প্রান্তিক জনজাগরণের ইতিকথা : সত্যেন সেনের উপন্যাস

নীলাদ্রি নিয়োগী

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মানুষ মূলত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত। শাসক ও শোষিত। দাসসমাজ থেকে শুরু করে সামন্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র— সব ধরনের সমাজ-ব্যবস্থাতেই প্রাগুক্ত দ্বিভাজন পরিলক্ষিত। মেইনস্ট্রিম ইতিহাসে ততটা নয়— নিম্নবর্গের ইতিহাসে চোখ রাখলে এই দুই শ্রেণির মেরুদূর পার্থক্য অনেকগুলি প্রশ্নের জন্ম দেয়। সমাজতত্ত্ব, তৎসহ রাজনীতি; পুঁজি-কেন্দ্রিক কিংবা বিকল্প-অর্থনীতি; নানান ‘ইজম’ ও বৈপ্লবিক অভিঘাত; পৃথকভাবে শাসক ও শোষিত-র বিবিধ বহিরাঙ্গিক পরিবর্তনের মাঝেও বক্ষ্যমান অপরিবর্তনীয় মৌল-চারিত্র্য— সমস্ত অ্যাসপেক্ট থেকেই অসংখ্য প্রশ্নের উদ্ভব হতে পারে। হয়ও। সেইসব প্রশ্ন ইতিহাসবিদ, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, তাত্ত্বিকদের পাশাপাশি শিল্পী ও সাহিত্যিকদেরও তো তাড়িয়ে বেড়ায়। যার যার মতো করে উত্তর খোঁজার প্রয়াসও শুরু হয় বৈকি। সেই অন্তর্গত অনিবার্য তাগিদ-সমূহের ফলশ্রুতিই এই শ্রেণি-বিভক্ত মানব সমাজের ওপর ক্যালাইডোস্কোপিক আলো ফেলে আসছে নিরন্তর।

প্রান্তিক মানুষের ওপর যুগান্তর ধরে হয়ে চলা শোষণ ও নির্যাতন নিয়ে যারা কলম ধরেছেন, তাঁরা সমাজ-সচেতন তো বটেই; তদুপরি রাজনৈতিক ইন্টারভেনশনের দিক থেকে প্রখর অন্তর্দর্শী না হলে সেইসব লেখা— হয় সেন্টিমেন্টাল নয় প্রোপাগান্ডা হয়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। সৌভাগ্যক্রমে বাংলা সাহিত্যে এমন কয়েকজন লেখক রয়েছেন, যারা নিম্নবর্গের যন্ত্রণা, আপাত খণ্ডিত হলেও লোকায়ত জীবন-দর্শন এবং স্থান বিশেষে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের কথা তুলে ধরেছেন যুগপৎ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ঐতিহাসিক নিষ্ঠায়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম সত্যেন সেন। ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করে, রাজনীতির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে, প্রান্তিক জন-জীবনের কথা বারংবার ফুটিয়ে তুলেছেন এই ধ্রুপদী কথাশিল্পী। সেইসব রচনায় নিম্নবর্গের ওপর ঘটে চলা অত্যাচারের সানুপুঙ্খ বিবরণ যেমন উঠে এসেছে, তেমনই তাদের সামুহিক প্রতিবাদ তথা বিক্ষোভ এবং বিপ্লবের ধারাক্রমিক বিবরণীও রয়েছে। ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’ এবং ‘পুরুষমেধ’ এমনই দুটি উপন্যাস। প্রথমটিতে বাংলায় পাল আমলে সংঘটিত কৈবর্ত বিদ্রোহের কথা আর দ্বিতীয়টিতে বৈদিক ভারতের শূদ্র জাগরণের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি।

দুটি উপন্যাসেই কেন্দ্রীয় থিম একটাই। নিম্নবর্গের ওপর রাজতন্ত্রের বাড়তি করের বোঝা চাপানো, ফলকথা, কৃষক শ্রেণির অসন্তোষ এবং সংগঠিত তীব্র প্রতিবাদ। এই বিষয়বস্তু নিয়ে ফিকশন লেখার ক্ষেত্রে একটি সহজলভ্য প্রবণতা লেখকদের মধ্যে লক্ষ করা যেতে পারে, যা ঐতিহাসিকদের মধ্যে ভীষণভাবেই দেখা যায়। ‘ভূমিকা: নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস’ প্রবন্ধে সেই দিকটিই খুব প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মতে—

উচ্চবর্গের ঐতিহাসিকেরা, এমন কি প্রগতিশীল এবং শোষিত শ্রেণীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ঐতিহাসিকেরাও যখন তাঁদের যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার বশবর্তী হয়ে কৃষকচেতনায় উপস্থিত ধর্মবিশ্বাস, অলৌকিকতা, মিথ, দৈবশক্তিতে আস্থা, অলীক কল্পনা প্রকৃতিকে অযৌক্তিক মনে করে উপেক্ষা করেন বা সে-সবের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা খাড়া করে একরাশ মিথ্যার ভেতর থেকে সঠিক ইতিহাসটুকু বের করে আনার চেষ্টা করেন, তখন তাঁরা কৃষকচেতনার বিশিষ্ট উপাদানগুলোকেই আসলে হারিয়ে ফেলেন। হয়তো নিজেদের অগোচরেই তাঁরা নিম্নবর্গের রাজনীতিকে উচ্চবর্গের চেতনার ছকে ফেলে বোধগম্য করার চেষ্টা করেন। নিম্নবর্গের নিজস্ব ইতিহাস, অথবা অন্যভাবে বললে, ইতিহাসে নিম্নবর্গের কীর্তির স্বাক্ষর কিন্তু সেখানে হারিয়ে যায়।

ঐতিহাসিকদের সম্পর্কে এই মূল্যায়ন নিম্নবর্গের জীবনালেখ্য লেখা সাহিত্যিকদের সম্পর্কেও সমান সত্য। তবে এই আশংকা মাথায় রেখেও সত্যেন সেন নিবিড় পাঠে একটা ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টা দেখতে পাওয়া যায়। ‘উচ্চবর্গের চেতনার ছকে’ ফেলে নিম্নবর্গের রাজনীতিকে দেখা এখানেও আছে ঠিকই; এতদসত্ত্বেও নিম্নবর্গের নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং কীর্তির স্বাক্ষর তিনি প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। আসলে যাপনে অন্ত্যজ জীবন-সত্যকে প্রাণপণ বুঝে নিতে চাওয়া, এমনকি ডিক্লাসড হতে পারার স্বভাবজ ক্ষমতা তাঁর লেখনীকে বুদ্ধিবাদী অহং থেকে যথাসম্ভব মুক্ত রেখেছে। সর্বোপরি তাঁদের ধর্মবিশ্বাস, মিথ, অকাল্টের ব্যবহার, লোকায়ত কল্পনা ইত্যাদিকে নিজস্ব চেতনার ছাঁচে ফেলে, তাকে সাবলাইম করে, সমমনস্ক পাঠক-সমালোচকের দীর্ঘস্থায়ী হাততালি কুড়োবার কোনও সংকীর্ণ প্রয়াস তাঁর লেখায় নেই।

‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’ (১৯৬৯) উপন্যাসে দ্বিতীয় মহিপালের আমলে সংঘটিত উত্তরবঙ্গের সামন্ত বিদ্রোহের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এমনিতেই বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের মধ্যে রাজ্য শাসন সংক্রান্ত বিরোধ সেই সময় চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। রাজ পরিবারেও ভাইয়ে ভাইয়ে সদ্ভাব ছিল না। বাইরের রাজ্য থেকে আক্রমণের উল্লেখ তো ইতিহাসেই রয়েছে। এহেন টালমাটাল পরিস্থিতিতে কৈবর্ত নেতা দিব্বোকের নেতৃত্বে সামন্তরা বিদ্রোহ করে এবং দ্বিতীয় মহিপালকে হত্যা করে স্বাধীন বরেন্দ্রভূমি স্থাপন করে। ইতিহাসের এই সূত্রটুকু বিশ্বাসযোগ্যভাবে অন্বিত করে উপন্যাসের আখ্যানভাগ নির্মিত হয়েছে। রাজ-পরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার প্রশ্নে হিন্দু-বৌদ্ধ সংঘাত, উচ্চবর্গের ভেতরকার ষড়যন্ত্র প্রভৃতিকে ছাপিয়ে উপন্যাসের নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে নিম্নবর্গের জীবন সংগ্রাম এবং দিব্বোকের তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক অভিজ্ঞান ও সুশাসনের ইতিবৃত্ত।

পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন। তবে তাঁরা চেদী বা রাষ্ট্রকূটের মতো হিন্দু রাজ্যের রাজকন্যাদের বিবাহ করতেও দ্বিধা করতেন না। শুধু তাই নয়, সেইসব রাজ্যের কূটনৈতিকেরাও এসে রাজসভায় গুরুত্বপূর্ণ আসন দখল করত। রাজা তৃতীয় বিগ্রহপালও প্রথমে চেদী রাজ্যের যৌবনশ্রীদেবীকে বিয়ে করেন এবং সেখানকার আমাত্য বরাহস্বামী এসে ক্রমে গৌড় রাজ্যের প্রধান আমাত্যতে পরিণত হয়। রানীর মৃত্যু হলে তৃতীয় বিগ্রহপাল পুনরায় রাষ্ট্রকূট বংশের কন্যা শঙ্খদেবীকে বিবাহ করেন। প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী এবং বুদ্ধিমতী এই নারী বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই রাজ পরিবারের অন্দরমহলসহ রাজ্যের যাবতীয় হালহকিকত বুঝে ফেলে এবং দুর্বলচিত্ত অযোগ্য রাজাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে বকলমে রাজ্য পরিচালনা করতে থাকে। তার কাছে বহুবার নাকাল হতে হয়েছে বলে বরাহস্বামী তাকে তীব্র অপছন্দ করত। তাই রাজার মৃত্যু হলে যৌবনশ্রীদেবীর সন্তান দ্বিতীয় মহিপালের সিংহাসন প্রাপ্তিতে সহায়তা করে বরাহস্বামী তাকে সম্পূর্ণ নিজের করায়ত্ব করে ফেলে এবং শঙ্খদেবীর সন্তান রামপালকে কারাগারে বন্দী করে। তবে তার এই প্রভাবও নিষ্কণ্টক ছিল না। শঙ্খদেবীর আত্মীয় মথনদেবের প্রবল জনপ্রিয়তা ছিল হিন্দু জনগণের মধ্যে। তার নেতৃত্বে বরাহস্বামী ও দ্বিতীয় মহিপালের বিরুদ্ধ শক্তি ক্রমেই দানা বাঁধছিল। অন্যদিকে রাজা নিজে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও বরাহস্বামীর প্রভাবে হিন্দু উৎসব অনুষ্ঠানে যা খরচ করতেন তার সিকিভাগও বৌদ্ধ বিহারগুলি পেত না। দিন দিন তাদের প্রাপ্য বরাদ্দ কমছিল। উচ্চপদস্থ বৌদ্ধ রাজ-কর্মচারীদের ক্ষমতাও হ্রাস পেয়ে হিন্দুদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তাই রাজা এবং বরাহস্বামীর বিরুদ্ধপক্ষে একদল হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় শ্রেণিই একজোট হয়ে দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি করছিল।

গৌড়ীয় রাজনীতির এই ঘূর্ণাবর্তের বহু দূরে বরেন্দ্রভূমিতে বেড়ে ওঠে আরেক শক্তি। ব্রাহ্মণ ও বৈশ্যদের নানাবিধ অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা কৈবর্তদের মধ্যে বিক্ষোভের আগুন ক্রমশ বাড়ছিল। এককালে কৈবর্তরা ছিল দুর্দান্ত যোদ্ধা জাতি। তারা দীর্ঘকাল গৌড়ের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়েছে। অস্ত্রের দিক থেকে কিছুটা দুর্বল হলেও তাদের সঙ্ঘশক্তি মারাত্মক। গহন অরণ্য ছিল তাদের দুর্ভেদ্য দুর্গ। বারবার পরাজিত হয়েও কৈবর্তরা কখনও ভেঙে পড়েনি। শেষ পর্যন্ত রাজা তৃতীয় বিগ্রহপালের আমলে গৌড়ের সঙ্গে তাদের একটা সন্ধি হয়েছিল, যাতে স্থির হয়— তারা কর দেবে না কিন্তু বহিঃশত্রুর আক্রমণ হলে রাজাকে সৈন্য দিয়ে সহায়তা করবে। দীর্ঘদিন সেই ব্যবস্থা প্রচলিত থাকায় শান্তি শৃঙ্খলাও বজায় ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় মহিপালের আমলে সেই চুক্তি ভঙ্গ করে কৈবর্তদের থেকে পুনরায় শস্যের ছয় ভাগের এক ভাগ কর আদায় করা নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়। রাজপুরুষেরা নানান অত্যাচার অনাচার করায় কৈবর্ত সমাজে ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে। রাজধানীতে রাজা ও অন্যান্য আমাত্যদের কিছুটা অজ্ঞতা ও অনেকাংশেই উপেক্ষা তথা উদাসীনতায় বরেন্দ্রর অরাজক অবস্থা ধীরে ধীরে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়।

এই প্রেক্ষিতে, ইতিহাসের ছায়ায় ভারি যত্নে দিব্বোকের চরিত্রাঙ্কন করেছেন লেখক। বিচক্ষণ, মানবিক ও রাজনৈতিক যুক্তি-যোজনায় পারঙ্গম এই ব্যক্তিত্ব নিবিষ্টচিত্ত নিপুণতায় কৈবর্তদের সংঘবদ্ধ করে দৃঢ়প্রোথিত প্রভুত্বের করালগ্রাস থেকে তাদের মুক্ত করে। পরভু নামের এক যুবক ব্যক্তিগত প্রতিশোধস্পৃহা থেকে দল গঠন করে বরেন্দ্রতে বসবাসকারী কপট ও অত্যাচারী গৌড়ের ব্রাহ্মণ এবং বৈশ্যদের মধ্যে ডাকাতি, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি শুরু করলে দিব্বোক সেই ডায়নামিক ফোর্সকে দ্রুত নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। বলাই বাহুল্য, খুচরো এইসব প্রত্যাঘাতের পরিবর্তে তার লক্ষ্য ছিল অনেক বৃহৎ ও সুদূরপ্রসারী। রাজতন্ত্রের সার্বিক অত্যাচার থেকে শোষিত এই জনজাতিকে মুক্ত করাই শুধু নয়, দিব্বোক চেয়েছিল প্রয়োজনে বাইরের শক্তির সাহায্য নিয়েও গৌড় দখল করতে। কিন্তু গৌড়ের অশ্বারোহী সেনা আছে, যা কৈবর্তদের নেই। তাই পীঠি রাজ্যের রাজা দেবরক্ষিতের সঙ্গে চুক্তি করে, তাদের অশ্বারোহী সেনার সহায়তায় দিব্বোক গৌড় দখল করে এবং কৈবর্তরা দ্বিতীয় মহিপালকে হত্যা করে।

উচ্চবর্গের উন্নাসিকতা কতটা অর্থহীন ও অন্তঃসারশূন্য, তা বোঝা যায় রাজার বিরোধী পক্ষের মানসিকতা দেখে। মথনদেবের নেতৃত্বে কিছু বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং সামন্তদের একাংশ কায়মনোবাক্যে রাজা দ্বিতীয় মহিপাল ও প্রধান আমাত্য বরাহস্বামীর পতন চাইছিল। অথচ তাদের উদ্যোগের পূর্বেই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে কৈবর্তদের উত্থান তারা মেনে নিতে পারেনি। এর আগেও কৈবর্তদের সঙ্গে চুক্তির কথা উঠলে মথনদেব তাতে রাজি হয়নি আর্য অহমিকায়। অথচ চেয়েছিল যে রাজার বিরুদ্ধে কৈবর্ত বিক্ষোভ একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় বজায় থাকুক। শেষ পর্যন্ত কৈবর্তরা গৌড় দখল করলে তারা হাহাকার করে ওঠে ‘সোনার গৌড় বর্বরদের হাতে গিয়ে পড়ল’ উচ্চারণে। উচ্চবর্গের শাসকের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা, হানাহানির যতই নিদর্শন থাক: নিম্নবর্গের প্রসঙ্গে যে তারা একই মনোভাব পোষণ করে, তা এখানে স্পষ্ট।

তবে গৌড় দখলের পর কৈবর্তদের উল্লাস ও প্রতিহিংসা চার্লস ডিকেন্সের ‘আ টেল অফ টু সিটিজ’ মনে করিয়ে দেয়। সেই এক নিষ্ঠুরতা, লুঠতরাজ, দোষী-নির্দোষ নির্বিশেষে বিনা-বিচারে হত্যা— তথাকথিত ‘অ-সভ্য’ কৈবর্তরা সভ্য সমাজে এসেই যেন প্রকৃত প্রস্তাবে অসভ্যতার পাঠ নিচ্ছিল। এমনই প্রতিবেশে উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বময় চরিত্র, পদ্মনাভকে মৃত্যুদণ্ড দেয় তারা। তবে এইসব বর্বরতা, লেখক দেখিয়েছেন, অধিকাংশই দিব্বোকের অগোচরে, মূলত পরভুর নেতৃত্বেই ঘটত। ক্রমে কৈবর্তদের মধ্যেও সভ্য সমাজের অনুকরণে উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র ইত্যকার ব্যবধান সৃষ্টি হয়। তাদের মানসভূমিতে চারিয়ে যায় পাপ ও লোভের বেসাতি। অবশ্য দিব্বোক সহজে পরিস্থিতি হাতের বাইরে যেতে দেয় না। তার মানবিকতার পরিচয় পাওয়া যায় আরও অন্তত দুটি ক্ষেত্রে। যুদ্ধে পরাজিত বা বন্দীদের অবাধে হত্যা করা বন্ধ করে সে। এবং তাদের আরাধ্য দেবতা ওলান ঠাকুরের পরবে যুগ যুগ ধরে চলে আসা নরবলি রদ করে। কৈবর্ত সমাজের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ঋজু প্রত্যয়ে সে এই পৈশাচিক প্রথা বন্ধ করতে সক্ষম হয়।

গৌড়ের শাসনকর্তা হয়ে দিব্বোক যে সব জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী নেয় ও সফলভাবে তার প্রবর্তন করে, সেখানে লেখকের নিজস্ব বামমনস্ক চেতনার ছায়াপাত লক্ষ করা যায়। শুধু কৈবর্তদের মধ্যেই নয়, তার সুশাসনে গৌড়ের অন্তর্গত প্রতিটি গ্রামবাসীর স্বার্থ রক্ষিত হয়। কোচ উপজাতি প্রাক-বিপ্লব কালে তাদের সঙ্গ না দিলেও দিব্বোকের সুযোগ্য পরিচালনায় তারাও এসে যোগদান করে। বহু অন্যায্য ও বাড়তি করের বোঝা তুলে দেওয়া হয়। ফসলে যেখানে ছয় ভাগের এক ভাগ কর দিতে হতো, সেটাও কমিয়ে আট ভাগের এক ভাগ করা হয়। ইতিমধ্যে একবার পাল রাজারা রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য আক্রমণ করলেও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দিব্বোকের সচেতন প্রয়াসে সম্মিলিত কৈবর্তরা তা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়। তবে এই আক্রমণের পর থেকে কৈবর্তরা আত্মরক্ষার নানান উপায় ভাবতে শুরু করে। দিব্বোকের ভাই রুদোকের ছেলে ভীম যুদ্ধে বীরত্ব দেখিয়ে খুব প্রশংসা পেয়েছে, কৈবর্ত সমাজের পরবর্তী নেতাও হবে সে। ভীম প্রস্তাব দেয় গোটা রাজ্যের চারপাশে জাংগাল (প্রাচীর) দিয়ে ঘিরে দিলে নিরাপদ রাখা যাবে। দিব্বোক তার উৎসাহকে নিরস্ত না করেও যে উপদেশ দেয় সেখানেই তার প্রজ্ঞা এবং দ্ব্যর্থহীন ঐকাত্ম্যনিবিড় মনোপ্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায়। সে জানায়—

এই জাংগালের চেয়েও শক্তিশালী মানুষের জাংগাল, সে কথাটা ভুলে যেও না যেন। … মনের সঙ্গে মন গেঁথে এই মানুষের জাংগাল গড়ে তুলতে হয়। আমরা কৈবর্ত, কোচ এবং আর অন্যান্য জাতের মানুষদের মন গেঁথে গেঁথে এই জাংগাল তুলতে পেরেছিলাম বলেই ওরা এই জাংগাল ভেদ করে ঢুকে পড়তে পারে নি। কিন্তু আরও অনেক দৃঢ়, অনেক সুগঠিত করে তুলতে হবে একে। মাটি পাথরে গড়া জাংগালের চেয়েও মানুষের জাংগালের শক্তি অনেক বেশি। যতদিন এই জাংগাল ঠিক থাকবে, ততদিন আমাদের ভয় নাই।

এই উক্তি থেকেই দিব্বোকের মন-মানসিকতা পড়ে ফেলা সম্ভব। একদা যার নিক্ষিপ্ত তীরের কারণে সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় অনিবার্য অথচ স্থির পদক্ষেপে, সেই আকনের পরিচয় জানতে পেরেও তাকে সর্বান্তকরণে ক্ষমা করতে পারে দিব্বোক। আস্তিত্বিক অবসাদে ভোগা আত্মহিংস্রক সেই যুবাকে জীবনের দিকে ফেরায় নির্মল মমতায়। দিব্বোকের চরিত্রে যে সুদক্ষ সংগঠক, পরহিতচিকীর্ষা, সমবায়িক আত্মতা, অনবচ্ছিন্ন মানবিকতার বহুমুখী প্রকাশ, ক্ষমা-দয়া-মঙ্গলাকাঙ্ক্ষার মতো অজস্র গুণের সমাহার: তার মধ্যে লেখকের কল্যাণকামী মানসিকতার প্রতিফলন স্পষ্ট।

‘পুরুষমেধ’ (১৯৬৯) উপন্যাসে বৈদিক যুগপ্রেক্ষায় রাজ্য শাসনকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়র চিরাচরিত দ্বন্দ্ব, শূদ্রের ওপর নির্মম অত্যাচার এবং তাদের প্রত্যাঘাতের কথা বর্ণিত। পূর্বোক্ত উপন্যাসের মতোই এখানেও ঘটনার অন্তরাবর্তন ঘটেছে নিম্নবর্গের দেওয়াল-পিঠ একক সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই। তবে এখানে শুধুই অস্ত্রের ঝনঝনানি নয়, বরং সবচেয়ে বড় কনট্রাস্ট তৈরি হয়েছে আর্য-অনার্য মনন ও চিন্তনের আবহমান, অসেতুসম্ভব বিপ্রতীপতার কারণেই। অনার্য দেবদেবী, রিচুয়ালস; তাদের নানান টোটেম ও ট্যাবু; শিক্ষা তথা বেদ নিয়ে, ঈশ্বর নিয়ে আর্যদের মনোভাবের সঙ্গে তাদের চিন্তা-সাংকর্ষ; নেতি-খারিজের নিরন্তর অভিঘাত-অভিজ্ঞতার মাঝেও তাদের আক্রমণ ও আত্মরক্ষাময় প্রত্যয়ী যাপন— সত্যেন সেনের বীক্ষণ-বিন্দু থেকে সমস্তটাই অনেকার্থদ্যোতনা-সমেত উঠে এসেছে আলোচ্য উপন্যাসে। সেই নিরিখে, এই টেক্সট যেন হয়ে উঠেছে প্রাচীন ভারতের কালচারাল হেজিমনির এক সময়ান্বিত আর্কাইভ।

‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’ উপন্যাসে অনতি-নির্দিষ্ট স্থান, কাল এবং পাত্রের উল্লেখ থাকলেও ‘পুরুষমেধ’ উপন্যাসে সেরকম কোনও ঐতিহাসিক তথ্য নেই। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক যতীন সরকারের ‘সত্যেন সেনের ঐতিহাসিক উপন্যাস’ প্রবন্ধের একটি মন্তব্য প্রাণিধানযোগ্য—

বৈদিক যুগের সমাজ বলতে তিনি কোনো একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নকে বোঝান নি, প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন স্থানে যে একই সময়ে বিভিন্ন ধরনের সমাজ কাঠামো বিদ্যমান ছিল,—সে সত্যটাকে তিনি সামনে নিয়ে এসেছেন। তথাকথিত আর্য সভ্যতার সৌধ যে বিপুল সংখ্যক শূদ্র জনতার লাঞ্ছনার উপরেই গঠিত,—সেই সুপরিচিত ঐতিহাসিক তথ্যটির জীবন্ত চিত্র উপস্থাপিত সত্যেন সেনের ‘পুরুষমেধ’-এ।

তবে ‘শূদ্র জনতার লাঞ্ছনার’ চিত্র যেমন রয়েছে, তেমনই কাহিনির গতিবর্ত্মে পরিত্রাণের এক বিকল্পহীন আকাঙ্ক্ষায় নিম্নবর্গের মৃত্যুতীর্ণ অন্তর্ঘাত লেখক অভ্রান্ত নিশ্চয়তায় বুনে দিয়েছেন। বৃষকেতু রাজা হলেও আসলে সে রাজপুরোহিত ঊষস্তি চাক্রায়নের পাপেট। ব্যক্তিত্বহীন, স্বভাবতই উগ্র পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন রাজা রাজ্য শাসন থেকে শুরু করে ধর্মাচরণ সবেতেই রাজপুরোহিতের মুখাপেক্ষী। রাজপরিবারের প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী বৃদ্ধ মন্ত্রী এই নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণের করালগ্রাস থেকে রাজাকে মুক্ত করার প্রবল প্রয়াস করলেও সফল হতে পারে না। রাজ্য পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে তো বটেই, অধিকন্তু দাম্পত্য যাপনের হরেক মুহূর্তেও রাজার মনকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে ঊষস্তি চাক্রায়ন। বিদুষী, বুদ্ধিমতী বড় রাণী সুদক্ষিণা রাজার মনে উদারতা, মানবতার বীজ উপ্ত করতে চেয়েও বারবার ব্যর্থ হয়। মাস ম্যানিউপুলেশনে দক্ষ রাজপুরোহিত নিজের তৈরিকৃত ইমেজ এমনভাবে রাজ্যমধ্যে প্রচার করে রাখে যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলেই তার গুণমুগ্ধ। তার ব্যক্তিত্বের দার্হ্য, পাণ্ডিত্যের চাকচিক্যে সকলেই তাকে ঈশ্বরের মতো শ্রদ্ধা করে। সেটাকেই মূলধন করে যাগযজ্ঞের ব্যাপারে তো বটেই, কর সংগ্রহের মতো রাজকার্যেও সে নিজস্ব নির্দেশিকা জারি করে। তার এই অশুভ প্রভাব কাটাতে বৃদ্ধ মন্ত্রী, রাণী সুদক্ষিণা এবং কয়েকজন ক্ষত্রিয়ের মধ্যে গড়ে ওঠে রাজপুরোহিত বিরোধী এক জোট।

দেশে তখন অনাবৃষ্টি থাবা বসিয়েছে চাষে। বৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায় নিম্নবর্গীয় কৃষক সমাজ তাদের কৃষ্টি অনুসারে একের পর এক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কখনও বৃষ্টি আনার গান তো কখনও ‘ভেক-দেবতা’র পূজা। এত করেও যখন বৃষ্টি হয় না, তখন বৃদ্ধা মাতঙ্গীর নেতৃত্বে নারীরা মেঘ-নামানি ব্রত করে। ভারি বিপজ্জনক এই অনুষ্ঠান। সেখানে পুরুষ প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই অনুষ্ঠানের সূত্রেই মাতঙ্গীর কথকতায় জানা যায় কিংবদন্তী জাঙ্গালী বুড়ির উপাখ্যান। সত্যেন সেন এখানে চমৎকারভাবে তৈরি করেন এক অনার্য দেবী-কেন্দ্রিক লোকায়ত ন্যারেটিভ ডিসকোর্স। সেখানে পিতৃতন্ত্রের চালাকি যেমন তুলে ধরা হয়েছে, তেমনই অকাল্টের ব্যবহারও একটা আলাদা ডাইমেনশন দেয় উপকাহিনিটিকে। সর্বোপরি যৌনতা নিয়ে, আরও স্পষ্ট করে বললে ইনসেস্ট এবং অবাধ যৌনতা নিয়ে যে ট্যাবু, তা জাঙ্গালী বুড়ির সঙ্গে গোটা কৌমের তর্কালোচনায় উঠে আসে। অথচ অনার্য প্রত্নজীবনে যৌনতাকে আর পাঁচটা স্বভাবজ দৈহিক ক্রিয়ার মতোই দেখা হতো: হতো উৎসবে অনুষ্ঠানে তার সেলিব্রেশন। বৃষ্টি, মৃত্তিকার উর্বরতা, বীজ বপন, ফসল উৎপাদন— প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই তো যৌনতার অমোঘ মেটাফর হিসেবে চিহ্নিত। তাই বৃষ্টির উদ্দেশে যখন জাঙ্গালী বুড়ি অবাধ যৌনতার নিদান দেয় এবং অনিকেত অস্বস্তিতে সেই জনজাতি তা পালন করতে ব্যর্থ হয়, তখন, কথিত, অনার্য দেবীর অভিশাপেই শূদ্র জাতের উৎপত্তি। এবং সেই থেকেই যূথবদ্ধ অনির্দেশ্য গ্লানির সূত্রপাত, যা বংশানুক্রমে যুগান্তরেও তারা বহন করে চলেছে।

অনাবৃষ্টির অনাময় ক্ষতচিহ্ন উপশমের পূর্বেই শূদ্রদের সামনে উপস্থিত হয় আরও বড় এক মৌল সংকট। পূর্বে তাদের উৎপন্ন শস্যের ছয় ভাগের এক ভাগ রাজকর দিতে হতো। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা আবেদন করেছিল, তা কমিয়ে আট ভাগের এক ভাগ করা হোক। কমানো তো দূরের কথা, তা বাড়িয়ে চার ভাগের এক ভাগ নির্ধারিত হয়। বৃষ্টিপাতের কারণ হিসেবে উচ্চবর্ণের তরফ থেকে জানানো হয়, ব্রাহ্মণদের দিয়ে ইন্দ্রের যজ্ঞ করানোর কথা। আর সেই যজ্ঞের খরচ তোলার জন্যই এই বাড়তি করের বোঝা অম্লান চাপানোর একতরফা সিদ্ধান্ত উচ্চবর্গের। ক্ষমতাবানের এই কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। শুরু হয় দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দ্ব। তারা প্রথম উপলব্ধি করে, শুধু অপদেবতা নয়, শাসক-মানুষেরাও তাদের সমান ক্ষতি করছে। সাহসী সুদাসের নেতৃত্বে ঘুলিয়ে ওঠে যুদ্ধ-পরিস্থিতি। বৃষকেতুর পিতা মৃত্যুর পূর্বে তাকে নির্দেশ দিয়েছিল কখনওই শূদ্রদের কর না বাড়ানোর জন্য। এই নিয়ে তার পিতামহের তিক্ত-করুণ অভিজ্ঞতা রয়েছে। কৃষকেরা এমনিতে নিরিহ, কিন্তু মরিয়া হয়ে খেপে গেলে তাদের সামলানো খুব কঠিন। ঊষস্তি চাক্রায়নের আদেশে রাজা তার পিতার নির্দেশিকা, স্ত্রী ও প্রধান মন্ত্রীর অনুরোধ— সব কিছু উপেক্ষা করে, আর ডেকে আনে অনিবারণীয় এক সাবভার্সন।

রাজপরিবার ও তার সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তি এবং শূদ্র সমাজের বাইরে নগরমনস্ক মধ্যবিত্ত একটি শ্রেণি উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তারা প্রায় সকলেই শিক্ষিত, শাহরিক চিন্তক। কেউ ব্রাহ্মণ তো কেউ ক্ষত্রিয়। এদের মধ্যে শ্রুতকীর্তি নামের একজন সরাসরি রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে জড়িয়ে পড়ে ও মন্ত্রিত্ব লাভ করে। অন্যদিকে রয়েছে সুদর্শন নামক এক মরমী যুবক, যে আর্য সভ্যতার প্রতি রীতিমতো অবসেসড; বেদে অগাধ পাণ্ডিত্য, অপিচ অনার্যদের প্রতিও তার মমত্ব কম না। তাদের দুর্দশায় সে যারপরনাই দুঃখিত। শূদ্রদের শিক্ষিত করে তুলতেও বদ্ধপরিকর সে। তবে, শাস্ত্রজ্ঞানী এই তরুণের সাংসারিক জ্ঞান যেমন কম, তেমনই মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কেও সে বাস্তবিকই অজ্ঞ। তাই ঊষস্তি চাক্রায়নের বাহ্যিক অ্যাটায়ারে সে মুগ্ধ-বিস্মিত-শ্রদ্ধাবণত। আর্য সংস্কৃতির প্রতি তার দ্বিধাহীন আনুগত্য থাকলেও সে অবশ্য গোঁড়া নয়। কেউ সঠিক যুক্তি দিয়ে তার বক্তব্যের বিরোধিতা করলে, এমনকি তার চিন্তনবিশ্বে ঝড় তুললেও সে কিন্তু নির্মোক স্থৈর্যে তা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।

তবে যে চরিত্রটিকে উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট বলা যেতে পারে, সে সাত্যকি। পৈতৃক সূত্রে সে আর্য কিন্তু মায়ের দিক থেকে অনার্য। চূড়ান্ত মেধাবী অথচ আজীবন দুর্ভাগ্যপীড়িত এই যুবক অনায়াসে মহাভারতের ট্র্যাজিক প্রতি-নায়কটির সঙ্গে তুলনীয়। খুব দ্রুত সে বেদ অধ্যয়ন করে। কিন্তু প্রশ্নতীক্ষ্ণ এই যুবকের বেদকে চ্যালেঞ্জ করা তার গুরু মেনে নিতে পারেনি। গুরুর ইঙ্গিতে ঈর্ষান্বিত সহপাঠীরা তীব্র শারীরিক লাঞ্ছনা করে তাকে গ্রাম থেকে বিতারিত করে। বাইরের পৃথিবীতে ভ্রমণ করে এবং অন্বত্থলা নাম্নী এক বিদুষী অনার্য রমণীর সংস্পর্শে এসে প্রতিকল্প এক প্রাকৃত জ্ঞানের ভাণ্ডারের সন্ধান পায় সে। বস্তুত, তখনই তার যথার্থ শিক্ষা সম্পন্ন হয়, উন্মোচিত হয় জ্ঞানচক্ষু। দেশে ফিরে সাত্যকি শূদ্রদের দলে ছদ্মবেশে যোগদান করে এবং তাদের বৌদ্ধিক নেতৃত্বের ভার নিজের হাতে তুলে নেয়। তারই বিচক্ষণ পরামর্শে সংঘবদ্ধ হতে থাকে অনার্য শূদ্রেরা।

ইতিমধ্যে রাজা উদরী রোগাক্রান্ত হলে ঊষস্তি চাক্রায়ন নিদান দেয় বরুণদেবকে সন্তুষ্ট করার জন্য পুরুষমেধ যজ্ঞ করার। এই যজ্ঞে ১৮৪ জন মানুষকে বলি দেওয়ার বিধান। পরিবর্তিত পরিস্থিতির বিকল্প ব্যবস্থাপনায় সংখ্যাটি একজনে এসে দাঁড়ায়। স্থির হয়, যাদের জীবনের কোনও মূল্য নেই— অর্থাৎ শূদ্রদের মধ্যে থেকে কাউকে এনে বলি দেওয়া হবে। এই বলির পক্ষে-বিপক্ষে উচ্চবর্গের মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হলেও রাজপুরোহিতের আত্যন্তিক প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সকলে রাজি হয় এবং সুদাসের শিশু পুত্র খেতুকে অপহরণ করে এনে যজ্ঞস্থলে বলি দেওয়া হয়। এই ঘটনা জানাজানি হলে শূদ্রদের ধৈর্যের বাধ ভাঙে এবং বিপ্লবের আভাস দিয়ে উপন্যাস শেষ হয়।

উপন্যাসের শেষাংশ অহেতুক মৃত্যু-আকীর্ণ। সুদক্ষিণা, ঊষস্তি চাক্রায়ন, সাত্যকি, উলুপী— প্রধান চরিত্রদের প্রায় সকলকেই হত্যা করা হয়। সুদর্শন আত্মহত্যা করে। তবে মৃত্যু-মন্থর পদক্ষেপেই বিপ্লবেরও সূচনা হয়। যদিও নিম্নবর্গ যখন লড়াই শুরু করে, তখন উচ্চবর্গের মধ্যেও যাবতীয় আভ্যন্তরীণ বিভেদ মুলতুবী রেখে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের বাধ্যত ঐক্যবদ্ধ হতে দেখা যায়। এখানেই ফের প্রমাণিত হয়, আলোচনার প্রারম্ভে উত্থাপিত শাসক-শোষিত শ্রেণিবিভাজনের দ্বিত্ব। সত্যেন সেন খুব সূক্ষ্মভাবে এই প্রতিমেরুকে চিহ্নিত করেছেন এবং ক্ষমতার প্রশ্নে তো বটেই, এমনকি প্রাচীন ভারতের সাংস্কৃতিক আধিপত্যমান্যতার প্রতর্কেও মেধাতীক্ষ্ণ ও বহুকৌণিক আলো ফেলেছেন।

আলোচ্য দুটি উপন্যাসেই উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের প্রতিনিধিদের মধ্যে একাধিকবার, নানান প্রসঙ্গে দ্বিবাচনিক বিনিময় ঘটেছে। সেখানে কখনও উঠে এসেছে অস্তিত্বের হতচেতন পরিস্থিতির বিষাদবর্ণ বয়ানমার্গ; তো কখনও শিক্ষা ও জ্ঞানের ফ্যালাসি উন্মোচিত হয়েছে প্রশ্ন-পরিপ্রশ্নময় তর্কালোচনায়। তাই এই উপন্যাসদ্বয় শুধুই প্রান্তিকায়িত মানুষের দহনক্লান্তির ইতিবৃত্ত নয়; নয় নিম্নবর্গীয় প্রতিস্রোতপন্থী বিপ্লবকে অহৈতুকি রোম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখানোর প্রচেষ্টা; বরং লেখক এখানে যথার্থভাবেই দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে অনেকান্তবাদী ভারতবর্ষের বহুস্তরী ভিতরভুবন তথা কৃষ্টি-প্রকরণকে উদ্ভাসিত করে দেখিয়েছেন। তাই ক্ষমতার রাজনীতিতে যুযুধান দুই গোত্রের ঈপ্সিত বিরোধ-বর্ণনের পাশাপাশি ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’ ও ‘পুরুষমেধ’ উপন্যাসে যথাপ্রাপ্ত পরিসর পায় বৈদিক-আর্য সংস্কৃতির প্রবল প্রতিস্পর্ধী এক কাউন্টার ন্যারেটিভ— অনার্য প্রত্ন-প্রকল্পের নৃতাত্ত্বিক বিনির্মাণ।

তথ্যসূত্র:

১. গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদিত) : ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ : আনন্দ পাবলিশার্স : কলকাতা : প্রথম সংস্করণ, এপ্রিল ১৯৯৮ : অষ্টম মুদ্রণ, জুলাই ২০১৫ : পৃষ্ঠা- ১২

২. বদিউর রহমান (সম্পাদিত) : ‘সত্যেন সেন রচনাবলি’ ৩য় খণ্ড : বাংলা একাডেমি : ঢাকা : প্রথম প্রকাশ, জুলাই ২০১৪ : পৃষ্ঠা- ৩০০-৩০১

৩. বদিউর রহমান (সম্পাদিত) : ‘সত্যেন সেন ধ্রুপদী গণ-কথাশিল্পী’ : জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ : ঢাকা : প্রথম প্রকাশ, বইমেলা ২০০৮ : পৃষ্ঠা- ৩৯

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান