ফ্যাসিবাদ ও উগ্র-জাতীয়তাবাদ : কালে ও কালান্তরে

দেবনারায়ণ মোদক

বিশ্ব-রাজনীতির এক মহাসন্ধিক্ষণে একটি রাজনৈতিক ভাবাদর্শ হিসেবে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল এবং বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে তা এক প্রলয়ংকর রূপ ধারণ করে মানব সভ্যতাকেই বিপর্যস্ত করে তুলতে উদ্যত হয়েছিল। ইতালি ও জার্মানিতে এই মতবাদের উৎকট প্রকাশ বহু-আলোচিত হলেও কালে ও কালান্তরে বিবিধ প্রকরণে তার প্রতিফলনগুলি লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে এবং সেগুলির পর্যালোচনায় ফ্যাসিবাদের এমন কিছু ‘সাধারণ বৈশিষ্ট্য’ আমাদের নজরে এসেছে– যা সাম্প্রতিক সময়েও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলির মধ্যে উগ্র-জাতীয়তাবাদ বোধ করি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতা দখল বা ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রশ্নে ফ্যাসিবাদ প্রায় সর্বত্রই উগ্র-জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনাকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়ে উঠেছে। তা সে জাতিগত শুদ্ধতার তত্ত্বকে আশ্রয় করে নাৎসি জাতীয়তাবাদ হোক; বা ভারতের মতো দেশে হিন্দু জাতীয়তার ধারণাই হোক। সেদিক থেকে বলতেই হয় যে, সাধারণভাবে ফ্যাসিবাদকে একটি ‘কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থা’ বা দমনমূলক শাসন-কাঠামো হিসেবে চিহ্নিত করলেই তার স্বরূপ উদ্‌ঘাটিত হয় না; এমনকি ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের পশ্চাতে ক্রিয়াশীল অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা– বিশেষত ফ্যাসিবাদ ও পুঁজিবাদের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষণেও তার সবটুকু নির্যাস ধরা পড়ে না। একটি ‘সাংস্কৃতিক প্রকল্প’ হিসেবে ফ্যাসিবাদের ভাবাদর্শটি অনুধাবন করা বোধ করি তাই অত্যন্ত জরুরি এবং সেক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ ও জাতীয়তাবাদের আন্তঃসম্পর্কটির গভীর অনুশীলনের প্রয়োজন। প্রসঙ্গত বলতেই হয় যে, ফ্যাসিবাদের অন্তর্নিহিত রক্ষণশীলতা, অসহিষ্ণুতা ও দখলদারির মনোভাব ইত্যাদির পাশাপাশি ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ বা ‘ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ’-কে হাতিয়ার করে জনসাধারণের মধ্যে একটি ‘বিকল্প চেতনা’ গড়ে তোলার প্রয়াস অথবা তার ‘অগণতান্ত্রিকতা’-কে বৈধকরণের প্রচেষ্টা এবং তার মাধ্যমে জন-সমর্থন আদায় করে নেওয়ার কৌশলী রাজনীতি সে-কালে এবং এ-কালে কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে– তা বিশেষভাবে ভেবে দেখা দরকার। বর্তমান নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাই ফ্যাসিবাদ ও উগ্র-জাতীয়তাবাদের আন্তঃসম্পর্ক এবং বিশেষত সাম্প্রতিক সময়ে তার বিভিন্ন প্রকাশ সম্পর্কিত একটি রূপরেখা নির্মাণের প্রয়াস গৃহীত হয়েছে।

এক

প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, একটি ভাবাদর্শ হিসেবে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ এবং তার বিবিধ প্রকরণ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা এই নিবন্ধের উপজীব্য নয়। শিরোনামে উল্লিখিত মূল বিষয়ের আলোচনার সুবিধার্থে এখানে ধারণাগত কিছু বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে মাত্র। আমরা সকলেই জানি যে, ইতিহাসের পথ বেয়ে ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন প্রকরণ আমাদের সামনে এসেছে এবং সেগুলির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে বিদগ্ধজনদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্যও রয়েছে। ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা নির্ণয়ের প্রশ্নেও ভিন্নমতের অবকাশ রয়েছে। এখানে কেবল এটুকুই বলার যে, সাধারণভাবে ফ্যাসিবাদকে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা হিসেবে চিত্রিত করা হলেও কেবলমাত্র এ-কথার মধ্যে দিয়ে তার অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনাটি বুঝে নেওয়া অসম্ভব। বস্তুতপক্ষে, ফ্যাসিবাদ একটি কর্তৃত্বমূলক শাসন হলেও সব ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদ আখ্যা দেওয়া সংগত হবে না। এক্ষেত্রে ‘অতিসরলীকরণ’ (Over-simplification)-এর প্রবণতাকে পিছনে ফেলে গভীর বিশ্লেষণের পথে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের পিছনে ক্রিয়াশীল মতাদর্শটি অনুধাবন করাটা তাই অত্যন্ত জরুরি বলে বিবেচিত হবে। সেক্ষেত্রে একটি মতবাদ হিসেবে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা অবশ্যই জরুরি। শব্দগতভাবে (etymologically) Fascism শব্দের ব্যঞ্জনাটিও এদিক থেকে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ইংরেজি Fascism শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Fascia শব্দ থেকে যার অর্থ হল এক বোঝা লাঠির সাথে একটি কুঠার। এটি হল ঐক্য, সংহতি ও কর্তৃত্বের প্রতীক। এটি এমন এক ধরনের মতবাদ যেখানে রাষ্ট্রই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী– ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতার প্রশ্নটি এখানে গৌণ। বলপ্রয়োগ ও হিংসার উপর প্রতিষ্ঠিত এমনতরো শাসনকাঠামোয় শেষ-বিচারে উগ্র-জাতীয়তাবাদ, সামরিকায়ন, প্রশাসনিক কঠোরতা, বিরোধী কণ্ঠরোধ এবং সর্বোপরি, ‘এক দল-এক নেতা-এক রাষ্ট্র’-এর ধারণাই প্রকটিত। ফ্যাসিবাদের তত্ত্বগত উৎসভূমি হিসেবে অনেকেই হেগেলের অধিবিদ্যামূলক ভাবনা এবং সোরেলের সক্রিয়তাবাদী মতবাদের উল্লেখ করেন। ইবেনস্টাইন অবশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন যে, ফ্যাসিবাদ হল অন্ধ জাতীয়তাবাদী, জাতিবিদ্বেষী, আগ্রাসী ও সামগ্রিকতাবাদী মতবাদ। 

মার্কসবাদীরা অবশ্য ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যায় পুঁজিবাদের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়েই অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন এবং তাকে ‘কর্পোরেট-বাদ’ (Corporatism)-এর সঙ্গে প্রায় সমার্থক বলে মনে করেন, কারণ তাদের মতে ফ্যাসিবাদ হল রাষ্ট্র ও কর্পোরেট শক্তির একীকরণ। সাম্প্রতিককালে মার্কসবাদের আলোচনায় অবশ্য অনিবার্যভাবেই জর্জি ডিমিট্রভের ফ্যাসিবাদ ভাবনার মূল সূত্রের পাশাপাশি ইতালীয় চিন্তাবিদ আন্তোনিও গ্রামশি-র ভাবনাও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিচারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। এছাড়াও পশ্চিমি মার্কসবাদীদের মধ্যে ফ্যাসিবাদকে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যার বাইরে এসেও বোঝার চেষ্টা হয়েছে

প্রসঙ্গত বলি যে, ফ্যাসিবাদকে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের আর-একটি সংস্করণ বলে লঘু করে দেখা ঠিক হবে না কারণ তা হল কার্যত একধরনের সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব। বাক্‌চাতুর্যের দ্বারা তারা জনগণের মন জয় করে; আগ বাড়িয়ে অনেক সময় তাদের মনের কথা বলার নামে তাদের বদ্ধমূল কুসংস্কারগুলিকে উসকে দিয়ে অন্ধকারময় অতীতকে সামনে টেনে আনে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদির দোহাই পেড়ে প্রতিহিংসার রাজনীতিতে তাদের শামিল করতে প্রয়াসী হয়। জাত্যভিমানের কথা বলে হিংসার বৈধকরণ করে। সবচেয়ে বিপদের কথা এই যে, এ-ধরনের রাজনীতিতে জনজীবনের মূল সমস্যাগুলি আড়াল করা হয় এবং বিদ্বেষমূলক রাজনীতি অবলম্বনে শাসন ও শোষণ ব্যবস্থার স্থায়ীকরণের প্রয়াস গৃহীত হয়। বলাবাহুল্য যে উগ্র-জাতীয়তাবাদ এ-সব কিছুর গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ফ্যাসিবাদ যখনই যেখানে ক্ষমতা দখল করেছে তা কোনও না কোনোভাবে উগ্র-জাতীয়তাবাদকেই সুকৌশলে ব্যবহার করেছে। এ-সব কিছু নিয়েই বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ রয়েছে। সে-সব কথায় না গিয়ে সংক্ষেপে বলি যে, ফ্যাসিবাদ হল মৌল কর্তৃত্ববাদী জাতীয়তাবাদের একটি রূপ– যা একটি সামগ্রিকতাবাদী (totalitarian) শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেদের শাসনকে সংহত করতে চায়। এ-কাজের জন্য তারা নির্ভর করে এমন একটি দল বা বাহিনীর উপরে যা গোটা দেশকেই ‘ফ্যাসিবাদী আদর্শ’-তে সংগঠিত করতে প্রয়াসী। এখানে রাষ্ট্রের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই ‘জাতীয় সংহতি’-র ধুয়ো তুলে শ্রেণিভেদকে আড়াল করার প্রচেষ্টাও তেমনি জোরদার। তত্ত্বগতভাবে ফ্যাসিবাদ তাই মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্রের প্রবলভাবে বিরোধী। অবশ্য পুঁজিবাদের কিছু বিষয়ও তাদের অপছন্দের, কারণ সেখানে উদারনীতির বাড়বাড়ন্ত মানুষের অধিকারের দাবিকে কমবেশি সামনে নিয়ে আসে। অনেকে তাই একে ‘তৃতীয় অবস্থান’ আখ্যা দিয়ে থাকেন। আসলে ফ্যাসিবাদের মধ্যে একটা ‘যুদ্ধং দেহী’ মনোভাব বিশেষ লক্ষণীয়, যা জনগোষ্ঠীর একটা বিপুল অংশকে আর-একটা গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়িয়ে দিতে চায়। সামরিকায়ন, দমননীতি ও অধিকারহীনতা তাই ফ্যাসিবাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ রূপে পরিচিত হয়।  

ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলি যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের পৃথিবীতে ইতালি ও জার্মানি-সহ যেখানেই ফ্যাসিবাদের বিকাশ ঘটেছে সেখানেই ফ্যাসিবাদের এই ‘সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি’ (Common Characetristics) কমবেশি লক্ষণীয় হয়েছে। অবশ্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত, পরিস্থিতিগত পার্থক্য এবং কালানুক্রম অনুসারে প্রকরণগত ভিন্নতার কথা মনে রাখতেই হয়। এতৎসত্ত্বেও জার্মানির হিটলার, ইতালির মুসোলিনি, স্পেনের ফ্রাঙ্কো, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো এবং ল্যাটিন আমেরিকার কিছু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পর্যালোচনা করে মার্কিন চিন্তাবিদ লরেন্স ব্রিট ফ্যাসিবাদের যে চোদ্দটি লক্ষণ (fourteen traits) শনাক্ত করেছেন তা এই প্রসঙ্গে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। সেগুলি যথাক্রমে–

১) কট্টরপন্থী ও চলমান জাতীয়তাবাদ ২) মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা ৩) শত্রু বা ‘বলির পাঁঠা’ চিহ্নিতকরণ ৪) সামরিক আধিপত্য ৫) উৎকট লিঙ্গবৈষম্য ৬) নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ৭) জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রচণ্ড উন্মাদনা ৮) ধর্ম ও রাষ্ট্রের গ্রন্থিবন্ধন ৯) কর্পোরেট শক্তিকে সুরক্ষাপ্রদান ১০) শ্রমিকশক্তির দমন ১১) বুদ্ধিজীবী ও শিল্পকলার প্রতি অবজ্ঞা ১২) অপরাধ ও শাস্তির বিষয়ে মাত্রাহীন আগ্রহ ১৩) অবাধ স্বজনপোষণ ও দুর্নীতি এবং ১৪) নির্বাচনে কারচুপি।

লরেন্স ব্রিট কৃত এই ‘সাধারণ বৈশিষ্ট্য’ নির্ণয় সম্পর্কে নানা কথা বলা গেলেও ফ্যাসিবাদের সঙ্গে উগ্র-জাতীয়তাবাদের সংযোগ প্রসঙ্গটি কিন্তু বিভিন্নভাবেই ঘুরে ফিরে এসে পড়ে। বস্তুতপক্ষে, ব্রিটের চোদ্দ দফার মধ্যে এটি যে প্রথমেই ভিন্নভাবে উত্থাপিত হয়েছে শুধু তাই নয়; অন্ততপক্ষে তার অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই যে তার সঙ্গে সম্পর্কিত সেকথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। লক্ষণীয় যে, প্রায় সব ফ্যাসিবাদী শাসন-কাঠামোতে বা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অতীত ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ, এক প্রকারের দেশভক্তিমূলক আদর্শ, স্লোগান, সংগীত, প্রতীক ইত্যাদির ব্যবহার এমন সুচারুভাবে ও ধারাবাহিকভাবে করা হয়ে থাকে যা মানুষকে তার দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলিকে তুলনামূলক ভাবে লঘু করে দিয়ে আবেগ-সর্বস্ব করে তুলতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সর্বত্র জাতীয় পতাকা বা প্রতীকের প্রদর্শন– পরিধেয় বস্ত্র এবং সাজসজ্জায় তার বহুল প্রচার এর গুরুত্বপূর্ণ দিক। রজার গ্রিফিনের আলোচনাতেও আমরা যেন বেশ কিছুটা তারই প্রতিধ্বনি লক্ষ করি। ‘Nature of Fascism’ শীর্ষক গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন যে, ফ্যাসিবাদের ধারণা গড়ে উঠেছে একটা ‘মিথ’ (Myth) অথবা প্রবাদ বা কল্পনাকে আশ্রয় করে– যার মূলে রয়েছে উগ্র-জাতীয়তাবাদ। ‘মহান অতীতের পুনরাবিষ্কার’ (re-discovery of glorious past) বা এক ধরনের ‘পুনর্জাগরণ’-এর ভাবনা যেন সেখানে কোনো-না-কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট থাকে। ফ্যাসিবাদের এমনতরো ভাবাদর্শের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন, সেগুলি যথাক্রমে– ১) পুনর্জাগরণের মতবাদ/প্রবাদ; ২) জনপ্রিয় উগ্র-জাতীয়তাবাদ; এবং ৩) নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের কল্পনা।

ফ্যাসিবাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত এমনতরো আলোচনা থেকে বর্তমান প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলে রাখা যেতেই পারে, যার মধ্যে প্রথমটি হল এই যে, ফ্যাসিবাদকে নিছক একটি কর্তৃত্বমূলক শাসন হিসেবে না দেখে তার অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনাটি অনুধাবন করাটা অত্যন্ত জরুরি। সংশ্লিষ্ট দ্বিতীয় কথাটি এই যে, আপাতদৃষ্টিতে তা একটি দমনমূলক কার্যক্রম বা হিংসার ভিত্তিভূমিতে প্রতিষ্ঠিত একটি জনবিচ্ছিন্ন অগণতান্ত্রিক ও শিল্প-সংস্কৃতি বিরোধী মতাদর্শ হিসেবে প্রতীয়মান হলেও তার গভীরে নিহিত ভাবাদর্শ বা কৌশলগত অবস্থানটি বুঝে নেওয়া দরকার। তৃতীয়ত, একটি মতাদর্শ হিসেবে ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তিটি যেমন অনুশীলন করা দরকার, তেমনই একটি ‘সাংস্কৃতিক প্রকল্প’ হিসেবে তার প্রকাশ এবং আবেদনটিও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুতপক্ষে, ফ্যাসিবাদ বৃহত্তর সমাজে একটি ‘বিকল্প সংস্কৃতি’-র পরিপোষণ করে, যা জনমনে ‘বিকল্প চেতনা’ গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে। আপন লক্ষ্য অর্জনের জন্য ফ্যাসিবাদ একটি ‘কাল্পনিক সময়’ নির্মাণ করে সেই প্রক্রিয়ায় নির্মিত হয় একটি কাল্পনিক ‘অপর’(Other)– যার ভিত্তিতে কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট হয় ‘নিরাপত্তাহীনতা’-র এক মনোভঙ্গি– প্রয়োজন হয়ে পড়ে রক্ষাকর্তা-র– ফ্যাসিস্ট শাসক আত্মপ্রকাশ করে ‘এক দেশ-এক রাষ্ট্র-এক নেতা’-র বয়ান সামনে রেখে। এই প্রক্রিয়াতেই হিংসার সংস্কৃতি বৈধতা লাভ করে– সরকারি স্তরে অনুসৃত দমননীতির প্রতি জনসমর্থন গড়ে ওঠে। সামগ্রিকভাবে অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি একটি ‘নান্দনিক রূপ’ পরিগ্রহ করে। এই সামগ্রিক ফ্যাসিবাদী কর্মপ্রবাহে উগ্র-জাতীয়তাবাদ যেন চালিকাশক্তির আসন গ্রহণ করে। ইতালি ও জার্মানির অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে আমাদের যেমন চক্ষুউন্মীলক (Eye-opener) হতে পারে, সাম্প্রতিক ভারতের রাজনীতির গতি-প্রকৃতিও ফ্যাসিবাদের সেই প্রবণতাকেই আমাদের সামনে মেলে ধরে। ফ্যাসিবাদের আলোচনায় উগ্র-জাতীয়তাবাদের অনুশীলন তাই আমাদের কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়।

দুই

পৃথিবীর দেশে দেশে এবং ইতিহাসের বিভিন্ন কাল পর্বে ফ্যাসিবাদ যে একই রূপে আমাদের সামনে নিজেকে মেলে ধরেনি এ কথা বিশদে বলার প্রয়োজন নেই। দেশ কাল ভেদে তার রকম ফের নিশ্চিতভাবেই পৃথক অনুশীলনের দাবি রাখে। এতৎসত্ত্বেও প্রায় সব ক্ষেত্রেই ফ্যাসিবাদের উপরোক্ত সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি (Common Characteristics) কমবেশি লক্ষণীয় এবং তৎপ্রেক্ষিতেই ফ্যাসিবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের আন্তঃসম্পর্কটি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তবে, সেই আলোচনায় প্রবিষ্ট হওয়ার আগে সামগ্রিকভাবে জাতীয়তাবাদ এবং প্রাসঙ্গিকভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া বোধ করি সমীচীন হবে। সাধারণভাবে জাতীয়তাবাদ বলতে এক ধরনের সাদৃশ্য বা ঐক্যের অনুভূতি বোঝালেও তার প্রেক্ষিত ও প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহের গভীরে অবগাহন করতেই এ বিষয়ে নানা মুনির নানা মত প্রকটিত হয়ে ওঠে। আমরা বুঝতে পারি যে জাতীয়তাবাদ এ যুগের অত্যন্ত বিতর্কিত এক ধারণাও বটে। উইলিয়াম কনোলি তাই একে এক ‘essentially contested concept’ আখ্যা দিয়েছেন। আলেকজান্ডার মোতিন তাই লিখেছেন যে, আমরা যে যার মতো তার অর্থ ঠিক করে নিই; কিন্তু ধারণাগত স্বচ্ছতার খাতিরে আমাদের তো একটা জায়গায় দাঁড়াতেই হয়।কথাটি ঠিক হলেও এক জায়গায় দাঁড়ানোটা যে বড়োই কঠিন তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। যুগে যুগে জাতীয়তাবাদের আদর্শ যেমন আমাদের ‘দেশপ্রেম’-এ উদ্দীপিত করেছে, স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছে তেমনি আবার এক জনগোষ্ঠীকে অপর জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়িয়েও দিয়েছে। এখান থেকেই ‘প্রকৃত জাতীয়তাবাদ’ বনাম ‘বিকৃত’ বা ‘উগ্র-জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কিত নানা কথা এসেছে। অনেকদিন আগেই রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষও জাতীয়তাবাদকে ‘একটি বড়ো অভিশাপ’ (a great menace) বলে আমাদের সচেতন করেছেন।

একটি রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে বিশদ আলোচনায় না গিয়েও বলি যে, আধুনিক পৃথিবীতে এ সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। বেনেডিক্ট আন্ডারসন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism’ শীর্ষক গ্রন্থে জাতীয়তাবাদ কেন এবং কীভাবে কল্পিত হয় এবং তার ধরন-ধারণগুলিই বা কী– সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে আমরা শুধু এটুকুই বলি যে, কেবল তত্ত্বগত বিচার বিশ্লেষণই জাতীয়তাবাদকে বুঝতে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয় না; তার প্রায়োগিক দিকসমূহও (Applied aspects) বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। জাতীয়তাবাদের আলোচনায় অবধারিতভাবেই এসে পরে ইতিহাস ও সংস্কৃতির নানা উপাদান– রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় পুষ্ট হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা নানা প্রকার রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের ভিন্নতা অনুসারে জাতীয়তাবাদের রকমফেরের প্রশ্নটিও এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। প্রসঙ্গত, জাতীয়তাবাদের ‘বিষয়গত দিক’ (Objective aspect) এবং ‘বিষয়ীগত দিক’ (Subjective aspect) সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা, জাতি, ধর্ম, ভূখণ্ড, ঐতিহ্য ইত্যাদি উপাদানগুলিকে সাধারণত বিষয়গত দিক হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। কিন্ত এ-সবের পাশাপাশি বিষয়ীগত দিক– We feeling– কম গুরুত্বের নয়। ‘আমরা-ওরা’ (We and they) সম্পর্কিত মেরুকরণ এর প্রশ্নটি এখান থেকেই আসে। জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রধান তত্ত্বকার হ্যান্স কুন তাই লিখেছেন– ‘Nationality is formed by the decision to form a notionality.’১০ বলাবাহুল্য যে, এখান থেকেই যেমন জাতীয়তাবাদের সূচনা– উগ্র-জাতীয়তাবাদ-এরও উৎসভূমি এখানেই।

প্রসঙ্গত বলি যে, জাতীয়তাবাদের অসংখ্য প্রকরণগুলির মধ্যে রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ (Conservative Nationalism), ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ (Religious Nationalism), নৃকুলগত জাতীয়তাবাদ (Ethno-nationalism) এবং ভাষাগত জাতীয়তাবাদ (Linguistic Nationalism) প্রভৃতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এমনতরো যে-কোনো এক বা একাধিক প্রকরণকে আশ্রয় করে ‘উগ্র-জাতীয়তাবাদ’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে এবং তা কালপ্রবাহে ফ্যাসিবাদের উত্থানের পথকে প্রশস্ত করে তুলতে পারে। সাধারণত ধর্মকে আশ্রয় করেই জাতীয়তাবাদের মধ্যেকার উগ্রবাদী তৎপরতা সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। আমাদের মতো দেশগুলিতে তা আবার অত্যন্ত প্রকট। ধর্মের নামে সংখ্যালঘু ধর্মীয়গোষ্ঠী সমূহের উপর আক্রমণ, ভিন্ন চিন্তার মানুষের অধিকারহরণ থেকে প্রাণহরণ– এমন প্রত্যক্ষ হিংসার পাশাপাশি চুপিসারে সমাজ ও ইতিহাসের ব্যাখ্যায় নিজেদের বক্তব্য আরোপ, পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নানা পরোক্ষ:কার্যক্রমের মাধ্যমে বিদ্বেষের বীজ রোপণ এ ধরনের ব্যবস্থায় লক্ষণীয়। সামগ্রিকভাবে ‘ঘৃণার রাজনীতি’ (Politics of hatred) উগ্র-জাতীয়তাবাদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে ওঠে। 

উদ্‌বেগের বিষয় এই যে, সাম্প্রতিককালে ‘রাজনীতির দক্ষিণায়ন’ এই প্রবণতাকে বেশ শক্তিশালী করে তুলেছে। বিগত শতাব্দীতে এই ধারার উদ্ভব ও বিকাশ লক্ষণীয় হলেও একুশ শতকে তা যেন নানা রূপে বিস্তৃততর হয়েছে। সে-কারণে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় দক্ষিণপন্থী রাজনীতি সম্পর্কে কিছু কথা বলে রাখা যেতে পারে। কার্যত এটি হল রাজনৈতিক ভাবাদর্শের এমন একটি পরিসর যেখানে সমাজ-শৃঙ্খলা ও স্তরবিন্যাসকে অনিবার্য, স্বাভাবিক, সাধারণ এবং কাম্য বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয় এবং তা পরিবর্তনের যে কোনো প্রয়াসকে প্রাণপণে প্রতিরোধ করতে সচেষ্ট হয়। স্বাভাবিকভাবেই ‘স্থিতাবস্থার’ (status-quo)-র পরিবর্তনকামী বামপন্থী রাজনীতিকে তা যথার্থ অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গণ্য করে। বিষয়ের আর-একটু গভীরে গিয়ে বলি যে, অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত উদ্যোগ ও ব্যক্তি মালিকানার প্রতি সমর্থনের আড়ালে এই ধরনের মতবাদ সামাজিক প্রথাগত অসাম্যকেও টিকিয়ে রাখতে প্রয়াসী হয় এবং সমতাভিত্তিক যে-কোনো ব্যবস্থাকে প্রতিহত করতে চায়। তাই দক্ষিণপন্থার বৈশিষ্ট্য হল, সমাজতন্ত্র তো বটেই যে-কোনো ধরনের ‘সামাজিক গণতন্ত্র’-র বিরোধিতা। অবশ্য দক্ষিণপন্থার প্রকাশ যে সবসময় এবং সর্বত্র একই রকম হবে– এ কথা বলাটা সংগত হবে না। ফ্যাসিবাদের সঙ্গে দক্ষিণপন্থার সম্পর্ক নিরূপণে তাই দক্ষিণপন্থার রকম-ফেরের কথাও মনে রাখতে হয়। উল্লেখ্য যে ফ্যাসিবাদকে ‘দূরতম দক্ষিণপন্থী’ (far-right) বলে অভিহিত করার প্রবণতাটি এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। যথার্থ অর্থে ‘দূরতম দক্ষিণপন্থী’ বলতে তাদেরকেই বোঝানো হয়ে থাকে যারা নিরঙ্কুশ সরকারকে সমর্থন করে, প্রভাবশালী জাতি বা ধর্মগোষ্ঠীকে সংগঠিত করতে, অপরাপর জাতি ধর্মের মানুষকে খাটো করতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং শক্তিমান রাষ্ট্রের ধারণা পরিপোষণ করে। এক-কথায় উগ্র-জাতীয়তাবাদ হয়ে ওঠে এরূপ দক্ষিণপন্থার সবচেয়ে বড়ো দোসর; বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র বিরোধিতা এবং শক্তিশালী রাষ্ট্রের পক্ষে ওকালতি এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। স্পেনে ফ্রাঙ্কো, ইতালিতে মুসোলিনি, জার্মানিতে হিটলার, চিলিতে পিনোচে এ-ধরনের শাসকদের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।১১

এ-সব কথা থেকে স্পষ্ট হয় যে, ফ্যাসিবাদের আলোচনায় জাতীয়তাবাদ একটি ‘উর্বর ক্ষেত্র’ (fertile soil) হিসেবেই কাজ করে। তত্ত্বগত দৃষ্টিতে জাতীয়তাবাদের নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়ায় তার বিভিন্ন ধরনের ‘বিকৃতি’-গুলি সুকৌশলে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং এক ধরনের জঙ্গিবাদ (extremism) মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বস্তুতপক্ষে, ফ্যাসিবাদ মানেই হল কোনো-না-কোনো ধরনের উগ্র-জাতীয়তাবাদ যা ক্ষেত্রবিশেষে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা ইত্যাদিকে বিদ্বেষ সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উদ্ভবগত বা নৃ-কুলগত প্রশ্ন যেমন একসময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, আমাদের দেশে বর্তমানে তেমনি ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা ফ্যাসিবাদের উৎসভূমি হিসেবে ক্রিয়াশীল হয়েছে। এখানে অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষের কথা (Space) যেমন মনে রাখতে হয়, সময়ের প্রশ্নটি (time)-ও বিচারধারার অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। সে-সব কথায় আসার আগে বলি যে, কোথাও বা বর্ণবিদ্বেষ, কোথাও ধর্মভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা, কোথাও নৃ-কুলগত প্রশ্নকে আশ্রয় করে উগ্র-জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ গড়ে তুলে ফ্যাসিবাদ আত্মপ্রকাশ করে থাকে। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের অন্যান্য সব প্রকরণগুলির সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেললে চলে না। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষনীয় বিষয় এই যে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এবং প্রচার মাধ্যমের সহযোগে ব্যাপক মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দগুলিও নিয়ন্ত্রিত হয়। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলিকে পিছনে ফেলে তারা জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদির প্রতি এক ধরনের আবেগময় আনুগত্য নিয়ে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা ও সংকটগুলি আড়ালে পড়ে যায়। সেই সুযোগে ক্ষমতা করায়ত্ত করার কাজটিও সহজ হয়ে যায়। উগ্র জাতীয়তাবাদের হাত ধরেই কায়েম করা সম্ভব হয় ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা। 

এবার একটু সময়ের দিকে নজর দিলে সহজেই বোঝা যাবে যে, কর্পোরেট দুনিয়ায় knowledge economy-র প্রেক্ষিতে ফ্যাসিবাদের বাড়বাড়ন্ত কীভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। ফ্যাসিবাদ কীভাবে সময়ের হাত ধরে নিজেকে পরিবর্তন করে তা অনুধাবন করতে হলে পরিবর্তনশীল দুনিয়া ও তার উন্নয়ন মডেলের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হয়। গণমাধ্যমগুলির অভাবনীয় বিকাশ এবং তার ক্রিয়াশীলতার ধরন-ধারণগুলি অনুসরণ করতে হয়। সর্বোপরি, শাসক ও শাসিতের আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রে নবতর কৌশলগুলি আয়ত্ত করতে হয়। উল্লেখ্য যে, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রও এখন উন্নয়নের নানা মডেল সামনে নিয়ে আসে– জনগণকে অধিকতর উন্নয়নের ধোঁকা দেয়– এক ধরনের ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’-র কথা বলে। মনে রাখতে হয় যে, ইতিহাসে অনেক শাসকই প্রথমে নির্বাচিত ছিলেন, পরে তারাই আবার নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেন। অন্য দিক থেকে বলি, সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের অধিকাংশই কিন্তু কর্পোরেটদের দখলে। Breaking News-এর তকমায় বাস্তব থেকে নজর ঘোরানোর অবিরাম প্রয়াস চলে ২৪/৭-এর দৌলতে। একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে গণমাধ্যমগুলি মানুষকে যেন পিছনের দিকে টেনে মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির দিকে চালিত করতে চায়। উগ্র-জাতীয়তাবাদ সেই পথেই কার্যকরী হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। মধ্যবিত্তের চিন্তার জগতে তোলপাড় করার ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত কার্যকরী; শাসকদের তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। লক্ষ করলে বোঝা যাবে যে, Knowledge economy-র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষদের মধ্যে এসবের আবেদন অনেক বেশি। এই প্রসঙ্গে পুরানো কথা হলেও সত্যি যে, মধ্যবিত্তের সমর্থনেই হিটলারের উত্থান হয়েছিল। ভারতের মতো দেশেও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ বা সাম্প্রদায়িকতার আবেদন সমাজের এই অংশের মানুষের মধ্যেই সর্বাধিক। বিগত নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনাও সে-কথাই বলে।১২

তিন

ফ্যাসিবাদ ও উগ্র-জাতীয়তাবাদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুশীলনে একদিকে যেমন তার তাত্ত্বিক দিকগুলি আরও একটু খতিয়ে দেখা প্রয়োজন; তেমনই আবার সময়ের হাত ধরে তার নবতর প্রকরণসমূহ এবং সেগুলোর ক্রিয়াশীলতা অনুধাবন করাটা অত্যন্ত জরুরি কাজ। উল্লেখ্য যে, ফ্যাসিবাদের তত্ত্ব প্রসঙ্গে একদিকে যেমন আলাপ আলোচনার এক বিস্তৃত পরিসর রয়েছে; তেমনই আবার তার ‘তত্ত্বহীনতা’ প্রসঙ্গে আলোচনারও সুযোগ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে, ফ্যাসিবাদের কোনো সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব নেই; বিরোধী সব তত্ত্বকে আপাদমস্তক খারিজ করে সুপরিকল্পিত উপায়ে ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতায় টিকে থাকাই তার লক্ষ্য। কথাটিতে আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা সত্যতা থাকলেও গভীর বিশ্লেষণে তা মেনে নেওয়া বেশ কঠিন। অন্যদিকে, ফ্যাসিবাদের পুঁজিবাদী যোগ– ব্যাপক অর্থে তার অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাটি– যা মার্কসবাদী মহলে বহু আলোচিত– তার গুরুত্বও অস্বীকার করা যাবে না। আবার, ‘সাংস্কৃতিক প্রকল্প’ হিসাবে ফ্যাসিবাদের গুরুত্ব বোধকরি সর্বাধিক সে কথাটা মনে রাখাও প্রয়োজন। বর্তমান প্রসঙ্গে বলি যে ফ্যাসিবাদের আলোচনা যেদিক থেকেই করা হোক না কেন, জাতীয়তাবাদের সঙ্গে তার আন্তঃসম্পর্কটি অনস্বীকার্য। এ কথা আমরা আগেই বলেছি যে, সাধারণত উগ্র-জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ বা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের আশ্রয়েই ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে থাকে। এক ধরনের স্বাভাবিক ‘জাতিদম্ভ’ বা ‘কৌলীন্যবোধ’ তা ‘অপর’ জাতিসত্তা বা ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীসমূহের বিরুদ্ধে বলগাহীন আক্রমণের প্রেরণা জোগায়। গণতন্ত্র সেখানে যেন এক ধরনের ‘পাগলামি’। এক ধরনের ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসন প্রতিষ্ঠাই ফ্যাসিবাদের মূল লক্ষ্য। এসব আলোচনা থেকে জাতীয়তাবাদ ও ফ্যাসিবাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণে বিকৃত জাতীয়তাবাদ বা উগ্র-জাতীয়তাবাদকে তার উৎসভূমি হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। বলা যেতে পারে যে, নিজেদের প্রতি ভালোবাসাকে যদি জাতীয়তাবাদ বলি, অপরাপর জাতিসমূহের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ হল ফ্যাসিবাদ। এ ধরনের পার্থক্য নির্ণয় মোটাদাগে গ্রহণীয় মনে হলেও তার মধ্যে অতিসরলীকরণের প্রবণতা অস্বীকার করা যায় না। তাই প্রয়োজন হল, ফ্যাসিবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি ও কর্মপ্রক্রিয়ার আরও গভীরে অবগাহন করা। সেক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হয় যে, আপাতদৃষ্টিতে তার জাতিবিদ্বেষী চেহারাটা প্রকট হলেও তার অর্থ এই নয় যে ফ্যাসিবাদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তথাকথিত কুলীন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সেখানেও ‘কৌলীন্য’-র ধারণা অনুসরণে ‘মুষ্টিমেয় প্রতিভাধরদের শাসন’ (elite rule)-এর তত্ত্ব যেন স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে। দেশশাসনে তাদেরই অধিকার স্বীকৃত অন্যেরা আজ্ঞাবাহী সেনাদল মাত্র। সেই বিচারে ফ্যাসিবাদ কেবল উগ্র-জাতীয়তাবাদী বা জাতিবিদ্বেষী নয়, তা একাধারে অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী, আগ্রাসী এবং অমানবিকও বটে। 

উল্লেখ্য যে, ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে যে-কোনো আলোচনায় তাকে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসন বা তৎসম্পর্কিত ব্যবস্থা বা নিয়ম-কানুনকে বোঝানো হয়ে থাকে। এটি যে একটি চরম কর্তৃত্ববাদী ধারণা সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু যে কোনো ধরনের কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাই যে ফ্যাসিবাদ নয় সে কথাটাও আমরা আগেই বলেছি। তাই, কোনো অতিসরলীকরন-এর ফাঁদে পা না দিয়ে তার অন্তর্নিহিত মতাদর্শটি অনুধাবন করাটা জরুরি বলেই মনে হয় এবং সে ক্ষেত্রে উগ্র জাতীয়তাবাদের নানা প্রকরণগুলি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হিসেবেই উঠে আসে। এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয় কথাটি এই যে ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যায় হিংসা ও বিদ্বেষের কথাটিও অনিবার্যভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে। এখানেও বলি যে ফ্যাসিবাদ যে হিংসার উপরে অনেকটাই ভর করে থাকে সে কথাটা যেমন সত্য তেমনই আবার এ কথাও সত্যি যে ফ্যাসিবাদ মানুষের মধ্যে হিংসার মনোভাব গড়ে তুলে হিংসাকে বৈধতা প্রদান করে এবং হিংসার সপক্ষে মানুষের সম্মতি আদায় করে। নিছক জবরদস্তির সঙ্গে এর পার্থক্য অনেক। উগ্র-জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাতিবৈরিতা, ধর্মীয় বিদ্বেষ ও বর্ণভেদ সম্পর্কিত ঘৃণার রাজনীতির গভীরে অবগাহন করলে এ বিষয়টি আমাদের বোধগম্য হবে। এক্ষেত্রে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল এই যে, ফ্যাসিবাদকে প্রায়শই শিল্প-সংস্কৃতি বিরোধী একটি মতবাদ হিসেবে চিত্রিত করা হয়ে থাকে। একে একটি রক্ষণশীল, পশ্চাদ্‌গামী ও আধুনিকতা বিরোধী প্রকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে কথাটি যথেষ্ট যুক্তি-গ্রাহ্যও বটে। কিন্তু, গভীর অনুশীলনে এটি একটি ‘সাংস্কৃতিক প্রকল্প’ (cultural project) হিসেবে বুঝে নেওয়া যেতে পারে। ফ্যাসিবাদ আমাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে– এ কথা যেমন সত্য, তেমনই তা অত্যন্ত সুকৌশলে আমাদের মধ্যে একটি ‘বিকল্প চেতনা’ গড়ে তুলে বৃহত্তর সমাজে তা জন্ম দেয় অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি বা ঘৃণার সংস্কৃতি। এই কাজটি ফ্যাসিবাদ কিন্তু সর্বদাই খুব স্থূল ভাবে করে না। বরং অত্যন্ত সুকৌশলে– অতি সূক্ষ্মভাবে হিংসাকে নান্দনিক রূপ দিতে তারা প্রয়াসী হয় এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়ে ওঠে। বলাবাহুল্য যে, জাতিভেদ, বর্ণভেদ ও ধর্মভিত্তিক ভেদ-বিভেদ জনিত সাম্প্রদায়িকতা এ ধরনের সাংস্কৃতিক পরিসরেই লালিত হতে পারে। তাই সাংস্কৃতিক স্তরেও এগুলির মোকাবিলা দরকারি হয়ে পড়ে। উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাংস্কৃতিক কার্যক্রম গড়ে তোলার প্রসঙ্গটি এদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।১৩ 

ফ্যাসিবাদের এমনতরো ‘বিকল্প চেতনা’ নির্মাণ কিন্তু মোটেই সহজসাধ্য কোনো কাজ নয়। একটি ‘কাল্পনিক সময়’ নির্মাণ ও তাকে বাস্তব হিসেবে পুনর্নির্মাণের এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের অগ্রসর হতে হয়। অতীত ইতালির পুনর্নির্মাণে মুসোলিনির প্রয়াস এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। এই প্রক্রিয়ায় যাদের সমর্থন প্রয়োজন তাদের জন্য একটি কাল্পনিক ‘অপর’ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি। সমর্থন নিশ্চিত করতে আবার প্রয়োজন হল কৃত্রিমভাবে হলেও এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার বাতাবরণ সৃষ্টি। এখানেই ‘আমরা-ওরা’ (We and they) ভাগাভাগিটা স্পষ্ট হয়। এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাববোধ গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচিত হয়। মনে রাখতে হয় যে এক ধরনের বিপদগ্রস্ততার অনুভব এবং রক্ষাকর্তার প্রয়োজন বোধ ছাড়া এমনতরো সমর্থনের ভিত্তিভূমি রচিত হতে পারে না। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনা– বিশেষত তার বিষয়গত ও বিষয়ীগত দিকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ– উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ও বিকাশের নানা দিক এক্ষেত্রে সবিশেষ প্রাসঙ্গিক। তবে একথা আবারও বলতে হয় যে দেশ-কালভেদে ফ্যাসিবাদের রূপভেদের কথা আমাদের সর্বদাই মনে রাখা দরকার।১৪

উদাহরণ হিসেবে বলি যে, ভারতে বিশেষত বর্তমান সময়ে ফ্যাসিবাদের উত্থান সম্পর্কিত আলোচনায় প্রেক্ষিত ও পরিস্থিতিগত ভিন্নতার দিকগুলি মোটেই অস্বীকার করা চলে না। ইতালি বা জার্মানিতে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে এদেশের তুলনা করার সময় এ কথাটা মনে রাখতে হয়। এদেশে ফ্যাসিবাদী শাসনের ভিত্তি হিসেবে হিন্দু জাতীয়তাবাদ বেশ কার্যকরী রূপ পরিগ্রহ করেছে, যা একটি ‘কাল্পনিক সময়’ হিসেবে একটি ‘সোনালি অতীত’-এর রূপকল্পকে আশ্রয় করে গড়ে তোলা হয়েছে। সে অতীত যে অবশ্যই হিন্দু অতীত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে কাল্পনিকভাবে ‘অপর’ নির্মাণের প্রয়াসটিও বেশ লক্ষণীয় এবং তা কৃত্রিমভাবে সংখ্যাগুরুর মধ্যেও এমন বিপন্নতাবোধ সৃষ্টি করে যা সংখ্যালঘুদের প্রতি যুদ্ধঘোষণাও করতে পারে। এমনই এক ‘অপর’ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলিকে দলে টানার প্রক্রিয়াটিও লক্ষণীয়। বর্ণহিন্দুদের দাপটে অতীতে যেসব জনগোষ্ঠীগুলিকে দূরে ঠেলে রাখাই দস্তুর ছিল; নতুন রকমের প্রয়োজনের তাগিদে তাদেরকেও ‘হিন্দুত্ব’-র পরিসরে অন্তর্ভুক্তিকরণ (inclusion)-এর চেষ্টায় আত্মপরিচয় (identity)-এর রাজনীতিকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টাটি যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মোটের উপর বলতে হয় যে ধর্মীয় ভিত্তিতে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি (Identity Politics)-র সুচারু ব্যবহার/ অপব্যবহারে ফ্যাসিবাদ এখানে ক্ষমতাসীন হওয়া বা ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রাণপণ চেষ্টায় নিয়োজিত। এক্ষেত্রে বল প্রয়োগ বা হিংসার উপাদান যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে সম্মতি আদায় বা মান্যতা অর্জনের বহুমুখী প্রয়াস। একটি ‘সাংস্কৃতিক প্রকল্প’ হিসেবে ফ্যাসিবাদের বিচার-বিশ্লেষণ এ দেশেও তাই বেশ জরুরি। 

পরিশেষে বলি যে, ফ্যাসিবাদের সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদের যোগসূত্র নির্ণয়ের বিষয়টি নতুন কিছুই নয়। বিগত শতাব্দীর তিরিশের দশকে ফ্যাসিবাদের উত্থানপর্ব থেকেই নানাভাবে সে আলোচনা চলছে। তার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণও আমাদের সামনে এসেছে। একটি কর্তৃত্বমূলক শাসনব্যবস্থা হিসেবে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হিংসা ও দমন-পীড়ন জাতি-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদি বিষয়কে আশ্রয় করে বিদ্বেষমূলক রাজনীতি ইত্যাদি সব বিষয়গুলি বহু আলোচিত সন্দেহ নেই। ফ্যাসিবাদের আলোচনায় এসব কিছুর আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও একটি ‘সাংস্কৃতিক প্রকল্প’ রূপে তা বিবেচনার অন্তর্ভুক্ত না হলে তা অসম্পূর্ণ থেকেই যাবে এবং ফ্যাসিবাদের মূল বিপদ আমাদের বোধের অগোচরে থেকে যাবে। ফ্যাসিবাদ যে নিছক একটি বলদর্পী ও জনবিচ্ছিন্ন ব্যবস্থাপনা নয়; তা এমন একটি ‘সাংস্কৃতিক প্রকল্প’, যা সুকৌশলে জনগণের সম্মতি আদায় করেই শাসনকাঠামোয় অধিষ্ঠিত হয় এবং টিকে থাকার চেষ্টা করে– একথাটা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। উগ্র-জাতীয়তাবাদ যে সেই লক্ষ্যে শাসকের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, ইতিহাসে তা প্রমাণিত সত্য। আবার কর্পোরেট দুনিয়ায় উগ্র-জাতীয়তাবাদের লালন প্রক্রিয়াটিও বর্তমান প্রেক্ষিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক কালের আলাপ আলোচনায় এদিকটিতে তাই বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে এবং সেই আলোচনায় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত নতুনতর অভিজ্ঞান যা উগ্র জাতীয়তাবাদের যথার্থ স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিরূপণে নতুনতর দিশার সন্ধান দিয়েছে। এক অর্থে ফ্যাসিবাদ তাই পুরোনো বিষয় হলেও নবতর তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়েছে এবং আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছে। 

সূত্র নির্দেশ:

১. Andrew Vincent, ‘Modern Political Ideologies’, Blackwell, 1995

২. Maurice Willam Cranston, ‘The Romantic Movement’, Blackwell, 1994

৩. William Ebenstein, ‘Great Political Thinkers : From Plato to the present’, S. Chand & Co, New Delhi, 1999

৪. James Gregor, ‘Marxism, Fascism and Totalitarianism : Chapters in the Intellectual History of Radicalism’, Stanford University Press, 2008; Also see his book- Interpretations of Fascism, Routledge, 1997

৫. Lawrance Britt, ‘The 14 Characteristics of Fascism’, Free Inquiry Magazine, Spring 2003, PC-00466 -pdf.(online source)

৬. Roger Griffin, ‘Nature of Fascism’, Routledge, London and New york, 1993

৭. William Connolly, ‘The Terms of Political Discourse’, pg. 44 (as quoted in Alexander Motyle, “The Modernity of Nationalism, Nations, States and Nation-states in contemporary world” in Journal of Internation Affairs 45(2) 1992 pp. 307-308

৮. জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : দেবনারায়ণ মোদক, “জাতীয়তাবাদ তত্ত্বে ও প্রয়োগে”, ‘নাব্যস্রোত’ দ্বাদশ বর্ষ, প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি-আগস্ট ২০১৮ পৃষ্ঠা ১৩২২। আরও দেখুন, Debnarayan Modak, ‘The Dynamics of National Question in India : The Communist Approach (1942-1964)’, Progressive Publishers, Kolkata, 2006 pp. 1-41

৯. বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন Benedict Anderson, ‘Imagined Communities : Reflections on the Origin and Spread of Nationalism’, Verso, London, 2006

১০. Hans Kohn, ‘Nationalism : It’s Meaning and History’, New york, 1965, pp.- 9-10

১১. Davies Peter and Derek Lynch, ‘The Routledge Companion to Fascism and the Far Right’, Routledge, 2002; Michael E. Brown, Owen R. Cote Jr., Sean M. Lynn – Jones and Steven E. Miller (eds), ‘Nationalism and Ethnic Conflict’, The MIT Press, 1997 ; Betz Hans Georg, ‘Radical Right wing – Populism in Western Europe’, Palgrave Macmillan, 1994; Shane Burley, ‘Fascism Today’, A.K. Press, 2017; etc.

১২. Enzo Traverso, ‘The New Faces of Fascism : Populism and the Far Right’, Verso, 2019; Dave Renton, Fascism : Theory and Practice, Pluto Press, London, 1999 ; Also see : Dave Renton, Fascism : History and Theory, Pluto Press, London, 2020.

১৩. বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন শোভনলাল দত্তগুপ্ত, ‘ফ্যাসিবাদ ভাবনা : অতীত ও বর্তমান’, সুশোভন চন্দ্র সরকার স্মারক বক্তৃতা, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ; ফ্যাসিবাদ প্রসঙ্গে অধ্যাপক দত্তগুপ্তের আরও কিছু লেখাপত্রের জন্য দেখুন : ‘আকালের ভাবনা : লেখালেখি, সাক্ষাৎকার, ২০১১-২১’, সেরিবান, কলকাতা, ২০২১

১৪. পূর্বোক্ত

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান