চিত্রিতা বসু
এক
‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়’ হলেও ছড়া, গাথা, স্লোগান ও কবিতায় যে ইতিহাস বিধৃত থাকে তা সাধারণত ক্ষুধিতের বয়ান। প্রথাগত ইতিহাসচর্চায় প্রাপ্ত তথ্যের সাধারণীকরণ অনেক ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার বর্ডারলাইন অতিক্রম করে ক্ষমতাবান শ্রেণি অথবা প্রতিনিধিস্থানীয় স্বরকে উপস্থাপন করে। ব্রিটিশ ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ঔপনিবেশিক সরকার এবং ভূস্বামী, মধ্যসত্বভোগী এবং সরকারি চাকুরেরা সমস্বার্থ পোষণ না করলেও শাসকের শাসন-শোষণ টিঁকিয়ে রাখার সহায়ক হয়ে উঠেছিল। বস্তুত শোষণযন্ত্রের একদম নিম্নধাপে ছিল মহাজন বা মধ্যসত্বভোগী শ্রেণি। এই সিস্টেমের দ্বিতীয় ধাপে ছিলেন জমিদার বা ভূস্বামীরা, যারা মহাজনদের পরোক্ষে অক্সিজেন জোগাত। আবার, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের মূল আশা ভরসাই ছিল জমিদার সম্প্রদায়। সুতরাং, আর্থিক নির্ভরতাই এই তিন শ্রেণিকে এক ঐক্যসূত্রে জুড়ে রেখেছিল। এই তিন শ্রেণিকেই নিম্নবর্গীয় ইতিহাসের ভাষায় উচ্চবর্গ বলা যেতে পারে। এই ত্রিবিভক্ত সামন্তচেতনার বিপ্রতীপে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকা কৃষক সম্প্রদায় নিজস্ব চেতনার মধ্যে যুগযুগান্তর ধরে শ্রম-রক্ত-ঘর্মের অক্লান্ত গল্প বুনে চলেছে। সাঁওতালদের লোকচেতনায় এমনই লড়াকু ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। ‘মোরা শুধু ভুখবো?’—এই প্রশ্নের উত্তরটি যখন হয় ‘না না মোরা রুখবো’, সেখান থেকেই শুরু হয় কৃষকচেতনার রাজনৈতিক উত্তরণ।
সাঁওতালদের রাজনৈতিক চেতনা একান্তভাবেই ভূমিজ। তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও পৌরাণিক ভিত এমন এক দৃঢ়বদ্ধ গোষ্ঠীচেতনা সৃষ্টি করেছে, যে ধারাবাহিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্যেও তারা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। আন্তোনিও গ্রামসির মতে, নিম্নবর্গের শ্রেণিচেতনার পরিবর্তনের গতিপথ অনুধাবনের জন্য তাদের জীবনযাত্রা, ভাবাদর্শ ও আচার আচরণকে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। ১৮৫৫-এর সাঁওতাল বিদ্রোহের যে বয়ান তাদের ছড়ায়-গাথায় ছড়িয়ে আছে, তা বস্তুত নিম্নবর্গের জবানবন্দি। পরবর্তীকালে রাজনীতি সচেতন আধুনিক সাহিত্যিকদের গল্পে-উপন্যাসে বহুবার মুণ্ডাদের ‘উলগুলান’ অথবা সাঁওতালদের ‘হুল’ বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। বলাই বাহুল্য, তারা সাহিত্য নির্মাণের রসদ সংগ্রহ করেছেন উপজাতিসমূহের নিজস্ব ন্যারেটিভ থেকেই।
সাঁওতালদের বৈপ্লবিক চেতনা গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে তাদের পূর্ব-ইতিহাস কাজ করেছে। এর সঙ্গে এক্স-ফ্যাক্টর হিসেবে যুক্ত হয়েছে মিথ-পুরাণ ও দৈববিশ্বাস। ব্রিটিশ সরকারসহ সমাজের উচ্চবর্গীয় শ্রেণি অর্থাৎ জমিদার, মহাজন, সরকারি আধিকারিকদের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা অকল্পনীয় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যে অসম লড়াই-এ সামিল হয়েছিল, তার শিকড়ে পৌঁছতে গেলে যেতে হবে অধুনা সাঁওতাল পরগণার জঙ্গলাকীর্ণ অতীতে। কবি লোকনাথ দত্ত সাঁওতাল বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে আঠারো সর্গবিশিষ্ট ‘সাঁওতাল কাহিনী’ নামে একটি বীরত্বব্যঞ্জক কাব্য রচনা করেছিলেন। সাঁওতাল প্রদেশে থাকাকালীন তিনি ঐ কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করেছেন। তিনি লিখছেন বিন্ধ্যপর্বতের প্রান্তদেশ থেকে শুরু করে নীলগিরি পর্বতের সীমা অবধি বিস্তৃত ঝাড়খণ্ড রাজ্য, রাজমহল ও পরেশনাথ পাহাড়বেষ্টিত যে বিস্তীর্ণ ভূমি ছিল সাঁওতাল জাতির মুক্তাঞ্চল।
উত্তর ভারতে, বিন্ধ্যাচলপ্রান্তে; ঝাড়খণ্ড দেশ বঙ্গের সীমান্তে; …পঞ্চাশ যোজন অর্ধচন্দ্রাকার; উত্তর দক্ষিণে বিস্তার যাহার; উত্তরে জাহ্নবী দক্ষিণে সাগর… দুমকার গিরি যার মধ্যমেরু; রাঁচী মালভূমি যার জঙ্ঘা ঊরু; সেই গিরিদেশ কানন কান্তার; স্বাধীন সাঁওতাল জাতির আগার। (পৃষ্ঠা: ৫৫)
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাঁকুড়া, বীরভূম, মানভূম, ছোটনাগপুর, হাজারিবাগ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে ঝাড়খণ্ডের অপেক্ষাকৃত প্রান্তিক অংশে এসে জঙ্গল সাফ করে বসতি স্থাপন করে। তাদের ভাষাতেই এই অঞ্চলের নাম হয় দামিন-ই-কো, যার অর্থ পাহাড়ের প্রান্তদেশ। উনিশ শতকের চারের দশকে লর্ড বেন্টিঙ্ক রাজমহল পাহাড়ের পশ্চিমদিকে সাঁওতালদের বসতি স্থাপনের জন্য অনুরোধ করেন। বিভিন্ন অঞ্চলের সাঁওতালরা সানন্দে সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং দামিন-ই-কো-তে পাকাপাকিভাবে বসতি গড়ে তোলে। সেখানকার ফলবান জমির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বাঙালি ও উত্তর ভারতীয় ব্যবসায়ীরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। পূর্বোক্ত গাথায় এর পরিচয় পাওয়া যায়:
সাঁওতাল দুর্বল হেরি বাঙ্গালী, বেহারী ঢুকেছে সাঁওতাল-গ্রামে খেলিছে চাতুরী কোথাও বসেছে তারা ব্যাপারীর বেশে সাঁওতাল ক্রেতার ডাকে সমাদর হেসে... (পৃষ্ঠা: ৫৬)
সাঁওতালদের কাছে এরা ‘দিকু’ নামে পরিচিত ছিল। ক্রমে দিকুরাই তাদের প্রভু হয়ে বসে। পূর্বোক্ত গাথা থেকে জানা যায় তাদের কাছে ঘৃত, মধু, শস্য, বাঘছাল প্রভৃতি পণ্য অতিরিক্ত দামে বিক্রি করা হতো। এরা যখন কোনও কিছু কিনত, তখন ছোটো বাটখারা— বেচারাম এবং যখন বিক্রি করত তখন বড়ো বাটখারা— কেনারাম ব্যবহার করত। পূর্বোক্ত গাথায় উল্লেখ আছে:
কিনিছে সাঁওতাল পণ্য, মিথ্যা তৌল বাটে একসের স্থানে লয়, দুই সের তুলি; প্রতারণা দাগাবাজি, মুখে মিষ্টবুলি। (পৃষ্ঠা: ঐ)
W.B.আর্চার ‘Man in India’ পত্রিকায় কিছু সাঁওতাল গানের অনুবাদ করেছিলেন, সেখানে কেনারাম বেচারামের উল্লেখ পাওয়া যায়:
Kenaram Becharam longed for land in Piparijuri... (পৃষ্ঠা: ৯৩)
সেই সময়ে কোম্পানিকে তাদের দেয় রাজস্বের হার ছিল অনেক কম। রণজিৎ সমাদ্দার তাঁর ‘সাঁওতাল গণবিদ্রোহ ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে ১৮৩৭-৩৮ সালে রাজস্ব ছিল বার্ষিক ৬৬৮২ টাকা। অথচ ১৮৫৪-৫৫ সালে সেই খাজনাই বেড়ে হয় ৫৮,০৩৩ টাকা। কঠোর পরিশ্রমী এই উপজাতি সম্প্রদায় নিজেদের শ্রমোপার্জিত অন্নে স্বচ্ছলভাবে স্ত্রী-সন্তানসহ দিন যাপন করত, কিন্তু ক্রমে রাজস্বের হার বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় জমিদার-মহাজনদের দ্বিমুখী শোষণ। মহাজনরা সাঁওতাল কৃষকদের দুঃখের দিনে ঋণ দিত যা কখনওই পরিশোধ হতো না। আদিম এই জনজাতির নিরক্ষরতা ও সরলতার সুযোগ নিয়ে বাঙালি মহাজনেরা তাদের অপরিশোধ্য ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলত। জমি, ফসল গবাদি পশু— যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি তো কেড়ে নিতই, পাশাপাশি সমগ্র পরিবারকে ক্রীতদাসে পরিণত করত। পূর্বোক্ত গাথায় পাওয়া যায়:
সাঁওতালেরই ধনে পুষ্ট, দুষ্ট মহাজন অর্পিয়া ধন করিয়ে বন্ধন অভাবে কৃষাণ লয়, ভুট্টা ধান বাড়ি দুচার বরষে ঋণ ক্রমে যায় বাড়ি; তখন কৃষাণ দেনা শোধিতে না পারে দেয় ছাড়ি ক্ষেত বাড়ী মহাজন করে। (পৃষ্ঠা: ৬৭)
সাঁওতালদের নিজস্ব গানে-গাথায় তাই ইংরেজ বিরোধিতার থেকেও উচ্চবর্গের প্রতিনিধি তথা মহাজন, জমিদারদের প্রতি সম্মিলিত ক্ষোভ ও ভীতির কথাই উঠে আসে। যেমন একটি গানে পাওয়া যায়:
বাকো লতুরা ক্’খান বাকো হেতওয়া ক্’খান, হায়রে হায়রে। ভগত কেনারা…ম নোয়ারাবোন নুসৌসাবোন বাংগেকো তেঙেগান, দঃক্’বোন দানাংবোন বাংগেকো রেবেন, তবে দো বোন হুল গেয়া হো।
(বঙ্গানুবাদ: কেউ না শুনলে কেউ না গ্রাহ্য না করলে হায় হায়! ভগত কেনারা…ম’ আমরা নিজেরাই বাঁচব কেউ পাশে দাঁড়ায় না, আমাদের সাহায্যের আশ্রয় দিতে কেউ রাজী নয় তবে আমরা বিদ্রোহ করব...) (পৃষ্ঠা: ৮৭)
উল্লিখিত কেনারাম ভগত ছিলেন এক কুখ্যাত মহাজন, যার বিরুদ্ধে সাঁওতালদের পুঞ্জীভূত বিদ্বেষের পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন গানে। অত্যাচারী কেনারামের চেহারা ও চলনে ছিল কুন্ঠাহীন তেজোদ্দীপ্ত ভঙ্গিমা যা সাঁওতালদের কাছে ভীতিপ্রদ হয়ে উঠেছিল। অপর একটি গানে কেনারাম ভগত সম্পর্কে বলা হচ্ছে:
…ভগত কেনারাম ঘোড়ার উপর পালান উপর সাওয়ারালাং কেনারাম কুলি কুলি যাইছে টাপটাপ। (পৃষ্ঠা: ৮৬)
(বঙ্গানুবাদ: হায় হায়! ভগত কেনারাম ঘোড়ার পিঠে জিনের ওপর সওয়ারি কেনারাম রাস্তায় রাস্তায় টগবগিয়ে যায়।)
মুখে মুখে প্রচারিত এই গানগুলো একইসঙ্গে যেন তাদের সতর্কবার্তা ও স্লোগান হয়ে ওঠে। সাঁওতালরা যে কেবল প্রশাসনের দ্বারা বা মহাজনদের কাছে ঋণের দায়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন এমন নয়, ব্রিটিশ রাজত্বে সাঁওতাল নারীর সম্মানও অরক্ষিত হয়েছে। জমিদার মহাজন এবং ব্রিটিশ সাহেবরা সাঁওতাল রমণীদের ভোগ্যপণ্যে পরিণত করেছিল। শ্লীলতাহানি, ধর্ষণসহ নানাবিধ অত্যাচারের শিকার হয়ে তারা আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হতেন। বিভিন্ন রাজকর্মচারীরাও এই বিষয়ে পিছিয়ে ছিল না। জানা যায় টমাস নামে কোম্পানির কর্মচারী প্রায় সাঁওতালদের গ্রামে প্রবেশ করে সাঁওতাল রমণীদের অসম্মান করতেন। একটি গানে পাওয়া যায়:
সয়্যালক পাহাড়ে দতো মাঝির কন্যা দিয়াছে গলায় দড়ি আম-গাছের ডালেরে। (পৃষ্ঠা: ৯১)
এমতয়াবস্থায় গ্রামপ্রধানেরা কেউ পাশে দাঁড়াবে না, সুতরাং বিদ্রোহই একমাত্র পথ:
নুসৌসাবোন নওয়ারাবোন চেলে হুঁ বাকো তেঙেগান, খাঁটি গেবোন হুল গেয়া হো। (পৃষ্ঠা: ৮৮)
(বঙ্গানুবাদ: আমরা নিজেরাই বাঁচব, কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াবে না আমরা সত্যিই বিদ্রোহ করব।)
স্থানীয় জমিদারদের কাছে অত্যাচারের প্রতিকার চেয়ে ব্যর্থ হয়ে তারা তৎকালীন আইনরক্ষক ও পুলিশি ব্যবস্থার দ্বারস্থ হলে সেখানেও একই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হয়। তারা মহাজন ও জমিদারদেরই সমর্থন করত, এমনকী মিথ্যা মামলায় শাস্তি দিতেও পিছপা হতো না। তাদের অত্যাচারে বহু কৃষক গ্রাম পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। সরকারি দারোগা ও পেয়াদাদের অকথ্য অত্যাচারের চিত্র উঠে আসে তাদের ছড়ায়, গানে:
কাটজীবা দারোগা কুরমটাহা পেয়াদা জিউয়ীরে দো সকগে দো বাং। দারোগা ঘোড়ার অপর টাপ টাপ কোমর পেটে পিতর পাটা পেয়াদা ঝাক ঝাক জিউয়ীরে দো সুকগে দো বাং।
(বঙ্গানুবাদ: নির্দয় দারোগা প্রতিহিংসাপরায়ণ পেয়াদা, মনে প্রাণে সুখ নেই, দারোগা ঘোড়ার ওপর টাপ টাপ যায় কোমরে পেতলের বেল্ট, পেয়াদাদের উজ্জ্বল পোষাক মনে প্রাণে সুখ নেই...) (পৃষ্ঠা: ৮৭)
সরকারি চাকুরে দারোগার জমকালো ইউনিফর্ম, কোমর বেষ্টন করে থাকা পিতলের বেল্ট—তাদের পদমর্যাদার পরিচায়ক যা সাঁওতাল জনজাতির কাছে ত্রাস হয়ে উঠেছিল। ঘোড়ার খুড়ের ধ্বনি যেন তাদের মধ্যে চারিয়ে দিচ্ছে পদাঘাতের স্মৃতি। আরেকটি দৃষ্টান্ত নেওয়া যেতে পারে:
The sub inspector of Amrapara The Daroga of Jangipur Sidu and Kanu For nothing they were bound. (পৃষ্ঠা: ৯৩)
বিনা অভিযোগে যে কোনও অজুহাতে সাঁওতালদের দড়ি দিয়ে বেঁধে কশাঘাত, জোর জুলুম করে সেলামি নেওয়া, জরিমানা করা— এগুলো ছিল খুবই পরিচিত ঘটনা। সরকারি পেয়াদা বা পদাধিকারী ভারতীয়দের ক্ষমতার অপব্যবহার ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়’ এই প্রবাদবাক্যই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৮৫৫ সালের ৭ই জুলাই দিঘি থানার দারোগা অত্যাচারী দারোগা মহেশ দত্ত ও তার সঙ্গীদের হত্যা করেই সাঁওতাল প্রতিবাদের উদ্বোধন ঘটে। গোক্ক নামে এক সম্পন্ন সাঁওতালকে মহাজনদের অন্যায় অভিযোগে গ্রেপ্তার করে নির্মমভাবে প্রহার করেছিল। প্রথম দিকে তারা প্রায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জমিদার মহাজন কিংবা দামিন-ই-কোর সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে আবেদন করে। তৎকালীন সরকার সাঁওতালদের ক্ষোভের কারণ সম্পর্কে সচেতন হলেও কোনও প্রকার ব্যবস্থা নেয়নি। ১৮৫৪ সালে লক্ষ্মীপুর সাসানের পরগানাইত বীরসিংহ মাঝি সাঁওতালদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন। এই প্রসঙ্গে সাঁওতালদের একটি গান যেন যুদ্ধের দুন্দুভি বাজিয়ে যায়:
বীরসিংহ বাজায় নাগরা
চন্নো বাজায় দুমদুমি
মেঘসিংহও বাজায় মাদল
সিদু পাঠায় শালগিরা
কান্য পাঠায় তীর আমরা এসেছি আমাদের অধিকার রাখতে। (পৃষ্ঠা: ৯২)
তাদের হুল যে ‘ক্ষ্যাপা ঝড়’ নয়, এই বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। নিম্নবর্গের শ্রেণিচেতনা যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা করেছিল, হুল হল তারই বহিঃপ্রকাশ। বীরসিংহের দল মহাজনদের কাছে আবেদন-নিবেদনের কোনও সদর্থক সাড়া না পেয়ে বাধ্যত ছয় জন মহাজনদের বাড়িতে লুণ্ঠন চালান। মহাজনরা ভীত হয়ে পাকুড় রাজার কাছে তাদের রক্ষার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পাকুড় রাজার দেওয়ান জগবন্ধু রায় বীরসিংহও মাঝি ও তাঁর অনুচরদের কাছারি বাড়িতে আটক করেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সৃষ্ট সাঁওতালদের একটি গান পাওয়া যায়:
কেনারাম ভগত শোনো সিদো আর কান্হুকে মিছামিছি বাঁধলে কেন? পাকুড়খানা আমড়াপাড়া পিরথি সিং এর আপিসে মিছেই হাকিম বাঁধলো তারে কড়া দড়ির ফাঁসে… সিদো তুমি কেন রক্তে ভেসছ কানহু তোমার বুলি শুধু হুল হুল হুল... (পৃষ্ঠা-৯০)
যে দিকুরা তাদের ভিটেমাটি-পরিবার-স্বাধীনতা বিনষ্ট করেছে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছাড়া পথ নেই। পাকুড়ের রানি ক্ষেমাসুন্দরী দেবীকে বিদ্রোহে যোগ দিতে আহ্বান জানানো হলেও তিনি অরাজি হওয়ায় পাকুড়ের রাজবাড়ি লুন্ঠন করা হয়।
হুলকে ঘিরে সাঁওতালদের গানে গভীর উন্মাদনার ছবি দেখা যায়। তাদের গানের প্রতিটি শব্দে লেগে আছে বিদ্রোহের অগ্নিদাহ্য ছোঁয়াচ। ছড়ার ছন্দের মধ্যে এমন এক অনাড়ম্বর আহ্বান কাজ করছে যা অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। যেমন:
ধানজুড়ি হে
ঢোল বাজে হে
ঢাক বাজে হে
সিদো কানহু, চাঁদ ভায়রো
হুলে হু…লে... (পৃষ্ঠা-৮৮)
নেহাতই সহজ সরল ভাষার এই ডাক সাঁওতালদের প্রাণের ভাষায় রচিত। ধীরে ধীরে বিদ্রোহ হিংসাশ্রয়ী হয়ে উঠতে শুরু করে। সরকারি কর্মচারী, নায়েব-দেওয়ান, মহাজন, জমিদার, অত্যাচারী নীলকর সাহেব, রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার— এই শ্রেণিটিই মূলত সাঁওতাল আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। বারহেতনগরে পঞ্চাশ জন মহাজন তাদের হাতে নিহত হন। গোদ্দা অঞ্চলের নীলকর সাহেব ফিজপ্যাট্রিকের ওপর গোক্ক তীব্র আক্রমণ চালায়। সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত লিটিপাড়া লুঠ করে।
এই বিদ্রোহের পরিণতিও কিছু আলাদা নয়। সিধু কানুসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারি ও ফাঁসি— ঐতিহাসিক তথ্যের এখানেই সমাপ্তি। লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, সাঁওতাল কৃষকরা তাদের ছড়ায়-গাথায়-গানে, যাদের অত্যাচার নিয়ে সরব হয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশই ভারতীয়, মূলত বাঙালি। সুতরাং, ব্রিটিশ শাসকের সমান্তরালে স্থানীয় প্রভুরাই ঔপনিবেশিক সিস্টেমের স্তম্ভ হয়ে উঠেছিল। বুদ্ধিজীবিতা যাদের পেশা নয়, জমির মালিকানা ও আর্থিক লেনদেনের মধ্যে যেসব বাঙালি ভূস্বামীদের আধিপত্যের বীজ উপ্ত হয়েছিল, তারাই রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্রিয় প্রতিনিধি।
দুই
আন্তোনিও গ্রামসি মনে করতেন নিম্নবর্গের শ্রেণিচেতনার পরিবর্তনের গতিপথ অনুধাবনের জন্য তাদের জীবনযাত্রা, ভাবাদর্শ ও আচার আচরণকে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। সাঁওতালরা আদিম দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর অংশ। আর্য আগমনের পূর্বে তাদের ছন্দোময় মেঠো জীবন ভারতকে সুফলা করেছে। ভারতবর্ষ বস্তুত দ্রাবিড়ভূমি, সেকথা তাদের গানেও পাওয়া যায়:
এই অরণ্য ও মাটির প্রথম সন্তানদের
একজন, একজন, একজন, আমরা
সভ্যতা আমাদের হাত ধরে কালো জঙ্গলে ঢুকেছিল
তাই—
আজ আমরা চলেছি আমাদের অধিকার রাখতে। (পৃ ১০২)
বিদ্রোহের সুদীর্ঘ টানেলের শেষ প্রান্তে আলোই আছে— এই অতি সরলীকৃত বিশ্বাসের পিছনে কাজ করেছে তাদের গোষ্ঠীগত ধর্মবিশ্বাস। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে সাঁওতাল জনমানসে এক অলৌকিক কাহিনি প্রচারিত হয়। কাহিনিটি খানিকটা এইরকম: দেবতা ভিন্ন ভিন্ন রূপধারণ করে প্রকট হয়েছেন। মেঘরূপে, অগ্নিশিখারূপে, আবৃত-মস্তক এক মূর্তির রূপে, প্রকাশ্য সূর্যালোকে, ভূগর্ভ থেকে উত্থিত পর্বতের রূপে, শালগাছের মূর্তিতে, সবশেষে সাঁওতালের মতো বস্ত্র পরিহিত এক শ্বেতাঙ্গ মূর্তি ধারণ করলেন। এটিই ছিল যুদ্ধের সপক্ষে যুদ্ধের সংকেত। জানা যায়, সাঁওতালরা সব গৃহে শালবৃক্ষের শাখা প্রেরণ করে যুদ্ধের আহ্বান করেছিলেন। সম্ভবত, শালগাছ মুণ্ডা ও সাঁওতালদের রক্ষক অর্থাৎ আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক। সিধু-কানু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মানুষের মধ্যে উপরোক্ত কাহিনি ছাড়াও আরও এক আধ্যাত্মিক কাহিনি চারিয়ে দেয়। রাত্রে সিধু কানু যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন সেই সময় সাঁওতালী পোশাক পরিহিত এক শ্বেতাঙ্গ ঠাকুর উপস্থিত হয়েছেন, যার প্রতি হাতে দশটি করে আঙুল। হাতে সাদা রঙের বই। সেই বই এবং কুড়ি টুকরো কাগজ দুই ভাইকে দিয়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। খানিকক্ষণ পর দুজন মানুষ এসে ঈশ্বরপ্রেরিত এই নির্দেশের ব্যাখ্যা দিয়ে যান। সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরবের দৈবী মহিমা সাঁওতাল গণমানসে এক গভীর আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করেছিল। ঘোড়সওয়ার ন্যায়দাতা বীর যোদ্ধা সিধু কানু যেন ঈশ্বরের প্রতিরূপ। এমনই লোকবিশ্বাস তাদের ছড়ায় উঠে আসে:
সিদো কানহু খুড়খুড়ি ভিতরে
চাঁদ ভায়রো ঘোড়া উপরে
দেখ সে রে! চাঁদরে! ভায়রোরে
ঘোড়া ভায়রোরে মুলিনে মুলিনে।
কিংবা,
সিদো আর কানহু পালকিতে
চাঁদ আর ভেরো ঘোড়ার পিঠে…
পরবর্তী সময়ে, সিধুর জন্মবৃত্তান্ত খ্রিস্টভাবাপন্ন সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানসে যীশুর জন্মকাহিনির আদলে গড়ে ওঠে। সাঁওতাল বিদ্রোহ চলাকালীন ‘সমাচার সুধাবর্ষণ’ পত্রিকায় ১৮৫৫ সালের ১৩ আগস্ট একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। সেখানে সিধু কানুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অলৌকিক কাহিনির পরিচয় পাওয়া যায়। কবিতাটিতে বলা হয়েছে অষ্টমবর্ষীয়া এক কন্যা বিধাতার আশীর্বাদে ভূমিষ্ঠ হয়েছে:
রূপে গুণে অবিকল য প্রকাশ যীশু।।
ভূমিষ্ঠ হইলে এই দৈববাণী হয়,
শুনরে সন্তালকুল হইয়া নির্ভয়।।
ঈশ্বরাংশে অবতার জন্মিলেন যিনি,
পৃথিবীর সর্বভার হরিবেন তিনি।।
বিদেশি শাসনে পৃথিবী ‘মেলচ্ছাক্রান্তা’ হয়ে উঠেছে, তাই এই শিশুকে অভিষিক্ত করে তার পূজায় অস্ত্র ধারণ করতে হবে। হুল ছিল তাদের ধর্মরক্ষার লড়াই। ইংরেজ সরকার বিদেশি বিজাতীয় হয়েও তাদের ভূমি অধিকার করে রেখেছে, আবার বলছে সাঁওতালরাই ঈশ্বরবিরোধী নাস্তিক। স্বধর্ম ও স্বাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই ছিল বিদ্রোহের মূল অনুঘটক। তাদের গানে উল্লেখ আছে:
ইংরাজ সরকার আবো দিশম
মেতাবোন কো সাঁওতাল বিদিন...
(বঙ্গানুবাদ: ইংরাজ সরকার বলে আমাদের দেশ
আমাদের বলে সাঁওতাল নাস্তিক...) (পৃ: ১০০)
আরও একটি গানে বিদ্রোহের লক্ষ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। সেখানে বলা হচ্ছে স্বজাতির জন্য এই রক্তস্নাত দ্রোহ। দস্যু বণিকরা অন্যায়ভাবে দেশ লুণ্ঠন করছে। মাতৃভূমিকে সাম্রাজ্যবাদী বণিকদের হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সাঁওতাল নেতা সিধু-কানুর রক্তাক্ত বেশধারণ। এইসব গানে এক হয়ে যায় উপজাতিগত স্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ। যেমন:
জৌত ভাই ক লৌগিৎ
মায়ামতে, দঞনুমেন
বেপারীয়া কোম্বড়ো হায়রে
দিশম দক হুহী।
(বঙ্গানুবাদ: জাত ভাইদের জন্য আমি রক্তে স্নান করেছি
দস্যু ব্যবসায়ীরা আমাদের দেশ লুণ্ঠন করেছে।)
কিংবা,
দেশের লেগে অঙ্গে মোদের রক্তে রাঙা বেশ
জাননা কি দস্যু বণিক লুটলো সোনার দেশ।।
শিক্ষিত সংস্কৃতিবান বাঙালির কাছে তখনও জাতীয়তাবাদের চেহারা স্পষ্ট নয়। ব্রিটিশ যুগ শুরু হওয়ার আগে সুদীর্ঘ ইসলামিক শাসনপর্ব হিন্দু বাঙালির কাছে পরাজয় ও নিরাপত্তাহীনতার সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। মুসলমান শাসকদের বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাংস্কৃতিক পার্থক্য বাঙালিদের কাছে মুসলমান ভীতি সৃষ্টি করেছিল, তার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ‘জাতীয়তাবাদ’ তাদের কাছে হিন্দুত্ববাদ হিসেবেই প্রতিফলিত হয়েছিল। অন্যদিকে, মুসলমান শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করার পর রাজনৈতিক স্বার্থে ইংরেজরা রাজকর্মচারী তথা মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী শ্রেণি তৈরি করল, তারা শিক্ষিত ও রাজনীতি-সচেতন হলেও সংকীর্ণ জাতিস্বার্থের বাইরে কিছুই ভাবতে পারেনি। বস্তুত, মুসলমান শাসনের পাঁচ-ছয়শো বছরের ইতিবৃত্ত আনলার্ন করে জাতীয়তার বৃহত্তর ছবিটি বুঝতে বাঙালির প্রায় এক শতাব্দী লেগে গেছে। শেষ মোগল বাদশা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের পরাজয় নিয়ে লেখা ‘যুদ্ধ-শান্তি’ কবিতায় এই সময়ের বাঙালির মানসিকতা চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছিলেন ঈশ্বরগুপ্ত:
সাধু সাধু ধর্ম্মরাজ বলি হারি যাই,
ঘুচাইল যত কিছু আপদ বালাই রে।
ব্রিটিশের জয় জয় বল সবে ভাই রে।
ফলত সাঁওতাল বিদ্রোহের মতো কৃষক বিদ্রোহগুলিকে তারা ইংরেজ সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধকতা হিসেবেই চিহ্নিত করেছিল। সমকালীন সংবাদপত্রে সাঁওতাল বিদ্রোহের যে ইতিহাস আমরা পাই, তা তথ্যগত দিক থেকে সাঁওতালদের নিজেদের ভাষ্যের সঙ্গে মিলে গেলেও দৃষ্টিকোণ সম্পূর্ণ বিপরীত। ঔপনিবেশিক সরকারের প্রতি শিক্ষিত বাঙালির অর্থনৈতিক নির্ভরতার পাশাপাশি সামাজিক প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ রাখার তাগিদও ক্রিয়াশীল হয়েছিল। নিম্নবর্গের পাঠ আমরা আগেই আলোচনা করেছি, এই অংশে উচ্চবর্গের দৃষ্টিকোণটি দেখে নেওয়া যাক। রাজমহল মহকুমার চৌধুরী ধনকৃষ্ণ রুজ একটি কবিতায় সাঁওতালদের ‘অসভ্য বর্বর’ বলে অভিহিত করছেন:
সাঁওতাল জাতি নামে,
বাস করে অল্প কৃষি করে খায়।
অসভ্য বর্বর অতি বুদ্ধি নাই ঘটে,
ভবিষ্যৎ না ভাবিয়া সেই পথে ছুটে।
সাঁওতালদের বঞ্চনার ইতিহাস তাঁর অজানা ছিল না, তাদের সরলতা হয়ে উঠেছে তাঁর বিদ্রূপের সহজলক্ষ্য। বাঙালি ও উত্তর ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ‘বুদ্ধি বলে’ তাদের সবকিছু লুণ্ঠন করেছে— এই আপ্তবাক্য স্বীকার করে নিয়েও সিধু-কানুর সংগ্রামকে ‘বুজরুকি’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখছেন:
এই দুই সহোদর যুক্তি করি মনে,
নিজ সম গুণধর
জোটাই যে সহচর
আরম্ভিল বুজরুকি আপন মনে…
সাঁওতাল প্রজাদের অলৌকিক ঘন্টাধ্বনি শুনিয়ে সিধু কানু বিদ্রোহে প্ররোচনা দিল— এমনই পাঠ পাওয়া যায় তাঁর কবিতায়। এখানেই উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের কৃষ্টি ও লোকবিশ্বাসগত পার্থক্যটি স্পষ্ট হয়ে যায়। আন্তোনিও গ্রামসি বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে জানিয়েছেন, যে কোনও শ্রেণির সাংগঠনিক কাজই হল নিজস্ব বুদ্ধিজীবী গড়ে তোলা ও তাদের লালন করা। পুঁজিবাদী সোশ্যাল সিস্টেমও নিজেদের অনুকূলে থাকা কিছু বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর কাঠামো তৈরি করে, যারা হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীনের মুখপত্র। উনিশ শতকে বাঙালি কবি-সাহিত্যিকরা এইভাবেই শাসকের পাপেট হয়ে উঠেছিল। ফলত, পূর্বোক্ত কবিতাটিতে মহাজনদের অত্যাচারের পরিবর্তে প্রত্যাশিতভাবেই উঠে আসে সাঁওতালদের লুঠপাটের ইতিবৃত্ত:
পৌঁছিল সাঁওতাল সবে, উচ্চরবে, মহেশপুরে গিয়ে। লুটিল দুষ্টচয়, রাজালয়ে, ধনরত্ন নিল। নিল নিল সব রেশমী-বসন, স্বর্ণভূষণ যেখানে যা ছিল।।
অবশেষে বিদ্রোহ-দমনের পর স্বস্তির নিঃশ্বাস নেমে এসেছে এবং কবিতার উপসংহারে এসেছে রাজানুগত্যের উপদেশসহ ব্রিটিশ সরকারের জয়গান। রায়কৃষ্ণ দাসের ‘সাঁওতাল হাঙ্গামার ছড়া’-তেও একই কাহিনি চোখে পড়ে। এখানে সাঁওতালদের গণহত্যার কাণ্ডারী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মহাজনী অত্যাচারের চিত্র সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে, সাঁওতালরা কীভাবে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, সেটিই হয়ে উঠেছে মুখ্য:
বেচারামকে কেটে বেটাদের রক্তমুখো সব, আর কি হাকিম মানে, বনে বনে রাস্তা পেয়ে সোজা। সাদিপুরে লুটে গিয়ে কাপড়ের বোঝা… যাও সব জোহালখানা, দিব থানা, মুক্ত করব চোরে শুভবাবু রাজা হবে, জজ সাহেবকে মেরে।
এইভাবে ইতিহাসের পাঠ বদলে যায়। শাসকের চেয়েও শাসকসৃষ্ট বুদ্ধিবাদীদের ঢক্কানিনাদে চাপা পড়ে যায় নিম্নবর্গের স্বর ও প্রতিরোধ। ‘সমাচার সুধাবর্ষণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে পাকুড়, মহেশপুর গ্রাম-লুন্ঠনের রিপোর্ট। ইংরেজ সেনা আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগ করেও সাঁওতালদের দমন করতে পারছে না, তাই বাঙালিরা আশঙ্কিত। ১৮৫৫ সালের ১৫ আগস্ট লেখা হচ্ছে ‘এ উৎপাত কবে যাইবেক, সন্তালকুলের সর্ব্বনাশ হোক’। ২২ আগস্ট রাণীগঞ্জ থেকে লেখা হচ্ছে সাঁওতালরা এত পরিমাণ খাবার ও অর্থ সংগ্রহ করেছে, যে তাদের দমন না করলে পুনরায় অত্যাচার করবে। প্রবল আনুগত্যের পরিচয় দিয়ে শ্রেণিস্বার্থকে সুরক্ষিত করতে ব্রিটিশ শাসকের ছদ্ম সমালোচনার সুরও দুর্লভ নয়: ‘এতদ্দেশীয় কোন স্বাধীন রাজ্যেশ্বর যদি সামান্য বন্যজাতির হস্তে এ প্রকার পরাস্ত হইতেন তাহলে লজ্জায় মুখ দেখাইতে পারিতেন না, ব্রিটীশ জাতির লজ্জা নাই এই কারণে তাঁহারদিগের আহার পরিপাক পাইতেছে…হিন্দু জাতির ন্যায় শান্ত জাতি কোথায় পাইবেন, হিন্দু জাতি রাজবিরুদ্ধাচারী নহেন বরং রাজকুলের মঙ্গল চেষ্টা করেন…’ (পৃষ্ঠা: ১১৩)
গ্রামসি দেখিয়েছেন, গতানুগতিক বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম কাজ হল— রাষ্ট্রের ক্ষমতা-প্রয়োগকে জনসমর্থন জোগানো এবং তাদের কাজকে ন্যায্যতা দেওয়া। উনিশ শতকীয় শিক্ষিত বাঙালি ঠিক এই ভূমিকাই গ্রহণ করেছিল। অন্যদিকে, সাঁওতাল গীতিকার-ছড়াকাররা হয়ে উঠেছিলেন নিম্নবর্গের মুখ। তাদেরই ছড়িয়ে দেওয়া স্বাধীনতার আদর্শ প্রথমে, এক ক্ষুদ্র সম্প্রদায়কে এবং পরবর্তী শতকে সমগ্র ভারতবর্ষের ইতিহাসে জাতীয়তাবাদকে সুনির্দিষ্ট পথে চালনা করেছিল। তাঁরাই গ্রামসি কথিত জৈব বুদ্ধিজীবী, যাঁরা নিজেদের শ্রেণিচেতনাকে স্পষ্ট রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সক্রিয় সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। ছড়া, গাথা ও গানগুলিই হয়ে উঠেছে সাঁওতাল বিপ্লবের বাহন।
গ্রন্থঋণ:
১. ডঃ রণজিৎ কুমার সমাদ্দার: ‘সাঁওতাল গণযুদ্ধ ও বাংলা সাহিত্য’: চ্যাটার্জী পাবলিশার্স: কলকাতা: প্রথম প্রকাশ, আশ্বিন ১৩৬২ (প্রবন্ধে ব্যবহৃত উদ্ধৃতি উক্ত গ্রন্থ থেকে গৃহীত)
২. আলতাফ পারভেজ: ‘গ্রামসি ও তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা’: প্রথমা: ঢাকা: প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০২১: তৃতীয় মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০২১