। পৃ.২৯
৫) হরিশংকর জলদাস। ‘মোহনা’। ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন। ২০১৩। পৃ.৫৯
৬) তদেব। পৃ.৬০
৭) তদেব। পৃ.৬০
৮) তদেব। পৃ.১২৮
৯) তদেব। পৃ. ১২৪
১০) তদেব। পৃ.১২৮