সাহাবুদ্দিন
That’s how Mussolini got in. That’s how Hitler got in. They took advantage of a situation, a problem, perhaps, that humanity was going through at the time, after an economic crisis.১
কথাগুলো বলেছিলেন Pena Nieto, মেক্সিকোর প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান। আর-এক রাষ্ট্রপ্রধান সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে। কে তিনি? প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সংকটকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে কীভাবে মুসোলিনি ও হিটলার মানবেতিহাসের ঘৃণ্যতম ফ্যাসিস্ট শক্তি হিসেবে মাথা তুলেছিলেন সে ইতিহাসের অনুষঙ্গ এনে একবিংশ শতকের আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একজন রাষ্ট্রপ্রধান যখন আর একজন রাষ্ট্রপ্রধান সম্পর্কে কথা বলেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না মুসোলিনি কিংবা হিটলারের ছায়া আজও কী সাংঘাতিক রকমের প্রলম্বিত।
এ হল সেই মারণ-ফ্যাসিবাদের ভ্রাম্যমাণ ছায়া, যা দীর্ঘতর হতে হতে গ্রাস করে চলেছে একবিংশ শতাব্দীকেও। স্থান-কাল-পাত্রের প্রথাগত বেড়া ডিঙিয়ে তার বিশ্বপরিক্রমা আজও অব্যাহত। শুধু চেহারাটা বদলেছে, স্বরূপত সে একই আছে। অতি-দক্ষিণপন্থা, উগ্র জাতীয়তাবাদ, ও স্বৈরাচারকে সঙ্গে নিয়ে পর্বান্তরে রূপান্তরে সেই একই ফ্যাসিবাদের রক্তচক্ষু ও আকাশচুম্বী আগ্রাসন। এই আগ্রাসন থেকে সত্যিই কি মানুষের মুক্তি নেই?
ঘরে-বাইরে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এই ফ্যাসিস্ট মনোবিকার গিলে ফেলতে চায় মনুষ্যত্বকে। যে মনুষ্যত্ব ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিস্বাধীনতার উদাযাপনে বিশ্বাস করে, যে মনুষ্যত্ব গণতান্ত্রিক আবহে পরম আদর ও উদারতায় লালন করতে চায় ভিন্নস্বরের সহাবস্থানকে, যে মনুষ্যত্ব কে কী খাবে, কে কী পরবে, কে কী বলবে, কী ভাববে, কীভাবে ভাববে– এসবের উপর কোনো খবরদারি ও দখলদারিতে বিশ্বাস করে না, বরং এই খবরদারি, এই নীতি-পুলিশগিরি ও ‘থ্রেট কালচার’-এর বিপ্রতীপে যে মনুষ্যত্ব দাঁড়িয়ে থাকে এক সদর্প দ্রোহ হয়ে, সেই মনুষ্যত্বকে গিলে ফেলতে চায় এই ফ্যাসিস্ট মনোবিকার। আর সেজন্য সে সর্বাগ্রে চায় এক বিকৃত ভাষ্যের সুপরিকল্পিত নির্মাণ। বলা বাহুল্য, সে ভাষ্য-নির্মাণের প্রাথমিক ও মুখ্যতম প্রকরণ ঘরে-বাইরে শত্রু চিহ্নিতকরণ।
এক
জলে দ্রবীভূত অক্সিজেন হল মাছের জিয়নকাঠি, মাছের মিত্র, যা ছাড়া মাছ বাঁচতে পারে না। কিন্তু ফ্যাসিবাদ শুধু মিত্র নয়, শত্রু ছাড়া বাঁচে না। বরং বলা ভালো, কখনো কখনো মিত্রের চেয়েও তার বেশি প্রয়োজন শত্রুর, আর এজন্যই তার শত্রু চিহ্নিতকরণের হরেক আয়োজন। এই শত্রু তার ভাষায় ‘অপর’– ‘enemy other’। কে এই ‘other’? এ হল সেই-ই, যে ‘us’-এর মধ্যে পড়ে না: “The ‘other’ is constituted by anyone or everyone who is potentially opposed to ‘us’…The fascists then project all the bad qualities on to the ‘other’ and reverse all the good for the ‘self’….The ‘us’ then necessarily project the ‘enemy other’ both– as strong enough to be a threat and weak enough to be vanquished and crushed.”২ অবশ্য, ঘরে-বাইরে সর্বত্র এই শত্রু খুঁজে বেড়ানো ও তার উপর ইচ্ছেমতো রাবারস্টাম্প সেঁটে দিলেও ফ্যাসিবাদ এই শত্রুকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে চায় না, তাকে নিয়ে নির্মম হলোকাস্ট বানালেও তার কিছুটা জিইয়ে রাখে। কারণ ‘অপরত্ব’-এর নির্মাণ তার বেঁচে থাকার প্রকল্প।
এই প্রকল্পকে সফল করে তোলার কুশীলব সারা বিশ্বে ছড়ানো। যেমন, হিন্দুত্ববাদীরা ‘অপরত্ব’-এর বোধ থেকে পাশে যতক্ষণ মুসলমানকে রাখতে পারে ততক্ষণই তারা একমাত্রিকতায় বাঁধা এক সংহত হিন্দু জাতি, কিন্তু মুসলমান না থাকলেই তারা হয়ে যায় কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ বৈশ্য, কেউ বা শূদ্র, আবার কেউ শৈব, কেউ শাক্ত, কেউ বৈষ্ণব, কেউবা লোকায়ত নাস্তিক– ইত্যাদি আরও কত কী। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলা ভালো, হিন্দু তখন আর হিন্দু থাকে না, সে হয়ে পড়ে শতসহস্র জাতপাত-দীর্ণ এক পরস্পর-বিচ্ছিন্ন, বহুধাবিভক্ত, অসংহত জনগোষ্ঠী। অবশ্য পাশে মুসলমান না থাকলেও হিন্দুত্ববাদীদের শত্রুর অভাব হয় না। তখন তার শত্রু হয়ে পড়ে দলিত সম্প্রদায়। কারণ, হিন্দুধর্ম আর হিন্দুত্ববাদ সম্পূর্ণ আলাদা। সহিষ্ণুতা, সহাবস্থান, সমন্বয় ও সর্বগ্রাহিতার যে সনাতন আতিথ্যে হিন্দুধর্ম হাজার হাজার বছরের পরম্পরা নিয়ে প্রোজ্জ্বল, তার বিপ্রতীপে হিন্দুত্ববাদ ঔপনিবেশিক ভারতের এক বিদ্বেষমূলক উগ্র মনোবিকার, যার ভিত্তি ব্রাহ্মণ্যবাদী আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা ভারতের বহুত্ববাদকে অস্বীকার করে তথাকথিত একমাত্রিক হিন্দু জাতিসত্তা নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে হিন্দু ভারত বানাতে চায়। মুসলমান, খ্রিস্টান, পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে অরণ্যের অধিকারকে ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিপ্রতীপে অনার্য কৃষ্টিকে আঁকড়ে থাকা দরিদ্র দলিত, শ্রমজীবী, কম্যুনিস্ট এবং মুক্তমনা গণতান্ত্রিক শক্তি এই ব্যবস্থার ঘোষিত শত্রু।
সুযোগ মতো কায়েমি স্বার্থে ‘অপর’-কে ঘোষিত শত্রু হিসেবে বলির পাঁঠা (scapegoat) করে তার বিপরীতে একটা স্ব-কল্পিত জাতিসত্তার নির্মাণ ফ্যাসিস্ট শক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্য। প্রয়োজনে সেই বলির পাঁঠাকে পরবর্তীতে নতুন জাতিসত্তার পোশাক (যেমন, জায়নিজম) পরিয়ে অন্য আর এক জাতিসত্তা (যেমন, প্যালেস্টাইনি)-র বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে সুবিধাজনক দূরত্ব থেকে নিজের ফায়দা লুটতেও এই ফ্যাসিস্ট শক্তি সিদ্ধহস্ত। ঠিক এই কথাটাই খেটে যায় জার্মানি তথা পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদের সাম্প্রতিক কিছু কার্যকলাপে, যখন বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে জায়নিজম তথা ইহুদি জাতিসত্তা নির্মাণের ইজরায়েলি প্রকল্পে তাদের প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষ মদত দেখা যায়। যে ইহুদিদেরকে এই নিয়ে এই নবতর ফ্যাসিবাদী (neo-fascist) প্রকল্প, তারা জার্মানি তথা ইউরোপ জুড়ে বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব সময়ে ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এক ছন্নছাড়া, নির্যাতিত ও সর্বদা মৃত্যুর ধার ঘেঁষে কোনোক্রমে টিকে থাকা বিপন্ন জনগোষ্ঠী। কিন্তু তাঁদের চোখে তাঁদেরই নির্যাতনকারী ইউরোপ পরিয়ে দিল জাতিসত্তা নির্মাণের রঙিন চশমা, যার পারিভাষিক নাম জায়নিজম (যার সঙ্গে ইহুদি ধর্মাদর্শের বিস্তর ফারাক):
The Jews in Europe were no more than convenient soft punching bags for inebriated, weak, frustrated, sadists till the advent of Zionism, the potential actualisatoin of the dream of the Jewish homeland– the land of ‘milk and honey’– of Israel….৩
দুই
শত্রু চিহ্নিতকরণের ফ্যাসিবাদী প্রকল্পে ফ্যাসিস্ট শক্তি খুব ভালো করে জানে কখন কাকে কোন প্রেক্ষিতে শত্রু হিসেবে দেগে দিতে পারলে আখেরে লাভের ফসল ঘরে তোলা যাবে। তাই কখনো সে শত্রু মেক্সিকান (ট্রাম্পপন্থী আমেরিকানদের কাছে), কখনো ইহুদি (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের জার্মানির কাছে), কখনো প্যালেস্টাইনি মুসলিম (জায়নিস্ট ইহুদির কাছে), কখনো মুসলমান (হিন্দুত্ববাদীদের কাছে) আবার কখনো হিন্দু (জামাত-পন্থী মুসলমানের কাছে), কখনো কম্যুনিস্ট কিংবা মুক্তচিন্তার বাহক (যে কোনো ফ্যাসিস্ট শক্তির কাছে)। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভিন্ন ভিন্ন আর্থ-রাজনৈতিক সমীকরণ আছে, কিন্তু প্রতিটি সমীকরণই বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির হাল শোচনীয় হলে বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে জার্মানি হাতে নিল এক উগ্র জাতিসত্তা নির্মাণের প্রকল্প। আর এই প্রকল্পকে সফল করতে তার দরকার হয়ে পড়ল এমন এক ‘অপর’-কে, যাকে শত্রু হিসেবে বিপ্রতীপে রেখে আপন জাতিসত্তার দম্ভকে চরিতার্থ করার মনোবিকারকে সঙ্গে নিয়ে এক অগণতান্ত্রিক, স্বৈরশাসন কায়েম করা যায়। এই ‘অপরত্ব’ আরোপ করার স্বেচ্ছাচারী প্রকল্পে হিটলার কাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করলেন? ভালো-মন্দ বাছবিচারের পরোয়া না করে ইহুদি মাত্রই চিহ্নিত হল শত্রু হিসেবে।
এই প্রকল্পেরই প্রতিরূপ ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প, যেখানে একই আঙ্গিকে মুসলমান মাত্রই ‘অপর’। নাৎসি হিটলারের চোখে যেমন ভালো-মন্দ নির্বিশেষে ইহুদি মাত্রই চিহ্নিত শত্রু, তেমনি হিন্দুত্ববাদীদের চোখে ভালো মুসলমান, খারাপ মুসলমান বলে কিছু হয় না, মুসলমান মাত্রই শত্রু। আর এই শত্রুকে চিহ্নিত করে তার প্রতি বিদ্বেষ ছড়াতে ও সেই বিদ্বেষকে জিইয়ে রাখতে হিন্দুত্ববাদীদের নবতম হাতিয়ার ইসলামোফোবিয়া। জনমানসে এই ফোবিয়াকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে তারা মুসলিম জন্মহার নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বলতে চায় ২০৫০ সালে নাকি মুসলমান জনসংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে, এবং তার ফলে হিন্দুরা হয়ে পড়বে বিপন্ন, এবং হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে অলীক কল্পনা। অথচ জনসংখ্যা তত্ত্বের এই গৈরিকিকরণ কতটা অবাস্তব ও ভিত্তিহীন তা সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হিন্দুত্ববাদ ও ভারতীয় ফ্যাসিজম’( পৃ: ১৩৯-১৬১, আবিষ্কার প্রকাশন, ২০২২) পড়লেই বোঝা যায়। এ ছাড়াও লাভ জেহাদ (হিন্দু নারীর সঙ্গে মুসলিম যুবকের প্রেম কিংবা বিবাহ), ল্যান্ড জেহাদ (হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকায় মাজার কিংবা মসজিদ নির্মাণ), মেহেন্দি জেহাদ ( মুসলিম হকার হিন্দু নারীকে মেহেন্দি পরালে), বেওসা জেহাদ (হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকায় মুসলমানরা ব্যাবসা করছে কিনা)– ইত্যাদি নানান কারণ দেখিয়ে মুসলমানদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে গণপিটুনিকে হাতিয়ার করা হয়।
আসলে, ফ্যাসিবাদ তার চিহ্নিত শত্রুর মধ্যে যেমন পরিস্থিতি সাপেক্ষে ইস্যুভিত্তিক শত্রুতার উপকরণ খোঁজে, তেমনই সে সার্বিকভাবে মনে করে তার শত্রু যেহেতু সম্পূর্ণরূপে এক পৃথক কৃষ্টি তথা জাতিসত্তার ধারক ও বাহক, তাই তার মধ্যে ভালো খারাপ চিহ্নিত করার কোনো মানেই হয় না। তার সবটাই খারাপ, এবং তার অন্তর্গত সকলেই শত্রু:
The antagonistic opposition is rooted in the very character and nature of the two communities– religious/ ethnic/ linguistic/ national. It is not just some people within the ‘enemy community’ who are the problem– but the entire community itself. Thus, Nazis made no distinction between the good and the bad Jews– the entire race was evil beyond redemption to the Nazis.৪
তিন
কম্যুনিস্টরা হল ফ্যাসিজমের মতাদর্শগত রেজিমেন্টেড শত্রু। সর্বদেশে, সর্বকালে। অবশ্য সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের নামে যখন প্রতিষ্ঠা পায় স্ট্যালিনীয় নির্যাতন, কিংবা তথাকথিত লাল সূর্যের ছটায় যখন রচিত হয় তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারের মতো নির্মম হত্যালীলা, কিংবা হাল আমলের কিম জনের শ্বাসরোধকারী উত্তর কোরিয়া, তখন কে ফ্যাসিস্ট আর কে কম্যুনিস্ট তা বুঝতে নতুন করে হিসেব কষতে হয়। যাইহোক, বাস্তবতা যা-ই বলুক না কেন দর্শনগতভাবে ফ্যাসিবাদ আর কম্যুনিজমের মধ্যে সতীনের সম্পর্ক। কথা হল, বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে কম্যুনিস্টদের শত্রু হিসেবে নিধন করতে মাঠে নেমে পড়ল রেজিমেন্টেড ফ্যাসিস্টরা, কিন্তু ইহুদি-বিদ্বেষের বীজ বুনতে প্রয়োজন হল বৃহত্তর সামাজিক পরিসরে সার্বিকভাবে ইহুদি-বিরোধী মানসিকতার চাষাবাদ। এই লোকমানস তৈরিতে সারা ইউরোপ জুড়ে চলতে লাগল ফ্যাসিস্ট শক্তির চূড়ান্ত তোড়জোড়: “The communists were the ideological enemies– the jews’ natural ones.”৫ বৃহত্তর জনমানসে ইহুদি আর কম্যুনিস্টদের শত্রু হিসেবে দেগে দেওয়ার এক প্রকল্প হাতে নেওয়া হল, যার প্রভাব গিয়ে পড়ল ইউরোপ পেরিয়ে ভারতের সংঘপরিবার তথা হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে, যারা শত্রু হিসেবে টার্গেট করল এ দেশের কম্যুনিস্ট এবং আরও যাঁরা মুক্তচিন্তার বাহক তাঁদেরকে। এই প্রবণতা চলছে আজও, যা গত দেড় দশকে আরও বেড়েছে। লেখক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিক্ষক, ছাত্র, কে নেই তাঁদের আক্রমণের তালিকায়? আক্রান্ত হলেন কালবুর্গি, পানসারে, গৌরী লঙ্কেশ, বিনায়ক সেন, উমর খালিদ, শারজিল ইমাম প্রমুখ।
এখানেই শেষ নয়, চূড়ান্ত ইতিহাস-বিকৃতিকে হাতিয়ার করে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিম আর অত্যাচারীকে সমার্থক হিসেবে দেগে দিতে লাগল। শুধু অত্যাচারী নয়, আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে ইদানীং বলা শুরু হয়েছে মুসলমান আর সন্ত্রাসবাদী সমার্থক। এ যেন চিহ্নিতকৃত শত্রুর প্রতি হিন্দুত্ববাদীদের সেঁটে দেওয়া একুশ শতকীয় রাবার স্ট্যাম্প। মূলত ১৯৯৩-এর মুম্বাই বিস্ফোরণের পর থেকে শুরু হওয়া এই প্রবণতা একুশ শতকের পর তীব্রতর হল বিশ্বজুড়ে তথাকথিত ইসলামি জেহাদিদের উৎপাত শুরু হলে। ঘোষিত শত্রু মুসলমানের প্রতি এই নেতিবাচক মানসিকতা তৈরিতে হিন্দুত্ববাদীদের শতাব্দী-ব্যাপী প্রচেষ্টা (যার শুরু ১৯১৩-তে সাভারকরের লেখা ‘হিন্দুত্ব’ প্রকাশিত হবার পর থেকে) কতটা সফল তার নমুনা তুলে ধরতে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি বয়ানই যথেষ্ট:
Who is the Indian Muslim? If one takes even cursory look at the television channels these days, he is a terrorist wanted for every other terror blast in the country. He is in close touch with Pakistan and the ISI and has extended links with Dubai. He is a wife beater. He is a rapist. He is anti-woman. He is uneducated, and over religious….৬
বলা বাহুল্য, এই মুসলিম-বিদ্বেষ সাম্প্রদায়িকতা (communalism) আর ফ্যাসিবাদ (fascism)-কে মিশিয়ে এ দেশে এক নতুনতর ফ্যাসিস্ট (neo-fascist) মনোবিকারের জন্ম দিয়েছে। আর সেই মনোবিকারের প্রত্যক্ষ শিকার মহম্মদ আখলাখ, পহেলু খান, জুনেইদ, নাসির প্রমুখ। সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’-এ প্রাণিত গোলওয়ালকরের লেখা ‘We or Our Nationhood Defined’(১৯৩৯) এবং ‘Bunch of Thoughts’(১৯৬৬)-এর প্রকাশ পর্যন্ত, এমনকি তার পর ১৯৯৩ পর্যন্তও দেশে সমগ্র মুসলমান জনগোষ্ঠীকে জাত-শত্রু হিসেবে দেখার এই অভিনব ফ্যাসিস্ট (neo-fascist) রীতি মূলত সংঘপরিবারের সক্রিয় সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এ দেশের তথাকথিত সেকুলার দলগুলির লাগাতার সংখ্যালঘু-তোষণ ও তাদেরকে ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহারের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের প্রতি এই মানসিকতাকে এমন স্তরে নিয়ে যেতে সক্ষম হল যে এই নেতিবাচক মানসিকতা ব্যাপকভাবে জনমানসে প্রোথিত হল। এমনকি, যারা তুলনামূলকভাবে অনেকটাই লিবারাল তারাও মুসলমান আর সন্ত্রাসবাদীকে সমার্থক না বললেও একটু নরমপন্থী ঢঙে একই কথা ঘুরিয়ে বলতে লাগল– ‘all Muslims are not terrorists but all terrorists are Muslims’.৭
সত্যি বলতে কী, স্বাধীনতার পর দীর্ঘ পঁচাত্তর বছরের বেশি সময় ধরে ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রের নিরন্তর অনুশীলনের পরেও গত দেড় দশকে এ দেশে ফ্যাসিস্ট মনোবিকার যেভাবে ভিন্নস্বরের কন্ঠরোধ করার চেষ্টা করেছে তা (সত্তরের দশকের জরুরি অবস্থাকে বাদ দিলে) এক কথায় নজিরবিহীন। সরকারি নীতির সমালোচনা করলেই তাকে দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়ার কদর্য প্রকল্পে যদি মুসলমান মুখ থাকে তাহলে তো কথাই নেই।
অবশ্য এর নেপথ্যে আরও একটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত কাজ করে। সেটি হল– ‘petro-dollar financed effort to purify Islam, to root out the local traditions and the folk elements’.৮ দেশজ লোককৃষ্টি ও যাপনরীতির বহুরৈখিক পরম্পরা থেকে বিচ্ছিন্ন করে সারা বিশ্ব জুড়ে এক ও অভিন্ন মুসলিম ‘উম্মাহ’ (যা ইসলামি যাপনের একমাত্রিকতায় বিশ্বাস করে) তৈরির এই আরবীয় চেষ্টা (যা এ দেশের মুসলিম মৌলবাদী শক্তিকে কাজে লাগায়) ভারতের বহুত্ববাদ ও সংস্কৃতিগত বিমিশ্রণের ধারাকে নষ্ট করতে চায়। আর এই প্রবণতা হিন্দুত্ববাদীদের সুবিধা করে দিয়েছে মুসলমানদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এ দেশকে হিন্দু ভারত বানানোর এজেন্ডা তৈরিতে।
আর ইতিহাস-বিকৃতির সুপরিকল্পিত প্রকল্প তো আছেই। কারণ, গোয়েবলসের তত্ত্ব (যা একটা মিথ্যেকে বার বার প্রচার করে সত্যি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়)-কে কাজে লাগিয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করে চিহ্নিত শত্রুর বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষেপানো ফ্যাদিবাদের এক উল্লেখযোগ্য হাতিয়ার। বাবরের ধর্মনিরপেক্ষ ওয়াশিয়েতনামা, আকবরের উদার ও সমন্বয়ী ‘সুল-ই-কুল’-এর সেকুলার পরম্পরা, সুফিদের ভক্তিবাদ, উদারতা ও সমন্বয়ী পরম্পরার অন্তঃস্রোত, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির চূড়ান্ত পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তার প্রসারে হুসেন শাহের শাসকোচিত অবদান– ইত্যাদি ইতিহাসের পাঠ্যক্রম থেকে সুপরিকল্পিতভাবে ছেঁটে দিয়ে মুসলমান শাসকদের শুধু অত্যাচারী ও বর্তমান ভারতের মুসলমান জনগোষ্ঠীকে অত্যাচারীর বংশধর হিসেবে গোয়েবলসীয় ঢঙে বার বার প্রচার করে এ ভারতকে de-muslimize করা হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিজমের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
চার
শুধু ভারত কিংবা ইজরায়েল নয়, ভারতের গর্ভ থেকে বেরিয়ে পাকিস্তান, এমনকি সম্প্রতি বাংলাদেশও মুক্ত নয় এই মারণ-প্রকল্প থেকে। ভারতে যেমন উগ্র হিন্দুত্ববাদী (যারা বর্ণহিন্দু হিসেবে বৈদিক তথা আর্য অস্মিতা নিয়ে গর্ব করে মনুবাদী ভারত চায়)-দের চোখে মুসলমান ছাড়াও দলিতরাও চিহ্নিত শত্রু, তেমনই পাকিস্তানে তথাকথিত খানদানি মুসলমান (‘আশরাফ’)-এর চোখে শুধু অমুসলিম নয়, আহমদিয়া ও কাদিয়ানি (যাঁদের পূর্বপুরুষেরা উপমহাদেশের হিন্দু ছিলেন এবং যাঁরা আজও অনেক দেশজ লোকাচার মানেন) মুসলমানরাও জাত-শত্রু। সম্প্রতি বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি এবং তাঁর বিতাড়নকে সে দেশের বিরাট অংশের মানুষ ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের পতন হিসেবে দেখছে। এই দেখাতে যেমন অনেকটাই সত্য আছে, তেমনি হাসিনা-পরবর্তী জমানায় অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে যেভাবে শত্রু হিসেবে চিহ্নিতকরণ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাকে কী বলা যাবে? সে আরও ভয়ংকর উগ্রতায় আচ্ছন্ন ফ্যাসিস্ট মনোবিকার নয় কি? এ যেন ভারতের হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট মনোবিকারেরই প্রতিরূপ। আসলে পৃথিবীর সমস্ত মৌলবাদী শক্তিই তাদের ফ্যাসিস্ট মানসিকতায় নিজেদের শত্রু চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে চোরে চোরে মাসতুতো ভাই– একে অপরের পরিপূরক। উপমহাদেশের ক্ষেত্রে এ কথা কতখানি সত্যি তা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে উভয় প্রকার মৌলবাদীদের তরফে কম্যুনিস্ট ও মুক্তচিন্তার মানুষদেরকে টার্গেট করা দেখলেই বোঝা যায়। গোলওয়ালকরের হিটলার-প্রীতির সঙ্গে অত্যাশ্চর্য মিল যায় জামাত-ই-ইসলামির প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা মাওদুদির ফ্যাসিবাদ-প্রীতি। মাওদুদি ১৯৩৪-এর ‘তরজমানুল কোরান’-এর ডিসেম্বর সংখ্যায় লিখছেন, ‘আজ আপনাদের সামনে জার্মানি ও ইতালির দৃষ্টান্ত মজুত রয়েছে। হিটলার ও মুসোলিনি যে বিরাট শক্তি অর্জন করেছে সমগ্র বিশ্বে তা আজ স্বীকৃত … এটা করতে পারত না যদি তারা নিজেদের নেতৃবৃন্দের কঠোর অনুগত না হত।’ শুধু তাই নয়, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির ককটেল বানিয়ে সেকুলার শক্তি ও তার অনুসারীদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিতকরণেও তাদের সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো। জামাত-ই-ইসলামির এক সময়ের প্রধান আবুল লাইস ইলাহি তাঁর ‘মসলা-ই-ইন্তিখিলাত’ বইতে লিখছেন: “We do not deny the value and worth of some of the slogans of Hindu Mahasava. For example, it is against secularism and supports the incorporation of religious ethical values in the political life of the people.”৯
পাঁচ
শত্রু চিহ্নিতকরণের এই ফ্যাসিবাদী প্রকল্প পর্বান্তরে রূপান্তরে গিলে ফেলছে আটলান্টিকের ওপারকেও। কীভাবে? এর উত্তর পেতে ফেরা যাক ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথায়, যাঁর প্রসঙ্গ টেনে শুরু করেছি এই আলোচনা। কোন অভিধায় ব্যক্ত করব এই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে? প্রেসিডেন্ট, রাষ্ট্রপ্রধান– এসব তো পোশাকি পদ মাত্র। ট্রাম্পের আসল পরিচয় হল, তিনি অতিদক্ষিণপন্থী আবহ পুনরুত্থানের হোতা। আর কে না জানে অতি-দক্ষিণপন্থা সমাজবিজ্ঞানীদের চোখে ‘generic fascism’ একটা গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন (‘matrix’)? যাইহোক, ট্রাম্পকে এই ছাঁচে ফেলার কারণটা অবশ্য তিনি ডেমোক্র্যাট নন বলে নয়। বরং কারণটা হল তিনি প্রকৃত অর্থে রিপাবলিকানও নন। অবাক হচ্ছেন শুনে? আসলে ট্রাম্প জমানার আগে আরও অনেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টকে আমেরিকা দেখেছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে এই তথাকথিত রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের দূরত্ব আলোকবর্ষ। হয়তো বা সেই কারণেই প্রাক্তন মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট Vicente Fox-কিঞ্চিৎ রসিকতা ও শ্লেষের সঙ্গে বলেন– “ What is Trump? He’s not a republican. Absolutely not. Those are not republican principles. He’s not a Democrat. He is just egocentric.”১০ বলা বাহুল্য, এই ‘egocentric’ কথাটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মনোবিকারের ধারণাটি। আর সেই কারণেই একজন রাষ্ট্রপ্রধান শুধু রাষ্ট্রপরিচালনাতে নয়, ব্যক্তিজীবনের পরিসরেও মুক্ত থাকেন না এই বিকারগ্রস্ত যাপনের অভিঘাত থেকে।
আসলে ট্রাম্প শেষপর্যন্ত হয়ে ওঠেন ফ্যাসিস্ট মনোবিকারের একটি প্রতীক মাত্র। অতিদক্ষিণপন্থী যে-কোনো রাষ্ট্রনেতার জীবনচর্যা তথা জীবনদর্শন এই বিকার থেকে মুক্ত নয়। এঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ঝোপ বুঝে কোপ মারতে এরা ভয়ংকর দক্ষ।
ট্রাম্প যেহেতু ব্যক্তিজীবনে ধুরন্ধর ব্যবসায়ী, তাই অর্থনৈতিক চালটি বেশ ভালোই বোঝেন। আর তারই প্রতিফলন আমেরিকার দক্ষিণ বরাবর মেক্সিকান অনুপ্রবেশ ঠেকাতে প্রাচীর তোলার মধ্যে অর্থনৈতিক বিষয়টি সুকৌশলে জুড়ে দেওয়া। ক্ষমতা দখলের জন্য নির্বাচনের আগে এই প্রাচীর নির্মাণের বিপুল খরচের ব্যাপারটা পরিষ্কার চাপিয়ে দিলেন মেক্সিকানদের উপর, কারণ হিসেবে বললেন যারা অনুপ্রবেশকারীদের উৎপাত ঠেকাতেই যেহেতু এই প্রাচীর সেহেতু তার খরচ বইতে হবে তাদেরই। এ যেন চোর ঠেকাতে বাড়ির তালা-চাবির ব্যয়ভার চোরের কাছেই দাবি করা। একেই বলে মাছের তেলে মাছ ভাজার বৈশ্যতান্ত্রিক কৌশল। কী বললেন তিনি? প্রথমেই আমারিকান সেন্টিমেন্টকে সুড়সুড়ি দিয়ে মেক্সিকানদের বলে দিলেন জাতশত্রু। মেক্সিকানদের প্রতি মার্কিন আধিপত্যবাদী মানসিকতা (যার সূত্রপাত ১৮৩২-এর মেক্সিকো-মার্কিন যুদ্ধের সময় থেকে) থেকে তিনি ভোটের রাজনীতির স্বার্থে আমেরিকানদের মেক্সিকো-বিদ্বেষ উসকে দিয়ে তাদেরকে দেগে দিলেন অনুপ্রবেশকারী, সমাজবিরোধী, এমনকি ধর্ষক হিসেবে। তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন: “The Mexican government is forcing their most unwanted people into the United States. They are, in many cases, criminals, drug dealers, rapists, etc.”১১ এ কথা ঠিক, যে কোনো দেশের অধিকার আছে অন্য দেশ থেকে আসা মানুষের অনুপ্রবেশকে রুখে দেবার বিদেশ নীতি নির্ধারণের। কিন্তু অধিকার নেই সেই দেশের মানুষকে সমাজবিরোধী, ধর্ষক হিসেবে দেগে এবার। যদি তা করা হয় তাহলে সেটা ফ্যাসিস্ট মনোবিকার, যা নগ্নরূপে দেখা গেল ট্রাম্পের নির্বাচনি ইস্তেহারে।
আসলে, যে আমেরিকা মুক্তচিন্তা ও গণতন্ত্রের অনুশীলনের জন্য অহংকার করে সেখানে ডেমোক্র্যাট বাইডেনের জমানাতেও পুঁজিবাদের পিঠে সওয়ার হয়ে নিরন্তর চলছে মুক্তচিন্তা ও প্রতিবাদের কন্ঠরোধ। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পর্যন্ত ছাড় পাচ্ছে না। গাজায় ইজরায়েলি সেনার মানব-নিধন যজ্ঞের বিরোধিতায় প্যালেস্তাইনের সমর্থনে সমস্ত প্রতিবাদ-মিছিলে যেভাবে পুলিশ হানা দিচ্ছে তা দেখে অনিকেত দে লিখছেন– ‘৯/১১-র পর থেকে মুসলমান গোষ্ঠী মানেই যে সন্ত্রাসবাদী, সেই কথাটা আমেরিকার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই প্যালেস্তাইনপন্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশি দাওয়াইটাই ঠিক বলে অনেকে মনে করেন।’১২ সত্যি বলতে কী, এই ‘অনেকে’-র মধ্যে যাঁরা পড়েন তাঁদের মতোই মুসলিম-বিদ্বেষী মানসিকতা ভারত সহ এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে। রবীন্দ্রনাথ আজ থেকে একশো বছর আগেও আমেরিকায় সংকীর্ণতা ও বর্ণবিদ্বেষী ফ্যাসিস্ট মনোবিকার দেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বহু অনুষ্ঠান বাতিল করে দেশে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। নেতানিয়াহুর গাজা-আক্রমণের পর মনে হচ্ছে ‘১৯২০-র দশকে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকার শিক্ষাঙ্গনে যে অসহিষ্ণুতা ও ক্ষুদ্রতা দেখে বিরক্ত হয়েছিলেন, ২০২০-র দশকে তা নতুন, বাজারি বর্ণবিদ্বেষ হয়ে ফিরে এসেছে।’১৩
ছয়
এ তো গেল আর্থ-রাজনৈতিক সমীকরণে বাঁধা বৃহত্তর সমাজব্যবস্থা অর্থাৎ macrocosm-এর পরিসরে শত্রু চিহ্নিতকরণের ছবি। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে microcosm অর্থাৎ সমাজের ক্ষুদ্রতম এককও এক্ষেত্রে বাদ যায় না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, আদালত ইত্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তথা ক্ষমতাবানের ফ্যাসিস্ট রক্তচক্ষু যেমন আছে, তেমনি আছে পারিবারিক পরিসরে ফ্যাসিস্ট স্বামী কিংবা তার বিপ্রতীপে ফ্যাসিস্ট স্ত্রী। দজ্জাল, হাড়জ্বালানে শাশুড়ি কিংবা শাশুড়ি-ননদের ফ্যাসিস্ট আঁতাতের উলটো দিকে আধুনিক নারীর তথাকথিত ক্ষমতায়নকে শিখণ্ডী করা ফ্যাসিস্ট বৌমার অত্যাচার– কী নেই?
যেটা লক্ষণীয় তা হল, বৌমা যখন সত্যি সত্যিই শাশুড়ি হন তখন তাঁর নির্যাতনের শিকার হন যে পুত্রবধূ, তিনি কোনোভাবেই দায়ী নন ওই শাশুড়ির বধুজীবনের নির্যাতনের জন্য। তা সত্বেও তিনি কেন তাঁর শাশুড়ির হাতে নির্যাতনের শিকার হন? ঠিক যে কারণে একজন উগ্র হিন্দুত্ববাদী মনে করেন বর্তমান ভারতের মুসলমান নিজে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী না হলেও সে বহিরাগত মুসলমান শাসকের বংশধর এবং ইসলামি যাপনরীতির অনুসারী, যা ভারতীয় কৃষ্টি ও যাপনের সঙ্গে যায় না। ভারতে জন্ম নিলেও অর্থাৎ ভারতকে ‘পিতৃভূমি’ মনে করলেও সে ‘পুণ্যভূমি’ হিসেবে মান্যতা দেয় মক্কা তথা সৌদি আরবকে। অর্থাৎ ‘তুই বেটা নিজে দায়ী না হলেও তোর চোদ্দোপুরুষ তো তো দায়ী’– এই গোছের বিকৃতি এই মানসিকতার মূলে।
এ যেন অনেকটা সেই বিকৃতি, যা থেকে জন্ম নেয় শাশুড়ি-ননদ আঁতাত এবং শাশুড়ি-বৌমা শত্রুতার প্যারাডাইম। এই প্যারাডাইম ফ্যাসিস্ট প্যারাডাইমের মতোই শাশুড়িকে তার শাশুড়ি সত্তা থেকে বের করে মমতাময়ী ‘মা’ করে তোলে নিজের মেয়ের বেলায়। আর এখানেই জন্ম নেয় চিহ্নিতকৃত শত্রু বৌমার বিপ্রতীপে শাশুড়ি-ননদ আঁতাত, যেখানে মা-মেয়ে নিজেদের কোনো দোষ দেখা তো দূরের কথা, দোষ যে তাদের থাকতে পারে সেটাই বিশ্বাস করে না। যত দোষের আকর হল বৌমা নামক ঘোষিত শত্রু। কারণ, বৌমা হল সেই ‘অপর’, যার ‘অপরত্ব’ জীবনব্যাপী চেষ্টাতেও ঘোচে না, কারণ (ফ্যাসিস্ট প্যারাডাইম অনুযায়ী) সে এসেছে ভিন্ন কৃষ্টি ও যাপনের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। সারাজীবন তাকে বাড়তি দায় নিয়ে প্রমাণ করে যেতে হয় শ্বশুর বাড়িটা তার নিজেরই বাড়ি, তবু তা তার নিজের বাড়ি না হয়ে বাপের বাড়ির বিপ্রতীপে স্বামী-শ্বশুরের বাড়িই থেকে যায়। এ যেন মনেপ্রাণে ভারতকে নিজের সত্তার স্বদেশ হিসেবে ভালোবেসেও ভারতীয় মুসলমান আজও হিন্দুদত্ববাদীদের চোখে শুধুই মুসলমান থেকে যাওয়ার প্রতিরূপ। দেশপ্রেমিক ভারতীয় মুসলমান হয়ে আজও সে বুঝতে পারল না– কতটা পথ পেরোলে তবে ভারতীয় হওয়া যায়। হিটলারের নাৎসি জার্মানিতে যেমন লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমিক ইহুদিরা বুঝতে পারেনি কোন জাদুতে ইহুদিত্ব অক্ষুন্ন রেখেও জার্মান হওয়া যায়, ঠিক তেমনি হাজার হাজার বৌমা (যারা প্রকৃত অর্থেই নীতিনিষ্ঠ) আজও বাপের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়ির ফ্যাসিস্ট সমীকরণের জাঁতাকলে ঘুরতে ঘুরতে খুঁজে পেলেন না তাঁদের নিজের বাড়ি।
সাত
আসলে মানুষের বিকৃত মনস্তত্ত্বের অন্ধকারময় জগতে জন্ম এই ফ্যাসিবাদের। আদৌ কাটবে এই ফ্যাসিবাদের অন্ধকার? মুক্তচিন্তা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নিরন্তর চর্চা এই অন্ধকারকে চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষমতা রাখলেও এই মনোবিকার পুরোপুরি কী শেষ হবার? প্রাকৃতিক নিয়মেই পৃথিবীর একপাশে যখন ঝলমলে আলো খেলা করে, তখনই অন্যপাশে অন্ধকার নামে। মানব মনস্তত্ত্ব এই আলো আর অন্ধকারের পারস্পরিক দ্বিত্বতা বা বৈপরীত্যের সহাবস্থানকে সঙ্গে নিয়ে চলা প্রাকৃতিক নিয়মেরই ক্ষুদ্রতম প্রতিরূপ (microscopic version)। আলো-আঁধারির এই রহস্যঘন স্বরূপ নিয়েই মানব মনস্তত্ত্ব। তাই গ্রিক শব্দ ‘fascio’ থেকে জন্ম নেওয়া ফ্যাসিবাদের পোশাকি পরিভাষা তথা ‘generic fascism’-এর বয়স খুব বেশিদিন না হলেও ফ্যাসিস্ট মনোবিকারের জন্ম সভ্যতার আদিকালেই। সমাজবিজ্ঞানীরা যতই বিংশ শতকের প্রথম ভাগের ইউরোপ তথা বিশ্ব-রাজনীতির প্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে মুসোলিনির ইতালি ও হিটলারের জার্মানিকে হাতে গরম রেফারেন্স হিসেবে সামনে এনে ফ্যাসিবাদের কিছু বৈশিষ্ট্য (‘matrix’)- নিয়ে একটা ‘genric fascism’-এর সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করুন, এ কথা মানতেই হবে– ‘fascism is a phenomenon of the past since those exact historical material conditions no longer obtain nor can come into existence once again.’১৪ অর্থাৎ, যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকে মনে রেখে ‘generic fascism’-এর সংজ্ঞা দেওয়া হয় সেই প্রেক্ষিতের হুবহু পুনরাবৃত্তি না হলেও সভ্যতার আদিকাল থেকেই ফ্যাসিস্ট মনোবিকার নানারূপে আছে, এবং থেকে যাবে।
এদিক থেকে দেখতে গেলে ফ্যাসিজম হল একপ্রকার ‘aberration, a pathological abnormal occurrence’১৫– একটা বিকারগ্রস্ত মানসিকতা। যেহেতু শুভ-অশুভ কোনো শক্তির ডিএনএ-ই আকাশ থেকে পড়েনি, সবটাই এই মাটির বাস্তব, তাই সভ্যতার আদিকাল থেকে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিতেই ছড়িয়ে আছে উভয় প্রকার জিন। পরিবেশ-পরিস্থিতি তাকে বাড়তে সুযোগ দেয় মাত্র। সেই সুযোগের জন্য তারা অপেক্ষা করে, সুযোগ পেলেই মাথা তোলে। বিশেষত অশুভ শক্তির জিন (যা পর্বান্তরে রূপান্তরে হয়ে ওঠে ফ্যাসিস্ট) যে-কোনো সুযোগকে কাজে লাগাতে অপেক্ষাকৃত বেশি দক্ষ। অনেকটা বাগান বা খেতের আগাছার মতো, উপকারী ও প্রয়োজনীয় চারা গাছের তুলনায় অনেক কম অনুকূল পরিস্থিতিতেও এদের লাগামছাড়া বাড়বাড়ন্ত। এই অনভিপ্রেত আগাছার মতোই যুগে যুগে বংশবিস্তার করে স্বৈরাচারী মানসিকতা– জন্ম নেন মুসোলিনি, হিটলার, ট্রাম্প, কিংবা কিমের মতো স্বৈরশাসক। নানা স্থানে, নানা কালে, নানানামে, নানারূপে। পর্বান্তরে রূপান্তরে।
তাই মানব মনস্তত্ত্বের আলো-আঁধারি বাস্তবতাকে সাক্ষী রেখে বলা যায়, প্রকৃতিগতভাবে ফ্যাসিবাদ যদি হয় ক্ষমতার ঔদ্ধত্যপূর্ণ উদগ্র আস্ফালন তথা এক অসুস্থ মনোবিকার, যদি হয় উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার স্বৈরাচারী প্রকল্প, যদি হয় ভিন্নমত ও ভিন্নস্বরের টুঁটি টিপে যে কোনো মূল্যে, এমনকি প্রাণঘাতী হলোকাস্ট বানিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে শুধু ধর্মীয় পরিচিতিতে ভিন্ন হওয়ার অপরাধে নির্মমভাবে নিধন করে নিজের তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করে নিজের মর্জিমতো খবরদারিকেই একমাত্র অভীষ্ট ভাবার অতি-দক্ষিণপন্থী অবস্থান, তাহলে তা micro level কিংবা macro level-এর পরোয়া করে না, তার ভীতিপ্রদ, সদর্প উপস্থিতি ঘরে-বাইরে সর্বত্র। এবং ঘরে-বাইরে শত্রুচিহ্নিত করার বিকৃত প্রকল্পকে সঙ্গে নিয়েই তার দর্প, তার অহং। আর এই মনোবিকার, এই দম্ভ, এই অহংকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে একমাত্র মুক্তচিন্তা ও তার সম্যক চর্চা, যার প্রয়োজনীয়তা সর্বকালে, সর্বদেশে নিরন্তর জারি রাখা মুক্তচিন্তকদের প্রথম ও প্রধানতম দায়িত্ব।
উল্লেখপঞ্জি:
১) abcnews.go.com, Morgan Winsor, Agust, 31, 2016
২)Sandeep Pendse, ‘Fascism & Communalism Consideration’, Centre for Education & Documentation, Mumbai & Bangalore, 2007, p.100
৩) Ibid, p.101
৪) Ibid, pp.98-99
৫) Ibid, p.101
৬) Ibid, p.104
৭) Ibid, p.104
৮) Ibid, p.104
৯) Ibid, p. শেখ সাইদুল হক, ‘মুসলিম মৌলবাদ ও মুসলিম জনমানস’, দীপ প্রকাশন, পৃ: ৭ থেকে নেওয়া উদ্ধৃতি
১০) abcnews.go.com, Morgan Winsor, August, 23, 2016
১১) Ibid
১২) অনিকেত দে, ‘উত্তর সম্পাদকীয়’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
১৩) প্রাগুক্ত
১৪) Sandeep Pendse, Ibid, p. 96
১৫) Ibid, p. 96