মৌলবাদের অন্তরাত্মা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

হিটলারের ফ্যাসিবাদী বাহিনী একদিন আত্মসমর্পণ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আজ এক হিটলারের দুঃস্বপ্নে পরিণত, মানুষ যাকে ভুলে যেতে চায়। কিন্তু তাই বলে কি বলা যাবে যে, ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পতন ঘটেছে, সে আর নেই, চিরকালের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এই পৃথিবী থেকে? না, তা বোধ হয় বলা যাবে না, চরম আশাবাদীরাও বোধ করি তেমনটা বলতে ভরসা পাবেন না।

কেননা ফ্যাসিবাদ তো কেবল হিটলার, মুসোলিনি কিংবা ফ্রাঙ্কো নন, ব্যক্তি নন, দেশও নয়, ফ্যাসিবাদ হচ্ছে একটি প্রবণতা ও বাস্তবতা যা মানুষের স্বভাবে এবং সামাজিক বিন্যাসের মধ্যেই রয়েছে, অনুকূল হাওয়া পেলে ভয়ংকর হয়ে ওঠে এবং আক্রমণ করে। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে অতি উগ্র ও আক্রমণাত্মক চরম দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীলতা যার অন্তর্গত উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে মানুষের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের পশ্চাৎমুখিতা। ফ্যাসিবাদ সামাজিক ডারউইনবাদে বিশ্বাস করে এবং অতিউৎসাহে তারই চর্চা করে থাকে। অর্থাৎ ডারউইন-প্রদর্শিত প্রাণীজগতে যেমন দুর্বল কেবলই আক্রান্ত হচ্ছে প্রবলের হাতে এবং শুধু সেই টিকছে যার ক্ষমতা আছে টিকে থাকবার, অন্যরা যাচ্ছে ধ্বংস হয়ে, ফ্যাসিবাদের উদ্দিষ্ট রাষ্ট্রেও তেমনই প্রবল শাসন করবে, যদিও রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করা হবে জনগণের নামে, এবং দুর্বল সেই শাসনের ভার বহন করে চলবে। ফ্যাসিবাদ সমাজে শ্রেণির বিদ্যমান বিন্যাসকে রক্ষা করবে, রক্ষা করেই চাইবে জনগণকে এক রাখতে, এবং সেই প্রয়োজনে আক্রমণ করবে অন্য দেশকে।

এই যদি হয় ফ্যাসিবাদের চেহারা তবে তা কি আজও বিদ্যমান নেই পৃথিবীর নানা দেশে– পুঁজিবাদী ধনী দেশগুলোতে যেমন, তেমনি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও। পুঁজিবাদের একেবারে কেন্দ্রভূমিতে পুঁজির স্বৈরশাসন বিরাজ করে। সেখানে গণতন্ত্র আছে ঠিকই, কিন্তু সে হচ্ছে ধনীদের গণতন্ত্র। তার সভ্যতার অভ্যন্তরে জঙ্গলই সত্য হয়ে রয়েছে। আর সাধারণ মানুষকে যে বশে রাখা সম্ভব হচ্ছে তা একদিকে স্বজাতির মহিমা প্রচার করে অন্যদিকে দরিদ্র দেশগুলোকে লুণ্ঠন করে। সবই ফ্যাসিবাদের উপাদান। গরিব পৃথিবীর অনেক দেশেই স্বৈরাচারের প্রতিষ্ঠা আরও নগ্ন ও নিষ্ঠুর। সে সব জায়গায় শ্রেণি রয়েছে, এবং ধনিক শ্রেণি শাসন করছে, সাম্রাজ্যবাদী ধনী দেশগুলোর প্রত্যক্ষ পৃষ্টপোষকতায়। জনগণকে অজ্ঞ ও পশ্চাৎপদ রেখে, তাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে ইহজাগতিকতার বোধকে ভোঁতা করে দিয়ে কোথাও ব্যক্তির কোথাও ‘দলের শাসন’ চলতে থাকে। এসব ঘটনা কি জাজ্বল্যমান সত্য নয়? তাহলে ফ্যাসিবাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এমন কথা কোন সাহসে বলি?

ফ্যাসিবাদকে ঠিকমতো চিনতে হলে তার ইতিহাসের দিকে একবার দ্রুত তাকানো ভালো। হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেন ১৯৪১ সালের ২২ জুন তারিখে। আক্রমণ করে ভুল করেছেন এটা বলা যেতে পারে। কেননা, ওই আক্রমণের ফলেই ফ্যাসিবাদের বিপর্যয় ঘটেছে। প্রচণ্ড যুদ্ধ হল, কিন্তু হিটলারের বাহিনীকে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে হল, পরে হিটলার আত্মহত্যা করলেন এবং ১৯৪৫-এর মে-তে আনুষ্ঠানিকভাবে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটল। এই আক্রমণ আত্মঘাতী ছিল ঠিকই, কিন্তু এটি না করে হিটলারের পক্ষে কি কোনো উপায় ছিল? না, তা ছিল না। ছিল না এই জন্য যে, নাৎসি জার্মানির জন্য তখন ভূমির বড়ো প্রয়োজন ছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করার সেটা একটা কারণ। আরও একটা কারণ এই যে, ফ্যাসিবাদ উগ্র ও আক্রমণাত্মক জাতীয়তাবাদের অন্ধ উত্তেজনা সৃষ্টি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখে। তাকে এক ধরনের সন্তোষ দেয়। জার্মান জাতি পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ, পৃথিবীকে শাসন করার অধিকার কেবল তারই– এই আওয়াজ তুলে রুশদেরকে আক্রমণ করা হিটলারের জন্য সেদিক থেকেও প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো ও মৌলিক কারণ ছিল এই যে, সমাজতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ হচ্ছে পরস্পরের জাত শত্রু, ফ্যাসিবাদ তাই অবশ্যই চাইবে সমাজতন্ত্রকে নির্মূল করে দিতে। সমাজতন্ত্র চলে গেলে উদারনীতিকদের কাবু করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। অল্প সময়ের। হিটলার সেটাই চেয়েছিলেন। এসব কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ না করে তাঁর উপায় ছিল না। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে উদারনীতিকরাও লড়ছিল। ব্রিটেন লড়ছিল, ফ্রান্স লড়ছিল। হিটলারের নিজের দেশেও যে উদারনীতিকেরা ছিল না তা তো নয়; ছিলেন এবং হিটলারের সঙ্গে তাঁদেরও বিরোধিতা ছিল। কিন্তু উদারনীতিক তথা বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের যে বিরোধ তা শেষ পর্যন্ত পারিবারিক বিরোধেই পর্যবসিত হয়। ফ্যাসিবাদ অবশ্যই গুন্ডা প্রকৃতির, উদারনীতি অবশ্যই ভদ্র স্বভাবের, কিন্তু তারা উভয়েই আবার পুঁজিবাদেরই অন্তর্গত, পুঁজিবাদ ধ্বংস হোক এ তাদের কারোই কাম্য হতে পারে না। সমাজতন্ত্রের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে পুঁজিবাদকে ধ্বংস করতে চায়, পুঁজিবাদকে ধ্বংস করে শ্রেণি ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই তার লক্ষ্য।

সমাজতন্ত্রে তাই আপসের স্থান ছিল না। থাকে না। হিটলার জানতেন তাঁর মূল শত্রু কে, তাই তাকে ধ্বংস করার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন তিনি– একেবারে অনিবার্যভাবে। আক্রমণের মতো পরাজয়ও অনিবার্য ছিল। কেননা সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন একটি সদ্যজাগ্রত বিপ্লবী শক্তি, তার আছে উন্নতর আদর্শ ও গভীরতর সংঘবদ্ধতা। সেই উন্নত আদর্শ তাকে দিয়েছিল অসামান্য সাহস, নৈতিক শক্তি ও আপসহীনতা। আর মানুষে মানুষে সহমর্মিতার ভিত্তিতে যে ঐক্য ও দেশপ্রেম গড়ে উঠেছিল তাও ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই অপরাজেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন লড়ছিল মনুষ্যত্বের পক্ষে, হিটলারের জার্মানি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল পশুত্বের রাজত্ব; মনুষ্যত্বের জয় হয়েছে, পশুত্বকে পরাভূত করে। জয় না হলে মানুষের খুব বড়ো বিপদ ছিল। সমাজতন্ত্র পিছিয়ে যেত, সভ্যতাও পিছিয়ে পড়ত। আর ওই জয়ের ফলে পুঁজিবাদের পক্ষেও তার আগের রূপে থাকা সম্ভব হয়নি, ছাড় দিতে হয়েছে, নমনীয় করতে হয়েছে চেহারাটাকে, কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণাকেও প্রশ্রয় দিতে হচ্ছে কোথাও কোথাও।


ইউরোপে ফ্যাসিবাদের অভ্যুদয়ের সময়ে সেখানে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন যে ছিল না তা নয়, বরঞ্চ শক্তিশালী আন্দোলনই বিদ্যমান ছিল, আর তাকে চুরমার করে দিয়েই ফ্যাসিবাদের অভ্যুদয় ঘটে। প্রথম জীবনে মুসোলিনি বামেরই লোক ছিলেন। বিপ্লবী বামের (আমাদের দেশে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কোনও কোনও নেতার মতো) সেই অবস্থানে থেকে জেল খেটেছেন, নির্যাতন ভোগ করেছেন। কিন্তু যথার্থ সমাজতন্ত্রী হয়ে ওঠেননি। ব্যক্তিগত সাফল্য খুঁজছিলেন আসলে; সেটা বাম দিক থেকে যখন আসছে না দেখলেন, তখন ডান দিকে ঝুঁকলেন, ঝুঁকে ফ্যাসিস্ট পার্টি গঠন করলেন। এটা ১৯১৯-এর ঘটনা। প্রথমাবস্থায় চেষ্টা ছিল বাম ও ডানকে একত্র করে ক্ষমতায় যাবেন চলে। ফ্যাসিস্ট পার্টি গঠন করার সময়ে মুসোলিনির ঘোষণাটি কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আমরা হচ্ছি প্রতিক্রিয়াশীল ও বিপ্লবী, আভিজাত্যগর্বী ও গণতন্ত্রী, রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল।’ কিন্তু এক সঙ্গে ওই দুই বিপরীত দিকের হবেন এ তো কিছুতেই সম্ভব নয়; সম্ভব হয়ওনি। তিনি দক্ষিণে চলে গেছেন, পুরোপুরি, এবং ভয়াবহ একটি রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তুলেছেন, সাধারণ মানুষের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে নিয়ে। এ কাজে তিনি উষ্ণ সমর্থন পেলেন জমি ও পুঁজির মালিকদের, যুদ্ধফেরতদের এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের। অন্যদের তো পাবেনই, কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তও যে এল তাঁর পেছনে এটাই বিশেষভাবে লক্ষ করবার মতো। এল হতাশায় ও ভয়ে। যুদ্ধপরবর্তী মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব যে ভয়াবহ হতাশার সৃষ্টি করেছিল মুসোলিনি তাকে কাজে লাগালেন, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তকে টেনে নিলেন তাঁর দলে। আর ছিল ভয়। সমাজতন্ত্রীরা আন্দোলন করছিলেন, মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত ভয় পেয়ে গেল, ভাবল শ্রেণির যেটুকু অবলম্বন অবশিষ্ট রয়েছে সেটুকুও যাবে চুরমার হয়ে, সমান হয়ে যেতে হবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে; শ্রেণি-হারাবার সেই আতঙ্কে তারা ছুটল মুসোলিনির পিছু পিছু। বিশেষভাবে গেল তরুণরা, তাদের মধ্যে হতাশাটা ছিল বেশি, বেশি ছিল অভিমানটাও।

হিটলারও জেল খেটেছেন প্রথম জীবনে। জেলে বসেই তিনি তাঁর ‘দার্শনিক’ গ্রন্থ ‘মেইন কেম্ফ’ রচনা করেন। তাঁর জার্মানিতেও অত্যন্ত প্রবল ছিল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। এত প্রবল যে, হিটলারকে তাঁর পার্টির নামই দিতে হয়েছিল জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল। সমাজতন্ত্রকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না, তাই সমাজতন্ত্রকেই ব্যবহার করলেন সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাকে জাতীয় করে তুললেন, এবং ইহুদিদেরকে জাতীয় শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলনের ধারাকে ইহুদি বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করলেন। পুঁজিবাদীরা খুশি হল, সমর্থন দিল। ওদিকে ওই যে হতাশ ও সন্ত্রস্ত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত তারা তো জার্মানিতেও ছিল, বেশি করেই ছিল, বাবা হিটলারকে পেয়ে বেঁচে গেল। হিটলার তাদেরকে আশার কথা শোনালেন, বললেন, জার্মানরা পৃথিবী জয় করবে, সারা পৃথিবীর প্রভু হবে। ফলে কারও জন্যই শ্রেণিচ্যুত হবার ভয় রইল না, সম্ভাবনা রইল জগৎ জয় করবার। হিটলারের জয় জয়কার পড়ে গেল।

স্পেনে সমাজতন্ত্রীরা আরও বেশি অগ্রসর হয়েছিলেন, ১৯৩৬ সালে তাঁদের পপুলার ফ্রন্ট রাষ্ট্রক্ষমতা-ই প্রায় দখল করে নিয়েছিল, তখন ফ্রাঙ্কো নামলেন, গৃহযুদ্ধ শুরু হল, এবং ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত চলে গেল ফ্যাসিস্টদের হাতেই। এই ইতিহাসে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে একাধিক। প্রথম সত্য এই যে, হতাশা, বেকারত্ব ও বিক্ষোভ থাকলেই যে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন জয়ী হবে তেমন কোনও কথা নেই। এই বিপ্লবী পরিস্থিতিকে কট্টর ডানপন্থীরাও ব্যবহার করতে পারে, এবং ব্যবহার করে নিজেদের লাইনে ‘বিপ্লব’ ঘটাতে পারে, যদি না সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সঠিক পথে অগ্রসর হয়। এবং সঠিক পথে অগ্রসর হওয়া যে সহজ তাও নয়। তুলনায় দক্ষিণপন্থীদের কাজটা অনেক সহজ। তারা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার আনুকূল্য পায় তো বটেই, মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক যে স্বার্থপরতা ও পশ্চাৎমুখিতা রয়েছে তার দ্বারাও সমানে পুষ্ট হয়। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব সমাজপ্রগতির যে-ধারাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল, তাকে নষ্ট করার চেষ্টার কোনও অবধি ছিল না। ফ্যাসিবাদ সেই চেষ্টারই সবচেয়ে সুসংগঠিত রূপ বটে। রক্ষণশীলরা এমন কোনও অস্ত্র নেই যা ব্যবহার করে না, ধর্মকেও ব্যবহার করে থাকে, মুসোলিনি যা করেছিলেন। ১৯২৯ সালে মুসোলিনি পোপের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। ঠিক হয় পোপকে ভ্যাটিকান সিটির ওপর আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব দেওয়া হবে এবং ক্যাথলিক ধর্মকে ইতালির একমাত্র রাষ্ট্রীয় ধর্ম করা হবে; বিনিময়ে পোপ মুসোলিনিকে সমর্থন দেবেন।

প্রথম শিক্ষা যেমন ফ্যাসিবাদের সাফল্য থেকে প্রাপ্য, দ্বিতীয় শিক্ষা তেমনি পাওয়া যাচ্ছে ফ্যাসিবাদের পতনের ঘটনা থেকে। ফ্যাসিবাদের পতন উদারপন্থীদের হাতে হয়নি, সমাজতন্ত্রীদের হাতেই হয়েছে। হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ না করলে যুদ্ধের ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হত। আক্রমণ যতটা অনিবার্য ছিল ততটাই অনিবার্য ছিল পতন। যাতে বোঝা যায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন যুদ্ধ কেবল সমাজতন্ত্রীরাই করতে পারেন; অন্যরাও তা করেন বটে, কিন্তু বেশি দূর এগোন না, মাঝপথে আপস করে ফেলেন। ভদ্র ভাই গুন্ডা ভাইটাকে মেনে নেন, কি করবেন, হাজার হোক ভাই তো। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই আজও চলছে। দেশে দেশে লড়ছে মানুষ।

সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন দেখে যেসব উদারনীতিকেরা উৎফুল্ল হন তাঁরা খেয়াল করেন না যে, সমাজতন্ত্রীরা যত হটবে ফ্যাসিবাদীরা তত এগুবে। ১৯৪৫-এ সোভিয়েত ইউনিয়ন হিটলারের জার্মানির কাছে হেরে গেলে পৃথিবী ফ্যাসিবাদের জন্যই নিরাপদ হত, গণতন্ত্রের জন্য নয়। আজও সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামই গণতন্ত্রকে নিরাপদ করতে পারে, অন্যকারও সেই শক্তি নেই। মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব যেমন আছে, তেমনি রয়েছে পশুত্ব, পশুত্বই বরঞ্চ অধিক ক্ষমতাবান, তাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে মনুষ্যত্বকে বিকশিত করতে চাইলে সমবেত, সংঘবদ্ধ উদ্যোগের প্রয়োজন হবে। আর সেই উদ্যোগকে কেবল রাজনৈতিক হলে চলবে না, সাংস্কৃতিকও হওয়া চাই। মানুষের চিত্তভূমিকে উদার, প্রগতিমুখী ও সহমর্মিতায় পুষ্ট না করলে অগ্রগতি সম্ভব নয়, এবং এগিয়ে গেলেও আবার পিছিয়ে আসতে হবে, পূর্ব জার্মানিসহ পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে এখন যেমনটা ঘটছে। পশু ও মানুষের সহাবস্থানে পশুর বড়ো সুবিধা, মানুষের বড়োই বিপদ।

১৯৪৮ সালে যখন ইজরায়েল নামে ইহুদিবাদী (অর্থাৎ পুরোপুরি বর্ণবাদী) একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটে তখন উদ্যোগটা নিয়েছিলেন বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরাই, যাঁরা হিটলারের পরাজয়ে উল্লসিত ছিলেন। হিটলারকে সরিয়ে হিটলারের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের মতোই যে নতুন একটি বর্ণ-মৌলবাদী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে সেদিকে তাকাবার কোনও ইচ্ছাই সেদিন বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের মধ্যে দেখা যায়নি। তবে তখন কিন্তু সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে প্রতিবাদ উঠেছিল। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পর্যন্ত ঘটেছে। সে-যুদ্ধ কোনও ধর্মযুদ্ধ ছিল না। মধ্যযুগের ক্রুসেড পুনরায় আবির্ভূত হয়নি। যুদ্ধটা ছিল জবরদখলের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষের মুক্তিযুদ্ধ। ফিলিস্তিনি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলনে কেবল যে মুসলমানরাই ছিলেন তা নয়, খ্রিস্টানরাও মনেপ্রাণে যোগ দিয়েছেন। সর্বাধিক অঙ্গীকারাবদ্ধ রূপে যে লিবারেশন ফ্রন্ট সেদিন গড়ে উঠেছিল তার নেতৃত্বে ছিলেন একজন খ্রিস্টান– জর্জ হাবাস। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে যে সাহিত্যিক জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত লিখে গেছেন তাঁর নাম এডওয়ার্ড সাইদ; তিনিও ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ফিলিস্তিনিদের সরব মুখপাত্র ছিলেন যে মহিলা অধ্যাপক জন্মসূত্রে তিনিও ছিলেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়েরই অন্তর্ভুক্ত।

কিন্তু আজকের মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আওয়াজটা এত দুর্বল কেন? কারণ কী? কারণ হল সেখানকার শাসকদের অধিকাংশই ইতিমধ্যে পুঁজিবাদে দীক্ষিত হয়ে গেছেন। আলখাল্লাটাই যা ভিন্ন, ভেতরে ভেতরে তাঁরা মার্কিনিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব চান, কামনা করেন ইজরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক (অর্থাৎ বন্ধুত্বপূর্ণ) সম্পর্ক।

ইজরায়েলের রাষ্ট্রশাসকেরা তো নির্বাচিত হয়েই এসে থাকে। এবং ফিলিস্তিনে তারা যে বর্বরতম গণহত্যা অবিশ্বাস্য গতিতে পরিচালনা করছে সেটাই হচ্ছে বুর্জোয়া শাসকদের আসল চরিত্র। গাজাতে ফিলিস্তিনিরা সংখ্যায় ছিল ২৩ লক্ষ, তার মধ্যে ৩৫ হাজার ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছে, বহুজন আহত অবস্থায় আছে, অনেকেই অপেক্ষা করছে মৃত্যুর। কম করে হলেও ১৯ হাজার শিশু আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। বাবা নেই, মা নেই, এমন শিশুরা বলছে তারা মরে যেতে চায়। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে সব চেয়ে অনমনীয় ও সোচ্চার যে রাষ্ট্র– মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র– তারা এই গণহত্যায় বিরোধিতা করবে কি, উলটে মদত জুগিয়ে চলেছে। এ ব্যাপারে বাইডেনে-ট্রাম্পে কোনও ফারাক নেই। অস্ত্র মার্কিনিরাই সরবরাহ করছে। অর্থাৎ অস্ত্র বিক্রি করছে। এরকম গণহত্যা ঘটলে অস্ত্রব্যবসায়ীদের লাভটাই সর্বাধিক; তারা সেই লাভ হাতে পেয়ে আহ্লাদিত অবস্থায় আছে। খোদ আমেরিকাতেই তো অস্ত্র-ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো, বন্দুক তৈরিকারীদের দাপটের চোটেই তো বন্দুকব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আর মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদের আপনজন বলে-কথিত যাদের বসবাস তারা, বিশেষভাবে রাজা-বাদশাহ এবং শাসনকর্তারা, দেখেও দেখছে না। সাড়াশব্দ নেই। কারণ তারাও পুঁজিবাদী আদর্শে দীক্ষিত, এবং ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ করতে আগ্রহী। একেবারে ভাই ভাই-এর সম্পর্ক হতে পারবে না ঠিকই, রক্ত এক নয়, আবার ধর্মীয় পার্থক্যও রয়েছে; কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে তো বাধা নেই, এবং পৃথিবীতে ভাইয়ে ভাইয়ে যত ঝগড়া হয় বন্ধুতে বন্ধুতে তত হয় না। হ্যাঁ, প্রতিবাদ হচ্ছে। বিশ্বব্যাপীই প্রতিবাদ হচ্ছে। ইজরায়েলের ভেতরও মনুষ্যদরদি মানুষ আছেন, যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, কিন্তু তাঁরা তো সংখ্যায় অল্প; তদুপরি রাষ্ট্র একপায়ে খাঁড়া তাঁদেরকে হেনস্তা করতে। গণমাধ্যমেও তাঁরা প্রশ্রয় পান না।

দুই

যে-যুবক খুন করেছে কাউকে এবং ধরা পড়ে গেছে, জানে শাস্তি হবে, মৃত্যুদণ্ডই সম্ভবত, সে যদি প্রফুল্ল থাকে, মৃদু হাসি ফুটিয়ে রাখে মুখে তাহলে তাঁকে আমরা কী বলব– বদ্ধ উন্মাদ, নাকি অন্যকিছু? ইগার আমির নামে যে ইহুদি যুবক ইজরায়েলের অর্থাৎ তারই রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ইসহাক রাবিনকে হত্যা করেছে তাকে আমরা অবশ্যই পাগল বলতে পারি। যোগ করা যাবে যে সে সাধারণ উন্মাদ নয়। আদর্শপাগল। কৃতকর্মের পরে তার মুখে যে প্রসন্ন হাসি ছিল সেটা কোনও স্বাভাবিক মানুষের নয়, সেই রকম একজনের যে মনে করে যে তার জীবন সার্থক হয়েছে, পরম চরিতার্থতা লাভ ঘটে গেছে। প্রসন্নতাটা আত্মপ্রসাদের এবং অবজ্ঞার। প্রভু, তুমি এদের ক্ষমা করে দিয়ো, এরা জানে না আমি কত ভালো একটা কাজ করেছি, না-বুঝে আমাকে আটক করেছে, ভাবছে শাস্তি দেবে। লোকটার ভাবটা ছিল এই রকমের। অনেকটা জিশু খ্রিস্টের মতো। তবে নিশ্চয়ই সে জিশু নয়। তার মন্ত্র ভালোবাসার নয়, ঘৃণার।

একই ঘটনা ঘটেছিল গান্ধি হত্যাকারী উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী নথুরাম গডসের ক্ষেত্রেও। সে-ও আদালতে সেরকমটাই বলেছিল এবং শাস্তি অনিবার্য জেনেও ধর্মীয় দীক্ষায় তার মধ্যে কোনও অনুশোচনা ছিল না। গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ওই হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা জনরায়ে ভারতের ক্ষমতায় রয়েছে। এবং ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী তৎপরতা ক্রমাগত চালিয়ে যাচ্ছে।

এই যুবক ঘৃণার সন্তান। মৌলবাদ যখন জঙ্গি চেহারা নেয় তখন সেটা কেমন নৃশংস হতে পারে তার প্রমাণ সে দিয়েছে। সে একলা নয়, অনেকেই দিচ্ছে। ওই পথে ঘাতকের সন্ধান যখন-তখন পাওয়া যাবে। পাকিস্তানেও পাওয়া গেছে, সেখানকার মিসরীয় দূতাবাসে মৌলবাদী জঙ্গিরা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। নিহত হয়েছে ১৬ জন, আহত ৬০। ইজরায়েলি যুবকটি ইহুদি, পাকিস্তানে তৎপর জঙ্গিরা মুসলমান। এক্ষেত্রে হিন্দু, ইহুদি, মুসলমানে কোনও ব্যবধান নেই; অন্য বহুক্ষেত্রে সেটা থাকলেও, এবং ইহুদি-মুসলমান পরস্পরের শত্রু হলেও। হিন্দু মৌলবাদীও কম পারে না, তাদেরই একজন হত্যা করেছিল মহাত্মা গান্ধিকে, একটা প্রার্থনা সভায় গিয়ে, সে কথা তো উল্লেখিত।

এ ধরনের খুনিদের মনস্তত্ত্বে গবেষণার উপাদান আছে। তাদের ব্যক্তিগত ইতিহাস নিশ্চয়ই কৌতূহলোদ্দীপক হবে। তবে সাধারণভাবে বলা খুবই সম্ভব যে, এরা যে জঙ্গি হয় তার কারণ থাকে দুটি– একটি হচ্ছে প্ররোচনা, অপরটি চরিতার্থতা লাভের অতুগ্র আকাঙ্ক্ষা। দুটি আলাদা হয়ে থাকে না, এক হয়ে যায়, এক দেহে লীন। উভয়েই অংশ একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের। হিটলারের শাসন গত শতাব্দীর ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যে নিকৃষ্টতম, বলা হয় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক কাজ ওই সময়ে ঘটেছে। কিন্তু হিটলার তো একা ছিল না, সঙ্গে ছিল অনেকে। হিটলার ইহুদিদের হত্যা করে জার্মানিকে বিশুদ্ধ করবে ভেবেছিল, আজ এক তরুণ ইহুদি হিটলারের মতো একই বর্ণবাদী উন্মাদনায় তার নিজের রাষ্ট্রের ইহুদি প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করল। হিটলার মনে করত ইহুদিরা পবিত্র জার্মান ভূমিকে অপবিত্র করছে, তাদেরকে নির্বংশ না করে গেলে জার্মানির মুক্তি নেই। গণহত্যার ওই অপরাধীদের আজও যখন ধিক্কার দেয়া হচ্ছে, পৃথিবীময়, বৃদ্ধ ও মৃতপ্রায় অবস্থাতেও কাউকে পাওয়া গেলে যখন ধরে এনে বিচার করা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে, তখন ওই একই অপরাধ করেছে এক তরুণ ইহুদি। সেও একজন হিটলারই। তারও ওই একই অভিযোগ, ইহুদিদের ঈশ্বর-প্রদত্ত পবিত্র ভূমির অংশ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ফিলিস্তিনীয় আরবদেরকে। এর প্রতিকার করবে সে। প্রতিশোধ নেবে।

হিটলারের প্রকৃত জন্মভূমি জার্মানি কিংবা ইজরায়েলে নয়, তাঁর জন্ম একটি মনোভূমিতে। মনোভূমিটা সাংস্কৃতিক। ইগার আমির কোনও বাউন্ডুলে যুবক নয়, সে শিক্ষিত, সে আইনের ছাত্র। হঠাৎ উন্মাদনায় সে খুনি হয়নি, ধীরে ধীরে প্রস্তুত হয়েছে। স্থির মস্তিষ্কে কাজ করেছে। হিটলারের নাৎসি বাহিনীতে কেবল যে ইহুদি-বিদ্বেষী ও অর্ধোন্মাদেরা ছিল তা নয়, সেখানে অতিশয় সভ্যভব্য, বুদ্ধিমান, সুশিক্ষিত মানুষেরাও ছিল। শেষ দিকে ওই একনায়কের ঘনিষ্ঠ সহচরদের মধ্যে ছিলেন আলবার্ট স্পিয়র নামে অতিশয় মার্জিত এক ব্যক্তি। নাৎসি জার্মানির ওপর সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ লিখেছেন যে ঐতিহাসিক– হিউ ট্রেভর রূপার– তিনি যাঁকে বলেছেন, ওই আমলের ‘আসল দুর্বৃত্ত’।

এই স্পিয়র নিজে খুনি ছিলেন না। যুদ্ধশেষে তিনি আত্মহত্যা করেননি, ন্যুরেমবার্গ আদালতে যখন তাঁর বিচার হয় তখন বরঞ্চ স্বীকার করেছেন যে, হ্যাঁ, তিনি অপরাধী। বিচারে তাঁর কারাদণ্ড হয়েছিল। স্পিয়র ১৯৮১-তে মারা গেছেন। কারাগারে বন্দি অবস্থায় তিনি ডায়েরি লিখে গেছেন, সে-ডায়েরি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলছেন নাৎসি বাহিনীতে যোগদানের পেছনে একটা স্বপ্ন ছিল তাঁর। বার্লিনকে তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহর এবং ‘সারা বিশ্বের রাজধানী’ হিসেবে গড়ে তুলবেন এটাই ছিল সেই স্বপ্ন। তাঁর পারিবারিক ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা গেছে যে, স্পিয়র বড়ো হয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারে, সেই পরিবারে অভাব ছিল ভালোবাসার। হিটলারের মধ্যে তরুণ বয়সে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন একজন পিতাকে। নিজের পরিবারে তিনি পিতার ভালোবাসা পাননি। রাজনীতিতে এসে সেই ভালোবাসা পেলেন এমন একজন মানুষের ভেতর যে-ব্যক্তি আসলে একজন নরঘাতক।

স্পিয়র একা নয়, হাজার হাজার যুবক তখন জার্মানিতে বিদ্যমান হতাশা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হবার পর জার্মানির ওপর দিয়ে হতাশায় তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে থাকে। একদিকে অর্থনৈতিক সংকট অন্যদিকে জাতিগত অসম্মান বড়োই পীড়িত করেছে বিশেষভাবে তরুণদেরকে। তারা দেখছিল বেকারত্বের আশঙ্কা বাড়ছে, দেখছিল ভার্সাই চুক্তি জার্মানিকে নানাভাবে অপমানিত করেছে। পিতৃভূমির এলাকা গেছে ছোটো হয়ে, তাকে মানতে হয়েছে পরাজিতের নানা শর্ত। তরুণের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন ছিল এই অবস্থা। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল জার্মানিতে। কিন্তু সমাজতন্ত্র তো জাতিগত অপমানের প্রতিষেধক নয়। সমাজতন্ত্র মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়; সে তো বলে না জার্মানরাই সেরা, পৃথিবীতে তারা অদ্বিতীয়। হিটলারের ডাকটাই উন্মাদ করল তরুণদেরকে। হিটলার বললেন, তিনি শোধ নেবেন জাতিগত অপমানের, জয় করবেন সারা বিশ্ব। তরুণ দেখল চরিতার্থতা লাভের সুযোগ তার সামনে উন্মুক্ত। সে প্ররোচিত হল প্রচারের দ্বারা এবং অন্যের দৃষ্টান্ত অবলোকনে। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে গিয়ে যোগ দিল নাৎসি বাহিনীতে।

একইভাবে প্ররোচিত হয়েছে রাবিন-হত্যাকারী। ইজরায়েল জার্মানির প্রতিবেশী নয়। সময়ের ব্যবধান, ব্যবধান স্থানের। সর্বোপরি বর্ণের। কিন্তু ওই ঘাতক যুবকও তো নাৎসি বাহিনীরই সদস্য একজন, যে নাৎসিরা একদিন তার আগের প্রজন্মের ইহুদিদেরকে হত্যা করেছে। বর্ণের যে পবিত্রতার ধারণার ওপর হিটলার তাঁর জার্মানিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, ইজরায়েল নামের রাষ্ট্রটি তো সেই বর্ণবাদের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। হিটলারের প্ররোচনা সভ্যভব্য জার্মান তরুণদেরকে ঘাতকে পরিণত করেছিল, ইজরায়েলের বর্ণবাদও সেই একই প্ররোচণা দিচ্ছে। ঘাতক যুবক নিজে বর্ণবাদ সৃষ্টি করেনি। সে তার রাষ্ট্রের অন্তর্গত বর্ণবাদকে চরম উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, সে একটি আদর্শের অগ্রবাহিনীর সদস্য। ইজরায়েল একটি আধুনিক রাষ্ট্র। তার উন্নতি ঈর্ষণীয়, সেখানে বহুদলীয় রাজনৈতিক প্রথা বিদ্যমান, এমন কি কমিউনিস্ট পার্টিও পেয়েছে কাজ করার স্বাধীনতা, যে-রকম সহনশীলতা তার আশাপাশের কোনও আরব রাষ্ট্রে নেই। কিন্তু রাষ্ট্রের অন্তরে তো আছে একটি বর্ণবিদ্বেষ, আছে এই ধারণাও যে তারাই জগতের শ্রেষ্ঠ। সেই বিদ্বেষ ও ধারণাকে যদি তার নির্গলিতার্থে দেখা যায় তবে যে-চেহারাটা ফুটে ওঠে সেটা ওই ইগার আমিরের, ওই যুবকের, যে তার রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করেছে এই অপরাধে অভিযুক্ত করে যে ইজরায়েলের তিনি অপমান করেছেন। শান্তি চুক্তি করেছেন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে এবং পবিত্র ভূমি দিয়ে দিয়েছেন ওই শত্রুদেরকে।

সভ্য মানুষ মানেই সভ্য নয়। তার অন্তরে থাকে আদিম পশু; কেবল যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে তা নয়, সমষ্টিগত পর্যায়েও, সমষ্টিগত পর্যায়েই সে অধিক মারাত্মক। বর্ণবাদ আবার ফিরে এসেছে ইউরোপে। নব্যনাৎসিরা জার্মানিতে, ইতালিতে, এমন কি ইংল্যান্ডেও মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, বাংলাদেশের জামায়েত, হেফাজতে ইসলামের মতো। নব্যনাৎসিরা বিদেশিদের ওপর যখন-তখন আক্রমণ করছে। গণতন্ত্রের পীঠস্থান আমেরিকাতে, যেখানে সবাই আসলে বিদেশি, সেখানেও নবাগতদেরকে তাড়িয়ে দেবার আয়োজন চলছে। চলছে কালোর ওপর সাদার নির্যাতন। তাদের টেলিভিশনেই শোনা যাচ্ছে সেসব খবর। একজন কালো পুরুষকে সাদা সাজিয়ে পাঠানো হয়েছিল রাস্তায়, দোকানে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে-মানুষটি দেখেছে যেন সে নতুন জীবন লাভ করেছে। এমন উষ্ণ আচরণ পাচ্ছে যা জীবনে কখনও পায়নি। আবার যখন গেছে সে কৃষ্ণ পরিচয়ে তখন এমন কি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষ্ণবর্ণ দারোয়ানটি পর্যন্ত বিতৃষ্ণাভরে তাকিয়েছে তার দিকে, সাদা মনে করে আগেরবার যে তার সঙ্গে সম্ভ্রম দেখিয়ে কথা বলেছিল। হার্ভাড থেকে ল-ডিগ্রি নিয়ে কৃষ্ণবর্ণের এক যুবক দেখে মক্কেল পায় না, এমন কি কৃষ্ণবর্ণের মক্কেলও তার কাছে আসে না। একজন পরামর্শ দিল শহরের বাইরে কান্ট্রি ক্লাবে ওয়েটারের চাকরি নাও, ভালো ভালো সম্ভাব্য মক্কেলের সঙ্গে পরিচয় হবে, পরে তাদেরকে নিজের পরিচয় দিয়ে আকর্ষণ করতে পারবে। আকর্ষণ করবে কি, দেখে যে সে ঢুকতেই পারে না। টেলিফোনে গলা শুনে কালো বলে তাকে চিনতে পারে না। ম্যানেজার বলে হ্যাঁ, হ্যাঁ এসো, আমাদের ক্লাবে লোক লাগবে বই-কি। গিয়ে হাজির হলে আমতা আমতা করে। বলে তুমিই কি ফোনে কথা বলেছিলে? দুঃখিত, অন্যকে চাকরিটা দিয়ে ফেলেছি। হার্ভার্ডের ল-গ্র্যাজুয়েট, কর্মঠ যুবক, ওয়েটারের চাকরি পাচ্ছে না। একজন ম্যানেজার বলল, বাসের কন্ডাক্টর হও। অন্তর্নিহিত দর্শনটা এই যে, বাসে নানা বর্ণের লোকের যাতায়াত, সেখানে ক্ষণস্থায়ী সম্পর্ক, ওখানে মানাবে তোমাকে, আমাদের এখানে তোমাকে নিলে উলটে আমরা গ্রাহক হারাব। কেউ বলল, পাকের ঘরে ধোয়ামোছার কাজ দিতে পারি, টেবিল পরিষ্কার করবে সেও হতে পারে, কিন্তু খাবার হাতে নিয়ে গিয়ে হাজির হলে গ্রাহকদের খাবার রুচি বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। ভিরমি খাওয়াও বিচিত্র নয়। একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা কালো সেজে কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার সঙ্গে গির্জায় গিয়েছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন পুরোহিত বলবেন, নতুন বন্ধুদের স্বাগত জানাই। পুরোহিত উলটে বললেন, বন্ধুগণ, আমাদেরকে সকল পরিস্থিতির জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। এই ঘটনা বর্ণবিদ্বিষ্ট বলে পরিচিত কোনও এলাকায় ঘটেনি, ঘটেছে উদারনীতির জন্য প্রসিদ্ধ কানেকটিকাতে। পুঁজিবাদী দেশে বর্ণবাদ অবলুপ্ত হবার কথা। কেননা সেসব দেশ গণতন্ত্রী, অর্থাৎ সহনশীল: সেখানে মানুষ টাকা চেনে, বর্ণ দেখে না। কিন্তু আমেরিকার বর্ণবাদের তৎপরতা বিষয়ে কোনও আমেরিকানেরই সন্দেহ থাকার উপায় নেই। ওয়াশিংটনে দশ লাখ কৃষ্ণকায় মানুষের শোভাযাত্রা এমনি এমনি সংঘটিত হয় না।

বর্ণবাদও এক ধরনের আদর্শ। এও মৌলবাদ বটে। যখন উগ্র হয় তখন সে জঙ্গিরূপ ধারণ করে এবং ঘাতকের চরিত্র নিয়ে শত্রু নিধনে বের হয়। ধর্মীয় মৌলবাদকে নানাভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ভারতে হিন্দু মৌলবাদীরা রাষ্ট্রক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখতে কখনও দেবতাকে দুধ খাওয়ায়, কখনও মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়ে। চরিতার্থতা লাভের স্বপ্ন দেখায়; আসলে চায় জাগতিক সুবিধা অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখা।

আলজেরিয়াতে মুসলিম মৌলবাদীরা মানুষ খুন করছে। মিসরেও তাই। রাষ্ট্র তাদেরকে উৎসাহিত করছে না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাঁরা আছেন তাঁরা বরঞ্চ ঘোরতর বিরোধী এই মৌলবাদীদের। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা মৌলবাদীদের যে সাংস্কৃতিক মনোভূমি সেটিকে নষ্ট করতে পারছে না; সেখানেই তাদের ব্যর্থতা; এবং সেই ব্যর্থতার সুযোগেই মৌলবাদের জঙ্গিরূপ ধারণ। আলজেরিয়াতে শাসকশ্রেণি বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত, তারা চালচলনে বলতে গেলে ইউরোপীয়। বঞ্চিত মানুষ এদেরকে ঘৃণা করে। সেই ঘৃণাই ঠেলে দেয় তাদেরকে এদের ইউরোপীয় জীবনযাপনের বিপরীত দিকে, ধর্মীয় মৌলবাদের অভিমুখে। তাদের একাংশ জঙ্গি হয়ে ওঠে। মনে করে ওই পথেই রয়েছে চরিতার্থতা। পরকালে তারা চিরস্থায়ী সুখ পাবে, ইহকালে যদি ধর্মের জন্য প্রাণ দেয়। ইহুদি যুবক ইগার আমির মনে করেছে মানুষ হত্যা করে সে ঈশ্বরের প্রেম লাভ করবে, মুসলিম মৌলবাদীরাও তেমনি মনে করে। ঈশ্বরের ধারণাটা স্বতন্ত্র হতে পারে, কিন্তু চরিতার্থতা লাভের স্বপ্নটা একই। মিসরেও দরিদ্র মানুষ প্রচুর। তারা মনে করে ধনীরা পাপী। দরিদ্ররা পাপের পথ পরিহার করে যেতে চায় মৌলবাদের পবিত্র পথে।

পাকিস্তানও বিপদে পড়েছে মৌলবাদীদের নিয়ে। ওই রাষ্ট্রের ভিতটাই মৌলবাদী। একাত্তরে তারা বাঙালি হত্যা করেছে, বাঙালিদেরকে কাফের মনে করেছে। জেনারেল জিয়াউল হক ভুট্টোকে ফাঁসি দিয়ে পবিত্র পাকিস্তানকে আরও পবিত্র করেছিল। আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটিয়ে সেখানে মুসলিম মৌলবাদীদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে মুজাহিদদের আশ্রয়ভূমি হিসেবে পাকিস্তান কাজ করেছে সানন্দে। এজন্য টাকাও পেয়েছে প্রচুর– আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে। যুদ্ধের ডামাডোলে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা করে ব্যবসায়ীরা তো বটেই সেনাবাহিনীর বড়ো বড়ো কর্তাও প্রচুর পয়সা করেছে। এতে দেশ পড়েছে মুশকিলে, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা প্রবল হবার ফলে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আর মৌলবাদীরা তৎপরতা শুরু করেছে মারাত্মকভাবে। তারা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার ষড়যন্ত্র করে প্রায়শই। ইসলামাবাদে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় নামে যে প্রতিষ্ঠানটি আছে সেটি আসলে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয়; দেশি-বিদেশি মৌলবাদী জঙ্গিদের লালনভূমি বটে। পাকিস্তানের মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষা পেয়ে সুযোগ্য আফগান তালেবানরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

বাংলাদেশেও মৌলবাদীরা তৎপর ছিল একাত্তরে, ওই পাকিস্তানিদের ছত্রছায়ায়। আবারও তারা জঙ্গি হচ্ছে। এখানেও মাদ্রাসা শিক্ষাকে অত্যন্ত বেশি উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। দেশবাসীকে ভাবতে হবে। তারা একাত্তরে একবার যা দেখেছে, নিশ্চিত যে আর-একবার তা দেখতে চায় না। মুশকিল এই যে, বুর্জোয়া দলগুলো মৌলবাদীদেরকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। বি এন পি এদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল, আওয়ামি লিগ এদেরকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করেছে। আর জাতীয় পার্টির তো কথাই নেই, তারাই তো এদেশে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করেছে। মৌলবাদী জঙ্গিদের মুখোমুখি হবার ব্যাপারে এই রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ভরসা করা সঙ্গত নয়; এরা একে কোনও সমস্যাই মনে করে না, বরঞ্চ প্রশ্রয় দেয়। আসলে এরা একই প্রভুর ভৃত্য, যে প্রভুর নাম পুঁজিবাদ। এদের শাসনে দেশে যে হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে ও হতে থাকবে সেই মনোভূমিতে সন্ত্রাসের জন্ম যেমন সহজ, জঙ্গি মৌলবাদের জন্মও তেমনি কঠিন নয়।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান