ফ্যাসিবাদ যত্রতত্র?

লরেন্স ব্রিট

ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যাবলি আজও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, ছদ্মবেশের আড়ালে নিজেকে গোপন করে চলেছে; আমরা যা-কিছুর পক্ষে, তারই সে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। কিছু প্রচলিত শব্দবন্ধ যা মনুষ্য সমাজ তথা জাতিসমূহ দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় শিখেছে ও জেনেছে তা বহু ব্যবহারে শুধু যে আজ ক্লিশে হয়েছে তা নয়, তার অতিমূল্যায়নও ঘটেছে। প্রায়শই আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হই বা ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হই। দুঃখজনকভাবে, এই ঐতিহাসিক বিস্মৃতির মধ্য দিয়ে চলছে ফ্যাসিবাদের স্বাভাবিক (অব)মূল্যায়ন! 

আমরা আড়াই প্রজন্মের নাৎসি জার্মানির ভয়াবহতা পার করে এসেছি; তবুও আমাদের চেতনা চৈতন্যকে ঝাঁকুনি দিয়ে চলেছে এর নিরন্তর অনুস্মারক। জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসিবাদের ঐতিহাসিক আদলে গড়ে ওঠা তাত্ত্বিক প্রকাশভঙ্গির মাঝে প্রকট হচ্ছে আজকের বিবর্তিত বিশ্ব-রাজনীতির ভাবনা। যদিও আজ তারা আর বিদ্যমান নেই তবুও সেই বিশ্ব-ভাবনা এবং তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অধুনা বিংশ শতাব্দীর নানা ঘাত-প্রতিঘাতে প্রোটোফ্যাসিস্ট জমানার অনুকরণের সাক্ষ্য বহন করছে। মূল জার্মান ও ইতালীয় তাত্ত্বিক নকশায় এবং পরবর্তী প্রোটোফ্যাসিস্ট শাসনের রূপরেখায় উল্লেখযোগ্যভাবে একই বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়েছে। যদিও বহু পণ্ডিত এই শাসনের মধ্যে প্রত্যক্ষ সংযোগ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তবুও অল্প কিছু ব্যক্তি এখনও উপস্থিত, যাঁরা এই দৃষ্টিলব্ধ সাযুজ্য সংক্রান্ত বিতর্ককে বহাল রাখতে পারেন।  

দৃশ্য-পরিসরের অন্তরালে এমনকি সাদামাটা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদ তথা প্রোটোফ্যাসিস্ট কার্যক্রমের লক্ষণীয় অভিন্নতা প্রকাশমান। এটি অবশ্যই তথ্যাভিজ্ঞ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের প্রকৃত প্রতিভাস নয়, তবে কখনও-সখনও দৃষ্টিভঙ্গির মূল্যায়নের স্বার্থে সুস্পষ্ট তথ্যের পুনরুল্লেখ করা একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং সেই কার্যক্রমের দ্বারা বর্তমান পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করা সম্ভবপর হয়।

এই দৃষ্টিভঙ্গির উদ্দেশ্য প্রকরণে আমি আলোচ্য জমানার কয়েকটি শাসন পদ্ধতি বিবেচনা করব: নাৎসি জার্মানি, ফ্যাসিস্ট ইতালি, ফ্রাঙ্কোর স্পেন, সালাজারের পর্তুগাল, পাপাডুপুলোসের গ্রিস, পিনোশের চিলি এবং সুহার্তোর ইন্দোনেশিয়া। তাঁদের কার্যক্রমকে সুনিশ্চিত করতে একটি মিশ্র মোড়কে উপস্থাপিত হয়েছিল জাতীয় পরিচয়, সংস্কৃতি, উন্নয়নের স্তর এবং ইতিহাস। কিন্তু তাঁরা সকলেই ক্ষমতা অর্জন, সম্প্রসারণ ও তার স্থিতিকরণে ভরসা রেখেছিল ফ্যাসিবাদ বা প্রোটোফ্যাসিস্ট আদলের অনুকরণের উপর। অতঃপর এইসব শাসনকে উৎখাত করা হয়েছে, সে কারণেই তাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কমবেশি পূর্ণাঙ্গ চিত্র সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। 

এই সাতটি দেশের শাসনব্যবস্থার বিশ্লেষণে উদ্‌ঘাটিত হচ্ছে চোদ্দোটি অনুরূপ যোগসূত্র যা তাদের জাতীয় আচরণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুস্পষ্ট স্বীকৃতি। এই সকল নিদর্শন তাদের একই বন্ধনীতে এনে ফেলেছে। এই মৌলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অন্য দেশের শাসন পদ্ধতির তুলনায় অনেক বেশি পরাক্রমী এবং উগ্র। সার্বিক কার্যপ্রণালীর সমধারা তাদের একই পঙ্‌ক্তিভুক্ত করেছে। 

১। জাতীয়তাবাদের শক্তিশালী এবং ধারাবাহিক অভিব্যক্তি: পতাকা তথা নিশানমূলক বস্ত্রাদির প্রদর্শন, সর্বব্যাপী ল্যাপেল পিন গেঁথে রাখার আগ্রহ, দেশপ্রেমিক তথা জাতীয়তাবাদী হিসাবে প্রকাশ করার উদগ্র উন্মাদনা; সকল প্রান্তের নাগরিকদের মধ্যে উন্মত্ততাকে তীব্র করা, আকর্ষণীয় স্লোগান, সেনাবাহিনীর প্রতি গর্ব এবং ঐক্যের দাবির মধ্যে ছিল তাদের জাতীয়তাবাদ প্রকাশের মূল তাগিদ। সেই সঙ্গে, বিদেশি বস্তু বা অপরিচিত বহিরাগতের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস সঞ্চারিত করা হয়েছিল প্রতিটি নাগরিকের মনে। 

২। মানবাধিকারের আদর্শের প্রতি অবজ্ঞা: আলোচ্য শাসন ব্যবস্থায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন শাসকগোষ্ঠী মানবাধিকারকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিল এবং তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায় সাব্যস্ত করেছিল। প্রচারের চতুর ব্যবহারের দ্বারা শাসকেরা জনগণকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়, এমনকি তাদের দৃষ্টিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের জন্য দানবীয় ব্যবহারকে লঘু বিষয় রূপে প্রতিপন্ন করার মানসিকতা তৈরি করেছিল। যখন এর অপব্যবহার নির্মমতার পর্যায়ে পৌঁছে যেত, তখন কৌশল হত, গোপন করো, অস্বীকার করো এবং সর্বত্র বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দাও। 

৩। শত্রু চিহ্নিতকরণ: এইসব রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য সাধারণ সূত্র হল, তাদের সমালোচকদের প্রতি নির্মমতার খবরকে গোপন রাখতে দেশের মানুষকে নানা সমস্যায় জর্জরিত রাখা, মানুষের আবেগকে বিভ্রান্ত করা, নিজেদের ব্যর্থতাকে অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া এবং মানুষের হতাশাকে তাদের ভাগ্যের গোলকধাঁধায় চালান করা। এর জন্য কার্যকর পন্থা হল নিরন্তর প্রচার তথা অপপ্রচার। প্রায়শই তাদের অপছন্দের তালিকার সারিতে ছিল কমিউনিস্ট, সমাজতান্ত্রিক, ইহুদি, উদারপন্থী, সাধারণত সংখ্যালঘু, ঐতিহ্যবাহী জাতীয় শত্রু, বিধর্মী, ধর্মনিরপেক্ষবাদী, সমকামী এবং ‘সন্ত্রাসবাদী’। তাদের দৃষ্টিতে সক্রিয় বিরোধীরাই ছিল সন্ত্রাসবাদী, যথাযথভাবে তাদের মোকাবিলা করাই ছিল কর্তব্য।

৪। সামরিক আধিপত্যবাদ: ক্ষমতাসীন অভিজাতগোষ্ঠী সর্বদা মিলিটারি কর্তৃত্ববাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করত, এবং সমরশিল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়নের অনুকূল পরিবেশ পছন্দ করত। জনগণের বেঁচে থাকার অন্যান্য চাহিদা যখন প্রবল তখনও অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে জাতীয়আয়ের বিপুল অংশকে সামরিকখাতে বরাদ্দ করা হত। সামরিক বাহিনীকে যেহেতু জাতীয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হত এবং জাতীয় লক্ষ্যকে জাহির করতে প্রয়োজন হত সামরিক বাহিনীর, সেহেতু ক্ষমতাধারী শাসকের শক্তি-সম্মান বৃদ্ধির অন্যতম সহায়ক শক্তি হয়ে ওঠে সামরিক বাহিনী। 

৫। উৎকট লিঙ্গবৈষম্য: সহজ সত্য হল, এলিট রাজনীতি এবং জাতীয় সংস্কৃতি ছিল পুরুষের আধিপত্যে। এখানে নারী ছিল দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত। শাসক সর্বতোভাবে ছিল গর্ভপাত ও সমকামিতার বিরোধী। এই দৃষ্টিভঙ্গি তদানীন্তন ধর্মীয় গোঁড়ামির সমর্থনপুষ্ট ছিল। তাই, স্বীয় ভাবনাকেই তারা নানান পৈশাচিক আইনের দ্বারা প্রয়োগ করে। এভাবেই প্রস্তুত হয় আলোচ্য শাসনের এক কুৎসিত মোড়ক।

৬। একটি নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম: দেশের আইনের সৌজন্যে উল্লেখিত কিছু রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণমাধ্যম শাসকের কঠোর ও প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে আবদ্ধ ছিল; দলের নিয়ম-বিধিকে লঙ্ঘন করার সাধ্য কারোর ছিল না। শাসক গণমাধ্যমকে তার সূক্ষ্ম, কঠোর শক্তি প্রয়োগের নীতি দ্বারা অন্ধ গোঁড়ামিকে গৌরবান্বিত করতে বাধ্য করেছিল। পদ্ধতিগুলি ছিল, লাইসেন্স নিয়ন্ত্রণ, সম্পদ অধিগত করা, অর্থনৈতিক চাপ, দেশপ্রেমের জন্য আবেদন এবং অবশ্যই প্রচ্ছন্ন হুমকি। গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিরা বিশিষ্ট ক্ষমতাধর মানুষদের রাজনৈতিক তল্পিবাহকের ভূমিকা পালন করতে তাই বাধ্য হয়েছিল। ফলস্বরূপ, সাধারণ জনগণের ওপর আরোপিত সকল অন্যায় অবিচার অন্তরালেই অবরুদ্ধ হল।

৭। জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উন্মাদনা: অনিবার্যভাবে জাতীয় নিরাপত্তা ছিল মর্যাদাসম্পন্ন শাসকের নিয়ন্ত্রণে। নিপীড়নের এ এক অমোঘ হাতিয়ার। সব বাধা তুচ্ছ করে অতি সংগোপনে একে কার্যসিদ্ধ করা হত। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আরোপিত আচরণবিধির অধীনে সমগ্র অপকর্মকে ন্যায়সঙ্গত করা হত– ফলে, এই কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হলে তা দ্রোহকর্ম রূপেই সাব্যস্ত হত।

৮। একই গ্রন্থিতে আবদ্ধ ধর্ম ও শাসককুল: কমিউনিস্ট শাসকের বিপরীতে মতাদর্শবাদী ফ্যাসিবাদী ও প্রোটোফ্যাসিস্ট শাসকেরা ঈশ্বরহীনতার তত্ত্বে আস্থা রাখেনি। প্রকৃতপক্ষে, বেশিরভাগ শাসনব্যবস্থায় দেশের প্রধান ধর্মের সঙ্গে তারা নিজেদের সংযুক্ত করেছিল এবং সেই ধর্মের প্রকৃত সহিংস রক্ষক রূপে নিজেদের জাহির করতে গৌরব বোধ করত। বাস্তবে বিশিষ্ট শাসকদের আচরণ প্রকৃত ধর্মের অনুশাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও তাকে তারা জনগণের অগোচরে রাখতেই অভ্যস্ত ছিল। প্রচার বিভ্রমের দ্বারা শাসক এই মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় যে, তারাই ধর্মের রক্ষক এবং ধর্মহীনতার পরিপন্থী। সর্বত্র এই বিশ্বাস ভাসিয়ে দেওয়া হয় যে শাসকের বিরোধিতার অর্থ ধর্মদ্রোহিতা। 

৯। বিধিবদ্ধ সংস্থার (Corporation) ক্ষমতা সংরক্ষণ: যদিও সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবন কঠোর নিয়ন্ত্রণভুক্ত ছিল, তথাপি বড়ো কর্পোরেশনের কাজ করার আপেক্ষিক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়নি। ক্ষমতাসম্পন্ন শাসকেরা কর্পোরেট কাঠামোকে শুধুমাত্র সামরিক উৎপাদন সুনিশ্চিত করার (উন্নত দেশগুলিতে) সোপান হিসেবে নয়, সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একটি অতিরিক্ত উপায় হিসেবেও দেখেছিল। ধারাবাহিক পারস্পরিক স্বার্থের সুনিশ্চিতিকরণের জন্য, বিশেষত, সর্বহারা নাগরিকের উপর পীড়নকে বৈধতা দিতে ক্ষমতাসীন শাসকবর্গ বিশিষ্ট অর্থনৈতিক অভিজাতবর্গের প্রতি আদুরে প্রশ্রয় নীতি বজায় রেখেছিল। 

১০। শ্রমিক শ্রেণির শক্তিদমন অথবা নির্মূলকরণ: যেহেতু সংগঠিত যৌথ শ্রমকে ক্ষমতার অন্যতম ভরকেন্দ্র রূপে দেখা হত এবং শাসক ও কর্পোরেট আধিপত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার এর অসামান্য ক্ষমতা ছিল, তাই তাকে চূর্ণ ও শক্তিহীন করার প্রয়োজন পড়েছিল। দরিদ্রদের নিম্ন শ্রেণিভুক্ত করে সরাসরি তাদের সন্দেহ ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হয়। কিছু শাসনব্যবস্থায় আবার দারিদ্র্যকে সামাজিক কলঙ্ক রূপে বিবেচনা করা হয়। 

১১। শিল্পকলা ও বিদ্বৎসমাজের প্রতি তুচ্ছতার মনোভাব: বুদ্ধিজীবীদের স্বকীয় মজ্জাগত ধারণা ও মত প্রকাশের সহজাত স্বাধীনতাকে এই শাসকেরা গর্হিত কর্মরূপে গণ্য করেছিল। বুদ্ধিমত্তা এবং শিল্পলব্ধ জ্ঞানের স্বাধীনতা জাতীয় নিরাপত্তা ও আদর্শের জন্য ধ্বংসাত্মক বিবেচিত হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কঠোর নিয়ন্ত্রণের ঘেরাটোপে ছিল, রাজনৈতিকভাবে অবিশ্বস্ত যে-সব পণ্ডিতবর্গ বিভিন্ন শিক্ষাঅনুষদে বহাল ছিলেন তাঁদের হয়রানি বা অপসারণ স্বাভাবিক ছিল। মুক্ত ধ্যান-ধারণা বা ভিন্ন মতের অভিব্যক্তিকে দৃঢ়ভাবে আক্রমণ করা, নীরব করা বা প্রয়োজনে নস্যাৎ করা হয়েছিল। শিল্প ও সাহিত্য জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হলে তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখার কোনো অধিকার ছিল না। 

১২। অপরাধ ও শাস্তির বিষয়ে নাছোড়-ঝোঁক (obsession): এই শাসনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দানবিক ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা বজায় ছিল। ফলত বিশাল ও জনাকীর্ণ কারাগারের ব্যবস্থাও বহাল ছিল। পুলিশকে অকারণে মহিমান্বিত করা হত এবং তাদের হাতে ন্যস্ত ছিল অবাধ ক্ষমতা। ফলে পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার হত নিরন্তর। মিথ্যা ও ইচ্ছে মতো ধারা প্রয়োগ করে সাধারণ ও রাজনৈতিক অপরাধীর বিচার চলত। পুলিশি কার্যকলাপের যথার্থতা প্রমাণ করতে অপরাধী ও বিশ্বাসঘাতকের প্রতি ছড়ানো হয়েছিল ঘৃণার মনোভাব। 

১৩। ব্যাপক পক্ষপাতিত্ব ও দুর্নীতি: ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের মানুষজন যারা ক্ষমতাসীন শাসকদের ঘনিষ্ঠ ছিল তারা সেই পরিচয়কে ব্যবহার করে নিজেদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাত। বাস্তবিকই, এই দুর্নীতি উভয় পক্ষকে লাভবান করেছে। ক্ষমতাসম্পন্ন শাসক অর্থবান ব্যবসায়ীর উপঢৌকনে সমৃদ্ধ হয়েছে, পরিবর্তে সরকারি আনুকূল্য ও পক্ষপাতিত্বের জোরে ব্যবসায়ী নিজের মুনাফা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শাসকেরা অন্যান্য নানা উৎস থেকেও বিপুল সম্পদ অর্জনের অবস্থানে ছিল, যেমন জাতীয় সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন। জাতীয় নিরাপত্তা দপ্তর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় এবং সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য করায় অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি সাধারণ জনগণের বোধগম্যতার বাইরেই থেকে যায়। 

১৪। জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচন: নির্বাচনের নামে গণভোট বা জনরায়, যা নেওয়া হত তা ছিল সম্পূর্ণ এক জালিয়াতি। যখনই বহু প্রার্থী সমন্বিত প্রকৃত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হত, তখনই অভিযোগ উঠত নির্বাচনি কারচুপি ও বিকৃতির। ফলত, নির্বাচনের ফলাফলে প্রকৃত জনরায় প্রতিফলিত হত না। এরূপ শাসনে নির্বাচনের সাধারণ অর্থই ছিল নির্বাচনযন্ত্র বা সার্বিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা, বিরোধী ভোটারকে ভীত-সন্ত্রস্ত করা, বৈধ ভোট বাতিল করা বা ব্যালট নষ্ট করা, অথবা শেষ অবলম্বন রূপে আদালতের শরণাপন্ন হয়ে চলতি শাসনব্যবস্থা যাতে বজায় থাকে তা সুনিশ্চিত করা। 

ফ্যাসিবাদী এই সব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কোনো একটি বিপদের সংকেত ধ্বনি কি আপনার কান অবধি পৌঁছেছে? নিশ্চয়ই, না। আসলে এটা তো আমেরিকা– এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনের শাসন, সংবিধান, মুক্ত গণমাধ্যম, সৎ নির্বাচন ব্যবস্থা এবং সু-অবহিত জনগণের সদা সজাগ দৃষ্টির দ্বারা গণতন্ত্র বলবৎ। এইরূপ ঐতিহাসিক তুলনা তাই বাচনিক কসরতের অতিরিক্ত কিছু নয়। (তাই কী?) হতেও পারে, আবার নাও পারে।

[মূল রচনা: Lawrence W. Britt, ‘Fascism Anyone?’, Free Inquiry, Spring 2003, অনুবাদ: মানস মুখোপাধ্যায়।]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান