ইকোফ্যাসিবাদ ও বিপন্ন পরিবেশ

রাহুল রায়

কথাসার

ইকোফ্যাসিবাদ শব্দটি পরিবেশবাদের সঙ্গে জাতিসম্বন্ধীয়-জাতীয়তাবাদ এবং স্বৈরাচারী ভাবাদর্শকে সুচতুরভাবে মিশিয়ে দেয়। সংজ্ঞার দিক থেকে ইকোফ্যাসিবাদ হল এমন যে কোনো ধরনের পরিবেশবাদ, যা মানব-সমাজে অসাম্যকে আরও শক্তিশালী করতে হিংসা ও জুলুমকে সমর্থন করে। এই কাজে এদের লক্ষ্য একদল বিশেষ মানুষ। ইকোফ্যাসিবাদী ধারণায় সমাজে কিছু ব্যক্তিবিশেষ এবং বিশেষ কোনো জাতির মানুষ একচেটিয়া প্রাকৃতিক সম্পদ ভোগ এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকারী। এই ধারণায় একদল মানুষ ‘নেটিভ প্রজাতি’-র তকমা পায়, অন্যরা হয়ে পড়ে ‘আক্রমণাত্মক প্রজাতি’। পরিবেশ সমস্যার জন্য ইকোফ্যাসিবাদীরা গরিব মানুষ, কালো চামড়ার মানুষ, অক্ষম মানুষ এবং অন্য যে-কোনো ধরনের প্রান্তিক মানুষের ঘাড়ে দোষ চাপায়। 

ইকোফ্যাসিবাদী ধারণা ও তার উগ্র রূপ

কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলেকজান্ডার মেনরিস্কি বলছেন, ফ্যাসিবাদের মতোই ইকোফ্যাসিবাদকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা বেশ কঠিন। রাজনৈতিক তাত্ত্বিকদের মতে, ইকোফ্যাসিবাদ ভাবাদর্শ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না; বরং সমাজে প্রচলিত সাংস্কৃতিক ধারণাগুলিকে কীভাবে জাতিসম্বন্ধীয়-জাতীয়তাবাদের লক্ষ্যে হাতিয়ার করে তোলা যায়, সেদিকেই এর নজর। পরিবেশের সাথে সাদা চামড়ার আধিপত্য জুড়ে দিয়ে পাশ্চাত্যের মৌলবাদী দক্ষিণপন্থীরা ইকোফ্যাসিবাদকে আঁকড়ে ধরে। প্রাকৃতিক সম্পদের উপর একমাত্র সাদা চামড়ার মানুষেরই অধিকার, এমন ক্ষতিকর ধারণা চিরস্থায়ী করতে চেয়ে এরা তর্কবিতর্ক জোড়ে। এমনকি সমাজে বেশ কিছু হাই-প্রোফাইল মানুষয়স্পষ্টভাবে নিজেদের ইকোফ্যাসিবাদী বলেন। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে ক্রাইস্টচার্চ, নিউজিল্যান্ড-এর মসজিদে অস্ট্রেলিয়া-র ব্রেন্টন ট্যারেন্ট নামে যে ব্যক্তি ৫১ জন মানুষকে হত্যা করেছিল, তার কথা বলা যায়। আবার বিগত ২০২২ সালের মে মাসে বছর কুড়ির মার্কিন যুবক পেটন জেন্ড্রন দীর্ঘ পথ গাড়ি চালিয়ে নিউ ইয়র্ক-এর বাফেলো সুপারমার্কেটে এসে ১০ জন কালো চামড়ার মুদি-দোকানিকে গুলি করে মারে। এই গণহত্যার পিছনেও সাদা চামড়ার আধিপত্যের ধারণাটি কাজ করেছিল।

এই দক্ষিণপন্থীরা নিজের দেশে যেখানে-সেখানে আবর্জনা ফেলা বা দূষণের ব্যাপারে পুরোপুরি অভিবাসীদের দায়ী করে। জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে নিজেদের নিষ্ক্রিয়তা বা অকর্মণ্যতা ঢাকতে অন্য দেশের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের দিকে আঙুল তোলে। এসব ভাবনা-চিন্তা সূক্ষ্মভাবে মানুষের নিত্যদিনের আলোচনায় ঢুকে পড়ে ক্ষতিকর বিশ্বাসগুলোকে এক স্বাভাবিক বিষয় করে তোলে। চরমপন্থী নানান ইস্তাহার রচনার রসদ জোগায়। 

ইকোফ্যাসিবাদীরা প্রায়ই একটা তর্ক করে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য পরিবেশ সমস্যার জন্য কিছু প্রান্তিক মানুষ যাদের গায়ের চামড়া সাদা নয়, প্রাথমিকভাবে দায়ী। এটি যুক্তিহীন। কারণ, এই গ্রহে মাথাপিছু গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ আমেরিকাতেই সবচেয়ে বেশি। বাস্তবে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কোনও ভূ-রাজনৈতিক সীমানা মানে না। মূলত যে কারণগুলির দ্বারা এটি ঘটে সেগুলি হল, বিশ্বজোড়া ট্রান্সন্যাশনাল ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, ভোগবাদ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা– যার সুবিধাগুলি প্রায়শই এই গ্রহের উত্তরের ধনী দেশের মানুষ ভোগ করে।

অন্যান্য পরিচিত ইকোফ্যাসিবাদী ধারণাগুলির মধ্যে আর একটি মানববিদ্বেষী বিবৃতি দেখা যায় যে, মানুষ ছাড়া পৃথিবী আরও ভালো থাকবে। সাম্প্রতিক অতীতে আমরা করোনা মহামারির শুরুতে এবং পরবর্তীকালে আবিশ্ব লকডাউনের সময় এই ধারণার টুকিটাকি দিকগুলি দেখেছি। বাইরে বেরোনো মানুষের সংখ্যা তখন কমে যাওয়ায়, রাস্তায় কোনো গাড়ি বা আকাশে কোনো বিমান না চলায় দূষণ মাত্রা ঝপ করে নেমে যাওয়ায় এবং বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাস মেশার সাময়িক বিরতিতে কিছু মানুষ এমনটিও দাবি করেছিল যে, আসলে ‘মানুষই ভাইরাস’। মূলত এই বক্তব্যের মধ্যে তারা ইঙ্গিত দিয়েছিল, বাস্তুতান্ত্রিক পুনরুদ্ধার তখনই সম্ভব, যদি আমরা এই গ্রহে আর না-থাকি। 

যে শোষণমূলক পুঁজিবাদী কাঠামো বা ব্যবস্থাগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী এবং একে ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে, সেগুলি খতিয়ে দেখার এবং নিয়ন্ত্রণ করার পরিবর্তে যখন অতিরিক্ত জনসংখ্যা, অভিবাসন এবং কিছু ক্ষেত্রে অতি-শিল্পায়নের ঘাড়ে দোষ চাপানো হয়, তখন তা প্রাণঘাতী হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার এমন ইকোফ্যাসিবাদী ধারণা যা নব্য-নাৎসি মতাদর্শ; গণহত্যা এবং উগ্রপন্থী হামলার সাথে যুক্ত, চরম এক মন্দের দিকে মানুষকে ঠেলে দেয়। অধ্যাপক মেনরিস্কি বলছেন, আবিশ্ব জলবায়ু সংকটের মধ্যে সাধারণ মানুষ প্রায়শই কিছু না বুঝে, পরিবেশবাদের ছদ্মবেশী প্রতিক্রিয়াশীল ও বর্ণবাদী এই ধারণাগুলিকে গ্রহণ করে। 

ইকোফ্যাসিবাদ– ফিরে দেখা 

ইকোফ্যাসিবাদ-এর মূলে রয়েছে জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শ। বিশ শতকের একেবারে গোড়ায় জার্মান ভূগোলবিদ ফ্রেডরিক রাৎসেল আমাদের ‘লেবেনস্রাউম’ (লিভিং স্পেস)-এর ধারণাটি দেন। এই ধারণায় এমন এক বাস্তুতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে যেখানে সভ্যতা বিকশিত হতে পারে। লেবেনস্রাউম ধারণায় জাতীয়তাবাদী সমাজতান্ত্রিক দল ওরফে নাৎসি দলের প্রধান অ্যাডলফ হিটলার প্রভাবিত হয়েছিলেন। পরবর্তী দশকগুলিতে নাৎসি এবং নব্য-নাৎসিরা বিশ্বজুড়ে পরিবেশবাদকে হাইজ্যাক করে এবং নিজেদের স্বার্থের জন্য লেবেনস্রাউম-এর ভাবাদর্শকে ইচ্ছেমতোন বাঁকিয়ে-চুরিয়ে ব্যবহার করে। এদের বিশ্বদৃষ্টিতে, প্রকৃতিকে রক্ষা করা এবং মানুষের বাস্তুতান্ত্রিক উৎস সংরক্ষণের নির্দোষ দাবি থেকেই পরিবেশবাদ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে এবং মূল (আদি) জাতি দ্বারাই বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চলের কার্যকলাপের উন্নতিবিধান সম্ভব। লক্ষণীয়, এই বক্তব্যে বহু-সংস্কৃতিবাদ এবং আন্তঃসীমান্ত চলন বা গতিবিধির বিরোধিতার সুর স্পষ্ট। এখানে জরুরি একটি কথা বলার, অনেক দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার করলেও ইকোফ্যাসিবাদীরা একে স্বীকার করে, তবে এর সমাধানের বেলায় ভিনদেশী এবং জাতিগত বিষয়টিকেই মাথায় রাখে। 

ইকোফ্যাসিবাদ যেভাবে ছড়ায়

অনেকে প্রায়শই ইকোফ্যাসিবাদকে একটি প্রান্তিক, চরমপন্থী গোষ্ঠীর কাছাকাছি রাখেন; কিন্তু বাস্তব হল, ইকোফ্যাসিবাদীরা যেভাবে ভাবনাচিন্তা করে, সেগুলি আমাদের সংস্কৃতিতেই রয়েছে এবং এটিই সবচেয়ে কঠিন সমস্যা। ইকোফ্যাসিবাদীরা আন্তর্জালে অনলাইন ফোরাম-এ মানুষের সাথে যোগাযোগ বজায় রেখে তাদের ধ্যানধারণা ভাগ করে নেয় এবং অন্যদের, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, যারা জলবায়ু সংকট নিয়ে চিন্তিত, তাদের দলে ভেড়াতে চেষ্টা করে। কারণ আজকের তরুণ প্রজন্মের বেশির ভাগেরই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্‌বেগ রয়েছে। 

ইকোফ্যাসিবাদীরা আন্তর্জাল থেকে অনলাইন-এ সাদাচামড়া-আধিপত্যবাদী মন্তব্যগুলি, অথবা জাতিগত ‘প্রতিস্থাপন তত্ত্ব’-র সর্বশেষ সংস্করণ, যা যুক্তি দেখায় যে, প্রথমত, জাতি মানবসমাজের এক স্থিতিশীল অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য এবং দ্বিতীয়ত, সাদা চামড়া নয়, এমন মানুষের সংখ্যা শুধু বাড়ছেই না, বরং সাদা চামড়ার মানুষদের বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্র করছে। উল্লেখ্য, এটাই ছিল নিউ ইয়র্ক-এর বাফেলো সুপার মার্কেটে বন্দুকবাজের যুক্তি। এই একই ধরনের সুর কি আমাদের দেশেও শোনা যাচ্ছে না যে হিন্দুরা বিপন্ন? 

অসার কিছু ইকোফ্যাসিবাদী বক্তব্য

ইকোফ্যাসিবাদীদের মতে অতিরিক্ত জনসংখ্যা জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য পরিবেশ সমস্যার মূল কারণ। বাস্তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমছে, ৫০ বছর আগে প্রতি বছর ২.২ শতাংশ থেকে বর্তমানে প্রতি বছর ১.০ শতাংশ। এটা অনস্বীকার্য যে, পৃথিবীতে মানুষের মোট জনসংখ্যার একটি ছোটো অংশ একটি বড়ো অংশের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য দায়ী, যদিও এর অশুভ পরিণতি তাদেরই সবচেয়ে কম ভুগতে হয়। সবচেয়ে ধনীরা (বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ) পৃথিবীর মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ৫০ শতাংশ নির্গত করে, যেখানে সবচেয়ে গরিব মানুষেরা (বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ) ৭ শতাংশের কম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে। মূল সমস্যাটি জনসংখ্যা নয়। সমস্যাটি পুঁজিবাদী নির্দিষ্ট কাঠামোয় সম্পদ আহরণ, তার ব্যবহার এবং সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থার। 

ইকোফ্যাসিবাদীরা বলেন, মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর এবং তারা একত্রিত না হলে সম্পদ নিঃশেষিত হবে। মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে টেকসইভাবে সম্পদ ব্যবহার ও তার পরিচালনা করেছে। সম্পদের নিঃশেষিত হওয়া নির্ভর করে বিশেষ সাংস্কৃতিক নিয়ম, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং অতি-ব্যবহারের ধরনের ওপর। যারা শুরু থেকেই সম্পদের ওপর অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে সবচেয়ে উপকৃত হয়েছে, তারাই প্রকৃতপক্ষে সম্পদ ধ্বংসের জন্য দায়ী।

ইকোফ্যাসিবাদীদের আর একটি বক্তব্য, মানুষ এই গ্রহে একটি রোগের মতো। বিপর্যয় এবং মহামারি হল প্রকৃতির প্রতিশোধ। এই বক্তব্যে বক্তা মানে নিজেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এটি এমন এক ধারণা যা আজকের সাদা চামড়া-আধিপত্যবাদী পরিবেশবাদকেই উসকানি দেয়। সবচেয়ে উদ্‌বেগজনক হল, এই যুক্তিগুলি ক্রমশ বামপন্থী এবং রাজনৈতিক মধ্যপন্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রচারিত হয়। ঐতিহাসিকভাবে ফ্যাসিবাদ এভাবেই কাজ করেছে। ফ্যাসিবাদী আন্দোলন খুব কমই কঠোর-আদর্শনিষ্ঠ হয়। পরিবর্তে তারা জাতীয়, জাতিগত, জাতপাতগত এবং পরিবেশগত সাধারণ প্রচলিত ধ্যানধারণাগুলির মধ্য দিয়েই নিজেদের চিন্তাভাবনা ছড়িয়ে দেয়। এই কারণেই জীবজগতের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী পরিবেশবাদীদের মুখেও ইকোফ্যাসিবাদী যুক্তির কথা শোনা যায়।

মেনরিস্কি জানাচ্ছেন, আর একটি সাধারণ ইকোফ্যাসিবাদী বক্তব্য হল, ‘যে কোনও মানুষের মৃত্যুই ভালো, কারণ এর ফলে কম সংখ্যক মানুষ সম্পদ ব্যবহার করবে এবং পরিবেশ অবনমনে অল্প কিছু মানুষের অবদান থাকবে।’ এখানে বলার, সমস্ত মানুষকে দোষারোপ করা ওপরে আলোচিত বাস্তব পার্থক্যগুলিকে অস্বীকার করারই নামান্তর।  

পর্যটনের বিভিন্ন মাধ্যমের কারণে বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন নিয়ে আলোচনা করার সময় যাতায়াতের সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও উঠে আসে। অভিবাসীদের (বহিরাগত গোষ্ঠী) বিমান যাতায়াতের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে পরিবেশ দূষণ ঘটে, এই যুক্তি খাড়া করে তাদের যাতায়াতের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রচার চলে। কিন্তু মাথায় থাকে না যে, পৃথিবীজুড়ে আমাদের ধনুকবেররা সর্বত্র ব্যক্তিগত বিমানেই যাতায়াত করতে বেশি অভ্যস্ত। 

ইকোফ্যাসিবাদী ভাবাদর্শে বিশ্বাসীদের আধুনিক যুগের প্রযুক্তিগত ও শিল্পগত অগ্রগতির বিপরীতে গিয়ে নিষ্কলুষ প্রকৃতিতে ফিরে যাওয়ার এক রোমান্টিক ঝোঁক দেখা যায়। এই ‘ডি-গ্রোথ’-এর যুক্তিটি গোলমেলে এবং সামাজিকভাবে প্রগতিশীলও নয়।

রাষ্ট্র যখন ইকোফ্যাসিবাদী 

জন স্কেলস্‌ আভেরি তাঁর ‘ফ্যাসিজম, দেন অ্যান্ড নাও’ বই-তে জানাচ্ছেন, এক নিবন্ধে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্ড্রু গ্লিকসন লিখেছেন– ‘ট্রেনটি স্টেশন ছেড়েছে এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রথমে +২ ডিগ্রি এবং তারপরে +৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের দিকে এগোচ্ছে, যেমনটি আইপিসিসি (ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ) অনুমান করেছে।’ জার্মানির প্রধান জলবায়ু বিজ্ঞানী জোয়াকিম হ্যান্স শেলনহ্যুবার-এর ভাষায়, পৃথিবীর ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠার ঘটনা সভ্যতার ভাঙনকে সূচিত করেছে। যদিও বেশিরভাগ প্রধান সংবাদমাধ্যমে একে আমল দেওয়া হচ্ছে না, বা এর গুরুত্বকে তরলীকরণের চেষ্টা চলছে। বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলগুলির কাছে জলবায়ু পরিবর্তন ব্রাত্যই থেকে গেছে।  

বিশ্বজুড়ে নানান রাষ্ট্রের ইকোফ্যাসিবাদী আচরণ বা মনোভাব মোটেই বিরল নয়। প্রবন্ধের নির্দিষ্ট পরিসরের কথা মাথায় রেখে এখানে দু-একটি রাষ্ট্রের কথা বলা হচ্ছে, যা না বললেই নয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকার, ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি থেকে সরে আসা এবং জীবাশ্ম-জ্বালানির, যা মানব সমাজ এবং জীবমণ্ডলের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড়ো বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই জীবাশ্ম-জ্বালানি শিল্পের খুল্লামখুল্লা পৃষ্ঠপোষকতার জন্য অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি ট্রাম্প-এর রিপাবলিকান দলটিকে ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক সংগঠন’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে প্রাইমারি-তে মনোনীত হওয়ার সম্ভাবনায় প্রতিটি রিপাবলিকান প্রার্থী জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার করেছিলেন। প্রত্যেকে জীবাশ্ম-জ্বালানি সংস্থাগুলির কাছ থেকে আশ্চর্যরকম মোটা অঙ্কের চেক পেয়েছিলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধু প্যারিস চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়েই আনেননি, দেশের ‘পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা’-র সঙ্গে এমন নাশকতামূলক আচরণ করেছিলেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সংস্থাটি অতি সতর্কতার সাথে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছিল, ট্রাম্প প্রশাসনের হাত থেকে তাদের বাঁচাতে বিজ্ঞানীরা গোপনে সেগুলি সংরক্ষণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি চালু করার উদ্যোগেও নাশকতা করেছিলেন। বিপরীতে কার্বন নিঃসরণকারী বৃহৎ কয়লা নিগমগুলিকে প্রচুর ভর্তুকি দিয়েছিলেন। আইপিসিসি-র ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে যখন বিশ্ব উষ্ণায়নকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বাতাসে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৩ শতাংশ কমিয়ে আনতে পৃথিবীর ১৯৬টি রাষ্ট্র সহমত হয়ে এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে সই করল, সেখানে এর পরেও জেপি মরগ্যান চেজ সহ অন্যান্য মার্কিন ব্যাংক জীবাশ্ম-জ্বালানি শিল্পকে সবচেয়ে বেশি অর্থসাহায্য করেছিল।  

ব্রাজিল-এর প্রেসিডেন্ট জেইর বোলসোনারো ট্রাম্পের মতো এক অতি নিন্দিত মানুষ। মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ এবং জীবমণ্ডলের প্রতি তিনি সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ করেছেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমাজন বৃষ্টিবন ধ্বংস করে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সর্বনাশা বিপর্যয় এড়াতে মানুষের প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে এ এক চরম আঘাত। আমাজনের বৃষ্টিবনকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ বলা হয়। ১ জানুয়ারি, ২০১৯-এ দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, জাইর বোলসোনারো (যাঁকে ‘ট্রাম্প অফ দ্য ট্রপিক্স’ বলা হয়) আমাজন বৃষ্টিবন উজাড়ের কাজে নেমে পড়েন কৃষিজ (সয়াবিন চাষ), খনিজ এবং নানান তেল কোম্পানির শিল্পস্থাপনে। আমাজনের স্থানীয় আদিবাসী যারা এই বৃষ্টিবনের অভিভাবক, তারা হারাল তাদের বংশ-পরম্পরায় বাস করা ভিটেমাটি।

প্রসঙ্গ ভারতবর্ষ  

এবার তাকানো যাক নিজের দেশের দিকে। ভারতবর্ষে বিগত দশকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উদ্ভব ইকোফ্যাসিবাদকে প্রাণিত করেছে। ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪ সালের ২৬ মে থেকে টানা দিল্লির মসনদে রয়েছে। ভারতবর্ষে ইকোফ্যাসিবাদ মূলধারার ভাবাদর্শ না হলেও পরিবেশ ও সমাজের ওপর এর বেশ কিছু লক্ষণীয় প্রভাব পড়েছে। এসব প্রভাবের প্রতিফলন দেখা গেছে সরকারি নানান বক্তব্যে ও নীতিতে, যেগুলি পরিবেশ সমস্যা সমাধানে নিষেধমূলক এবং স্বৈরাচারী ধারণাকে অগ্রাধিকার দেয়। দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ হিন্দুত্ব-র কিছু প্রবক্তা পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারেও সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় আফিম মিশিয়ে প্রায়শই বলেন, হিন্দুত্বের আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই রয়েছে পবিত্র নদীগুলিকে (যেমন-গঙ্গা) এবং বনভূমিকে (যেমন-তরাই হিমালয়) রক্ষা করা। এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী বক্তব্য সামাজিক ঐক্যের ক্ষতি করে। 

২০১৪ সালে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার স্বেচ্ছাসেবী পরিবেশবাদী সংস্থা ‘গ্রিনপিস ইন্ডিয়া’ সহ অন্যান্য সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে বিদেশি অর্থসাহায্য নেওয়ার অভিযোগ আনে। এমন ইশারাও করা হল, বিদেশি অর্থের মদতে এরা উন্নয়নবিরোধী ও দেশবিরোধী কাজকর্ম করে। এখানে বলার, সকল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিদেশি অর্থসাহায্য পায় না। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাদের বিদেশি অর্থসাহায্য পাওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্র সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করল। এ থেকে ছাড় পেল শুধু ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’-র সাথে সম্পর্কযুক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এমনকি দেশের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির পরিচালনগত পরিকাঠামো সরকারি গোয়েন্দা দপ্তরের থেকে প্রতিবেদন বের করে পালটানো হল।

২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের প্রাক্‌কালে ভারতবর্ষ বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন লক্ষ্যমাত্রার আইনি এক বাধ্যবাধকতার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এই সম্মেলনে ‘ক্লাইমেট জাস্টিস’ গঠনের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর বক্তৃতায় ধর্মীয় আলাপন মিশিয়ে দিয়ে বলেন যে, বাস্তুতান্ত্রিক সংবেদনশীলতার প্রতি হিন্দু এবং বৌদ্ধ উভয় ধর্মই একজোট। লক্ষণীয়, এখানে ইসলাম ধর্মের নাম অনুচ্চারিত। মোদির এই হিন্দুত্ববাদী ধর্মীয় অনুরক্তি আমাদের বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না যখন দেখা যায়, বাস্তুতান্ত্রিক-সংবেদী অঞ্চলগুলির বুক চিরে ধর্মীয় স্থানে (মন্দির) যাওয়ার ঝাঁ-চকচকে রাস্তা গড়ে উঠছে কোনোরকম আলোচনা বা ক্ষতিপূরণ ছাড়াই।

বিগত ২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে করোনা অতিমারি। ২০২০ সালের মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় সরকার অতিমারি ঠেকাতে দেশজুড়ে ঘোষণা করেছিল লকডাউন। লকডাউনের মধ্যে মুখোমুখি বসে কোনো নিয়ন্ত্রক সভা (রেগুলেটরি মিটিং) না ডেকে অনলাইনে তড়িঘড়ি নানান পরিবেশ-সংবেদী কর্মসূচি অনুমোদনের ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এসব কর্মসূচি বা পরিকল্পনা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা বা অনুপুঙ্খ আলোচনার সুযোগও মিলল না। অনলাইন মিটিং-এ জীববৈচিত্র্যে ভরপুর ১১টি রাজ্যের বনভূমির মধ্যে প্রায় ৩০টি প্রকল্পকে পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া হয়। জাতীয় বনভূমি, অভয়ারণ্য ও বাঘের যাতায়াত অঞ্চলের মধ্যে রাজপথ, রেলপথ ও ট্রান্সমিশন লাইন তৈরির ছাড়পত্র পেয়েছিল ১৬টি প্রকল্প। দেশের অন্যত্র পরিবেশ-সংবেদী তিন হাজার একর জুড়ে গড়ে উঠবে বাকি ১৪টি প্রকল্প।

সবচেয়ে উদ্‌বেগজনকভাবে তড়িঘড়ি যে প্রকল্পটির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, সেটি হল ভারতের উত্তর-পূর্বে চিন সীমান্তে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত অরুণাচল প্রদেশ-এ ৩০৯৭ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ‘এটালিন’ জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন। বাস্তুতন্ত্র-সংবেদী দিবং উপত্যকায় ভারতের অন্যতম বড়ো এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি হাইড্রোপাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন অফ অরুণাচল প্রদেশ লিমিটেড এবং জিন্দাল পাওয়ার লিমিটেড-এর যৌথ উদ্যোগে গড়া হবে। বিগত ২৩ এপ্রিল, ২০২০, বন উপদেষ্টা কমিটি-র ভার্চুয়াল মিটিং-এ এই প্রকল্প সংক্রান্ত উপসমিতির প্রতিবেদনটি গৃহীত হয় এবং প্রকল্পটি গড়তে সবুজ ছাড়পত্র দেওয়া হয়। দিবং উপত্যকায় এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তুলতে দুটি বড়ো আকারের বাঁধ দিতে হবে। এছাড়াও অন্যান্য পরিকাঠামো গড়তে প্রায় ৫০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হবে। এর ফলে উপত্যকার ২,৮০,০০০ গাছ কাটা পড়বে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গোটা দিবং উপত্যকায় প্রায় ৪৫০ প্রজাতির পাখি আছে। যেখানে এটালিন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে ওঠার কথা, সেখানেই রয়েছে প্রায় ২৩০ প্রজাতির পাখি। গাছ কাটা পড়লে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হবে এই পাখি প্রজাতিগুলি। এই প্রকল্প গড়তে ৩০০০ একর জমি নানা ধরনের নির্মাণ ও খননকাজে জলে ডুবে যাবে।

২০১৯ সালের জুলাই মাসে পরিবেশমন্ত্রক ১৩টি রেল প্রকল্পকে ছাড়পত্র দিয়েছে। প্রকল্পগুলির আনুমানিক খরচ প্রায় ২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতের চারটি রাজ্যের প্রায় ৮০০ হেক্টর বনভূমির মধ্যে প্রকল্পগুলির কাজ চলবে। এই প্রকল্পগুলির মধ্যে অন্তত চারটি অতি পরিবেশ-সংবেদী কিছু অঞ্চলকে ধ্বংস করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক এবং গোয়া-য় অবস্থিত এই অঞ্চলগুলির মধ্যে রয়েছে একটি জাতীয় বনভূমি, একটি বাঘ সংরক্ষণকারী অঞ্চল, বাঘের যাতায়াতের একটি রাস্তা এবং একটি অভয়ারণ্য।

কোভিড-কালে কয়লা খনি, সিমেন্ট শিল্প, রাসায়নিক সার কারখানা, অ্যাসিড এবং কীটনাশক উৎপাদন শিল্প স্থাপনে এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সংক্রান্ত নীতি বা প্রকল্প গ্রহণে মানুষের সঙ্গে আলোচনা বা জনশুনানির বিষয়টিকে শিকেয় তুলে রাখা হয়। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ বিধিগুলিকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বর্তমান কেন্দ্র সরকারের আমলে দেশের বনভূমির মধ্যে শিল্পতালুক গড়ার প্রস্তাবিত প্রকল্পের ৯৯.৮২ শতাংশ সবুজ ছাড়পত্র পায়।

বিগত এক দশকে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিয়ম যতবার সংশোধিত হয়েছে, অতীতে তা হয়নি। কোনো নতুন প্রকল্প করতে হলে পরিবেশের উপর তার কী প্রভাব পড়তে পারে, তার এক মূল্যায়ন আগে থেকে করার আইন রয়েছে– এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট বা সংক্ষেপে ইআইএ। ২৩ মার্চ, ২০২০ সালে এক খসড়া ‘ইআইএ নোটিফিকেশন’-এ কোনো পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই নানান প্রকল্প চালু করার অনুমতি দেওয়া হল পরিবেশের আইনি রক্ষাকবচগুলি শিথিল করে। দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠল। কুড়ি লক্ষেরও বেশি মানুষ আপত্তি জানিয়ে নানান মন্তব্য ও প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠালেন। এই খসড়াটি বাস্তবায়িত হল না বটে, কিন্তু পরিবেশ মন্ত্রকের অফিস মেমোর‍ান্ডাম এবং অর্ডারের মাধ্যমে বেশ কিছু ধারা চালু হল, বিশেষজ্ঞদের মতে যা খসড়া ইআইএ-র অনুলিপি মাত্র।

২০১৮-২২ সালের মধ্যে বন্যপ্রাণী, বনভূমি, পরিবেশ এবং উপকূলভাগ সংক্রান্ত ছাড়পত্রের সংখ্যা ২১ গুণ বৃদ্ধি পায় (৫৭৭ থেকে ১২,৪৯৬)। ২০১৪ সালে যেখানে কোনো পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে গড়ে ৬০০ দিন সময় লাগত, ২০১৭ সালে তা কমিয়ে ১৬২ দিন করা হয়। অতি দ্রুত ছাড়পত্র দিতে গিয়ে পরিবেশের উপর ক্ষতিকর কী প্রভাব পড়তে পারে, সেই আলোচনার সময় কমে পরিবেশের ধ্বংস ত্বরান্বিত হল।

২০২৩ সালে ‘অরণ্য সংরক্ষণ আইন, ১৯৮০’ সংশোধিত হয়। ‘অরণ্য সংরক্ষণ (সংশোধিত) আইন, ২০২৩’-এ অরণ্যের সংজ্ঞা এমনভাবে পালটে দেওয়া হল, যার ফলে ভারতের প্রায় ২৮ শতাংশ বনাঞ্চল আইনি রক্ষাকবচ হারাল। এখানে বলার, উত্তর-পূর্ব ভারত, ওড়িশা, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশে এমন অনেক বনভূমি আছে যেগুলি সরকারিভাবে ‘অরণ্য’ বলে নথিভুক্ত নয়। এগুলি বেশির ভাগই ‘সমষ্টিগত বনাঞ্চল’ (কমিউনিটি ল্যান্ড)। এখানে ষষ্ঠ সিডিউল ও সংবিধানের ৩৭১ ধারা অনুযায়ী স্থানীয় গোষ্ঠীর বনভূমির এবং সেখানে তাদের পরম্পরাগত সাংস্কৃতিক কাজকর্মের অধিকার সুরক্ষিত আছে। সংশোধিত আইনে এসব এলাকা অরণ্য সংরক্ষণ আইনের বাইরে থাকছে। ফলে সেখানে নানান প্রকল্প গড়া হলে বনবাসী মানুষদের বাপ-ঠাকুর্দার ভিটেমাটি ছেড়ে উৎখাত হওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেল। সমষ্টিগত এসব বনাঞ্চল ছাড়াও দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঝোপঝাড়ের ছোটো জঙ্গলের কী হাল হবে, সেটিও নয়া এই সংশোধনীতে স্পষ্ট নয়।

‘অরণ্য অধিকার আইন, ২০০৬’ অনুযায়ী অরণ্যে বসবাসকারী মানুষদের ‘গ্রামসভা’-র অনুমতি ছাড়া সেখানকার জঙ্গলের জমির চরিত্র বদলানো যাবে না। কিন্তু নয়া এই সংশোধনীতে ‘অরণ্য’-এর সংজ্ঞা বদলে দিয়ে গ্রামসভার অনুমতির বিষয়টিকে তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে বনবাসী মানুষেরা তাদের দীর্ঘদিনের অরণ্যের অধিকার হারাবে। সরকারি সদিচ্ছায় বহুজাতিক পুঁজির দখলদারিতে গরিব প্রান্তিক এই মানুষগুলি নিজভূমে পরবাসী হবে। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার, এই আইনি রক্ষাকবচের জোরেই বহু রাজ্যে অরণ্যে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের নানান প্রকল্প গড়া সম্ভব হয়নি বা হচ্ছে না। হাতের কাছে সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ হল, ওড়িশার রায়গড়া জেলায় নিয়মগিরি পাহাড় সংলগ্ন বনাঞ্চলে বক্সাইট উত্তোলনের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল সেখানকার ডোংরিয়া কন্ধ আদিবাসীদের ১২০টি গ্রামের গ্রামসভার অনুমতি না মেলায়।

অরণ্যকে স্রেফ পণ্য হিসেবে দেখা হয়েছে সংশোধিত এই নয়া আইনে। অরণ্যে বাণিজ্যিক কাজকর্ম শুরু হলে সেখানকার পরিবেশ নষ্ট হবে। অরণ্যের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হলে পশুপাখি সে জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবে। ফলে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। উল্লেখ্য যে, ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল জীববৈচিত্র্যে ভরা। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এই অঞ্চল ৩,১৯৯ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি হারিয়েছে। এসব অঞ্চলে উন্নয়নমূলক পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য ব্যাপক বনাঞ্চল সাফ করা হবে। এর ফলে তাপমাত্রা বেড়ে জলবায়ু পরিবর্তন আরও ঘনীভূত হবে। বৃষ্টিপাত কমবে। বায়ু দূষণ বাড়বে। সংশোধিত নয়া অরণ্য সংরক্ষণ আইন নিশ্চিতভাবেই এক আশু বিপর্যয়ের আগাম পদধ্বনি।

সম্প্রতি পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের এক নয়া নির্দেশিকায় (১২.১০.২৩) রাজ্য বনদপ্তরগুলিকে উন্মুক্ত জঙ্গল, ঝোপঝাড়, পতিত জমি এবং অববাহিকা সহ ‘অবক্ষয়িত’ ভূমি চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে, যা তাদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনায় থাকবে। কেন এই নয়া নির্দেশিকা? না, এসব অঞ্চলে সবুজ আচ্ছাদন বাড়াতে দেশজুড়ে গাছ লাগানো হবে ‘গ্রিন ক্রেডিট’ সৃষ্টির জন্য। ‘গ্রিন ক্রেডিট’ কী? বলা হচ্ছে, কার্বন নিঃসরণ কমানো সহ নানান পরিবেশবান্ধব কাজে বাজারি উৎসাহদানের এক প্রচেষ্টা। বিশেষজ্ঞরা এই গ্রিন ক্রেডিট বিধিকে বনভূমির বাস্তুতান্ত্রিক দিক থেকে ‘সর্বনাশা’ ও ‘ক্ষতিকর’ এবং সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক বলে জানিয়েছেন। এই নির্দেশিকায় ‘অবক্ষয়িত’ শব্দটির অর্থ ও ব্যবহার নিতান্তই অস্পষ্ট এবং এর মাধ্যমে এসব অঞ্চলে কেবল কর্পোরেট বনসৃজন-এ উৎসাহ দেওয়া হল। এর ফলে এখানকার জমির গুণমান পালটাবে। স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে এবং স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেন্দ্রের জারি করা গ্রিন ক্রেডিট বিধিতে তৃণভূমির নামও রয়েছে, যা বেশ কিছু একান্তভাবে স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির বাসভূমি, যেমন– কৃষ্ণসার হরিণ। এই বিধির ফলে এরা অত্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়ল।

বিশিষ্ট লেখিকা অরুন্ধতী রায় তাঁর বই ‘আজাদি’-তে ডঃ মনমোহন সিং-এর প্রধানমন্ত্রিত্বকালীন এক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। মধ্য ভারতের নিবিড় বনভূমি কেটে কর্পোরেট সংস্থার খনন প্রকল্প গড়ে ওঠার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল স্থানীয় আদিবাসী মানুষ। এদের শায়েস্তা করার জন্য ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ নামে যুদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। মুক্ত বাজারি অর্থনীতির প্রবর্তক মনমোহন সিং এই স্থানীয় আদিবাসী মানুষদের উদ্দেশে বলেছিলেন– single largest internal security challenge। ভারতীয় সেনায় ছেয়ে গিয়েছিল এই বনভূমি। শত্রুপক্ষ ছিল হতদরিদ্র নিরস্ত্র কিছু মানুষ।

এরকম ফ্যাসিবাদী মনোভাবের পরিচায়ক কাজকর্মের উদাহরণ আরও থাকলেও নির্দিষ্ট-পরিসর প্রবন্ধে তা থেকে বিরত থাকা গেল। এখানে অবশ্যই বলার, কেবল বিগত ১০ বছর নয়, ভারতবর্ষে পরিবেশের সচেতন নিধনযোগ্য আরম্ভ হয়েছিল ব্রিটিশদের সময় থেকেই। ভারতবর্ষ তথা বিশ্বজুড়ে রেলপথ পাতার জন্য যে কাঠের দরকার ছিল তা খুঁজে পেয়েছিল ব্রিটিশরা ভারতের জঙ্গলে। তার ফলে ছোটোনাগপুর ও বিন্ধ্য পর্বতমালার শাল গাছের জঙ্গল প্রায় সাফ হয়ে গেল। প্রাকৃতিক কারণেই ভারতবর্ষের ভূগর্ভস্থ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল বনাঞ্চলে। স্বভাবতই এসমস্ত ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক সম্পদ, যেমন– কয়লা, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, অভ্র সহ নানাবিধ খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ফলে অরণ্য ধ্বংস হয়েছিল অতি দ্রুত ও নির্বিচারে।

বিগত সত্তরের দশক থেকে পরিবেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা হলেও রাষ্ট্রীয় প্রশাসকরা কখনোই পরিবেশ আইনগুলোকে যথাযথ কার্যকরী করেননি। তার ফলে বারংবার ভারতের সম্মানিত বিচারব্যবস্থা পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ব্রিটিশ আমল থেকে আদিবাসীরা জঙ্গল ধ্বংসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং প্রাক্‌স্বাধীনতা কালেও ভারতের যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিবেশ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তার মূল চালিকাশক্তি ছিল প্রান্তিক মানুষের আন্দোলন। একুশ শতকে পরিবেশ নিয়ে নানাবিধ আলোচনা হলেও কার্যত পরিবেশ আইন কার্যকরী হয়নি। ফলে নদী দূষণ বেড়েছে, অরণ্য ধ্বংস হয়েছে, বন্যপ্রাণী কমেছে, বায়ু দূষণ বেড়েছে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হয়নি, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পরিবেশ অপরাধ। কিন্তু পরিবেশ-অপরাধ করা সত্ত্বেও কারোর কোনো শাস্তি হয়নি। কিছু দূষণমূল্য ধার্য করে রাষ্ট্রীয় কোশাগার স্ফীত হয়েছে; আর মাঝেমধ্যে কিছু শিল্পকে সাময়িকভাবে দূষণের দায়ে বন্ধ করা হলেও পরবর্তীকালে তারা আবার দূষণ করেই উৎপাদন প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।

অতঃকিম্

এবার নটে গাছটি মুড়োনোর পালা। রাজনৈতিক ভাবাদর্শ হিসেবে ফ্যাসিবাদ ১৯১৯ থেকে ১৯৪৫ সাল অবধি ইউরোপের নানান অংশে কর্তৃত্ব করেছে। ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যই হল চরম জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্রের প্রতি ঘৃণা, এলিট-শাসন এবং সামাজিক ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিন্যাসে বিশ্বাস। এই ভাবাদর্শে একটি মাত্র দলই কথা বলবে। আর কেউ নয়; এবং সেটাই শেষ কথা। এর চরিত্র যুদ্ধবাজ। ধনতন্ত্রের দূষিত পুঁজি বাড়াতে এরা যুদ্ধের আবহ সৃষ্টি করে। যেমন, আমেরিকা আরব দুনিয়ায় তেলের খনির অধিকারী হতে চায়। ধনতন্ত্রের এই নগ্ন রূপ যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়। আর কে না জানে যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি প্রাণ যায় পরিবেশের।

এখানে একটা সংগত প্রশ্ন ওঠে, কীভাবে রুখব আমরা ইকোফ্যাসিবাদ? প্রথমেই ইকোফ্যাসিবাদী বক্তব্যগুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলির বিরোধিতা করতে হবে। এটা বুঝতে এবং সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে যে, পরিবেশের সমস্যা বেশ জটিল বিষয় এবং কোনো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী এর জন্য দায়ী হতে পারে না। জাতি, জাতপাত, আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং গোষ্ঠী-নির্বিশেষে পরিবেশ ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার হতে হবে। পরিবেশের সংকট বা সমস্যাগুলি যে একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং আমাদের সমষ্টিগত প্রচেষ্টা ছাড়া যে এর সমাধান অসম্ভব, এই শিক্ষাটি দিয়ে সকলকে ইকোফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। এখানে আমাদের একটি অতি পরিচিত বিষয়ের কথা বললে বোধ করি তা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। নানান উৎসবে এবং কালীপূজা সহ অন্যান্য পূজায় দেদার নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফাটানো হয়। উচ্চগ্রামে ডিজে বক্স বাজানো হয় যা আইনত নিষিদ্ধ। এই আচরণও ফ্যাসিবাদী চরিত্রের প্রকাশ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না মানার ঔদ্ধত্য। অথচ দেশে আইন আছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই। যতক্ষণ না আমরা সমষ্টিগতভাবে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব, এর ক্ষতিকর দিকগুলি মানুষের সামনে তুলে ধরব, এ জিনিস বন্ধ হবে না।

এমন অবস্থায় আবিশ্ব পরিবেশকর্মী তথা সমস্ত মানুষকেই সোচ্চারে বলতে হবে, যে রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রক্ষমতায় আসুক, তাকে দিতে হবে এক দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, পরিবেশবান্ধব ও বিজ্ঞানসম্মত উন্নয়ন, দারিদ্র্যমুক্ত মানবসমাজ ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক টেকসই সবুজ পৃথিবীর অঙ্গীকার।

[কৃতজ্ঞতা: বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়, সমাজ ও পরিবেশকর্মী।]

সাহায্য নিয়েছি:

১। Arundhati Roy: ‘Azadi’; Penguin Random House India, Haryana, India, 2020.

২। Ashok Kumar Meena and R K Maikhuri: ‘Evolution of Environmental Policy and Law in India’; GAP BODHI TARU, Volume- VI, August 2023, Grand Academic Portal.

৩। Diyora Shadijanova: ‘What is eco-fascism and why is it dangerous?’; The Face, October 18, 2021.

৪। Elaina Hancock: ‘Darker Shade of Green: Understanding Ecofascism’; Uconn Communications, September 7, 2022.

৫। ‘Forestland Diversion’; State of India’s Environment. Pp. 178-179, Down To Earth, New Delhi.

৬। Himanshu Nitnaware: ‘Green Credit Rules will negatively impact forest ecology, say experts’; Down To Earth, 27.02.24, New Delhi.

৭। Jayashree Nandi: ‘Recent environmental rules mirror controversial draft’; Hindustan Times, 05.01.22.

৮। John Scales Avery: ‘FASCISM THEN AND NOW’; August 2019, Eqbal Ahmed Centre for Public Education.

৯। রাহুল রায়: ‘অরণ্যের রোদন– নির্বিকার প্রশাসন’; সম্পাদনা– ফিলিপ ম্যাথ্যু, মনোরমা ইয়ারবুক ২০২৪, ২৯তম সংস্করণ, কোট্টায়াম, কেরালা, ভারত।

১০। রাহুল রায়: ‘স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের পরিবেশ আন্দোলনের পথরেখা– ফিরে দেখা’; নিষ্পলক, এপ্রিল-জুন, ২০২২, কলকাতা।

১১। Sam Moore and Alex Roberts: ‘The Rise of Ecofascism’; Polity, April 18, 2022.

১২। Sam Moore and Alex Roberts: ‘Ecofascism and Indian Nationalism’; Ecologist, February 7, 2022.

১৩। Sangya Chatterjee: ‘What is Ecofascism?’; Science The WIRE, 18.01.2021.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান