চন্দন সেন
হিটলার মুসোলিনির কালে ভারতে বা বাংলায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রথম ও প্রধান সোচ্চার কণ্ঠ ছিল রবীন্দ্রনাথের। ১৯২০ সাল থেকেই ফ্যাসিবাদের উত্থানের কালে ফ্যাসিবাদ ঘিরে রবীন্দ্রনাথের কন্ঠ দীপ্ত না হলেও সময়ের নিরিখে গুরুদেবের বুঝতে অসুবিধা হয়নি ফ্যাসিবাদের বিপদকে। রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত আর দু-জন বাঙালি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গত শতাব্দীর দুয়ের দশক থেকেই বিশেষরকমভাবে সোচ্চার ছিলেন। তাঁরা হলেন অমিয় চক্রবর্তী এবং অন্নদাশঙ্কর রায়। উগ্র জাতীয়তাবাদ যে দেশ-কাল-সমাজের একটা ভয়ংকর ক্ষতি করতে পারে, এই ধারণায় ভারতবাসীকে সতর্ক করবার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, সমসাময়িক কালে প্রত্যক্ষ রাজনীতির অঙ্গনে থাকা, বা না থাকা, কোনো ব্যক্তিত্ব তেমনভাবে করেছিলেন কিনা সন্দেহ। ফ্যাসিবাদের যে তথাকথিত শৃঙ্খলাবদ্ধ একটা দিক, জাতীয়তাবাদী প্রবণতার ভেতর দিয়ে মানুষকে একটা অন্য পথে চালনা করবার দিক– সে সম্পর্কে প্রথমে এক ধরনের মুগ্ধতা রেখেও, খুব সহজেই রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন, এই দৃষ্টিভঙ্গির কদর্যতার দিকগুলিকে। ১৯২৬ সালে ফ্যাসিবাদের যে তথাকথিত সম্মোহন, তা প্রথমে রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করলেও, তাঁর সেই ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। রবীন্দ্রনাথের যখন এ ধরনের সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা গড়ে উঠছে ফ্যাসিবাদের বিকাশের একদম প্রথম যুগে, সেই সময়কালে অমিয় চক্রবর্তী শান্তিনিকেতনই আছেন। কিন্তু ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ ভ্রমণের সঙ্গী হয়ে, নিজের চোখে যা অমিয় চক্রবর্তী দেখলেন, তা তাঁর দৃষ্টির দুনিয়াকে এক আধুনিক চশমা পরিধানের সুযোগ এনে দিল। এই সময় অমিয় চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাশিয়াতেও গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠির পাশাপাশি সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ঘুরে এসে অমিয়বাবু ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার ১৩৩৮ সালের মাঘ ফাল্গুন সংখ্যায় (১৯৩২) সোভিয়েত ভ্রমণের এক বিস্তৃত বিবরণী লিখলেন। বিচিত্রা পত্রিকায় অমিয় চক্রবর্তীর এই রাশিয়া ভ্রমণের বিবরণী, একে গুরদেবের রাশিয়ার চিঠির পরিপূরক বললে মনে হয় না ভুল হবে। (সূত্র : আজকাল, রবিবার : নিবন্ধ– শ্যামলী ভট্টাচার্য)
রবীন্দ্রনাথের মতোই ইতালির মুসোলিনি প্রবর্তিত ফ্যাসিবাদ নিয়ে প্রাথমিকভাবে সম্মোহিত হয়েছিলেন ইতালি তথা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক নাট্যকার তথা লেখক লুইগি পিরানদেল্লো। আজ থেকে বছর ৫-৬ আগে পিরানদেল্লোকে নিয়ে মানে, তাঁর যাপন, প্রেম, ব্যর্থ বিয়ে আর আত্মক্ষয়ী রাজনীতি নিয়ে একটি জীবনী নাট্য লেখার উন্মাদনা আমায় পেয়ে বসেছিল। কয়েক দশক আগে নান্দীকার-এর ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’ আমার ৪-৫ বার দেখা হয়ে গেছে। জীবনী নাট্য লিখতে গিয়ে মূল নাটকটি (ইংরাজি তর্জমায়) পড়ে দেখলাম; যৌবনের চমককে থাপ্পর দিয়ে পিরানদেল্লোর আসল ভাষ্যটিকে আরও অনেক শক্তিশালী মনে হল। এহেন একজন ক্লান্তিহীন ভাবুক, জীবনের জটিল আর সরল আঁকাবাঁকা পথ খোঁজা দার্শনিক, ফ্যাসিবাদের সমর্থক হয়ে পড়লেন কীভাবে ও কেন? গলার জোরে, মনের জোরে, পারলে গায়ের জোরে, ইতালির বাকি সব ফ্যাসিবাদ বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের তিনি ধমক দিয়ে বলে চললেন, “আমি অরাজনৈতিক। আমি শুধু দেশের ভালো চাই, যুদ্ধবিধ্বস্ত ও নানা সমস্যা জর্জর দেশের কল্যাণ চাই বলেই আমি মুসোলিনি ও তাঁর দেশপ্রেম-দৃপ্ত মৌলিক মতবাদ— ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করি।” ১০০টি ছোটোগল্প ও প্রায় ৪০টি নাটক পিরানদেল্লোকে ইতালিয়ান আধুনিকতাবাদের মুখ্য কান্ডারি হিসেবে পরিচিত করেছে। ১৯৩৪ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন। তার আগে ফ্যাসিবাদের উগ্র সমর্থক হয়ে মুসোলিনির কাছ থেকে বিপুল অর্থ সম্মান আর দুনিয়া জুড়ে নাটক দেখানোর সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিলেন পিরানদেল্লো। মুখে বলে চললেন আমি অরাজনৈতিক, কমিউনিস্ট নই, সোশ্যালিস্ট নই, সত্যি বলতে কি আমি কিছুই নই। পিরানদেল্লোর দাম্পত্য জীবন ঘিরে যেমন ঘোর অসুখ তেমনই ফ্যাসিবাদের প্রতি আরোপিত সমর্থনও যখন তাঁকে ধীরে ধীরে অস্থির করে তুলছে তখন পরপর লিখে চললেন, ‘Mountain Giants’ সহ অনেক নাটক,— অনেক অনুতাপ-দগ্ধ রচনা। মৃত্যু পর্যন্ত পিরানদেল্লোর মতো যুগান্তকারী প্রতিভা লোভের হাতে পড়ে দুর্ভাগ্য আর অনুতাপের পাপেট হয়ে রইলেন। তাঁর স্ত্রী মালিনা পর্তুলানো তাঁর আগেই মানসিক রোগের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই নিয়েই আমার নাটক ছিল ‘পিরানদেল্লো ও পাপেটিয়ার’।
সমকালের সঙ্গে একটা ব্যাপারে পিরানদেল্লোর কথাটির মিল আছে,— ‘আমি অরাজনৈতিক’…। ফ্যাসিবাদী আবহে কথাটা খুব জনপ্রিয় হয়।
এবার সংক্ষেপে একটু বোঝার চেষ্টা করি ফ্যাসিবাদ ঠিক কোন ধরনের মতবাদ, কোথায় তার আকর্ষণ, কোথায় তার ভয়ংকর পরিণতি। আধুনিক ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আদিম (মুসোলিনি-হিটলার) ফ্যাসিবাদের বেশ কিছু মিল ও প্রচুর অমিল আছে। আমাদের দেশ জুড়ে এখন ফ্যাসিবাদের প্রসঙ্গ ঘন ঘন শোনা যাচ্ছে। একালের এক বিশিষ্ট তাত্ত্বিক (অধ্যাপক শোভনলাল দাত্তগুপ্ত) ফ্যাসিবাদকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁর সূত্র ধরেই সামান্য কিছু গুরুগম্ভীর বক্তব্য হজমের চেষ্টা করা যাক।
ফ্যাসিবাদের আধুনিক জমিটা কেমনভাবে তৈরি হয়। প্রথমটা হচ্ছে, একটা হিংসার সংস্কৃতি তৈরি করা। একটা Culture of Violence, হিংসার বাতাবরণ এমন ভাবেই তৈরি করা হয় যে, মানুষ সেটাকেই মোটামুটি জীবনের অঙ্গ হিসেবে, স্বাভাবিক, সহজভাবে মনে স্থান দেয়; কিছুদিন পরে মানুষ আর এই সব হিংসার ঘটনাগুলো নিয়ে বিচলিত বোধ করে না। এটার জন্য কিন্তু শুধুমাত্র যারা ফ্যাসিবাদী মতবাদে বিশ্বাস করে আমি তাদের দায়ী করছি না। এটার জন্য সবাই দায়ী। যারা এই ধরনের হিংসার বাতাবরণ, হিংসার রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়, তারা সবাই। আমাদের দেশে বেশ কিছু দিন ধরেই এই ব্যাপারটা ঘটছে। সমাজবিরোধী, গুন্ডাবাহিনী, যারা যত রকমের অসামাজিক এবং হিংসাশ্রয়ী কাজের সঙ্গে যুক্ত, তারা প্রায় সবাই বেলাগাম অবস্থায়, বেআব্রু অবস্থায় কতকগুলো মারাত্মক রকমের অপরাধমূলক কাজ করে পার পেয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাদের ধরাছোঁয়া যাচ্ছে না। তারা আবার নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসছে। এইভাবেই আস্তে আস্তে, যেটাকে আমরা ইংরাজিতে lumpenisation (লুম্পেনাইজেশন) বলি, সেটা বৈধতা পাচ্ছে। ভারতবর্ষে এই আবহাওয়া কিন্তু ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন রাজ্যে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও তাই। কাউকেই ছেড়ে কোনো লাভ নেই। মানুষ আস্তে আস্তে এগুলোকেই স্বাভাবিক বলে মনে করতে শুরু করেছে। এই ব্যবস্থাকে কার্যকরী করার জন্য এক ধরনের মস্তানবাহিনী, গুন্ডাবাহিনী, ঝটিকাবাহিনী প্রয়োজন। হিটলারের সময় তাই হয়েছিল, মুসোলিনির সময়ও তাই হয়েছিল। এই ঝটিকাবাহিনী নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে সমাজে এক কথায় যারা লুম্পেন তাদের নিয়ে এই ঝটিকাবাহিনী তৈরি করা হয়েছে।
এবারে প্রয়োজন আরও একটি শর্ত। এটা আমাদের দেশে কিন্তু গত কয়েক বছরে খুব সুন্দরভাবে তৈরি করা হচ্ছে। আপনি মানুষকে যদি অনিশ্চয়তা, এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা, এক ধরনের অনির্দিষ্টতার দিকে ঠেলে দিতে পারেন, তথন কিন্তু স্বাবাভিকভাবে মানুষের মনের মধ্যে একটা তাগিদ থাকবে কোনো একটা জায়গায় নিরাপত্তা খোঁজার। নিরাপত্তা কে দেবে? প্রধানমন্ত্রী আছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আছেন, আপনাদের কোনও চিন্তা নেই। আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন, সব ঠিক হয়ে যাবে। এইভাবে মানুষের সবকিছু সম্পর্কে অনিশ্চয়তাটা যত বাড়ছে, সেখান থেকেই কিন্তু আবার উলটোদিক থেকে কাউন্টার পয়েন্ট তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে যে এগুলো নিয়ে আপনারা এত ভাববেন না। রাজ্য ও সরকার আছে। সব ঠিক করে দেবে। এইভাবেই কিন্তু আস্তে আস্তে একজন ব্যক্তি সম্পর্কে মোহ তৈরি করা হয়। মোহজাল তৈরি করা হয়। একটি প্রশ্ন বামপন্থীদের ভাবায়। যথেষ্ট প্রভাব সত্ত্বেও ফ্যাসিবাদের উত্থানকে বার্মপন্থীরা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন বা হচ্ছেন কেন? ফ্যাসিবাদের মতো একটি মানবতাবাদবিরোধী ভাবাদর্শ জনমানসে ঠাঁই পেলই বা কীভাবে? ফ্যাসিবাদের গণভিত্তির কারণটাই বা কী? ফ্যাসিবাদের বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বামপন্থীদের, কমিউনিস্টদের কি কোনও তাত্ত্বিক খামতি ছিল, যার মাশুল তাঁদের গুনতে হয়েছিল। বিশ-তিরিশের দশকে ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থানপর্বের পর্যালোচনা যদি নির্মোহ দৃষ্টিতে করা যায়, তাহলে এই জটিল প্রশ্নের উত্তর এবং বর্তমান সময়ে এই বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্ট হবে।
বিশ শতকের প্রথম পর্বে এসে আমাদের নাট্য-আন্দোলনের দোলাচল বৃত্তির রেনেসাঁস-প্রভাবিত মানসিকতায় প্রগতি আর পরাগতির মধ্যে বারবার দোল খাওয়া বহমান কিছু যুগান্তকারী ঘটনার অভিঘাতে একটা প্রবল আপসহীন স্থিতাবস্থা-বিরোধী উত্তরণের মুখে এসে দাঁড়াল। ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, আর ১৯১৭ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার বিপ্লব এবং বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার প্রভাব আন্দোলিত করল সারা দুনিয়াকে। বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতবিক্ষত প্রেক্ষাপটেই লক্ষ লক্ষ মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে পরাধীন ভারতবাসীও নতুন বিশ্বাস আর স্বপ্ন নিয়ে ব্রিটিশ শোষণের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। মস্কোতে ১৯২১ সালে ভারতের প্রবাসী কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হবার পর ১৯২৬ সালে ভারতেই এ দেশীয় কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হল। চারদিকে ব্যাপক ধরপাকড়, লাঠি, গুলি চালিয়ে ব্রিটিশ রাজশক্তি এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে দমনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। কংগ্রেসও পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনের ডাক দিল। বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, হরতালে উত্তাল পরিবেশে নাট্যকাররা এগিয়ে এলেন অনেকটাই প্রচ্ছন্ন আর খানিকটা প্রত্যক্ষ প্রতিবাদের নাটক নিয়ে। মন্মথ রায়ের ‘দেবাসুর’ আর ‘কারাগার’ নাটক দু-টিতে পৌরাণিক কাহিনির মধ্য দিয়ে পরাধীন জাতির শৃঙ্খলমোচনের তীব্র ইচ্ছেটা সোচ্চার হয়ে উঠল। ‘কারাগার’ স্থান পেল অত্যাচারী ব্রিটিশের কারাগারে। কিন্তু আগের মতো ইংরেজদের দমন-পীড়ন আর রক্তচক্ষু এই সময়ের নাট্যকারদের আর পিছন দিকে মুখ ঘুরিয়ে দিতে পারল না। যদিও গল্প, কাহিনি বা কবিতার মতো নাট্যমঞ্চে কিন্তু রুশবিপ্লবের প্রভাব ততটা প্রত্যক্ষ ছিল না। তবুও স্বীকার করতেই হয়, মন্মথ রায়, শচীন সেনগুপ্তের নাটকগুলোতে ঐতিহাসিক কাহিনিনির্ভর স্বাদেশিকতার হাওয়া বয়ে আনছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ইচ্ছা-ইঙ্গিত। সমকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতার উপর লেখা ‘দশের দাবি’ (১৯৩৪) কিংবা কৃষি আর শিল্পের পারস্পরিক সম্পর্ক তুলে ধরার সূত্রে সামন্ততন্ত্র আর ধনতন্ত্রের বিরোধের ভিত্তিতে লেখা ‘সংগ্রাম ও শান্তি’ (১৯৩৯) নাট্যকার শচীন সেনগুপ্তের সমাজ-সচেতন বলিষ্ঠতার পরিচয় দেয়। মনোজ বসুর লেখা ‘নতুন প্রভাত’ নাটকেও অর্থনৈতিক শোষণের চিত্রটি দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরা হল। ‘সিরাজদ্দৌল্লা’-র নাট্যকার শচীন সেনগুপ্ত যখন গভীর দেশপ্রেমকে সাম্যবাদী চেতনার আন্তর্জাতিক দিগন্তে পৌঁছে দেন, ‘নরদেবতা’ নাটকে তখন ব্রিটিশ সরকার নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন আরও একবার প্রয়োগ করল ‘নরদেবতা’- র অভিনয় নিষিদ্ধ করার জন্য। চল্লিশের দশক দেশজুড়ে উত্তাল হাওয়ার দশক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধের রসদ সংগ্রহে এই উপনিবেশকে চরম লুণ্ঠনের জন্য ব্যবহার, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, লুণ্ঠিত দেশে দুর্ভিক্ষ আর মন্বন্তরের করাল ছায়া, পুরানো মূল্যবোধগুলোর ধবস্ত অবস্থা— সব মিলিয়ে দেশের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, আর সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বোবাকান্নায় গুমরে ওঠা মানুষের বিবেকের প্রতিস্বর সমসাময়িক লেখক নাট্যকাররা ক্ষোভ প্রকাশের স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা নাটকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা তথা প্রতিরোধের পথ হাতড়াচ্ছেন। ধনবাদী ব্যবস্থার বিষদাঁতটির হদিস পেয়ে যিনি এই অমাবস্যার আগেই রূপক আর সংকেতের সাহায্যে মানুষকে সাবধান করতে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ, আর সাংকেতিক রচনাটির নাম ‘রক্তকরবী’। কিন্তু ক্ষণকালের খণ্ডকূপে সাঁতার কাটতে কাটতে হাবুডুবু খাওয়া বাঙালির সাংস্কৃতিক মন তখন বিশ্বজনীনতা আর বিশ্ববোধের নতুন এই দৃশ্যকাব্য, ধনতন্ত্র তথা সাম্রাজ্যবাদের সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া ধবংসলীলার প্রতীকী আলেখ্যকে ঠিকমতো গ্রহণ করতে পারেনি। প্রায় চারদশক শম্ভু মিত্রের মতো প্রতিভাবান নাট্যনিয়ন্ত্রকের প্রয়াসে ‘রক্তকরবী’-কে বাঙালি থিয়েটার যখন মুগ্ধ বিস্ময়ে গ্রহণ করল, বুঝিয়ে দিল ফ্যাসিবাদী রাজার বিরুদ্ধে নন্দিনীদের বিদ্রহোকে তখন ধনতন্ত্রের বিষদাঁত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিস্তীর্ণ মৃগয়াক্ষেত্রে তীক্ষ্ণভাবে গেড়ে বসেছে। যক্ষপুরীতে সহস্র রঞ্জনদের লাশ আঁকড়ে শৃঙ্খলিত পাগল ভাইদের কান্নার গান শুনতে শুনতে অসংখ্য নন্দিনী হাহাকার করছে। ধনতন্ত্রের এই দানবীয় সন্ত্রাসের চেহারাটি যে রবীন্দ্রনাথ সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, তার অজস্র প্রমাণ তাঁর প্রবন্ধ, কবিতা ছাড়াও সংকোচের বিহ্বলতায় অথবা মূল্যায়নের অক্ষমতায় যে নাটকগুলিকে আমাদের নাট্যবোদ্ধারা দীর্ঘদিন দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন ‘রক্তকরবী’, ‘মুক্তধারা’ প্রমুখ সেই সৃষ্টিগুলোতেও ছড়িয়ে আছে। অথচ শিশির ভাদুড়ির মতো সুশিক্ষিত নাট্যব্যক্তিত্বও যখন রবীন্দ্রনাথ শুধু ঠাকুরবাড়ির মঞ্চের দিকে তাকিয়েই নাটক লিখে গেলেন বলে অনুযোগ করেন, কিংবা তৎকালীন মঞ্চ নিয়ন্ত্রকরা রবীন্দ্রনাটক বড়ো বেশি মস্তিষ্ক নির্ভর তাই পাঠে যতটা তৃপ্তি অভিনয়ে ততটাই কাঠিন্য— ইত্যাদি অজুহাতে যখন ‘শেষরক্ষা’, ‘তপতী’, ‘যোগাযোগ’ বা ‘চিরকুমার সভা’ ছাড়া গভীর জীবনবোধ আর সমাজ-রাজনীতি সচেতন নাট্যকার রবীন্দ্রনাথকে মঞ্চে দুঃস্পর্শনীয় করে রাখেন, তখন সাধারণ নাট্যদর্শকরা দীর্ঘকাল রবীন্দ্রনাথের নাটকের অন্তর্নিহিত বিশ্বমানবিকতার সুর ধনতন্ত্র তথা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার তীব্র সংকেত অনুধাবনে অনাগ্রহী থাকবেন— তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
চল্লিশের দশকে দুনিয়া জুড়ে উপনিবেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদী তথা ফ্যাসিবাদী শোষণের জালবিস্তার, বিশ্বযুদ্ধের দামামা, নির্বিচার লুণ্ঠন আর অত্যাচারের ফলশ্রুতিতে দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া, অবাধ কালোবাজারি যে হতাশা আর অন্ধকার বয়ে এনেছিল, তা দূর করার জন্য সাংকেতিক নাটক বা বুদ্ধিদীপ্ত রূপকের চাইতেও প্রয়োজন অনুভূত হল, সহজভাবে, অব্যর্থ সাবলীলতায় আর সরল বাস্তববোধে দুঃসহনীয় বর্তমানকে তুলে ধরা নাটক, গান আর শিল্পকলার। এই প্রতিকূল পরিবেশেই গণনাট্য সংঘের আবির্ভাব। এই আবির্ভাব ঐতিহাসিক হলেও আকস্মিক ছিল না। বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদী ড্রাগন তখন আগুনে ক্ষুধা মেটাবার প্রতিযোগিতায় উন্মত্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে লুণ্ঠিত, অনুন্নত, অবদমিত উপনিবেশগুলের উপর। মরিয়া মানুষগুলো তখন প্রতিবাদের পথ খুঁজছে। লেনিনের নেতৃত্বে দুনিয়া কাঁপানো দশদিনের বিপ্লব সারা পৃথিবীর অবদমিত মানুষের মনে তখন নতুন করে বেঁচে থাকার দুর্দম স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এ দেশেও তাই নিস্তেজ নিরামিষ সাংস্কৃতিক চর্চার বিপ্রতীপে গড়ে উঠল বিকল্প সাহিত্য আর সংস্কৃতির আন্দোলন। সাম্রাজ্যবাদ আর বেপরোয়া ধবংসলীলায় অতৃপ্ত ফ্যাসিবাদ যখন পূর্ব গোলার্ধের এই লুণ্ঠিত স্বর্ণভূমে প্রলয়-আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তখন ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার ডাকে সাড়া দিতে এগিয়ে এলেন বাংলার জাগ্রত-বিবেক, রবীন্দ্রনাথ অকুণ্ঠ আবেগে পশুশক্তির বিরুদ্ধে মানবিকতার উত্থানকে আহ্বান করলেন। ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক সংঘ আর তার শাখা গণনাট্য সংঘের পতাকার তলায় তখন একসঙ্গে অনেক প্রতিবাদী প্রতিভা। নাট্যকার, সংগীতস্রষ্টা থেকে নৃত্যশিল্পী, চিত্রশিল্পী— চারপাশের ঘোর অন্ধকারে চল্লিশের দশকে বাংলায় তখন একসঙ্গে অনেক তিমিরবিনাশী সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের আশ্চর্য মিছিল। বিনয় রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, নিবারণ পণ্ডিত, সলিল চৌধুরি, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রমুখের গান, কবিতা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস প্রমুখের মধুর উদার কণ্ঠ, চিত্তপ্রসাদ, জয়নুল আবেদিনের ছবি, রবিশংকর, তিমিরবরণের বাজনার সুর, উদয়শংকর অমলাশংকর-এর নৃত্যশৈলী— বাংলা থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে জোরালো এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তরঙ্গ। নাট্যক্ষেত্রেও তখন শ্রমিক-কৃষকের শোষণ বিরোধী, ফ্যাসিবাদ-বিরোধী, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সৃজনী বৈভব। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মার্কসীয় চিন্তাধারা যে নাটকেও সম্যকভাবে প্রতিফলিত হতে পারে তার প্রমাণ হিসেব রচিত হয় জলি কাউলের ‘দি পলিটিশিয়ান’, জ্যোতিরিন্দ্র সেনগুপ্তের ‘মহাযুদ্ধের ফলে’ প্রমুখ নাটকগুলো। যদিও এই নাটকগুলোর অভিনয়ের কোনো প্রামাণ্য দলিল এখনও মেলেনি, তবু বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল যে রাজাবাদশার কাহিনি, পুরাণের আখ্যান, কিংবা পারিবারিক মেলোড্রামা আর প্রহসনের গড্ডালিকা স্রোত এড়িয়ে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাজ আর দেশের জাতীয় আর আন্তর্জাতিক শত্রুকে অভ্রান্তভাবে চিহ্নিত করার চেষ্টায় ব্রতী হলেন, চল্লিশের দশকে গণনাট্য আন্দোলন তারই উজ্জ্বল অভিজ্ঞান। ১৯৪৩-এর মে মাসে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ মঞ্চস্থ করে বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম নাটক ‘আগুন’; প্রখ্যাত নট মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে লেখা অসাধারণ নাটিকা ‘হোমিওপ্যাথি’ আর বিজন ভট্টাচার্যের ‘জবানবন্দী’ একই সঙ্গে মঞ্চস্থ হয় স্টার থিয়েটারে ১৯৪৪-এর ৩ জানুয়ারি। বাংলা মঞ্চে এই প্রথম সমকালীন রূঢ় বাস্তবকে নির্মোহ বলিষ্ঠতায় প্রতিফলিত করার উল্লেখযোগ্য প্রয়াস লক্ষিত হল। ১৯৪৪-এর ২৪ অক্টোবর বাংলার প্রগতি নাট্য আন্দোলনের যুগান্তকারী সৃষ্টি বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটকের প্রথম অভিনয় হল শ্রীরঙ্গমে, এই নাটকটি ফ্যাসিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবিরোধী নাটক নয়, তবে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অনিবার্য অনুষঙ্গ দুর্ভিক্ষ আর মন্বন্তরের অবিস্মরণীয় দলিল এই নাটক। এ নাটকে ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তি, বিশ্বমানবিকতার আর্তি, এ নাটকে জোতদার মহাজন আর শহুরে বণিক শ্রেণির হহৃদয়হীনতা আসলে বিশ্বব্যাপী দাপিয়ে বেড়ানো ধনতান্ত্রিক দানবীয় শক্তির হহৃদয়হীনতার প্রতিবিম্ব হয়ে দাঁড়ায়। এ নাটকে কুচক্রীর বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের প্রতিরোধ বিশ্বজুড়ে মেহনতি মানুষের অখণ্ড সংগ্রামেরই খণ্ডচিত্র, এ নাটকে সাধারণ কৃষিজীবী মানুষের জীবন সংগ্রাম, বিদ্রোহী চেতনা আর একই রাস্তায় নেমে দুর্ভাগ্যকে জয় করার সংহত এষণা আসলে দেশ-কাল-ভাষা-ধর্মের ব্যবধান আর দূরত্ব জয় করে সাম্য সুখ আর মৈত্রীর পরমতীর্থে মানুষের বোধ আর প্রত্যয়কে প্রোথিত করার এষণা। উনিশ শতকের প্রতিবাদী নাটকের মাইলস্টোন যদি হয় ‘নীলদর্পণ’, তবে বিশ শতকের চল্লিশের ঝোড়ো দশকে ‘নবান্ন’ হচ্ছে বাস্তববাদী চেতনা আর শোষণ বিরোধী প্রতিবাদের নয়া বাঁকের দিকে মুখফেরানো সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বা টার্নিং পয়েন্ট। বিজন ভট্টাচার্যের পরবর্তী নাটকগুলিতে বিশেষ করে ‘কলঙ্ক’ (১৯৪৬) আর ‘মরাচাঁদ’ (১৯৪৬) নাটক দুটিতে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ আর যুদ্ধের বিরুদ্ধে স্বচ্ছ গভীর জীবনবোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ১৩৫০ সালের সর্বগ্রাসী মন্বন্তরের পটভূমিকায় আর একটি বলিষ্ঠ নাটক তুলসী লাহিড়ীর ‘দুঃখীর ইমান’। এ নাটকের মুখবন্ধে নাট্যকার স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করলেন— ‘ধনতান্ত্রিক সভ্যতার চরম পরিণতি মন্বন্তরের দিনে চিরবঞ্চিত ও অবজ্ঞাতের দল যারা ধনলোভীর লোভের যূপকাষ্ঠে বলি হয়েছিল তাঁদের ছবি আঁকতেই এই নাটকের সৃষ্টি।’ এই প্রস্তাবনা থেকেই আমরা বাংলা থিয়েটার মঞ্চে বাস্তববাদী নাট্য আন্দোলনের বহমান হাওয়া অনুভব করতে পারি, যে হাওয়ার উৎসমূলে ছিল সাম্যবাদী চিন্তাধারা, প্রতিবাদে প্রতিরোধে জেগে ওঠা মানুষের বিদ্রোহ আর গণনাট্য আন্দোলনের বহুব্যাপ্ত অভিঘাত। পরবর্তীকালের নবনাট্য আর গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের উদ্ভব আর বিস্তারেও ওই হাওয়ার প্রত্যক্ষ প্রভাব প্রবলভাবে অনুভব করা যায়। আসলে সবটাই ফ্যাসিবাদ বিরোধী অক্টোবর বিপ্লবের ধারাবাহিক প্রভাবের ফসল।
স্বাধীনতা-উত্তরকালের নাটকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা— “জানিস ও দুঃস্বপ্ন দু’দিনের। দস্যুদের দিন ফুরিয়েছে সারা দুনিয়া জুড়ে। তারপর আবার ফসল ফলবে, মায়ের পেটে বাচ্চা আসবে, হো-চি-মিনের ক্রুদ্ধ মুখখানা আবার সেই আগের হাসিতে ভরে যাবে।”— নাটক ‘অজেয় ভিয়েতনাম’, নাট্যকার— উৎপল দত্ত।
দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের দগদগে ঘা অনেকটা ছড়িয়ে আর কিছুটা বুকে নিয়ে দুর্বার গণ আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এ দেশ ছাড়ল বটে, তবে তাদের বিদায়কালীন চক্রান্ত-চুম্বনে সম্মোহিত দেশের জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের দুর্বলতায় সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার সূর্যের গায়ে তখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার রক্ত ছিটকে আসছে ঘনঘন। পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে ছিন্নমূল লক্ষ লক্ষ মানুষের স্রোত এপারে আছড়ে পড়ছে আর বিবর্ণ বিষণ্ণ করে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের জোয়াল থেকে মুক্তির আনন্দকে। গণনাট্য আন্দোলনের আর এক নাট্যকার দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সমসাময়িক অস্থিরতার যন্ত্রণাকে বাণীরূপ দিলেন ‘বাস্তভিটা’ (১৯৪৭), ‘মশাল’ প্রভৃতি নাটকে। কায়েমি স্বার্থ সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে শ্রমিক কৃষকের আসল লড়াই-কে হীনবল করার যে চেষ্টা করে তার স্বরূপ দিগিনবাবুর এইসব নাটকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁর আগেই সাম্রাজ্যবাদী প্রশ্রয়ে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে জাতীয় নেতাদের আপসপন্থা তথা দেশভাগের চক্রান্তের প্রতিবাদে গণনাট্য সংঘের ছায়ানাট্য ‘শহীদের ডাক’ বিপুলভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে দর্শকদের মনে। এ প্রসঙ্গে এই সত্যও স্মর্তব্য যে দেশভাগের যন্ত্রণা, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রাণের দায়ে পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর ভিড়, বিশ্বযুদ্ধের দগদগে ঘা আর ধবস্ত অর্থনৈতিক অবস্থা, তীব্র বেকারি আর দুঃসহ খাদ্যাভাব— দেশজ ক্ষেত্রে এতসব জটিল সমস্যার সামনে দাঁড়িয়েও আন্তর্জাতিক চেতনার ছোঁয়া লাগা বাঙালি মনন কিন্তু বিশ্ববীক্ষার আদর্শকে ভোলেনি। দেশীয় অর্থনীতি আর রাজনীতির অবিচার, অসাম্য আর অপদার্থতার পিছনে যে সাম্রাজ্যবাদের কলাকৌশল, আফ্রো-এশীয়-লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীন অথবা মুক্তিকামী দেশের অভ্যন্তরে মার্কিনি ফাঁস আর তার বিপ্রতীপে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার স্বপ্নভূমি সোভিয়েত আর চিন সহ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর প্রভাবে আর উদ্দীপনায় দেশে দেশে মুমূর্ষু মানুষের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক শৃঙ্খল ভাঙার লড়াই, সাম্রাজ্যবাদী দেশের অভ্যন্তরেও মানবতাবাদী, মুক্তি সংগ্রামের সমার্থক চেতনার প্রকাশ— এ সব জ্বলন্ত বাস্তবের সঙ্গে বাঙালি মনন তখন ভালোভাবেই পরিচিত হচ্ছে। নাটকেও তখন এই উন্নত চেতনার প্রতিফলন। তুলসী লাহিড়ীর ‘পথিক’ নাটকে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সচেতনতা আর সংহত হবার আহ্বান শোনা গেল। ১৯৫০-এ প্রযোজিত তুলসী লাহিড়ীর পরবর্তী নাটক ‘ছেঁড়াতার’-এর পটভূমি মন্বন্তর, সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট সামন্ততান্ত্রিক গ্রাম সমাজের আচার সংস্কার, শোষণ-পীড়ন, বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’-পরবর্তী ‘কলঙ্ক’, ‘মরাচাঁদ’, ‘অবরোধ’, ‘জিয়নকন্যা’, ‘গর্ভবতী জননী’ নাটকও সংকীর্ণ পটভূমি থেকে গভীর বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে নাট্যকাহিনির ‘প্রেমাইজ’-কে সংস্থাপনের চেষ্টা ধরা পড়ে। এরই পাশাপাশি এগিয়ে এলেন এমন কয়েকজন সক্ষম নাট্যকার, যাঁরা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের আবেগতপ্ত অনুপ্রেরণায় মানবমুক্তি আর বিশ্বজনীনতার কথা তুলে ধরলেন মৌলিক, অনূদিত, অনুপ্রাণিত কিংবা রূপান্তরিত বহু নাটকে। একদিকে ‘আমরণ’ (টিল দি ডে আই ডাই), ‘অরুণোদয়ের পথে’ (রাইজিং অফ দি মুন), ‘ওয়েটিং ফর লেফটি’ প্রভৃতি অনূদিত বা রূপান্তরিত নাট্যপ্রযোজনা, অন্যদিকে ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’ (উমানাথ ভট্টাচার্য), ‘মৃত্যু নেই’ (মণি মজুমদার), ‘রাহুমুক্ত’ (বীরু মুখোপাধ্যায়) প্রমুখ মৌলিক নাটক প্রতিবাদী চেতনার জোয়ার আনল। এই সময়ের আরও তিনটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা মিখাইল সেবেস্তিয়ান অনুপ্রাণিত ‘শেষ সংবাদ’, ফার্গুসন-এর নাটকের রূপান্তর ‘মা’ আর মিকোলাসের সার্থক রূপান্তর ‘বিশে জুন’। শেষোক্ত নাটকে পৃথিবীকে দাবিয়ে রাখার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আণবিক অস্ত্র পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর সুখ, সমৃদ্ধি আর নিরাপদ স্বাধীন জীবন কামনায় সমর্পিত প্রাণ বিজ্ঞানী রোজেনবার্গ দম্পতির সাহসী ভূমিকা মর্মস্পশী ট্রাজেডিতে রূপ পেয়েছে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে আর শান্তির সম্প্রীতির সপক্ষে লেখা ‘রাহুমুক্ত’ প্রয়োজনাও বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। পঞ্চাশ-এর দশকেই গোর্কির ‘মা’ বাংলা মঞ্চে দুই পর্যায়ে অভিনীত হয়। গণনাট্য সংঘের প্রযোজনায় এই প্রযোজনাও যথেষ্ট খ্যাতি আর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এইভাবে পঞ্চাশের দশকেই বিশ্ববোধ আর সহমর্মিতার জানালা খুলে দিয়ে আমাদের থিয়েটারে তুলে ধরা হল চেকভ, মায়াকভস্কি, তলস্তয়, গোগোল, সিমোনভ প্রমুখের কালজয়ী সৃষ্টিগুলোকে। ফরাসি, ইংরেজি, জার্মান, আইরিশ নাটকের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনাগুলিও এই সূত্রে মূল্যবান হয়ে উঠল।
ইতিমধ্যেই গণনাট্য সংঘের বাইরে যে নতুন নাট্য-আন্দোলনের সূচনা হয় তার মধ্যে সংগ্রামবিমুখ নেতিবাচক জীবনদর্শনের প্রবণতার দিকটি যেমন সমাজসম্পৃক্ত প্রতিবাদী চেতনার নাট্যপ্রবাহের সমান্তরাল একটি ভিন্নধর্মী নাট্যপ্রবাহের সূচনা করে, তেমনি আবার সংস্কারমুক্ত প্রগতিশীল ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী উন্নত মেধার অনেকেই ‘গণনাট্য সংঘ পরিচালনার সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার কারণে’ নতুন কয়েকটি নাট্যগোষ্ঠী তৈরি করেন। তাঁদের প্রযোজিত প্রথম দিককার অধিকাংশ নাটকই ছিল গণনাট্য ভাবনায় উদ্ভূত সমাজসত্যের দর্শন। যদিও নাট্য আন্দোলনের এই বৈচিত্র্য-অন্বেষ অস্থির সময়ে একদিকে গণনাট্য আন্দোলনকে অস্বীকার আর উপেক্ষা করে ‘নবনাট্য’, ‘সৎনাট্য’, ‘শুদ্ধশিল্প’, ‘কলাশিল্প’ ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ ইত্যাদি রম্য শব্দব্রহ্মের আয়ুধে জনজীবনে বিপ্লবী রাজনীতির নাট্যধারাকে অন্যপথে চালিত করার প্রবণতা উঁকি দিল, অন্যদিকে তেমনি আবার গণনাট্য সংঘের বাইরে দাঁড়িয়েই ঋত্বিক ঘটকের মতো নাট্যকার আর চলচ্চিত্র স্রষ্টা খোলাখুলি ঘোষণা করলেন—
…তখন আমরা গণনাট্য আন্দোলন করতাম, ঠিক ভুল যাই করি নিজের হদিসটা ঠিক ছিল। সামাজিক, রাজনৈতিক দিক্নির্দেশে সময় সময় ভুল হয়েছিল,— কিন্তু কোন শক্তির শরিক আমরা আর কার প্রতি আমাদের দায়িত্ব সে বোধে কোনও ধোঁয়াটে ভাব ছিল না। আজও মনে করি আমরা ঠিকই পথ চিনেছিলাম। তীব্রভাবে সামাজিক ক্লেদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন এবং বাস্তবের শ্রদ্ধেয় অংশের প্রতি আকুলভাবে ভালোবাসা দেখানো— সর্বযুগের সব শিল্পীর এ হচ্ছে পবিত্র দায়িত্ব।
এই দায়িত্বকে অস্বীকার করা অসম্ভব বলেই বোধ হয় ‘নবনাট্য আন্দোলনের একমাত্র ত্রিমাসিক নাট্যপত্র’ গন্ধর্ব পত্রিকায় ১৯৬১-র অক্টোবর সংখ্যার সম্পাদকীয় নিবন্ধে লেখা হল: নবনাট্যের প্রগতিপথে মূলত সংঘর্ষমান জীবনদ্বন্দ্বকেই মঞ্চ আলোয় সুস্পষ্ট করে তোলা যেখানে লক্ষ্য, সেখানে পুরানো দিনের ক্লাসিক নাটকে যেমন নাটকের পুনরুজ্জীবন, তেমনি দরকার নতুন দিনের নতুন রীতির নাটক করে বাংলা নাট্যপ্রবাহে নতুন সংযোজন।… নাট্য প্রযোজনাগত এমন শিল্পমুখিনতা বাংলা নাটকে পূর্বে ছিল না, সেটা গণনাট্যের দান, এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না।
ষাটের দশকে পৌঁছে থিয়েটারের পথ, মত আর নাটকের বিষয়বস্তুর তত্ত্ব নিয়ে এই বিতর্ক প্রবল হয়ে উঠলেও ষাট আর সত্তরের দশককেই বাংলা নাটকের উল্লেখযোগ্য সৃজনশীল সময় বলা যেতে পারে। একদিকে স্থিতাবস্থা বিরোধী গণআন্দোলনের জোয়ার, জমিদখলের লড়াই, খাদ্য আন্দোলন, কেরোসিনের দাবিতে ছাত্র-যুবাদের আন্দোলন, ট্রামবাসের ভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন-দাবি, অন্যদিকে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা থেকে ভিয়েতনামে বীভৎসময় সাম্রাজ্যবাদের প্রতি প্রবল ঘৃণার উত্তাপে ভেসে গেল থিয়েটারে কলাকৈবল্যবাদে কিংবা ‘বিশুদ্ধ থিয়েটারের’ তত্ত্ব। মানুষের, বিশেষ করে সৃজনশীল যৌবনের মুখপত্র হয়ে উঠল গ্রামগঞ্জের অসংখ্য গ্রুপ থিয়েটার। কলকাতার থিয়েটারও তখন পেয়ে গেছে সমকালের দুই শ্রেষ্ঠ নাট্য প্রতিভাকে, অর্থাৎ একদিকে শম্ভু মিত্র ও অন্যদিকে উৎপল দত্তকে। দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকলেও এই দুই দশক থেকেই বাংলার থিয়েটার সবদিক দিয়ে সৃজনশীল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সবচেয়ে জীবন্ত ও ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে। একদিকে ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ থেকে তলস্তয়, ব্রেখট, চেকভের রূপান্তরিত নাট্যসম্ভার আমাদের বিশ্বচেতনায় সন্দীপিত থিয়েটার চর্চার দিগন্তকে ঘরের উঠোন থেকে সুদূর চরাচরে বিস্তৃত করল, অন্যদিকে উৎপল দত্তের হাত ধরে প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের নাটক এই বাংলার এস্ট্যাবলিশমেন্ট বিরোধী জনমানসে বামপন্থী সংগ্রামী চেতনাকে আরও বিকশিত করে তুলল। আমৃত্যু উৎপল দত্ত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এই ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন ‘প্রফেসর মামলক’, ‘মে দিবস’ থেকে ‘মানুষের অধিকারে’, ‘অঙ্গার’, ‘অজেয় ভিয়েতনাম’, ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘কল্লোল’, ‘তিতাস’, ‘ব্যারিকেড’, ‘লালদুর্গ’, ‘ক্রুশবিদ্ধ কিউবা’ প্রভৃতি প্রায় নব্বইটি পূর্ণাঙ্গ, একাঙ্ক আর যাত্রা নাটকে। আর এইসব নাটকে উৎপল দত্ত বিস্ময়করভাবে পেশাদার মঞ্চকে ব্যবহার করেছিলেন রাজনৈতিক মতবাদ গঠনের-প্রচারের শিল্পভূমি হিসেবে। এগারো বছর ধরে মিনার্ভা মঞ্চ হয়ে উঠল তাঁর সামন্তবাদ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রতিবাদী চিন্তাধারার কর্মশালা, যেখানে বড়ধেমো কয়লাখনির শ্রমিক, প্রসাদজোতের কৃষক, খাইবারের বিদ্রোহী নাবিক, ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধা কিংবা ১৯৩১-এর এলাবামার বিপ্লবী বাঙালি দর্শকদের দৃষ্টি আর বোধকে রাষ্ট্রীয় ভৌগোলিক গণ্ডি ভাঙতে উদ্বুদ্ধ করল। ধনতান্ত্রিক শোষণ নিপীড়ন আর ভোগলোলুপ বিচ্ছিন্নতার চালচিত্র রচনা করতে গিয়ে উৎপল দত্ত তাঁর নাট্যঘটনার বিস্তার ঘটালেন সারা পৃথিবীর বিশাল ভূখণ্ডে। টালিগঞ্জের স্টুডিয়োপাড়া থেকে বড়ধেমো কোলিয়ারি, বাংলার ভুবনডাঙা, তিতাসের মালোপাড়া, বোম্বাই-এর নাবিকদপ্তর বস্তি থেকে উৎপল দত্ত অক্লেশে চলে যান হিন্ডেনবর্গ, সায়গন, মস্কো, বুখারেস্ত, প্যারিস হয়ে আরও অনেক দেশে। যে কোনো মাধ্যমের সৃজনী ক্ষেত্রেই এই বিস্তার অকল্পনীয়। আবার আন্তর্জাতিক।
এই দেশগুলি তো কেবলমাত্র তার পটভূমি নিয়ে উপস্থিত হয়নি। নাটকে গোটা দেশ এসেছে তার সমগ্র ঐতিহ্যে সম্পৃক্ত আর্থ-সামাজিক কাঠামোটি নিয়ে। যেমন ভারতবর্ষের কোনো অঞ্চল বর্তমান থেকে ফিরে গেছে অতীতে যে কোনো সময়ে— ঠিক একইভাবে বিদেশ বিন্যস্ত হয়েছে কখনও সমকালিক, আবার কখনও বা কয়েকশো বছর অতিক্রম করে। উৎপল দত্তর তত্ত্বগত প্রজ্ঞায় এই কর্মিক বিস্তারকে হয়তো বুঝতে পারা সম্ভব হলেও নাটক (এবং নাট্য) নির্মাণ ক্ষেত্রে তাঁকে প্রধান দুটি দ্বন্দ্বের মীমাংসা করতে হয়েছে শৈল্পিক যথার্থতায়। অর্থাৎ ওই বিদেশকে যেমন তার দেশ-কাল প্রেক্ষিতে সৃজন-বাস্তবতায় বাঁধতে হয়েছে, পাশাপাশি ওই আন্তর্জাতিক ঘটনাকে, ব্যবহৃত চরিত্রকে হতে হয়েছে আজকের— এই কলকাতার সমকালিক। এই মুহূর্তের সময়ের স্পন্দন সেখানে অনুরণিত না হলে তা শুধু মহফেজখানার সংকলন হয়ে থাকত মাত্র। (‘কালের কল্লোল বনাম উৎপল দত্ত’— দেবাশিস মজুমদার)।
১৯৫৮-তে লেখা প্রথম নাটক ‘ছায়ানট’ থেকে ১৯৯৩-এ ‘প্রতিবিপ্লব’ গ্রন্থ রচনা পর্যন্ত বিপুল বিস্তৃত গণসংস্কৃতিধর্মী কর্মকাণ্ডে প্রায় চার দশকের রাজনৈতিক নাট্য আন্দোলনের প্রধান সেনাপতি আর গণতান্ত্রিক অধিকারে বিশ্বাসী তাঁর অজস্র সহযোদ্ধা নাট্যকর্মী, নাট্যকার, নির্দেশকের দুর্মর চেষ্টায় প্রতিবাদী নাট্য আন্দোলন ফিনিক্স পাখির মতো কতবার পুনরুজ্জীবন পেয়েছে। ষাট-এর দশকের সাম্যবাদ বিরোধী ‘জাতীয়তাবাদী’ আগ্রাসন, সত্তর দশকের ব্যক্তিসন্ত্রাসের রক্তাক্ত প্রতিবেশ আর সরকারি মদতপুষ্ট পুলিশ দক্ষিণপন্থী ‘যুব বাহিনীর’ বেপরোয়া আক্রমণ সাম্রাজ্যবাদী মদতে বামপন্থীদের নির্বিচার সংহারলীলা ইত্যাদি সমাজ-রাষ্ট্রীয় প্রতিকূলতা আর তার ফলে গতিশীল নাট্যচর্চার সাময়িক স্তিমিতি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাস আর প্রশাসনিক মদতে বাণিজ্যিক থিয়েটারের মালিকদের আমদানি করা ইয়াংকি সংস্কৃতির অনুষঙ্গ ‘ক্যাবারে কালচার’ আর যৌনতাসর্বস্ব নাট্যব্যবসার বিরুদ্ধে পাল্লা দিয়ে গণনাট্য সংঘের সংগ্রামী জীবনমুখী নাট্যচর্চার ঐতিহ্যকে যে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হল তার পিছনেও রয়েছে ওইসব আত্মত্যাগী, কষ্টসহিষ্ণু, সংগ্রাম-সচেতন গ্রুপ থিয়েটার-কর্মীদের প্রবল প্রতিরোধ; আর দুর্দম সৃজনশীলতা সেই সব আক্রমণের মোকাবিলা করেছে। এই প্রসঙ্গে উৎপল দত্তের নামের পাশাপাশি জোছন দস্তিদার (‘অমর ভিয়েতনাম’, ‘কর্ণিক’), অরুণ মুখোপাধ্যায় (‘মারীচ সংবাদ’, ‘হারানের নাতজামাই’), মোহিত চট্টোপাধ্যায় (‘রাজরক্ত’), অমল রায় (‘কমিটেড’, ‘নোপাসারন’), চিররঞ্জন দাস (‘জুলিয়াস ফুচিক’, ‘তৃষ্ণা’, ‘ফ্রিডম রোড’), শ্রীজীব গোস্বামী (‘ফুলওয়ালী’), জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় (‘লংমার্চ’, ‘মা’), শ্যামাকান্ত দাস (‘অগ্নিগর্ভ লেনা’), অসিত বসু (‘কলকাতার হ্যামলেট’), শশাঙ্ক গঙ্গোপাধ্যায় (‘সামান্য-অসামান্য’), অলক রায়চৌধুরী (‘লাল লণ্ঠন’), অসিত ঘোষ (‘নর্মান বেথুন’), শম্ভু বাগ (‘লেনিন-পালা’), মনোজ মিত্র (‘নরক গুলজার’, ‘চাক ভাঙা মধু’), চন্দন সেন (‘চিলি’, ‘অন্য ভিয়েতনাম’, ‘ঝড়ের খেয়া’), অমল চক্রবর্তী (‘হচ্ছেটা কি’) প্রমুখ নামও স্মর্তব্য। বিগত দুই দশকের গণতান্ত্রিক আবহাওয়ার মুক্ত আলোয় বসে যে নবীন প্রজন্ম নাট্যচর্চা করছেন, তাঁদের কাছে কার্জন পার্কে অভিনয় করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত নাট্যকর্মী প্রবীর দত্তের লাশ, ‘কল্লোল’ বা ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ অভিনয় বন্ধের জন্য প্রবল সন্ত্রাস, গণনাট্য সংঘের দশ জন শিল্পী আর থিয়েটার ওয়ার্কশপের নাট্যকার অভিনেতা সত্যেন মিত্রের হত্যা, জরুরি অবস্থা জারি করে দেশের গণতান্ত্রিক বাতাবরণ আর নাটকের প্রতিবাদী ভূমিকাকে সংহার করার অপচেষ্টা কিংবা এ সব ঘটনার নেপথ্যে সাম্রাজ্যবাদের প্রিয় এই মৃগয়াভূমিতে দেশীয় শাসকদের সহযোগিতায় দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিক-কৃষক মধ্যবিত্তের সংগ্রামীচেতনার নিয়ন্ত্রক পশ্চিম বাংলার দুর্বার সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক দিক দিয়ে, গণমাধ্যমের নির্লজ্জ অপপ্রচারের সাহায্যে দমন করার চেষ্টা শুধুমাত্র সুখপাঠ্য ইতিহাস হয়েই রয়েছে হয়তো। তা নইলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রতিবাদী ঐতিহ্যের এই নাট্যচেতনা বিগত দুই দশকে কেন এতখানি স্তিমিত হয়ে পড়বে? এর মধ্যেই স্তালিনের শতবর্ষ এল (উৎপল দত্ত লিখলেন ‘স্তালিন-৩৪’), আফ্রিকান কবি বেঞ্জামিন মোলায়েজকে হত্যা করা হল (চিররঞ্জন দাস লিখলেন ‘মৃত্যুহীন বেঞ্জামিন’, শেখর চট্টোপাধ্যায় লিখলেন ‘বেঞ্জামিন মোলায়েজ’), নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠল, পথনাটক করতে গিয়ে সফদর হাশমি শাসকদলের গুন্ডাদের হাতে নিহত হলেন, ভিয়েতনামে সাম্রাজ্যবাদ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হল, আবার নব্বই-এর দশকের শুরুতেই সাম্রাজ্যবাদী গর্বাচভদের সহযোগিতায় ভিয়েতনামের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল সোভিয়েত সহ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধবংস করে দিয়ে, কিউবার উপর আক্রমণ প্রবলতর হল, সাম্রাজ্যবাদ প্রায় একচেটিয়া হুংকারে দাবিয়ে রাখতে চাইল ইরাক, লাওস, কোরিয়াকে। নববই-এর দশকের শেষ পাঁচ বছরই আবার দুনিয়া জুড়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক শক্তির পুনরুজ্জীবনের সুর সোচ্চার হচ্ছে। মরণ-বাঁচন, কান্না-হাসির দোল লাগানো এই ঘটনাবহুল সমকালে কেন বাংলার নাট্য আন্দোলন শুধু পরিবারভিত্তিক অথবা লোকায়ত দর্শনভিত্তিক কিংবা রূপক লোকগাথার বৃত্তে ঘুরপাক খাবে— তার অনুসন্ধানের ক্ষেত্র অন্য। তবে আমাদের নাট্য আন্দোলনের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দীর্ঘকালের একাবস্থা গণ্ডিতে আবদ্ধ থেকে আমাদের নাট্যক্ষুধা কিন্তু অস্থির অতৃপ্তিতে ছটফট করে, আর ‘নীলদর্পণ’ থেকে ‘রক্তকরবী’, ‘কল্লোল’, ‘টিনের তলোয়ার’, ‘জগন্নাথ’, ‘শোয়াইক’, ‘বেলা অবেলা’ হয়ে আজকের ‘রুদালি’ বা ‘লোককথা’— আমাদের থিয়েটারের সবগুলো মাইলস্টোনের গায়েই প্রতিবাদী চেতনার রঙ লেগে আছে। নাটক নিয়ে বহমান অজস্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার ইতিবাচক পরিমণ্ডলেও আমাদের থিয়েটারে এখনও সাম্রাজ্যবাদ তথা ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার অবকাশ আছে। ধনতান্ত্রিক শোষণ, নিপীড়ন আর পণ্যমুখী মানসিকতার ফলে উদ্ভূত বিচ্ছিন্নতার দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের বিরুদ্ধে নাট্যযোদ্ধাদের সক্ষম সংগ্রামেরও অবকাশ আছে। বরং সাম্রাজ্যবাদ আর ধনতান্ত্রিক শোষণ নিপীড়ন যত দ্রুত একচেটিয়া আধিপত্যের সুযোগ নিয়ে আজকের দুনিয়ার অনুন্নত, স্বল্প উন্নত দেশগুলোতে নানা বিচিত্র চেহারায় আর মুখোশে আক্রমণ শানাচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রতিবাদী নাট্যচর্চার দৃপ্ত পুনরুজ্জীবন ততই জরুরি হয়ে উঠেছে। চার-পাঁচ দশক আগেই মোহিত চট্টোপাধ্যায় যখন ‘গজানন চরিত’ লেখেন, মনোজ মিত্র যখন ‘আত্মগোপন’ রচনা করেন, দেবাশিস মজুমদার যখন ‘দানসাগর’ কিংবা ‘অমিতাক্ষর’ সৃষ্টি করেন তখন মনে হয় বাজারি বিজ্ঞাপন আর প্রমোদপণ্যের অন্ধযুগেও মানবিকতা বিরোধী রঙ-বেরঙি দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে নাট্যসৃজনের দায় হয়তো আমাদের নাট্যব্যক্তিত্বরা ভুলতে চাইছেন না। রাজ্য বা কেন্দ্রের অভিন্ন ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চুপ করে থেকে, চাইলে হয়তো চল্লিশের প্রেতাত্মা হয়ে, সত্তরের ব্যর্থ পরিহাস হয়ে আমাদের থিয়েটার এখন শুধু পারিবারিক ভুলভুলাইয়ায় খেলা করত, আমাদের গান হয়ে উঠত শুধু এই তিমির বিলাসী জীবনমুখী গান— ‘এই তুমি কি আমায় ভালোবাসো’, আমাদের গল্প হয়ে উঠত শুধু ‘কাগজের বউ’, আমাদের ছবি হয়ে উঠত শুধু ‘নারী, ক্যাকটাস আর মাধুরী-বিলাস’, আমাদের চলচ্চিত্র হয়ে উঠত শুধু ‘তাহাদের কথা’ অথবা আমাদের একমাত্র তৃপ্তির কবিতা হয়ে উঠত ‘নীপা, এখানে একবার এসো, এই নির্জনে’।
ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে বামপন্থীদের মূল্যায়নে গুরুতর ত্রুটি বিচ্যুতি ছিল, এই কথাটা স্বীকার করে নেওয়া এখন দরকার। এর কারণ দ্বিবিধ। এক: ইতিহাসগত কারণেই ফ্যাসিবাদ সম্পর্কিত কোনও আলোচনা মার্কস-এঙ্গেলস বা লেনিনের লেখায় পাওয়া যায় না। স্তালিনের রচনাতেও ফ্যাসিবাদের কোনও যথার্থ তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ অনুপস্থিত। দুই: যাঁর বক্তব্য এই বিষয়ে আমাদের কাছে সর্বাধিক পরিচিত, তিনি হলেন তৃতীয় আন্তর্জাতিকের (কমিনটার্ন) মধ্য তিরিশের দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব জর্জি ডিমিট্রভ। ডিমিট্রভের আলোচনাতে মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ফ্যাসিবাদের চরিত্র ও ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করার রণনীতির বিস্তৃত ব্যাখ্যা মেলে। ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করতে হলে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তির সমন্বয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলা প্রয়োজন— যেখানে শ্রেণি ঐক্যের প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দিলে চলবে না,— ডিমিট্রভের এই বক্তব্য যখন ১৯৩৫ সালে কমিনটার্নের সপ্তম কংগ্রেসে উপস্থিত করা হল, সেটি অবশ্যই ছিল অভিনব। পরবর্তী বছরগুলিতে ডিমিট্রভের প্রস্তাবিত এই রণনীতিই ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
কিন্তু ফ্যাসিবাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ডিমিট্রভ যে ব্যাখ্যা দিলেন তার একটা বড়ো রকমের সীমাবদ্ধতা ছিল। ডিমিট্রভ সঠিকভাবে ফ্যাসিবাদকে ফিনান্স-পুঁজির বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু ফ্যাসিবাদকে শুধুমাত্র আগ্রাসী পুঁজির সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখার মধ্যে একটা বড়ো রকমের ফাঁক ছিল। ফ্যাসিবাদ শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নয়, এটি যে একটি ভিন্ন গোত্রের সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা, যা শাসন করে মানুষের মস্তিষ্ক ও চেতনাকে মতাদর্শগত স্তরে, তার বিশেষ কোনও আলোচনা ডিমিট্রভের ব্যাখ্যার মধ্যে মেলে না। এর নেপথ্যে কাজ করেছিল মার্কসবাদ আসলে এক ধরনের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদ মাত্র,— এই রকম একটি যান্ত্রিক ভাবনা। এই ভাবনা যে ভুল তা রবীন্দ্রনাথ থেকে আজকের আধুনিক মননেও প্রতিষ্ঠিত।
কৃতজ্ঞতা : শোভনলাল দাত্তগুপ্ত (কালান্তর) | গণশক্তি | আজকাল | গণবার্তা | ‘আমাদের থিয়েটার’: চন্দন সেন (কলাভৃৎ পাবলিকেশন)