মনস্তত্ত্বের আলোয় ফ্যাসিবাদ

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

কালের যাত্রাপথে মানবসভ্যতা প্রগতির পথেই এগিয়ে চলেছে জানি, কিন্তু ঐতিহাসিক যুগে পৃথিবীর দেশে দেশে ফ্যাসিবাদ ও তার গণহত্যার যে বিপুল নৃশংস নিদর্শন আমাদের পেরিয়ে আসতে হয়েছে তাতে বিস্ময় জাগে– মানুষ কি তাহলে প্রাণীর থেকে এতটুকু কম হিংস্র নয়! বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি বিবেচিত না হলে সভ্যতা কি তাহলে একবিন্দুও অগ্রসর হয়নি! ইতিহাসের বুকে মানব হৃদয় দ্বারা এমন নৃশংসতা কীভাবেই বা সম্ভব হল? দেখা যাচ্ছে ইতিহাসের সমস্ত ফ্যাসিবাদ ও একনায়কতন্ত্রের মূলেই রয়েছে ক্ষমতা ও আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা। ব্যক্তির ক্ষমতা যখন সম্মিলিতভাবে গোষ্ঠী বা জাতির ক্ষমতায় পরিণত, তখন ব্যক্তি গোষ্ঠী বা জাতির আধিপত্যের মধ্যে নিজেরই আধিপত্য খুঁজে পায়। তখনই মাথা তোলে ফ্যাসিবাদী শাসন, পেছনে পেছনে ঘটে যায় গণহত্যাও। সমগ্র বিংশ শতাব্দী জুড়ে তাই পৃথিবীতে গণহত্যায় প্রাণ হারায় প্রায় ১০ কোটি মানুষ। যার প্রায় অর্ধেক ঘটে ফ্যাসিবাদী শাসনে। তখন মনে হয় সূর্যের সোনালি আলোয় আলোকিত হয়ে নীল-সবুজে ঘেরা এই অপূর্ব পৃথিবী শুধু ভালোবাসা নয়, হিংসার নৃশংস বাসনাকেও বহন করে চলেছে পাশে পাশে, সূর্যকে প্রদক্ষিণের পথে।

ফ্যাসিবাদের জন্ম

যদিও ফ্যাসিবাদের প্রথম প্রকাশ ১৯২২ সালে ইউরোপের মাটিতে, ইতালির মুসোলিনি ও জার্মানির হিটলারের শাসনে। কিন্তু এর মনস্তাত্ত্বিক পটভূমি গড়ে উঠতে থাকে মানুষের চিরন্তন ক্ষমতা ও আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা থেকে উৎসারিত সেই প্রাচীন যুগের একনায়কতান্ত্রিক শাসন ও গণহত্যার পথে। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের বিশ্বজয়, মোগল শাসক চেঙ্গিস খাঁ-এর পৃথিবীর অধিপতি হওয়া ও ইউরোপের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বজয় ও গণহত্যায় আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা মানুষকে ইতিহাসের পথে ক্রমাগত ক্ষমতার গৌরবের দিকে নিয়ে গেছে। সেই গৌরবই পূর্ণতা পেতে চেয়েছে ইতিহাসের ফ্যাসিবাদী শাসনে।

ফ্যাসিবাদের পূর্ব শর্ত: উগ্র জাতীয়তাবাদ

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে ফরাসি বিপ্লবের পর আধুনিক জাতিরাষ্ট্র (Nation State) গঠনে রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের দিকে পদক্ষেপের শুরু। জাতির সাথে একাত্মতায় জন্ম নিল জাতীয়তাবাদ। জাতির ভেতরে শাসকের বিরুদ্ধে চেতনা জাগলেও জন্ম নিল উগ্র জাতীয়তাবাদ। সেখান থেকে উৎসারিত হল জাতি শ্রেষ্ঠত্বের আকাঙ্ক্ষা তথা অন্য জাতির উপর আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষার পিছনে অজুহাত হিসেবে কাজ করল অনুন্নত অসভ্য জাতিকে সভ্য করে অথবা হত্যা করে পৃথিবীতে বিশুদ্ধ করে তোলা। সেই আকাঙ্ক্ষা আর যুক্তির নীচে মানব মনের কল্যাণকামী সত্তা চাপা পড়ে মৃতপ্রায় হয়ে যেতে থাকল। শিল্প বিপ্লবে আরও উন্নত যুদ্ধ সম্ভারে সজ্জিত হয়ে ইউরোপের জাতিরাষ্ট্রগুলি– ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ, ডাচ, জার্মান ও ইতালীয়রা খ্রিস্টান ধর্মের মুখোশে বাইবেলের স্বর্গীয় বাণীর নামে সম্পদ লুঠ ও গণহত্যার পথে সারা বিশ্বে সাম্রাজ্য বিস্তারে নামল। দীর্ঘকালব্যাপী এই সাম্রাজ্যবাদী সত্তাই ফ্যাসিবাদের মনোসাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটটি গড়ে তুলেছিল।

ইউরোপে ফ্যাসিবাদের প্রস্তুতি চলছিল। যখন রেনেসাঁস, রিফর্মেশনের যুগে শিল্প বিপ্লবের দৌলতে জনসাধারণ মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারে সোচ্চার হতে লাগল, অন্যের ধর্ম ও মতবাদের প্রতি সহনশীলতা যখন মর্যাদা পেতে লাগল, তখন পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে পুঁজিবাদ বুঝল– রাষ্ট্রের হাতে আরও ক্ষমতা না থাকলে শিল্পায়ন, বাণিজ্য-প্রসার সম্ভব নয়। অন্যদিকে মার্কসবাদের প্রভাবে শ্রেণি জাগরণের ফলে শ্রেণি দ্বন্দ্ব তীব্র হতে থাকল। শ্রেণিগত মনস্তাত্ত্বিক ভূমিতে দাঁড়িয়ে দার্শনিক ও চিন্তাবিদরা পুঁজিবাদের সমর্থনে মার্কসবাদ ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলেন। দার্শনিক নিৎসে বুঝলেন– বিপ্লবকে বাধা দেওয়ার শক্তি উদার ও বুর্জোয়া নীতিবাদে নেই। তাঁর দর্শন যুক্তিবাদ ও কার্যকারণবাদকে অগ্রাহ্য করে স্বতঃস্ফূর্ততাকে সামনে নিয়ে এল। বাঁর্গস তাঁর ভাববাদী দর্শনকে সামনে নিয়ে এলেন– “ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত শ্রেণির দুর্বলতর শ্রেণিকে শাসন ও শোষণ– এটি প্রকৃতির নিত্য সত্য!” বাঁর্গস-এর দর্শন ঔপনিবেশিক গণহত্যার পেছনে যে যুক্তি, তারই পুনরাবৃত্তি।

পুঁজিবাদ যে মানবিকতার কথা বলে, তা শ্রেণি-নিরপেক্ষ কখনোই নয়, ফলে স্পিংলার-এর ভাষ্যও একই তারে বাঁধা– “যুদ্ধ অস্তিত্ব রক্ষার ও মানবতা বিকাশের শ্রেষ্ঠতম পন্থা।” তাঁদের এই ভয়ংকর অমানবিক তত্ত্বই ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থানের দার্শনিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করল। হিটলার-মুসোলিনি উইলিয়াম জেমস-এর ভাষ্যেরই প্রতিধ্বনি করলেন– সত্যাসত্য নির্ণয় অসম্ভব। বাস্তব সত্য বিচারের পদ্ধতি আমাদের অনায়ত্ত। সুতরাং যা আমরা সত্য বলে বিশ্বাস করি, তাই সত্য। বিশ্বাস সত্য ঘটনা তৈরি করতে পারে। পরশ্রীকাতরতা, অর্থলোভ, যুদ্ধ শিল্প, নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতা ইত্যাদি সবই মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এগুলি বুর্জোয়া সভ্যতার বিশেষ ধর্ম নয়। মানবপ্রকৃতি অপরিবর্তনীয়, সমাজ বদলালেও মানুষ বদলাবে না। উইলিয়াম জেমস্‌কে অনুসরণ করে হিটলার-মুসোলিনির একই ভাষ্য– সাফল্য লাভের প্রধান বাধা অন্য মত, অন্য দল, অন্য ধর্ম। এক দেশ, এক নেতা, এক পথ, এক মত– এই প্রচারে চারশো বছরের উদারনীতিবাদ ভেঙে পড়ল। জাতির আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষার ভেতরে আশ্রয় পেল সংকটাপন্ন জাতি। অন্যকে অধিকার করে ভেতরের শূন্যতাকে পূর্ণ করল। একনায়কের দম্ভের ভেতরে জাতির পুনর্বাসন ঘটল।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার যে সংকট, উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রেখে সেই সমস্যা সমাধানের অক্ষমতা থেকেই শাসকের ফ্যাসিবাদী চরিত্র গড়ে ওঠে। আর্থিক মন্দার যুগেই জার্মানি, ইতালি ও স্পেনে ধনতন্ত্রের সংকট ঘিরে ফ্যাসিবাদের প্রকাশ্য অভ্যুত্থান। ধর্ম ও ফ্যাসিবাদ সব সময় হাত ধরাধরি করে চলে। দুজনেই চায় প্রশ্নহীন আনুগত্য। অবতারবাদ, নিয়তিবাদে আক্রান্ত মানুষ ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করে না। বরং একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠে।

ফ্যাসিবাদ কী?

ফ্যাসিবাদকে সংজ্ঞায়িত করতে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যকরী ত্রয়োদশ প্লেনামে বলা হয়– “ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদ হল লগ্নিপুঁজির তরফে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল সবচেয়ে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ এবং সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী অংশের সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব।” জর্জ ডিমিট্রভের ভাষায়– “ফ্যাসিবাদ হল শ্রমজীবী জনতার উপর পুঁজির হিংস্রতম আক্রমণ, ফ্যাসিবাদ নিরঙ্কুশ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ আর পররাজ্য হরণের যুদ্ধ, ফ্যাসিবাদ জঘন্যতম প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবিপ্লব। ফ্যাসিবাদ হল শ্রমিক শ্রেণি ও প্রতিটি মেহনতি মানুষের ক্রূরতম শত্রু।” ফ্যাসিবাদের অন্যতম উপাদান তার একনায়কত্বের ধারণা এবং সন্ত্রাস। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের সম্পর্ক সেই অর্থে বিরোধিতার নয়। কারণ পুঁজিবাদের সংকটে বুর্জোয়া শাসককে রক্ষা করতে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব।

মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দুঃসহ অর্থনৈতিক সংকটে ইতালীয় সোশ্যালিস্ট পার্টি যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিলে ওই পার্টিরই সদস্য মুসোলিনি নিজ উদ্যোগে ফ্যাসিস্ট পার্টি গঠন করেন (১৯১৫)। এই ফ্যাসিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছিল দেশীয় পুঁজিপতি ও ভূস্বামীদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায়। এই পার্টি অভিজাত সম্প্রদায়ের শাসনকে স্বীকৃতি দেয় এবং বামপন্থী ও মার্কসবাদীরা শত্রু হয়ে ওঠে। এরপর খুনে ব্ল্যাকসার্ট বাহিনী গ্রাম-শহরে বামপন্থীদের হত্যা শুরু করে। শ্রমিক ইউনিয়ন অফিসগুলি রাতের অন্ধকারে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক হতাশাকে অতিক্রম করে যেতে জাতির গৌরব উজ্জ্বলতার কাল্পনিক ছবি তুলে ধরে জাতিকে ফ্যাসিবাদে মোহাচ্ছন্ন করে তুলতে থাকেন। মুসোলিনি বলেন– “ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে… বিশুদ্ধ আর্য জাতির ভূমধ্যসাগরীয় শাখার সুগভীর চিরন্তন প্রয়োজন থেকে।” এভাবেই ফ্যাসিস্টরা নিজেদের ‘আকাঙ্ক্ষা’কে ‘প্রয়োজন’-এ দাঁড় করায়। এভাবে উগ্রজাতীয়তাবাদকে সম্বল করে ইতালীয় জনগণকে আর্থিক সংকট থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুসোলিনি নিয়ন্ত্রণবাদী (tolalitarian) রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করেন। যেখানে বিরোধী দলের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। ন্যূনতম সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে গণ্য করা হত। তিনি জাতীয়তাবাদের প্রচারে শ্রমিকদের মন থেকে শ্রেণি সংগ্রামের আদর্শ উৎপাটিত করে ইতালীয় বুর্জোয়াদের সাথে মিলিত হয়ে জাতীয় গৌরবের জন্য সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে শ্রমিকদের প্ররোচিত করেন। শ্রমিক বিপ্লবে আতঙ্কিত বুর্জোয়াদের পক্ষে ফ্যাসিস্টরা স্বর্গের দূত রূপে দেখা দিল।

হিটলারের নাৎসিবাদ

বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে গোটা পৃথিবীর পুঁজিবাদের যখন নাভিঃশ্বাস উঠছে, শ্রমিক বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ছে নানা দেশে, যখন বুর্জোয়া লিবারেলিজিম দ্বারা পুঁজিবাদকে বাঁচানোর কাল গত, তখন লিবারেলিজম আর ডেমোক্র্যাসির মুখোশ খুলে ফেলে জার্মানিতে বাজার দখলে নেমে পড়ল পুঁজিবাদ তার সন্ত্রাস নিয়ে। জাতীয়তাবাদের নেতা হিসেবে হিটলারকে শিখণ্ডী খাঁড়া করল জার্মানির ক্যাপিট্যালিস্টরা। ‘নাৎসি পার্টি’ গড়ে উঠল হিটলারের নেতৃত্বে। ১৯৩৩-এ জার্মানিতে তৈরি হল ‘গেস্টাপো’ বাহিনী। নাৎসিদের নিজস্ব গুপ্ত পুলিশ বাহিনী। তারা সোশ্যালিস্ট সেজে শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দখল করে শ্রমিকদের শ্রেণি স্বার্থকে প্রতারণা করল জনগণের উপর বলগাহীন শোষণ কায়েম করে। লুণ্ঠনকারী বুর্জোয়া, ব্যাংক ট্রাস্ট ও ধনকুবেরদের বিরুদ্ধে মেহনতি জনগণের তীব্র ঘৃণা নিয়ে ফ্যাসিবাদ অতি সুকৌশলে পুঁজিবাদ বিরোধী বুলি কপচিয়ে, জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়ে তাদের চিত্ত জয় করে। তাদের স্লোগান এমন ছিল– “ব্যক্তিগত মঙ্গলের চেয়ে সাধারণ মঙ্গল অনেক ঊর্ধ্বে।” যেমন মুসোলিনির স্লোগান ছিল– “আমাদের রাষ্ট্র ধনতান্ত্রিক নয়, বরং এক যৌথ রাষ্ট্র।” জনতার ভক্তিবাদের উচ্ছ্বাসে হিটলার অবতার হয়ে উঠলেন। বিনা দ্বিধায় পার্লামেন্টের অনুমোদন নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের হত্যা করলেন। তাঁর লক্ষ্য হয়ে উঠল– ‘ঈশ্বরের জার্মান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা’। স্যোমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় পাই–

ফ্যাসিবাদ জনগণকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এই কারণে যে, জনগণের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন ও দাবিগুলির কাছে সে মহাবাগাড়ম্বর আবেদন করে। …জার্মান ফ্যাসিবাদীরা যারা বড়ো বড়ো বুর্জোয়াদের সেবাদাস ও সমাজতন্ত্রের মারাত্মক শত্রু, তারা জনগণের কাছে নিজেদের সমাজবাদী বলে পরিচয় দেয় এবং তাদের ক্ষমতা দখলকে বিপ্লব বলে বর্ণনা করে। কারণ জার্মানির অগণিত মেহনতি জনগণের সমাজতন্ত্রের যে আকাঙ্ক্ষা এবং বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাস, তাকেই কাজে লাগাবার চেষ্টা করে।

ভারতে হিন্দু ফ্যাসিবাদ

জার্মানিতে নাৎসিরা ইহুদিদের যেভাবে বিশেষভাবে চিহ্নিত করত, সফল গণহত্যার লক্ষ্যে, তেমনি ভারতে হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবারের আদর্শে চালিত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মুসলিম পরিবারগুলিকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি হরিদ্বারে ধর্ম সংসদে হিন্দু ধর্মের স্বঘোষিত অভিভাবকেরা তাঁদের কল্পিত হিন্দুরাষ্ট্রের বাস্তবায়নে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে নিকেশ করার ফতোয়া দিয়েছেন। তাঁরা যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান ও ইতিহাস চেতনা এবং গণতন্ত্র বিরোধী। তাঁরা প্রকাশ্যেই একনায়কতন্ত্রের প্রবক্তা। তাই তাঁরা কোনও বিরুদ্ধ স্বর সহ্য করতে পারেন না। তাই আজ বহু প্রতিবাদী লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী আজ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। একনায়কতন্ত্রের ভেতরে যে ঘনীভূত ক্ষমতা, তার ভাগীদার হতে পারে সমস্ত অনুগামীরাই। তাই ক্ষমতা ভোগের সুরক্ষার প্রশ্নে গণতন্ত্রের প্রতি এঁদের ভয়। বিজ্ঞানমনস্কতাকে ভয়, প্রশ্ন করাকে এঁদের ভয়। এঁরা চায় প্রশ্নহীন আনুগত্য। ভারতবর্ষের ভাষা, সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যকে এঁরা অস্বীকার করে ঘোষণা করেন– “People of a country become a nation ones when they are unified by one culture.” ফ্যাসিবাদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সমালোচনা দেশদ্রোহিতা। দেশদ্রোহী কথাটি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ মানুষকে করে ক্ষুব্ধ। এভাবে অন্য গোষ্ঠীর মানুষকে দ্রুত জাতীয় সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষ্য–

Selective behaviour is harmful for democracy. Some try to dert the Country’s image in the name of human rights, looking at human right with an eye on political gains and loss harms these right as well as democracy.

হিটলার-মুসোলিনির পথেই ভারতের হিন্দু মৌলবাদ নিজেদের আর্য শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে নিম্নবর্ণের অনার্যদের থেকে নিজেদের পৃথক করে তাদের শাসক হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষায় বিকৃত ইতিহাসকে সামনে এনেছে। গোলওয়ালকারের ভাষায়– ভারতবর্ষই আর্যদের আদি বাসস্থান। ভারত থেকে তারা বিশ্বের নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্ম, মনুবাদী দর্শন, গীতা রচনা করে হিন্দু ধর্মের দেবদেবীর মুখ দিয়ে তা বলিয়ে নিম্ন বর্ণের মানুষকে ধর্মের নামে পায়ের নীচে রাখবার চেষ্টা হিটলারের ইহুদি নির্যাতনেরই সমতুল্য। যুগ যুগ ধরে মনুসংহিতা ও গীতার মাধ্যমে এগুলির অভ্রান্ততার ধারণা আসলে দেবতার নামে সাধারণ মানুষের যুগযুগ ব্যাপী এক গণসম্মোহিত অবস্থা।

দ্য ন্যুরেমবার্গ মাইন্ড

‘দ্য ন্যুরেমবার্গ মাইন্ড’ গ্রন্থে লেখকদ্বয়ের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নেতৃত্বের কয়েকজনের মনঃসমীক্ষণ দ্বারা যুদ্ধের ও বন্দিশিবিরের নৃশংসতার কারণকে রহস্যময় ব্যক্তিমনের বিচার তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যার যে প্রয়াস, তা সম্পূর্ণ দুর্বল ও হাস্যকর। এটা আসলে বিশেষ এক সমাজ ব্যবস্থার গলদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া। এঁরা একদলের মধ্যে পেয়েছেন বর্বরতা, হিংস্রতা; স্থূল-নগ্ন-প্রত্যক্ষভাবে। অন্যদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন দ্বারা বিধিবদ্ধ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ক্ষমতালিপ্সু মনোভাব। গ্রন্থকারদ্বয়ের মতে এই বৈশিষ্ট্যগুলিই নাকি ফ্যাসিবাদের জন্য দায়ী। কিন্তু তাঁরা যে বৈশিষ্ট্যগুলি খুঁজে পেয়েছেন তা কম-বেশি সব মানুষের মধ্যেই জন্মগত বৈশিষ্ট্য হিসেবে উপস্থিত। সভ্যতার যাত্রাপথে সামাজিক অনুকূলতা বা প্রতিকূলতায় বিকশিত হয়ে ওঠে গুণগুলি। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বৈষম্য বিকশিত করে হিংসা, ক্ষোভ ও প্রতিযোগিতাকে। অন্যদিকে সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সহমর্মিতা বিকাশ ঘটায় মানবিকতা, সুকুমার শিল্প ও সংস্কৃতিবোধের। পণ্যসর্বস্ব প্রতিযোগিতামূলক সমাজে প্রতিটি ব্যক্তির মনে চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান ও অতৃপ্তি উৎসারিত হয় গণবিক্ষোভ, গণহিংসায়। নিরীহ দুর্বল মানুষও গণহিংসার ধ্বংসাত্মক উন্মাদনায় মেতে ওঠে। সাময়িকভাবে নিজেকে শক্তিমান ভেবে তৃপ্তি পায়।

ফ্যাসিবাদ ও গণহত্যার মনস্তত্ত্ব

পৃথিবীর সব যুগে সব দেশে মানুষের মধ্যে ফ্যাসিবাদের বীজ মনের গভীরে থাকে ক্ষমতা ও আধিপত্যের বাসনা হয়ে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যেমন দারিদ্র্য, অসাম্য, প্রতিযোগিতার পরিবেশ, পরাধীনতা উসকে দেয় ক্ষমতার লোভ অথবা বিপরীতে প্রতিবাদ প্রতিরোধ সাম্য ও গণতন্ত্রের বোধ। মনস্তত্ত্বের যে ধাপগুলি বেয়ে মানুষ এমন নৃশংসতার রক্তাক্ত রাজ্যে পৌঁছে যেতে পারে, তা নিয়ে আলোচনায় আসতে মানুষের প্রজাতিগত প্রবৃত্তি বা Instinct-এর আলোচনাতে যেতে হয়। প্রাণীর সমস্ত প্রবৃত্তিই মানুষ ধারণ করে তার নিম্নমস্তিষ্ক বা Limbic কর্টেক্স-এ। এই Instinct-গুলি বা unconditioned reflex-গুলির আরও উন্নত নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে অভিভাবক রূপে গড়ে উঠেছে উচ্চ মস্তিষ্ক বা Neocortex, যা মানবপ্রজাতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই মস্তিষ্ক দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, উচিত-অনুচিত, সততা-অসততা, মানবিকতার বোধকে ধারণ করে রাখে। এই দ্বান্দ্বিক মহাবিশ্বে মানব মস্তিষ্কও বহন করছে একদিকে কল্যাণকামী ও জাতির সাথে একাত্মবোধের সত্তা, বিপরীতে ধ্বংসাত্মক, আক্রমণাত্মক ও প্রতিযোগী প্রবৃত্তি। বন্য হিংস্র প্রাণী যেমন বাঘ বা সিংহ হরিণ শাবককে হত্যা ও ভক্ষণ করে এসে নিজের শাবককে আদর করে, তার সাথে খেলা করে। যে সৈন্য বন্দিশিবিরে শিশুর পেট ফালাফালা করে দেয় বেয়নেটে, সে-ই বাড়ি ফিরে পিতা হয়ে গিয়ে নিজ সন্তানকে কোলে তুলে নেয়। এই বৈপরীত্য দ্বান্দ্বিক বিশ্বেরই চিরন্তন সত্য।

তাহলে হিংসা আর ভালোবাসা, আক্রমণ আর রক্ষার এই দ্বান্দ্বিক মন নিয়ে মানুষ কখন প্রধানত হিংস্র আচরণ করবে, আধিপত্যকে ভালো লাগবে, আবার কখন সাম্যতার দিক ঝুঁকবে, অন্যের কল্যাণে নিজেকে খুঁজে পেয়ে অন্যের সাথে আত্মবৎ হবে; কখন কোন সভ্যতা কল্যাণকামী হয়ে উঠবে, আর কখন সে ফ্যাসিবাদের ঘোর সমর্থক হয়ে উঠবে– এ-সবই নির্ধারিত হয় উচ্চ মস্তিষ্ক বা নিওকর্টেক্স দ্বারা। পরিবার, সমাজ, পরিবেশ নতুন নতুন শর্তাধীন পরাবর্তের মাধ্যমে লঘু মস্তিষ্কের কোন শর্তহীন পরাবর্ত (Instinct)-গুলিকে উদ্দীপিত অথবা নিস্তেজিত করে কোনও একটিকে প্রধান করে তুলবে, তা নির্ভর করে আর্থ-সমাজ-রাজনৈতিক পরিবেশের উপর। সেভাবেই নির্ধারিত হয় ব্যক্তির প্রকাশিত আচরণ ও প্রবণতা। এভাবেই ইতিহাসে জন্ম নেয় ফ্যাসিবাদ, গণহত্যা, একনায়কতন্ত্র; অন্যদিকে প্রজাবৎসল রাজা, মানবিক ও সহযোগী ব্যক্তিত্ব। নতুন নতুন শর্তাধীন পরাবর্তের মধ্যে দিয়ে নিওকর্টেক্স যেসব বোধ ও উপলব্ধি গড়ে তোলে, তা যুক্তি-বিশ্লেষণ ছাড়াও সম্মোহন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আবেগগতভাবেও গড়ে তোলা যায়। ইতিহাসে ফ্যাসিবাদ, গণহত্যা ও একনায়কতন্ত্রের পিছনে কোনও একটি বোধ বা উপলব্ধির গণসম্মোহন ঘটে যায়। জাতির সুরক্ষার মধ্যে ব্যক্তি নিজের সুরক্ষা খুঁজে পায়। জাতির বিপন্নতায় নিজের বিপন্নতা দেখতে পায়। জাতির আধিপত্যে নিজের আধিপত্য খুঁজে পায়। ফ্যাসিবাদের সমর্থক নিজ জাতির আধিপত্যে নিজেকে ক্ষমতাবান ভাবতে পারে। দাঙ্গার পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষকে ক্রমাগত শত্রু মনে হতে থাকে। শত্রুপক্ষকে নিরপেক্ষভাবে মানুষ হিসেবে বিচার করার ক্ষমতা তলিয়ে যায় সম্মোহিত উপলব্ধির তলায়। নিরপেক্ষ বিচার বোধ চলে যায় মস্তিষ্কের নিস্তেজনার অঞ্চলে। জেগে থাকে শুধু প্রকট জাত্যভিমানের আবেগ। সেই একমাত্রিক দ্বন্দ্বহীন আবেগে ঘটিয়ে যায় একের পর এক হত্যা। তাতে কোনও অপরাধবোধ থাকে না, বরং নিজ জাতির স্বার্থ ‘ত্যাগ’ হয়ে দাঁড়ায়। অস্তিত্ব সুরক্ষিত হয়। প্রতিহিংসা চরিতার্থ হয় আবার ক্ষমতার তৃপ্তিও পাওয়া যায়।

মানুষের যত আদি প্রবৃত্তি, তার কেন্দ্রে আছে অস্তিত্ব বোধ, (Refex of existence)। এই অস্তিত্ববোধ ক্রমাগত সুরক্ষিত ও উজ্জ্বল হয়ে উঠতে চায়। তারই পথ ধরে গড়ে ওঠে খ্যাতি, ক্ষমতা, স্বীকৃতি ও আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা। গোষ্ঠীর সাথে একাত্মতায় গোষ্ঠীর আধিপত্যের অংশীদার হয়ে যায়। সেখান থেকেই জন্ম নেয় উগ্র জাতীয়তাবাদ, সেখান থেকে ফ্যাসিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদ। এই অস্তিত্বের প্রকটতা নিহিত যখন আধিপত্যে, তখন সেই আকাঙ্ক্ষাকে নিজের আর এক বিবেচক সত্তার কাছে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে মনেরই ভিতরে প্রতিপক্ষকে হীন, ঘৃণ্য, অসভ্য জাতি হিসেবে গণ্য করা (Dehumanitigation)। আর তাই তাদের উপর আধিপত্য অথবা তাদের হত্যা করে পৃথিবীকে কলুষ মুক্ত করে তোলা নিজেরই কাছে যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। জার্মানি ও ইতালির পুঁজিবাদ তাদের পুঁজির সংকট কাটিয়ে উঠতে যথাক্রমে হিটলার ও মুসোলিনিকে সামনে রেখে দুই জাতিকে জাত্যভিমানে মোহাচ্ছন্ন করে তুলে উগ্রজাতীয়তাবাদের পথে প্রতিপক্ষ জাতির প্রতি ঘৃণা ও প্রতিহিংসাকে সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করল। হিটলার ইহুদি ও স্লাভ জাতির (রাশিয়া) প্রতি ঘৃণাকে প্রতিষ্ঠিত করে রাশিয়া আক্রমণ করলেন, ইহুদি হত্যা করলেন। ছয়টি ইতিহাসখ্যাত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা হল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আউৎশভিৎজ ক্যাম্প, যা প্রকৃতপক্ষে ছিল ডেথ ক্যাম্প। কম খরচে হত্যার জন্য সেখানে গ্যাস চেম্বারে হাজার হাজার ইহুদিকে বন্দি করে গ্যাসে শ্বাসরোধ করে গণহত্যা ঘটানো হল। শুধু আউৎশভিৎজেই প্রায় ১০ লক্ষ গণহত্যা ঘটে, আর নাৎসি বাহিনীর মোট গণহত্যা প্রায় দেড় কোটি। শ্বাস রোধ হয়ে কী দারুণ ছটফট করতে করতে ইহুদিরা মারা যায়, সেই অভূতপূর্ব সৌন্দর্য(!) বাইরে থেকে ছোটো একটি জানলা দিয়ে দেখবার জন্য সেনাপত্নীদের ভিড় জমে যেত। এ থেকেই বোঝা যায় সাধারণ মানুষের মনে ইহুদিদের কতখানি ঘৃণ্য প্রাণীসম করে তোলা সম্ভব হয়েছিল। প্রতিপক্ষের প্রতি কোনও মানবিক বিচারবোধ যাতে জেগে উঠতে না পারে, সেজন্যই এই Dehumanitigation। একটি জাতিকে ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ সম কতখানি তুচ্ছ করে তোলা যায়, যাতে বিবেকবোধ না জাগে, অপরাধবোধ না জাগে। এই প্রক্রিয়াটি ক্রমাগত গণসম্মোহনের পথেই গড়ে তোলা হয়। নিজেদের দুর্ভাগ্যের কারণ হিসেবে সেই ঘৃণ্য জাতির উপস্থিতিকেই প্রতিষ্ঠা করা হয়, যাতে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠতে পারে। ঔপনিবেশিক গণহত্যায় ব্রিটিশ সামাজ্যবাদের যুক্তি ছিল– “এইসব খর্বকায় কালো আর বাদামি মানুষগুলো নিরক্ষর, বোধহীন। এদের জমির অধিকার থাকা উচিত না। সভ্যতার বিকাশের প্রয়োজনে এদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যেতেই পারে।” কলোরাডো গণহত্যার নায়ক সিডিংটোন বললেন– “আমরা ইখতিয়ারদের হত্যা করতেই এসেছি। বিশ্বাস করি– এ অধিকার আমাদের আছে। ঈশ্বরের স্বর্গের নীচে যে কোনও অর্থেই তা সম্মানের।” হিটলারের সেনানায়কের ভাষ্য ছিল– “These are no longer people, they are animals. This is therefore not a humanitasion but a surgical task. They must be eliminated.” মনের ভেতরে মানুষ সম্পর্কে এমন কুৎসিত ভাবনা জমে থাকলে এমন কোটি কোটি গণহত্যা তো ঘটতেই পারে।

একনায়কতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত বাঁধা থাকে আনুগত্যের hierarchy-তে। অর্থাৎ গণতন্ত্রের কোনও জায়গা নেই। সবই নির্ধারিত শিখর দেশ থেকে। প্রত্যেকের মধ্যে থাকে পরবর্তী উঁচু পদের প্রতি ভয় মেশানো আনুগত্য। পরবর্তী নীচের প্রতি থাকে আধিপত্যের আকাঙ্ক্ষা। এভাবে সমস্ত পদগুলি জুড়ে জুড়ে এক স্বৈরাচারী সংগঠন। যেমন হিটলার- মুসোলিনির পার্টিতে, আর এস এস -এ, বহু ধর্মীয় সংগঠনে। এই কাঠামোয় থাকতে থাকতে মুক্তভাবনার বিকল্প পথগুলি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে চেতনা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। সে তখন মনে করে সে এখন এক কঠোর ও শ্রেষ্ঠ নিয়মানুবর্তিতার পথিক। এই উপলব্ধিতে ক্রমাগত সম্মোহিত হতে হতে ক্রমশ নির্দিষ্ট একটি ভাবনায় অন্ধ হয়ে পড়ে। সেই ভাবনার সম্মোহিত সুড়ঙ্গ পথটিতে বন্দি হয়ে পড়ে। হারিয়ে ফেলে মুক্তভাবনার আকাশ। তার জন্য তখন যে পথটুকু সামনে পড়ে থাকে, অর্থাৎ উপরের নির্দেশ প্রশ্নহীনভাবে মান্য করা, তা না করলে অস্তিত্বই বিপন্ন। আবার অধঃস্তনের আনুগত্যের মধ্যেই তার একমাত্র স্বীকৃতি। তাই অধঃস্তনের প্রতিও স্বৈরাচারী হওয়া ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা থাকে না। এভাবেই, ফ্যাসিবাদ ও একনায়কতন্ত্র শিখর থেকে পাদদেশ পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে হয়ে ওঠে স্বৈরাচারী ও গণহত্যাকারী।

মানুষের চিরন্তন মানবিক সত্তার উৎস অন্যের সাথে একাত্ম হবার বাসনাকে সেই আদিকাল থেকেই আর এক চিরন্তন সত্তা ক্ষমতা-আধিপত্যের বাসনার বিরুদ্ধে বহু যুদ্ধের পথ পেরিয়ে আসতে হয়েছে আজকের সভ্যতায়। ইতিহাসের পথে আজও হয়ে চলেছে মানুষের ওপর মানুষেরই ক্ষমতার মত্ততা, নির্যাতন ও গণহত্যা। মানবিক সত্তাই যে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ আজকের সভ্যতায় এসে পৌঁছানো। আজ ভারতবর্ষেও মাথা তুলছে হিটলার-মুসোলিনির পথে হিন্দু ফ্যাসিবাদ। ঘটনার পরম্পরায় একইরকম ছবির পথ ধরে– নীচবর্ণের প্রতি ঘৃণা ও নির্যাতন। মুসলিম বিতাড়ন, নারী বিদ্বেষ, গণতন্ত্র বিরোধী একনায়কতান্ত্রিক ধর্মীয় হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের দিকে যাত্রা। পৃথিবীর বুকে আর-একটি নতুন ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র গড়ে ওঠাটা ‘শুধু সময়ের অপেক্ষা’ হয়ে যাবে, যদি না এখনও সতর্ক হই।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান