ফ্যাসিবাদ ও গণমাধ্যম

সৌম্য দত্ত 

ফ্যাসিবাদ একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ, যা কর্তৃত্ববাদ, জাতীয়তাবাদ এবং বিরোধীদের দমনকে চিহ্নিত করে, ইতিহাসে প্রচার ও নিয়ন্ত্রণের জন্য মিডিয়াকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফ্যাসিবাদ এবং মিডিয়ার সম্পর্ক বহুমাত্রিক, যা জনসাধারণের ধারণা পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক বর্ণনা গঠন এবং ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য গণমাধ্যম ব্যবহারের অন্তর্ভুক্ত। ফ্যাসিবাদ এবং মিডিয়ার সম্পর্ক হিটলার এবং মুসোলিনির যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। হিটলারের উত্থান মিডিয়ার ভূমিকার সঙ্গে যুক্ত। হিটলারের একটি যত্নশীল, কোমল ব্যক্তিত্ব হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে নির্মিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপত্যের ইতিহাসের অধ্যাপক দেশপিনা স্ট্র্যাটিগাকোস তাঁর বই ‘হিটলার অ্যাট হোম’-এ লিখেছেন হিটলারের অভ্যন্তরীণ বৃত্ত ১৯৩০-এর দশক জুড়ে তাঁকে এক উন্নত চরিত্রের ও নৈতিক রাষ্ট্রনীতিবিদ হিসেবে চিত্রায়িত করতে কাজ করেছিল। জার্মানি এবং বিদেশে সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক থেকে হালকা বিষয়বস্তু সম্পর্কিত প্রকাশনায় হিটলারকে চিত্রিত করা হয়েছিল একজন সহানুভূতিশীল ব্যক্তি হিসেবে, যিনি শিশু এবং কুকুরদের সঙ্গে খেলা করতে ভালোবাসতেন। ম্যাককোনাল তাঁর থিসিস ‘হাউ হিটলার কন্ট্রোলড দ্য প্রেস’-এ পর্যবেক্ষণ করেন যে, ‘Mein Kampf’-এ হিটলার পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন কেন প্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তিনি মনে করতেন যে, রাষ্ট্রের প্রেসের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। তাঁর বইয়ে তিনি গণমানুষের বোকামির জন্য প্রেসকে দোষারোপ করেন। হিটলারের প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়বেলস এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করেন যা সমস্ত মিডিয়া– পত্রিকা, রেডিও এবং সিনেমা– নিয়ন্ত্রণ করত। তিনি নিশ্চিত করেন যে, নাৎসি মতাদর্শের সাথে সংগতিপূর্ণ নয় এমন পত্রিকাগুলি নির্মূল করা হোক এবং তাদের সম্পাদকদের concentration camp-এ পাঠানো হোক। জার্মান প্রেস, মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নির্দেশনার অধীনে কাজ করত। রাষ্ট্র-সমর্থিত সংবাদপত্রগুলির একচেটিয়া প্রভাব ছিল। নাৎসি প্রচারের একটি মূল নীতি ছিল সরল, আবেগময় বার্তার ব্যবহার। নাৎসিরা শুধু শিক্ষিত এলিটকেই নয়, সাধারণ নাগরিকের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিল। তারা জটিল ধারণাগুলিকে স্লোগান এবং চিত্রে সংক্ষিপ্ত করত যা একটি বৃহৎ শ্রোতার সঙ্গে প্রতিধ্বনিত হতে পারে। বিখ্যাত স্লোগান ‘Ein Volk, ein Reich, ein Führer’ (এক জাতি, এক সাম্রাজ্য, এক নেতা)– এই কৌশলের উদাহরণ, যা হিটলারের প্রতি একতাবদ্ধতা এবং আনুগত্যের অনুভূতি তৈরি করেছিল। সিনেমা নাৎসি প্রচারের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে উদ্ভূত হয়েছিল। হিটলার সিনেমার সম্ভাবনা উপলব্ধি করে দেখেন যে চলচ্চিত্র জনসাধারণের ধারণা গঠন করতে এবং বার্তা আরও কার্যকরভাবে পৌঁছাতে পারে। সরকার চলচ্চিত্র তৈরি করেছিল যা আর্য জাতিকে গৌরবান্বিত করে এবং হিটলারের চরিত্রকে নায়ক হিসেবে চিত্রিত করে। এর মধ্যে একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল লেনি রিফেনস্টালের ‘ট্রায়াম্ফ অফ দ্য উইল’, যা ১৯৩৪ সালের নুরেমবার্গ সমাবেশ ডকুমেন্ট করেছে। চলচ্চিত্রটি চিত্তাকর্ষক দৃশ্য, মহিমান্বিত সংগীত এবং শক্তিশালী বক্তৃতার সংমিশ্রণে হিটলারের চারপাশে একটি দেবত্ব সৃষ্টি করে এবং জাতীয় গর্বের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। রিফেনস্টালের কাজ দেখায় কীভাবে ভিজ্যুয়াল মিডিয়া ব্যবহার করে শক্তিশালী আবেগময় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা যায়। ব্যাপক সমাবেশ, পোশাক পরিহিত সৈন্য এবং হিটলারের আকর্ষণীয় বক্তৃতার চিত্রায়ন শাসকের প্রতি সমর্থনের একটি কল্পনা তৈরি করতে কাজ করেছিল। এই চলচ্চিত্র নিশ্চিত করে দেখায় যে নাৎসিরা জার্মানির রক্ষক, তারা জার্মান জনগণের মধ্যে একটি সাধারণ জাতীয় পরিচয় তৈরি করছে। সিনেমার পাশাপাশি, রেডিয়ো হিটলারের প্রচার কৌশলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নাৎসিরা রেডিয়োর শক্তি বুঝতে পেরেছিল এবং একে ব্যবহার করে প্রতিটি পরিবারের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল।

নাৎসি শাসন ব্যবস্থা সম্প্রচারের এমন বাতাবরণ তৈরি করে যা হিটলারের বক্তৃতা, নাৎসি সংবাদ এবং তাদের মতাদর্শের সাথে সংগতিপূর্ণ সাংস্কৃতিক কর্মসূচিগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে। হিটলারের বক্তৃতাগুলি প্রায়শই আবেগময় ছিল, জাতীয় পুনর্জাগরণের প্রতিশ্রুতি এবং শনাক্তকৃত শত্রুদের বিরুদ্ধে দোষারোপ দিয়ে পূর্ণ। এইসব বক্তৃতা সম্প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল হিটলার এবং জার্মান জনগণের মধ্যে একটি সরাসরি সংযোগ তৈরি করা। চলচ্চিত্র, রেডিয়ো এবং সেন্সরশিপের কৌশলগত ব্যবহারের মাধ্যমে, হিটলার জনসাধারণের ধারণা পরিচালনা করতে, একতার অনুভূতি সঞ্চার করতে এবং বিরোধীদের দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই ঐতিহাসিক সময়ের বিভিন্ন নিবন্ধগুলি দেখায় নাৎসি মতাদর্শ গঠন এবং জার্মান সমাজকে প্রভাবিত করতে মিডিয়া কতটা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে।

ইতালিতে মুসোলিনি ১৯২৯ সালে High Commission of the Press প্রতিষ্ঠা করেন, সরকারি আগ্রাসনের বিরোধিতা না করে প্রেসের স্বাধীনতা রক্ষার নিশ্চয়তা দিয়ে। প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে, সাংবাদিকরা তাদের পেশাকে জাতির সেবায় নিয়োজিত করবে। মুসোলিনি আশা করেছিলেন যে ফ্যাসিজমের উন্নয়নের জন্য militant journalism প্রয়োজন। জাতীয় পত্রিকাগুলি মহৎ উদ্দেশ্যে কাজ করবে এবং এই অবস্থান থেকে বিচ্যুত যে কোনো তথ্য বা গল্পকে আড়ালে রাখা হবে। মুসোলিনি একজন লেখক এবং সম্পাদক হিসেবে ধারণার শক্তি এবং লিখিত শব্দের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন এবং বিভিন্ন সেন্সরশিপের মাধ্যমে প্রেসের উপর চাপ দেওয়া শুরু করেন। মুসোলিনির বক্তৃতা এবং লেখাগুলি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, এর মাধ্যমে তাঁর একটি আবেগপূর্ণ শক্তিশালী নেতার চিত্র তুলে ধরা হয় যিনি ইতালির পুনরুজ্জীবনে নিবেদিত। ফ্যাসিস্ট শাসক জাতীয়তাবাদকে সুনির্দিষ্ট করার জন্য স্লোগানগুলো ব্যবহার করে জনগণকে একত্রিত করে। এই মন্ত্রটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে কৌশলগতভাবে পুনরাবৃত্তি করা হয়। মুসোলিনি চলচ্চিত্রের সম্ভাবনাকে প্রচারের শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে বুঝেছিলেন। সরকার ফ্যাসিজমকে গৌরবান্বিত করে এবং মুসোলিনিকে অতিরঞ্জিত করে একটি চলচ্চিত্র সিরিজ তৈরি করে। এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল ১৯৩৭ সালের ‘দ্য লাস্ট ডেজ অফ পম্পেই’, যা প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যকে ইতালির মহানতার প্রতীক হিসেবে চিত্রিত করে এবং জাতীয় গর্ব ও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। মুসোলিনি ব্যক্তিগতভাবে চলচ্চিত্র উৎপাদনের অনেক দিক তদারকি করেছিলেন। তিনি বুঝতে পারেন যে ভিজ্যুয়াল ইমেজ শক্তিশালী আবেগীয় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। চলচ্চিত্র প্রযুক্তি, মহৎ দৃশ্যাবলি এবং নাটকীয় বর্ণনা ব্যবহার করে ইতালি এবং তার নেতার একটি আদর্শায়িত চিত্র তৈরি করা হয়। চলচ্চিত্রগুলি প্রায়ই শক্তি, ঐক্য এবং আনুগত্যের বিষয়গুলিকে গুরুত্ব দেওয়ায় ফ্যাসিবাদকে জাতীয় মহত্বের সমার্থক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। রেডিয়োর আগমন মুসোলিনিকে ফ্যাসিবাদী প্রচার ছড়ানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম প্রদান করে। সরকার একটি জাতীয় সম্প্রচার পরিষেবা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে যা মুসোলিনিকে আপামর শ্রোতার কাছে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়। রেডিয়ো সম্প্রচারের বিষয়বস্তু ছিল মুসোলিনির ভাষণ, সরকারি ঘোষণা, এবং ফ্যাসিস্ট আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সাংস্কৃতিক কর্মসূচি। মুসোলিনি প্রায়শই এই সম্প্রচারের মাধ্যমে সরাসরি জাতির উদ্দেশ্যে কথা বলতেন। তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত বক্তৃতাশৈলী এবং আবেগপ্রবণ আবেদন জনগণের মধ্যে একাত্মতার অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল। ফ্যাসিস্ট শাসক তাঁদের নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, সমালোচনা করা বুদ্ধিজীবী, শিল্পী এবং সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করে এক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।

ফ্যাসিবাদের উত্থান কীভাবে গণমাধ্যমের উপর প্রভাব ফেলেছিল, তা বিবেচনা করলে দেখা যায় যে গণমাধ্যমের ক্ষমতা রাজনৈতিক শাসনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে পারে– ঐতিহাসিকভাবেই এ সত্য। রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এবং শাসনের প্রভাব একত্রিত হয়ে মিডিয়াকে মানুষের চিন্তা এবং আচরণকে প্রভাবিত করতে ব্যবহার করা হয়। ফ্যাসিবাদী শাসন কেবল ফ্যাসিস্ট ভাবধারার প্রচার বিস্তৃত করেনি বরং বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গির পদ্ধতিগত দমনেও জড়িত ছিল। শাসকের প্রতি জনসমর্থন ও জনতার ঐক্যের ভাব বজায় রাখার জন্য মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ অত্যাবশ্যক ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ইতালিতে, বিরোধী সংবাদপত্রগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এই আধিপত্যবাদ সংস্কৃতির ওপরেও তার প্রভাব ফেলেছিল, শিল্প এবং সাহিত্যতে ফ্যাসিস্ট ভাবধারাকে প্রতিফলিত করা হয়েছিল। দেশের শাসনতন্ত্র নির্ধারণ করত কোনটা ঠিক এবং কোনটা ভুল। যে সকল শিল্পকর্মে দেশের শাসনতন্ত্রের গুণগান করা হত তাদেরকে অধিক প্রচার করা হত এবং যারা সমালোচনা করত তাদের নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হত। ফলস্বরূপ সৃজনশীলতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে দমিয়ে দিয়ে শুধু আনুগত্যকে উৎসাহিত এবং বলবৎ করা হয়েছিল। 

ফ্যাসিবাদ এক সম্মিলিত একক পরিচয়ের সৃষ্টি করে, যেখানে সবার লক্ষ্য এক শত্রু। মিডিয়া এই সমস্ত ক্ষেত্রে এমন এক কাহিনির যোগসূত্র গড়ে তোলে যার দ্বারা ফ্যাসিবাদের সমর্থকদের মধ্যে এক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে ওঠে এবং এই বৃত্তের বাইরের মানুষজনের প্রতি ঘৃণার জন্ম দেয়। জার্মানিতে ইহুদি, কমিউনিস্ট এবং অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীর চিত্রায়ণ একটি স্পষ্ট উদাহরণ, যে কীভাবে মিডিয়া নির্দিষ্ট জনগণের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উসকে দিতে পারে। প্রচারমূলক গণমাধ্যমে ক্রমাগতভাবে নেতিবাচক ধারণাকে প্রশ্রয় দিয়ে ভয় ও ঘৃণার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, যার পরিণতি নৃশংস হত্যা ও ধ্বংসলীলা । জনমত গঠনের ক্ষমতা বিশেষভাবে শক্তিশালী হয় সংকটের সময়, যখন মানুষ চরমপন্থী মতাদর্শের প্রতি আরও সংবেদনশীল হয়। ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থা প্রায়ই অর্থনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অশান্তি, এবং জাতীয় অপমানকে কাজে লাগিয়েছে, মিডিয়াকে ব্যবহার করে নিজেদেরকে এই সংকটগুলির সমাধান হিসেবে উপস্থাপন করতে।

বর্তমান গণমাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান

ফ্যাসিবাদ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পুনরুত্থানের সাক্ষী হচ্ছে। এর আধুনিক রূপটি মিডিয়ার ব্যবহার– সামাজিক মিডিয়া, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং গণমাধ্যমের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন ধরনের দ্বারা উল্লেখযোগ্যভাবে সহজতর হয়েছে, যা চরমপন্থী মতাদর্শগুলির দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ তৈরি করেছে। সামাজিক মিডিয়া তথ্য বিতরণ এবং গ্রহণের পদ্ধতিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। ফেসবুক, টুইটার এবং ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলি রাজনৈতিক আলোচনা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হয়ে উঠেছে। তবে, এই প্ল্যাটফর্মগুলি ফ্যাসিবাদসহ চরমপন্থী মতাদর্শগুলির জন্য প্রজনন ক্ষেত্র হিসাবেও কাজ করে। সেন্সেশনাল বিষয়বস্তুকে অগ্রাধিকার দেওয়া অ্যালগরিদমগুলি ঘৃণা বক্তৃতা, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা ফ্যাসিস্ট কাহিনিগুলিকে প্রান্তিক জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে। সামাজিক মিডিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এর মাইক্রো-টার্গেটিং-এর ক্ষমতা। ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ প্রচারকারী গোষ্ঠীগুলি তাদের বার্তাগুলির প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে এবং লক্ষ করতে তথ্য(data)-বিশ্লেষণ ব্যবহার করতে পারে। এই ব্যক্তিগতকৃত পদ্ধতিটি ফ্যাসিস্ট মতাদর্শধারী গোষ্ঠীকে আবেগগতভাবে স্পর্শকাতর বার্তা তৈরি করতে সক্ষম করে, যেখানে প্রায়শই পরিচয়, অভিবাসন এবং সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত ভয় এবং ক্ষোভকে কাজে লাগানো হয়। ফলস্বরূপ, ফ্যাসিস্ট মতাদর্শগুলির বিস্তার আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে এবং তাদের মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে ওঠে। তথ্যের ম্যানিপুলেশন আজকের ফ্যাসিবাদ প্রচারকদের একটি মুখ্য কৌশল। ভুল তথ্য প্রচার যা প্রায়ই চরম ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলির দ্বারা পরিচালিত হয় এবং মূলধারার মিডিয়া, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি বিভ্রান্তি এবং অবিশ্বাস তৈরি করার চেষ্টা করে। এই গোষ্ঠীগুলি মিথ্যা গল্পের মাধ্যমে তথ্যের পরিবেশকে দূষিত করে, বিরোধী মতামতকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার এবং নিজেদের মতাদর্শকে বৈধতা দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে। সাম্প্রতিক বছরের অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ভুয়া তথ্য সত্য তথ্যের চেয়ে দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে সংকটকালীন সময়ে বা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাবলির সময়। এর ফলে ফ্যাসিবাদী আন্দোলনগুলি সামাজিক ভয়ের সুযোগ নিয়ে নিজেদেরকে সমস্যা সমাধানের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করেছে। অভিবাসন, অপরাধ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে ভুয়া তথ্য প্রচার ভয় এবং বিদ্বেষ উসকে দেয়, যা এই ধারণাকে দৃঢ় করে যে জাতি আজ বাইরের লোকদের থেকে হুমকির মুখে।

প্রথাগত মিডিয়াও ফ্যাসিবাদ প্রচারে একটি ভূমিকা পালন করে। মূলধারার সংবাদপত্রে চরম ডানপন্থী বক্তৃতার স্বীকৃতি দিলে এই মতাদর্শগুলি বৈধতা পেয়ে যায়। যখন মিডিয়া ‘মুক্ত বক্তব্য’-এর অছিলায় উগ্রবাদী কণ্ঠস্বরকে প্ল্যাটফর্ম দেয়, তখন এ এমন এক পরিবেশ তৈরি করে যেখানে এসব মৌলবাদী মতামত গ্রহণযোগ্য, এমনকি মূলধারার হিসেবে দেখা হতে থাকে। রাজনৈতিক বিষয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেখানে বিভাজনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যেমন অভিবাসনকে আক্রমণ হিসেবে উপস্থাপন করা বা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে উগ্রপন্থা হিসেবে চিত্রিত করা। এর ফলে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই স্বীকৃতির প্রক্রিয়া কেবল জনমতের উপর প্রভাব ফেলে না, বরং নীতি নির্ধারণের উপরও প্রভাব বিস্তার করতে পারে, কারণ রাজনীতিবিদরা মিডিয়ার দ্বারা গঠিত আখ্যানগুলিতে প্রতিক্রিয়া জানায়। ফ্যাসিবাদের আকর্ষণ প্রায়ই পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির মধ্যে নিহিত থাকে, যেখানে জাতীয়তাবাদ এবং সাংস্কৃতিক বিশুদ্ধতার উপর জোর দেওয়া হয়। আধুনিক মিডিয়া এই বিষয়গুলিকে পুনর্ব্যক্ত করতে একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। জনপ্রিয় সংস্কৃতি– যেমন চলচ্চিত্র, সংগীত এবং আন্তর্জালিক বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম– জাতীয়তাবাদী অনুভূতিকে প্রচার করতে এবং ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদী ব্যক্তিত্ব বা আন্দোলনকে গৌরবান্বিত করতে পারে। এই সাংস্কৃতিক অনুরণন তাদের আকৃষ্ট করতে পারে, যারা সরাসরি ফ্যাসিস্ট হিসেবে চিহ্নিত না হলেও এই বর্ণনার দ্বারা উৎসাহিত মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তদুপরি, শিল্প এবং মিডিয়ায় ঐতিহাসিক ফ্যাসিস্ট প্রতীক ও থিমের পুনরুজ্জীবন ফ্যাসিবাদী মতাদর্শকে আরও বৈধতা দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নিয়ো-ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীগুলির পুনরুত্থান প্রায়ই সেই সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির সঙ্গে মিলে যায় যা অতীতকে রোমান্টিকভাবে উপস্থাপন করে, যা একটি ‘সোনালী যুগ’ রূপে চিহ্নিত এবং যাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

ভারতের গণমাধ্যম ও ফ্যাসিবাদী প্রবণতা

ভারতীয় গণমাধ্যম গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। এযাবৎ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে বর্তমানে ভারতীয় মিডিয়ার অনেকাংশে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে; গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতি এই হুমকির কারণে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা নিয়ে উদ্‌বেগ প্রকাশিত হচ্ছে। ভারতের মিডিয়ায় সবচেয়ে উদ্‌বেগজনক প্রবণতাগুলির মধ্যে একটি হল সরকার এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের দ্বারা বাড়তে থাকা সেন্সরশিপ এবং নিয়ন্ত্রণ। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রতিকূল প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ, ভীতি বা এমনকি হিংসাত্মক ঘটনা বাড়ছে। অবৈধ কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন (UAPA) এবং অন্যান্য কঠোর আইনগুলি প্রায়ই ভিন্নমতকে নীরব করতে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা রিপোর্টার এবং মিডিয়া সংস্থাগুলির মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে। তাছাড়া, সরকারি সম্প্রচারকদের উপর সরকারের প্রভাব বিভিন্ন মতামতের সংকোচন ঘটিয়েছে। মিডিয়াতে উৎপাদিত বিষয়বস্তু প্রায়ই শাসক দলের বর্ণনার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিলে যাচ্ছে, যা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য মতামতের বৈচিত্র্যকে সীমাবদ্ধ করে তুলেছে। তথ্যের উপর এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ ফ্যাসিবাদী শাসনের স্মৃতি উসকে দেয়, যেখানে রাষ্ট্র মিডিয়ার উপর অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রভাব বিস্তার করে একটি একক মতাদর্শ প্রচার করে।

ভারতের মিডিয়ার মালিকানা কাঠামোও ফ্যাসিস্ট প্রবণতার বিষয়ে উদ্‌বেগ তৈরি করে। কিছু কর্পোরেট কনগ্লোমারেট মিডিয়া পরিবেশকে প্রাধান্য দেয়, যা শক্তির কেন্দ্রীকরণ এবং একটি একক বর্ণনা সৃষ্টি করতে পারে। এই কেন্দ্রীকরণ প্রায়ই স্ব-সেন্সরশিপের দিকে নিয়ে যায়, যেখানে মিডিয়া সংস্থাগুলি তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্য বা সরকারের বিরাগভাজন হওয়া এড়াতে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ এড়িয়ে চলে। যখন মিডিয়া মালিকদের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে, তখন সাংবাদিকতা এবং প্রচারের মধ্যে রেখাটি অস্পষ্ট হয়ে যায়। বিষয়, ঘটনা এবং ভিন্নমতের উপস্থাপনা প্রায়ই শাসক দলের পক্ষে বিড়ম্বনার হয়, কিন্তু, মিডিয়া এ বিষয়ে নীরব থাকায় জনসাধারণের মধ্যে নিরপেক্ষ তথ্যের প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই ধরনের কার্যকলাপ মিডিয়ার সমালোচনামূলক যথার্থ ভূমিকা দুর্বল করে, যা গণতান্ত্রিক সমাজের এক অন্যতম ভিত্তি।

ভারতের মিডিয়ায় ফ্যাসিস্ট প্রবণতার আর-একটি মাত্রা হল এক চরম জাতীয়তাবাদের প্রচার। সাম্প্রতিক সময়ে, রাষ্ট্রকে গৌরবান্বিত এবং ভিন্নমতকে দেশবিরোধী রূপে উপস্থাপন করার এক মিডিয়া-বর্ণনার উত্থান ঘটেছে। ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’-এর মতো শব্দগুলি প্রায়ই সরকারি নীতির সমালোচনাকারী ব্যক্তিদের উদ্দেশে ব্যবহার করা হয়, যা গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে শত্রুতাপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি করে। এই উগ্র-জাতীয়তাবাদী বক্তৃতা সংখ্যালঘুগোষ্ঠী এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের আরও বেশি করে কোণঠাসা করতে থাকে। মিডিয়ার এই ভূমিকা বিভাজনকে সামনে এনে সামাজিক উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে, যা ফ্যাসিস্ট প্রচার কৌশলের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়, যেখানে ভয়কে ব্যবহার করে জনগণকে একত্রিত করার চেষ্টা চলে।

মিডিয়ার ভিন্নমত সম্পর্কিত এই দৃষ্টিভঙ্গি ফ্যাসিস্ট প্রবণতাগুলিকে আরও স্পষ্ট করে। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিবাদের সংবাদ পরিবেশন সংবাদের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। সরকারি এজেন্ডার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আন্দোলনগুলি ইতিবাচকভাবে পরিবেশিত হয়, অথচ যে খবরগুলি তা চ্যালেঞ্জ করে সেই সংবাদগুলি প্রায়শই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হয়। এই পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদনে জনমতের বিকৃতির পাশাপাশি নাগরিক সম্পৃক্ততা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণও বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যে-সকল সাংবাদিকরা বিতর্কিত বিষয়কে উত্থাপন করার চেষ্টা করেন, তাঁরা হয়রানি এবং হুমকির শিকার হন। এই ভয়ের পরিবেশ অন্যদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে নিরুৎসাহিত করে, করতে পারে। ফলে এমন একটি মিডিয়া পরিবেশ সৃষ্টি হয় যেখানে পেশাগত দায়িত্বশীলতা এবং স্বচ্ছতার অভাব থাকে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হওয়ার পর দেশে ব্যাপক প্রতিবাদের সৃষ্টি হয়। এই আইনটি প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে আগত অ-মুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদান করে, যা অনেকের বিবেচনাতে ছিল বৈষম্যমূলক। শাসক দলের মিডিয়া সহযোগীরা এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিত্রিত করে, প্রতিবাদকারীদের ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ রূপে চিহ্নিত করে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রায়ই জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার জন্য বিতর্ক সভার আয়োজন করে, যা সিএএ-এর বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক কণ্ঠগুলিকে দমিয়ে দিতে চায়। এই প্রচার কেবল জনমানসের ধারণাকে বিকৃত করে বিপথে চালিত করেনি, বরং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাও উসকে দিয়েছে, যা জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার চারপাশে জনমত একত্রিত করার একটি বৃহত্তর কৌশলকে প্রতিফলিত করে। ২০২০-২০২১ সালের কৃষকদের প্রতিবাদ, যা নতুন কৃষি আইনগুলির বিরুদ্ধে ছিল, মিডিয়া ম্যানিপুলেশনের আর-একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। শাসক দলের মিডিয়া ন্যারেটিভ প্রতিবাদী কৃষকদের ‘জঙ্গি’ বা ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ হিসেবে চিত্রিত করে, তাদের বৈধ অভিযোগ সত্ত্বেও। কিছু মিডিয়া প্রতিষ্ঠান কৃষকদের চরিত্রহননের জন্য লিপ্ত হয়, অধিকাংশ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ঘটনাকে আড়াল করে বিচ্ছিন্ন হিংসার ঘটনাগুলি বড়ো করে দেখায়। এই চিত্রায়ণ কৃষকদের দাবি খণ্ডিত করার এবং সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করেছে, যা দেখায় মিডিয়াকে কীভাবে বিরোধী কণ্ঠকে দমন এবং নিষ্ক্রিয় করার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। বিক্ষোভের উপস্থাপন ভঙ্গি বিদ্রোহীদের প্রতি এক শত্রুতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করে, যা কর্তৃত্ববাদীর শাসন-কৌশলের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। COVID-19 মহামারির সময়, গণমাধ্যমে জনসাধারণের ধারণা গঠনের ভূমিকা বিশেষভাবে স্পষ্ট ছিল। যখন সরকার সংকট মোকাবিলায় সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল, তখন সরকারপন্থী মিডিয়া ব্যাপকভাবে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ এই ন্যারেটিভের উপর গুরুত্ব দেয়, সরকারের প্রচেষ্টাগুলিকে তুলে ধরে এবং ব্যর্থতাগুলিকে লঘু করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, সরকারি উদ্যোগে ‘ভ্যাকসিন মৈত্রী’ কার্যক্রমের উদ্‌যাপনমূলক রিপোর্টের প্রকাশ, যা সমগ্র বিশ্বে ভারতের ভ্যাকসিন সরবরাহকারীর উজ্জ্বল ভূমিকাকে তুলে ধরে নাগরিকদের অভ্যন্তরীণ সংগ্রামকে ঢেকে দেয়। এই বৈষম্য মূলক সাংবাদিকতা সত্যের এক অপলাপ মাত্র। এই সাংবাদিকতা সরকারের কোনো সমালোচনা করে না কেবলমাত্র মেরুদণ্ডহীন লেজুড়ের মতো সরকার যা বলে তাই সংবাদ হিসেবে পরিবেশন করে। 

হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, X এবং ফেসবুকের ব্যবহার প্রপাগান্ডার দ্রুত বিস্তারে সহায়তা করে চলেছে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে পার্টির সাথে যুক্ত ট্রোলাররা প্রতিপক্ষকে কলঙ্কিত করতে এবং সম্প্রদায়গত বিভাজন করতে কাজ করে। নির্বাচনের সময় দেখা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারাভিযানগুলি বিরোধী নেতাদের সম্পর্কে মিথ্যা ন্যারেটিভ ছড়িয়ে দেয়, তাঁদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এই কৌশল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে তোলে এবং ভয়ের মাধ্যমে জনসাধারণের ধারণা পরিবর্তন করে দেয়, যা ফ্যাসিস্ট প্রপাগ্যান্ডার এক পুরাতন কৌশল। বেশ কয়েকজন সাংবাদিক দেশের প্রকৃত তথা সংবেদনশীল সমস্যা নিয়ে প্রতিবেদন রচনা করার জন্য হেনস্তা, আইনি পদক্ষেপ, এমনকি হিংসার সম্মুখীন পর্যন্ত হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে সাংবাদিক রানা আয়ুবের বিরুদ্ধে মামলার কথা বলা যেতে পারে, যিনি তাঁর সরকার বিরোধী সমালোচনামূলক রিপোর্টিংয়ের জন্য হেনস্তা ও হুমকির শিকার হয়েছেন। রাষ্ট্রের ক্ষমতার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে স্বাধীন পথে চলার চেষ্টা করে চলেছে যে সমস্ত সাংবাদিক, এই অগণতান্ত্রিক ও ভয়ের আবহ তাঁদের জন্য এক দ্বিধাময় ও প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করেছে।

ফ্যাসিস্ট প্রবণতার হাত থেকে মুক্তির পথ

ভারতীয় মিডিয়ায় ফ্যাসিস্ট প্রবণতার প্রভাব মোকাবেলা করতে হলে সাংবাদিকতার সততা পুনরুদ্ধার, মতপ্রকাশের বৈচিত্র্য প্রচার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করার জন্য একটি বহুমুখী পন্থার প্রয়োজন:

নৈতিক নির্দেশিকা প্রয়োগ: পক্ষপাতহীন রিপোর্টিং এবং সততাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য কঠোর নৈতিক বিধি স্থাপন ও অনুসরণ করা।

সম্পাদকীয় স্বাধীনতা: সম্পাদকদের রাজনৈতিক সম্পর্ক বা কর্পোরেট স্বার্থের পরিবর্তে সাংবাদিকতার নীতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া উচিত।

শিক্ষামূলক উদ্যোগ: বিদ্যালয় স্তর থেকে শুরু করে সাধারণ জনতার মধ্যে এমন শিক্ষামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা, যা মানুষকে সংবাদের সূত্রগুলি থেকে সমালোচনামূলকভাবে তথ্য ও সংবাদের যথার্থ মূল্যায়ন করতে এবং পক্ষপাত বা ভুল তথ্য চিহ্নিত করতে শেখাবে।

তথ্য যাচাই: ভুল তথ্য মোকাবেলার জন্য স্বাধীন তথ্য যাচাইয়ের সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং স্বচ্ছতা প্রদান করা।

মিডিয়া স্বাধীনতার আইনকে সমর্থন করা: সাংবাদিকদের হেনস্তা, ভয়ভীতি এবং হিংসা থেকে রক্ষার জন্য আইনগত কাঠামো তৈরি করা।

সমর্থন নেটওয়ার্ক তৈরি করা: যে-সমস্ত সাংবাদিকরা হুমকি বা নির্যাতনের সম্মুখীন হচ্ছেন, তাঁদের জন্য আইনগত সহায়তা এবং সমর্থন প্রদানকারী সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

সোশ্যাল মিডিয়ার দায়িত্বশীল ব্যবহার: মিডিয়া সংস্থাগুলিকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে উৎসাহিত করা; যেন তারা আউটরিচের জন্য এই মাধ্যমগুলি ব্যবহার করে, সেইসঙ্গে নৈতিক মান বজায় রাখে।

বিকল্প প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার: সরকারি ভাষ্যের বিপরীতে বিকল্প বহুমুখী সংবাদ প্রদানকারী, অর্থাৎ মূলধারার ন্যারেটিভকে চ্যালেঞ্জকারী স্বাধীন মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে সমর্থন করা।

দায়বদ্ধতা: স্বাধীন প্রতিবিধানকারী সংস্থা ও জনসাধারণকে প্রদেয় পরামর্শদাতা বোর্ড গঠন করা, যার ফলে তারা মিডিয়া সংস্থাগুলিকে তাদের দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে সাহায্য করতে পারে।

সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা: সাংবাদিকদের অধিকার এবং নৈতিকমান রক্ষার জন্য ইউনিয়ন বা সমিতি গঠন করলে একটি শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ মিডিয়া ব্যবস্থা তৈরি হতে পারে।

সহযোগী তদন্ত: সহযোগী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করতে হবে। এই ধরনের সাংবাদিকতার প্রভাব বাড়াতে এবং তাকে সুনিশ্চিত করতে পারে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি তাদের যথাযথ প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে।

গণমাধ্যমে ফ্যাসিস্ট প্রবণতা আমাদের দেশে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। আশার আলো দেখাচ্ছে কিছু কিছু স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, কিছু কিছু নির্ভীক সাংবাদিক। কিন্তু আপামর চিত্রটা উদ্‌বেগের। বিভিন্ন প্রাইম টাইম নিউজ শোতে যেভাবে মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলে তা কোথাও গিয়ে মানুষের মধ্যে এক ক্লান্তির সঞ্চার করছে। আজ সাংবাদিকের উপর মানুষের আস্থা তলানিতে। বিভিন্ন সরকারের লেজুড় গণমাধ্যম এখন সবচেয়ে বিভ্রান্তির কারণ। ফেসবুক এবং এক্স-এর মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো এখন ফ্যাসিবাদ মতাদর্শ বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপদজ্জনক। এই মুহূর্তে সবচেয়ে প্রয়োজন মানুষের গণমাধ্যম সম্পর্কিত সঠিক সচেতনতা এবং ঠিক ও ভুল খবর নির্ণয় করার সক্ষমতা। খবরের প্রতি সত্যনিষ্ঠতা আগামী দিনে ফ্যাসিবাদের এই আগ্রাসনের হাত থেকে গণমাধ্যমকে রক্ষা করতে পারবে বলেই নিশ্চিত।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান