সঞ্জীব দাস
উন্মোচন
Peeing on that tomb was a legitimate artistic act. ****Borges was a giant as a writer but I feel complete contempt for him as a citizen. As an old man, almost blind, he came to meet the dictator Pinochet in the days when he was busy killing.
–Eduardo Labraca
২৪ জানুয়ারি ২০১১। গার্ডিয়ান পত্রিকায় চিলির লেখক এদোয়ারদো ল্যাব্রাকার এই মন্তব্য পড়ে গোটা বিশ্বের শিক্ষিত মননশীল সমাজ চমকে গিয়েছিল। এই দুনিয়াখ্যাত লেখক স্প্যানিশ ভাষার অবিসংবাদী আর্জেন্টাইন লেখক বোর্হেসের সমাধিতে মূত্রত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আর্জেন্টিনার মননশীল সমাজ-পরিসর এই সংবাদ পড়ে সমালোচনায় মুখর হলেও এই ঘটনায় একটুও লজ্জিত নন। একদা মার্কসবাদী, ফ্যাসিবাদের সমালোচনায় মুখর বোর্হেস ঘাতক পিনোশের ডাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া এদোরদোর মতে নব্য ফ্যাসিবাদকে আলিঙ্গন করার শামিল। এবং এইজন্য বোর্হেসের সমাধিতে মূত্রত্যাগ তাঁর মতে ‘legitimate artistic act’। এই ঘটনাই প্রমাণ করে ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দের সঙ্গে কী পরিমাণ ঘৃণা জড়িয়ে আছে!
বস্তুত ‘ফ্যাসিবাদ’ বা ‘ফ্যাসিজম’ শব্দটি বিগত শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা পরিচিত ঘৃণিত শব্দ। তত্ত্ব কিংবা তত্ত্ববাচক শব্দচিহ্ন এর পূর্বে বা পরে কম আসেনি। কিন্তু আর কোনও শব্দ বা ভাষা-চিহ্নের সঙ্গে এত ঘৃণা লগ্ন হয়ে নেই বা ছিল না। এই মতাদর্শের জন্ম ইতালিতে একথা সবাই জানেন। অন্য যে-কোনও মতাদর্শের মতো এই মতাদর্শেরও উদ্ভব একটি নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে। ইতালি থেকে এই মতাদর্শ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে জার্মানি, সুইডেন এবং স্পেনে। জার্মানিতে এই মতাদর্শ ‘নাৎসিবাদ’ নামে পরিচিত পায়। মুসোলিনি, হিটলার, ফ্রাঙ্কো প্রমুখের বিদায় ঘটলেও ফ্যাসিবাদ কিন্তু আজও নিঃশেষিত হয়নি। ভারতীয় পুরাণের রক্তবীজের মতোই ফ্যাসিবাদ আবারও ফিরে এসেছে, নতুন চেহারায়, নতুন নির্মোকে। জার্মানি, ইতালি, সুইডেন, ব্রাজিল, এমনকি গণতান্ত্রিক আদর্শের পীঠস্থান ফ্রান্স, আমেরিকা এবং ভারতবর্ষেও ফ্যাসিবাদের দৈত্য গোকুলে বাড়ছে।
আমরা জানি কোনও ক্ষমতাকেন্দ্র, তা যদি রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্র হয়, তার উত্থান এবং বিকাশের পশ্চাতে কবি, লেখক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, চলচ্চিত্রকার, শিক্ষক, অধ্যাপক ইত্যাদি বুদ্ধিজীবীবর্গভুক্তদের সক্রিয় কিংবা পরোক্ষ ভূমিকা থাকে। বিগত শতাব্দীতে ফ্যাসিবাদ-নাৎসিবাদের উত্থান ও বিকাশের পশ্চাতেও বুদ্ধিজীবীদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। আজও আছে। আবার কোনও কোনও বুদ্ধিজীবী– তারা সংখ্যায় কম হলেও ফ্যাসিবাদের কাছে আত্মসমর্পন করেননি। বরং ছুঁড়ে দিয়েছেন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জ। বক্ষ্যমাণ প্রতিবেদন বুদ্ধিজীবীদের সেই দ্বৈত ভূমিকার উপর আলোকপাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
বুদ্ধিজীবী ও ফ্যাসিস্ট শক্তির দ্বিরালাপ– চুম্বকে
এখন মূল বিষয়ে প্রবেশের পূর্বে প্রথমেই আমাদের দেখে নেওয়া দরকার বুদ্ধিজীবীশ্রেণিকে ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা কেন্দ্র কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। বিভিন্ন ফ্যাসিস্ট সরকারের কার্যপ্রণালী বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের সম্পর্ক পরস্পর বিরোধী। উভয় পক্ষের মধ্যে যে দ্বিরালাপ চলে সেখানে ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাকেন্দ্রের পক্ষ থেকে যেমন সুস্পষ্ট প্রত্যাখ্যান আছে, তেমনই আছে নিজের প্রয়োজনে বুদ্ধিজীবীদের কাজে লাগানোর সুচতুর প্রয়াস। আপাতভাবে ফ্যাসিবাদ বুদ্ধিজীবীদের মতাদর্শগত শত্রু বলেই মনে করে। কারণ বুদ্ধিজীবীদের প্রাধান্য দিতে গেলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, স্বাধীন চিন্তাশক্তিকে স্বীকার করতে হয়। কিন্তু মতাদর্শগত দিক থেকে ফ্যাসিবাদ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তিস্বাধীনতা, সৃজনশীলতার ঘোর বিরোধী। কারণ ফ্যাসিস্টরা যে চরম কর্তৃত্ববাদে বিশ্বাসী সেই কর্তৃত্বের মুষ্টি শিথিল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ব্যক্তিস্বাধীনতায় প্রবল বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্রয় দিলে। তাছাড়া ফ্যাসিবাদীরা মনে করেন ‘বুদ্ধিজীবী’ ধারণাটি ‘elitism’-এর সঙ্গে লগ্ন, যার তাঁরা ঘোর বিরোধী। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁরা বুদ্ধিজীবীদের কড়া হাতে দমনের পক্ষপাতী। নিজের স্বার্থ পূরণ করতে, নিজেদের মতাদর্শ জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে, জনসাধারণের কাছে নিজেদের গ্রহণীয় করে তুলতে এরাই আবার বুদ্ধিজীবীদের দ্বারস্থ হয়। এরা বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে সেই সমস্ত মানুষদের বেছে নেয় বুদ্ধিজীবীর তকমা যারা খোলস হিসেবে ব্যবহার করেন নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে। এরা ক্ষমতার প্রসাদ-ভিক্ষু। নিজেদের প্রতিষ্ঠা এবং আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদগ্র এষণায় এরা জনগণ ও মানব সভ্যতার হিত ভুলে ফ্যাসিস্ট শক্তির ভজনা করে। এরকম বুদ্ধিজীবীও দেখা গেছে যারা ফ্যাসিস্টদের মানবতাবিরোধী আদর্শকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা মতাদর্শগত দিক থেকে ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যান। এবং ফ্যাসিস্ট শক্তির হাত শক্ত করতে তারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
বুদ্ধিজীবী– ফ্যাসিবাদের বন্দনায়
ফ্যাসিবাদের উত্থান ও বিকাশে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অনুসন্ধান করতে আমরা প্রথমে ফ্যাসিবাদের ধাত্রীভূমি ইতালির দিকে তাকাব। মুসোলিনি আদর্শগত দিক থেকে এক ঝাঁক বুদ্ধিজীবীর সমর্থন পেয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে জিওভান্নি জেন্টিল এবং গাব্রিয়েল ডি আনুনজিও প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
প্রকৃত পক্ষে জিয়োভান্নি জেন্টিল-ই হলেন ইতালিয়ান ফ্যাসিবাদের প্রকৃত উদ্গাতা। মুসোলিনির সঙ্গে যৌথভাবে তিনি রচনা করেন ‘Dottrina del Fascismo’ শীর্ষক বিখ্যাত প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনেই ফ্যাসিবাদের আদর্শ প্রথম স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়। জেন্টিল-ই জাতীয়তাবাদের আদর্শে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন জাতীয়তাবাদই একটি রাষ্ট্রের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করে। আপনি মনে করতেন এই জাতি রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন একটি আধিপত্যকামী সরকার। আসুন পাঠক, তাঁর কিছু প্রসিদ্ধ উক্তির দিকে ফিরে তাকাই:
১. Fascism is a religion that worships the state and makes the individual a mere instrument of the state’s power.
২. The state is not a means to an end, but an end in itself.
৩. Fascism is the most recent and most coherent expression of the totalitarian concept of the state.
৪. The fascist state is a state of labor, where everyone works for the common good.
৫. War is the ultimate test of the strength of a state and the loyalty of its citizens.
প্রিয় পাঠক, এই উক্তিগুলি কী প্রমাণ করে না জিয়োভান্নি জেন্টিল ফ্যাসিবাদকে কতটা অন্ধ-আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন! বস্তুত তাঁর সাহায্য না পেলে মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ এতটা বৈধতা পেত না।
জার্মানির হিটলারেরও তোষামুদে বুদ্ধিজীবী কিছু কম ছিল না। যাঁর কথা এই প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে পড়ে তিনি হলেন তিনি হলেন দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার (1889-1976)। তিনি সে যুগের একমাত্র বিখ্যাত জার্মান বুদ্ধিজীবী যিনি হিটলারকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালে তাঁর বিখ্যাত “Rectoral Address (1933)” কী আজও স্মরণীয় হয়ে নেই! তাঁর সেই বিখ্যাত বক্তৃতার কিছু উক্তি এখানে তুলে দেওয়া হল:
১. Das deutsche Volk ist zu sich selbst gekommen, und damit muss auch die Universität ihr Wesen finden. (The German people has come into its own, and thus the university must also find its essence.)
২. Der Führer allein ist die gegenwärtige und zukünftige deutsche Wirklichkeit, und er allein ist das Gesetz. (The Führer alone is the present and future German reality, and alone is he the law.)
৩. Wir müssen uns erziehen, Führer und Hüter des deutschen Volkes zu werden. (We must educate ourselves to become the leaders and guardians of the German people.)
হাইডেগার ছিলেন উদারনৈতিক গণতন্ত্রের তীব্র সমালোচক। জার্মান জাতি এবং সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে হিটলারের দৃষ্টিভঙ্গির তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন সমর্থক। হিটলার ক্ষমতা আসার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নাৎসি দলে যোগদান করেন। ফ্রেইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটারের দায়িত্ব পালন করার সময় ছাত্রদের মধ্যে নাৎসি আদর্শ প্রচারে তিনি যত্নবান হন। তিনি হিটলারের এতটাই অনুগত ছিলেন যে হিটলারের পতনের পরেও ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত নিজের লেখা বিভিন্ন চিঠিতে ‘Heil Hitler’ সম্বোধন শব্দবন্ধটি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতেন।
ফ্যাসিবাদ-নাৎসিবাদ এবং হিটলার সম্পর্কে সেকালের অধিকাংশ জার্মান কবিদের ভূমিকা ছিল দোদুল্যমানতায় দীর্ণ। এঁদের মধ্যে সামনের সারিতে ছিলেন Gottfried Benn (1886-1956), Ernst Jünger (1895-1998), নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত কবি-নাটককার Gerhart Hauptmann (1862-1946)। এঁরা নাৎসিবাদ এবং হিটলারের কার্যক্রমের প্রকৃতি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কার্যত এই অজ্ঞানতার জন্যই নাৎসিদলের ভাবাদর্শকে তাঁরা সমর্থন করে বসেন। পরবর্তীকালে যখন নিজেদের জীবন অভিজ্ঞতা দিয়ে তাঁরা বুঝতে পারলেন নাৎসিবাদের প্রকৃত স্বরূপ, দেখলেন গেস্টাপো বাহিনীর নারকীয় কার্যকলাপ তখন সেই অকুণ্ঠ-অন্ধ সমর্থন প্রত্যাহৃত হল। তাঁরা হিটলার এবং তাঁর দলের অমানবিকতা, আগ্রাসী যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে মুখর হয়ে উঠলেন।
ইতালি-জার্মানির বাইরে তাকালে প্রথমেই আমাদের চোখ চলে যায় নরওয়ের Gudbrandsdalen-এর Lom গ্রামের দিকে। এখানেই জন্মেছিলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ন্যুট হামসুন (1859-1952)। ১৯২০ সালে সাহিত্যে নোবেল পাওয়া এই সাহিত্যিক আডলফ হিটলারের মৃত্যুতে শোকবার্তায় লিখেছিলেন, ‘হিটলার ছিলেন মানবজাতির যোদ্ধা। সব জাতির জন্য ন্যায়বিচারের বার্তা প্রচারক।’ প্রবল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিরোধী মনোভাব হামসুনকে ফ্যাসিবাদের কাছাকাছি নিয়ে গেছিল। প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বোয়ার যুদ্ধের (১৮৯৯-১৯০২) পর থেকেই তিনি ব্রিটিশবিরোধী অবস্থান নেন। দক্ষিণ আফ্রিকার স্বর্ণখনির দখল পেতে ব্রিটিশরা স্থানীয় বোয়ারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এই যুদ্ধে ৪৬ হাজার বোয়ার মৃত্যুবরণ করে যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল শিশু। ব্রিটিশ বিরোধিতার সূত্র ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিও তাঁর বিরূপ মনোভাব জন্মায়। তিনি ক্রমেই জার্মানি ও জার্মান সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি নরওয়ের দখল নিলেও হামসুনের মনোভাব বদলায় না। বরং তিনি জার্মানির পক্ষ অবলম্বন করে লেখালেখি করতে থাকেন। আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে তিনি নিজের নোবেল পদকটি হিটলারের প্রচারণামন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলসকে পাঠিয়ে দেন। সঙ্গে নোবেলের কিছু অর্থও। এই অন্ধ আনুগত্যের পুরস্কার মেলে অচিরেই। হিটলারের দরবারে ডাক পড়ে। ১৯৪৩ সালের জুনে হামসুন সাগ্রহে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। তবে ৪৫ মিনিটের সেই অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর ছিল না। তিনি হিটলারের কাছে এই মর্মে নালিশ করেন যে, নরওয়েতে জার্মানির বেসামরিক প্রশাসক জোসেফ ট্যারবোডেন অপশাসন চালাচ্ছেন। ট্যারবোভেন যে নরওয়েবাসীকে জেলে পুরেছেন, তাদের ছেড়ে দেয়ার জন্য তিনি হিটলারের কাছে অনুরোধ জানান। শোনা যায়, এ কথায় হিটলার এতটাই রেগে যান যে শান্ত হতে সময় নিয়েছিলেন তিন দিন! হামসুনও এই ঘটনায় প্রবল দুঃখ পেয়েছিলেন।
তবু হিটলারের প্রতি তাঁর মোহ যায়নি। হিটলারের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর ৮৬ বছরের হামসুন তাঁকে উদ্দেশ করে একটি শোকবার্তা লেখেন। তবে তাঁর এই হিটলার প্রীতি নরওয়ের জনগণ ভালো চোখে দেখেনি। যুদ্ধ শেষে উত্তেজিত জনতা নরওয়ের বিভিন্ন শহরে হামসুনের বই পুড়িয়েছিল। বিচারের আগে হামসুনের মানসিক সুস্থতার পরীক্ষা করা হয়। সেখানে ‘অসুস্থ’ প্রতিপন্ন হওয়ায় বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ থেকে তিনি রেহাই পান।
এরপরেই যাঁর কথা মনে আসে তিনি হলেন বিখ্যাত মার্কিন কবি এজরা পাউন্ড (1885-1972)। তাঁর মুসোলিনি-হিটলার প্রীতি তো প্রবাদ হয়ে আছে। ১৯২৪ সালে তিনি ইতালি চলে যান। ১৯৩০ ও ৪০ দশকজুড়ে মুসোলিনি এবং হিটলারের পক্ষে সক্রিয়ভাবে নানা কাজ করেন, হিটলারকে সমর্থন দেন, তাঁর আত্মজীবনীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে প্রতিবেদন লেখেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মুসোলিনির পক্ষে তিনি অনেক রেডিও সম্প্রচার নির্মাণ করেন। এগুলো ছিল মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণায় ভরপুর। দিনের পর দিন তিনি রেডিওতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে চরম বিষোদ্গার চালিয়ে যান।
১৯৪৫ সালে মার্কিন বাহিনী পাউন্ডকে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। সেখানে থাকা অবস্থায় তাঁর মধ্যে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিলে বিচারক তাঁকে অসমর্থ ঘোষণা করেন। তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। প্রায় ১৩ বছর সেই হাসপাতালে থেকে তিনি মুক্তি পান।
সুইডেনেও ফ্যাসিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়ে। সেখানেও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন Sven Hedin (1865-1952), Knut Hamsun (1859-1952), Per Engdahl (1909-1994) প্রমুখ। অন্যদিকে ছিলেন Tage Erlander (1901-1985), Alva Myrdal (1902-1986), Gunnar Myrdal (1898-1987), Eyvind Johnson (1900-1976), Karin Boye (1900-1941) লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীবৃন্দ। তাঁদের রচনা, বক্তৃতায় ফ্যাসিবাদের প্রতি বিতৃষ্ণা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিল।
প্রতিবেদনের সূচনাতেই হোর্হে লুই বোর্হেসের (1899-1986) কথা এসেছে। আর্জেন্টিনার বিখ্যাত লেখক বোর্হেস নব্য ফ্যাসিবাদের সমর্থক ছিলেন বলা হয়। কিন্তু আদ্যোপান্ত জানলে মনে হয় তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ছিল গোলমেলে, স্ববিরোধী। একদিকে তিনি জার্মানির অ্যাডলফ হিটলারের বিরোধিতা করেছেন, অন্যদিকে প্রশংসা করেছেন চিলির অগাস্তো পিনোশে, স্পেনের ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো, আর্জেন্টিনার হোর্হে রাফায়েল ভিদেলার।
আমরা জানি আর্জেন্টিনা ১৯২০ ও ৩০-এর দশক এই দীর্ঘ সময় ধরে সেনাশাসনের অধীনে ছিল। সেই সময় বোর্হেস গণতান্ত্রিক রাজনীতির সমর্থক ছিলেন। তিনি ছিলেন হিটলারের তীক্ষ্ণ সমালোচক। ১৯৪৬ সালে আর্জেন্টিনার ক্ষমতায় আসেন স্বৈরশাসক হুয়ান পেরন। তিনি সরকারি কোপে পড়েন। গ্রন্থাগারের সরকারি চাকরি থেকে পোলট্রি ও খরগোশ খামারের পরিদর্শক হিসেবে তাঁকে বদলি করা হয়। এই ঘটনায় তিনি চরম অপমানিত বোধ করেন।
স্বৈরাচারী পেরন-এর শাসনের বিরোধিতায় আর্জেন্টিনার কমিউনিস্ট পার্টির দোদুল্যমানতা বোর্হেসকে তীব্রভাবে আহত করে। তিনি কমিউনিজমের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তিনি কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থাকে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা বলে মনে করতেন। তিনি স্পষ্ট বলেন: “Communists are in favor of totalitarian regimes and systematically combat freedom of thought, oblivious of the fact that the principal victims of dictatorships are, precisely, intelligence and culture.” অথচ তিনি জেনারেল ভিদেলার একচ্ছত্র স্বৈরাচারী শাসনকে মেনে নেন। ১৯৭৬ সালে পেরনের স্ত্রী ইসাবেলের সরকারকে উৎখাত করে জেনারেল ভিদেলার নেতৃত্বে সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করলে বোর্হেস তাঁকে সমর্থন করেন। ভিদেলার আমন্ত্রণে দেখা করে তিনি আর্জেন্টিনাকে পেরনের প্রভাবমুক্ত করার অকুন্ঠ ধন্যবাদ জানান।
বোর্হেসের প্রথম দিকের রচনায় ফ্যাসিবাদের তীব্র সমালোচনা পরিকীর্ণ হয়ে আছে। যেমন:
১. “Tlön, Uqbar, Orbis Tertius” (1940) – ১৯৪০ সালে রচিত এই গ্রন্থে বোর্হেস সর্বগ্রাসীবাদ একনায়কতন্ত্র, মতাদর্শগত নিয়ন্ত্রণবাদের প্রবল সমালোচনা করেছেন।
২. “The Lottery in Babylon” (1941) – আপাতদৃষ্টিতে এখানে রয়েছে ভাগ্য, নিয়ত আকস্মিকতাময়, বিশৃঙ্খলাপূর্ণ এক পৃথিবীর স্বপ্ন। এর মধ্যে দিয়ে তিনি সুকৌশলে ফ্যাসিস্টদের অতি নিয়ন্ত্রণবাদকে বিদ্ধ করেছেন।
৩. “Deutsches Requiem” (1946) – শ্রেণিগত বিচারে এটি একটি ছোটোগল্প। বোর্হেসের ফ্যাসিবাদ বিরোধী মানসিকতার এখানে অনন্য শিল্পরূপ পেয়েছে।
পরবর্তীতে বোর্হেসের জীবনদৃষ্টির বদল ঘটে। তিনি ফ্যাসিস্ট পিনোশের আমন্ত্রণে পুরস্কার নিতে চিলিতে যান। পিনোশের সঙ্গে দেখা করে তিনি বলেছিলেন, আর্জেন্টিনা, চিলিতে অরাজকতার অবসান হয়েছে। তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন, গণতন্ত্রে তাঁর আর আস্থা নেই। অন্য দেশের জন্য ভালো হলেও হতে পারে, কিন্তু চিলি বা আর্জেন্টিনায় এটি কার্যকর কোনও পদ্ধতি নয়। তবে বোহের্সের লেখাপত্র পড়লে বোঝা যায় ফ্যাসিবাদকে ভেতর থেকে তিনি সমর্থন করতেন না।
বুদ্ধিজীবী– ফ্যাসিবাদের প্রতিরোধে
বুদ্ধিজীবীরা শুধু যে ফ্যাসিবাদের পোস্টা হিসেবে কাজ করেছেন এমনটা নয়। ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান প্রতিরোধে তাঁরা নিয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। এ প্রসঙ্গে বিগত শতাব্দীর দুই ইতালিয়ান চিন্তাবিদের নাম আমাদের মনে আসে। মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের বন্দনায় যখন অধিকাংশ ইতালিয়ান বুদ্ধিজীবী উদ্বেল তখন সেই দেশের অন্তত দুজন বুদ্ধিজীবী অকুন্ঠ প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন। একজন ক্রোচে, অন্যজন গ্রামশি।
বেনিডিতো ক্রোচে (১৮৬৬-১৯৫২) প্রথম দিকে ফ্যাসিবাদের সমর্থক ছিলেন। সেই সময় তিনি ফ্যাসিবাদকে জাতীয় উন্নতি এবং দেশের স্থায়িত্বের পক্ষে সহায়ক শক্তি হিসেবে গণ্য করতেন। কালে নানা ঘটনা পরম্পরায় ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে তাঁর মনোভাব পালটে যায়। বস্তুত পক্ষে গ্রামসির মতোই তিনি মুসোলিনি ও তাঁর ফ্যাসিবাদের তীক্ষ্ণতম সমালোচকে পরিণত হন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিলেন ফ্যাসিবাদ কী পরিমাণ ব্যক্তির স্বাধীনতা বিরোধী, কী পরিমাণ সর্বাত্মক কর্তৃত্ববাদী। গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং শিল্পীর স্বাধীনতায় ফ্যাসিস্টদের যে মজ্জাগত ঘৃণা তা বাস্তবের অভিঘাতে তাঁর সম্মুখে স্পষ্ট হয়ে যায়। এই অভিজ্ঞতাই তাঁকে ফ্যাসিবাদবিরোধী করে তোলে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় ফ্যাসিস্টদের নিরঙ্কুশবাদকে নস্যাৎ করেন। রচনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে মানবতাবাদের প্রতি তাঁর আন্তরিক সমর্থন। তিনি বুদ্ধিবৃত্তি, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। তিনি এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি জিওভানি আমেন্দোলার সঙ্গে রচনা করেন “Manifesto of the Anti-Fascist Intellectuals” (1925)। এখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় ফ্যাসিবাদকে আত্মার অসুখ, যুক্তিবাদ ও স্বাধীনতার বিরোধী মতবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেন: “Fascism is a disease of the spirit, a rebellion against reason and liberty.” (From “Manifesto of the Anti-Fascist Intellectuals”, 1925)। তাঁর ভাষায় “Fascism is not a revolution, but a counter-revolution, a reaction against the principles of liberty, equality, and fraternity.” (From “History of Italy”, 1928)
তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন : “The fascist regime is a form of absolutism, which destroys every liberty, every right, every guarantee of the individual.” (From “History of Europe in the Nineteenth and Twentieth Centuries”, 1932)। তিনি ফ্যাসিবাদের মধ্যে মহৎ কিছু খুঁজে পাননি। তাঁর মতে: “The fascist ideology is a mixture of sentimentalism, nationalism, and authoritarianism, which leads to the destruction of every moral and intellectual value.” (From “Politics and Morals”, 1931)
এইসব কারণে তিনি ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার তীব্র রোষের শিকার হন। মুসোলিনি তাকে ‘ইতালি বিরোধী’ এবং ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে অভিহিত করেন। নির্ভীক ক্রোচে এতে ভীত হননি। বরং অভূতপূর্ব সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে তিনি মুসোলিনির উদ্দেশ্যে একটি পত্র লেখেন। সেই পত্রের ছত্রে ছত্রে ফ্যাসিস্ট সর্বাত্মক কর্তৃত্ববাদ, চিন্তার স্বাধীনতার বিরূপ মনোভাবকে তিনি তীক্ষ্ণ সমালোচনায় বিদ্ধ করেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর ভূমিকা স্বীকৃতি পেয়েছে ঐতিহাসিকের মূল্যায়নেও:
For twenty years, Benedetto Croce was the only free voice in our country. The only intellectual to whom the fascist regime, due to his prestige and charisma, granted a certain freedom of expression. Alone, through his books, his journal, and his relationships, he managed to keep the flame of hope alive in many young people. A story that reiterates the eternal battle between freedom and cultural enslavement.
প্রথম দিকে আন্তোনিও গ্রামশি (1891-1937)-ও ফ্যাসিবাদকে সুনজরে দেখতেন। দ্রুতই তিনি সেই ভ্রান্তি কাটিয়ে ওঠেন। বিরোধীদের যাবতীয় বিরোধিতাকে দমন করে মুসোলিনি ইতালির শাসন ক্ষমতা দখল করলে গ্রামশি একের পর এক তীক্ষ্ণ লেখা লেখায় তাঁকে বিদ্ধ করতে থাকেন। গ্রামশি নতুন সরকারের অস্তিত্বের পক্ষে বিপদ্জনক হয়ে উঠবেন এই বিবেচনা করে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। কিন্তু যার হাতে তীক্ষ্ণ কলম আছে তাঁকে দমন করবে কে? গ্রামশি জেলে বসেই তাঁর তীক্ষ্ণ লেখায় ফ্যাসিবাদের চরিত্র নগ্ন করে দিতে থাকেন। প্রথমেই তিনি মুসোলিনির স্তাবক বুদ্ধিজীবীদের তীক্ষ্ণ ভাষায় বিদ্ধ করেন। তাঁর চোখে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তিন শ্রেণির জীব দেখা যায়:
১) Intellettuali tradizionali বা ঐতিহ্যবাদী বুদ্ধিজীবী:
এই শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের স্বাধীন, যাবতীয় সংকীর্ণতা, গোষ্ঠীবাদ থেকে মুক্ত বলে দাবি করেন: “Gli intellettuali che si considerano autonomi e indipendenti dalla classe dominante.” (Intellectuals who consider themselves autonomous and independent from the dominant class.)
শাশ্বত কতগুলি বিষয় বা মূল্যবোধ তাঁদের আলোচ্য বিষয়। গ্রামশি বলেন এঁরা প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার স্বার্থ রক্ষায় সর্বদা তৎপর। এঁদের দ্বারাই শাসকশ্রেণি সুচতুরভাবে নিজের সর্বাত্মক আধিপত্য (hegemony) কায়েম করেন।
২) Intellettuali organici বা জৈব বুদ্ধিজীবী:
কোনও না কোনও গোষ্ঠী থেকে এই বুদ্ধিজীবীদের জন্ম। এঁরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এবং জনগণের মধ্যে সংযোগকারীর ভূমিকা পালন করেন।
আদর্শ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে তাঁর নির্ণয় প্রণিধানযোগ্য:
Gli intellettuali sono gli organizzatori delle idee di una classe, i costruttori delle strutture ideologiche che giustificano e sostengono il dominio di una classe.” (Intellectuals are the organizers of the ideas of a class, the builders of ideological structures that justify and support the dominance of a class.)
[Source: Antonio Gramsci, “Quaderni del carcere” (Prison Notebooks), Notebook 3, Page 44]
গ্রামশি নিজের জীবনচর্যা দিয়ে প্রমাণ করেন সমাজে একজন Organic বুদ্ধিজীবীর কী ভূমিকা হতে পারে। তিনি তীক্ষ্ণ ভাষায় ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন বারংবার:
১. Fascism is the most recent and most complete form of reaction, which tries to crush the working class and its revolutionary organizations. (Gramsci, 1921)
২. Fascism tries to divide the working class through nationalism, racism, and other forms of ideology, in order to prevent its unification and mobilization.(Gramsci, 1925)
৩. Fascism is a dictatorship which suppresses the democratic liberties of the working class and its organizations. (Gramsci, 1926)
৪. Fascist ideology is a form of ‘false consciousness’ which prevents the working class from becoming aware of its own interests and its own historical mission.(Gramsci, 1930)
৫. Fascism is unable to solve the economic crises which lead to its rise, and can only perpetuate them. (Gramsci, 1931)
৬. Fascist corporatism is a form of state control over the economy, which suppresses the autonomy of the working class and its organizations. (Gramsci, 1932
৭. Fascist ideology is a form of intellectual and moral bankruptcy, which is unable to provide a coherent and consistent worldview. (Gramsci, 1933)
হিটলারের সমকালীন জার্মানিতেও বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদী স্বর উচ্চারিত হয়েছিল। এই প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম জুর্গেন হাবেরমাস (Jurgen Habermas)। ১৯২৯ সালে তাঁর জন্ম। জার্মানিতে হিটলার উত্থান যখন হয় তখন তিনি নিতান্তই কিশোর। হিটলারের কর্তৃত্ববাদ, গেস্টাপো বাহিনীর অত্যাচার এসব তাঁর নিজের চোখে দেখা। ছেলেবেলার সেই অভিজ্ঞতাই তাঁকে ফ্যাসিবাদ বিরোধী করে তোলে। সারা জীবন ধরে লেখা অসংখ্য প্রবন্ধে গ্রন্থে তিনি নাৎসিবাদ ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে নিজের অনুভব ব্যক্ত করেছেন।
চাটুকার কবি-শিল্পীদের পাশাপাশি কয়েকজন নাট্যকার এবং কবি সে যুগের জার্মানিতে ছিলেন যাঁরা শাস্তি ও মৃত্যুর ভয়কে অগ্রাহ্য করে নাৎসিবাদের প্রকাশ্য বিরোধিতায় সরব হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে প্রথমেই যাঁদের কথা মনে পড়ে তাঁরা হলেন বের্টোল্ট ব্রেখট Bertolt Brecht (1898-1956), Thomas Mann (1875-1955),’ Heinrich Mann (1871-1950), Erich Maria Remarque (1898-1970) এবং Stefan Zweig (1881-1942)। ব্রেখট তাঁর নাটকে, কবিতায়, প্রবন্ধে ফ্যাসিবাদ-নাৎসিবাদকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠেন: “Fascism is the temporary victory of the bourgeoisie over the proletariat.”
তিনি “The Resistible Rise of Arturo Ui” (1941) হিটলারের ক্ষমতায় আসাকে তীক্ষ্ণ স্যাটায়ারে বিদ্ধ করেন। তাঁর “The Mother” (1932) নাটকে ফ্যাসিবাদী সরকারকে কুখ্যাত করতে বিপ্লবের ডাক দেয়া হয়। তাঁর “Fear and Misery of the Third Reich” (1938) – জার্মানিতে নাৎসি শাসনের ভয়াবহতা জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবীরাও সেদিন ফ্যাসিবাদের বিরোধিতায় পিছিয়ে ছিলেন না। সেকালে ফ্যাসিবাদের বিরোধিতায় যে সকল ফরাসি চিন্তাবিদ সরব হয়েছিলেন তাদের মধ্যে রোমা র্যোঁলা (1866-1944) ছিলেন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। ফ্যাসিস্টদের উগ্র জাতীয়তাবাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধিতা, সৃষ্টিশীলতাকে দমন, সমরবাদ এবং জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে সর্বাত্মক আধিপত্যবাদকে গণতন্ত্রপ্রিয় মানবতাবাদীরা সঙ্গত কারণেই মানবতার পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করতেন। তিনি অসামান্য নির্ভীকতায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেন। তিনি ফ্যাসিবাদকে মনের অসুখ এবং যুক্তিবাদ ও মানবতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে অভিহিত করেন : “Fascism is a disease of the spirit, a revolt against reason and humanity.” মানবসভ্যতার যা কিছু সুন্দর এবং যা কিছু মহৎ, ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা হল সেই সবকিছুর অস্বীকৃতি : “The fascist regime is a monstrous negation of all that is noble and beautiful in human civilization.”
১৯২৩ সালে ইতালিয়ান ফ্যাসিবাদকে তীব্র নিন্দা করে রচনা করেন ‘The Appeal of June’ (12, 1923)। অতি দ্রুতই ফ্যাসিবাদের বিরোধিতায় পাশ্চাত্যের সর্বাপেক্ষা অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। আঁদ্রে জিদ, হেনরি বার্বসের মতো ব্যক্তিত্ব তাঁকে দেখেই ফ্যাসিবাদের বিরোধিতার প্রেরণা পান। ফ্যাসিস্টদের প্রচারচ্ছটায় সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত রবীন্দ্রনাথকে তিনিই মুসোলিনি ও ফ্যাসিবাদের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে সচেতন করেন। এছাড়া ছিলেন সার্ত্র্, কামু। ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইতে তাঁরাও স্পষ্ট এবং ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
স্প্যানিশ বুদ্ধিজীবীরাও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট মুখর ছিলেন। বিশেষত চিত্রশিল্পীদের কথা বলতে হয়। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন পাবলো পিকাসো এবং সালভাদোর দালির মতো চিত্রশিল্পী। পাবলো পিকাসোর চিত্রশিল্পে ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর সুপ্রসিদ্ধ চিত্রকর্ম “গের্নিকা”-য় (১৯৩৭)। এই চিত্রটি স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় ফ্যাসিস্ট বাহিনী কর্তৃক গের্নিকা শহরের ওপর বোমাবাজির প্রেক্ষিতে তিনি রচনা করেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতার এমন স্পষ্ট উচ্চারণ আর নেই। সালভাদোর দালি অবশ্য প্রথমদিকে ফ্যাসিবাদের প্রতি প্রবলভাবে অনুরক্ত ছিলেন। তাঁর প্রথম দিকের শিল্পে সেই অনুরাগের পরিচয় প্রাণবন্ত। পরে ফ্যাসিবাদের আসল পরিচয় বুঝতে পেরে তিনি ফ্যাসিবাদ বিরোধী হয়ে ওঠেন। তাঁর বিভিন্ন চিত্রের চিত্রকলায় সেই বিরোধিতার ছাপ স্পষ্ট। যেমন:
১. “সফ্ট কনস্ট্রাকশন উইথ বোইল্ড বিনস” (1936) – এই শিল্পকর্ম দালির স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
২. “দ্য পার্সিস্টেন্স অফ মেমরি” (1931) – এই পেইন্টিংয়ে ডালি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন।
স্পেনের লেখক কবি-নাট্যকারেরাও অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সরব হন। এঁদের মধ্যে লোরকা (1898-1936) সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। প্রথম থেকেই তিনি ছিলেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এর মাশুল তাঁকে প্রাণ দিয়ে দিতে হয়েছিল। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি “লা কাসা ডে বার্নার্ডা আলবা” (বার্নার্ডা আলবার ঘর) চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। এই নাটকটিতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ শানিত হয়ে উঠেছে। ফ্যাসিবাদ বিরোধী মনোভাব তাঁর কবিতাতে উৎকীর্ণ। “পোয়েটা এন নুয়েভা ইয়র্ক”, “বোদাস দে সানগ্রে” ইত্যাদি কবিতার নাম এই প্রসঙ্গে মনে পড়বে। তাঁর রচিত ‘Cantos para los muertos de la guerra’ আজও ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে। সেই কবিতার কয়েকটি প্রসিদ্ধ উচ্চারণ:
Gacela del niño muerto Todas las tardes en Granada, todas las tardes se muere un niño. Todas las tardes el agua se sienta a conversar con sus amigos.
Los muertos llevan alas de musgo. El viento nublado y el viento limpio son dos faisanes que vuelan por las torres y el día es un muchacho herido.
No quedaba en el aire ni una brizna de alondra cuando yo te encontré por las grutas del vino No quedaba en la tierra ni una miga de nube cuando te ahogabas por el río.
Un gigante de agua cayó sobre los montes y el valle fue rodando con perros y con lirios. Tu cuerpo, con la sombra violeta de mis manos, era, muerto en la orilla, un arcángel de frío
(Gazelle of A Dead Child Every afternoon in Granada, every afternoon a child dies. Every afternoon the water sits down to chat with its friends. The dead wear wings of moss. The cloudy wind and the clear wind are two pheasants that fly through the towers and the day is a wounded boy. There was not even a shred of lark left in the air when I found you in the wine caves. There was not even a crumb of cloud left on the earth when you were drowning in the river. A giant of water fell on the mountains and the valley rolled with dogs and lilies. Your body, with the violet shadow of my hands, was, dead on the shore, an archangel of cold.)
[‘cantos para los muertos de la guerra’]
সেদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লেখনী তুলে নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন– দার্শনিক John Dewey (1859-1952), কবি Langston Hughes (1902-1967), কথাশিল্পী Ernest Hemingway (1899-1961) এবং William Faulkner (1897-1962) প্রমুখ। মার্কিন বুদ্ধিজীবীদের এই প্রতিবাদের ঐতিহ্য এখনও বহমান নোয়াম চমস্কির মধ্যে। সারা জীবন ধরে তিনি আধিপত্যবাদ-সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মুখর প্রাণবন্ত। এখনও তিনি এক অপরিক্লান্ত যোদ্ধা।
ফ্যাসিবাদের বিরোধিতায় বাংলার শিল্পী-বুদ্ধিজীবীসমাজের কয়েকজন
পরাধীন ভারতবর্ষে বিশেষত অবিভক্ত বঙ্গদেশে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা দানা বেঁধেছিল। কবি রবীন্দ্রনাথের সার্বভৌম ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা তো সর্বজনবিদিত। প্রথমদিকে তিনিও মুসোলিনির বন্দনায় মুখর হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারেন। ফ্যাসিবাদের স্বরূপ উন্মোচন করেন তীক্ষ্ণতম ভাষায়। ১৯৩৭ সালে তাঁর সভাপতিত্বেই গড়ে ওঠে ‘League against Fascism and war.’ সেদিন কমিউনিস্ট পার্টির পতাকাতলে বুদ্ধিজীবীরা সমবেত কন্ঠে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, গোপাল হালদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, রাম বসু, সোমেন চন্দ, গোলাম কুদ্দুস প্রমুখ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেন। এমনকি বুদ্ধদেব বসু যিনি কোনোভাবেই কমিউনিস্ট আদর্শে সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তিনিও এগিয়ে এসে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মুখর হয়েছিলেন। এ বিষয়ে গোলাম কুদ্দুসের স্মৃতিচারণা স্মৃতিচার্য হয়ে আছে: “এই বুদ্ধদেব বসু কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। আবার তিনি সমকালীন কংগ্রেস রাজনীতির শরিকও ছিলেন না। অথচ ছিলেন তীব্র ফ্যাসিবিরোধী।” তাঁর এই ফ্যাসিবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে সমসময়ে ফ্যাসিবিরোধী সাংস্কৃতিক সংগ্রামে সামিল করেছিল। তিনি প্রগতি লেখক সংঘে যুক্ত হয়েছিলেন, ফ্যাসিবিরোধী সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের ১৯ এবং ২০ তারিখে কলকাতায় নিখিল বঙ্গ ফ্যাসিবিরোধী যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার সহযোগী সভাপতি হিসেবে তিনি তাঁর প্রদত্ত অভিভাষণে বলেছিলেন রোমা র্যোঁলার বিখ্যাত বাণী– ‘সকল উৎপীড়কের বিরুদ্ধে সকল উৎপীড়িতের সঙ্গে’ নিজেদের বাণী হিসেবে ‘আজ আমরা’ গ্রহণ করব। এদিনের অভিভাষণে তিনি সাবেগ উচ্চারণে ঘোষণা করেছিলেন:
… যে মেদস্ফীত মদাপ্লুত অন্যায় পশুশক্তি বীভৎস মাৎলামিতে আজ পৃথিবী ভরে ছারখার করে বেড়াচ্ছে তাকে আমরা বলব : তুমি সব পারো কিন্তু আমাদের মনুষ্যত্ব কাড়তে পারো না– তুমি যা করছ আমাদের দিয়ে তা করাতে পারবে না– তাই তুমি পরাজিত আর আমরাই জয়ী।
সমসময়ে ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের তরফ থেকে প্রকাশিত এক সংকলনে ‘সাহিত্যিকের জবানববন্দি’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল বুদ্ধদেব বসুর ‘সভ্যতা ও ফ্যাসিজম’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ। সেই প্রবন্ধে বুদ্ধদেব লিখেছিলেন যে ‘পশুত্বের বিরুদ্ধে’ আমাদের অর্থাৎ লেখক শিল্পী সাহিত্যিকদের ‘রুখে দাঁড়াতেই’ হবে অন্যথায় ‘আমাদের অস্তিত্বই’ বিপন্ন হয়ে পড়বে। স্বভাবতই ‘আমরা যারা’ সংস্কৃতি তথা ‘বিশ্বমানবের ঐতিহাসিক প্রগতিতে আস্থাবান’ তাঁদের সামনে এই ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অন্য কোনও বিকল্প পথ নেই। প্রগতিতে আস্থা না রাখতে পারলে, তাঁর মতে, জীবন নিরর্থক হয়ে যাবে। তাই বুদ্ধদেব বসু নির্দ্বিধায় বলেছিলেন:
চোখ বুজে বলে দেয়া যায় যে ফ্যাসিস্ট মনোবৃত্তি … বাঁধন-ছেঁড়া ক্ষিপ্ত কুকুরের মত ছুটে বেরিয়ে এসে তাদেরই কামড়াতে যাবে মুক্তির সাধনায় জীবন যাদের উৎসর্গিত।
শেষের কথা
প্রতিবেদনের শেষে আবার শুরুর কথায় আসি। জীবনের এক সন্ধিক্ষণে বোর্হেসের নব্য ফ্যাসিবাদী শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন তাঁকে সংবেদনশীল মানুষের ঘৃণার পাত্র করে তুলেছিল। তাঁর এই পরিণতি দেখে শিক্ষা নেওয়ার কথা ছিল এদেশের লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের। কিন্তু এদেশে নব্য-ফ্যাসিবাদের উন্মেষের প্রাক্কালে তাঁদের অধিকাংশের ভূমিকা দেখলে ঘৃণা জাগে। যে মহাশ্বেতা দেবী, কবীর সুমন, প্রতুল মুখোপাধ্যায়দের রচনা পাঠ করে, গান শুনে শিক্ষিত-সমাজ থেকে প্রান্তিক মানুষেরা উজ্জীবিত হতেন তাঁরা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে হাত মেলালেন। একজন দুজন শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন, নবারুণ ভট্টাচার্য তো নেহাতই ব্যতিক্রম।