সৌরীন ভট্টাচার্য
ফ্যাসিবাদের কথা বলতে গেলেই আমাদের কাছে স্বাভাবিকভাবে শ-খানেক বছর আগের ইতালি ও কিছু পরের জার্মানির নাৎসিবাদের কথা এসে পড়ে। এতে অবাক হওয়ার বা আপত্তি করার কিছু নেই। মুসোলিনির নেতৃত্বাধীন ইতালি এবং হিটলারের নেতৃত্বাধীন জার্মানি বিশ শতকের ফ্যাসিবাদের প্রায় ক্লাসিকাল রূপাদর্শ। সেই সঙ্গে ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বাধীন স্পেনের কথাও বলা যেতে পারে। এতদূর যে কোনো দেশে কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ফ্যাসিবাদের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা তা নির্ণয়ের জন্যে ইতালি বা জার্মানির অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার কথাও ভাবা হয়। কয়েক বছর আগে আমাদের এখানেই এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। মোদি জমানায় ভারতে কি ফ্যাসিবাদের চেহারা ফুটে উঠছে, এই প্রশ্নে তখন বেশ কথা বার্তা চলছিল। কারও কারও মনে হচ্ছিল যে, না, এখনও ঠিক পরিষ্কার ফ্যাসিবাদের লক্ষণ দেখা গেছে বলে বলা যাবে না। তবে অনেকেই মনে করছিলেন সেরকমের বিপদের সম্ভাবনা আছে।
এক রকমের হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রসারের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের বিপদের কথা আমাদের এখানকার রাজনৈতিক আলোচনায় বিলক্ষণ ছিল। কোনোদিনই কোনো কথা যে ঠিক তেমন পরিষ্কার করে বলা হয়েছে তা নয়। কিন্তু আভাসে ইঙ্গিতে উপচে-পড়া কিছু খবরে গুজবে এমন কথা কান পাতলেই শোনা যেত, এখনও যায়, যার মধ্যে প্রভাব খাটানো, হাত মোচড়ানো দোমড়ানো, দেশের সমস্ত প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলিকে দখল করার অপচেষ্টার গল্প যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে। এটাই ভারতীয় সমাজের ফ্যাসিবাদের লক্ষণ বলে সাব্যস্ত করেন অনেকে। গণতান্ত্রিক কাঠামোর একটা বহিরঙ্গ চেহারা অবশ্যই বজায় আছে। এখন এই রকম কথা বললেই তথ্যের সত্য মিথ্যা নিয়ে বিতর্ক বেধে যাবে। কিন্তু প্রসঙ্গটাই এমন যে তথ্যের স্তরে মীমাংসা করতে গেলেই ওই কোনো একটা রূপাদর্শের সঙ্গে মিল গরমিলের হিসাব নিতে হয়। অথচ প্রশ্ন হল আমরা ঠিকমতো দম নিতে পারছি কি না তা নিয়ে আমাদের বোধটা কেমন দাঁড়াচ্ছে তাই। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে মোদি সরকারের প্রথম পর্বেই স্বয়ং লালকৃষ্ণ আদবানি প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলেছিলেন, এত ভয় কেন?
এসব প্রশ্নের গোড়ার দিকের দুটো একটা ছোটো কথা স্মরণ করা যাক। ২০১৪-র নির্বাচনে জিতে নরেন্দ্র মোদি প্রথম বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণের পরে প্রথামতো বিভিন্ন মন্ত্রকে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী সবার সঙ্গে পরিচয় পর্ব সমাপ্ত করেন। তখন ক্রিকেট অনুষঙ্গে টিম ইন্ডিয়া কথাটা খুব চালু। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রকের কর্মীদের অন্তরঙ্গভাবে বলেন, এখন থেকে আমরা সকলে টিম ইন্ডিয়ার মতো কাজ করব। আপনাদের যখনই মনে হবে আমার কাছে সোজা চলে আসবেন। প্রোটোকল আনুষ্ঠানিকতা ইত্যাদির জন্যে কাজ ফেলে রাখলে চলবে না। টিম ইন্ডিয়ার মতো কাজ করতে হবে আমাদের।
সৌজন্যের এই সুসমাচারের মধ্যে অন্য একটা কথা অকথিত থেকে গেল। প্রত্যেক মন্ত্রকেই মন্ত্রী একজন বা হয়তো তার চেয়েও বেশি থাকেন। কথাটা এই যে, তাঁকে বা তাঁদেরকে নিয়ে অত বেশি মাথা ঘামাবার দরকার হবে না। সম্পর্কটা আমার সঙ্গে ঠিক থাকলেই চলবে। অনেক মন্ত্রকেই মন্ত্রটা খেটেছিল। দু-এক জায়গায় অল্প বিস্তর অসুবিধা হয়েছিল। সম্ভবত বিদেশমন্ত্রক তার মধ্যে অন্যতম। প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজনৈতিক দলের প্রায় সমস্ত সিনিয়ার নেতাদের রাজনৈতিক নির্বাসনে পাঠিয়েও বিদেশমন্ত্রকের মন্ত্রীকে শেষ পর্যন্ত এক ধরনের মান্যতা দিতে হয়েছে। ওই নির্বাসিতের তালিকায় আদবানির মতো নেতাও ছিলেন। আর অটলবিহারী বাজপেয়ির ক্ষেত্রে তাঁর অসুখ শেষ পর্যন্ত মোদিকে বিড়ম্বনার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।
একনায়কের উত্থান উপাখ্যানে এই রকমের পার্শ্ববর্তী কাহিনি অনেক সময়ে আলোকপাত করে। ঘটনাগুলো যখন ঘটছে তখন গোটা চালচিত্র সামনে থাকে না বলে আদলটা আমাদের কাছে ঠিক পরিষ্কার হয় না। প্রাতিষ্ঠানিকতা থেকে ব্যক্তিতান্ত্রিকতার দিকে সরে যাওয়া। এই সরে যাবার পথে প্রতিষ্ঠানের গায়ে আঁচড় লাগে। সেসব নিয়ে অত মাথা ঘামাতে গেলে একনায়কের চলে না।
প্রতিষ্ঠান ভাঙার অন্য সময়ের অন্য একটা নজির দেখা যাক। গত শতকের ষাটের দশকের শেষ দিক। ইন্দিরা গান্ধি তাঁর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পথে এগোচ্ছেন। প্রথম লক্ষণীয় যে বড়ো কাজটা তিনি করলেন তা হল নিজের দলের সাংগঠনিক কাঠামো ভাঙলেন। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের ডানা ছাঁটার মধ্যে দিয়ে বস্তুত নিজের দলের মধ্যেই এক উল্লেখযোগ্য বিরোধী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটালেন নিজেরই নেতৃত্বে। রাজনৈতিক দিক থেকে এই বিরোধী মুখটাকেই বেশ ঘষে ঘষে উজ্জ্বল বামপন্থী চেহারায় রূপান্তরিত করা হল। ব্যাংক জাতীয়করণ এবং রাজন্যভাতা বিলোপ, এই ধরনের পদক্ষেপ এই রূপান্তর সাধনে সহায় হল। পরিণতিতে পার্টি ভাগ হল। ইন্দিরা কংগ্রেস নামে এক পার্টির উদ্ভব হল। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তখন কংগ্রেস (ও) এবং কংগ্রেস (আই), এই দুই নামে বিভক্ত। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারা কংগ্রেস (ও) এবং নবীনেরা ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস (আই)-তে। অল্প দিনের মধ্যে কংগ্রেস (ও) মিলিয়ে যায়। ইন্দিরা কংগ্রেস কার্যত কংগ্রেসের রূপ নেয়। পরে আনুষ্ঠানিকভাবেও সেটাই ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস-এর একমাত্র উত্তরসূরি হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
ইন্দিরা গান্ধির উত্থানপর্বে আন্তর্জাতিক স্তরের দুটি বিষয় অবশ্যই লক্ষণীয়। নেহরুর সময় থেকেই ভারত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান শক্তি। ইন্দিরার সময়েও ভারত জোটনিরপেক্ষতার নীতি থেকে কখনোই সরে আসেনি, তবে তাঁর সময়ে স্পষ্টত সোভিয়েত শিবিরে ঘেঁসে থাকার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও দু-দেশের পারস্পরিক নৈকট্য বেড়েছে ওই সময়ে। যে-পর্বে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে টপকে টপকে ইন্দিরা গান্ধি ব্যক্তি ভাবমূর্তিভিত্তিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করছেন সেই পর্বে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরেও সোভিয়েত সুহৃদ হিসেবে ক্রমশ বেশি বেশি করে চিহ্নিত হচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক স্তরে দ্বিতীয় বিষয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ওই সময়ে ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা অবশ্যই বিশ্বের নজর কেড়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য আমেরিকা ও চিনের চোখে প্রকারান্তরে সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের প্রসার। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের পরে মানবিক কারণেই সেদিকে ভারতের বন্ধুসুলভ হাত এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেই বন্ধুতার হাত যৌথ বাহিনীর স্তরে পৌঁছে গেলে আর-একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে। তা হল পাকিস্তান নামের এক সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিভাজন। ব্যাপারটা এক স্তরে অবশ্যই ছিল পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধ। সেখানে বাইরের কোনো দেশের হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিক রেওয়াজ নয়। আবার ভারতের এত নিকটেই এক প্রতিবেশীর ঘরের আগুনে আর কিছু না হোক শরণার্থীর প্রশ্ন উঠবেই। ভারত নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতে পারে না। যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানের পরাজয়ের পরে বাংলাদেশের জীবনে ও রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব স্বাভাবিক কারণেই বাড়ল। সে দেশের সাম্প্রতিক আন্দোলনের ফলে এই অঞ্চলে প্রভাব সমীকরণে বদল আসতে চলেছে। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রগুলি ইতিমধ্যেই ইতিহাসে অন্তর্হিত।
এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ইন্দিরা গান্ধির ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি যে-উচ্চতায় পৌঁছে গেল সেখানে এক একনায়কের উত্থান কিছু দূর কল্পনা নয়। ভারত তখন ইন্দিরাময়। ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা, এ ধ্বনিও উঠেছিল। ঠিক যেমন এই মুহূর্তে ভারত নরেন্দ্র মোদিময়। এই দুই পর্বের ভারতের সমাজ রাজনীতিকে একাকার করার কোনো মানে হয় না। আর ইতিহাসের এক পর্ব ঠিক অমনি করে আর এক পর্বের অনুবর্তী হয় না। তবে ফ্যাসিবাদের ক্লাসিকাল রূপাদর্শের সঙ্গে যদি আমরা বেবাক মিলিয়ে নেবার চেষ্টায় বেশি বিব্রত না হই, তাহলে এক নায়কের উত্থান উপাখ্যানের আদল খানিকটা চিনে নিতে পারব। ফ্যাসিবাদী আদলে মিলিয়ে নিয়ে ফ্যাসিস্ট বলে একবার চিহ্নিত করতে পারলে আমাদের নিজেদের মতাদর্শগত অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ খুঁজে পেতে খানিক সুবিধা হয়।
একনায়কের মডেলে বিচার করার তাৎপর্য এই যে, নানা রকমের রাজনীতির সঙ্গেই একনায়কতন্ত্রের উপাদানের মিশেল থাকতে পারে। ধর্ম, জাতীয়তা, সমাজতন্ত্র, পুঁজিতন্ত্র, বিভিন্ন কেতার এথনিক জাতীয়তা, সব আদর্শের রূপায়ণেই একনায়কের উত্থানের অবকাশ আছে। একনায়কের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে বস্তুগত বিকাশ ছাড়াও মনোগত স্তরের কিছু কিছু লক্ষণের দিকে আমাদের নজর যেতে পারে। ক্লাসিকাল ফ্যাসিবাদের রূপাদর্শের বিচারে অনেক সময়ে বস্তুগত অবস্থার উপরে জোর পড়ে। সাধারণত সমাজের বিশৃঙ্খলা, তার থেকে পরিত্রাণের পথের কথা ভাবা হয়। যে-রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী বা সংঘ এই পথের দিশা দেখাতে পারে সে বা তারা ক্রমে ক্রমে জনমনে জায়গা করে নেয়। এক অর্থে এই সময়বিন্দুটাকে একনায়কের উত্থানের বিন্দু বলে মনে করা যেতে পারে। কিন্তু একটু ভাবলেই দেখা যাবে যে, ওই পরিত্রাণের চিন্তাটাই এক অর্থে অলীক। জনমনে দখল নেবার ওটা একটা বড়ো পরিসর। আমাদের বর্তমানে উন্নয়নের ধারণা ওইরকম একটা পরিসর তৈরি করে দিচ্ছে। শুধু আমাদের এখানে না, অন্যত্রও। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক দেশত্যাগ পর্বেও এ কথা উঠেছিল। ওঁর বিরুদ্ধে নির্বাচনি কারচুপি, জনমত উপেক্ষা করা এবং আরও নানা রকমের দমন পীড়নের অভিযোগ ছিল। প্রতিষ্ঠিত শাসকপক্ষের নামে এই ধরনের অভিযোগই থাকে। কিন্তু বিপরীত পক্ষে এ কথা খুবই ছিল যে, তাঁর সময়েই বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অন্য নানা সামাজিক সূচকের নিরিখে প্রভূত উন্নতি করেছে।
এখানেই কথাটা তোলা দরকার যে, প্রশ্নগুলোকে দুটো স্তরে ভাগ করে দেখতে হবে। একটা স্তর যেখানে ঘটনাগুলো ঘটছে। এটা ঘটমান বাস্তবের স্তর। কিন্তু সেটুকুই সব নয়। কী ঘটছে আর তাকে আমরা কেমন ভাবে নিচ্ছি, এই দুটো স্তর মিলিয়ে নির্মিত হয় যে-জিনিস তাকে আমরা নাম দিতে পারি সমাজ-ঘটনা। সমাজ-ঘটনার মধ্যে থাকে ঘটনার গ্রহণ। সমাজের দিক থেকে গ্রহণ। ঘটে-যাওয়া কোনো ঘটনা সমাজের কাছে কীভাবে দেখা দিল সেটাই এখানে প্রধান বিবেচ্য। কারণ সমাজের প্রতিক্রিয়া সেই হিসেবেই ঠিক হবে।
আমাদের এই মুহূর্তের বাস্তব অবস্থা থেকে একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। যখন এই লেখাটা লিখছি তখন প্রায় দেড় মাস হল গোটা পশ্চিমবঙ্গ আর জি কর কাণ্ডে ‘ফুঁসছে’। সঙ্গে সঙ্গে অনেকে বলবেন, গোটা পশ্চিমবঙ্গ নয়, কলকাতা; কলকাতাও নয়, তার মধ্যেকার এক শ্রেণির মানুষ। ভাবলে দেখা যাবে, এইসব কথাই তথ্যস্তরের কথা। কিন্তু মনের স্তরের কথাটা কী তা বুঝতে গেলে একটা সহজ উপায় হল গত দেড় মাস সময়ের আগে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের যে-অবস্থা ছিল তার সঙ্গে গত দেড় মাসের কথাটা একসঙ্গে মনের মধ্যে ভাবা। বলে দিতে হবে না যে, এইভাবে ভাবতে পারলে ওই ‘ফুঁসছে’ কথাটা বুঝতেও কোনো অসুবিধা হবে না। তা বুঝতে পারলে দু-দিন আগে ঘটে-যাওয়া সাগর দত্ত হাসপাতালের ঘটনার সঙ্গে একটা যোগসূত্রও হয়তো চোখে পড়ে যাবে। একই সঙ্গে এটাও হয়তো খেয়াল করা সম্ভব হবে যে, প্রথম দফার একটানা আন্দোলনের পরে জুনিয়ার ডাক্তারেরা কর্মবিরতি আংশিক তুলে নিলে প্রশাসনের তরফে এক ধরনের রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে। সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে যাঁরা রাত দখলের ডাক দিয়েছিলেন তাঁদের কারও কারও নামে পুলিশি তলব পাঠানো হচ্ছে, সভা সমিতির পুলিশি অনুমতি অনেক ক্ষেত্রে মিলছে না, নতুন সংহিতা অনুসারে ১৬৩ ধারা (পুরোনো ১৪৪ ধারার নবরূপ) জারি করা হচ্ছে। অর্থাৎ, বলা যেতে পারে রাষ্ট্রের তরফে এবার কঠোর মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে গেলে সাগর দত্ত হাসপাতালে সেদিন যাঁরা ডাক্তারদের উপরে চড়াও হয়েছিলেন তাঁদের রাজনৈতিক স্বরূপের প্রশ্ন ১৪ আগস্টের রাতে যাঁরা আর জি করে ভাঙচুর করেছিলেন তাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারে। সমাজ-ঘটনার তাৎপর্য এখানে, ঘটনা কোথায় কী ঘটছে তা কে জানে। এমনকি কানাঘুষোয় এদিকে ওদিকে যে শোনা যাচ্ছে আসন্ন পুজোয় নাকি ‘গোলমাল’ হতে পারে তাও কি তবে সমাজ-ঘটনা’-র এই চরিত্রের সঙ্গে জড়িত। প্রশাসনের ভাবখানা কী এই রকম যে, প্রথম চোটে তোমাদের আন্দোলন আমরা সহানুভূতির সঙ্গে প্রশ্রয় দিয়েছি বা সহ্য করেছি। এখন আর না, ঢের হয়েছে। তা না হলে রাষ্ট্র রাষ্ট্রের পথে চলবে। এবং রাষ্ট্রের পথে সহজ পথও যেমন থাকে, তেমনি বাঁকাচোরা পথও থাকতে পারে। রাষ্ট্রের সহযোগী শাসক দল থাকে। তাদের কাজ রাষ্ট্রকে সহায়তা করা। রাষ্ট্রের অ্যাজেন্ডা সহজেই রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে দলের অ্যাজেন্ডায়। এই চেহারায় পৌঁছে গেলে ক্লাসিকাল রূপাদর্শের সন্ধান পেতে বেশি গবেষণার দরকার পড়ে না।
রাষ্ট্র এবং তার সহযোগী দল মিলে গিয়ে প্রায় যে-কোনো অ্যাজেন্ডা রূপায়ণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে পারে। শুধু চিকিৎসক বা নাগরিক সমাজের আন্দোলন স্তব্ধ করা নয়, আরও নানা রকমের সামাজিক সাংস্কৃতিক ধর্মীয় আদর্শ রূপায়ণের দায়িত্ব ব্রত পালনের মতো একাগ্রতায় চর্চা করা সম্ভব। গোমাংস আহার্য হিসেবে বর্জন, যে-কোনো রকমের সীমা-পেরোনো বিবাহ সম্পর্ক এড়িয়ে যাওয়া, ‘বিদেশি’ সাংস্কৃতিক-সামাজিক প্রথা বা রেওয়াজকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় না দেওয়া, অন্যধর্মে বিয়ে করলে পারিপার্শ্বিক সমাজকে তাতিয়ে তুলে নবদম্পতির জীবনকে অতিষ্ঠ করে দেওয়া, সমাজে যারা ঠিক ‘আমাদের’ মতো নয় তাদের প্রতি নানাবিধ প্রেজুডিসকে নিরন্তর জাগিয়ে রাখা, এইরকম কত ধরনের আদর্শ পালনের সামাজিক রাজনৈতিক লক্ষ্য আমরা ভেবে নিতেই পারি।
একনায়কের উপাখ্যানে উপরের ওইসব আদর্শ পালনের প্রশ্ন যখন ওঠে, তখন দেখা যায় নাগরিকেরা প্রায় স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের আদর্শে শামিল হয়ে যান। না হতে চাইলে লড়াই বাধে। এ কথাটা যদি তথ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে একনায়কের উত্থানে আমাদের প্রত্যেকের ভূমিকা আছে। আমাদের মানসভূমিতেই একনায়ক তাঁর ডালপালা মেলেন।