ফ্যাসিবাদের গণমনস্তত্ত্ব সম্পর্কিত তত্ত্ব : সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ

তরুণকুমার দত্ত 

অনেক মানুষের বিশ্বাস প্রকৃত রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক থেকে ১৯৪৫-এর পর থেকে ফ্যাসিজম শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বিংশ শতকের শেষের দিকে আবার ফ্যাসিস্ট দলগুলির আবির্ভাব ও বাড়বাড়ন্ত শুরু হতে থাকে। তাহলে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা কি বলতে পারি ফ্যাসিবাদ অতীতের বিষয় হয়ে গেছে?

এ কথা বলতে পারি না। কারণ ফ্যাসিবাদকে এমন কিছু হিসেবে দেখা ঠিক নয় যাকে নিশ্চিতভাবে চরিত্রায়িত করা যায়। একে অবশ্যই এর বিকাশের মধ্যে দেখতে হবে এবং কখনোই পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা বা রূপ হিসাবে নয়। একে দেখতে হবে ধারাবাহিক, বস্তুগত উপাদানের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট বাস্তব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিবিধ সম্পর্কের পরিণতি হিসাবে। তবে, ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি এখন আকছার ব্যবহার হচ্ছে। শব্দটিকে আমরা লুফে নিয়েছি। তাই স্পষ্টই কিছু প্রশ্ন উঠছে। যাঁরা ব্যবহার করছেন তাঁরা সবাই কী আসলে ফ্যাসিবাদের অভিঘাত জেনেবুঝে শব্দটি ব্যবহার করেন? সকল দক্ষিণপন্থী দল বা গোষ্ঠী, সকল গোঁড়া দক্ষিণপন্থী সরকার কি আবশ্যিকভাবে ফ্যাসিস্ট? শব্দটির প্রথম ব্যবহার পাই সিসিলির কুখ্যাত সালফার খনিগুলির কর্মীদের মধ্যে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালির দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী শব্দটিকে নতুনভাবে ব্যবহার করা শুরু করে। 

যে শব্দটি এতক্ষণ নির্দ্বিধায় ব্যবহার করলাম তার অর্থ আসলে কী বোঝা খুব সহজ নয়। অথচ, শব্দটি ব্যবহার করার মানে ফ্যাসিবাদ কী তা আমরা বুঝি। আর বুঝি মানেই ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের কারণ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা অবশ্য প্রয়োজনীয়। 

অ-প্রথাসিদ্ধ (informal) বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদের মতো এই জটিল ঘটনাকে বুঝতে একটা কাজ চালানোর মতো সংজ্ঞা দিয়ে শুরু করা ভালো। সেই দিক থেকে গ্রিফিনের পরামর্শ– ‘ফ্যাসিবাদ’ বোঝার জন্য একজনকে অবশ্যই ‘জাতীয় সমাজতন্ত্র’ (National Socialism) ও মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ, উভয় মতাদর্শকেই পুরোপুরি আলোচনায় আনতে হবে। এটা ঠিক ফ্যাসিবাদ কাকে বলে তা আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বুঝি না। কিন্তু, আমাদের কাছে ‘ফ্যাসিজম’ বিষয়ে গুটিকতক অভিজ্ঞতাভিত্তিক অথবা তাত্ত্বিক সামান্যীকরণের অবলম্বন আছে। এতে কিছুটা বিশ্বাস রেখে এগোনো যাক। 

গুরুত্বপূর্ণ ‘তাত্ত্বিক’ দিক থেকে ফ্যাসিজমকে ব্যাখ্যা করার প্রথম বড়ো প্রচেষ্টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর দুই দশক আগে থেকেই আরম্ভ হয়েছিল। আন্তঃযুদ্ধের বছরগুলিতে এই সকল প্রচেষ্টা থেকে ফ্যাসিজম-এর ‘ক্ল্যাসিক’ কিছু ব্যাখ্যা মেলে–

  • নৈতিক সংকটের পরিণতি হিসেবে ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যা। 
  • মনস্তাত্ত্বিক অক্ষমতার পরিণতি হিসেবে ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যা। 
  • রাজনৈতিক জীবনে ‘অসংবদ্ধ জনগণ’(amorphous masses)-এর অনুপ্রবেশের পরিণতি হিসেবে ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যা। 
  • শ্রেণি-সংগ্রামের ফল হিসাবে ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যা। 

এ-প্রসঙ্গে দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি এই প্রবন্ধে আলোচনা করব। তবে এক্ষেত্রে সেই প্রচেষ্টাগুলিকে ব্যাখ্যা ও বিচারের জন্য বেছে নেব যে ব্যাখ্যাগুলির প্রচলন খুব বেশি এবং যা বিষয়ের ব্যাখ্যাকে বুঝতে সাহায্য করবে। জর্জি ডিমিট্রভ সহ কেউ কেউ ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যায় অর্থনৈতিক কারণকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থনৈতিক কারণ গুরুত্বপূর্ণ সত্য, তবে এর সঙ্গে আরও কিছু কারণ যেমন, মানসিক, সাংস্কৃতিক কারণও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ প্রসঙ্গে Wilhelm Reich একটি প্রাসঙ্গিক মন্তব্য করেছেন–

The ideology of any given society not only reflects the economic process of the society, it also has the function of anchoring the economic process in the psychological structure of the individual members of the society. Man is influenced by the conditions of his existence in a twofold manner: directly by the immediate influence of his economic and social position, and indirectly by the ideological structure of his society.

সবার প্রথমে যে প্রশ্নটি মনে আসে তা হল সামাজিক ইতিহাস কি ব্যক্তি-মানসিকতার বৈশিষ্ট্য দ্বারা নির্ধারিত? বহু বছর আগে প্রকাশিত ‘দ্য নুরেমবার্গ মাইন্ড’ নামক পুস্তকের সমালোচনা প্রসঙ্গে এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন ফ্রান্সিস এ টুচেট। ইতিহাস যে কেবলমাত্র ব্যক্তি বিশেষের দেবোপম চারিত্রিক মাহাত্ম্য ও বীরত্ব অথবা দানবীয় নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতার কাহিনি নয়, একথা অনেক আগে প্লেখানভ বলেছিলেন। বিশেষ সামাজিকতা এই মানসিকতা সৃষ্টি করে। নেপোলিয়ন, জুলিয়াস সিজার, মুসোলিনি, হিটলার, গোয়েবেল, গোয়েরিংদের মানসিকতা বিশ্লেষণ করে যুদ্ধ বা যুদ্ধকালীন নৃশংসতার বীভৎসতার কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা একদল মনস্তাত্ত্বিক অনেকদিন ধরেই করে আসছেন। ‘The Nuremberg Mind’ সেই চেষ্টার পুনরাবৃত্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও নাৎসি বর্বরতার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকে কোনোরূপ গুরুত্ব না-দিয়ে অথবা নামমাত্র উল্লেখ করে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তির মনোসমীক্ষার দ্বারা লেখকদ্বয় যুদ্ধের কারণ ও বন্দিশিবিরের অত্যাচারের কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। ফ্যাসিবাদী নাৎসিদের জন্ম ইতিহাস রহস্যময় ব্যক্তিমনের বিকারতত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যার এই প্রয়াস উদ্দেশ্যমূলক এবং হাস্যকর– সমালোচক টুচেট এই মন্তব্য করেছেন। তাঁর মতে, বিশেষ ধরনের সমাজ ব্যবস্থার গলদের দিকে পাঠকের দৃষ্টি যাতে নিবদ্ধ না হয় এই উদ্দেশ্য নিয়েই ইতিহাসের এই মানসিকীকরণ প্রচেষ্টা (psychologization of history)। তিনি আরও বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের মনোবিদ্যা চর্চার দৈন্য ও হাস্যকর দিক এই প্রয়াসে ফুটে উঠেছে। ন্যুরেমবার্গ মাইন্ডের লেখকরা বন্দি নাৎসি সেনানায়কদের যে মনোবিশ্লেষণের বিবরণী দাখিল করেছেন, তার মধ্যে Rorshock plates-এর চিত্রকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সমালোচক সেই প্রসঙ্গে বলেছেন– 

…Pseudo social analysis is served up in place of the prime social analysis which could provide the whole mozaic out of which these men emerged. How would the Rorshock test scores of ‘successful’ international business magnets and executives compare?….

সমাজের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে যাঁরা প্রয়াসী তাঁরা এই মানসিকীকরণ পদ্ধতির প্রবক্তাদের বিশেষ উৎসাহ প্রদান করেন, এটাই স্বাভাবিক।

এবার বিষয়টি দাঁড়াল ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি, বিকাশ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা প্রসঙ্গে এর গণমনস্তত্ত্বের দিকে আমাদের মূল আলোচনা নিবদ্ধ থাকবে। তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত মতের উল্লেখ, বিশ্লেষণ ও প্রাসঙ্গিক কিছু সমালোচনাও উপস্থিত করব। এ ব্যাপারে পিটার নাথান, ভিল্‌হেল্‌ম রাইস, এরিক ফ্রম ও কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তিত্বের ধরনধারণ আলোচনায় উঠে আসবে। 

দুই 

রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের মতো ফ্যাসিবাদকে ব্যক্তিগত মানসিক সমস্যার ফলাফল বলে মনে করে। এই ধরনের ব্যাখ্যা একচেটিয়াভাবে মনোবিশ্লেষণমূলক। সাইকোডাইনামিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সমস্যা হিসেবে ফ্যাসিবাদ কাজ করে। James Gregor মনে করছেন–

Fascism is the product of a ‘sick-society’ that is afflicted with the working out of the problems of psycho-dynamically impaired individuals. 

Perhaps the most unfortunate accounts in this tradition are those that are the product of an unrestricted enthusiasm for Freudian analysis conjoined with the righteous indignation borne in the years of conflict against Fascism and National Socialism.

পিটার নাথানের ‘The Psychology of Fascism’ ঠিক এমনই একটি বই। এই ঐতিহ্যের অন্য প্রধান কাজগুলি হল Wilhelm Reich-এর ‘The Mass Psychology of Fascism’ ও Erich Fromm-এর ‘Escape from Freedom’। রাইস ও ফ্রম-এর কাজ নাথানের থেকে আলাদা। রাইসের বিশ্লেষণ ফ্রয়েডবাদের একটি ‘সংশ্লেষণ’ এবং এর সাথে মার্কসবাদের কিছু অন্তর্দৃষ্টি জড়িত। অন্যদিকে ফ্রম ফ্রয়েডের বিশ্লেষণ সম্পর্কে কিছু গুরুতর সংশ্লেষণ (synthesis)-এ সহমত। প্রকৃতপক্ষে, ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যায়‌ এখানে অন্তত তিনটি প্রধান রূপের আলোচনা উঠে আসবে। এই তিনটি রূপ হল– নৈষ্ঠিক (orthodox), ফ্রয়েডীয় ও মার্কসীয় অন্তর্দৃষ্টির সংমিশ্রণ (amalgam) এবং ফ্রয়েডীয় ব্যাখ্যাকে উল্লেখযোগ্যভাবে গুরুত্ব দেওয়া। নাথান সবার প্রথমে বলেন, ব্যক্তির জীবনে নানা পরিস্থিতির মধ্যে কোনো-না-কোনোভাবে পিতামাতার সঙ্গে শাসকদের যুক্ত করার প্রবণতা তৈরি হয়ে যায়। ফলে, পিতামাতার প্রতি আমাদের মনোভাবের মাধ্যমে সরকারের প্রতি মনোভাব প্রভাবিত হয়। এর সঙ্গে নাথান পারিবারিক নাটকের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে আমাদের মনোরঞ্জন করতে চান। এর কারণ হল, কিছু ফ্রায়েডানুসারী এভাবেই বুঝে থাকেন। সুতরাং, সরকারের প্রতি আমাদের মনোভাব যদি কোনোভাবে পারিবারিক সম্পর্ক দ্বারা প্রভাবিত হয় তবে এই সম্পর্কগুলি বিষয়ে আমাদের জানা সরকারের প্রতি মনোভাবকেই প্রকাশ করবে।

পিটার নাথানের ফ্যাসিবাদের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা

পারিবারিক নাটকে নাথানের বিবরণ অনুসারে শিশু তার মাকে ভালোবাসার বস্তু হিসাবে একেবারে দখল করে ফেলতে চায়। তখন বাবা প্রতিযোগিতার এক প্রধান উৎস হয়ে ওঠেন। এরপরে শিশু পিতার প্রতি দোটানার অনুভূতিতে ভোগে‌। যদি এই দোটানা সহ্য করা কঠিন হয় তবে শিশু নিজের ঘৃণা ও বিরক্তিকে দমন করে তাকে প্রশমিত করে। সমস্ত শিশুই নাকি এই আন্তর্মানসিক আততিতে (tension) ভোগে। যেমন ধরুন শিশু যদি বাবার মৃত্যু কামনা করে, তবে তার অপরাধবোধ শেষমেশ ওই ইচ্ছাকে দমন করতে বাধ্য করতে পারে। কিন্তু বলা হয়, শুধুমাত্র সমাহিত অনুভূতি নয় অবদমিত অপরাধবোধও তার মধ্যে রয়ে যায়। এর থেকে ব্যক্তি প্রায়শ্চিত্ত করতে আত্মঘাতী হতে পারে। যাই হোক নিজেকে সে বাবার সাথে অভিন্ন অনুভব করে ও রক্ষণশীল হয়ে ওঠে। ‘…He upholds all that he imagines his father would uphold, he takes root in the past, he stands for tradition…. He is opposed to any change, for a change would not agree with these fixed standards; he also can’t tolerate anything new….’ এর থেকেও খারাপ হল শিশুটি যে মানগুলিকে নিজের মধ্যে বপন করেছে (introjected) সেগুলি পিতার চর্চিত বা নিযুক্ত, কিন্তু কোনোভাবেই প্রকৃত মান নয়। এই ধরনের ব্যক্তিরা যে-কোনো প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্বকে লক্ষ করে এবং তাকে কঠোরভাবে মেনে চলে। আমাদের বলা হয় এমন লোক অনেক রয়েছে। যা কিছু বিপ্লবী যা কিছু কর্তৃত্ব-বিরোধী (anti-authoritarian) বা সাধারণের থেকে কিছুটা আলাদা বা অন্যতর– সে সবকিছুতেই তারা আতঙ্কিত। তারপরে একটার পর একটা শর্ত দিয়ে যাওয়া হয় যাতে করে তারা ‘রক্ষণশীল’ বিপ্লব বিরোধী ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে অত্যাচারকে স্বাগত জানাতে পারে। এর পেছনে অনেক কারণ আছে, যেমন মায়ের প্রতি অস্বাভাবিক শক্তিশালী সংযুক্তি, আবার এমন পরিস্থিতি যাতে পিতাকে নির্মম প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করা, এরকম আরও বেশ কিছু। এভাবে বড়ো হলে তাদের মধ্যে অত্যাচার করার প্রবণতা জন্মাবে, ভয় ও হীনম্মন্যতার অনুভূতি সৃষ্টি হবে, ভয়ের কিছু যেমন পিতার প্রতি ঈর্ষা জাগাবে, তেমনি ক্ষমতার প্রতি তীব্র লালসা জাগবে ও অন্যের হৃদয়ে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা হবে, কর্তৃত্ব ও জোর খাটানো প্রশংসিত হবে। এক কথায় এরা প্রোটোফ্যাসিস্ট (proto-fascist)। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব কিছু থেকে নাথান এক যুক্তিহীন সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন– 

…man is essentially governable; which is the same as saying he is essentially gullible. He is ready to accept any government, provided it has the power and prestige, the insignia and paraphernalia of office, and makes its presence known.

যেখানে মানুষ শাসিত হয় এবং ফ্যাসিবাদকে একটা অদ্ভুত ‘জাতীয় ঐক্যের’ পরিণতি করে তোলে, সেখানে নাথানের ব্যাখ্যা কোনোভাবেই খাটে না। আসল কথা হল মনোবিশ্লেষণের আঙ্গিকে সকল জটিল মানবিক ঘটনা ব্যাখ্যার এ এক কেন্দ্রীয় সমস্যা। পারিবারিক পরিস্থিতিতে শিশুরা যে বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিবন্ধকতার শিকার হয় তার প্রমাণ সংগ্রহ আমরা কি করে করব? আমরা কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব সাধারণ মানুষ ফ্রয়ডীয় পারিবারিক নাটকের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত ট্রমা ভোগ করে। আমরা যদি স্বনির্বাচিত বায়ুগ্রস্তদের (neurotics) অনিয়ন্ত্রিত ক্লিনিকাল স্টাডি সংগ্রহ করি, তবে কি কোনো রকম আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি সাধারণ জনগণের ওপর বাধ্যতামূলক ফলাফলের প্রকাশ ঘটে থাকে? তার চেয়েও বড়ো কথা হল আমাদের সমস্ত চিন্তা প্রক্রিয়া যদি ‘পাগলদের’ থেকে আলাদা না হয় তাহলে কেন আমাদের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করতে আমরা অন্য আর-এক প্রলাপসম ব্যাখ্যা উপস্থাপন করব? (‘More than that, if all our thought processes are indistinguishable from those of lunatics why should we invest credence in one lunatic interpretation rather than other?’) মনোসমীক্ষণ ভিত্তিক ব্যাখ্যায় যে-কোনো গুরুতর আলোচনার ক্ষেত্রে এই ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। আমরা রাইস ও ফ্রম উভয়ের কাছে একই জিনিস খুঁজে পাব। 

তিন

A ‘Sex-Economic’ Analysis of the Rise of Fascism 

ত্রিশের দশকের প্রথম দিকে লেখা ভিল্‌হেল্‌ম রাইস-এর ফ্যাসিবাদের গণমনস্তত্ত্বের বইটির একটি নবতর সংস্করণ পাই ১৯৭০ সালে। কেন বইটি এত জনপ্রিয় হয়েছিল তা বোঝা কঠিন। আজও বিদগ্ধ সমাজে এর অবদান কম নয়। তবে বইটি পড়ে মনে হয়েছে এটি নিশ্চিতভাবে ফ্যাসিবাদ উত্থানের একটি উপযুক্ত ও সম্পূর্ণ বিবরণ দেওয়ার ভান করে (মতের সমর্থন মিলবে ক্রমশ)।

এই বইতে রাইস ফ্যাসিবাদের উপলব্ধ ব্যাখ্যাগুলি খারিজ করে দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ নৈষ্ঠিক (orthodox) মার্কসবাদীদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর পরিবর্তে আংশিকভাবে ফ্রয়েড ও আংশিকভাবে মার্কসের উপর ভিত্তি করে যৌন-অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ (sex-economic analysis) নামে তার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি কীভাবে একটি ‘আদর্শগত প্রতিফলন’ (ideological reflex) তৈরি করে এবং কীভাবে সেই ‘প্রতিবর্ত’ (reflex) অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ‘প্রত্যাঘাত’ (retroact) করে তিনি সেই সমস্যার মুখোমুখি হন। সমস্যাটিকে যেভাবে সমাধান করা হয় তাকে তিনি ‘character-analytic psychology’ বা ‘চরিত্র বিশ্লেষণাত্মক মনোবিজ্ঞান’ বলে প্রস্তাব করেছেন। বিশ্লেষণটি ইদিপাস গূঢৈষার (Oedipus complex) সমস্ত কলকবজা (machinery) এবং পিতার প্রতি শিশুর অপরাধবোধের সাথে জড়িত পরিচিতি ‘পারিবারিক নাটক’ দিয়ে শুরু হয়েছিল। বিশ্লেষণটিতে critical variable ফিরে যায় ‘যৌন দমন’ (sexual suppression)-এ। এই বিশ্লেষণের মূল ভিত্তি হল যৌন দমন। চরিত্র বিশ্লেষণের অনুসন্ধান জানায়, সমাজ-অর্থনীতির সংগঠন যৌন-সংগঠনের সঙ্গে মিশে যায়। আর এই মিশে যাওয়ার ব্যাপারটি জীবনের প্রথম চার-পাঁচ বছরের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী পরিবারে গড়ে ওঠে। স্বৈরাচারী পরিবার হল এমন এক ক্ষেত্র যেখানে শিশুর স্বাভাবিক যৌনতা বিশেষ করে তার যৌনাঙ্গের যৌনতা দমন করা হয়। ফলে শিশুটি হয়ে ওঠে–

শঙ্কিত, লাজুক, বাধ্য, কর্তৃত্বে ভীত, কর্তৃত্ববাদী অর্থে ‘ভালো’ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ; এটি বিদ্রোহীর শক্তি বা বলকে পঙ্গু করে দেয়, কারণ যে-কোনো বিদ্রোহী-ই উদ্‌বেগ ভারাক্রান্ত, এটি যৌন কৌতূহল এবং যৌন চিন্তাভাবনা দমন করে, বিচারমূলক ভাবনাচিন্তাকে দাবিয়ে রাখে। সংক্ষেপে, যৌন দমনের লক্ষ্য হল এমন একজন ব্যক্তি তৈরি করা যিনি কর্তৃত্ববাদী আদর্শের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবেন এবং সমস্ত দুঃখ ও মর্যাদাহানি সত্ত্বেও তাঁর কাছে নতি স্বীকার করবে।….কর্তৃত্ববাদী কাঠামো যৌন বাধা ও যৌন উদ্‌বেগকে ধারণ করে গড়ে ওঠে।

শিশুদের স্বাভাবিক যৌনতার দমন থেকে ভয়, হতাশা, শক্তিহীনতা ও হীনম্মন্যতারবোধ, ‘অর্গাজম উদ্‌বেগ’, আগ্রাসন, ধর্ষমর্ষকাম, সমকামিতা, প্রতিরক্ষামূলক আস্পর্ধা এবং রহস্যবাদের জন্ম দেয়। এসবের রাজনৈতিক প্রকাশ হল ফ্যাসিবাদ।

এই সাধারণ দিকটি কেবলমাত্র মজার। কারণ রাইস ‘কর্তৃত্ববাদী পরিবার’ ও ‘যৌন দমন’-এর সূচনা দ্রুত সনাক্ত করেছেন। মানবজাতি মাতৃতান্ত্রিক থেকে পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হ‌ওয়ার সময় থেকে যৌনাঙ্গের যৌনতার দমন শুরু হয়। রাইসের নৃতাত্ত্বিক অনুমান অনুসারে ‘সে প্রায় ছয় হাজার বছর আগের কথা’। হাজার বছরের সামাজিক ও শিক্ষাগত সংঘর্ষের ফলস্বরূপ আমাদের জানানো হয় জনগণ জৈবনিকভাবে অনমনীয় এবং স্বাধীনতা তার কাছে অক্ষম হয়ে পড়েছে। তারা আর একসঙ্গে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের আয়োজন করতে সক্ষম নয়। হাজার হাজার বছর ধরে ‘পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্ত্ববাদী পরিবারের’ মধ্যে থেকে থেকে কন্ডিশনিং-এর ফলে মানুষ ‘জৈবিকভাবে অনমনীয়’ হয়ে উঠেছে, তার ‘অতৃপ্ত অর্গাস্টিক স্পৃহা’ ক্রমশ নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। রাইসের বিবরণ অনুসারে ফ্যাসিস্ট মহামারির সমস্যা হাজার হাজার বছর ধরে বিকাশের ফল। বহু অর্থনীতিবিদ বিশ্বাস করেন ফ্যাসিবাদ তাই বিগত দুশো বছর এমনকি গত কুড়ি বছরের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের পরিণতি নয়।

কিন্তু শৈশব ও বয়ঃসন্ধিকালে যৌনতার দমনের ফলে ফ্যাসিজমের উদ্ভব হয়…. এটাই ঘটনা, এবং মানুষের জৈবিক ক্রিয়ার সাথে অর্থনৈতিক শ্রেণি ভেদাভেদের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যক্তি যে শ্রেণির হোক না কেন যারা শৈশব ও বয়ঃসন্ধিকালে যৌন দমনের শিকার হয়েছে তাদের ফ্যাসিবাদী হতে হবে। এছাড়াও যেহেতু সমগ্র মানবজাতি হাজার হাজার বছর ধরে এই ধরনের দমন পীড়ন ভোগ করছে, ফলত সবাই আমরা আশা করব– হয় আমরা বাস্তবত ফ্যাসিস্ট হব অথবা অন্তরে সুপ্ত ফ্যাসিস্ট। রাইস আমাদের জানালেন– 

আমার চরিত্র বিশ্লেষণের অভিজ্ঞতা দেখায় যে, আজ এমন কেউ নেই যার কাঠামোতে ফ্যাসিবাদী অনুভূতি এবং চিন্তাভাবনার উপাদান নেই…ফ্যাসিবাদ হল গড়-মানব চরিত্র কাঠামোর রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত প্রকাশ, একটি চরিত্র গঠন। এমন চরিত্র গঠন যার সাথে সেই জাতি বা দলের কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু যা সাধারণ এবং আন্তর্জাতিক… ফ্যাসিবাদ হাজার বছরের মানব কাঠামোর ফল। এটি যে কোনো দেশে বিকশিত হতে পারে। এটি একটি নির্দিষ্ট জার্মান বা ইতালীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নয়। এটি প্রতিটি মানুষের মধ্যে কাজ করে। 

আমরা আবার সবাই ফ্যাসিস্ট হয়ে ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যা কিনছি। মানব অক্ষমতার জেনেরিক সংগ্রহের সম্ভাব্য খতিয়ান কিনছি। যেহেতু মানুষ (অন্তত রাইস-এর মতে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ আবির্ভাবের পর থেকে) যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে, তাই আমরা সবাই জৈবিকভাবে অনমনীয় এবং অতৃপ্ত যৌনতার কারণে ক্ষুব্ধ। প্রত্যেকেই যেহেতু সম্ভাব্য ফ্যাসিবাদী, তাই ইতালীয় ফ্যাসিস্টরা ব্যাপক সমর্থন অর্জন করেছিল। এর কারণ তারা তার বিরোধীদের থেকে বেশি জোরদার ফ্যাসিস্ট ছিল। আর-একটা কথা, তখন এক অর্থনৈতিক সংকট চলছে। সেই সময় তাই একটা সংশক্তির প্রয়োজন ছিল– সর্বগ্রাসী (totalitarian) এবং কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা কেবল নামমাত্র বাধা সত্ত্বেও যেন জয়যুক্ত হতে পারে। আর মনে হয় একটা ব্যাপার হলো সেই সময় কিছু দেশে এমন ‘ঐতিহ্য’ ছিল যা ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করছিল বা উৎসাহিত করছিল। সকল দেশে একটাই সাধারণ ব্যাপার ছিল, তা হল ‘সামাজিক স্ব-শাসনের জন্য জনসাধারণের অক্ষমতা’। তবে আমেরিকা ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠেনি কারণ আমেরিকা পুরানো ঐতিহ্য নিয়ে আপ্লুত হয়নি। আমেরিকার তেমন অতীত গৌরবের ইতিহাসও নেই। আমেরিকা স্বৈরতন্ত্র থেকে নিজের উত্তরণের সৃষ্টিতে মজে থাকে, তাই ফ্যাসিবাদী খোশামোদ প্রতিহত করে। ত্রিশের দশকে ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স অর্থনৈতিক সংকটের সময় কেন ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠেনি তা ভাবনা-চিন্তার বিষয়। ‘জাতীয় ঐতিহ্য’-এ প্রত্যয়ী হয়ে আমরা আবারও ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যার কাছে নিজেদেরকে দুর্বল করেছি। কারণ আমরা সবাই জৈবিকভাবে বোকা বিপর্যস্ত। এর ফলে আমরা সবাই পোটেনশিয়াল ফ্যাসিস্ট। ফ্যাসিবাদ আবির্ভাবের অনুমিত আবশ্যিক শর্তগুলি এই ধরনের পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালোভাবে দিতে পারে। তবে ফ্যাসিবাদ থাকার জন্য অবশ্যই ‘স্বৈরাচারী পরিবার’ থাকতে হবে। আর এই ধরনের পরিবার জন্ম দেয় ‘জননাঙ্গের পেশির অনৈচ্ছিক আক্ষেপ’ (spastic condition of the genital musculature)। তবে কেন এমন হওয়া উচিত তা কখনো ব্যাখ্যা করা হয় না। তবে ফ্যাসিবাদের আবির্ভাবের কারণ হিসেবে এইরূপ যৌনাক্রান্ত মানুষের অবস্থানই কিন্তু যথেষ্ট নয়, নয়তো ফ্যাসিবাদ সবসময় থেকে যেত। রাইস আমাদের বলেন ফ্যাসিবাদ আসলে বিংশ শতাব্দীতে সম্পূর্ণ নতুন কিছু। কেনই এমন হওয়া উচিত তা কখনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয় না। ফ্যাসিবাদ আবির্ভাবের জন্য পর্যাপ্ত শর্ত কী হতে পারে সে সম্পর্কে আমরা সুলুক সন্ধান পাই না। রাইস আমাদের আবারও বলেন ফ্যাসিবাদী চরিত্র বৈশিষ্ট্যগুলি, ‘পৃথিবীর প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে প্রকাশ পাবে’। তাঁর মতে আমরা দেখেছি প্রায় ছয় হাজার বছর ধরে এমনটা ঘটে চলেছে। তাহলে কেন ফ্যাসিবাদ বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আবির্ভাবের অপেক্ষায় ছিল তা রহস্যই থেকে গেল। 

কার্যত নাথানের মতো রাইসের একই ধরনের কিছু ঘাটতি বা অক্ষমতা ছিল। এটি এমনই বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধক যা যথেষ্ট ব্যাখ্যা দেয়। এছাড়াও ‘বিশ্বের প্রতিটি ব্যক্তি’ সম্পর্কে রাইসেরর সামান্যীকরণ কীভাবে বিশ্বাসযোগ্য প্রামাণিক সাক্ষ্য হতে পারে তা প্রতিষ্ঠা করার উপায় নেই। James Gregor-এর কথায় “…there is no way to establish what credible evidence supports Reich’s generalization about ‘every single individual in the world.’”এই ধরনের অনিয়ন্ত্রিত সাধারণীকরণের জন্য যে সাক্ষ্য প্রমাণ প্রয়োজন তা রাইসের আলোচনায় কোথাও পাবেন না।

চার

ফ্রমের ফ্রয়েডীয়-মার্কসীয় ব্যাখ্যা   

এরিক ফ্রমের ‘Escape from Freedom’-কে ফ্যাসিবাদের একটি ক্ল্যাসিক ব্যাখ্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই বইতে আমরা ফ্যাসিবাদের একটি পরিশীলিত ব্যাখ্যা পেতে পারি। ফ্রমের কাজে রয়েছে ফ্রয়েডীয় ও মার্কসবাদী ঐতিহ্য। তবে ফ্রম ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণকে নির্বিচারে কবুল করেননি। ফ্রম তাঁর নিজের বিশ্লেষণে বেশ আস্থাশীল। যৌনতার সাইকোডাইনামিক দিকটির ওপর কেবল জোর দিয়েছিলেন। ফ্রয়েডের বিপরীত অবস্থান থেকে ফ্রম মনে করেন, যেসব চালিকাশক্তি আমাদের সঙ্গে অন্য মানুষের এবং গোটা বিশ্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে সেগুলির উৎপত্তি যৌন চালিকাশক্তি সমূহের থেকে নয়, বরঞ্চ ‘মনস্তাত্ত্বিক চালিকাশক্তি’ হিসাবে তাদের একটি নিজস্ব স্বাধীন অস্তিত্ব আছে। এইভাবে ফ্রম মানব প্রকৃতির একটি স্বাধীন মনস্তাত্ত্বিক অস্তিত্বের কথা বলেছিলন। ফ্রম বলেছেন– ‘there are certain factors in man’s nature which are fixed and unchangeable ; the necessity to satisfy the physiologically conditioned drives and the necessity to avoid isolation and moral aloneness. [বাঁকা অংশ লেখককৃত]’। ফ্রমের কাছে ন্যায় ও সত্যের জন্য সংগ্রাম মানব প্রকৃতির একটি সহজাত প্রবণতা, আর সেটা ‘বৃদ্ধির প্রবণতা, যার ফলে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঘৃণা’ মানুষের কাছে স্বাভাবিক। মনস্তাত্ত্বিক গুণাবলির বিচারে মানুষ অবশ্যই পশু থেকে আলাদা। মূল মনস্তাত্ত্বিক সূচনা বিন্দু থেকে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক কাঠামো বিবর্তিত হতে হতে এগিয়েছে। মানব প্রকৃতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।

‘আবশ্যিক’ এবং ‘অন্তর্নিহিত মানবিক গুণাবলির’ এই পটভূমিতে আমাদের ‘ব্যক্তি স্বতন্ত্রীকরণের’ একটি বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ব্যক্তি মানুষ নাড়িরটানে নিজেকে একদিকে বহির্বিশ্বের সাথে অপরদিকে আদিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। মানব ইতিহাসের ধারায় ব্যক্তি প্রকৃতি থেকে ‘স্বাধীনতা’ ও ‘ঐতিহ্যগতভাবে একটি কাঠামোবদ্ধ সামাজিক ব্যবস্থা’ পেয়ে আসছে। এই স্বাধীনতা পরিপক্ব অর্থনৈতিক শক্তির পরিণতি। সমাজের অর্থনৈতিক শক্তিগুলি ধীরে ধীরে মানুষকে বস্তুগত অভাব থেকে মুক্ত করেছে। ঐতিহ্যগতভাবে সংঘটিত, সুস্থিত সামাজিক ব্যবস্থার ‘প্রাথমিক বন্ধন’ থেকে বেরিয়ে আসার পূর্বশর্ত হল ‘অর্থনৈতিক শক্তি’। সামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন কেবল বৈষয়িক চাহিদা পূরণের কাজ করে না তার সাথে মানুষের সম্পর্কের প্রকৃতিকেও পরিবর্তন করে। এটি ব্যক্তির মধ্যে ক্রমশ আত্মবোধের জন্ম দেয়। একই সাথে বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব, শক্তিহীনতা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সম্পর্কে ধীরে ধীরে সচেতনতা গড়ে ওঠে। ব্যক্তির মধ্যে বিকাশ যদি কেবল এভাবেই ঘটে তবে এই ধারায় তার মধ্যে প্রকৃতিকে অনুমোদন করার একটা বোধ গড়ে ওঠে। মানুষ কি এই নতুন স্বাধীনতা থেকে মুক্তির প্রবণতাকে এড়াতে পারে? এমন কোনো অনুষঙ্গ আছে কি যা তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও একাকিত্বের ক্রমবর্ধমান অনুভূতি থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিতে পারে?

ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রে নবজাগরণের সময় থেকে এ এক কেন্দ্রীয় সমস্যা। তিনি বণিক পুঁজিবাদের বিকাশ এবং শিল্প পুঁজিবাদের আবির্ভাবের কথা প্রথম বলেন। তার সাথে বলেছেন যে, পুঁজির প্রভাব বাজারের নৈর্ব্যক্তিক আদান-প্রদান ও ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করে ব্যক্তিত্বের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে। মধ্যযুগীয় সমাজের একসাথে থাকার বন্ধনগুলিকে ভেঙে দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে যে-যে এলাকায় পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছিল সেখানে বিভিন্ন ধর্মীয় আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছিল। এই আন্দোলনের মধ্যে লুথেনারিজম (খ্রিস্ট ধর্মের বিশেষ শাখা যা মার্টিন লুথারের শিক্ষাদান থেকে উদ্ভূত) এবং ক্যালভিনিজম (প্রটেস্টান্ট সংস্কারক জন ক্যালভিন উদ্ভাবিত)-এর বিশেষত্ব হল ‘সার্বিক স্বাধীনতা থেকে মুক্তি’ (flight from freedom)। পাঠক যেহেতু স্বাধীনতার স্বাভাবিক বা প্রচলিত অর্থ না ধরে সেজন্য এখানে ‘সার্বিক স্বাধীনতা’ কথাটি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার চরম অবস্থা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। লুথারকে ফ্রম স্বৈরাচারী ব্যক্তির দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখিয়েছেন। অর্থনৈতিক শক্তিগুলির গতিধারা যে নতুন স্বাধীনতা নিয়ে আসে তার থেকে মুক্তি পেয়ে লুথারের মতো স্বৈরাচারী ব্যক্তি বাঁচতে চান। কারণ লুথার হলেন অস্বাভাবিক রকমের জাঁদরেল পিতা। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বড়ো হতে পারেননি ও তাঁর উচ্ছলতা নিস্তেজ হয়ে গেছিল। তাই তিনি হয়তো কর্তৃত্বের প্রতি অবিচ্ছিন্ন দ্বিধাদ্বন্দ্বে একেবারে জেরবার হয়ে গেছিলেন। তাই কর্তৃত্বকে একদিকে যেমন ঘৃণা করে এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, আবার একই সঙ্গে এর প্রশংসা করেছিলেন, বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। 

লুথার এক ধরনের চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। এ ধরনের লোকেরা একরকম ফাঁদে আটকা পড়ে গেছিলন। বিশেষ অর্থনৈতিক উন্নয়ন একই সাথে যেমন স্বাধীনতার নেতিবাচক অবরোধ থেকে ব্যক্তিকে মুক্তি দেয় তেমনি গোষ্ঠীর সাথে থাকতে না পারার জন্য ব্যক্তির মধ্যে অবহেলা ও শক্তিহীনতার অনুভূতি বাড়তে থাকে, এবং তাকে বিবশ করে তোলে। পুঁজিবাদের বিকাশ, বিশেষ করে একচেটিয়া পুঁজিবাদের পরিপক্বতা পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে গেছে। মানুষ বৈষয়িক বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হয়েছিল, প্রকৃতির শক্তির উপর ক্রমবর্ধমান নিমন্ত্রণ গড়ে তুলেছিল; কিন্তু তাদের মধ্যে অন্তর্নিহিত অহং-এর ঘাটতি হচ্ছিল এবং তার সাথে গোষ্ঠীভুক্তির অভাববোধ‌ও দেখা দিচ্ছিল। প্রকৃত স্বাধীনতা ও তার উপলব্ধির মধ্যে একটা ‘ব্যবধান’ ছিল। ফ্রমের মতে এই প্রতিবন্ধকতা ছিল বিশেষ করে মধ্যবিত্তের মধ্যে। বড়ো পুঁজিপতিরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত আরাম-আয়েশ আরও বেশি করে উপভোগ করেছে এবং করছে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি উন্নয়নশীল প্রলেতারিয়েত ও বৃহৎ পুঁজিপতি– এই দুই শক্তির মধ্যে আটকা পড়ে গেছে। এই মধ্যবিত্তরা নিজেদের অসহায় ও অবহেলিত মনে করে, তাদের মর্যাদা হুমকির মুখোমুখি হ‌ওয়ায় আশাহীনভাবে তাদের গোষ্ঠীবোধ আহত হয়। আবার প্রলেতারিয়েতদের মধ্যে ডুবে যাওয়া কেও তারা ঘৃণা করে। এর ফলে মধ্যবিত্তরা বড়ো পুঁজিপতিদের এক দিক থেকে প্রশংসা করে ও ভয় পায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণি তার নিজস্ব তাৎপর্যকেই সন্দেহ করেছে। হিংসা ও বিরক্তি বোধ করেছে। বড়ো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসাবে নিজেদেরকে ঘৃণা করে, অন্যদিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার জন্য মানসিক চাপ অনুভব করে। পরিবর্তে নিম্ন শ্রেণির শহরের দরিদ্র জনসংখ্যা স্বাধীনতার জন্য নতুন অনুসন্ধান চালায় এবং ক্রমশ বেড়ে চলা অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত নিপীড়নের অবসানের প্রবল আশায় অনুপ্রাণিত হয়।

সাধারণভাবে পুঁজিবাদ ব্যক্তিকে আরও একা ও বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে এবং তাকে অবজ্ঞা ও শক্তিহীনতার অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করেছে…এটা মানুষকে ব্যক্তিঅতিবর্তী তথা ব্যক্তিস্বার্থের বাইরের জন্য কাজ করতে বাধ্য করেছে, তাকে তার তৈরি মেশিনের সেবক বানিয়েছে। এর ফলে ব্যক্তির মধ্যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অবজ্ঞাও ক্ষমতাহীনতার অনুভূতি দেখা দিয়েছে। মানুষ শুধু পণ্য বিক্রি করে না, সে নিজেকেও বিক্রি করে। ব্যক্তি আরও একা, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, নিজের বাইরের অপ্রতিরোধ্য, শক্তিশালী শক্তির হাতে একটি যন্ত্র হয়ে ওঠে, ‘ব্যক্তি’ একজন মানুষ কিন্তু ব্যক্তি বিভ্রান্ত ও নিরাপত্তাহীন।১০

ফলস্বরূপ ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে মুক্তি পেতে ও আশ্রয়ের অনুসন্ধান করতে থাকে। নিরাপত্তা খোঁজার জন্য সে কর্তৃত্বের বশীভূত হয়, অথবা, বিকল্পভাবে সে তার বিচ্ছিন্নতার বিস্তৃত বোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শক্তি খোঁজে। সে একজন ধর্ষকামী (masochist) অথবা একজন স্যাডিস্ট হয়ে ওঠে। অথবা তার চরিত্র গঠনে উভয় উপাদানই প্রকাশ পায়। একই বিশ্লেষণ দৃশ্যত ইতালির ‘মধ্যবিত্তের’ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। আমাদের বলা হয়েছে যে, ‘কর্তৃত্ববাদী চরিত্র’ শব্দটি দিয়ে ব্যক্তিত্বের কাঠামোর প্রতিনিধিত্বকে বোঝানো হয়। আর এই ব্যক্তিত্ব কাঠামোই ফ্যাসিবাদের মানবিক ভিত্তি।

ফ্রম ফ্যাসিবাদের আলোচনার সময় বেশ কয়েকটি অভিজ্ঞতামূলক মানুষিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দাবি করেছেন– ১) মানুষের মধ্যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও শক্তিহীনতার একটি ক্রমবর্ধমান অনুভূতি রয়েছে, ২) এই অনুভূতি বিশেষ করে মধ্যবিত্তদের বৈশিষ্ট্য ও তা প্রধানত রিফরমেশন থেকে শুরু, ৩) কমকরে হলেও এই অনুভূতিগুলি আচরণগত বৈশিষ্ট্যের এক সংগ্রহ তৈরি করে যাকে ঠিকভাবে ধর্ষমর্ষকাম বলা যায় এবং একে ‘কর্তৃত্ববাদী চরিত্র’ বলা হয়, ৪) ব্যক্তিত্বের এই ধরনটি জেনেরিক ফ্যাসিবাদের মানবভিত্তি প্রদান করে। ফ্রম স্পষ্টভাবে স্বীকার করেন যে, এই ধরনের দাবির জন্য এর সমর্থনে বেশকিছু প্রমাণ প্রয়োজন হয়। সেই প্রমাণ সরবরাহ করার জন্য তিনি ইঙ্গিত করেন যে, তাঁর গবেষণাগুলির মূল্যায়নের ভিত্তি পৃথক পৃথক ক্লিনিক্যাল অনুসন্ধান। James Gregor বলেন, “The result of these ‘minute’ and individual studies, he insists, can be projected to whole populations, classes and categories.” উদাহরণস্বরূপ মধ্যযুগের কারিগররা তাদের শ্রমের পণ্য সম্পর্কে কী অনুভব করেছিল এবং রেনেসাঁর ধ্বনি অভিজাত ও বার্গাররাই (মধ্যযুগের ইউরোপীয় মধ্যবিত্ত) বা কী অনুভব করেছিল ফ্রম সেটা জানার ভান করেন। স্বনির্বাচিত নিউরোটিকসের একটি সমসাময়িক সংগ্রহ, তা যতই সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করা হোক না কেন, এমন তথ্য প্রদান করতে পারে যা মধ্যযুগের বা রেনেসাঁর সময়ে বসবাসকারী শ্রেণিগুলির ওপর প্রয়োগ করা যেতে পারে। ফ্রম বিভিন্ন ঐতিহাসিক কালে ও বিভিন্ন জাতীয় ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে সমগ্র শ্রেণির ও সমগ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অনুভূতির বিস্তৃত গুণাবলি তৈরি করেছেন। আমাদের বলা হয়েছে জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ ব্যক্তিগত তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও ক্ষমতাহীন অনুভূতি থেকে নিবৃত্ত থেকেছে। এটি সাধারণভাবে একচেটিয়া পুঁজির আদর্শ। James Gregor বলছেন– 

If we should request evidence to support such a broad empirical claim, we are informed that such evidence cannot be obtained by surveying the explicit feelings of populations– because the ‘normal’ individual does not know that he has such feelings. He has either been ‘fooled’ by propaganda or has ‘compensated’. We are left with Fromm’s insistence that on the basis of his clinical studies of some unspecified number of neurotics he knows what the unconscious feelings of entire classes, categories, and populations over our centuries might be.১১ 

ব্যক্তির মাধ্যমে গোষ্ঠীকে জানতে চেয়ে ফ্রম নিশ্চয়ই ঠিক করেননি। বিষয়টি আসলে অভিজ্ঞতার ব্যাপার নয়। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী কেমন অনুভব করছে তা প্রতিষ্ঠা করার উপায় আছে। এ ধরনের উপাত্তে ফ্রম আগ্রহী নন। তিনি অনির্দিষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ড, অনির্দিষ্ট বয়স, লিঙ্গ, শিক্ষার স্তর ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি থেকে কিছু অনির্দিষ্ট সংখ্যক নিউরোটিকের স্বপ্ন ও শব্দ অনুষঙ্গের ‘ব্যাখ্যা’-র ভিত্তিতে সমগ্র জনগণের অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে চান। এই ধরনের প্রমাণ ও ব্যাখ্যার ভিত্তিতে ফ্রম জোর দিয়ে বলতে চান– ‘নিম্ন মধ্যবিত্তের সামাজিক চরিত্র শ্রমিক শ্রেণির থেকে, উচ্চ মধ্যবিত্তের স্তর ও উচ্চবিত্তদের থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা ছিল।’ কিন্তু, তিনি কি বলতে পারেন সমগ্র ইতিহাস জুড়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির কী ধরনের চরিত্র বৈশিষ্ট্য ছিল? অন্যান্য শ্রেণির মধ্যেও এই ধরনের চরিত্র বৈশিষ্ট্যের দোলাচল সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে সূক্ষ্ম পরিমাণগত বিচার-বিশ্লেষণ তিনি কী করতে পারতেন? আমাদের বলা হল শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে এই ধরনের কর্তৃত্ববাদী চরিত্রলক্ষণ থাকতে পারে তবে তা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির একেবারে আদর্শ, একেবারে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। শ্রমিক শ্রেণির মাত্র একটি সংখ্যালঘু অংশে এই ধরনের চরিত্র কাঠামো স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এর কোনোটিকেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চালানো যেতে পারে না। কারণ, এতে সন্দেহের পর সন্দেহ করা যেতেই পারে। বলা যেতে পারে অতি উত্তম অনুমান। একজনকে বিনাদ্বিধায় তাঁর যুক্তির প্রধান আশ্রয়বাক্যটিকে স্বীকার্য বলে মেনে নিতে কোনোভাবেই অনুমোদন করা যায় না। এখানে সেই প্রধান আশ্রয় বাক্যটি হল– “….men have an inherent tendency to seek ‘freedom’, justice, truth and so forth.” ফ্রম কীভাবে এত সহজে পৌঁছে গিয়ে বলতে পারলেন– স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, সত্য এসব খোঁজার জন্য মানুষের একটা সহজাত প্রবণতা রয়েছে। আবার এটাও নাকি স্বীকার করতে হবে নিম্ন মধ্যবিত্ত বিশেষ ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যা ভোগ করে এবং এটা তাদের শ্রমিক শ্রেণি থেকে আলাদা করে। তাহলে তো যে কাউকে মেনে নিতে হবে ফ্রম বড্ড বেশি অভিজ্ঞতা অনুসারী ছিলেন। এমনকি সবকিছু অনুমোদন করার পরও বলতে হয় যে ভিত্তির ওপর ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যা দাঁড়িয়ে রয়েছে তা ভীষণ নড়বড়ে ভঙ্গুর টলমলে। 

এবার আমাদের যে আলোচনায় আসতে হচ্ছে তা হল মানুষের জেনেটিক সমস্যা– ফ্রমের ‘ইতিবাচক স্বাধীনতা’ যখন খর্ব হয় তখন তা ব্যক্তিত্বের বিকার বা ক্ষতির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে। আবার ফ্রম স্বীকার করেন কোথাও কখনোই এমন কেউ নেই যে ইতিবাচক স্বাধীনতা উপভোগ করতে পেরেছে। ফলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের বলা হয়েছে বৃহত্তর গোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্মবোধ না হওয়ার অনুভূতির থেকে সাধারণ মানুষের পক্ষে যে-কোনো কিছু সহ্য করে নেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। এর সাথে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও শক্তিহীনতার অনুভূতি ‘স্বাভাবিক’ ব্যক্তির মধ্যে একটি ‘স্বয়ংচালিত যন্ত্রে পরিণত হওয়ার’ মনোভাব তৈরি করে। এতে আমরা স্ব-ইচ্ছুক ব্যক্তি-বিভ্রমের মধ্যে বাঁচতে পারি। তাই আমরা অবশ্যই স্বীকার করতে পারি যে, ‘তথাকথিত যুক্তিবাদী আচরণ মূলত চরিত্রের গঠন দিয়ে নির্ধারিত হয় না’। এর থেকে দাঁড়াল আমরা যা নিউরোটিক ব্যক্তির মধ্যে দেখি তা আদতে স্বাভাবিক মানুষের থেকে আলাদা নয়। শেষ পর্যন্ত সাধারণভাবে ‘যদি আধুনিক মানুষ’ ‘ক্ষমতাহীনতার গভীর অনুভূতি’ কাটিয়ে উঠতে পারে এবং ‘গড়পরতা’ মানুষ যদি স্বয়ং চালিত হয় আর ‘স্বয়ংচালিত মানুষেরা মরিয়া হয়ে যদি ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য’ উর্বর মৃত্তিকারূপে কাজ করে, তাহলে অবশ্যই প্রশ্ন জাগে কেন আমরা সবাই রিফরমেশন-এর পর থেকে ফ্যাসিবাদী ছিলাম না? ফ্রমের একমাত্র উত্তরটি হল, বিশেষ ধরনের একচেটিয়া পুঁজিবাদের শর্তগুলি সংকটকে বাড়িয়ে তোলে। আর এর ফলে আমাদের সকলের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী চরিত্রের মানুষকেও শোষিত বঞ্চিত করা যায়। তবে কেন, সব থেকে উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠল না তা বলা কিন্তু কঠিন? ইতালি মূলত কৃষি নির্ভর হওয়া সত্ত্বেও কেন সেখানে ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব হল? স্পেন ও পর্তুগালে একচেটিয়া পুঁজিবাদ না থাকা সত্ত্বেও কেন সেখানে ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব হল? 

সম্ভবত আরও মজার বিষয় হল এ ধরনের ব্যাখ্যা বলতে চায়– যেখানেই টানা সংকট রয়েছে সেখানে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ‘সহজাত আগ্রাসনের’ ফলে সার্বিক ব্যক্তিত্বের হানি ঘটছে। অথবা ‘তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও ক্ষমতাহীনতার’ অনুভবের জন্য ‘শিশু ও বয়ঃসন্ধির যৌন দমন’-এর ফল হবে ফ্যাসিজম। তাই শ্রমিক শ্রেণি বা শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের ভেতর এসব অনুভূতি কাজ করবে না কেন? শ্রমিক শ্রেণি যে ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয় সে বিষয়ে রাইস ও ফ্রম দুজনেই অনর্গল ছিলেন। রাইস-এর কাছে শ্রমিক শ্রেণি হল অধিকতর আন্তর্জাতিকতাবাদী (more internationationalistic), আন্তর্জাতিকতার কাছে অধিকতর সহজলভ্য (more accessible to internationalism)। তাঁরা মানসিক ও যৌনতা বিষয়ে মধ্যবিত্ত মানসিকতার সাথে সহমত নয়। শ্রমিক শ্রেণি তুলনাহীনভাবে টিপিকাল মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ অপেক্ষা যৌন-অর্থনৈতিক ধারণা সম্পর্কে খোলাখুলি ও মুক্তমনা। ফ্রমের মতে, সামাজিক পিরামিডের তলার দিকে থাকা শ্রমিকরা মধ্যবিত্তের কিছু ‘স্বয়ংক্রিয়’ আচরণ এড়িয়ে চলে। তাদের প্রচলিত নিয়মের ধার ধারতে হয় না, তাদের হারানোর কিছু নেই, যা আছে সবকিছু পাওয়ার। 

তবে ছবিটা এখনও পরিষ্কার নয়। আলোচনার সময় রাইস বিলাপ করছেন– বিশ শতকের শিল্প শ্রমিকরা বাঁচার রাস্তা ও মধ্যবিত্ত মনোভাব আয়ত্ত করে ফেলেছে, এবং ফ্রম অনুমোদন করছেন শ্রমিকদের যন্ত্রাংশ হিসাবে গড়ে তোলা গেছে। তবে পাঠক আশ্চর্য হবেন না, রাইস ও ফ্রম দুজনেই আবিষ্কার করে ফেলেছেন যে, বিপ্লবী রাশিয়ায় ক্ষমতায় আসা শ্রমিকদের আন্দোলন ফ্যাসিবাদের একটি নিখুঁত উপমায় পরিণত হয়েছে। আমরা অনুমান করতে পারি রাইস মাওবাদ, চিন সম্পর্কে কী বলবেন। এখানে তো রাইসের ‘সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণি’ মানে ‘কৃষক’ শ্রেণি ক্ষমতায় এসেছে। এখানে একটি ক্যারিশমাটিক কান্ডারি এমন একটি রাষ্ট্রকে শাসন করে যেখানে জাতীয়তাবাদকে একটি বিশেষ গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, আর জীবন পরিচালিত হয় সামরিক শক্তির মাধ্যমে। যে কেউ এখানে কিউবা ও তার কৃষিবিপ্লব সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলতে পারেন। এখানে বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল শ্রেণিচ্যুত কিছু বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী যোদ্ধা। ক্যারিশমাটিক জেফে (Jefe) এজেন্সি এখানকার জনগণকে শাসন করেছিল। এই ধরনের ব্যাখ্যাগুলি কী ব্যাখ্যা করে তা জানা কঠিন। প্রাথমিকভাবে মনে হয় তারা খুব বেশি ব্যাখ্যা করতে পারে সাধারণভাবে সমস্ত শাসনব্যবস্থা বা অন্তত সেই সমস্ত ক্ষেত্র যেখানে জনগণ ক্যারিসমাটিক নেতাদের অনুসরণ করে। আমাদের প্রশ্ন কেন তবে ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলিতে একচেটিয়া পুঁজিবাদ থাকা সত্ত্বেও ফ্যাসিবাদ আসেনি?

জানেন তো আমরা সবাই আস্ত ফ্যাসিস্ট নয়তো পোটেনশিয়াল ফ্যাসিস্ট। তারপরেও আমাদের কাছে কোনো ব্যাখ্যা নেই কেন জানি না। জানি না একটা শ্রেণি অন্য শ্রেণির তুলনায় কেনই বা বেশি ফ্যাসিবাদী। যে-সব আন্দোলন মধ্যবিত্ত তা ফ্যাসিবাদী হবেই, আর এর বিকল্পের কথা যদি বলেন মানে উলটোটা প্রমাণের জন্য আমাদের হাতে কাছে রেডিমেড কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চিন এবং কিউবার শ্রমজীবী জনগণ অন্যদের মতোই স্বাধীনতা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে (escape from freedom)। কেউ হয়তো বলবেন স্টালিনবাদ, মাওবাদ বা ক্যাস্ট্রোইজম মূলত মধ্যবিত্ত আন্দোলন। তবে মানুষ যদি তার আদর্শ খুঁজে পাওয়ার মতো সরকার পায় তবে শ্রমজীবীরা ও যে-কারও মতো ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠবে। ফ্যাসিবাদ যদি আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্বের ফল হয় তবে এ ধরনের ব্যক্তিত্ব সর্বজনীন না হলেও সংখ্যাতে খুব কম কিন্তু নয়। ব্যাখ্যা যেন মনে হয় আমাদের ছেড়ে পালিয়েছে।

পাঁচ

কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তিত্বসম 

এসব আলোচনা থেকে টিকে রইল কেবল অভিজ্ঞতামূলক অনুমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একদল গবেষক এবং পণ্ডিত কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তিত্বের অস্তিত্বকে পরীক্ষামূলকভাবে নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছিলেন। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণধর্মী এক উন্নত ব্যাটারি (tool) ব্যবহার করে তারা বিষয়গুলি অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। তাঁরা আবিষ্কার করেন, আসলে চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলির একটি সিনড্রোম রয়েছে যাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে ‘স্বৈরাচারী’ বা “অস্ফুট ফ্যাসিস্ট’ হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তাঁরা আবিষ্কার করেছিলেন, এমন কিছু মানুষ আছে যারা শনাক্তযোগ্য আচরণ প্রলক্ষণের সমন্বয় (identifiable collection of behavioral traits) এবং মনে হয় যেন একসাথে সংযুক্ত আছে। তাঁরা দেখেছেন, যারা ইহুদি বিরোধী হওয়ার প্রবণতা পোষণ করেছিল তারা নৃকুলতাকেন্দ্রিক (ethnocentric) ছিল। অর্থাৎ তারা বিদেশি বা এলিয়েন কোনো কিছুকে অবমূল্যায়ন করার প্রবণতা পোষণ করেছিল। তাঁরা আরও দেখেছেন যে, এই ধরনের ব্যক্তিরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে রক্ষণশীল হয়ে থাকে। এই ধরনের ব্যক্তি পিতা-মাতাকে আদর্শ হিসেবে দেখে থাকে। অথবা তার পারিবারিক সম্পর্কে কঠোর বা কর্তৃত্ববাদী হয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে যারা সব থেকে নীচে রয়েছে তাদের মধ্যেই সম্ভবত ‘ফ্যাসিবাদের’ সুনির্দিষ্ট লক্ষণগুলো দেখা যায়। হয়তো এটাই সব থেকে মজার বিষয়। এইভাবে যদি কাউকে কর্তৃত্ববাদী (authoritarian) বা পোটেনশিয়াল ফ্যাসিস্ট বলে দেগে দেওয়া হয়, তবে প্রায়ই এমন সমস্ত মানুষ এর আওতায় চলে আসে যাদের শিক্ষা ন্যূনতম, বুদ্ধ্যঙ্ক কম, সামান্য চাকরি অথবা খুব কম মজুরি পায়। বাস্তবে পোটেনশিয়াল ফ্যাসিস্ট শ্রমিক শ্রেণির মধ্যেই দেখা যায়। পোটেনশিয়াল ফ্যাসিস্ট বা অস্ফুট ফ্যাসিবাদী বাইরের দিক থেকে সুবিধাজনক উপসংস্কৃতির (underprivileged subculture) প্রথাসিদ্ধ আচরণ মেনে চলে। অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে গবেষণায় মাঝেমধ্যে দেখা যায় শ্রমিক শ্রেণি ও যে দলে শিক্ষা খুব কম তারা ব্যতিক্রমী ধরনের কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে। ‘দ্য অথোরেটারিয়ান পার্সোনালিটি’ বইতে গবেষকরা একটি সেট উদ্ভাবন করেছিলেন। এর সাহায্যে ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলিকে সংজ্ঞায়িত করা যায় ও বিভিন্ন স্তরভুক্ত করা যায়। এই বৈশিষ্ট্যগুলি ও তাদের তীব্রতাকে কোনো প্রদত্ত ব্যক্তির মধ্যে প্রয়োগ করলে যদি সে একটি বিশেষ স্কেলে পরে তাহলে বোঝা যাবে ফ্যাসিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করার প্রবণতা তার বেশি। এই বিশেষ স্কেলটিকে তারা ‘এফ স্কেল’ বলেছেন। স্কেলটির বিষয়ে এখানে আলোচনা দাবি করে না। এই বইতে অ্যাডর্নো ও তার সহযোগীরা ব্যক্তিত্বের ধরনগুলিকে নয়টি ভাগে ভাগ করেছিলেন। শ্রমিক গোষ্ঠীর মধ্যে ‘এফ স্কেল’-এর স্কোর সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল। এতে রজার ব্রাউন (Roger Brown) অভিমত প্রকাশ করেন কর্তৃত্ববাদ পশ্চিমি শিল্পসমাজের অশিক্ষিতদের বিশ্ববীক্ষা। তাই এই স্কোর নিয়ে অধিক আলোচনার তেমন গুরুত্ব দেখছি না।

‘অস্ফুট ফ্যাসিবাদী’ (potential fascist) ব্যক্তিত্বের অস্তিত্বের সমর্থনকারী প্রমাণগুলিকে যদি ইতালীয় ফ্যাসিবাদের আংশিক ব্যাখ্যা হিসেবে ব্যবহার করা হয় তবে ‘নিম্ন মধ্যবিত্ত’ থেকে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে এ ধরনের ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার আশা করা যেতে পারে। মনে হয় এরকম ব্যক্তিত্বের ধরন কঠিন ও অনড় পরিবারের মধ্যেই দেখা যায়, যেখানে শাস্তিমূলক শৃঙ্খলা তুলনায় বেশি। তবে এটা কিন্তু নয় তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পড়ে। যদি মধ্যবিত্ত শ্রেণি ফ্যাসিবাদের পক্ষে যথেষ্ট সমর্থন জোগাতে পারে তবে তা কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তিত্বের পরিণাম। আর এটা এই শ্রেণির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই বিতর্কের সমর্থনে কোনো বিশ্বাসযোগ্য অভিজ্ঞতাসম্মত প্রমাণ আমাদের কাছে নেই।

যুদ্ধোত্তর গবেষণা স্পষ্টভাবে দেখায় না যে, প্যারানয়েড সামাজিক গোষ্ঠীগুলি কর্তৃত্ববাদী আবেদনের ওপর কী পরিমাণ ভিত্তি করে রয়েছে, কর্তৃত্ববাদী যে-কোনো ধরনের চরমপন্থী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কতটা সামর্থ্য, প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক ধরন ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই ধরনের গোষ্ঠীগুলি কীরূপ প্রভাব ফেলে, কর্তৃত্ববাদের মহামারি সংক্রান্ত বিদ্যা কী রকম হওয়া উচিত। ফ্যাসিবাদের মনোবিশ্লেষণ ভিত্তিক গবেষণা কার্যত মূল লক্ষ্যেরই দ্যোতক ছিল। গবেষণাটি হয় সজ্ঞাবিরাধী প্রমাণ, নতুবা স্পষ্টতই সিদ্ধান্তহীন ছিল। এই সজ্ঞাবিরোধী দিকটি হল– ‘the working class should be the recruitment base of fascist movement.’

অবশেষে মনে হয়, ফ্যাসিবাদের মতো জটিল এবং তুলনামূলকভাবে কার্যকর একটি আন্দোলন sadomasochistic; সুপ্ত সমকামী ব্যক্তিত্বের ধরন যাতে বিচারবিতর্কের অভাব, সাধারণ সহিংসতার প্রতি আসক্তি এবং একটি অদম্য রহস্যবাদের পরিণতি– এর কোনোটিই ফ্যাসিবাদের কারণ বা ফলাফল হতে পারে না। একচেটিয়াভাবে আমেরিকান জনসাধারণের মধ্যে থেকে এই নমুনাগুলি নেওয়া হয়েছে। তাদের কেউই সাধারণভাবে জনসাধারণের প্রতিনিধি নয়। আমরা শুধুমাত্র বিপত্তি বা ঝুঁকির সাথে সাধারণীকরণ করতে পারি। ইতালীয় ব্যক্তিত্বের ধরনগুলি মধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী যাই যত হোক না কেন আমরা কোনো আত্মবিশ্বাসের সাথে সাধারণীকরণ করতে পারি না। কিন্তু যাই হোক না কেন ফ্যাসিবাদের সাইকোঅ্যানালিটিক ব্যাখ্যা মূলত অপর্যাপ্ত। এত গবেষণার পরেও আমাদের কাছে কেবল কিছু পরিবেশ, কিছু মনোগত বৈশিষ্ট্য‌ই র‌ইল। লোকে এগুলিকেই ফ্যাসিবাদের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য বলে মনে করে। আরও মনে করে বাস্তবে এই বৈশিষ্ট্যগুলি খুব ভালোভাবেই থাকতে পারে। এইসব প্রমাণ এও বলে যে, বেশি সুবিধাপাওয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি অপেক্ষা শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে এই কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তিত্ব দেখা যায়। এই চেষ্টা সাধারণ ব্যাখ্যা হিসেবে যথেষ্ট নয়। এছাড়া এমনকিছু লোক আছে যারা ফ্যাসিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে, যদি ফ্যাসিবাদ যথেষ্ট আগ্রাসী ও কর্তৃত্ববাদী হয়। কিন্তু এ ধরনের বুদ্ধিমত্তা আমাদের বেশিদূর নিয়ে যায় না। যখন আমরা এই মতবাদের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যা পর্যালোচনার চেষ্টা করি তখন শুধু সমর্থনহীন জল্পনা-কল্পনার এক মিথ্যা জালে আবিষ্ট থাকি। এ শুধুমাত্র এমন একটি অস্পষ্ট ধারণা দেয় যে, আমরা সবাই পাগল, নিউরোটিক ও ফ্যাসিবাদী– এর চেয়ে ভালো কিছুর সম্ভাবনা কম। এ ধরনের ব্যাখ্যা শুধুমাত্র অপর্যাপ্ত নয় ভীষণভাবে হতাশাজনক। এই ধরনের ব্যাখ্যাগুলি সম্ভবত ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে যা জানায়, তার চেয়ে ব্যাখ্যাতাদের সম্পর্কে বেশি বলে।

উল্লেখপঞ্জি:

১.‘The Mass Psychology of Fascism’, Wilhelm Reich, p. 37

২. ‘The Nuremberg Mind: The Psychology of Nazi Leaders’, New York, Quadrangle Press, 1975

৩. ‘বিচ্ছিন্নতার ভবিষ্যৎ’, ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়; দ্বিতীয় খণ্ড, প্রবন্ধ– ‘ফ্যাসিবাদী মন মানুষ ও সমাজ’, প্রতিভাস, কলকাতা, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ২০৩ 

৪. ‘Interpretation of Fascism’, A. James Gregor, Chapter III

৫. ‘Psychology of Fascism’, p. 17

৬. ‘Interpretation of Fascism’, A. James Gregor, Chapter III

৭. Ibid

৮. ‘Mass Psychology of Fascism’, Wilhelm Reich, p-XIX

৯. Ibid, p. 47        

১০. ‘Escape from Freedom’, Erich Fromm, p. 37        

১১. ‘Interpretation of Fascism’, A James Gregor, Chapter III

[এই প্রবন্ধের প্রয়াস অভয়ার ন্যায় বিচারের দাবিতে।]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান