সন্তোষ কুমার পাল
বর্তমান প্রবন্ধে আমি ফ্যাসিবাদের মতাদর্শ তথা ‘দর্শন’ বিচারে মনোনিবেশ করছি। কিন্তু ফ্যাসিবাদ কী এবং বর্তমানে তৎসম্পর্কিত আলোচনা কেন জরুরি সে কথা না তুলে সরাসরি ফ্যাসিবাদের দর্শনের আলোচনায় প্রবেশ করা সমীচীন নয়। তাই একটু বিস্তারিত গৌরচন্দ্রিকা করেই ফ্যাসিবাদের দার্শনিকতা বিচারে প্রবেশ করব।
যে কথা না বললেই নয়
‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটি এসেছে ইতালির নিন্দিত একনায়ক বেনিতো মুসোলিনি (Benito Mussolini)-র রাজনৈতিক সংগঠন ‘Fascio’ (বহুবচনে ‘Fasci’) থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ ‘গুচ্ছ’, বিকল্প নিহিতার্থে ‘ভ্রাতৃত্ব’। প্রাচীন রোমে ‘এলম’ বা তজ্জাতীয় গাছের লম্বা কয়েকটি ডাল একসাথে আঁটোসাঁটো করে বেঁধে উপরের দিকে একটি টাঙ্গি বা কুঠার শক্ত করে আটকানো থাকত, শাস্তিদণ্ড হিসেবে যা ব্যবহৃত হত। এই শাসন-দণ্ডকে মুসোলিনি তাঁর রাজনৈতিক দলের প্রতীক হিসেবে নির্দিষ্ট করেছিলেন। [প্রসঙ্গত, হিটলার ‘স্বস্তিকা’ চিহ্নকে ব্যবহার করেছেন তাঁর রাজনীতির সিম্বল হিসেবে। অনেক ইউরোপীয় পণ্ডিত মনে করেন ইউরোপ ও এশিয়া জুড়ে বিকশিত আর্য-সংস্কৃতির সঙ্গে এই ট্যাগটি সংশ্লিষ্ট। এই সিম্বলটিকে স্বাভিমানী জাতিবাদীরা ‘আর্য-পরিচিতি’-র চিহ্ন হিসাবে ব্যবহার করেন। জার্মান জাতির উৎকৃষ্টতার সিম্বল হিসাবে হিটলার এটিকে ব্যবহার করেছেন, যাকে আমরা হিন্দুরা শান্তি-সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করি, (যদিও এখন হিন্দুত্ববাদীরা একে জার্মানদের মতো করে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে।)] যাই হোক, ‘বামপন্থী’ ও ‘দক্ষিণপন্থী’ পরিভাষার ব্যবহার ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই আমরা লক্ষ করি, যেখানে ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটির প্রথম প্রয়োগ আমরা পাই ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের পরে। প্রাথমিকভাবে তৎকালীন ইউরোপের যুদ্ধের সমর্থক উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলিকে বোঝাতে শব্দটি সামনে আসে। মুসোলিনি ও হিটলারের যে ‘ক্লাসিকাল!’ ফ্যাসিবাদ সেখানে যেসব সংজ্ঞার্থজ্ঞাপক বৈশিষ্ট্য আমরা লক্ষ করেছি তাদের তুলনায় এই সংগঠনগুলিকে ‘প্রোটো-ফ্যাসিস্ট’ বলা বেশি যুক্তিযুক্ত। আর একটি বিষম লাগার কথা: অ্যাডলফ হিটলার তো নাৎসিবাদ (Nazism)-এর সাধক। তাহলে তাঁকে ফ্যাসিবাদী বলা কেন! হাঁ, ঠিকই ধরছেন। এদের মধ্যে খুঁটিনাটি বিষয়ে পার্থক্য আছে। আসলে ফ্যাসিবাদ হচ্ছে একটি ‘জেনেরিক’ নাম, নাৎসিবাদ বা ইসলামো-ফ্যাসিবাদ১ বা হিন্দুত্ববাদ তার এক একটি দৃষ্টান্তস্থল। আজকের পরিভাষায় আমরা ফ্যাসিবাদকে ‘মহাবিষয়’ (metanarrative) বলতে পারি। ইহুদি-বিদ্বেষ তথা রক্তের বিশুদ্ধতার যে ভয়ংকর প্রকরণ আমরা নাৎসিবাদে লক্ষ করেছি মুসোলিনির ফ্যাসিবাদে তা ছিল না, যদিও পরের দিকে বন্ধু হিটলারের অনুপ্রেরণায় ইহুদি-বিদ্বেষকে তাঁর রাজনীতিতে কিছুটা স্থান করে দিয়েছিলেন মুসোলিনি!
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মুসোলিনির রাজনৈতিক দল ‘ফ্যাসিও দ্য কমবাত্তিমেন্তো’ প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যর্থ হয়। পরে ১৯২১-এ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ‘ন ‘ন্যাশানাল ফ্যাসিস্ট পার্টি’ গঠন করেন। ইতালির বেশ কিছু অঞ্চলে এই নতুন সংগঠন প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়। এই সময় ‘ব্লাক শার্ট’ নামে একটি ঝটিকা-বাহিনী গঠন করে রোম দখলের হুমকি ছাড়েন তিনি। যদিও বাস্তবিক তাঁর ‘রোম মার্চ’ রোম দখল করেনি, তথাপি তাঁর এই প্রতীকী শক্তিপ্রদর্শন তাঁকে প্রকৃত শক্তি অর্জন করতে অকল্পনীয়ভাবে সাহায্য করে। তৎকালীন রাজা তৃতীয় ইম্যানুয়েল তাঁকে কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে আমন্ত্রণ জানান। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর মুসোলিনি কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। চরম ফ্যাসিস্ট একনায়ক হিসেবে বিশ্ব-(কু)খ্যাত হতে তাঁর আর তিন/ চার বছর সময় লেগেছিল।
হিটলারের ‘শুরুয়াত’
এদিকে ‘মনের মানুষ’ মুসোলিনির এই অভাবনীয় সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে হিটলার তাঁর নাৎসি-ভাবাদর্শ সংহতকরণে মনোযোগী হন। অবশ্য এর আগেই তিনি প্রথমে ‘জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’, পরে ‘ন্যাশানা সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি’ (NAZI যার সংক্ষিপ্ত ডাক নাম) গড়ে তোলেন। প্রথমে সমাজতন্ত্রের নাম করে, পরবর্তীতে জাতিভিত্তিক জনসম্প্রদায় (এখানে কেবল অবিমিশ্রিত জার্মান জাতি) তত্ত্ব (das Volk)-কে সামনে এনে ইহুদি-নিধন সহ ভয়ংকর রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম শুরু করেন। এই জাতিতত্ত্ব অনুসারে জার্মান জন-গোষ্ঠীই পৃথিবীর সর্বোত্তম নৃগোষ্ঠী, এবং এই সত্যকে সামনে রেখেই সামাজিকতা তথা নৈতিকতা বিচার্য হত। অর্থাৎ যা কিছু জার্মান জাতির উন্নয়ন ও সংরক্ষণের স্বার্থে তাই সঠিক, নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। (আমাদের দেশে ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারির শীতে খ্রিস্টান মিশনারি গ্রাহাম স্টেইনকে তাঁর দুই সন্তান সহ এক সংগঠনের উন্মত্ত জনতার পুড়িয়ে মারা বা ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে নিছক গো-হত্যার সন্দেহে উত্তর প্রদেশের দাদরির সন্নিকট বিশাড়া গ্রামে মহম্মদ একলাখকে পিটিয়ে মারার ঘটনার কথা আপনার স্মরণে আসতে পারে!) যদিও নির্বাচনি রাজনীতি তথা গণতান্ত্রিক উপায়েই (এবং জাতীয় সমাজতন্ত্রের কথা বলে!) তাঁর ক্ষমতা লাভ, তথাপি জার্মানির প্রজাতান্ত্রিক সংবিধানের প্রতি তাঁর কোনোই শ্রদ্ধা ছিল না।
ফ্যাসিবাদের আন্তর্জাতিকতা
আগেই বলেছি, ফ্যাসিবাদের কোনো এক সর্বজনীন মডেল নেই, যদিও এই উদ্দেশ্যে ১৯৩৪-এ ইতালির মন্ট্রিউক্সে আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডাকা হয়েছিল। হিসেবমতো সেই সময় কমবেশি ৩০টি দেশে গণতন্ত্র-বিরোধী ফ্যাসিবাদী রাজনীতির চর্চা ছিল। অনেকেই এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করলেও জাতি-বিদ্বেষ, কর্পোরেট ব্যবস্থা ইত্যাদি প্রশ্নে তাঁরা সহমত হতে পারেননি। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিস্ট শাসন ছিল। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, আমরা কয়েকটি দেশের কথা এখানে লিপিবদ্ধ করছি: ইতালিতে ১৯২২-৪৫, জার্মানিতে ১৯৩৩-৪৫, স্পেনে ১৯৩৬-৭৫, জাপানে ১৯২৬-৪৫, অস্ট্রিয়ায় ১৯৩৩-৪৫, ব্রাজিলে ১৯৩২-৩৮, চিনে ১৯৪০-৪৫, ফ্রান্সে ১৯৪০-৪৪, পর্তুগালে ১৯৩৩-৭৪ ফ্যাসিবাদী সরকার ছিল। এখানে স্মর্তব্য, ভারতবর্ষ সহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে নতুন নতুন ‘মিউটেটেড মডিউলে’ এখনও ফ্যাসিবাদের চর্চা চলছে।
কীভাবে চিনব ফ্যাসিবাদ?
যদিও ফ্যাসিবাদের সর্বজনমান্য কোনো সংজ্ঞা নেই, তথাপি এই বিকৃত রাজনীতির ভাবাদর্শ ও অনুশীলন পদ্ধতির কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন কয়েকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তথা দার্শনিক। আমি এখানে প্রধানত আর্নস্ট নোলটে ও শোভনলাল দত্তগুপ্তকে অনুসরণ করে২ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরব।
নোলটে ন্যূনতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে তুলে ধরেছেন ফ্যাসিবাদের মার্কসবাদ-বিরোধিতা, বামপন্থা তথা উদারনীতিবাদের প্রতি অশ্রদ্ধা, যুদ্ধোন্মত্ততা, জনমোহিনী একনায়ক (যাকে আমরা বলি, ক্যারিস্মাটিক লিডার, ‘নন্-বায়োলজিক্যাল’ ওরিজিন হলে আরও ভালো!), তাঁর প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যের সংগঠন-নীতি, পার্টির সেনাবাহিনী তৈরি, রাষ্ট্রের সর্বময়তা (totalitarianism), অতীত গরিমার উগ্র জাতীয়তাবাদ, অতিরিক্ত কর্পোরেট-প্রীতি, বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীকে শত্রু-বানানো (যেমন হিটলারের অ্যান্টি-সেমিটিজম বা ইহুদি-বিদ্বেষ বা হিন্দুত্ববাদীর মুসলিম বিদ্বেষ) বা অন্য ভাষায়, অপরায়ন– এই সব আর কি। একটু ঘুরিয়ে বললে, এ পর্যন্ত যেসব রাজনৈতিক তথা রাষ্ট্রনৈতিক ভাবনা সমাদৃত হয়েছে, বা অন্তত মন্দের ভালো বলে গৃহীত হয়েছে, সেগুলি সবই পরিত্যাগ করার কথা বলে, নয়তো সরাসরি বিরোধিতা করে এই ফ্যাসিবাদ। সঙ্গে থাকে ব্যাপক মিথ্যা-প্রচারের কারুকার্য, নির্জলা মিথ্যা থেকে শুরু করে সত্যের অপলাপ ও দায়িত্বজ্ঞানহীন ভয়ংকর পোস্ট-ট্রুথের আখ্যান-নির্মাণ। তাই এই মতাদর্শকে ভালো করে আপাদমস্তক জরিপ করে নেওয়া শিক্ষিত তথা দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে আমাদের অবশ্য কর্তব্য এবং ছাত্র-ছাত্রীসহ জনগণের কাছে তার প্রকৃত চেহারা তুলে ধরার আমাদের দায়িত্ব।
ফ্যাসিবাদ কবরস্থ! আবার কেন তাকে টেনে তোলা?
অনেকে মনে করেন, ফ্যাসিবাদ বা নাৎসিবাদ ইতিহাসের বিভ্রম, যার জন্য দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গেছে। দুর্যোগের মেঘ কেটে গেছে। ফ্যাসিবাদ কবরস্থ। তাই এসব নিয়ে দুশ্চিন্তার আর কী আছে! কেউ মনে করতে পারেন, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যেকার যে দ্বন্দ্ব আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তারই বাই-প্রোডাক্ট হল ফ্যাসিবাদের এই সাময়িক ভ্রমবিলাস! এখন এসব নিয়ে মাথা-ঘামানোর কোনো মানে হয় না, বৃথা কালক্ষেপ! কিন্তু, অনিল আচার্য, শোভনলালবাবুরা আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন: ‘আসলে গণতন্ত্রের মধ্য থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে যদি ইতালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ কায়েম হতে পারে তাহলে যেকোনো ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ফ্যাসিবাদ তেড়েফুঁড়ে উঠতে পারবে না কেন?’৩ আসলে ফ্যাসিবাদের এই প্রলক্ষণগুলির বিনাশ তো ঘটেই না, যুগে যুগে তা ভাইরাসের মতো ‘মিউটেট’ করে নব নব রূপে আবির্ভূত হতে থাকে। কখনও কখনও একটু আধটু রেখে-ঢেকে ফেস-লিফ্ট করে সামনে আনা হয়। বর্তমানে আমাদের মাতৃভূমির দিকে তাকালে এর সত্যতা অনেকটা বোঝা যায়।
কেউ কেউ আবার ভাবেন, ফ্যাসিবাদ জোর করে অগণন দেশবাসীর উপর চাপিয়ে দেওয়া একটা সামরিক শাসন মাত্র, এ ব্যবস্থা বেশি দিন টেকে না! ভুল, ভুল বিচার! একথা ঠিক যে শুধু বেয়নেট আর আইনকানুন দিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসন বেশি দিন চলে না, চালানো হয়ও না। প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন ও সম্মতি নিয়েই চলে এই ব্যবস্থা। সম্মতি-সমর্থন না থাকলে হিটলারের ‘লেবেনসবর্ন’ কর্মসূচি কি সফল হতে পারত? এই কর্মসূচি জাতি হিসেবে আর্যত্বের ভয়ংকর স্বাভিমান ও উৎকৃষ্ট মানব-সৃষ্টির আপত্তিকর হিটলারি মতাদর্শ, ‘এভরিথিং ফর দ্য হেলদি চাইল্ড’-এর স্লোগান বিবাহিত-অবিবাহিত যুবতিদের ‘সুৎসটাফেল’ (Schutzstaffel: SS)-সদস্যদের সঙ্গে শয্যাগ্রহণ ও উন্নত আর্য-সন্তানের জন্ম দিতে যেভাবে প্রণোদিত করেছিল তা ভাবলে শিহরিত হতে হয়। পক্ষান্তরে, যারা এই মহৎ আর্য সন্তানের জন্মদানে যোগ্য নয় বলে নাৎসিরা ভেবেছিল তাদের হয় স্টেরিলাইজড করা হয়েছিল, নয়তো গর্ভনাশে বাধ্য করা হয়েছিল। ইতিহাসের নিরিখে খণ্ডকালের জন্য হলেও কোনও এক ধরনের সম্মতি না থাকলে এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হতে পারত না।
যাই হোক, এই সম্মতি আদায়ের কত যে ব্যবস্থা আছে সে আমরা শিখেছি লুইস আলথুজের, আন্তনিয়ো গ্রামশি প্রমুখ মার্কসবাদী তাত্ত্বিকদের কাছ থেকে। নাগরিকদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ তথা আবেগ-অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে এক ধরনের সম্মতি আদায় করে নিয়েই তাদের ফ্যাসিবাদের চাষাবাদ চলতে থাকে। গ্রামশির হেজিমনির দর্শন আত্মস্থ করে হোয়াটসঅ্যাপ য়ুনিভার্সিটি খোলা, মিডিয়ার দখল নেওয়া, শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের সব শীর্ষপদ নিজেদের জিম্মায় নেওয়া, আরও কত কী চলছে আমরা দেখছি! কত বুদ্ধিজীবী, কথিত রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চিত্রপরিচালক প্রাণপাত করছেন এই পোস্ট-ট্রুথের বাজার তথা ডানপন্থী রাজনীতি চলমান রাখতে। এই মন্দ বিশ্বাস এতটাই জনসাধারণকে প্রভাবিত করে যে সামনের বছরে তার কষ্টার্জিত চাকরিটা থাকবে কিনা, দেশের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য কমবে কিনা, তার সন্তান-সন্ততি বাসযোগ্য একটি দেশ পাবে কিনা– এসব ভাবনা পিছনের সারিতে চলে যায়। আর এই শনি-পথেই নানা মুখোশে ‘অতিমানব’ হিটলারদের ক্ষমতা দখল।
দর্শন ও মতাদর্শ
প্রথমে যে প্রশ্নটি সামনে আসে তাহল, ফ্যাসিবাদ কে আদৌ কি কোনো ‘দর্শন’? একে খুব বেশি হলে ‘মতাদর্শ’ বলা যেতে পারে, এবং সেখানেও তার আগে একটি বিশেষণ ‘মন্দ’ জুড়ে দেওয়া উচিত। এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে ‘দর্শন’ (philosophy)-এর সঙ্গে ‘মতাদর্শ’ (ideology)-এর পার্থক্য একটু বলে নেওয়া ভালো। ’দর্শন’ কথাটি অনেক অনেক পুরানো। জ্ঞানের প্রতি অনুরাগ বা সত্যদর্শন– যেভাবেই বলুন না কেন– দর্শনের এক আদর্শনিষ্ঠতা ও সর্বজনীনতার ছাপ আছে। অন্য দিকে ‘মতাদর্শ’ (ideology) কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন অ্যান্তোনি দেসত্তুৎ দ্য ত্রেস (Antoine Desttut de Trace) ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ‘ধারণাগুচ্ছের বিজ্ঞান’ (a science of ideas) অর্থে কথাটিকে বুঝতে চেয়েছেন। জনসাধারণের প্রবৃত্তি-তাড়িত চিন্তাধারার বিপরীতে ধারণাগুচ্ছের যুক্তিঋদ্ধ এক তন্ত্র (a rational system of ideas)-কে বোঝাতে ‘আইডিয়োলজি’ পরিভাষাটি ব্যবহার করেন তিনি। এই আইডিয়োলজি বা মতাদর্শ দর্শন থেকে কিঞ্চিৎ আলাদা। সাবেক দর্শন যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে সত্যের অনুসন্ধানে নিয়োজিত থাকে। অন্য দিকে, মতাদর্শ এক বিশ্বাসগুচ্ছ, যা বহির্জগতে কোন রাডিক্যাল পরিবর্তন সাধনের জন্য রচিত হয়, এবং তাই তার বাস্তবায়নের জন্য নির্দিষ্ট কর্ম-পবিকল্পনা থাকে। চিন্তনের সঙ্গে ফিলিং-উইলিং যুক্ত হলে তবেই মানুষ কর্মতৎপর হয়। এজন্য মতাদর্শের প্রচারকেরা আমাদের শুধু যুক্তিবত্তাকেই নয়, ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতিকে তাদের পক্ষে আনতে চেষ্টা করে। এখন, এই ভাবাবেগ যদি যুক্তিসিদ্ধ হয়, ভালো হয়, জীবন ও জগতের প্রগতির সূচক হয় তাহলে তাকে ‘ফলিত দর্শন’ (applied philosophy) বলে মেনে নিতে অসুবিধা নেই। কিন্তু তা না হয়ে যদি জীবনকে বিধ্বস্ত করে, সমাজকে পিছনের দিকে টানে তাহলে তা মতাদর্শ হলেও দর্শন নয়। তবে এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করা সব সময় সহজ নয়। চিন্তা-চেতনার দখলদারির ব্যাপারে তারা অনেক সময় এক বিন্দুতে মিলে যেতে পারে। অন্যভাবে বললে, আবেগ-অনুভূতির প্রাবল্যে মতাদর্শ যেমন আমাদের বিপথগামী করতে পারে, তেমনি ভাববাদের বিশুদ্ধ (আরাম-কেদারা-)চিন্তাজাত দর্শনও আমাদের সমস্যায় ফেলতে পারে। ব্যক্তার্থ, কোনো কোনো দর্শনতত্ত্বও যখন যুক্তি-প্রমাণের বাঁধন ছিন্ন করে যায় তখন তা মন্দ দর্শন (bad philosophy)-এও পরিণতি লাভ করতে পারে, এবং পরোক্ষে দারিদ্র্য, বর্ণবাদ ও জাতপাতের মতো অকল্যাণকেও সমর্থন করে বসতে পারে। তবে যথার্থ দর্শনের ক্ষেত্রে যুক্তির দরজা প্রায়শই উন্মুক্ত থাকে, যেখানে মতাদর্শ আমাদের বিচারবুদ্ধিকে অকেজো করে দিতে পারে। এজন্য বেশ কিছু মতাদর্শ আমাদের ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়, বিপথগামী করে। তবে আগেই বলেছি, সুস্থ প্রগতিশীল উত্তম বিশ্বাসগুচ্ছের মতাদর্শ আবার ফলিত দর্শনে পরিণতি লাভ করতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বেশ কিছু শিক্ষিত ভারতীয় বলে থাকেন, ভারতীয় সংস্কৃতি তথা দর্শনের সবকিছু ভালো, পাশ্চাত্যের সবকিছু খারাপ! বা বস্তুবাদ খারাপ, অধ্যাত্মবাদ ভালো!– এই ধরনের ভাবনাকে মতাদর্শ বলাই শ্রেয়। আর যাঁরা যুক্তি-প্রমাণ সাথে নিয়ে, সামগ্রিক মানব-কল্যাণের নিরিখে এসব বিচার-বিশ্লেষণ করেন তাঁরা দর্শন-চর্চা করছেন বলতে পারি।
এই আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, সাধারণ বিচারে ফ্যাসিবাদ এক মন্দ মতাদর্শ। এই মতাদর্শকে রক্ত-মাংসের সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে একটি দর্শনের আলখাল্লা পরানোর চেষ্টা থাকে। এরকমই একটি ফ্যাসিবাদী দর্শনের উদ্ভাবন করার চেষ্টা হয়েছে জিয়োভানি জেন্টাইলের সঙ্গে লেখা মুসোলিনির ‘দ্য ডক্টরিন অফ ফ্যাসিজিম’ প্রবন্ধটিতে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা, এই ফ্যাসিবাদের তাত্ত্বিকীকরণে জেন্টাইল, জে জি ফিক্টে, মার্টিন হাইডেগারের মতো সাহায্য করেছেন। অন্যদিকে ফ্রিদরিখ নিৎসে, হার্বাট স্পেনসারের মতো দার্শনিকদের ভাবনাকে এর সমর্থনে ব্যবহার করা হয়েছে। আবার বিশুদ্ধতাবাদী কিছু দর্শনবেত্তা একে ‘তত্ত্ব’ (‘ism’) বলতেই পছন্দ করেন না। একে এক-দু’জন অহংসর্বস্ব ব্যক্তির ‘ইডিয়োসিনক্রেসি’ হিসেবে বুঝতে চান। তবে সবচেয়ে অ্যালার্মিং ব্যাপার হল শিক্ষিত মানুষজনের মধ্যে এখনও এই মতাদর্শকে দার্শনিক যুক্তি-কাঠামো দিয়ে সমর্থন করার অপচেষ্টা বন্ধ হয়নি।
মুসোলিনির নিজের বয়ানে ফ্যাসিবাদ
ফ্যাসিবাদকে বুঝতে আমরা সরাসরি তৎকালীন ইতালিও দার্শনিক জিওভানি জেন্টাইলের সঙ্গে মুসোলিনি ‘দ্য ডক্টরিন অফ ফ্যাসিজিম’ নামে যে নথিটি রচনা করেছেন তার সাহায্য নিতে পারি। মুসোলিনির মতে, ফ্যাসিবাদ এক বিশেষ ধরনের মতাদর্শ, যা একই সাথে চিন্তন ও কর্মধারা। স্থান-কালের সীমায় উঠে এলেও এর মধ্যে এমন এক আধ্যাত্মিক ও আদর্শগত উপাদান আছে যার জন্য একে চিন্তার ইতিহাসে সত্যের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব। তাঁর মতে, এই মতাদর্শ ব ব্যক্তি, সমাজ তথা পৃথিবীকে শুধু তার বহিরঙ্গে দেখে না, অন্তরঙ্গের এক গভীর ভাবনা তথা নীতির অনুষঙ্গে বিচার করে। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের দোলাচলে নয়, ত্যাগের আদর্শে নিবেদিত, গভীর রাজনীতি তথা ধর্মীয় চেতনায় ঋদ্ধ এক আধ্যাত্মিক দায়িত্বের অধীন সত্তা হিসেবে মানুষের জীবনকে দেখে। রাষ্ট্রের অধীনস্থ হিসেবে সকল ব্যক্তিকে বিচার করে, যেখানে রাষ্ট্রের লক্ষ্য সবার উপরে স্থান পায়। সমগ্রতাবাদী এই ভাবাদর্শে রাষ্ট্রই চূড়ান্ত, ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সেখানে আপেক্ষিক।
বলার অপেক্ষা থাকে না যে হিটলার-মুসোলিনির সময়কালে এই রাষ্ট্র-ভাবনা একেবারেই নতুন ছিল, যদিও এখন আমরা এর সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনেছি। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং সমস্যাসংকুল বিষয় হল, উদারনীতিবাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তথা অর্থনীতি থেকে শুরু করে গণতন্ত্র তথা প্রজাতন্ত্র– সব প্রতিষ্ঠিত ধ্যানধারণাকে বাতিল করে দেয় এই ফ্যাসিবাদ।
ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য উদারনৈতিক রাষ্ট্র-দর্শনের এক গঠনগত প্রকরণ। মনে করা হয়, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ছাড়া সৃজনশীল কর্মকাণ্ড সম্ভব নয়। তাই একে একবারে অস্বীকার করে মানবিক রাষ্ট্রগঠনের কথা বলা অর্থহীন। মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রকে এক ঐতিহাসিক সত্তা হিসেবে, মানুষের চেতনার সচেতন বিশ্বজনীন প্রকাশ হিসেবে দেখে। তাই তাঁরা রাষ্ট্রের স্বার্থের বাইরে ব্যক্তি-স্বাধীনতা বলে কিছু দেখেন না। রাষ্ট্রকে এরকম এক অতিবর্তী সচেতন সত্তা হিসেবে দেখা এবং তার সঙ্গে সর্বোচ্চ এক নেতৃত্বের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যের প্রস্তাব নাগরিক হিসেবে ব্যক্তির গুরুত্বকে অস্বীকার করে। মুসোলিনি লিখেছেন: ‘যে ধ্রুপদী উদারনীতি বাদের জন্ম হয়েছিল স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে, রাষ্ট্র জনতার চেতনা ও ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যার ঐতিহাসিক ভূমিকার অবসান ঘটেছে।’৪ ফ্যাসিবাদ যে কোনো ধরনের উদার-ভাবনার বিরোধী। তিনি লিখেছেন: ‘উদারনীতিবাদ ব্যক্তির নামে রাষ্ট্রকে অস্বীকার করেছিল। ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রের অধিকারসমূহকে ব্যক্তিসমূহের (অধিকারসমূহের) প্রকৃত নির্যাসের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী।’৫
সমাজ-রাজনীতির ক্ষেত্রে যেমন, অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তেমনই ফ্যাসিবাদ উদারনৈতিক অর্থনীতির বিরোধী: ‘ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার দখলদারি অন্য যে কোনো মতাদর্শ থেকে কোনো অংশে কম বলে মনে করে না। এই রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড সমগ্র দেশের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ জুড়ে অনুভব করা যায় তার সমবায়ভিত্তিক, সামাজিক এবং শিক্ষাগত প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে দিয়ে।’৬ কথার মারপ্যাঁচে যে সত্যটি ঊহ্য থাকে তা হল এরা কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে সখ্যতা রেখেই কাজ করে। হিটলারের জার্মানি ঘোষণা করেছিল যেসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সরকারের অর্থনীতি সমর্থন করবে সরকার তাদের পাশে থাকবে। আর যারা এর বিরোধিতায় যাবে তাদের ভয়ংকর শাস্তির মুখে পড়তে হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বহু খ্যাতনামা জার্মান কোম্পানি, যেমন Bosch, Siemens, Volkswagen এই সমর্থন দিয়েছিল (ঠিক যেমন আমাদের এখানেও দু-একটি শিল্পগোষ্ঠী সমর্থন দিচ্ছেন ও প্রতিদানে দেশের সম্পদ পকেটে পাচ্ছেন!) জার্মানিতে তারা বিজিত দেশের শ্রমিকদের দাসের মতো খাটিয়ে নেওয়ার সুযোগও পেয়েছিল! ফ্যাসিবাদী অর্থনীতির এই ভাবনা আরও স্পষ্ট হয় যখন আমরা সমাজতন্ত্র তথা মার্কসবাদ সম্পর্কে এদের বিচার সামনে আনি।
ফ্যাসিবাদ ও মার্কসীয় সমাজতন্ত্র
ফ্যাসিবাদ সমাজতন্ত্রের ঘোর বিরোধী, কেননা এই মতাদর্শের কাছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঐক্য গঠিত হয় সকল শ্রেণির অনুগত নাগরিকবৃন্দের আত্মিক মিলনে। সকল শ্রেণি মিলে একটি একক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা নৈতিক বাস্তবতা নির্মিত হয়। একইভাবে শ্রেণি-হাতিয়ার হিসেবে শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যেরও বিরোধিতা করে এই মতাদর্শ। তথাকথিত বৈজ্ঞানিক ও মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের ভিত্তিস্বরূপ যে মতাদর্শ মানবেতিহাসকে শ্রেণিতে শ্রেণিতে দ্বন্দ্ব হিসাবে ব্যাখ্যা করে, উৎপাদন-ব্যবস্থা তথা উৎপাদনের উপকরণের মালিকানার পরিবর্তনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে তার তীব্র বিরোধিতা করে এই রাষ্ট্রভাবনা। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে মন্তব্য করেছেন, ‘ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে বিপ্লব-পরিপন্থী বুর্জোয়া মতবাদ। এই মতবাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে কমিউনিস্ট বিপ্লবের ঘনায়মান বিপ্লবের আশঙ্কা থেকে ক্যাপিটালিজমকে বাঁচানো।’৭ যাই হোক, অর্থনীতিতে বিকল্প হিসেবে সমবায়, গিল্ড ব্যবস্থা ইত্যাদির কথা বলেন ফ্যাসিবাদীরা, যদিও তাঁদের কর্পোরেট-প্রীতি আমাদের অজানা নয়। তাদের কর্পোরেটিজম আসলে পুঁজিবাদকে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে রেখে বেড়ে উঠতে সাহায্য করা। আর জাতীয় স্বার্থের জুজু দেখিয়ে শ্রমিক-পুঁজিপতির শ্রেণি-বিরোধকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলা।
গণতন্ত্র তথা প্রজাতন্ত্রেরও বিরোধী এই মতাদর্শ
ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ গণতন্ত্রের বিরোধিতা করে এই যুক্তিতে যে এই শাসন-ব্যবস্থা জাতিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সঙ্গে এক করে দেখে, তাকে নামিয়ে আনে সর্বোচ্চ সংখ্যার স্তরে। রাজতন্ত্র সম্পর্কেও এঁদের কোনো অরুচি নেই: ‘রাজতন্ত্র বনাম প্রজাতন্ত্র, যা নিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দীর্ঘ দিন বিতর্ক চালিয়েছে, সকল অপ্রতুলতার দায় পূর্বোক্ত ব্যবস্থায় চাপিয়ে পরোক্ত ব্যবস্থাকে একটি ত্রুটিহীন শাসনব্যবস্থা হিসেবে তুলে ধরেছে, ফ্যাসিবাদ সেই টানাপোড়েনের ঊর্ধ্বে। অভিজ্ঞতার শিক্ষা অনুযায়ী কিছু প্রজাতন্ত্র মূলগতভাবে প্রতিক্রিয়াশীল ও স্বৈরাতান্ত্রিক, অপরদিকে কিছু রাজতন্ত্র রয়েছে যা সর্বাপেক্ষা দুঃসাহসী রাজনৈতিক ও সামাজিক পরীক্ষার সমর্থক।’৮ আসলে মুসোলিনিরা বলতে চান, তাঁরা রাষ্ট্রকে গুণমানের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন। তিনি লিখছেন ‘ফ্যাসিবাদী আদর্শ সর্বশক্তিমান, কারণ তা সর্বাপেক্ষা নৈতিক, সর্বাপেক্ষা সংহত, সর্বাপেক্ষা সত্য, যার প্রকাশ জনতার মধ্যে ঘটে স্বল্প সংখ্যায় …যার অন্তিম রূপ দেখা যায় জনতার চেতনায় ও ইচ্ছায়, যেখানে একটি সমগ্র গোষ্ঠী প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতির মাধ্যমে নৃতাত্ত্বিকভাবে একটি জাতির, এবং একক চেতনা ও একক ইচ্ছার দ্বারা চালিত হয়ে উন্নয়ন নৈতিক গঠনের একই সরলরেখায় অগ্রসর হয়।’৯ এই ভাবনায় জাতি রাষ্ট্রের জন্ম দেয় না, রাষ্ট্র জন্ম দেয় জাতির। এই রাষ্ট্র মানুষকে প্রদান করে সংকল্প, সচেতন করে নিজেদের নৈতিক তথা আধ্যাত্মিক ঐক্য সম্পর্কে।
সর্বগ্রাসী মতাদর্শ
এই মতাদর্শ শুধু শাসনকার্যই পরিচালনা করে না, আমাদের মনোজগতে তথা আত্মিক জীবনের শিক্ষক ও প্রচারক এই ভাবাদর্শ। এই রাষ্ট্রভাবনা বদলে ফেলতে চায় মানুষ, তার চরিত্র, তার বিশ্বাস– সবকিছুকে! ঈশ্বরের যা প্রাপ্য ঈশ্বরকে দাও, সিজারের যা প্রাপ্য সিজারকে– এই নীতির বিপরীতে গিয়ে মস্তিষ্কের প্রতিটি কোশকে দখলে রাখতে চায় এই ভয়ংকর মতাদর্শ। ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা-কর্মের সবদিক এরা দখলে নিতে চায়। প্রসঙ্গত হিটলার-মুসোলিনিরা ফ্যাসিবাদের প্রকরণ হিসেবে ধর্মকে যেভাবে ব্যবহার করেছেন তাও লক্ষ করার মতো। তবে আজকের ভারতের হিন্দুত্বের স্বরগ্রামের তুলনায় মুসোলিনিকে অন্তত ধর্ম বিষয়ে একটু নরমপন্থী দেখায়: ‘রাষ্ট্র কোনো ধর্মতত্ত্বের সমর্থক নয়, কিন্তু তার একটি নৈতিক নিয়মাবলি বর্তমান। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ধর্মের মধ্য দিয়ে দেখতে পায় আধ্যাত্মিকতার গভীরতম বহিঃপ্রকাশ। এই কারণে তা শুধু ধর্মকে শ্রদ্ধা করে না, তার রক্ষা ও নিরাপত্তা বিধানেও গুরুত্ব প্রদান করে।’১০ তবে বোঝা যায়, সরাসরি ধর্মকে ব্যবহারের কথা না বললেও রাষ্ট্রনৈতিক আলোচনায় ধর্মের নৈতিক নিয়মাবলি, আধ্যাত্মিকতার যে প্রসঙ্গ তিনি উত্থাপন করেন তাতে ফ্যাসিবাদের মডিউলই পুষ্ট হয়।
ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ : সহোদর হয়েও স্বতন্ত্র
যদিও আমরা বলেছি নাৎসিবাদ ফ্যাসিবাদের একটি প্যারাডাইম, তথাপি এদের মধ্যে পার্থক্যের কয়েকটি বিন্দু উল্লেখের দাবি রাখে–
(১) ইতালির ফ্যাসিবাদ স্পার্টান মতাদর্শ (প্রাচীন গ্রিক নগর-রাষ্ট্র স্পাটার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জাতিগত বিশুদ্ধতা তথা সমরবাদের উপর সমধিক গুরুত্ব দেওয়ার ভাবাদর্শ)-এর দ্বারা পুষ্ট, যা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ও সামরিক সেবার কথা বলে। অন্যদিকে নাৎসিবাদ জাতি তথা গোষ্ঠীগত স্বাভিমান, রক্তের বিশুদ্ধতার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ডারউইনবাদের দ্বারাও প্রভাবিত।
(২) সমাজের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য টিকিয়ে রাখা ফ্যাসিবাদের প্রধান স্তম্ভ, এবং সব জাতির, সব সংস্কৃতির, সব ধর্মের অভিজাতদের দ্বারা পরিচালিত। অন্যদিকে নাৎসি মতাদর্শ জাতি-ভিত্তিক শ্রেণি-সমাজে বিশ্বাস করে। এই ভাবনায় আর্যরা পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট জাতি এবং তাই বাকি সব জাতির প্রভু!
(৩) ফ্যাসিবাদ সব সামাজিক সত্তাকে একসূত্রে বাঁধতে চায়। অপরদিকে নাৎসিবাদের চোখে জাতিগত বিশুদ্ধতা রক্ষা করা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কাজ।
(৪) ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় সামাজিক গতায়াত, অর্থাৎ এক অবস্থান থেকে অন্য বা উন্নততর অবস্থানে যাওয়া অনুমোদিত। বিপরীতে কেবল আর্যজাতি জার্মানদের জন্যই সামাজিক স্থানান্তরণ স্বীকৃত, ইহুদিসহ অন্যদের জন্য নয়।
(৫) ফ্যাসিস্ট ইতালির লক্ষ্য ছিল স্বয়ম্ভরতা ও মেডিটেরিয়ান সাগরের উপর ইতালীয় আধিপত্য। নাৎসি জার্মানির লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের বিরুদ্ধে জনবিন্যাসগত, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও পূর্ব ইউরোপে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুত্ব নিশ্চিত করা।
(৬) ইতালির ফ্যাসিবাদ তৎকালীন সমাজের প্রচলিত সংস্কৃতির সেভাবে বিরোধিতা করেনি। বিপরীতে নাৎসিরা বহুত্ববাদী সংস্কৃতির ধ্বংস সাধনে তৎপর ছিল। অন্য জাতি-গোষ্ঠির শিল্প-সাহিত্যকে পুড়িয়ে ফেলতে দ্বিধা করেনি।
দর্শনের অবদান
বলে নেওয়া ভালো যে, ফ্যাসিবাদী দর্শনের উৎপত্তি ও বিকাশে অনেক চিন্তকের অবদান আছে। তাদের সবার কথা বলা এখানে সম্ভব নয়। আমরা এখানে প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন বিশেষ দার্শনিকের পরোক্ষ অবদানের কথাই বলব। প্রথমে তিন জনের কথা বলি: প্লেটো, হেগেল ও মার্কস। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’-এ যে অভিজাততন্ত্রের পক্ষে যুক্তি সাজিয়েছেন তা চরম কতৃর্ত্ববাদকে সমর্থন করে, দার্শনিক-রাজা (Philosopher-King)-র ধারণায় হাতে গোনা কয়েকজনই শাসন-কার্য পরিচালনায় আসতে পারে। শুনতে যতই ভালো লাগুক না কেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর সংখ্যালঘিষ্ঠের অবদমনের সব ব্যবস্থাই এখানে পাকা থাকছে। সামাজিক ন্যায়ের ধারণাকে প্লেটো একইভাবে বাতিল করেছেন। তৎকালীন এথেনীয় গণতন্ত্রকে তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আরও ভয়ংকর ‘রিপাবলিক’ (424A & 459A-B)-এর সিলেক্টিভ ব্রিডিং-এর ইউজেনিকস তত্ত্ব। তবে হাঁ, তিনি সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন দেননি, যা ফ্যাসিবাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকরণ। অন্য দিকে জি ডাবলিউ এফ হেগেল রাষ্ট্রের চূড়ান্ত কর্তৃত্বের পক্ষে যুক্তি সাজিয়েছেন: ‘’রাষ্ট্র ছাড়া স্বাধীনতার বাস্তবায়নের সুযোগ কোথায়! (রাষ্ট্রই স্বাধীনতা এবং) রাষ্ট্রই এই মর্ত্যে ঈশ্বরের প্রতিভূ।’১১ আর যুদ্ধের প্রতি তাঁর সমর্থনের কথা আমাদের হতাশ করে, যুদ্ধের পক্ষে তাঁর যুক্তিজাল যেন মুসোলিনিকেই মনে করিয়ে দেয়! আর মার্কসের দর্শনের যে প্রভাব তা তো জলের মতো স্পষ্ট। আগেই উল্লেখ করেছি, পুঁজিবাদের কবর খননকারী ও সমাজতন্ত্রের সম্ভাবনার উজ্জ্বল প্রতিমূর্তির যে রাজনৈতিক দর্শন তাকে প্রতিহত করার জন্য বুর্জোয়া শ্রেণি সেই সময় যেকোনো ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত ছিল। মার্কস দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে দুনিয়ার সব শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ হতে বলার সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলেছেন যে ‘[N]ation-states and national pride as tools in the arsenal of bourgeois propaganda.’১২ এই মতাদর্শের বিপরীতে গিয়েই ফ্যাসিবাদীরা জাতীয় স্বার্থ তথা গর্বের প্রসঙ্গ তুলে শ্রেণি-সংগ্রামের পরিবর্তে শ্রেণি-সহযোগিতায় আস্থা রাখতে বলেন। হেনরি বার্গসোঁ-র রহস্যবাদও ফ্যাসিবাদের পক্ষে কাজ করে থাকতে পারে বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।
রাডিক্যাল অস্তিবাদী দার্শনিক সম্প্রদায়ের কথা বলতেই হয়। বিশেষ করে ফ্রিদরিখ নিৎসে ও মার্টিন হাইডেগারের কথা এখানে সামনে আসে। আর নিৎসের পিছনে নৈরাশ্যবাদী দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার, বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন ও তাঁর অনুগামী হার্বাট স্পেনসার আছেন বলে মনে করা হয়। অনুরূপ ডারউইনের ‘সর্বোত্তমের টিকে থাকা’-র বিজ্ঞান-দর্শন ও স্পেনসারের সামাজিক ডারউইনবাদ তাঁকে প্রভাবিত করেছিল বলে মনে করা হয়। তবে যেভাবে নিৎসেকে আমরা বাইরে থেকে দেখি তা কিন্তু আসল নিৎসে নয়। ব্যক্তি-জীবনকে আরও শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে, সত্যিকারের মহত্তর সার্থক অস্তিত্বকে রূপ দিতে এসব ভাবনাচিন্তা তাঁর ছিল– একথা একবারে মিথ্যা নয়। কিন্তু নাৎসিরা তাঁকে যেভাবে পেতে চেয়েছেন– মানব সভ্যতাকে কলঙ্কিত করতে– আসল নিৎসে তার থেকে বহু যোজন দূরে। তবে যাই বলা হোক না কেন, নিৎসের চরম ব্যক্তিবাদী, যুক্তিবাদবিরোধী, প্রথাগত নীতিভাবনা-বিরোধী, ক্ষমতাকামী, গণতন্ত্র-রিরোধী দর্শন-ভাবনা নাৎসিবাদকে অবশ্যই প্রভাবিত করেছে। তাঁকে হিটলারের জাতিবাদ তথা স্বাজাত্যভিমানের প্রেরণা বলে অনেকে মনে করেন। হতে পারে, এবং অসম্ভব নয় যে নিৎসের অতিমানব (Übermensch)-এর ধারণা, ক্ষমতা-আকাঙ্ক্ষা (die Wille der Macht), প্রভু-নৈতিকতা (Master Morality) ইত্যাদি প্রকরণ ফ্যাসিবাদী হিটলার ও তাঁর অনুগামীদের রাজনীতির মূল প্রকরণ হিসেবে থেকেছে। কিন্তু ব্যক্তি নিৎসের কোনো বিশেষ জার্মান জাতি-প্রীতি ছিল না। বরং জার্মান জাতিকে কঠিন ভাষায় তিনি আক্রমণ করেছেন। শুধু তাই নয়, জীবনের বেশিরভাগ সময় জার্মানির বাইরে সুইৎজারল্যান্ডে কাটিয়েছেন, যেখানে কান্ট-পরবর্তী কালের উল্লেখযোগ্য দার্শনিক জে জি ফিকটে জার্মান জাতীয়তাদের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন বার বার। আর তাঁর অতিমানব কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা জাতির প্রতিভূ নয়। সাবেক নিশ্চল সংস্কৃতির ধংসস্তূপের ভিতর থেকে নতুন চলমান সভ্যতার আগমন এই অতিমানবদের অপেক্ষায় থাকে। এই সভ্যতা বৈশ্বিক, মোটেই জার্মান-সর্বস্ব নয়। এদিক থেকে বিচার করলে তাঁকে নাৎসিবাদের উদ্গাতা বলা যায় না। তাছাড়া, অতিমানবের যেসব গুণের কথা তিনি বলেছেন নাৎসিদের চরিত্রে সেসব কীভাবে আরোপ্য হবে?
হিটলার ও তার অন্ধ ভক্তরা নিজদের ভেবে থাকতে পারে যে তারা অতিমানব, কিন্তু নিৎসে কল্পিত অতিমানবের দর্শন কতটুকু তারা অনুকরণ করতে পেরেছে? অতিমানব সম্পর্কে বলতে গিয়ে নিৎসে ১৮৮১-৮২ খ্রিস্টাব্দে লিখছেন: ‘তারা নির্ভীক, জীবন-রসিক, তাদের ইচ্ছাশক্তি প্রবল, কোনো সংকটেই তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয় না। তারা যেমন জীবনকে পরিপূর্ণভাবে ভোগ করে, মৃত্যুকেও তারা তেমনি স্বাগত করতে জানে।…তারা জীবন-শিল্পী; কারণ তারা নিজেদের প্রয়াসেই নিজেদের গড়ে তোলে। আত্মনিয়ন্ত্রণে সক্ষম বলেই তারা যথার্থ স্বাধীন।’১৩ সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে সাবেক দাস্যরসসিক্ত নৈতিকতাকে তুড়ি মেরে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য মনোবল তথা আত্মিক শক্তিকে তিনি ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা বলেছেন। এই ক্ষমতা বা শক্তি গায়ের জোর বা অস্ত্রের ঝনঝনানি নয়, কাপুরুষের মতো কাউকে আঘাত করার জন্যও নয়। এ জোর মানে জাদু, সৃষ্টি সুখের উল্লাস, অপ্রতিরোধ্য। তবে হ্যা, কিছুটা তা রহস্যাবৃত।
তবে গণতন্ত্র সম্বন্ধে নিৎসের রিরূপ মনোভাব, তাঁর নারী-বিদ্বেষ নাৎসিদের বিকৃত বুদ্ধির পোষণে সহায়তা করে থাকতে পারে। তবে এক্ষেত্রেও শোভনলাল দত্তগুপ্ত নিৎসের পারিবারিক একটি বিষয়ের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন।১৪ নিৎসের মৃত্যুর পর তাঁর ভগিনী এলিজাবেথ, যাঁর ইহুদি-বিদ্বেষ ও নাৎসি-প্রীতি সর্বজনবিদিত, তিনিই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার দর্শনকে প্রাথমিকভাবে সামনে নিয়ে আসেন। এলিজাবেথ নাৎসি দলের সক্রিয় সদস্যও ছিলেন। এই এলিজাবেথই পরবর্তীতে হয়ে দাঁড়ালেন তাঁর চিন্তা ও ভাবাদর্শের একচেটিয়া ব্যাখ্যাকার। এবং বলা বাহুল্য, তাঁর ভাষ্যই হয়ে দাঁড়াল নিৎসের পরিচয়। প্রচলিত ভাবনা তথা ব্যবস্থার কট্টর সমালোচক রূপে নিৎসেকে উপস্থাপিত করা হয়। এভাবে ভগিনী এলিজাবেথ নাৎসিবাদের বৌদ্ধিক পূর্বসূরি হিসেবে তাঁকে প্রোজেক্ট করলেন। নিজের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি ও নাৎসিবাদ সংহতকরণের বিশেষ উদ্দেশ্যে অনেক কিছু নিজে লিখে দাদার নামে চালিয়ে দিলেন। পরে এসব ফাঁস হয়েছে। জানা গেছে দাদার ৩০টি পত্র-নথি তিনি একবারে বদলে দিয়েছিলেন। অনেক পরে আমরা প্রকৃত নিৎসেকে পেলেও এলিজাবেথের ভুল ভাষ্যই নাৎসিদের সাংঘাতিকভাবে আকর্ষণ করেছিল।
এবার আসি আর একজন খ্যাতনামা দার্শনিকের চিন্তা-জগতে। তিনি মার্টিন হাইডেগার। বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় দর্শনে তাঁর যুগান্তকারী প্রভাব। মুসোলিনি-হিটলারের প্রায় সমসাময়িক এই দার্শনিকের অস্তিবাদী সত্তাতত্ত্ব, মানব-অস্তিতার ব্যাখ্যায়, বিশেষ করে যথার্থ অস্তিতা (authentic being)-র ধারণা ফ্যাসিবাদের বিকাশে সহায়তা করেছে মনে করা হয়। জর্জ লুকাচের মতো ব্যাখ্যাকাররা মনে করেন, অস্তিবাদের সামূহিক যুক্তিহীনতার সঙ্গে সঙ্গে হাইডেগারের সত্তা-যাথার্থ্যবাদ নাৎসিবাদকে সংহত করেছে। প্রচলিত চিন্তাধারাকে কারণে-আকারণে বিরোধিতা করে, সাধারণ জনগণের গড়পড়তা জীবন-বোধকে অবজ্ঞা করে তিনি মানুষে-মানুষে সম্পর্ককে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে মাড়িয়ে গিয়ে মুষ্টিমেয়ের দলতন্ত্রকে পরোক্ষে বৈধতা দিয়েছেন।
এবার আসি ব্যক্তি হাইডেগারে। জার্মানিতে ইহুদিদের অবাধ গতায়াতকে ‘Jewification of German spirit’ বলে খেদ প্রকাশ করতেন। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মুক্ত চিন্তাকে তিনি বিপজ্জনক বলে মনে করতেন। আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানী, থিয়োডোর অডর্নো, হানা আর্ন্টের মতো দার্শনিককে বিপজ্জনক ভেবেছেন তিনি! ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হাইডেগার নাৎসি-পার্টির সদস্য ছিলেন। আর ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর (আমাদের যেমন উপাচার্য) থাকাকালীন ইহুদি ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার, নিজের শিক্ষক (যিনি ইহুদি থেকে খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত) এডমুন্ড হুসার্লের সঙ্গে তাঁর আচরণ আমাদের পীড়া দেয়। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সম্পূর্ণ নাৎসিকরণে তাঁর অত্যুগ্র বাসনা, সকল রকমের রিরোধী ভাবনা-মুক্ত করতে তাঁর বিচার ও কর্মধারা দর্শনের জগতের মানুষ হিসেবে আমাদের লজ্জা দেয়।
প্রসঙ্গত, ডারউইনের যোগ্যতমের ধারণা স্পেনসার সমাজের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। এই ধারণা সাম্রাজ্যবাদী বিস্তারবাদ তথা অপেক্ষাকৃত দুর্বল তথা নিরীহ গোষ্ঠী তথা জাতিকে পরাজিত করার উন্মত্ততাকে পরোক্ষে সমর্থন করেছে। এই ধরনের ভাবাদর্শগুলি ফ্যাসিবাদীদের নির্বিচার হিংসা, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও নিপীড়নকে অনেকখানি বৈধতা দিয়েছিল, মানবসভ্যতাকে এক অন্ধকারতম গলির মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল।
ভারতীয় দর্শন ও ফ্যাসিবাদ
ভারতীয় সংস্কৃতি বা দর্শন সরাসরি ফ্যাসিবাদের উত্থানে সহায়তা করেছে একথা কেউ-ই বলবেন না। দরকারি কথা হল, ভারতীয় দর্শন-সংস্কৃতির মধ্যে ফ্যাসিবাদী উপকরণ আছে কি না সেটাই এখানে বিচার্য। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলি, যুক্তিতর্কের আবহের মধ্যেই কতৃর্ত্ববাদ তথা মুষ্টিমেয়ের দ্বারা সংখ্যাগুরুর শাসনের অগণতান্ত্রিক উপাদান ভারতীয় সংস্কৃতি তথা দর্শনে ছিল, এখনও আছে। বৈদিক সভ্যতার প্রথমদিকে উদার তথা আলোকিত সংস্কৃতির চর্চা যে হয় নি তা নয়। কিন্তু স্মৃতি-শাস্ত্রের যুগে এসে তা ধাক্কা খায়। বিশেষ করে ‘মনুসংহিতা’-য় যখন থেকে বর্ণবাদ তথা ব্রাহ্মণের সর্বাধিপত্য পাকাপোক্ত হল তখন থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ শূদ্র ও নারীর জন্য যে শাস্ত্র-সংহিতা লাগু হয়েছে তা মানবিক তথা গণতান্ত্রিকতার পরিপন্থী। (প্রসঙ্গত, সম্প্রতি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ে ‘মনুসংহিতা’-পড়ানোর প্রস্তাব উঠেছে। তবে প্রবল চাপের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় তা আপাতত প্রত্যাহার করে নিয়েছে।) আপনি বলবেন, এ তো হিন্দু ধর্মের ব্যাপার, এর মধ্যে ভারতীয় দর্শন কোথায় পেলেন! ঠিকই। তবে ভারতীয় দর্শন ও হিন্দু ধর্ম প্রায়শই হাত ধরাধরি করে চলে। শাস্ত্র-অনুমোদিত ধর্মকে অস্বীকার করে ভারতীয় দর্শন করার যাঁরা চেষ্টা করেছেন– চার্বাক, জৈন ও বৌদ্ধরা– তাঁদের কোথায় কতটুকু ঠাঁই হয়েছে তা আমরা জানি। আর আমরা এও স্বীকার করি ষড়দর্শনের সবগুলিই সরাসরি স্মৃতি বা শ্রুতি-নির্ভর তা নয়। তবে এটুকুই বলাই যায় যে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির সঙ্গে সমঝোতা করেই এদেরকে টিকে থাকতে হয়েছে। অন্যদিকে শংকরাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য দর্শন হিসেবে দেশে-বিদেশে সমাদৃত। আমি এর মধ্যে বর্ণবাদী তথা ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির প্রসঙ্গ আলাদাভাবে তুলছি না। কিন্তু এর জ্ঞানতত্ত্ব (যাকে এপিস্টিমোলজি বলা হয়) যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে দেখব শ্রুতি তথা শাস্ত্রবচনকে আমাদের প্রত্যক্ষের উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। এর তাৎপর্য কী? জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বচ্ছন্দ গতিকে আটকে দিয়ে, জগৎ ও জীবনের চরম সত্তাকে অস্বীকার করে প্রগতির পথকে রুদ্ধ করে না কি এই ধরনের দর্শনতন্ত্র? চাঁদ সওদাগরের মনসাকে বাঁ-হাতে পূজা দেওয়ার মতো জগতের কেবল ব্যবহারিক সত্তার স্বীকৃতি কোনোভাবেই বিজ্ঞান-বিরোধী ভাববাদকে কাটিয়ে উঠতে পারে না। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা: আমাদের বস্তুনিষ্ঠ আয়ুর্বেদ অনেক উন্নত ছিল তখনই, যখন ইউরোপ অন্ধকারে ডুবে ছিল। ভাবতে পারেন, সুশ্রুত ১১২০ ধরনের রোগ, তার মধ্যে ৭২ প্রকার চোখের রোগের আবিষ্কর্তা! ধন্বন্তরি সম্প্রদায়, জীবক শল্য-চিকিৎসার উপর কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন ভাবলে অবাক লাগে। চরক দৈব-ব্যপাশ্রয় ভেষজ থেকে যুক্তি-ব্যপাশ্রয় ভেষজের উপর নির্ভর করতে বলছেন। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের আবহে টিকে থাকতে তাঁদের নানা পৌরাণিক কাহিনি এদের সঙ্গে জুড়ে দিতে হয়েছে! উচ্চশ্রেণির আধিপত্য, শূদ্রদের কায়িক শ্রম-শোষণ যেখানে মূল রাজনীতি সে সমাজ-কাঠামোর মধ্যে সার্থক বিজ্ঞানচর্চা কীভাবে সম্ভব! পাশাপাশি,আমরা সবাই জানি, আরোহী পদ্ধতি, যা বিজ্ঞান-চর্চার মূল চালিকাশক্তি, সেই পদ্ধতিতত্ত্বকে জাতপাত-দীর্ণ সমাজ মন থেকে মেনে নিতেই পারেনি। কায়িক শ্রমের প্রতি অবজ্ঞা, সমাজের মাতব্বরদের যুক্তিবাদ-বিরোধিতা, প্রত্যক্ষের সাক্ষ্য-প্রমাণে আস্থা রাখতে অনীহা– এসবের কারণে বিজ্ঞান সাধনা ভয়ংকরভাবে ব্যাহত হয়েছে।
বলা বাহুল্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সার্থক চর্চা, দেশ-সমাজের বিজ্ঞানসম্মত অধ্যয়ন ব্যতিরেকে যেমন যথার্থ মানব-প্রগতি সম্ভব নয়,তেমনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে স্বীকার না করে তাকে বর্ণ তথা জাতপাতের নিগড়ে বেঁধে রাখলে ফ্যাসিবাদের নবরূপে প্রকাশ (যেমন আজকের হিন্দুত্ববাদের আস্ফালন)-কে আটকানো যায় না। আমরা যেন ভুলে না যাই ফ্যাসিবাদের সম্পর্কে রম্যাঁ রলাঁর ‘a dozen of masks’-এর কথা। তাই গোটা বিশ্বে এখন নতুনভাবে অতি-ডানপন্থী (Far Rightist)-দের পুনরাবির্ভাব!
হেনরি বার্গসোঁর মতো আমাদের এখানে রহস্যবাদী সংস্কৃতির লালন-পালন তথা অন্ধ গুরুবাদ তেমনই ক্ষতিকর হতে পারে। আবার শ্রী অরবিন্দের ‘অতিমানব’-এর দর্শনকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে হিন্দুত্বের পক্ষে টেনে আনা যেতে পারে, ঠিক যেমন ‘গর্ব করে বলো, আমি হিন্দু!’ বিবেকানন্দের এই বক্তব্য হিন্দুত্বের অন্ধ ভক্তদের অনুপ্রাণিত করছে। এখানে একটি অভিযোগ ভেবে দেখার দাবি রাখে: আজকাল অনেকেই বলেন, আমার সম্প্রদায়গত, ধর্মগত, ভাষাগত ও জাতিগত সংলগ্নতা তো স্বাভাবিক। সেসব নিয়ে গর্বিত হব না! বাঙালিত্ব বা হিন্দু পরিচয়কে জানান দিতে পিছপা হব কেন? উত্তরে আমার বলার: অবশ্যই, নিজের সব পরিচয়েই আমি গর্বিত হতে পারি। কিন্তু আমার এই প্রিমিটিভ বিলংগিংস-কে বেলাগাম হতে দেওয়া যুক্তিশীল মানুষ হিসেবে কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। আমার মতো অপরের যাবতীয় পরিচয় সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমার পরিচিতির আস্ফালন যেন অন্য কাউকে আঘাত না করে। আর যেখানে সমাজ-রাষ্ট্রের প্রবেশ সেখানে আমি ততদূর পর্যন্ত নিজের অধিকারকে জানান দিতে পারি যতদূর তা অন্যের নাসিকাকে স্পর্শ না করছে!
আর একটা বিষয় না বললেই নয়: কর্মবাদ, নিষ্কাম কর্ম ও জন্মান্তর সম্বন্ধীয় দার্শনিকতা যতই উচ্চ মানের হোক না কেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে উচ্চবর্ণ তথা ক্ষমতাবানের এক অংশ এরকম বুঝিয়েছে যে তোমার পূর্ব জন্মের কর্ম উপযুক্ত ছিল না, তাই তোমার দারিদ্র্যে জন্ম হয়েছে, নীচ জাতের পরিবারে স্থিতিলাভ করেছ, এজন্মে নিষ্কামভাবে কাজ করে গেলে পরের জন্মে উন্নত জীবন-লাভ করবে। আর তোমার তো কর্মেই অধিকার, ফলের কথা ভাবার দরকার নেই! এখানেও অনেকে বলবেন, এতে দর্শন-সংস্কৃতির যত না দোষ তার থেকে বেশি দোষ যা়রা এ সবকিছুকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছে, কতৃর্ত্ববাদের পক্ষে ব্যবহার করছে! কিন্তু আমরা এইসব প্রশ্ন তুলতেই থাকব, এসব দর্শনতত্ত্বের নিজেদের মধ্যেই ভুলভাবে ব্যাখ্যাত হওয়ার উপাদান আছে কিনা, থাকলে সেগুলির সংস্কার হবে কিনা, এবং তা না পারলে আমাদের ‘সেফটি মেজার’ কী হবে? আমরা কীভাবে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের এসব বিষয় পড়াব? ন্যাড়ার দ্বিতীয়বার (নাকি বার বার?) বেলতলা যাওয়া আটকাতে আমাদের কী করণীয়? এসবের মীমাংসা করতে না পারলে মুষ্টিমেয়র দ্বারা সংখ্যাগুরুর চিন্তার দখলদারি কীভাবে বন্ধ হবে!
সূত্রপঞ্জি:
১. অধ্যাপক-গবেষক তামির বার-অন ‘ইসলামোফ্যাসিজম’ প্রবন্ধের শুরুতেই লিখেছেন ২০১৬ সালে হামেদ আবদেল-সামাদ ‘ইসলামি ফ্যাসিবাদ’ শিরোনামে একটি বইয়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের হিটলার-মুসোলিনির প্রশংসা করেছে, এবং বলেছেন এদের থেকেই ইসলামো-ফ্যাসিজিমের উৎপত্তি। দ্রষ্টব্য: অনিরুদ্ধ রাহা “অধর্ম ও ফ্যসিবাদ– তুলনামূলক আধিপত্য বীক্ষণ”, অনুষ্টুপ (বিষয়: ফ্যাসিবাদ), ভ্যলুম ৫৭, সংখ্যা ২, পৃঃ ২৩৯
২. শোভনলাল দত্তগুপ্ত, ‘ফ্যাসিবাদ: একটি প্রকল্পের নির্মাণ ও প্রয়োগ’, অনুষ্টুপ (বিষয়: ফ্যাসিবাদ), পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৬
৩. অনিল আচার্য, ‘সম্পাদকীয়’, অনুষ্টুপ (বিষয়: ফ্যাসিবাদ), পূর্বোক্ত, পৃঃ xiv
৪. জিওভানি জেন্টাইল ও বেনিটো মুসোলিনি, ‘দ্য ডক্টরিন অফ ফ্যাসিজিম’ (অনু: অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত), অনুষ্টুপ (বিষয়: ফ্যাসিবাদ), তদেব, পৃ.৪৪২.
৫. তদেব.
৬. জিওভানি জেন্টাইল ও বেনিটো মুসোলিনি, ‘দ্য ডক্টরিন অফ ফ্যাসিজিম’, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৪৫৫
৭. সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ফ্যাসিজিম’, অনুষ্টুপ (বিষয়: ফ্যাসিবাদ), পৃঃ ৫০০
৮. জিওভানি জেন্টাইল ও বেনিটো মুসোলিনি, ‘দ্য ডক্টরিন অফ ফ্যাসিজিম’, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৪৫০
৯. তদেব, পৃঃ ৪৪৩.
১০. তদেব, পৃঃ ৪৫৫-৫৬.
১১. ‘ফ্যসিজিম অ্যান্ড আইডিওলজি’, উকিপিডিয়া, অ্যাকসেসড ৬ জুলাই, ২০২৪.
১২. তদেব
১৩. শিবনারায়ণ রায়. “অস্তিত্ব, শূন্যতা, ‘অতিমানব’ ও ফ্রিডরীশ নিৎসে”, এবং মুশায়েরা (নিৎসে), ভ্যলুম, ৭, সংখ্যা ৪, পৃঃ ১৮
১৪. শোভনলাল দত্তগুপ্ত, ‘নিৎসের রাজনৈতিক দর্শন: একটি মৃত্যু শতবার্ষিক মূল্যায়ন’,
পূর্বোক্ত, পৃঃ ১০৬