গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
একশো বছর আগে ইউরোপের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ফ্যাসিবাদ ক্ষমতা দখল করেছিল। তার বাইরেও সেই মতবাদের গুণমুগ্ধের সংখ্যা কম ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থানে ভীত সমাজতন্ত্রের অন্ধ বিরোধীরা ফ্যাসিবাদের মধ্যে নিজেদের পছন্দের মতাদর্শকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তার বাইরেও অনেক মানুষ প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে ফ্যাসিবাদের সম্যক রূপকে ধরতে পারেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের পর ফ্যাসিবাদের ঘৃণিত চরিত্র বিশ্ববাসীর নজরে আসে। কিন্তু পরাজিত হলেও ফ্যাসিবাদের মৃত্যু হয়নি, আবার বিভিন্ন দেশে নানা সময়ে সে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অবশ্যই তার রূপান্তর ঘটেছে, যেমন বর্তমানের নিওফ্যাসিস্ট মতবাদের সঙ্গে দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ের ফ্যাসিবাদের কিছু পার্থক্য সহজেই দেখা যায়। তবে সেই আলোচনা এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু নয়, এই সংকলনের অন্য লেখাতে সেই নিয়ে আলোচনা পাওয়া যাবে। দুই বিজ্ঞানে প্রথম সারির দেশ ইতালি ও জার্মানিতে ফ্যাসিবাদ কেমনভাবে বিজ্ঞানীদের উপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল এবং তার ফলশ্রুতিতে বিজ্ঞানচর্চার ভারকেন্দ্র নতুন দুনিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানত্রিত হয়েছিল, সংক্ষেপে সেই ইতিহাস আমরা ফিরে দেখব।
ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনির নেতৃত্বে ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি ক্ষমতায় এসেছিল একশো বছর আগে ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে। তার এক দশক পরে জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতা দখল করেন। হিটলারের দলের নাম ছিল ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টি (সংক্ষেপে নাৎসি) বা জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল; অবশ্য সমাজতন্ত্র শুধুমাত্র দলের নামে সীমাবদ্ধ ছিল। জাতীয়তাবাদের প্রতি আবেদন ছিল দুই দলেরই মূল মন্ত্র, এবং সেই জাতীয়তাবাদের মূল মন্ত্রই ছিল জাতিবিদ্বেষ। জার্মানির কথা পরে অনেকবার আসবে, মুসোলিনির একটি বক্তৃতা উদ্ধৃত করি, “I would say we can easily sacrifice 500,000 barbaric Slavs for 50,000 Italians …”।
ফ্যাসিবাদ নিজেকে বিজ্ঞানসম্মত বলে দাবি করত, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে বাস্তবে তা বিজ্ঞানচর্চার প্রতি মোটেই অনুকূল ছিল না। আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম ইউরোপে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত সেই মহাদেশই ছিল বিজ্ঞান জগতের অবিসংবাদী নেতা। বিভিন্ন সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বিজ্ঞানে বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উনিশশো তিরিশের দশকের ঘটনাক্রম পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন ঘটায়, আধুনিক বিজ্ঞানের ভরকেন্দ্র চলে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের উদাহরণ নিয়ে দেখা যাক। বিংশ শতাব্দীর প্রথম চল্লিশ বছরে নোবেলজয়ীদের মধ্যে আটত্রিশ জন ছিলেন ইউরোপের আর সাতজন উত্তর আমেরিকার। অথচ শেষ চার দশকে এই সংখ্যাদুটি যথাক্রমে হয়ে দাঁড়িয়েছিল তেত্রিশ ও বাহান্ন। অন্যান্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এই অনুপাতটা খুব একটা অন্য রকম নয়। এর মূল কারণ ছিল বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের উপর ফ্যাসিবাদী আক্রমণ। সেই আক্রমণ শুরু হয়েছিল জার্মানিতে, যদিও পরবর্তীকালে অক্ষশক্তি অধিকৃত গোটা ইউরোপে তা ছড়িয়ে পড়েছিল। তার ফলে বহু বিজ্ঞানী দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, যাঁদের অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত আমেরিকাতে আশ্রয় খুঁজে পান।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিজ্ঞানের উপর ফ্যাসিবাদী আক্রমণ শুরু হয়েছিল যে দেশে, সেই জার্মানি ছিল বিংশ শতাব্দীর সূচনাতে বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। বিংশ শতাব্দীর সূচনাতে একমাত্র জার্মানিতেই রাষ্ট্র বিজ্ঞান গবেষণাকে গুরুত্ব দিত। সে দেশে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছিল এবং বিজ্ঞানীরা সেখানে শুধুমাত্র গবেষণাতেই নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁদের পড়ানোর কোনও দায়িত্ব নিতে হত না। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের কাছেই জার্মানিতে বিজ্ঞানের পরিকাঠামো ও পরিবেশ ছিল ঈর্ষার বস্তু। শিক্ষাদানের পাশাপাশি স্বাধীন চিন্তার বিকাশে উৎসাহ দানের জন্য জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে মধ্যযুগেও খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখা হত। কোনও সন্দেহ নেই যে জার্মান শিক্ষাপদ্ধতি অনেক দিক থেকে আধুনিক যুগের সঙ্গেও মানানসই ছিল। নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়েছিল ১৯০১ সাল থেকে, ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান ও সাহিত্যে মোট ৪১ জন জার্মান সেই পুরস্কার লাভ করেন।
জার্মানিতে ফ্যাসিবাদী নাৎসিরা ক্ষমতায় আসে ১৯৩৩ সালে। বৃহৎ পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের শক্তি ধ্বংস করতে তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী এই মতবাদকে কাজে লাগিয়েছিল। ফ্যাসিবাদ প্রায়শই এক শ্রেণির মানুষকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে এবং তাদের বলির পাঁঠা বানায়। নাৎসিদের অপর এক মূল নীতি ছিল ইহুদি বিরোধিতা। নাৎসিরা ইহুদিদের নিচু শ্রেণির মানুষ মনে করত এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় ও তার পরের দুঃখকষ্টের জন্য তাদের দায়ী করেছিল। নাৎসিরা সরকারে আসার পরে তাদের উপর নিপীড়ন চরমে উঠেছিল সে ইতিহাস সকলেই জানেন, এই লেখাতে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই। একই সঙ্গে চিন্তার জগতে একাধিপত্য কায়েম করার জন্য শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাকে নিজের কবলে আনার জন্য সচেষ্ট হয় নাৎসিরা।
ফ্যাসিবাদ সাধারণভাবে মুক্তচেতনার বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের বিরোধী। শিক্ষাবিদদেরও হিটলার বিশ্বাস করতেন না, তিনি চেয়েছিলেন নাৎসি মতবাদ শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং সমস্ত শিক্ষাতেই একটা নাৎসি ঝোঁক আনতে হবে। হিটলারের ক্ষমতায় আসার তিন মাসের মধ্যেই তাই নতুন সিভিল সার্ভিস আইন জারি করে প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সব স্তরের শিক্ষককে তার আওতায় আনা হয়। ইহুদি এবং সরকারবিরোধীদের সরাসরি পদচ্যুত করা হয়। ঠাকুমা, ঠাকুরদা, দাদু বা দিদিমার মধ্যে একজন ইহুদি হলেই তাঁর চাকরি যায়। শুধুমাত্র কমিউনিস্টরা নয়, প্রজাতন্ত্রের সমর্থক উদারবাদীরাও সরকার বিরোধী পরিচয়ে বরখাস্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে পনেরো শতাংশ এই আইনের আওতায় চাকরি হারান, তাঁদের এক তৃতীয়াংশ ছিলেন ইহুদি। বাকি দুই তৃতীয়াংশ তাঁদের রাজনৈতিক মতামতের জন্য বরখাস্ত হন। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝাই যাচ্ছে ইহুদিরা আক্রমণের মূল লক্ষ্য হলেও ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসীরাও বাদ পড়েননি।
কেমন মানুষরা বরখাস্ত হয়েছিলেন? অনেকের নামই এই লেখাতে আসবে, তবু একজনের কথা এখানে বলি। তাঁর নাম এমি নোয়েথার। নোয়েথারের তিন অপরাধ, প্রথম তিনি জার্মানির উদারনৈতিক প্রজাতান্ত্রিক সরকারের সমর্থক ছিলেন, দ্বিতীয়ত তিনি ইহুদি। তার উপরে তিনি ছিলেন মহিলা। মহিলাদের সম্পর্কে নাৎসিদের মনোভাব পরে আলোচনাতে আসবে। আধুনিক পদার্থবিদ্যাতে প্রতিসাম্য এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে, সেই বিষয়ে নোয়েথারের উপপাদ্য অবশ্যপাঠ্য। তা ছাড়াও গণিতে তাঁর নানা গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। আইনস্টাইনসহ অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানীই তাঁকে সর্বকালের সেরা মহিলা গণিতজ্ঞ মনে করতেন। সেই নোয়েথার একটা চিঠি পেলেন যে সিভিল সার্ভিস আইন অনুসারে তিনি আর পড়াতে পারবেন না।
যে দেশ শিক্ষাতে সেই সময় সারা পৃথিবীতে শীর্ষস্থান অধিকার করেছিল, সেই জার্মানিতেও বিশেষ কোনও প্রতিবাদ শিক্ষাবিদ বা ছাত্রমহল থেকে শোনা যায়নি। অ-ইহুদি অধ্যাপকরা কেউ কেউ বলেছিলেন যে এই আইনের ফলে জার্মান বিজ্ঞানের ক্ষতি হবে, কিন্তু দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় কেউই তার অনৈতিকতা নিয়ে সরব হননি। কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শিক্ষাদানের পাশাপাশি উগ্র জাতীয়তাবাদের সূতিকাগার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ছিল শিক্ষার অঙ্গ, ফলে রাষ্ট্র নিজেই যখন অপরাধী তখন জার্মান বুদ্ধিজীবীরা তার বিরোধিতা করার কথা ভাবতে পারেননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি স্পষ্টতই ছিল আক্রমণকারী, অথচ ১৯১৫ সালে সাড়ে চারশো জন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জার্মানির সামরিক অভিযানকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। বিরোধিতা করেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইনসহ মাত্র তিনজন। আইনস্টাইন দেয়ালের লিখন পড়তে পেরেছিলেন, তাই হিটলারের ক্ষমতায় আসার আগের মাসেই তিনি দেশ ছাড়েন। ছাত্রদের মধ্যেও নাৎসিদের প্রভাব ছিল খুবই বেশি, অধিকাংশ ছাত্র-সংগঠন থেকে আগেই ইহুদিদের বিতাড়িত করা হয়েছিল। তাই ছাত্রদের থেকে নতুন আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আসা দূরের কথা, তারাই জার্মান সাহিত্যকে অ-জার্মান প্রভাব থেকে মুক্ত করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আগুনে নিক্ষেপ করে সিগমুন্ড ফ্রয়েড, কার্ল মার্ক্স, বের্টোল্ট ব্রেখট, স্টিফেন জুইগ, আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো ইহুদি দার্শনিক বিজ্ঞানী বা সাহিত্যিকদের বই। এভাবেই জার্মানিতে চিন্তার জগতে আধিপত্য কায়েম করেছিল নাৎসিরা।
সারা পৃথিবীতেই উচ্চশিক্ষার সেরা প্রতিষ্ঠানগুলি এখনও উদারনৈতিক মতবাদের (নয়া উদারবাদ নয়) ঘাঁটি, কারণ তাদের মূল কথা হল প্রশ্ন করার স্বাধীনতা। উদাহরণ স্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানরা বাকি সমস্ত প্রতিষ্ঠানে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তাদের বিশেষ জায়গা নেই। কিন্তু সাবধান না হলে আমার দেশও ভবিষ্যতে নাৎসি জার্মানির পথ নেবে, বিশেষ করে শিক্ষার স্বাধিকার যখন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণের সুযোগে মুক্ত চিন্তার উপরে আক্রমণ যখন ক্রমবর্ধমান।
অধ্যাপকরা কোন পথ ধরেছিলেন, একটা উদাহরণ থেকে তা বোঝা যাবে। ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় ছিল জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে সবচেয়ে উদার, অধ্যাপকরা তাঁদের শিক্ষাদীক্ষা এবং গণতন্ত্র ও বিবেক নিয়ে গর্ব বোধ করতেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাৎসি কমিশনার সমস্ত অধ্যাপককে এক সভাতে ডেকে ঘোষণা করেন ইহুদি অধ্যাপকদের অবিলম্বে বরখাস্ত করা হচ্ছে। বিভাগীয় প্রধানদের অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করে কমিশনার বলেন যে কোনও রকম বিরোধিতা করলে তাঁদেরও কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে। সভায় উপস্থিত ছিলেন উদারনীতি ও স্বাধীনতার পক্ষে একনিষ্ঠ সমর্থনের জন্য বিখ্যাত এক বিশিষ্ট শরীরতত্ত্ববিদ। কমিশনারের বক্তৃতার শেষে সবাই যখন তাঁর মন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করছেন; তিনি উঠে বললেন, ‘এ সব তো খুব ভালো কথা, কিন্তু শরীরতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণার জন্য কি বেশি টাকা পাওয়া যাবে?’ কয়েকজন অধ্যাপক ইহুদি সহকর্মীদের সঙ্গে সভা থেকে বেরিয়ে গেলেও বাকিরা কিন্তু তাঁদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন।
নাৎসিদের বিরোধিতা করেছিলেন কয়েকজন সন্দেহ নেই। কয়েকজন ইহুদি বা উদারবাদী না হয়েও এই নতুন নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগও করেছিলেন। কিন্তু সেই সংখ্যাটা ছিল খুবই কম, কারণ প্রতিবাদ করে কোনও লাভ হবেনা এমন একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ বরখাস্ত সহকর্মীদের সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু গোপনে, কারণ তা অপরাধ হিসাবে গণ্য হত। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীরা নাৎসি মতবাদের পক্ষে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক যুক্তি হাজির করেছিলেন। ফ্রেইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার ছাত্র ও সহকর্মীদের বলেন যে নাৎসিদের সমর্থন করা উচিত কারণ জার্মানির আত্মার নিশ্বাস নেওয়ার জন্য তাজা বাতাসের প্রয়োজন। তাঁর মতে প্রশ্ন করার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হল স্বার্থপর ও নেতিবাচক। অথচ এই স্বাধীনতাই হল আধুনিক বিজ্ঞানের মূল কথা, এর জন্যই বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত নিজেকে সংশোধন ও পরিবর্তন করতে পারে। এর পরেও হাইডেগারের সহকর্মী অধ্যাপকরা তাঁকেই ভোট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাচিত করেন। হিটলার ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ইহুদি অধ্যাপককে বরখাস্ত করা হয়। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী জেমস ফ্রাঙ্ক যখন তার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করেন, তখন গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক চিঠি লিখে তাঁর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের অভিযোগ আনেন। সরকার বা বাইরের শক্তির শিক্ষাঙ্গনে হস্তক্ষেপ বিভিন্ন দেশে নতুন কথা নয়। এ কথাও বলা বাহুল্য যে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি সবসময়েই নিজেদের সুবিধার জন্য প্রতিষ্ঠানের বা সমাজের স্বার্থকে বিসর্জন দিতে তৈরি থাকবেন। নাৎসি জার্মানিতেও এই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু যে শিক্ষাবিদ আদর্শগতভাবে এই ধরনের হস্তক্ষেপকে সমর্থন করেন তিনি শুধু একটা প্রতিষ্ঠান নয়, গোটা ব্যবস্থাটার অনেক বেশি অনেক বেশি ক্ষতি করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিস্থিতি উত্তরোত্তর খারাপ হয়েছিল। হিটলার ক্ষমতায় আসার ছ’বছরের মধ্যে জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মোট ছাত্রছাত্রীর অর্ধেকেরও বেশি কমে যায়। শুধুমাত্র ইহুদি ছাত্রদের বিতারণ দিয়ে এই ঘটনার ব্যাখ্যা করা যাবে না, কারণ তারা সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না। নাৎসিরা উচ্চশিক্ষাকে পছন্দ করত না এবং সাধারণ ভাবে মৌলিক জ্ঞানার্জনের বিরোধী ছিল। উচ্চশিক্ষাতে সুযোগ পেতে গেলে পুরুষদের জন্য মিলিটারি সার্ভিস ও মহিলাদের জন্য লেবার সার্ভিস করা হয়েছিল বাধ্যতামূলক। এই সমস্ত কারণে ছাত্রসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে।
শুধুমাত্র ইহুদি বা রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর আক্রমণ নেমে এসেছিল, তা নয়। মহিলারাও বিশেষ করে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফ্যাসিবাদের চরিত্রগতভাবে পুরুষকেন্দ্রিক, মহিলাদের কোনও সম্মানই তার মধ্যে নেই। নাৎসিদের মতবাদে মহিলাদের শুধুমাত্র সন্তানের জন্মদানের যন্ত্র হিসাবে দেখা হত। হিটলারের এক উক্তি, ‘Your child belongs to us already… What are you? You will pass on. Your descendants, however, now stand in the new camp. In a short time they will know nothing else but this new community.’ ফলে নারীশিক্ষার অবস্থা বিশেষ করে খারাপ হয়। আইন করে অধ্যাপক পদে মহিলাদের নিয়োগ বন্ধ করা হয়। মহিলা ডাক্তারদের চিকিৎসা করতে দেওয়া হত না, পরে অবশ্য বাধ্য হয়ে সেই আইন শিথিল করতে হয়েছিল। আইনে জার্মানিতে বিবাহিত মহিলাদের চাকরি করার অধিকার ছিল না। এই সব কারণে ছাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পায়।
নাৎসি শাসনকালে ইহুদি শিক্ষাবিদদের জার্মানি ত্যাগের ইতিহাস খুবই পরিচিত। যাঁরা তা সত্ত্বেও দেশে রয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের শেষ পর্যন্ত স্থান হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানে ষাট লক্ষ ইহুদিকে খুন করা হয়েছিল, বন্দি অধ্যাপকদের অধিকাংশই ছিলেন সেই তালিকায়। পোল্যান্ডের নারীবিজ্ঞানী স্টেফানি হরোভিৎজের মতোই দশা হয়েছিল তাঁদের, কবে কোথায় তাঁদের হত্যা করা হয়েছিল সে খবরও জানা যায় না। সবচেয়ে বিখ্যাত দেশত্যাগীদের মধ্যে আছেন সাতজন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী— আলবার্ট আইনস্টাইন, জেমস ফ্রাঙ্ক, ফ্রিজ হেবার, অটো লোয়েই, অটো মেয়েরহফ, ভিক্টর হেস ও এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার। প্রসঙ্গত বলি, শ্রয়ডিঙ্গার কিন্তু ইহুদি ছিলেন না। হেসও ইহুদি ছিলেন না, কিন্তু তাঁর স্ত্রী ছিলেন ইহুদি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি মারণ গ্যাস ব্যবহার করেছিল, তার পিছনে ছিলেন নোবেলজয়ী রসায়নবিদ ফ্রিজ হেবার। ইহুদি বলে তাঁকেও দেশ ছাড়তে হয়, এবং ইতিহাসের পরিহাসে তাঁর তৈরি গ্যাস লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে খুন করার জন্য ব্যবহার করা হয়। দেশত্যাগের অল্প পরেই ভগ্নহৃদয় হেবারের মৃত্যু ঘটে। জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স বর্ন, হান্স বেথে, অটো স্টার্ন ও জেরার্ড হার্জবার্গ, হাঙ্গারির ইউজিন উইগনার, অস্ট্রিয়ার উলফগ্যাং পাউলি, ডেনমার্কের হেনরিক ডাম এবং ইতালির এমিলিও সেগ্রে দেশত্যাগের পরে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। নোবেল জয়ীদের তালিকার বাইরে নাম করতে হয় অটো ফ্রিশ, ফ্রিজ লন্ডন, লিজে মাইটনার, মারিয়াট্টা ব্লাউ, এলিজাবেথ রোনা, লিও জিলার্ড, এডওয়ার্ড টেলার, ভিক্টর ভাইসকফের মতো বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের। পদার্থবিদ্যাতে তিনজন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর জন্ম যুদ্ধপূর্ব জার্মানিতে, কিন্তু তাঁদের পরিবার দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। অপর একজন হলেন দেশত্যাগী জার্মান দম্পতির সন্তান। ফ্যাসিস্ট আক্রমণের থেকে বাঁচতে যারা পালিয়েছিলেন, তাঁরা ও তাঁদের সন্তানদের মধ্যে দশজন পরবর্তীকালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জিতেছেন। এই সংখ্যাটার সঠিক তাৎপর্য বোঝার জন্য একটা তথ্য দেখে নেয়া যাক। একশো কুড়ি বছরের নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে পৃথিবীতে মাত্র পাঁচটি দেশ আছে যেখানে দশ বা তার বেশি পদার্থবিজ্ঞানের পুরস্কার এসেছে।
ছাত্রসংখ্যা হ্রাসের ফল কী হয়েছিল তা অনুমানের বিষয়, কিন্তু নাৎসি আক্রমণের মুখে বিজ্ঞানীদের দেশত্যাগের ফলে বিজ্ঞানের ভরকেন্দ্র যে জার্মানি থেকে নতুন দুনিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়েছিল সন্দেহ নেই। ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের বিজ্ঞানীদের এই দেশত্যাগের থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল নতুন দুনিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের মধ্যে তাঁদের জায়গা দিতে পেরেছিল মূলত গ্রেট ব্রিটেন। কিন্তু মহামন্দার সময় সেখানে সুযোগ ছিল খুবই কম। ইউরোপের অন্য দেশে কোনও কোনও বিজ্ঞানী গেলেও পরবর্তীকালে যখন প্রায় গোটা পশ্চিম ইউরোপ জার্মানির অধিকার যায়, তখন তাঁরা আশ্রয় পান আমেরিকায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আয়তনে বিশাল, সম্পদের দিক থেকেও তার ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। তাই মন্দার মধ্যেও সেই বিজ্ঞানীদের স্থান করে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে সে দেশে গবেষণা এক ধাক্কায় অনেক দূর এগিয়ে যায়, এবং কয়েক দশকের মধ্যে পৃথিবীতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যে এক লক্ষ তেত্রিশ হাজার জার্মান ইহুদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এঁদের অনেকেই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ। পদার্থবিজ্ঞানের কথা আগেই বললাম; এক সমীক্ষাতে দেখে গেছে যে রসায়নের যে সমস্ত ক্ষেত্রে এই দেশত্যাগীরা কাজ করতেন, সে সব বিষয়ে মার্কিন পেটেন্টের সংখ্যা একত্রিশ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। শুধুমাত্র কতজন বিজ্ঞানী নোবেল পেয়েছেন বা উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছেন তা দিয়ে বিজ্ঞানের উপর প্রভাব বিচার করা যায় না। কতজন তরুণ বিজ্ঞানীকে তাঁরা সাহায্য করেছেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯৩০ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে যে সাতজন নোবেল জয়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদের আমেরিকান ছাত্র বা তরুণ সহযোগীদের মধ্যে ছ’জন পরবর্তীকালে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। ঠিক বিপরীত প্রভাব পড়েছিলে জার্মান বিজ্ঞানে। বিশ্বযুদ্ধের পরেও জার্মানি তার হৃতগৌরব ফিরে পায়নি। ১৯৩৩ সালের আগে যেখানে বিজ্ঞানে তিরিশ শতাংশ নোবেলজয়ী ছিলেন জার্মান, পরের চল্লিশ বছরে সেই সংখ্যাটা কমে দাঁড়ায় নয় শতাংশ। অবশ্যই এর একটা কারণ হল যুদ্ধোত্তর জার্মানির প্রথমদিকের আর্থিক দুরবস্থা, কিন্তু বিজ্ঞানীদের এক বিরাট অংশের দেশত্যাগই ছিল প্রধান কারণ।
বিজ্ঞানীদের দেশত্যাগের ফল বোঝার জন্য মার্কিন পরমাণু বোমা প্রকল্পের পিছনের ইতিহাসের দিকে চোখ রাখা যাক। পরমাণু বোমার পিছনে আছে নিউক্লিয় বিভাজন বিক্রিয়া। জার্মান অটো হান এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাস জানে যে তার পিছনে হানের দীর্ঘদিনের সহযোগী লিজে মাইটনারের ভূমিকা তাঁর থেকে কম নয়। পরীক্ষার ফল ব্যাখ্যার জন্য হানকে মাইটনারের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। মাইটনার কিন্তু তখন জার্মানি থেকে পালিয়ে গেছেন। ফলে নিউক্লিয় বিভাজনের কথা গোপন রাখার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। বস্তুত এ বিষয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশের আগেই ডেনমার্কের বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিল্স বোরের মারফত সেই খবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু প্রকল্পে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁদের একটা বড়ো অংশই প্রাণ বাঁচাতে দেশত্যাগী হয়েছিলেন। আইনস্টাইন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টকে এক চিঠিতে পরমাণু বোমা তৈরি সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন করে দিয়েছিলেন। এই চিঠি লিখতে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন লিও জিলার্ড, ইউজিন উইগনার এবং এডওয়ার্ড টেলার। এঁরা সবাই হাঙ্গারিয়ান ইহুদি এবং প্রাণ বাঁচাতে নাৎসি অধিকৃত ইউরোপ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। জিলার্ড শৃঙ্খল বিক্রিয়ার আবিষ্কর্তা যা পরমাণু বোমা ও রিঅ্যাক্টরের প্রাণ স্বরূপ। টেলার এবং উইগনার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্কিন হাইড্রোজেন বোমা নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। উইগনার বা টেলার ছাড়াও পরমাণু বোমা প্রকল্পের প্রধানতম বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিলেন তিন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জেমস ফ্রাঙ্ক, এনরিকো ফের্মি ও নিল্স বোর। ফের্মি ইতালিয়ান, তাঁর দেশেও হিটলারের চাপে মুসোলিনি ১৯৩৮ সালে ইহুদি বিরোধী আইন চালু করেন। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ডেনমার্ক অধিকার করে নেওয়ার পরে সেখানে ইহুদিদের উপর আক্রমণ নেমে আসে। বোরের মা ও স্ত্রী ছিলেন ইহুদি। ফের্মি ইহুদি ছিলেন না, কিন্তু তাঁর স্ত্রী ছিলেন ইহুদি। তাঁকে রক্ষা করতে ফের্মিকে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল।
দুই
আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের দর্শনের বিরোধ যে থাকবেই তা সহজে বোঝা যায়।ফ্যাসিবাদ চারিত্রিক ভাবেই মুক্ত চিন্তার বিরোধী, স্বাভাবিক ভাবেই ফ্যাসিবাদী সমাজে বিজ্ঞানের বিকাশ ব্যাহত হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মই হয়েছে প্রতিষ্ঠিত কর্তৃত্ববাদী ধ্যানধারণাকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে, অথচ ফ্যাসিবাদে যে কোনও ধরনের সমালোচনা বা প্রশ্নকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আপস করার ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে জার্মান বিজ্ঞানের সম্মানহানি ঘটেছিল। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে নাৎসিদের ক্ষমতা দখলের পরে জার্মানির বাইরে থেকে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের মধ্যে জার্মান পত্রপত্রিকাতে প্রকাশিত বিজ্ঞান প্রবন্ধের উল্লেখ অনেক কমে যায়। বিশেষ করে নৃতত্ত্ববিজ্ঞানকে ইহুদিদের হেয় করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল, সে কথায় আমরা পরে আসব।
নাৎসি আমলে নিন্দিত ‘ইহুদি’ বিজ্ঞানের জায়গায় বসানো হয় এক কল্পিত ‘জার্মান’ বিজ্ঞানকে। বিজ্ঞানের এরকম জাতিগত চরিত্রের কথা আজ যতই অদ্ভুত ঠেকুক, ফ্যাসিস্ট জার্মানিতে তাই ছিল স্বাভাবিক। ইহুদিদের গবেষণা সম্পর্কে তাচ্ছিল্যের কারণ এই নয় যে পরীক্ষার বা যুক্তির মাধ্যমে তাকে ভুল প্রমাণ করা গেছে। কেবলমাত্র ইহুদিদের আবিষ্কৃত বলেই তা ভ্রান্ত। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দুই মূল স্তম্ভ হল আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে বলা হয়েছিল ইহুদি ধাপ্পাবাজি – এই কথাটা কিন্তু নাৎসি পার্টির নেতা বা সরকারের উচ্ছিষ্ট ভোগে উন্মুখ অপরিচিত অধ্যাপকদের থেকে আসেনি। এ কথাও বলা যাবে না যে নাৎসিরা ক্ষমতায় আসার পরেই এই ধরনের কথা শোনা যাচ্ছিল। আপেক্ষিকতাবাদের উপর আক্রমণ শুরু হয়েছিল ১৯২০-র দশকের একেবারে গোড়া থেকে যখন নাৎসি পার্টিরই জন্ম হয়নি। যে দু’জন বিজ্ঞানী আপেক্ষিকতা তত্ত্বের উপর আক্রমণের নেতৃত্ব দেন, তাঁরা ভালোই জানতেন যে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব পরীক্ষাতে প্রমাণিত। ফিলিপ লেনার্ড ও জোহানেস স্টার্ক যথাক্রমে ১৯০৫ এবং ১৯১৯ সালে পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু অন্ধ আইনস্টাইন বিদ্বেষ তাঁদের চিন্তাশক্তিকে আচ্ছন্ন করেছিল।
স্টার্ক লিখেছিলেন যে অন্য কোনও সৃষ্টিশীল কাজের মতো বিজ্ঞানও চর্চাকারীর মানসিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। এ এক অদ্ভুত কথা যা বিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিক দর্শনের সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। স্টার্কের মতে ‘জার্মান’ বিজ্ঞান তথ্য ও পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করে, বিপরীতে ‘ইহুদি বিজ্ঞান’ বাস্তব বিবর্জিত অঙ্কের গোলকধাঁধা সৃষ্টি করে। আসলে লেনার্ড ও স্টার্কের প্রধান সমস্যা ছিল যে জটিল গণিত নির্ভর আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব তাঁদের বোধগম্য হচ্ছিল না, তাই তাঁরা সেগুলোকে বাতিল করতে চেয়েছিলেন। কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক হলেন ম্যাক্স প্লাঙ্ক, আইনস্টাইন তার অনেক উন্নতি সাধন করেছিলেন; কোয়ান্টাম বলবিদ্যার স্রষ্টা ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ও এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার। এঁরা সবাই ছিলেন জার্মান। প্ল্যাঙ্ক ও হাইজেনবার্গ আইনস্টাইনের তত্ত্বকে প্রকাশ্যে সমর্থন করাতে স্টার্ক বিদ্রূপ করে তাঁদের নাম দিয়েছিলেন ‘শ্বেত ইহুদি’। স্টার্ক বা লেনার্ডের মতো সক্রিয়ভাবে সহায়তা না করলেও প্রায় সমস্ত বিজ্ঞানীই ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আপস করেছিলেন, নোবেল জয়ী পদার্থবিদ ফন লউ এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। হাইজেনবার্গও শেষ পর্যন্ত নাৎসিদের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নাৎসিবিরোধী হিসাবে পরিচিত শ্রয়ডিঙ্গারও সেই চেষ্টা করেছিলেন, সেজন্য তিনি পরে দুঃখপ্রকাশও করেন। প্ল্যাঙ্ক ভেবেছিলেন বিজ্ঞানীর রাজনীতিতে নিরপেক্ষ থাকা উচিত। জার্মান বিজ্ঞানের পতন এড়াতে দিকপাল বিজ্ঞানীদের ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে বিজ্ঞানের সত্য যতই ব্যক্তি বা সমাজ নিরপেক্ষ হোক না কেন, তার চর্চা ও প্রয়োগ কখনোই সমাজ-নিরপেক্ষ হতে পারে না।
হিটলার বুঝেছিলেন যে কোনও জাতিকে বিনা প্রতিবাদে ফ্যাসিবাদের পথে নিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি হল শিক্ষা। তাই শিক্ষাকে কুক্ষিগত করার জন্য স্কুলস্তর থেকে পাঠ্যপুস্তকে অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা ঢোকানোর ঢালাও ব্যবস্থা করা হয়, প্রয়োজনে সত্যকে বিকৃত করা হয়। শেখানো হয় যে ঈশ্বর শুরুতে জার্মানজাতিকে সৃষ্টি করেছিলেন। রোমান জুলিয়াস সিজার বা ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়নকে সর্বকালের সেরা রণপণ্ডিতদের মধ্যে ধরা হয়, জার্মান স্কুলের বইতে তাঁদের সবাইকেই বলা হয় জার্মান। এভাবেই ছোটবেলা থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদের বীজ শিশু মনে রোপণ করা হয়। শিক্ষা ব্যবস্থাকে রেজিমেন্টেড করা হয়।
ছ’বছর বয়স হলেই তাকে হিটলার ইউথে যেতেই হত। নিজে ভাবার জন্য এক মুহূর্ত সময়ও তাকে দেওয়া হত না। এভাবে ফ্যাসিবাদে ইনডকট্রিনেশন বা দীক্ষাদান শুরু হত খুব ছোটবেলা থেকে। জার্মান শিক্ষা দপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক হিলকে ড্রয়ারের লেখা ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের একটা অংশ উদ্ধৃত করি, “The collapse of German society and of the German economy was the deliberate result of the Jews. When will the savior come who will do battle against these forces of hell, the Jews? Now we hear his footsteps. He is arriving to save us. Awake, Germany, the redeemer has come. The truth is coming to light. The Nordic Aryan race shall yet rule the world.” চতুর্থ শ্রেণির বই থেকে আর একটা উদ্ধৃতি, “Germany being on the brink of an abyss, Divine providence sent the German people a great leader, Adolf Hitler, descendant of the Nordic Aryan race. May you be able to give yourselves limitlessly for the sake of the Fuehrer. Do not forget that treason against a leader like this will bring perdition and bitter revenge down on you, for he was sent to save the nation. Only the Germans can understand his sublime language. And now, children, so can you.” কোনও প্রচারপুস্তিকা নয়, এ ছিল স্কুলের পাঠ্য।
তিন
বিশ্বব্যাপী প্রবল অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে সাধারণ মানুষ ও শ্রমিকরা হিটলারের দেখানো স্বপ্নকে বিশ্বাস করেছিলেন। সমাজের তথাকথিত উঁচুতলার মানুষদের জন্য বাছতে হয়েছিল সিউডোসায়েন্স বা অপবিজ্ঞানের পথ। জাতিবিদ্বেষকে প্রতিষ্ঠিত করতে নাৎসিরা সামাজিক ডারউইনবাদকে ব্যবহার করেছিল।
সামাজিক ডারউইনবাদ হল বিবর্তনবাদের এক বিকৃত প্রয়োগ। সে কথা আলোচনার আগে মনে রাখতে হবে ইউরোপীয় মননে জাতিবিদ্বেষের ক্ষেত্র কিন্তু প্রস্তুত ছিল। আধুনিক জীববিজ্ঞানের বিচারে জাতি কথাটা অর্থহীন হলেও এ বিষয়ে ঊনবিংশ শতকের ইউরোপীয়-আমেরিকানদের মধ্যে উৎসাহের অন্ত ছিল না। তার কারণটা সহজেই আমরা বুঝতে পারি। এশিয়া আফ্রিকা বা অন্যান্য মহাদেশের মানুষের উপর ঔপনিবেশিক শাসন বা আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের প্রায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার সমর্থনে যুক্তি হিসাবে শ্বেতাঙ্গদের তথাকথিত জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বকে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাই সমাজের উপরের দিকের সুবিধাভোগী অংশের মানুষ সহজেই সামাজিক ডারউইনবাদকে আপন করেছিলেন। জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে জাতিতত্ত্ব বিজ্ঞানের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাই নাৎসিরা ক্ষমতায় আসার পরে জীববিজ্ঞানী ও নৃতত্ত্ববিদদের এক বড়ো অংশ তাদের সমর্থন করেছিলেন।
নাৎসিদের মতে জার্মানরা হল আর্য, তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। জাতি হিসাবে আর্য কথাটার ব্যবহার খুব পুরানো নয়। যখন ঊনবিংশ শতাব্দীতে ম্যাক্সমুলারের মতো জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদদের গবেষণার সুবাদে আর্য কথাটা জনপ্রিয় হয়েছে, তখন হঠাৎ করে ফরাসি, জার্মান, ইংরাজ, ভারতীয় – সবাই দাবি করতে শুরু করল তাদের দেহেই আর্য জাতির রক্ত সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাবে বইছে। আর্যদের আদি বাসস্থান কোথায় তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হল। আজও আমাদের দেশে এক শ্রেণির ঐতিহাসিক মহেঞ্জোদড়ো থেকে শুরু করে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার পুরোটাই আর্যদের তৈরি তা দেখানোর জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ জাল করতে পিছপা হচ্ছেন না।
নিজেদের আর্য জাতির বংশধর প্রমাণ করার এই আকুল কামনার কারণ কী? আসলে আর্য জাতির কল্পনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই ধারণা যে তারা হল বিজেতাদের জাতি, অন্যান্য জাতিদের পদানত করে তারা তাদের প্রভুত্ব বিস্তার করেছে। যে সময় আর্য কথাটা চালু হয়, সে সময় সারা পৃথিবী শাসন করত ইউরোপীয়রা। ইংরাজি, ফরাসি, জার্মান, গ্রিক, লাতিন – এই সমস্ত ভাষাভাষীরাই বিভিন্ন সময় অন্য জাতিদের পদানত করেছ। এই সব ভাষাগুলিই আর্যদের ভাষা থেকে উদ্ভূত। সুতরাং আর্য যে বিজেতাদের ভাষা তা নিয়ে আর সন্দেহ কী? তাই আর্যদের বংশধররাই বাকি পৃথিবীকে শাসনের অধিকারী। ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের পক্ষে যা ছিল একটা বড়ো যুক্তি, তাকেই নাৎসিরা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
এই লেখার শুরুতেই স্লাভদের সম্পর্কে মুসোলিনির কথা উদ্ধৃত করেছি। পোল্যান্ড বা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের পিছনে ছিল হিটলারের ‘lebensraum’ বা জাতির স্বাভাবিক বাসভূমির তত্ত্ব। জার্মান জাতি শ্রেষ্ঠ, সুতরাং তার বিকাশের জন্য যতটা ভূমি প্রয়োজন, তাতে তার স্বাভাবিক অধিকার – এই দাবির পিছনে আছে সামাজিক ডারউইনবাদ। জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের নামে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বা বন্দিশিবিরে ষাট লক্ষ ইহুদির পাশাপাশি তিরিশ লক্ষ রাশিয়ান ভাষাভাষী ও পাঁচ লক্ষ জিপসিকে হত্যা করিয়েছিলেন হিটলার। রাশিয়ান ভাষা এবং জিপসিদের ভাষা রোমানি, দুইই কিন্তু জার্মান ভাষার মতোই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। জার্মানরা আর্য জাতির বংশধর হলে রাশিয়ান ও জিপসিরাও তাই।
সামাজিক ডারউইনবাদকে নাৎসিরা বিজ্ঞান হিসাবে ব্যবহার করেছিল, তাই খুব অল্প কথায় সেই তত্ত্ব সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। ডারউইনবাদে একটা মূল কথা হল প্রাকৃতিক নির্বাচন বা Natural selection. কিছুদিন ডারউইন একই অর্থে যোগ্যতমের উদ্বর্তন বা Survival of the fittest বাক্যবন্ধটি ব্যবহার করেছিলেন। কথাটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন হারবার্ট স্পেনসার যাঁকে সামাজিক ডারউইনবাদের জনক বলা যেতে পারে। অথচ স্পেনসার নিজে জীববিদ্যাতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ডারউইনীয় তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না। ডারউইনের লেখা থেকে যোগ্যতমের উদ্বর্তন সম্পর্কে তাঁর ধারণা পরিষ্কার বোঝা যায়। কিন্তু তাঁর এই শব্দচয়ন পরবর্তীকালে অনেক সমস্যার জন্ম দিয়েছিল। ডারউইন নিজেও এই বিশেষ পরিভাষাটি যে ভুল তা কিছুদিন পরে বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে, স্পেনসারের সামাজিক অগ্রগতির তত্ত্বের সমর্থনে জীববিদ্যার সবচেয়ে বিখ্যাত তত্ত্বের সিলমোহর পড়ে গেছে। অথচ সঠিক বিচারে সামাজিক ডারউইনবাদের সঙ্গে ডারউইনের তত্ত্বের কোনও সম্পর্ক নেই। অথচ জার্মানিতে বিকলাঙ্গ ও পঙ্গুদের হত্যা করা হয়েছিল, তার সমর্থনে খাড়া করা হয়েছিল যোগ্যতমের উদ্বর্তন সম্পর্কে বিকৃত ধারণা।
ডারউইনের তত্ত্বের অপর এক স্তম্ভ হল অস্তিত্বের সংগ্রাম বা Struggle for existence। এই ধারণাটা (এবং এই বাক্যবন্ধ) ডারউইন নিয়েছিলেন টমাস ম্যালথাসের লেখা থেকে। ম্যালথাসও সমাজতাত্ত্বিক, জীববিজ্ঞানী নন। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন সমাজে দারিদ্র অপরিহার্য, অভাব ও দুঃখকষ্টকে এড়ানো সম্ভব নয়। সুতরাং সমাজ বা রাষ্ট্রের এ বিষয়ে কোনও দায়িত্ব নেই। অস্তিত্বের সংগ্রাম ও যোগ্যতমের উদ্বর্তন, এই দুই বাক্যবন্ধ সমাজবিজ্ঞানে প্রয়োগের অর্থ দাঁড়াল একমাত্র যোগ্যরাই জীবনসংগ্রামে জয়লাভ করে। সংগ্রামের ভিতর দিয়ে সমাজ ক্রমশ উন্নতির দিকে যাচ্ছে। সুতরাং জীবনসংগ্রাম প্রগতির অপরিহার্য অঙ্গ, তাতে রাষ্ট্র বা সমাজের হস্তক্ষেপ অনুচিত। এভাবেই সামাজিক ডারউইনবাদের জন্ম হল। মুক্ত বাজার অর্থনীতির পক্ষে সামাজিক ডারউইনবাদকে ব্যবহার শুরু হয়েছিল প্রধানত আমেরিকাতে, আর সাম্রাজ্যবাদের কুৎসিততম রূপ ফ্যাসিবাদের সমর্থনে জার্মানিতে তাকে প্রয়োগ করা হয়েছিল।
হিটলারও সংগ্রামের মাধ্যমে জাতি বা রেসের উন্নতির কথা ভেবেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘Whoever would live, let him fight, and he who does not want to do battle in this world of eternal struggle, does not deserve life.’ অস্তিত্বের সংগ্রামের এই ব্যাখ্যা ছিল স্পেনসার বা তাঁর অনুসারী সামাজিক ডারউইনবাদীদেরও মত। হিটলার ভেবেছিলেন আর্য জার্মান জাতি বিবর্তনের ফলে শেষ পর্যন্ত জার্মান দার্শনিক নিৎসের কল্পিত সুপারম্যান স্তরে উন্নত হবে। বিবর্তন তত্ত্বে প্রগতির বিষয়টা জটিল ও তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায় প্রাকৃতিক বিবর্তন প্রক্রিয়া কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে অগ্রসর হয় না। বিবর্তনের ফলে সমস্ত জীব তার নিজস্ব পরিবেশে অভিযোজিত হয়ে অর্থাৎ মানিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকে, সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলে তারও পরিবর্তন হয়। এই হল প্রাকৃতিক নির্বাচন। এই মুহূর্তে যে সমস্ত জীব পৃথিবীতে বেঁচে আছে, বিবর্তনের হিসাবে তারা একই সারিতে পড়ে। কাউকেই বেশি উন্নত বা বলার কোনও অর্থ নেই। বিবর্তনের ক্ষেত্রে Fit বা যোগ্য কথাটার অর্থ খুব সুনির্দিষ্ট, তা না বুঝলে যোগ্যতমের উদ্বর্তন বাক্যবন্ধটা একটু সমস্যার জন্ম দেয়। যোগ্যতা মাপা হবে কীসের ভিত্তিতে? বেঁচে থাকাই যোগ্যতার প্রমাণ, আবার যোগ্যরাই বেঁচে থাকে। অর্থাৎ একটু অসতর্ক হলেই আমরা সারকুলার আর্গুমেন্ট বা চক্রাকার যুক্তির আবর্তে পড়ে যেতে পারি। জীববিজ্ঞানে তাই বলা হয় যে জীব যত বেশি বংশধর রেখে যেতে পারবে সে তত যোগ্য। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সমর্থ জীবকেই বলা হয় যোগ্যতম। তার সঙ্গে নিৎসের সুপারম্যানের কোনও সম্পর্ক নেই। যোগ্যতমের উদ্বর্তন শ্রেষ্ঠ জাতির জন্ম দেয়, এই মত প্রতিষ্ঠা করতে, বুঝে বা না বুঝে, ডারউইনের দোহাই দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আদৌ তা ডারউইনের তত্ত্বের অনুসারী নয়।
ইহুদিদের গণহত্যার পক্ষে সমর্থন জুগিয়েছিল জার্মান আর্য বা নর্ডিক জাতির শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্ব। সামাজিক ডারউইনবাদকে যুদ্ধের সমর্থনে ব্যবহার করা হয়েছিল। ফিল্ড মার্শাল ফন ব্রাউকিচ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত জার্মান সৈন্যদের বলেছিলেন, ‘The troops must understand that this struggle is being fought race against race, and that they must proceed with the necessary harshness.’ অপর এক জেনারেল এরিক হোয়েপনার যুদ্ধের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘The war against Russia is an essential chapter in the German people’s battle for survival.‘ এভাবেই সামাজিক ডারউইনবাদের ভাষা ব্যবহার করে অন্য জাতির উপর কর্তৃত্ব স্থাপনের এমনকি তাকে নিশ্চিহ্ন করার পক্ষে যুক্তি হাজির করা হয়েছিল। এখানে দুই ভাবে ডারউইনবাদকে বিকৃত করা হয়েছে। প্রথমত কোনও ভাবেই ইহুদি ও জার্মানদের ভিন্ন প্রজাতি প্রতিপন্ন করা সম্ভব নয়, সেই মুহূর্তেও তা সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত ডারউইনের তত্ত্বে প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটে একক জীবের ক্ষেত্রে, প্রজাতি বা জাতির নির্বাচন সম্পূর্ণ অবাস্তব। এরিক হবসবম লিখেছিলেন, ‘Social Darwinism and racist anthropology or biology belong not to the science of the nineteenth century but its politics’, বিংশ শতাব্দীর ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়।
চার
যে বিজ্ঞানীদের উপর সরাসরি আক্রমণ হয়নি, তাঁদের অনেকের গবেষণাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আমরা দেখেছি যে তার একটা কারণ প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের এক বিরাট অংশের দেশত্যাগ বা বন্দিদশা। আরও এক্সএকটা কারণ হল ফ্যাসিবাদের সর্বব্যাপী সন্দেহের পরিবেশ যা মুক্ত আলোচনাতে বাধার সৃষ্টি করে। বিজ্ঞান গবেষণার এক মূল স্তম্ভ হল তথ্য ও মতের আদান প্রদান। আবারও পরমাণু গবেষণার উদাহরণ দেখা যাক। নাৎসি জার্মানিতে বিজ্ঞানীরা কেন পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারেননি, তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা ইচ্ছাকৃতভাবে গবেষণাতে ঢিলে দিয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সে তর্কের মধ্যে না গিয়েও একটা তথ্যের দিকে চোখ রাখাই যায়, জার্মানিতে তিন জায়গায় এ বিষয়ে গবেষণা হত। যে সমস্ত সরকারি অফিসার সেই সমস্ত গবেষণাগারের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা কে হিটলারের কত প্রিয় হতে পারবেন তাই নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। সেজন্য তাঁরা তাঁদের অধীনস্থ বিজ্ঞানীরা যাতে কখনোই নিজেদের মধ্যে আলোচনা না করতে পারেন সেদিকে কড়া নজর রাখতেন। পক্ষান্তরে আমেরিকার পরমাণু বোমা প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা শুধু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন তা নয়, একই বিষয়ে গবেষণারত ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। প্রথম পরমাণু বোমা তৈরির জন্য যে পরিমাণ অর্থ ও মেধাশক্তির প্রয়োজন হয়েছিল, বিশ্বযুদ্ধের সময় যে কোনো দেশের পক্ষেই তা জোগাড় করা সহজ ছিল না। জার্মানিতে আবার তিন জায়গায় একই কাজ হওয়ার ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাজে খরচ অনেক বেশি হয়েছিল। ফলে পরমাণু বোমা তৈরির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিপুলাকার প্রয়াসের পথে জার্মানি কখনোই এগোয়নি।
তবে নাৎসি আমলে জার্মানিতে বিজ্ঞান একেবারেই এগোয়নি, সে কথা ভাবলে আমরা ভুল করব। বিজ্ঞানের চরিত্র ব্যক্তি নিরপেক্ষ এবং মূল্য নিরপেক্ষ (value-neutral); তা গবেষকের পারদর্শিতার উপর নির্ভর করে, তার উদ্দেশ্যের উপর নয়। পরবর্তী গবেষণাতে কাজে লেগেছে এমন দুটি বিষয়ের উল্লেখ করা যাক। প্রথম ক্ষেত্রে গবেষক নিঃসন্দেহে শাস্তিযোগ্য অপরাধী, তিনি পুরোপুরি মানবতাবিরোধী কাজ করেছিলেন। সেটি হল চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণা। নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের তথ্য এই গবেষণাতে ব্যবহার নৈতিক কিনা, তা আধুনিক কালে একটি ভীষণ বিতর্কিত বিষয়। তার কারণ যে বীভৎস পদ্ধতিতে এই তথ্য আহরণ করা হয়েছিল, তার কোনও নিন্দাই যথেষ্ট নয়। মানুষের উপরে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে গেলে সবসময়েই খুব সতর্ক থাকতে হয়, আর তাঁদের সম্মতি ছাড়া এর প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু আউশভিৎশ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হয়ে দাঁড়িয়েছিল বন্দিদের উপর নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষার জায়গা। কোনও নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে, জোর করে বন্দিদের উপর নানা অমানুষিক পরীক্ষা চালানো হয়েছিল সেখানে। পরীক্ষাগারে ইঁদুর বা গিনিপিগের জায়গা নিয়েছিল বন্দিরা। সেই কারণে অনেকেই এই সমস্ত তথ্য ব্যবহারের তীব্র বিরোধী, তাঁদের বক্তব্য যে এর ফলে সেই ন্যক্কারজনক আচরণকে আংশিক হলেও বৈধতা দেওয়া হবে। যাঁরা এই তথ্য ব্যবহারের সমর্থক, তাঁরা অবশ্যই মানুষের উপর পরীক্ষাকে সমর্থন করেন না, কিন্তু তাঁরা বলেন যে আমরা চাই বা না চাই, আউশভিৎশের পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণাতে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাকে অস্বীকার করা যায় না। তাকে যদি চিকিৎসা বিজ্ঞান গবেষণাতে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো হয়, তাহলে অন্তত সেই অত্যাচারিত মানুষগুলোর যন্ত্রণা বিফলে যাবে না। সেই বিতর্কে না ঢুকেও বলা যেতে পারে যে আউশভিৎশের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি পড়লে বা শুনলে বিবমিষা উৎপন্ন হতে পারে, কিন্তু তাতে করে সংগৃহীত তথ্যের গুরুত্ব কমে যায় না। সঠিকভাবে বলতে গেলে বরং বাড়ে, কারণ বন্দিদের উপর যে ধরনের পরীক্ষা করা হয়েছিল, তা কখনোই কোনও মানুষের সম্মতি নিয়ে তার উপর চালানো সম্ভব নয়। নানা আপত্তি সত্ত্বেও সেই তথ্য পরবর্তী গবেষণাতে ব্যবহার করা হয়েছে।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি যুদ্ধ সংক্রান্ত গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। উদারনৈতিক দিক থেকে সমালোচনা থাকলেও বাস্তব এটাই যে বিজ্ঞানের বহু অগ্রগতির পিছনে আছে যুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা। তবে এক্ষেত্রেও যে পদ্ধতিতে গবেষণা চালানো হয়েছিল তা অপরাধের মধ্যে পড়ে। নাৎসি আমলে রকেট বিজ্ঞানে অনেক উন্নতি হয়েছিল । মিত্রপক্ষের শহরগুলি আক্রমণ করতে পৃথিবীর প্রথম লং রেঞ্জ মিসাইল ভি-২ শ্রেণির রকেট ব্যবহার হয়েছিল, এর স্রষ্টা ছিলেন ওয়ার্নার ফন ব্রাউন। এই রকেটের আক্রমণে মিত্রপক্ষের ন-হাজার মানুষ প্রাণ হারান। তার থেকেও বড়ো কথা হল জার্মান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দিদের জোর করে ভি-২ তৈরিতে কাজে লাগানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে প্রায় বারো হাজার জন তৈরির সময় বিভিন্ন কারণে প্রাণ হারিয়েছিলেন। তাই অন্য যুদ্ধ সংক্রান্ত গবেষণার সঙ্গে ভি-২ তৈরিকে এক করে দেখা ঠিক নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম পর্বে ইঙ্গ-মার্কিন ও সোভিয়েত বাহিনী ফন ব্রাউন ও তাঁর সহযোগীদের এবং ভি-২ তৈরির কারখানার উপরে অধিকার স্থাপনের জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। ফন ব্রাউন ও তাঁর একশোর বেশি সহযোগী মার্কিন পক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আমেরিকানরা প্রায় আশিটি ভি-২ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশও পেয়েছিল। সোভিয়েতরা শেষ পর্যন্ত কারখানাটা দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। সোভিয়েত ও মার্কিন উভয় পক্ষের মহাকাশ গবেষণার পিছনে রয়েছে ভি-২। আমেরিকাতে প্রায় ষোলশো ও সোভিয়েত ইউনিয়নে বাইশশো বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদকে যুদ্ধবন্দি হিসাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ফন ব্রাউন প্রথম মার্কিন উপগ্রহ উৎক্ষেপণের রকেট বানিয়েছিলেন, পরে তিনি নাসার মার্শাল স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের অধিকর্তা হয়েছিলেন। তাঁর ডিজাইন করা রকেটই আমেরিকার চন্দ্র-অভিযানে কাজে লাগানো হয়েছিল।
হিটলার নাৎসি শাসনকে বিজ্ঞানসম্মত বলে দেখাতে চাইলেও ফ্যাসিবাদের দর্শন আধুনিক বিজ্ঞানের উপযোগী নয়। উগ্র জার্মান জাতীয়তাবাদ এবং প্রশ্নহীন আনুগত্যের উপর জোর দেওয়ার ফলে আধুনিকতা নয়, বরঞ্চ প্রাচীন রীতিনীতি জীবনে আবার ফিরে আসে। ফ্যাসিবাদ কখনও কখনও প্রায় ধর্মীয় আকার নিয়েছিল। একই সঙ্গে নানা অদ্ভুত কল্পনাও জন্ম নিয়েছিল। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ভূমধ্যসাগরে আটলান্টিস বলে এক দ্বীপের কথা বলেছিলেন যেখানে এক অতি উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। পরে সেই দ্বীপ সমুদ্রে তলিয়ে যায়। ইতিহাসে আটলান্টিসের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলেনি, কিন্তু আর্যজাতি নিয়ে অলীক চিন্তায় বিভোর নাৎসিরা কল্পনা করেছিল যে সে দ্বীপের অধিবাসীরাই আর্যদের পূর্বপুরুষ। এমনকি ১৯৩৮ সালে এক জার্মান অভিযান আটলান্টিসের সত্যতার প্রমাণ উদ্ধারে তিব্বতে এসেছিল। এক সুদূর অতীতে নর্ডিক জাতির কল্পিত কীর্তিকে গৌরবান্বিত করতে গিয়ে ইতিহাস ও কল্পকথা মিশে গিয়েছিল।
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পঁচাত্তর বছর পরেও জার্মানি বিজ্ঞান গবেষণাতে তার অতীত শীর্ষ অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছোতে পারেনি। ভুলে গেলে চলবে না যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটা জরুরি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জোরালো হয়নি, তাই শিক্ষাক্ষেত্রে ইহুদিদের উপর আক্রমণ দিয়ে যে ঘটনাক্রম শুরু, জার্মানির এবং ইতালির প্রায় সার্বিক ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। অনেক পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ না করাটা অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর নামান্তর। লিজে মাইটনার না পাঠানো এক চিঠিতে অটো হানের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, “You all worked for Nazi Germany. And you tried to offer only a passive resistance. … millions of innocent human beings were allowed to be murdered without any kind of protest being uttered. … you first betrayed your friends, then the men and women who worked with you in that you let them stake their lives on a criminal war – and finally that you betrayed Germany itself, because even when the war was already quite hopeless, you did not once arm yourselves against the senseless destruction of Germany.” ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মুখ বুজে থাকা তাকে সমর্থনের থেকে খুব আলাদা নয়। প্রতিবাদ করতে ভুলে যাওয়া শেষ পর্যন্ত দেশের ধ্বংস ডেকে এনেছিল।
পরিশেষে আর একটা কথা বলতে হয়। নিউটনের সময় থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা সমাজে একটা অন্যরকম জায়গা অধিকার করে এসেছিলেন। বৃহত্তর সমাজ তাঁদের গবেষণা খুব বেশি বুঝত না, কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে সাধারণভাবে শ্রদ্ধা পোষণ করত। তাই কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বিজ্ঞানীও সমাজ সম্পর্কে খুব একটা সচেতন ছিলেন না। ফ্যাসিবাদী আক্রমণ তাঁদের মাটিতে নামিয়ে আনে এবং অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাভোগী শ্রেণির মানু্ষের সঙ্গে একসারিতে দাঁড় করায়। দেশত্যাগী বিজ্ঞানীদের একটা বড়ো অংশ যুদ্ধের মধ্যে পরমাণু বোমা তৈরিতে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁরা এর নৈতিকতা নিয়ে সেই মুহূর্তে প্রশ্ন তোলেননি, কারণ তাঁরা ফ্যাসিস্ট আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু বোমা তৈরি বা তা প্রয়োগের পরে অনেক বিজ্ঞানীই শান্তি ও নিরস্ত্রীকরণের সপক্ষে প্রকাশ্যে মত প্রকাশ করে মার্কিন প্রশাসনের বিরাগভাজন হয়েছিলেন, আইনস্টাইন তার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ঘটনাক্রম দেখিয়ে দিয়েছিল যে সমাজবিচ্ছিন্ন ভাবে বিজ্ঞান গবেষণার দিন ফুরিয়েছে।
ফ্যাসিবাদের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের সহাবস্থান কখনোই খুব স্বচ্ছন্দ নয়। বিজ্ঞানের মোড়কে অবিজ্ঞানকে তুলে ধরা, বিজ্ঞান ও ইতিহাসকে বিকৃত করা, প্রাচীন ইতিহাস বা পুরাণের মধ্যে বর্তমানের অন্যায়ের যৌক্তিকতা খোঁজা ও এক কল্পিত স্বর্ণযুগে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা ফ্যাসিবাদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। প্রশ্নহীন আনুগত্যের উপর জোর দেওয়া, বুদ্ধিজীবীদের প্রতি সন্দেহ – এই সমস্ত আমরা আধুনিক কালের ফ্যাসিবাদী শক্তির মধ্যেও দেখতে পাচ্ছি। প্রতিষ্ঠিত মতকে প্রশ্ন করা আধুনিক বিজ্ঞানের চরিত্রের মূল অঙ্গ। কোপার্নিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও বা ব্রুনো যদি বাইবেলে বর্ণিত পৃথিবীকেন্দ্রিক জগতের বর্ণনায় সন্তুষ্ট থাকতেন, তাহলে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম হত না। অথচ ফ্যাসিবাদ কখনোই প্রশ্ন করাকে বা নিজে চিন্তা করাকে উৎসাহ দেয় না। ইতিহাস দেখায় যে রাষ্ট্র ও দেশকে এক করে দেওয়ার লক্ষ্যে সফল হয়েছিল নাৎসিরা, তাই বহু বিজ্ঞানী সহ দেশের মানুষ তাদের বিরোধিতা করার কথা চিন্তা করতে পারেনি। সেই ফাঁদ সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি।