সুমন্ত্র দত্ত
প্রাক্কথন
বিংশ শতাব্দীতে আবির্ভূত ‘ফ্যাসিবাদ’ নামক ধারণা ও ফ্যাসিবাদের সঠিক প্রকৃতি সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং ইতিহাসবিদদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে বিতর্ক রয়েছে। ১৯৯১ সালে ব্রিটিশ রাজনীতি-তত্ত্ববিদ রজার গ্রিফিন ‘The Nature of Fascism’-গ্রন্থে প্রথম ‘Palingenetic Ultranationalism’ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ফ্যাসিবাদের ধারণা গড়ে উঠেছে একটা Myth অর্থাৎ প্রবাদ বা কল্পনাকে আশ্রয় করে, যার মূলে রয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদের পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগরণ। গ্রিফিন জানিয়েছেন এই ভাবাদর্শের তিনটি উপাদান রয়েছে। সেগুলি হল– পুনর্জন্ম বা পুনর্জাগরণের প্রবাদ, জনপ্রিয় উগ্র-জাতীয়তাবাদ এবং নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের কল্পনা।
মার্কিন চিন্তাবিদ লরেন্স ব্রিট ২০০৩ সালে ‘Free Enquiry’ পত্রিকায় (Vol 23, No.2) ‘Fascism Anyone?’ প্রবন্ধে ফ্যাসিবাদের চোদ্দটি লক্ষণ শনাক্ত করেছিলেন। ফ্যাসিবাদের সেই লক্ষণগুলি হল– পরাক্রমশালী ও চলমান জাতীয়তাবাদ, মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা বা ঘৃণার প্রকাশ, শত্রু শনাক্ত করা, সামরিক আধিপত্য, উৎকট লিঙ্গবৈষম্য, সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম, জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে প্রচণ্ড ঔৎসুক্য, দেশের প্রধান ধর্মটিকে ব্যবহার করে মানুষের মতামতের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার প্রতিরক্ষা, শ্রমিকদের ক্ষমতা রোধ, বুদ্ধিজীবীতা ও শিল্পের প্রতি অবজ্ঞা, অপরাধ ও শাস্তির বিষয়ে মাত্রাহীন আগ্রহ, অবাধ স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি, নির্বাচনে কারচুপি। ফ্যাসিবাদ এবং তার অনুগামীরা সর্বদাই সাম্যবাদ বা কমিউনিজম, রক্ষণশীলতা এবং উদারতাবাদকে আক্রমণ করেছে। ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রধানত সুদূর দক্ষিণপন্থীদের সমর্থন পেয়েছে। রাষ্ট্র দ্বারা নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ বা সর্বগ্রাসীবাদ (Totalitarianism) ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য।
বর্তমান প্রবন্ধে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তিন মহাদেশের (ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়া) চারটি দেশে (ইতালি, জার্মানি, চিলি ও ইন্দোনেশিয়া) গড়ে ওঠা ফ্যাসিবাদী শাসনের বিকাশ ও তার পতনের ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে। এগুলি ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আরও ফ্যাসিবাদী শাসন দেখা গেলেও এই সীমিত পরিসরে সেগুলির আলোচনা থেকে আপাতত বিরত রইলাম।
ইতালি– প্রথম ফ্যাসিবাদের উত্থান
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালিতে গভীর হতাশা এবং তীব্র রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকট প্রচলিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিমূলে প্রবল আঘাত হানে। দেশে প্রবল খাদ্যাভাব ও মুদ্রাস্ফীতি শুরু হয়। কৃষি-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দুষ্প্রাপ্য ও অগ্নিমূল্য হয়ে ওঠে। যুদ্ধশেষে সেনাদল ভেঙে দিলে বেকার সমস্যা জটিলতর রূপ ধারণ করে। এই অবস্থায় রাশিয়ার বলশেভিক ভাবধারা ইতালিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বেকার যুবক ও শ্রমিকরা সমাজতন্ত্রী দলে যোগদান করতে থাকে। কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা হয়। ইতালির শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধি এবং কাজের সময় ও দ্রব্যমূল্য হ্রাস প্রভৃতির দাবিতে ডাকঘর, রেলসহ কলকারখানায় ধর্মঘট করতে থাকে। কৃষকরা খাজনা দেওয়া বন্ধ করে, জমিদারদের ভূসম্পত্তি দখল করে এবং তাদের হাতে বহু জমিদার প্রাণ হারান। দাঙ্গাহাঙ্গামা, লুঠতরাজ, ধর্মঘট– প্রভৃতি দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত হয়। শিল্পপতি, জমিদার ও মধ্যবিত্তশ্রেণি সমাজতন্ত্রীদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
যুদ্ধোত্তর ইতালিতে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বলেও কিছু ছিল না। ১৯১৯ থেকে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইতালিতে অন্তত ছয়টি মন্ত্রীসভা গঠিত হয়, কিন্তু কারও পক্ষেই ইতালির কোনো একটি সমস্যারও সমাধান করা সম্ভব হয়নি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জনসাধারণ শ্রদ্ধা হারায়। ১৯১৫ সালের ‘লন্ডন চুক্তি’-তে মিত্রপক্ষ ইতালিকে যে সমস্ত স্থানের উপর আধিপত্য বিস্তারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা ১৯১৯-এর ভার্সাই সন্ধিতে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে তখন থেকেই ইতালিতে উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়, যাদের বক্তব্য ছিল ইতালির প্রাপ্য বলপূর্বক দখল করতে হবে। তারা প্রচার চালায় যে বর্তমান উদারপন্থী সরকার ইতালিবাসীর আশা-আকাঙ্খা পূরণে অক্ষম।
জাতীয় জীবনের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে ইতালিতে বেনিতো আমিল্কারে আন্দ্রেয়া মুসোলিনি (Benito Amilcare Andrea Mussolini – ১৮৮৩-১৯৪৫ খ্রিঃ) নামে এক নেতার আবির্ভাব হয়। প্রথম জীবনে তিনি সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং সুইজারল্যান্ডে ‘আভান্তি’ নামে একটি সমাজতান্ত্রিক পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়। যুদ্ধের অবসানে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ মিলান শহরে ১১৮ জন কর্মচ্যুত সৈনিক ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের এক সমাবেশে ‘ফ্যাসিস্ট দল’ গড়ে তোলেন। এই দলের প্রতীক ছিল ‘ফ্যাসিস’ (Fasces) বা দড়িবাঁধা কাষ্ঠদণ্ড। প্রাচীন রোমের রাজশক্তির প্রতীক ছিল এই ‘ফ্যাসিস’। প্রাচীন ঐতিহ্যকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে তিনি এই প্রতীক গ্রহণ করেন। এই দলের মূল বক্তব্য ছিল যে, সকল শক্তির আধার রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের বাইরে বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু থাকতে পারে না। ব্যক্তির কোনো মূল্য নেই। বিশ্বে ইতালিকে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কমিউনিস্ট প্রভাব থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিককালে R. J. Bosworth যথার্থই মন্তব্য করেছেন, “Mussolini skillfully exploited the post-World War I discontent, presenting Fascism as a dynamic alternative to both liberal democracy and socialism.”১
ইতালিতে ফ্যাসিস্ট দলের সদস্যসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ইতালির প্রায় সত্তরটি শহরে দলের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। সাম্যবাদীদের চরমপন্থা ও গণতন্ত্রীদের অপদার্থতায় বীতশ্রদ্ধ ধনবান ব্যক্তি, শিল্পপতি ও সাধারণ মানুষ মুসোলিনিকে তাঁদের ত্রাণকর্তা মনে করে তাঁর দলকে অর্থসাহায্য করতে থাকেন। ঐতিহাসিক Denis Mack Smith স্বীকার করেছেন যে, “Mussolini’s rise to power was marked by his ability to manipulate the fears and hopes of the Italian middle classes, presenting himself as the only bulwark against socialism and Chaos.”২ ফ্যাসিস্টদের হাঙ্গামায় বিরোধী দলগুলি একরকম বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৯২১-এর নির্বাচনে ফ্যাসিস্ট দল ৩৫টি আসন লাভ করে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে মুসোলিনি ইতালির রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েলকে জানান যে, তিনি তাঁর ‘ব্ল্যাক শার্ট’ বাহিনী নিয়ে রোম নগরী অভিযান করবেন। ইতালির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সামরিক আইন জারি করে এই অভিযান বন্ধ করতে চাইলে রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমান্যুয়েল সম্মত হননি। এর ফলে রোমের লুইগি ফাক্টা (Luigi Facta)-র নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে এবং রাজার আহ্বানে মুসোলিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন (৩০ অক্টোবর, ১৯২২ খ্রিঃ)। এইভাবে মুসোলিনি ও তাঁর দল ক্ষমতা দখল করে।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়ে মুসোলিনি ইতালিতে ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। বিরোধী দলগুলির ওপর অত্যাচার, দমন-পীড়ন, বিরোধী নেতৃবৃন্দকে কারারুদ্ধ বা হত্যা করে সব রকম ফ্যাসিস্ট বিরোধিতার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ইতালিতে যে-সাধারণ নির্বাচন হয় তাতে গুন্ডামি ও কারচুপির দ্বারা ফ্যাসিবাদী দল ৬৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে যে নতুন সংবিধান প্রবর্তিত হয়, তার দ্বারা ইতালিতে অন্যান্য দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং দেশের সর্বক্ষেত্রে ফ্যাসিস্ট দলের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসোলিনি ‘ইল দ্যুচে’ (II Duce) বা ‘একনায়ক’ উপাধি ধারণ করেন।
নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভ করলেও মুসোলিনি ও ফ্যাসিস্ট দলের চালিকাশক্তি ছিল পার্লামেন্ট বহির্ভূত গণআন্দোলন, যার মতাদর্শ ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি পশ্চাৎপদ রোমান ক্যাথলিক চিন্তাধারা, উগ্র কমিউনিস্ট বিরোধিতা এবং স্বাধীন শ্রমিক সংগঠনের বিপরীতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শ্রমিক-মালিক সমঝোতা, যাতে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে শ্রমিক আন্দোলন দেখা না দেয়। ১৯২৫-২৭-এর মধ্যে সংসদীয় গণতন্ত্রের শেষটুকুও বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। অন্য সব দলকে বেআইনি ঘোষণা করে একনায়কতন্ত্রী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ফ্যাসিস্ট দলের বিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধিতার শামিল গণ্য করা হয়। সমস্ত বিষয়ে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়, যদিও রাষ্ট্র বলতে বোঝাত মুসোলিনি ও তাঁর দলকে। সব ট্রেড ইউনিয়নগুলির জায়গা নেয় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ফ্যাসিস্ট ট্রেড ইউনিয়ন। প্রায় দু-দশকের শাসনে ১৫০০০-এর বেশি ব্যক্তিকে রাষ্ট্রবিরোধী কাজের অভিযোগে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়। ইতালিতে ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্র ও সভাসমিতি করার স্বাধীনতা খর্ব হয়। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের থেকেও বেশি বিপজ্জনক ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ ও সংস্কৃতি। জনগণকে এক আধুনিক সমাজের স্বপ্ন দেখিয়ে বোঝানো হয় এই স্বপ্ন সার্থক করতে প্রয়োজন একনায়কতন্ত্র, এক শক্তিশালী নেতা ও এক শক্তিশালী রাষ্ট্র। তবে মুসোলিনির শাসনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ব্যাপক বর্ণবাদী, জাতিবাদী হিংসা ছিল না, তা শুরু হয় পরবর্তীকালে, যখন তিনি হিটলারের সঙ্গে হাত মেলান।
ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় অর্থনৈতিক বিকাশ যে খুব দ্রুত গতিতে হয়েছে তা নয়। কৃষিক্ষেত্রে অনুৎপাদক ইতালি শেষ অবধি অনুৎপাদকই থেকে গেছে। প্রাথমিক পর্বে বিমা ইত্যাদির বেসরকারিকরণ ঘটালেও, পরবর্তীকালে এক সময় সরকার দেশের অর্থনীতির দুই-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করে। এ প্রসঙ্গে John Whittam বলেছেন, “The Fascist regime’s economic policy was a combination of state intervention and private enterprise, but it often prioritized grandiose projects over the practical needs of the Italian economy.”৩ এ ছাড়াও তারা শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যয় করে। ক্ষোভ-বিক্ষোভ যাতে দানা না বেঁধে ওঠে, তার জন্য জনমুখী কর্মসূচি নেওয়া হয়। কিন্তু এ সবই ছিল সাময়িক। শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য হয় ফ্যাসিবাদী ভাবধারার অনুগত নাগরিক গঠন করা। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে উৎসাহ দিলেও সেই বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রীর জোগান ছিল অপর্যাপ্ত। এসবের ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ইতালির অর্থনীতি ভেঙে পড়ে ও যুদ্ধের শেষদিকে মুসোলিনির একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সৃষ্টি হয় প্রবল জনবিক্ষোভ।
ইতালির ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগ্রাম শুরু হয়েছিল মুসোলিনি ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই। ১৯২১ সালে ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতা দখলের প্রাক্কালে দুই সপ্তাহের সংঘর্ষে মৃত্যু হয় ৭১ জনের। ফ্যাসিস্টদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্ট, মধ্যপন্থী বুর্জোয়া উদারনীতিকরা। উল্লেখযোগ্য যে ১৯২১ সালে সোশ্যালিস্ট দলের বামপন্থী অংশ সোশ্যালিস্ট দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করে, যার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বোর্দিগা। বোর্দিগা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে সোশ্যালিস্ট দলের মধ্যে বিপ্লবী প্রবণতা তৈরি করেছিলেন। ১৯২১-এ সমাজতন্ত্রী দল ছিল ইতালির পার্লামেন্টের সর্ববৃহৎ দল, দ্বিতীয় স্থানে ছিল বুর্জোয়া উদারনৈতিক দল, আর জাতীয় ফ্যাসিস্ট দল ছিল তৃতীয় স্থানে।
বোর্দিগাদের সোশ্যালিস্ট-কমিউনিস্ট জোট বিরোধী মতের বিপরীতে ছিলেন আন্তনিও গ্রামশি, তিনি সোশ্যালিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। শুরুতে গ্রামশির মতামত সংখ্যালঘু থাকলেও ধীরে ধীরে তা সমর্থন অর্জন করতে থাকে। ১৯২৪ সালের নির্বাচন এক অর্থে ছিল প্রহসন। কিন্ত সমাজতান্ত্রিক দল ২৪টি আর কমিউনিস্ট পার্টি ১৯টি আসন পায়। বিরোধী দলগুলি পার্লামেন্ট বয়কট করে। এই পর্বে বিরোধী দলগুলিকে নিয়ে এক গোষ্ঠী তৈরি হয়, যার মধ্যে সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্ট এবং বুর্জোয়া দলগুলিও ছিল। এই জোটের মূল কর্মসূচি ছিল গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন। গ্রামশির চিন্তাকে মুসোলিনি সরকার এত ভয় পেয়েছিল যে তাঁকে ১৯২৬ সালে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ করে রাখে এবং পরবর্তীকালে কারাগারেই তাঁর মৃত্যু ঘটে।
১৯৪৩ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে মুসোলিনির শাসনের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন (Resistenza) গড়ে ওঠে যা সক্রিয় ছিল ১৯৪৫ পর্যন্ত।মিত্রশক্তি বিশেষত আমেরিকা, ব্রিটেন ও অন্যান্যরা ইতালিতে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে ও প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে সহযোগিতা করে। অবশেষে ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর পতন হলে তার দোসর মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকারেরও পতন ঘটে। মুসোলিনি গ্রেপ্তার হন ও ১৯৪৫-এর ২৮ এপ্রিল প্রতিরোধ যোদ্ধাদের দ্বারা তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। Ray Moseley যথার্থই বলেছেন, “Mussolini’s decision to join the Axis Powers was as much about prestige as it was about strategy, a move that ultimately led to Italy’s military disaster and his own downfall.”৪
জার্মানি
বিংশ শতকের প্রথমার্ধে জার্মানিতে আবির্ভূত নাৎসি (Nazi) পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত ‘নাৎসিবাদ’-কে (Nazism) একধরনের ‘ফ্যাসিবাদ’ বলে চিহ্নিত করা হয়। অ্যাডলফ হিটলারকে (Adolf Hitler) নাৎসিবাদের প্রবক্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পূর্ব পর্যন্ত এটি জার্মানির রাষ্ট্রীয় মতবাদ ছিল। দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, শিল্পবাণিজ্যে মন্দা, জনস্ফীতি, খাদ্যসংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি নানান সমস্যার কারণে মানুষের জীবন যখন দুর্বিষহ হয় ওঠে ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই সন্ধির (১৯১৯) অপমানজনক শর্তগুলো জার্মানদের মধ্যে গভীর উত্তেজনা ও প্রতিশোধ স্পৃহা জাগিয়ে তোলে, তখন ইতালির অনুকরণে জার্মানিতেও ‘নাৎসি’ নামক এক শক্তিশালী দলের উদ্ভব হয়। ফ্যাসিস্টদের মতো নাৎসিরাও ছিল প্রতিক্রিয়াশীল ও গণতন্ত্রের ঘোর বিরোধী। দেশে জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করাই ছিল নাৎসিদের লক্ষ্য। জার্মানির ওয়েমার প্রজাতন্ত্র (Weimar Republic) সাম্যবাদী আদর্শকে ঠেকালেও জনগণের স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে বা তাদের নতুন আশা আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে পারছিল না।
জার্মানিতে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অ্যাডলফ হিটলারের (১৯৩৩-১৯৪৫) নেতৃত্বে নাৎসি পার্টি (N.S.D.A.P) জার্মান রাষ্ট্রের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং একটি নিপীড়নমূলক একনায়কতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করে। হিটলার Der Fuhrer (The Leader) নামে পরিচিত হন। নাৎসি শাসন ছিল মানবাধিকারের জন্য বিপজ্জনক, যেখানে বিরোধী রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর উপর ব্যাপক অত্যাচার ও নিপীড়ন চালানো হয়। কমিউনিস্ট, সমাজতান্ত্রিক এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর সদস্যদের গ্রেপ্তার, কারাবন্দি, এবং অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। নাৎসি গোপন রাষ্ট্রীয় পুলিশ (Gestapo), সশস্ত্র নাৎসি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী (SA) এবং গুপ্ত পুলিশ বাহিনী (SS) রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সন্ত্রাস চালায়।
হিটলারের শাসনের সবচেয়ে নৃশংস দিক ছিল ইহুদি জনগণের উপর গণহত্যা (Holocaust)। ১৯২৫ সালে লেখা তাঁর আত্মজীবনী ‘Mein Kampf’-এ হিটলারের বক্তব্য ছিল প্রতিটি জার্মানকে তার জার্মান জাতির আর্য গরিমার ভিত্তিতে সংগঠিত হতে হবে। ইহুদিরা হচ্ছে নিকৃষ্ট ও পরগাছা জাতি এবং বুর্জোয়া উদারনৈতিক, সোশ্যালিস্ট এবং কমিউনিস্টরা এই ইহুদিদের দালাল। এই গণহত্যায় প্রায় ৬ মিলিয়ন ইহুদি নিহত হন। তাদের গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হয় এবং কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য করা হয়। Raul Hilberg ১৯৬১ সালে লিখেছিলেন, “The Holocaust was the culmination of Hitler’s obsession with racial purity, driven by an ideology that dehumanized Jews and led to their systematic extermination.”৫ ইহুদিদের পাশাপাশি রোমা জনগোষ্ঠী, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, সমকামী এবং অন্যান্য জাতিগত ও সামাজিক গোষ্ঠীর মানুষও হিটলারের শাসনে নিপীড়নের শিকার হয়। তাদের হত্যার পাশাপাশি তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় এবং বাধ্যতামূলক শ্রমে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৩৩-১৯৪৫ অবধি নাৎসি সন্ত্রাসের বলি ছিল প্রায় দু-কোটিরও বেশি মানুষ।
হিটলারের শাসনে ব্যক্তিস্বাধীনতা সম্পূর্ণ বিলোপ করা হয়। গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলি পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মুক্তচিন্তা এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। পার্লামেন্ট এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কার্যত অকার্যকর করে তোলা হয়। জার্মান পার্লামেন্ট ‘Reichstag’ হিটলারকে প্রায় পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করে, যা তাঁকে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, যেমন বাক্স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে হরণ করা হয়। জোসেফ গোয়েবলসের নেতৃত্বে নাৎসি সরকার প্রচার মাধ্যম, শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালায়। এর উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে নাৎসি মতাদর্শে বিশ্বাসী করে তোলা। বক্তৃতা ও শিক্ষার মাধ্যমে স্কুল থেকে শুরু করে সমাজের সব ক্ষেত্রে নাৎসি মতাদর্শ প্রচার করা হয়। নাৎসি যুবসংগঠনের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে জাতিগত ঘৃণা এবং নাৎসি মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস হয়। নাৎসি জার্মানির আধিপত্যবাদী শাসনের দুটি প্রধান ভিত্তি ছিল দমননীতি ও অর্থনৈতিক বিকাশ। দমন ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে যেমন আধিপত্য প্রষ্ঠার প্রয়াস করা হয়েছিল, তেমনি বৈষয়িক উন্নতির মাধ্যমে জনগণের স্বাচ্ছন্দ্য বিধান করে নাৎসি শাসনের প্রতি তাদের সমর্থন সুনিশ্চিত করা এবং সেইসঙ্গে এর মাধ্যমে জার্মানির সম্প্রসারণশীল পররাষ্ট্রনীতির উপযোগী ভিত্তি গঠন করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত অ্যাডলফ হিটলারের পতন ছিল একটি ধাপে ধাপে সংঘটিত প্রক্রিয়া, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে এসে চূড়ান্ত রূপ নেয়। হিটলারের পতনের মূল কারণগুলি ছিল সামরিক পরাজয়, মিত্রশক্তির আক্রমণ, অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং অবশেষে বাধ্যত তাঁর আত্মহত্যা।
১৯৪১ সালে হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আক্রমণ শুরু করেন, যা ‘Operation Barbarossa’ নামে পরিচিত। এই আক্রমণ প্রাথমিকভাবে সফল হলেও ১৯৪৩ সালের জানুয়ারিতে স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধে জার্মান বাহিনী পরাজিত হয়। ফলে হিটলারের সামরিক কৌশলগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে।
১৯৪৪ সালের ৬ জুন, মিত্রশক্তির সৈন্যরা নর্ম্যান্ডির উপকূলে অবতরণ করে (D-day), যা ‘Operation Overlord’ নামে পরিচিত। এই আক্রমণ জার্মান বাহিনীকে পশ্চিম ইউরোপ থেকে পিছু হটতে বাধ্য করে। একই সময়ে সোভিয়েত বাহিনী পূর্ব ফ্রন্টে অগ্রসর হতে থাকে, যা হিটলারের বাহিনীকে দুই দিক থেকে চাপে ফেলে।
যুদ্ধের শেষদিকে হিটলারের মানসিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তাঁর প্রতি তাঁর সামরিক কমান্ডারদের আস্থা হারাতে থাকে, এবং তাঁরা বুঝতে পারেন যে যুদ্ধ জয়ের আর কোনো সম্ভাবনা নেই। ২০ জুলাই ১৯৪৪ সালে হিটলারের বিরুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা চালায়, যা ‘Operation Valkyrie’ নামে পরিচিত। এই অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হলেও, এটি হিটলারের শাসনের প্রতি অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের ইঙ্গিত দেয়।
যুদ্ধের শেষদিকে, জার্মানির অর্থনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেশনিং, খাদ্যাভাব এবং জীবনযাত্রার মানের পতন জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। হিটলারের প্রতিশ্রুতি এবং যুদ্ধকালীন প্রচারের সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির পার্থক্য জনগণের বিশ্বাস ভেঙে দেয়। যুদ্ধের সময় পূর্ব ফ্রন্ট থেকে লাখ লাখ জার্মান শরণার্থী পশ্চিমে পালিয়ে আসে। এই শরণার্থী সংকট সরকারের ওপর চাপ বাড়ায় এবং হিটলারের শাসনের অদক্ষতা ও নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পায়। যুদ্ধের সময় জার্মান জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ দেখা দেয়। বোমা হামলা, খাদ্যাভাব এবং সামরিক পরাজয় জার্মানদের মধ্যে হতাশা এবং যুদ্ধবিরোধী মনোভাব তৈরি করে। যদিও হিটলারের শাসনের বিরুদ্ধে জার্মানির অভ্যন্তরে বড়ো আকারের বিদ্রোহ বা বিপ্লব হয়নি, তবে বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো প্রতিরোধ এবং বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা হিটলারের প্রতি জনসমর্থনের অভাবের প্রমাণ।
১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে, সোভিয়েত বাহিনী বার্লিনে আক্রমণ শুরু করে। মিত্রশক্তির অন্য বাহিনীগুলি জার্মানির বিভিন্ন অংশে অগ্রসর হতে থাকে এবং জার্মান বাহিনী দ্রুত পরাজিত হতে থাকে। যুদ্ধের শেষের দিকে হিটলারের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তাঁর নেতৃত্বে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো অযৌক্তিক এবং অসংলগ্ন হয়ে পড়ে, যা তাঁর সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে হতাশা এবং বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
হিটলারের অবস্থা খারাপ হওয়ার সাথে সাথে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। এই নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং সংঘর্ষ তাঁর শাসনের পতন ত্বরান্বিত করে। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল, সোভিয়েত বাহিনী বার্লিনের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর, হিটলার ও তাঁর স্ত্রী ইভা ব্রাউন আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারে আত্মহত্যা করেন।
হিটলারের আত্মহত্যার কয়েকদিন পর, ১৯৪৫ সালের ৭ মে, জার্মানির সামরিক বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। এর মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপীয় মঞ্চের সমাপ্তি ঘটে এবং হিটলারের শাসনের আনুষ্ঠানিক পতন ঘটে। ঐতিহাসিক Alan Bullock-এর ভাষায়, ‘The collapse of the Third Reich and Hitler’s suicide in the bunker marked the end of one of the most catastrophic regimes in history, a regime built on hatred, war, and destruction.’৬
চিলি
দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলবর্তী রাষ্ট্র চিলি ষোড়শ শতক থেকে স্পেনের একটি উপনিবেশ ছিল। ১৮১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে ও চিলির শেষ ভূখণ্ড চিলোয়ি স্পেনের শাসনমুক্ত হয় ১৮২৬ সালে। স্বাধীনতার পর নানা ঘটনা পরম্পরা পেরিয়ে ১৯৭০-এ সালভাদোর এলেন্দের অধীনে চিলিতে সমাজতান্ত্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠা ছিল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তিনিই ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম মার্কসবাদী রাষ্ট্রপতি। তবে খুব স্বল্প ব্যবধানে জয়লাভ করেছিলেন বলে রক্ষণশীল কংগ্রেসের কাছ থেকে তিনি সমাজতন্ত্রমুখী সংস্কারগুলি বাস্তবায়নে বাধা পান। এছাড়া পশ্চিম গোলার্ধে চিলির মতো একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উত্থান আমেরিকা সুনজরে দেখেনি। এলেন্দে সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই আমেরিকা চিলিতে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছিল। ১৯৭৩-এর প্রথমার্ধে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধ চিলিতে মুদ্রাস্ফীতিজনিত সামাজিক সংকট সৃষ্টি করে। বামপন্থী দলের উগ্র সমর্থকবৃন্দ দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দাবি জানাতে থাকে। ১৯৭৩-এর ১১ সেপ্টেম্বর চিলিতে এক সামরিক অভ্যুত্থান হয়। রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে হামলার সময় এলেন্দের মৃত্যু হয়। চিলিতে সমাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটে ও মার্কিন মদতে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতা লাভ করেন আউগুস্তো হোসে রামোন পিনোশে উগার্তে (Augusto Jose Ramon Pinochet Ugarte)। পিনোশের শাসনকালকে ফ্যাসিবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা একটু জটিল, যদিও তাঁর শাসনকালে কিছু ফ্যাসিবাদী উপাদান যে ছিল না তা নয়।
আউগুস্তো পিনোশের শাসনকালে (১৯৭৩-১৯৮৯ খ্রিঃ) যে সমস্ত ফ্যাসিবাদী উপাদান ছিল তা হল একদলীয় শাসন ও দমনমূলক ব্যবস্থা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সেনাবাহিনী ও গোপন পুলিশ ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ, শাসনের বৈধতা প্রদানের জন্য ব্যাপক প্রচার ও বিরোধী মতাদর্শকে দমন। কিন্তু পিনোশের শাসনকালে ফ্যাসিবাদী শাসনের মতো জাতীয়তাবাদ তেমন প্রচারিত হয়নি। বরং তাঁর শাসন ছিল সামরিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারমুখী। এছাড়া এই সময় ফ্যাসিবাদী আদর্শের তুলনায় নব উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতিতে বেশি মনোনিবেশ করা হয়েছিল। এই সময় দেশ থেকে শুধুমাত্র যে মার্কসবাদের অপসারণের চেষ্টা করা হয় তা নয়, সব ধরনের বামপন্থা, শ্রমিক সংগঠন, সংস্কার প্রচেষ্টা সব কিছুর বিরোধিতা করা হয়। অর্থনীতির বেসরকারিকরণের ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হতে থাকেন। প্রথমদিকে পিনোশের সামরিক শাসন অভিজাত, মধ্যবিত্তশ্রেণির একাংশ ও দক্ষিণপন্থীদের সমর্থন লাভ করলেও, ক্রমশ এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় যে, এই সামরিক নেতৃত্বের নিজস্ব রাজনৈতিক লক্ষ্য আছে। এই লক্ষ্য হল সমস্ত বামপন্থী, কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তি, ক্রিশ্চান ডেমোক্র্যাট দলসহ জাতীয় দল, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলকে দমন করা। সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট, প্রগতিবাদী দলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৪ সালে পিনোশে নিজেকে চিলির রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। প্রথম তিন বছরে প্রায় এক লক্ষ লোককে কারাবন্দি করা হয়। এঁদের অনেকের উপরেই নির্যাতন চালানো হয়। অনেকে নিখোঁজ হন। ১৯৭৭ নাগাদ দেখা যায় যে দেশে বিরোধীপক্ষের তেমন কোনো অস্তিত্ব নেই। নাগরিক অধিকারগুলি হরণ করা হয়। দেশে এক ধরনের সন্ত্রাসের শাসন সৃষ্টি হয়। এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক Mark Ensalaco লিখেছেন, “The Pinochet dictatorship is a paradigmatic example of state terror, where repression was silenced through fear and violence.”৭
১৯৭৮ সালে পিনোশে একটি গণভোটের আয়োজন করেন, যাতে ৭৫% মানুষ তাঁর নীতির প্রতি সমর্থন জানান। ১৯৮০ সালে পিনোশে নতুন সংবিধান রচনা করেন এবং আর-একটি গণভোটের মাধ্যমে সেটিকে কার্যকর করা হয়। নতুন সংবিধান অনুসারে পিনোশে আরও আট বছর দেশ শাসন করার শপথ নেন। তিনি নিজেকে একনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান ও সামরিক বাহিনীর প্রধানের পদ গ্রহণ করেন। পাশবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও কমিউনিস্টরা নিজেদের সংগঠন বজায় রাখতে সমর্থ হন। তাঁরা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত জাগ্রত করার ও এই শাসনকে কূটনৈতিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস চালিয়ে যেতে থাকেন। ক্রিশ্চান ডেমোক্র্যাটরাও সামরিক শাসনের বিরোধী হয়ে ওঠেন।
পিনোশের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠতে থাকে ১৯৭০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে। মানবাধিকার রক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি, রোমান ক্যাথলিক চার্চ চিলির পরিস্থিতির নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে। এ সময় পিনোশের সরকারের মুক্তবাজার নীতি ও অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ দেশের আর্থিক বিকাশকে ব্যাহত করে। আন্তর্জাতিক বাজারে চিলির প্রধান খনিজ সম্পদ তামার মূল্য কমে, জাতীয় ঋণ বাড়ে, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব তীব্র সমস্যার সৃষ্টি করে। ১৯৮২ সালের অর্থনৈতিক ধস পিনোশের অভ্যন্তরীণ প্রভাব অনেকাংশে খর্ব করে। চিলিতে তীব্র সরকারবিরোধী প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। ক্রিশ্চান ডেমোক্র্যাটিক দল ও অন্যান্য বিরোধী দলগুলি ‘ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স’ নামে বিরোধী গোষ্ঠী গঠন করে। কমিউনিস্ট ও রোমান ক্যাথলিক চার্চও বিরোধীদের সমর্থন করে। এগারোটি রাজনৈতিক দল ১৯৮৪ সালে ঐক্যবদ্ধভাবে ১৯৮৯-এর আগেই দেশে নির্বাচনের দাবি জানাতে থাকে। উল্লেখযোগ্য যে ১৯৮৬-তে পিনোশেকে হত্যার এক ব্যর্থ উদ্যোগ হয়। এই ঘটনার ফলে পিনোশে দমননীতি আরও তীব্র করেন।
১৯৮০-র দশকে তাঁর শাসনের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বিরূপ ভাব প্রদর্শন শুরু করে, যদিও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ-র সাহায্য নিয়েই তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। আমেরিকার দুই রাষ্ট্রপ্রধান রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ডের আমলে চিলিতে আমেরিকার সাহায্য ও ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও পিনোশের গোপন পুলিশের দ্বারা আমেরিকায় নিযুক্ত চিলির প্রাক্তন রাষ্ট্রদূতের হত্যাকাণ্ড দু-দেশের সম্পর্ক তিক্ত করে। ফলে ১৯৮০-র দশকে চিলিতে পিনোশের সন্ত্রাসবাদী শাসন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি আমেরিকাসহ চিলিকে আর্থিক সাহায্যদানকারী অন্যান্য দেশকেও চিলির প্রতি বিরূপ করে তোলে।
১৯৮৮ সালে পিনোশে চিলিতে আবার একটি গণভোট ডাকেন, কিন্তু এবার ৫৫% জনগণ তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দেন। নির্বাচকদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হলেও তিনি পদে বহাল থাকেন। তবে শেষ পর্যন্ত পিনোশে ১৯৮৯-এর ডিসেম্বরে চিলিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দিন ঘোষণা করতে বাধ্য হন। ঐ নির্বাচনে জয়ী হন ‘ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স’-এর প্রার্থী ক্রিশ্চান ডেমোক্র্যাটিক দলের প্যাট্রিসিও আইলউইন, যিনি ১৯৯০ সালের ১১ মার্চ শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন। এই ঘটনা চিলিতে গণতন্ত্রের জয় ঘোষণা করে। তবে পিনোশে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেও ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি সামরিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন এবং রাজনীতিতে নেপথ্য প্রভাব রেখে যাচ্ছিলেন। ১৯৯৮-এ পিনোশেকে ব্রিটেনে গ্রেপ্তার করা হয় ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিচারের কথা বলা হয়। তবে ২০০০ সালে অসুস্থতার কারণে তিনি চিলিতে ফিরে এলে বিচারে উপস্থিত হওয়া থেকে চিলির আদালত তাঁকে রেহাই দিলেও রাজনৈতিক জীবন থেকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়। গৃহবন্দি অবস্থায় ২০০৬ এর ১০ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। উল্লেখযোগ্য যে, তাঁর বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা থাকলেও কোনটিরই নিষ্পত্তি হয়নি।
ইন্দোনেশিয়া
১৯৬০-এর দশকে ইন্দোনেশিয়াতে আবির্ভাব ঘটে জেনারেল মুহম্মদ সুহার্তোর। সুহার্তো ১৯৪০ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্রুত উন্নতি লাভ করে তিনি মেজর জেনারেলের পদ অধিকার করেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ একত্রিশ বছর ধরে ইন্দোনেশিয়া শাসন করে এসেছেন এই দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদ ও সামরিক নেতা। তাঁর শাসনকাল ‘নতুন আদেশ’ (Orde Baru) নামে পরিচিত ছিল।
ফ্যাসিবাদ যে সকল নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যুক্ত সুহার্তোর শাসনকালে তা সরাসরি প্রযোজ্য না হলেও বেশ কিছু ফ্যাসিবাদী উপাদান লক্ষ করা যায়। যেমন– সুহার্তোর শাসনকালে কঠোরভাবে রাজনৈতিক বিরোধিতা দমন, সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষা, রাষ্ট্রের প্রচারমাধ্যগুলোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল– যা ফ্যাসিবাদী শাসনেরও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে সুহার্তোর শাসনকালে ইন্দোনেশীয় জাতীয়তাবাদ প্রচারিত হলেও তা ফ্যাসিবাদী শাসনের মতো কঠোর জাতীয়তাবাদী আদর্শে পরিচালিত ছিল না। আর এই শাসন একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শুরু হলেও তা কিছুটা গণতান্ত্রিক বৈধতা বজায় রেখে চলেছিল। অর্থাৎ, তাঁর শাসনকে এক বিশেষ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে যা ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ইন্দোনেশিয়ার জন্য স্বতন্ত্র ছিল।
১৯৫৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি ও জাতির জনক সুকর্ন সেনাবাহিনী ও কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন নিয়ে ঘোষণা করেন যে ইন্দোনেশিয়া এখনও পশ্চিমি গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে তিনি প্রবর্তন করেন ‘Guided Democracy’ নামের এক ছদ্মবেশী একনায়কতন্ত্র। সুকর্ন সবসময় সেনাবাহিনী, ইন্দোনেশিয়ার সমাজতান্ত্রিক দল এবং ধর্মীয় দলগুলোকে একে অপরের সাথে বিরোধে লিপ্ত থাকতে দিতে চাইতেন। ১৯৬২ সালে ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি সুকর্নের সরকারে যোগ দেয়। ১৯৬৫ সাল নাগাদ চিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পরে ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি (P.K.I) বিশ্বের বৃহত্তম কমিউনিস্ট পার্টিতে পরিণত হয়। ১৯৬৫-এর এপ্রিলে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রধান আহমেদ ইয়ানি ঘোষণা করেন যে, তিনি একটি পৃথক কমিউনিস্ট বাহিনী (Communist Militia) গঠন করবেন। সুকর্ন এতেও সায় দেন।
১৯৬৫-এর ৩০ সেপ্টেম্বর সুকর্নের কয়েকজন দেহরক্ষী আর সামরিক বাহিনীর কয়েকজন সদস্য মিলে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেন। এই অভ্যুত্থানে ইন্দোনেশিয়ার শীর্ষ সামরিক নেতাদের মধ্যে ছয় জনকে হত্যা করা হয়। অভ্যুত্থানকারীরা দাবি করেন যে তাঁরা একটি সামরিক কাউন্সিলের নেতৃত্বে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। মেজর জেনারেল সুহার্তো দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি জাকার্তায় অবস্থিত ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর কৌশলগত রিজার্ভ কম্যান্ডের (KOSTRAD) প্রধান ছিলেন। তিনি সফলভাবে অভ্যুত্থান দমন করেন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
সুহার্তো ও তাঁর সমর্থকরা অভ্যুত্থানের জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন অভিযান শুরু করেন। শুরু হয় কমিউনিস্ট নিধন যজ্ঞ। সুকর্নকে ক্ষমতাহীন আর গৃহবন্দি করা হয়। উল্লেখযোগ্য যে, ক্ষমতায় আসার পরে সুকর্ন সামরিক অভিযান আর বিশ্ব রাজনীতির পিছনে ছুটতে গিয়ে নিজের দেশের অর্থনীতির ওপরে মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। ফলে জনসাধারণের মধ্যেও অসন্তুষ্টি ছিল ব্যাপক। আর ধর্মীয় দলগুলো তো মারমুখী হয়েই ছিল। ইন্দোনেশিয়ার শহরে গ্রামে শুরু হয় একের পর এক হত্যাকাণ্ড, যা ইতিহাসে এক বৃহত্তম গণহত্যার ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনী, সুহার্তো তখন যার সর্বেসর্বা, কমিউনিস্টরা ছাড়াও তাদের বলি হয় ইন্দোনেশিয়াতে বসবাসকারী চিনা লোকেরাও, যাদের চিনের দালাল, গুপ্তচর, নাস্তিক ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়। জাকার্তা হয়ে জাভা, বালি এবং সুমাত্রা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে হত্যাকাণ্ড। কমিউনিস্টরা প্রশিক্ষিত একটি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিশেষ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান দিপা নুসানতারা আইদিতকে ১৯৬৫ সালেই হত্যা করা হয়। বালি অঞ্চল হিন্দুপ্রধান হলেও সেখানেও কমিউনিস্টরা পার পায়নি। জাভা অঞ্চলের আবাংগান মুসলিমদেরকেও (কিছুটা নরমপন্থী মুসলিম) বাদ দেওয়া হয়নি। কোনো কোনো ঘটনায় ক্রিশ্চানরাও হত্যায় অংশ নিয়েছে বলে জানা যায়। সুমাত্রা অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ জাভাদেশীয় মানুষকে হত্যা করা হয় চিরাচরিত ‘বসতি স্থাপনকারী-আদিবাসী’ বিতর্ককে কেন্দ্র করে।
১৯৬৫-র পরবর্তী দশ বছর ধরে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ আর সরকারি জেল-জুলুম অগণিত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। পশ্চিমি বিশ্বে রবার্ট এফ কেনেডি এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের আন্দ্রেই শাখারভ ছাড়া আর কাউকে এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি সে সময়। এমনকি জাতিসংঘ পর্যন্ত নীরব ছিল। চিন অবশ্য খুবই কড়া প্রতিবাদ জানায়, তবে তাতে ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনী সমর্থিত সরকার বিশেষ পাত্তা দেয়নি। ইন্দোনেশীয় সরকারের হিসেবে মৃতের সংখ্যাটা আশি হাজারের মতো হলেও গবেষকদের ধারণা কমপক্ষে দশ থেকে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয় এই সময়ে।
১৯৬৬ সালের ১১ মার্চ সুহার্তো একটি ডিক্রি (Supersemar) জারি করে দেশে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে নেন। ১৯৬৭-র মার্চে সুকর্ন-কে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অপসারিত করা হয়। ১৯৬৭-র ১২ মার্চ সুহার্তো ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। ১৯৬৮-তে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন ও ‘নতুন আদেশ’ (Orde Baru) শাসনকাল শুরু করেন। সুকর্নকে গৃহবন্দি করে রাখা হয় এবং সেখানেই তিনি ১৯৭০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। সুহার্তোর ক্ষমতায় আসার প্রক্রিয়া ছিল রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রমের একটি জটিল মিশ্রণ, যার মাধ্যমে তিনি ইন্দনেশিয়ার শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
সুহার্তো ‘বার্কলে মাফিয়া’ নামে পরিচিত একদল অর্থনীতিবিদ এবং মার্কিন সাহায্যে রাতারাতি ইন্দোনেশিয়াকে বদলে ফেলেন। সরকারি সম্পত্তির বেসরকারিকরণ করা হয়। ধনীগোষ্ঠী গজিয়ে ওঠে যত্রতত্র, বাড়তে থাকে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য, দুর্নীতি এবং রাষ্ট্র সমর্থিত মাফিয়াদের যন্ত্রণা। ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতিতে কমিউনিস্টদের ইতি টানা হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে সুহার্তোর নির্দেশেই তাঁর নৃশংস জেনারেলরা পূর্ব তিমুরে হামলা এবং ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
১৯৯৮ সালে এশিয়ার অর্থনৈতিক বাজারে যে ধস নেমেছিল তার প্রভাবে ভেঙে পড়ে ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি। জনসাধারণের রোষ গিয়ে পড়ে রাষ্ট্রপতি সুহার্তোর ওপর। বিক্ষোভ বেআইনি ঘোষণা করা হলেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় তখন প্রতিবাদ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সুহার্তোর পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ উত্তাল হয়ে ওঠে। ১৯৯৮ সালে এই পরিবেশের মধ্যেই শীর্ষস্থানীয় ত্রি-শক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেন এবং নিজেরাই বিক্ষোভ সংগঠনের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৮ সালে জাকার্তায় ছাত্রবিক্ষোভ দমন করতে পুলিশ শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর গুলি চালায়। সেদিন গুলিতে মারা গিয়েছিল চারজন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে রক্তাক্ত মৃত্যুর ঘটনার পর জাকার্তার বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে অব্যাহত ছাত্র বিক্ষোভ, অন্যদিকে উচ্ছৃঙ্খল জনতার ভাঙচুর ও লুটতরাজের কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়ে সুহার্তোর সরকার। তিনদিনের দাঙ্গায় প্রাণ হারায় প্রায় হাজার খানেক মানুষ। পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট সুহার্তো। সুহার্তোর পতন সম্পর্কে Edward Aspinall মন্তব্য করেছেন, ‘Suharto’s downfall was the result of a combination of economic crisis, growing public discontent, and the loss of support from key elites, leading to the end of his 32-year rule.’৮ সুহার্তোকে আদালতের সামনে দাঁড় করানো যায়নি। শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে তাঁর মৃত্যু হয় ২০০৮ সালে।
পরিশেষে বলা যায় যে, ফ্যাসিবাদ সাধারণত রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময়ে উদ্ভূত হয়। এটি ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। তবে ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন ঘটে মূলত এর নিজস্ব অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও গণপ্রতিরোধের কারণে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি জনগণের দাবি, আন্তর্জাতিক চাপ ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে মানবজাতির সচেতন থাকা উচিত যাতে আলোচিত ভয়ানক মানববিদ্বেষী, ঘৃণা ও হিংস্রতার মতাদর্শবাহী ফ্যাসিবাদের মতো ধ্বংসাত্মক শক্তির উত্থান পুনরায় না ঘটতে পারে এবং গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ সংরক্ষিত হয়।
সূত্র নির্দেশ:
১। R. J. B Bosworth, ‘Mussolini’s Italy : Life under the Fascist Dictatorship, 1915-1945’ (2006)
২। Denis Mack Smith, ‘Mussolini’ (1981)
৩। John Whittam, ‘Fascist Italy’ (1995)
৪। Ray Moseley, ‘Mussolini’s Shadow : The Double Life of Count Galeazzo Ciano’ (1999)
৫। Raul Hilberg, ‘The Destruction of the European Jews’ (1961)
৬। Alan Bullock, ‘Hitler: A Study in Tyranny’ (1952)
৭। Mark Ensalaco, ‘Chile Under Pinochet : Recovering the Truth’ (2000)
৮। Edward Aspinall, ‘Opposing Suharto: Compromise, Resistance and Regime Change in Indonesia’ (2005)
ঋণ স্বীকার:
১। Roger Griffin, ‘The Nature of Fascism’ (1991)
২। Lawrence Britt, ‘Fascism Anyone?’, ‘‘Free Enquiry’’ Magazine (Vol 23, No.2, 2003)
৩। Norman Lowe, ‘Mastering Modern World History’ (2013)
৪। Tim Hannigan, ‘A Brief History of Indonesia’ (2015)
৫। Peter Calvocoressi, ‘World Politics since 1945’ (First published 1968, 9th Ed. 2009)