অশুভের সাথে আপসবিহীন দ্বন্দ্ব চাই…

In the dark times,                                                                                                       will there also be singing?                                                                                           Yes, there will be singing                                                                                         about the dark times.
–Bertolt Brecht, “Motto”

বিলিয়নেয়ার নিক হানাউয়ের সতীর্থ জিলিয়নেয়ারদের সতর্ক করে লিখছেন– ‘No society can sustain this kind of rising inequality. In fact, there is no example in human history where wealth accumulated like this and pitchfork didn’t eventually come out. You show me a highly unequal society, and I will show you a police state. Or an uprising.’

দুই শতাংশ ধনকুবেরের হাতে ৯০-৯৫ শতাংশ দেশজ ধনসম্পদ কুক্ষিগত– প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে OXFAM রিপোর্ট। নব্য উদারবাদী ধনতন্ত্রের সংকট ক্রমঘনায়মান। চূড়ান্ত আর্থিক-সামাজিক বৈষম্য, ক্রমবর্ধমান বেকারি, কর্মসংকোচন, জীবিকার সন্ধানে অভিবাসী স্রোত, উদ্বৃত্ত শ্রমবাজারে মজুরি মূল্য হ্রাস, সরকারি চাকরির স্থলে ন্যূনতম বেতনে চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ, সর্বোপরি কল্যাণমূলক দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাকৃত অব্যাহতি গ্রহণ জনতার মৃত্যুকে প্রতিদিন সুনিশ্চিত করে চলেছে। অভুক্ত, নিরক্ষর, রোগাক্রান্ত অশান্ত মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বেড়ে চলেছে উত্তরোত্তর। ক্রুদ্ধ জনতা বেঁচে থাকার তীব্র প্রতিকূল ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাইছে। ফিনান্স ক্যাপিটালের স্বার্থবাহী শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন তাদের মানুষী মর্যাদায় বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সর্বব্যাপ্ত অর্থনৈতিক সংকট ও মানবীয় অবমাননার এই পরিসরে একনায়কের আবির্ভাব অথবা সমাজ বদল– দ্বিবিধ সম্ভাবনা উন্মুক্ত করছে। বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনের শক্তিক্ষয়, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের দুর্বলতা আমূল সমাজবিপ্লবের বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ। সেক্ষেত্রে ধান্দার পুঁজি ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রের সঙ্গে আঁতাত করে; উঠে আসেন নব্য-ফ্যাসিবাদী একনায়কেরা, একচেটিয়া পুঁজির রক্ষক যাঁরা। লৌহমানব, সর্বহারা জনতার মসিহা নির্দেশ দেন– ‘Don’t target the rich, Turn your guns against the socially marginal.’ জাতীয় পতাকার দমকে, জাতীয় সংগীতের ধমকে, জাতীয় নেতার বজ্রগর্জনে জঠরের জ্বালা ভুলে জনগণ ঘরে-বাইরে শত্রু খুঁজে ফেরে। ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের ‘অপর’ (other) অস্ত্রে শান দিয়ে ভারতে, তুরস্কে, ইতালি-জার্মানিতে, আমেরিকায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নব্য-ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব চোখ রাঙায় তাই।

বিদ্বেষে খণ্ডিত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার ঘৃণা, ক্রোধকে বিপথে চালিত করে জনবাদী শাসক কোনও বিমূর্ত মতাদর্শ হাজির করেন না দেশবাসীর কাছে। শত্রুরূপে যে ‘অপর’-কে দাগিয়ে দেওয়া হয়, ‘যাদের’ জন্য প্রকৃত স্বদেশবাসীর জীবন-জীবিকা বিপন্ন, ‘তারা’ একান্ত দৃশ্যমান, সহনাগরিক। সংখ্যালঘু, মুসলমান, রোহিঙ্গা, নিগ্রো, মেক্সিকান, উদ্‌বাস্তু শরণার্থী তারা। এবং শহুরে নকশাল, যুক্তিবাদী বুদ্ধিজীবী, পরিবেশবাদী, প্রান্তিক যৌনতার মানুষজন, স্বাধিকারে সরব নারীবাদী। এই ‘অপর’-দের প্রতি হিংস্র আক্রমণ, গণপিটুনি অথবা তাদের ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ নাগরিকে পর্যবসিত করার যাবতীয় কার্যক্রমকে রাষ্ট্রের তরফে উৎসাহ দেওয়া, ক্ষেত্র বিশেষে আইনি বৈধতা অর্জনের প্রচেষ্টা নাৎসি ‘pogrom’-কে স্মরণ করাচ্ছে। ফ্যাসিস্ত, নাৎসি শাসনের সময়কালের ঝটিকাবাহিনীর (stormtrooper) স্থলাভিষিক্ত হয়েছে দক্ষিণপন্থী ট্রোলবাহিনী। প্রগতিশীল যে-কোনও চিন্তা, সরকারি পদক্ষেপের প্রতি প্রশ্ন, সমালোচনা, সংশয় প্রকাশকে দেশের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক রূপে চিহ্নিত করে অ্যালগরিদমের চক্করে টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে। ক্রমাগত সচেতন মিথ্যা ভাষণে (ওয়াশিংটন পোস্ট-এর ফ্যাক্ট চেক কলাম হিসাব করে দেখিয়েছে তদানীন্তন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প দিনে গড়ে প্রায় ১৫টি মিথ্যা জনগণের উদ্দেশে জ্ঞাপন করতেন। ২০১৭ সালের ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৭৬৪৫টি মিথ্যা বাক্য বা প্রসঙ্গের তিনি অবতারণা করেছেন, এই বিষয়ে প্রমাণ দেখিয়েছে পত্রিকাটি। রাজনৈতিক দলগুলির কুৎসিত অভিযোগ, জুমলা নিয়েই তো আমরা ভোটের লাইনে দাঁড়াই) এক ধরনের বিপন্ন উদ্‌বেগবাতিক দিয়ে ঘিরে ফেলা হচ্ছে জনগণকে। যুক্তি তর্ক নয় আবেগ, কুসংস্কার, অবৈজ্ঞানিক চেতনাকে হাতিয়ার করছে নব্য-ফ্যাসিবাদীরা। জনবাদী সংস্কৃতিতে বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীরা এলিট তথা ‘অপর’ রূপে নিন্দিত। এখানে প্লাস্টিক সার্জারি, নলজাতক শিশুর আবিষ্কারকে পুরাণ-সাহিত্যের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। টিকা বিরোধী আন্দোলনে উৎসাহ প্রদান করেন রাষ্ট্রনেতা। জলবায়ু পরিবর্তনের অশনি সংকেতকে তাচ্ছিল্য করে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পক্ষে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেন নিয়ো-ফ্যাসিজমের পোস্টার বয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের তোয়াক্কা না করে আধুনিক খাণ্ডবদাহনে আমাজনের জঙ্গল পুড়তে থাকে ক্ষুধামান্দ্য অগ্নিউন্নয়নের উদরপূর্তির কোলাটারাল ড্যামেজ স্বরূপ। বিবর্তনবাদ, জিন সংক্রান্ত গবেষণা, পরিবেশ বিজ্ঞানের সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। ডারউইন তাই পাঠক্রম থেকে বাদ পড়েন। একশিলীয় অতীত ইতিহাস নির্মাণের জন্য ডাক পড়ে পেটোয়া নৃতত্ত্ববিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক ও পার্টিজান ইতিহাসবিদের। স্বর্ণালি অতীত নির্মাণকল্পে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে ইতিহাসের ধারাক্রম। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেশবাসীর কাছে ফেরি করে জনগণকে বেপথুমান করার যোগসাজশে লিপ্ত হয়েছে নিয়ো-লিবারাল ক্যাপিটালিজম ও নিয়ো ফ্যাসিজম। মানুষের অধিকার কেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানসমূহ আক্রান্ত প্রতিনিয়ত। ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাক্‌স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকারকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার নামে দমন করা হচ্ছে। জনগণ উত্তর-সত্যের ল্যাবিরিন্থে আটক। পোষ্য অনুগত মিডিয়া সত্য তথ্য উদ্‌ঘাটিত না করে সরকারি আখ্যান ও প্রপাগ্যান্ডা প্রচারে সক্রিয়। মিথ্যা, অসম্পূর্ণ তথ্যকে সত্যের মোড়কে হাজির করছে Whatsapp, Facebook, ফেক নিউজ ওয়েবসাইট। টিভি-নভেলা জনগণের কাছে সম্মতি আদায় করে নেয় ‘Anti-National’-দের অন্তর্ঘাতের বিপরীতে একনায়ক শাসকের লৌহদৃঢ় চারিত্রিকতার স্বপক্ষে। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা থেকে জনমত সমীক্ষায় নির্বাচনে হস্তক্ষেপ ঘটে চলেছে। নোয়া হারারি এক সাক্ষাৎকারে যথার্থ বলেছেন– ‘Politics becomes the struggle to control the flows of data. And dictatorship now means that too much data is being concentrated in the hands of the government or of a small elite.’ সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল দখল করেছে বৃহৎপুঁজি। কর্পোরেট মিডিয়ায় শত্রু উৎপাদন হয় সরকারের অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী। আমাদের তো জানাই আছে– সর্বদা শত্রু ও শত্রুতায় ফ্যাসিবাদ বেঁচে থাকে (Fascism celebrate enmity and enemy.)। ভারতীয় প্রেক্ষিতে শাসকের ধামাধরা গণমাধ্যমের ন্যক্কারজনক ভূমিকা সম্পর্কে রবীশ কুমার লিখছেন– ‘Since information and questioning are the basis of citizenship and solidarity, the possibility of either has been severely curtailed. Our mainstream media does not question the government; on the contrary, it interrogates the people on behalf of the government!’ শাসকের প্রতি দ্বিধাহীন বাধ্যতা, বৈচিত্র্যবিহীন সমরূপ সংস্কৃতিতে আত্মসমর্পণের জন্য ভয় উদ্‌গার করে চলে বশংবদ মিডিয়াকুল। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার আর্থ-রাজনীতি যে মানুষের অস্তিত্ব সংকটের মূলে– এই প্রকৃত সত্য আড়ালবর্তী। সরকার ঘোষিত নতুন নতুন ‘অপর’ শিকারি উন্মত্ত জনতার বিবেচনায় আসে না– কর্পোরেট বন্ডের মূল সুবিধাভোগী কারা, ইজরায়েলি শিল্পপতির আনুকূল্য অর্জন করে কোন আমেরিকান শিবির; সমান্তরালে ক্ষুধার্ত, কর্মহীন জনতা আলোড়িত হয় না এই প্রশ্নে– ইতর ধনবৈষম্যের পরেও কেন কর্পোরেটদের ওপর সম্পদ কর ধার্য হয় না, মুনাফাখোরদের বাঁচাতে সরকারি সহযোগিতায় Bailout উপুড়হস্তে অপেক্ষা করে থাকে কেন। Krupp, Thyssen-এর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে নাৎসি জার্মানির মিলিটারিকরণ সম্পূর্ণ হওয়ার কথা, হিটলার কর্তৃক I. G. Farlen এবং Bayer কোম্পানিকে ভর্তুকি প্রদান থেকে কর ছাড় দেওয়ার কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়। ফ্যাসিস্ত ইতালিতে Fiat, Pirelli, Eni, Enel; সাম্রাজ্যবাদী জাপানে Mitsubishi, Toyota, Honda, Sumitomo কোম্পানিগুলি বৃহৎ শিল্প ও আধুনিক অস্ত্রপ্রযুক্তির মাধ্যমে যে Industrial Military Complex গড়ে তুলেছিল সেখানে ফ্যাসিবাদী শক্তি ভর্তুকি প্রদান করে, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে নিষিদ্ধ করে, কিঞ্চিন্মাত্র মজুরিতে বাধ্যতামূলক শ্রমদানের মাধ্যমে যোগ্য সঙ্গত দেওয়ায় ইতিহাস স্মর্তব্য। সুতরাং ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের সমস্ত রকম বৈশিষ্ট্য হাতিয়ার করেই বিভিন্ন দেশে নব্য-ফ্যাসিবাদী প্রবণতা প্রভিন্ন মাত্রাবৈগুণ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে নিঃসন্দেহে। পুঁজির সংকটকালীন পর্বে গণমনস্তত্ত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে, জনগণের ধর্মীয় চেতনা, সাংস্কৃতিক স্বাজাত্যের গৌরব, পৌরাণিক মিথ, সংস্কার, বিশ্বাস, আবেগকে ব্যবহার করে ফ্যাসিবাদী হেজিমনির নির্মাণ এবং কল্পিত ‘অপর’-কে (ইসলামোফোবিয়া, পাশ্চাত্য সাদা শয়তানকে আসামি করে) সমস্ত বিপদ, দুর্গতি, অবিচারের মূল রূপে অভিযুক্ত করে আদিম ঘৃণার উৎসারের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ সুচতুরভাবে পুঁজিকেই সুরক্ষিত রাখে– ঐতিহাসিক এই বোঝাপড়া নব্য-উদারবাদী পুঁজি ও নব্য-ফ্যাসিবাদী শাসকের অপ-আঁতাতের বর্তমানেও জারি আছে। উপস্থিত হুমকি তাই নিয়ো-ফ্যাসিজম এবং তার চালিকাশক্তি নিয়ো-লিবারাল ক্যাপিটালিজম।

ইতালির Lega Nord, ফ্রান্সের National Rally, জার্মানির Alternative for Germany (AFD), গ্রিসের Golden Dawn, নেদারল্যান্ডের Party for Freedom, সুইডেনের Sweden Democrats, অস্ট্রিয়ার Freedom Party এবং স্লভাকিয়ার People’s Party– Our Slovakia ইউরোপে নব্য-ফ্যাসিবাদী ভাবাদর্শকে বিস্তৃত করছে। প্রত্যেকটি দক্ষিণপন্থী পার্টি ইসলাম ও শরণার্থী অভিবাসনের বিরোধী। বিদেশিদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য কেউ কেউ উগ্র জাতীয়তাবাদের হয়ে সওয়াল করে। আমেরিকার শ্বেত বর্ণবাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে KU Klux Klan, alt-right, Proud Boy। দেশে নিগ্রো, মেক্সিকান ও ইসলামি শক্তিকে বিনাশ করে শ্বেত-শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপন– এই দলগুলির কখনও গোপন কখনও প্রকাশ্য কর্মসূচি। গণতন্ত্র ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ঘোর বিরোধী তারা। ব্রাজিলে বোলসোনারো আদিবাসী, LGBTQ+ মানুষের অধিকার দুরমুশ করেছেন তাঁর শাসনকালে। দেশজ সম্পদকে কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দিয়েছেন। তুরস্কের এর্দোয়ানের একনায়কতান্ত্রিক শাসন বিরুদ্ধ স্বরকে নির্মমভাবে দমন করে চলেছে। স্বৈরাচার সেখানে এখন স্বাভাবিকত্ব অর্জন করেছে। ভারতবর্ষে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শে অনুপ্রাণিত, তাদের সাংগঠনিক গঠন পদ্ধতি অনুসরণ করে হিন্দু জাতীয়তাবাদ জাগরণে, ‘হিন্দি, হিন্দুত্ব, হিন্দুস্তানের’ মতাদর্শীয় চেতনায় হিন্দুরাষ্ট্রবাদের ভিত স্থাপনে সক্রিয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও তার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক শাখা সংগঠন। ‘হিন্দুর হৃদয় সম্রাট’ নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির শাসনামলে ধর্মীয়-অসহিষ্ণু দেশ রূপে ভারতের স্থান চার নম্বরে (পিউ রিসার্চ,২০১৭); সংবাদপত্রের স্বাধীনতার মাপকাঠিতে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৬১ নম্বরে (আরএসএফ, ২০২৩), পাশাপাশি বেকারদের মধ্যেও ৮৩ শতাংশ যুব সম্প্রদায়ের (৭৬.৭ শতাংশ শিক্ষিত যুবক ও ৬২.২ শতাংশ শিক্ষিত যুবতি– আইএলও)। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে গুরুতর ক্ষুধার তীব্রতা সহ ভারতের স্থান ১১১তম। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স (GHI-2023) জানাচ্ছে এদেশে শিশুদের অপুষ্টির হার ১৮.৭ শতাংশ। ২০২৪ সালের একটি সমীক্ষা অবশ্য অন্যরকম, যাঁকে বলতে পারেন ‘ধনগরিমার ইতরতার’। ফোর্বসের ধনকুবের তালিকায় ২০০ জন ভারতীয় জায়গা করে নিয়েছে এই বছর। বিগত বছরের থেকে ৪১ শতাংশ সম্পদ বৃদ্ধি পেয়ে বিলিয়নেয়ারদের সম্মিলিত সম্পত্তি দাঁড়িয়েছে মোট ৯৫৪ বিলিয়ন ডলার। কালনিরূপণ বিদ্যায় বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই, কর্পোরেট ইলেকট্ররাল বন্ডের হিসাবটা মিলিয়ে দেখলেই কর্পোরেট পুঁজির সঙ্গে ব্যক্তিঅর্চনা (The cult of personality) সম্পর্কিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরস্পর নির্ভরশীল রসায়ন বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

নিয়ো-ফ্যাসিজম বর্তমান ও আগামী পৃথিবীর মূর্তিমান বিপদ। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, জ্ঞানবিজ্ঞানের মানবকল্যাণ ভিত্তিক অগ্রগতি ও সহাবস্থানের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বিনাশী মতাদর্শ রূপে ক্রিয়াশীল ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংস্রতার এই আর্থ-রাজনীতিক এবং অবশ্যই সাংস্কৃতিক দর্শন। একমাত্র অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রক রূপে পরিগণিত করলে প্রতিরোধের কর্মসূচি ব্যর্থ হতে বাধ্য। ফ্যাসিবাদের হেজিমনির পালটা গণতান্ত্রিক, উৎকট বৈষম্যবিহীন, সমন্বয়ধর্মী সাংস্কৃতিক চেতনার হেজিমনি গড়ে তুলতে হবে। শ্রেণি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে পরিচিতিসত্তার দাবি, নিপীড়নের হীনম্মন্যতার বিরুদ্ধে মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবি, নারীর সমান অধিকারের দাবি, প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের লিঙ্গকেন্দ্রিক সাম্যের দাবি, পরিবেশ বাঁচানোর ঐকান্তিক সংগ্রাম। গণমানুষের সম্মেলনের যৌথ লড়াই ফ্যাসিজমের আধিপত্যবাদী আগ্রাসনকে প্রতিহত করতে পারে। সম্প্রতি ও বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ফ্রান্স, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, টিউনিজিয়া, চিলি, ভেনেজুয়েলায় চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি পরাভূত হয়েছে। ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শত্রু-চিহ্নিতকরণের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে বারংবার। ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে প্রমাণিত যে, মানুষ এখনও তার এযাবৎ অর্জিত সুচেতনায় মানুষিক অধিকারে বাঁচতে চায়।

গাজার গণহত্যার বর্ষপূর্তি এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কিত সম্ভাবনার মৃত্যু পরিকীর্ণ সময়ে অভিক্ষেপ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যার বিষয়– প্রসঙ্গ ফ্যাসিবাদ : পর্বান্তরে রূপান্তরে। ফ্যাসিবাদ কী, কেন, কখন, কীভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, করে চলেছে– মূলগত প্রশ্নাবলি কেন্দ্র করে বিবিধ বিস্তার– আলোচনার মূল অবলম্বন। স্বদেশ-বিদেশে সংগঠিত ফ্যাসিবাদী বিপজ্জনক কর্মকাণ্ডের প্রতিফলে গণতান্ত্রিক অধিকার, মানুষের মর্যাদা ও সমানাধিকারে বাঁচার যে-সমস্ত প্রশ্নে আমরা ভাবিত, সেই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কী; প্রত্যাঘাতের, সংগ্রামের ঐতিহাসিক শিক্ষা ও অনুপ্রাণনাই-বা কী– সম্মিলিতভাবে উত্তর খোঁজার প্রয়াস করা হয়েছে বর্তমান সংকলনে। পাঠক আপনিও এই দুঃসময়ে বিচলিত নিশ্চিত: আসুন একত্রিত হয়ে চিন্তন-কর্মের যৌথচর্চায় ভেবে দেখি–

  • পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব ও বিকাশের যেমন ভিন্নতর প্রেক্ষিত রয়েছে, কালপ্রবাহে তার প্রকাশভঙ্গিতেও নানা পরিবর্তন ঘটেছে। সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী?
  • ইদানীংকালের নানা রাজনৈতিক ভাষ্যে নব্য ফ্যাসিবাদ প্রসঙ্গ বহুল ব্যবহৃত। এ-কে ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদেরই বিকাশমান রূপ হিসেবে আমরা দেখব, না কি প্রেক্ষিতগত ভিন্নতর দিকটিকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে একে সম্পূর্ণ এক নতুন রাজনৈতিক প্রকরণ হিসেবে বিচার করব?
  • নয়া উদারবাদী অর্থনীতির সঙ্গে নয়া ফ্যাসিবাদের সম্পর্ক কী প্রকার? পুঁজিবাদী সংকটের সময়ে যেমন ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়েছিল, তেমনই উদারবাদী অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষিতেই কী নয়া ফ্যাসিবাদের এক প্রেক্ষিত তৈরি হচ্ছে?
  • ইউরোপ সহ বিশ্বের অন্যত্র আজ সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ এবং উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাসিবাদ ধীরগতিতে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রোটো-ফ্যাসিবাদী ধারণাগুলিও বর্তমান সময়ে ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছে। ইতালি সহ হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ডে প্রোটো-ফ্যাসিস্ট বাহিনী সরকারে ভালোভাবেই নিযুক্ত রয়েছে। সুইডেন, ফ্রান্স এবং জার্মানিতেও চরম ডানপন্থী দলগুলি নির্বাচনি রাজনীতিতে যথেষ্ট সাড়া জাগিয়েছে। এর মূল কারণ কী?
  • ফ্যাসিবাদ কীভাবে সাধারণ জনগণের থেকে ঘৃণার সপক্ষে সম্মতি আদায় করে, অর্থাৎ, ফ্যাসিবাদের গণমনস্তত্ত্ব বোঝার উপায় কী? 
  • সাধারণভাবে এই ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, গণতন্ত্র পরিপক্ক হলে ফ্যাসিবাদের মৃত্যু হয়, কিন্তু বর্তমান সময়ে গণতান্ত্রিক পরিসরকে কাজে লাগিয়েই তথাকথিত নব্য ফ্যাসিস্টদের উত্থান ঘটছে, এই ধাঁধার উত্তর কী? 
  • ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদী ধারণায় একজন কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তিত্ব গুরুত্ব পেয়েছেন, যিনি সমস্ত সামাজিক কুফল দূর করার জন্য সহজ সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন; তাঁকে এমন একজন হিসাবে দেখা হয় যিনি জনগণের মূল্যবোধ এবং ভয়কে বোঝেন এবং প্রতিফলিত করেন। সমসাময়িক রাজনীতিতে স্বঘোষিত শক্তিশালী নেতাদের রাজনীতিতে যেমন,  ট্রাম্প, পুতিন, মেলোনি, এরদোগান, বোলসোনারো, নেতানিয়াহু ও মোদির মধ্যে এই ধারণা কতটা সক্রিয়? 
  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনে নব্য-ফ্যাসিস্ট আন্দোলনগুলি সর্বদা একটি শক্তিশালী বর্ণবাদী পক্ষপাত দেখিয়েছে, আবার ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে অনুরূপ ফরাসি দলগুলিও আলজেরিয়ানদের বিরুদ্ধে ছিল, সুইজারল্যান্ডেও এই ধারণায় বিদেশি কর্মীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। বর্তমান সময়ে এই বিদ্বেষের কেন্দ্রবিন্দু কী মুসলিম, অভিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা (বাংলাদেশ, পাকিস্তানে যেমন হিন্দুরা)? শত্রু চিহ্নিতকরণ তো আবার ফ্যাসিবাদী ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু।
  • বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পণ্ডিতদের অনেকে উগ্র দক্ষিণপন্থা ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে একটি তীব্র পার্থক্য প্রত্যক্ষ করেন। এঁরা মূলত অর্থনৈতিক পার্থক্যকে গুরুত্ব দেন। বাস্তবতা কী তাই? এদের মধ্যে মিল বা অমিলগুলি থাকলে সেগুলি কী কী? 
  • ধ্রুপদী ফ্যাসিস্ট দলগুলি প্রযুক্তি বিরোধী হলেও বর্তমানে বিশ্বের তথাকথিত নব্য ফ্যাসিস্ট দলগুলি ফেসবুক, ইউটিউব বা এক্স মাধ্যমে নিজেদের প্রচারের জন্য বিপুল অর্থ খরচ করে। তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি কী ফ্যাসিবাদের প্রপাগ্যান্ডায় মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে অধিক সহায়ক হচ্ছে? এর বিরুদ্ধে লড়াই হবে কীভাবে? বিকল্প হেজিমনি তৈরিতে প্রযুক্তির সহায়তা অনিবার্য নয় কী?
  • যে ইহুদি জাতি ফ্যাসিবাদের বলি হল, সেই ইহুদি রাষ্ট্রই আজ গণহত্যায় শামিল হয়ে ফিলিস্তিনি জনতাকে নিশ্চিহ্ন করে প্যালেস্টাইনের জনপদকে দখল করে নিতে চাইছে– বর্বরতার এই কার্যক্রমে ইজরায়েলি আগ্রাসনের মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলি কী হতে পারে?
  • বর্তমানে ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার আত্মপ্রকাশ ও কার্যক্রমের সম্পর্ক কী?
  • নয়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে ইউনাইটেড ও পপুলার ফ্রন্ট গঠনের প্রয়োজনীয়তা কী আজ সময়ের দাবি নয়? রাজনৈতিক মতাদর্শগত ছুৎমার্গিতা কাটিয়ে উঠে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির একত্রিত হওয়ার প্রয়োজনীতা তো আজ বাস্তব; বামপন্থীদের দায়িত্ব এখানে কতটা?
  •  ইউনাইটেড ও পপুলার ফ্রন্টের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার কর্মসূচিতে কী কী বিষয় প্রাধান্য পাওয়া উচিত?
  • দেশে-বিদেশে নব্য ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে বুদ্ধিজীবীদের কীরূপ ভূমিকা আমরা দেখছি? এই প্রসঙ্গে গ্রামশির ভাবনা দিক্‌নির্দেশক হতে পারে?

সর্বোপরি, ফ্যাসিবাদী চেতনার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত আমরা সতর্ক থাকব কীভাবে? কেননা, প্রতিদিনের ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনে আমরা সচেতন অথবা অচেতন অজানতে ফ্যাসিবাদী চেতনায় সমর্পিত হয়ে চলি। কেন? অপরিহার্য ও এই প্রাথমিক জিজ্ঞাসার উদ্দিষ্ট কিন্তু স্বয়ং নিজেরা।

চব্বিশের অস্থির সময়ে উপদ্রুত কলকাতা একাত্তরের বুক থেকে উঠে আসা যুবক মুখোমুখি হয়ে অভিযুক্ত করছে আমাদের–

এত নিশ্চিত কেন আপনারা? এত নিস্পৃহ কেন, এত অন্ধ কেন, এত জড় কেন? আপনারা এই দেশের মানুষ না, আপনাদের ইচ্ছে করে না আমার এই ভয়ংকর মৃত্যুর জন্য আপনারা যন্ত্রণা পান? ইচ্ছে হয় না ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যান? হতাশায় কষ্টে রাগে শরীর রিরি করে ওঠে?

দুঃসময়ে নাগরিকদের সিদ্ধান্ত নিতেই হয়– আপস না রাজপথ! ফ্যাসিবাদ না গণতন্ত্র?

সহায়:

Ravish Kumar, ‘The Free voice on Democracy, Culture and the Nation’, New Delhi, Speaking Tiger, 2019

Shivam Shankar Sing, ‘How to win an Indian Election’, Haryana, An imprint of Penguin Random House, 2019

Swati Chaturvedi, ‘I am a Troll’, New Delhi, Juggernaut, 2019

Vijay Prashad (Ed.), ‘Strongmen’, New Delhi, Left Word, 2020

ইউটিউব ভিডিও: Prabhat Patnaik speaks on ‘Neo-Liberalism and Neo-Facism’

                 [লিংক: https://youtu.be/S6a9ZJp5jHM?si=B5TVp0itfj1nwT0G]

                 শোভনলাল দত্তগুপ্ত – ‘ফ্যাসিবাদ ভাবনা : একটি অনুসন্ধান’ 

                 [লিংক: https://youtu.be/VSRe3yjU2vw?si=q6xB1FrkZIVggLvi]

চলচ্চিত্র: মৃণাল সেন, ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান