সুমিতা চক্রবর্তী
‘ফ্যাসিবাদ’ এক রাষ্ট্রনীতি। জাতীয়তাবাদী সাম্রাজ্যবাদের এক উগ্র প্রকাশ এবং সেই মানসিকতা অনুসারে রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচালনা পদ্ধতিকে ফ্যাসিবাদ বলা যায়। সাধারণত এই ফ্যাসিবাদ স্বৈরতন্ত্রী একনায়কের শাসিত দেশেই সম্প্রসারিত হয়। এই রাষ্ট্রচেতনার উদ্ভব ভারতে হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা কবিতার প্রসঙ্গে ‘ফ্যাসিবাদ’ ও ‘ফ্যাসিবাদ-বিরুদ্ধতা’ শব্দ দুটি আমরা প্রায়শই শুনে থাকি। তার কারণ সন্ধানে ফ্যাসিবাদের ইতিহাস এবং তার গতিপ্রকৃতির পরিচয় গ্রহণ করা যেতে পারে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ইতালি-র নির্বাচনে জয়লাভ করেন বেনিতো মুসোলিনি (১৮৮৩-১৯৪৫)। ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটিকে সাধারণত হিটলার ও জার্মানির সঙ্গেই যুক্ত করা হয় কিন্তু ‘সর্বাত্মক ক্ষমতা’ অর্থে ‘ফ্যাসিজমো’ (FASCISMO) শব্দটির প্রয়োগ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পাওয়া যায় মুসোলিনির লেখায়। রাষ্ট্র-পরিচালনায় ফ্যাসিস্ট নীতির প্রথম প্রবক্তা মুসোলিনি। এই নীতি অন্যান্য কোনো কোনো দেশ গ্রহণ করতে শুরু করে ১৯৩৩ থেকে। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫) এই নীতির অনুসারী। জার্মানিতে দেখা দিল নাৎসি পার্টি। মুসোলিনির আবসিনিয়া আক্রমণের ঘটনা ঘটে ১৯৩৪-এ। স্পেন-এ প্রজাতন্ত্রী সরকারের পতন ও স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটল ১৯৩৬-এ। জাপান এই নীতির দ্বারা চালিত হয়ে চিন-এ আঘাত হানতে শুরু করে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে।
প্রথম মহাযুদ্ধের কারণ ছিল ইউরোপীয় রাষ্ট্রশক্তিগুলির ক্ষমতা বিস্তার ও ক্ষমতা অধিগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে বৃহৎ শক্তি ছিল জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও রাশিয়া। যুদ্ধের দুটি শিবিরের একটিতে ছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং তুরস্ক। অপর শিবিরে ছিল ফ্রান্স, রাশিয়া, ব্রিটেন– ১৯১৭-তে যোগদান করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং জার্মানি প্রথম যুদ্ধ ঘোষণা করে।
যুদ্ধ শেষ হল ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলবার পর জার্মানির পরাজয়ে। ভার্সাই সন্ধি স্বাক্ষরিত হল ১৯১৯-এ। এই সন্ধির চুক্তিপত্রে যেভাবে বিজয়ী দেশগুলি জার্মানির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ-স্পৃহায় অপমানজনক ও দুঃসাধ্য সব শর্ত আরোপ করেছিল তা জার্মানি বাধ্য হয়ে মেনে নিলেও মনে মনে কখনো এই সন্ধিপত্র গ্রহণ করতে পারেনি। যুদ্ধে হৃতসর্বস্ব দেশটিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলে; চাপানো হয়েছিল বিপুল ব্যয়ভারের বোঝা। ভার্সাই-সন্ধির শর্তাবলি যে ‘অন্যায্য’ ছিল তা আজ সর্ব-স্বীকৃত। জার্মানি এই সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হয়েছিল গভীর অপমানবোধের সঙ্গে। এই অপমান ছিল সমগ্র জাতির।
কিন্তু ‘ফ্যাসিজম’-এর ধারণার সূত্রপাত হয় ইতালিতে। বেনিতো মুসোলিনি ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে পরিচিত ছিলেন সাংবাদিক ও সমাজতন্ত্রবাদী হিসেবে। তিনি ‘লা লত্তা দি ক্লাসসি’ (La Lotta di Classe) অর্থাৎ ‘শ্রেণি সংগ্রাম’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তবে তিনি যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন বলে সমাজতন্ত্রবাদীদের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে। মুসোলিনি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্যাসিস্ট দল গঠন করেন। ক্রমে ইতালির তৎকালীন রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইতালিতে পূর্ণ-একনায়কতন্ত্র প্রবর্তন করে। সমগ্র জাতীয় জীবনে কঠোর স্বৈরতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের মূল কথা। অবশ্য মুসোলিনির আর্থনীতিক সংস্কার সাময়িকভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। তার কারণ প্রথম মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরে বিশ্বের সর্বত্রই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতিতে এক অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সাধারণ নাগরিকেরা একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চাইছিলেন। প্রথম পর্বে ইতালিতে মুসোলিনি সেই ভরসা খানিকটা দিতে পেরেছিলেন।
একই কারণে জার্মানিতেও ফ্যাসিবাদের প্রবর্তন ঘটে। জার্মানিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশানাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কারস পার্টি গঠিত হয়। হিটলার এই পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ১৯২১-এ। এই দলের উদ্ভব হয়েছিল ভার্সাই সন্ধিপত্রের বিরুদ্ধে। এই দলই নাৎসি নামে পরিচিত। এই দলের নীতি ও কর্মধারাই নাৎসিবাদ, যার সঙ্গে ফ্যাসিবাদী নীতির প্রবল সাদৃশ্য আছে। উগ্র স্বাদেশিকতা এবং জাতিবৈরিতা এই নীতির বৈশিষ্ট্য। নাৎসিরা মনে করত আর্যরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি এবং তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল জার্মানরা। বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা তীব্র হয়ে ওঠে ১৯২৯-৩০-এ। দেশব্যাপী অভাব ও কর্মহীনতার সুযোগে নাৎসি দলের সমর্থকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। হিটলার এই দলের নেতা হিসেবে নির্বাচনে জয়লাভ করে ১৯৩৩-এ জার্মানির চ্যান্সেলার নিযুক্ত হন। ১৯৩৩-৩৪ থেকে জার্মানি ও ইতালিতে স্বৈরতন্ত্রী শাসনের অত্যাচার এবং অন্যান্য দেশের প্রতি আগ্রাসনের আয়োজন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
প্রথম দিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স খানিকটা তোষণ-নীতির পথে চলেছিল। রাষ্ট্রনীতির সার্বিক পরিস্থিতিটাই ছিল একান্ত স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট। হিটলার যখন ক্রমশই শক্তি বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট তখন ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স অন্যান্য আক্রান্ত ইউরোপীয় দেশকে সাহায্য করবার কোনও চেষ্টাই করেনি। হিটলারকে তুষ্ট করতেই নেতারা ছিলেন ব্যস্ত। এই ভাবনার মূলে ছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত সাধারণতন্ত্র। ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কাছে তখন জার্মানির তুলনায় সোভিয়েত সাধারণতন্ত্রই বেশি বিপজ্জনক বলে গণ্য হয়েছিল। অথচ সোভিয়েত দেশ, অন্তত সেই মুহূর্তে অন্য দেশ আক্রমণের কোনো চেষ্টাই করেনি। কিন্তু, যেহেতু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রনীতির চরিত্র সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে ছিল অচেনা, সেজন্য তারা নিজেদের বিপদগ্রস্ত মনে করেছিল এই ভেবে– ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদের কাঠামো হয়তো বা বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। যদিও ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ লয়েড জর্জ (১৮৬৩-১৯৪৫) আর উইনস্টন চার্চিল (১৮৭৪-১৯৬৫) জার্মানির পরিবর্তে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গেই চুক্তি করা উচিত মনে করেছিলেন কিন্তু ১৯৩৭-এ ব্রিটেন-এর প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেন (১৮৬৯-১৯৪০) সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে হিটলার-এর সঙ্গে চুক্তি করেন। মিউনিখ-এ ১৮৩৮-এর ২৯ সেপ্টেম্বর সম্পাদিত চুক্তিতে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালি-র নেতৃবর্গ হিটলার-এর দাবিকেই মেনে নিলেন। হিটলার চেকোস্লোভাকিয়া-র কিছু অংশ অধিগ্রহণ করেছিলেন এবং ঘোষণা করেছিলেন যে, ইউরোপ-এর আর কোনো অংশ তিনি দাবি করবেন না। যদিও অচিরেই তিনি প্রতিশ্রুতি ভেঙে পোল্যান্ড আক্রমণ করেন এবং ১৯৩৯-এর ১ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
অবশ্য এরমধ্যে আর একটি ঘটনা ছিল এই যে, নাৎসি জার্মানি এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৩৯-এর ২৪ অগাস্ট। এই চুক্তি বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্টদের বিস্মিত করেছিল এবং সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি তাদের আস্থা কিছুটা বিচলিত হয়। কিন্তু এই চুক্তির জন্য স্তালিনকে খুব বেশি দায়ী করা যায় না। দেশের নেতার প্রধান কাজ হল দেশকে রক্ষা করা। মিউনিখ চুক্তির সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে যেভাবে উপেক্ষা করা হয়েছিল তাতে স্তালিন-এর মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, কোনো অবস্থাতেই ব্রিটেন, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশ বিপদের সময় রাশিয়ার পাশে দাঁড়াবে না। এই অবিশ্বাস থেকেই স্তালিন-এর এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু হিটলার স্বভাব-সিদ্ধভাবে ১৯৪১-এর ২১ জুন চুক্তি অগ্রাহ্য করে রাশিয়া আক্রমণ করলে কমিউনিস্টদের চিন্তাধারা সম্পূর্ণভাবে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী হয়ে উঠল।
ফ্যাসিবাদের আগ্রাসী নীতি সমগ্র বিশ্বের শুভবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিদের বিচলিত করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই ১৯২১-এর অক্টোবর মাসে লন্ডন-এর একটি রেস্টুরেন্ট-এ ‘পেন ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্দেশ্য ছিল শিল্প-সাহিত্যের জগতে কোনো রকম আগ্রাসন বা নিষেধাজ্ঞা চলবে না। প্রত্যেককে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার দিতে হবে। ‘পেন’– এই শব্দটি তৈরি হয়েছিল ‘পোয়েট্স্, এসেয়িস্টস, নভেলিস্টস’– এই তিনটি শব্দের আদ্যক্ষর নিয়ে। পরে যুক্ত হয়েছিল ‘প্লেরাইট্স্’ এবং ‘এডিটরস’– এই দুটি শব্দ। বিশ্বে যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং চলেছে অত্যাচার– তার বিরুদ্ধে ‘পেন’-এর সদস্যরা প্রতিবাদ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘পেন’ ছিল খুবই সক্রিয়।
অনেকটা সেভাবেই ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল ভারতীয় লেখক শিল্পীদের প্রথম সংগঠন ‘প্রগতি লেখক সংঘ’। তারও আগে সংস্কৃতি ও সাম্যবাদের সংযোগ স্থাপনার যে পরিচয় আমরা বাংলায় পাই তার মধ্যে অতীব উল্লেখযোগ্য হল কিছু পত্র-পত্রিকা– যেগুলি বিশের দশক থেকেই এসে দাঁড়িয়েছিল নিপীড়িতের পাশে। ‘নবযুগ’(১৯২০), ‘সংহতি’(১৯২৩), ‘ধূমকেতু’(১৯২২), ‘লাঙল’(১৯২৫), ‘গণবাণী’(১৯২৬) ইত্যাদি সাময়িকপত্রে পরিকল্পিতভাবে এবং ‘বিজলী’(১৯২৪), ‘কল্লোল’(১৯২৩), ‘কালিকলম’(১৯২৬) ইত্যাদি পত্রিকায় পাঁচমিশেলি লেখার সঙ্গেই তুলে ধরা হয়েছিল সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের সংকট-সমস্যার কথা; তাদের প্রতি যে অন্যায় হয়ে চলেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছিল ধ্বনিত। তখনও অবশ্য ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে ভারতীয়দের কোনো স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি। তখনো হিটলার আসেননি ক্ষমতায়।
১৯৩৫-এর প্রধান ঘটনা হল ‘প্রগতি লেখক সংঘ’-এর প্রথম সম্মেলন। এই সংঘের পরিকল্পনা ও প্রাথমিক কাজকর্ম শুরু হয়েছিল লন্ডন-এ একদল শিক্ষিত ভারতীয় যুবকের আগ্রহে। প্যারিস-এর ফ্যাসিস্ট-বিরোধী সম্মেলনের পরই এ-সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা জাগে এবং লন্ডন-এর ডেনমার্ক স্ট্রিটের নানকিং নামের চিনে-রেস্তরাঁয় প্রস্তুত করা হয় একটি ম্যানিফেস্টো যার ভিত্তিতে গঠিত হল ‘Indian Progressive Writers Association’ বা ‘ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ’। এ-ঘটনা ১৯৩৫-এর নভেম্বর মাসে। তারপর এই সংঘের পাক্ষিক মিটিং অনুষ্ঠিত হতে থাকে লন্ডন-এ, ম্যানিফেস্টো-টি মুদ্রিত হয়ে (ডিসেম্বর) প্রচারিত হয় ভারতে এবং ভারতীয়রাও ক্রমে আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকেন। এই সংঘের সদস্য ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন রজনী পাম দত্ত, মুল্করাজ আনন্দ, সজজাদ জহির, ইকবাল সিং, ভবানী ভট্টাচার্য, রাজা রাও। কিছু কিছু বিদেশি লেখকও ছিলেন যেমন হার্বার্ট রিড, হ্যারল্ড ল্যাস্কি, ই এম ফর্স্টার প্রমুখ। প্রথম সভাটিতে অনুপস্থিত থাকলেও এ-সভার উৎসাহী সদস্য ছিলেন হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
এই ম্যানিফেস্টো-র ভিত্তিতেই ১৯৩৬-এর ১০ এপ্রিল লখনউ-এ জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন উপলক্ষে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’-এর সম্মেলন হয় প্রেমচন্দের সভাপতিত্বে। নতুন নামকরণ হয় ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’। এই সংঘের সকলেই সমাজতন্ত্রবাদী ছিলেন না তবে নিঃসন্দেহেই সমাজতন্ত্রবাদীর সংখ্যা ছিল বেশি, নিয়ন্ত্রণও ছিল অনেকটাই তাঁদের হাতে।
তারপর শুরু হল যুদ্ধ। ফ্যাসিবাদ বিরোধী কবিতার নিদর্শন দেখা দিতে লাগল বাংলা সাহিত্যে। প্রধানত চারের দশকের বাংলা কবিতাতেই ফ্যাসিবাদ বিরোধী স্বরায়ণ হয়ে উঠল তীব্র। এর মধ্যেও কিন্তু ছিল একটু জটিলতা। যেহেতু ১৯৩৯-এর সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪১-এর জুন-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে ছিল অনাক্রমণ চুক্তি, সেজন্য সরাসরি জার্মানির বিরুদ্ধে কমিনিউস্ট কবিরা কিছু বলতে পারতেন না। তাঁরা প্রধানত আক্রমণ শানিয়েছিলেন ফ্যাসিস্ট শক্তি জাপানের বিরুদ্ধে। তবে ১৯৪১-এর পর সরাসরি তাঁরা আঘাত করেছিলেন সমগ্র ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনকে।
চারের দশকের বাংলা কবিতায় অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। তার আগে অন্য একটি দিকের কথা একটু ভাবা যাতে পারে। বিশ্ব-সাহিত্যে ফ্যাসিজম-এর বিরোধিতা অনেকে করলেও ইতালি এবং নাৎসি জার্মানির পক্ষেও কোনো কোনো কবি ছিলেন। তাঁদের মধ্যে চার জনের নাম করা যায়। ইতালির ফিলিপ্পো মারিনেত্তি (১৯৭৬-১৯৪৪) বিশেষ ভাবে মুসোলিনির অনুগামী ছিলেন। জার্মানির গটফ্রিড বেন (১৮৮৬-১৯৫৬)। তিনি ছিলেন মার্কসবাদ বিরোধী, আমেরিকারও পক্ষে ছিলেন না। জার্মানিতে যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চলছিল তার প্রেক্ষিতে কিছু সময়ের জন্য নাৎসিদের তিনি সমর্থন করা উচিত বলে মনে করেছিলেন। অবশ্য পরে তাঁর মত পরিবর্তিত হয়। বিশিষ্ট আমেরিকান কবি এজরা পাউন্ড মুসোলিনি-কে কেবল সমর্থন করতেন না প্রকাশ্যে মুসোলিনি-র সঙ্গে কাজও করেছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর তাঁকে দশ বছরের বেশি কারারুদ্ধ থাকতে হয়। তিরিশের কালপর্বে বাংলার কবিদের কাছে প্রধান হয়ে ওঠা টি এস এলিয়টও একটা সময়ে ফ্যাসিস্টদের পক্ষে মন্তব্য করেছিলেন। এলিয়টকে কেন্দ্র করে বিষ্ণু দে এবং সমর সেনের সঙ্গে সাম্যবাদী বাঙালি কবি ও চিন্তকদের কারও কারও যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছিল। এই পাশ্চাত্য কবিরা কেন ফ্যাসিবাদ সমর্থন করেছিলেন তার ব্যাখ্যা সহজে করা যায় না। বিস্তৃততর আলোচনার অপেক্ষা রাখে এই পরিস্থিতি। এখানে আমরা বাংলা কবিতায় ফ্যাসিবাদ বিরুদ্ধতার দিকটি লক্ষ করব।
১৯৩৮-এর শেষে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’-এর দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। এই সম্মেলনের চেহারা ছিল সত্যিই ফ্যাসিস্ট-বিরোধী। কলকাতার প্রায় সমস্ত মার্কসবাদী এবং অ-মার্কসবাদী সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী একই ঐকান্তিকতায় এখানে মিলেছিলেন। বুদ্ধদেব বসু এই সময় থেকে শুরু করে কিছুদিন সাংগঠনিকভাবে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন মার্কসবাদীদের সঙ্গে। সেই সঙ্গে বলা যায়, ১৯৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে যখন ফ্যাসিবাদের উত্থান ক্রমেই বাড়ছে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ঠিক তখনই ভারতে তথা বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির ভিত হয়েছে শক্ত। সাম্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এই যুদ্ধকে দেখেছেন এমন কবিরা ক্রমে নতুন এক কবিতা-ধারার সৃষ্টি করেছেন। অরুণ মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও দিনেশ দাস থেকে এই ধারার সূত্রপাত ধরতে পারি আমরা।
আমরা আগেই বলেছি যে, চারের দশকের প্রথম কয়েক বছর জার্মানির চেয়ে জাপানই হয়ে উঠেছিল বাঙালি কবিদের আক্রমণের লক্ষ্য। সেই সঙ্গে আর একটি কথা বলে রাখা যায়, চারের দশকে মন্বন্তর-কেন্দ্রিক অনেক কবিতা লেখা হয়েছে কিন্তু সেগুলিকে আমরা ফ্যাসিবিরোধী কবিতার মধ্য ধরব না। এই মন্বন্তর ঘটেছিল ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ-নীতির ফলে। বৃহত্তর অর্থে তাকেও হয়তো ফ্যাসিবাদ-বিরোধী বলা যায় কিন্তু আমরা সরাসরি জার্মানি ও জাপানের ফ্যাসিবাদকে বাংলার কবিরা যেভাবে দেখেছেন সেই দিকটাই লক্ষ করব।
প্রথমেই কিছুটা গোষ্ঠী-বহির্ভূত কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথা বলা যায়। জাপান-বিরোধী একাধিক সরস কবিতা তিনি লিখেছিলেন। একটি দৃষ্টান্ত, কবিতার নাম ‘পিতাপুত্রসংবাদ’। পিতা, অধিকাংশ পরিণত-বয়স্ক বাঙালির মতোই, একই সঙ্গে স্বরাজপন্থী, আবার সুভাষ-ভক্ত। তিনি বলেন–
স্বরাজ স্বরাজ সবাই চ্যাঁচায় স্বরাজ কি ফলে গাছে! স্বরাজ রয়েছে আধ পয়সার আস্ত কাতলা মাছে! জাপানীরা যদি আসে পশুরাজ যাবে বসুরাজ হবে মুক্ত করবে দাসে।
তরুণ-বয়স্ক পুত্র ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ও রুশপন্থী। সে বলে–
স্বরাজ স্বরাজ যেজন চ্যাঁচায় সে জন জাপানী চর আমাদের বাণী রাশিয়ার মতো গেরিলা যুদ্ধ কর। জাপানীরা যদি আসে ল্যাজ তুলে তারা কাল পালাবেই লাল গেরিলার ত্রাসে।
ঢাকায় তরুণ কমিউনিস্ট কর্মী সোমেন চন্দ মিছিল চলাকালীন জাতীয়তাবাদী একদল হিংস্র ব্যক্তির হাতে নিহত হলে সারা দেশের লেখক-শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা গভীরভাবে বিচলিত হন। ‘প্রগতি লেখক সংঘ’-এর নাম বদলে রাখা হয় ‘ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’। নানা কাজের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিস্ট-বিরোধিতা আবার প্রবল হয়ে ওঠে। বুদ্ধদেব বসুর মতো রাজনীতি-বিরোধী লেখকও এ-ঘটনার বিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডে যোগ দেন। ‘দক্ষিণ কলকাতা ছাত্র ফেডারেশন’ ‘প্রাচীর’ নামে একটি প্রতিবাদী কবিতার সংকলন সোমেন চন্দের নামে উৎসর্গ করে। ঢাকায় ‘প্রতিরোধ’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত কমিউনিস্টদের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি অত্যন্ত সক্রিয় এবং সুপরিচালিত ছিল, ধীরে ধীরে জনসমর্থনও কিছুটা আদায় করে নিতে পেরেছিল ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬-এর মধ্যে। এই সময়ে বেশ কিছু পুস্তিকা ও কবিতা-সংকলন তাঁরা প্রকাশ করেন।
বিষ্ণু দে-র লেখা যোলো পৃষ্ঠার একটি ফ্যাসিবাদ-বিরোধী কবিতা-সংকলন প্রকাশিত হয় এখান থেকে– নাম ‘২২শে জুন, ১৯৪২’। যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও বৈনাশিকতার প্রসঙ্গই কবিতাগ্রন্থটির অবলম্বন– “জলে স্থলে যুদ্ধ চলে, ভারতেও ভিৎ টলে, প্রাণের নির্দেশে / কলকাতার পূর্ণিমাও জটায়ুর পাখা ঝাড়ে দূর দেশে দেশে।” (২২শে জুন, ১৯৪২)। এই সংকলনভুক্ত আর একটি কবিতায় কবি লিখেছেন–
বিমানে বিমানে ছিন্নভিন্ন স্বপ্নপালক ওড়ে...। গৃধ্রগৃহিণী ভিড় করে আসে অলকার মোড়ে মোড়ে। কেলিকদম্ব নির্মূল করে এ কোন্ পরশুরাম।
(‘আজকে এসেছি দুর্গশিখরে’, পূর্বোক্ত সংকলন)
কমিউনিস্ট পার্টির উৎসাহী ও সক্রিয় কর্মী; আর সেই সঙ্গেই উল্লেখযোগ্য কবিরূপে যাঁরা তখনই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথম নামটিই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। কবি-স্বভাবেই সমাজমুখী এবং সাম্যবাদে আস্থাশীল সুভাষ মুখোপাধ্যায় যুদ্ধ আর যুদ্ধের ফলে সংঘটিত মন্বন্তর– দুটি বিষয় সম্পর্কেই ছিলেন সচেতন। জার্মানি ও রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধ সম্পর্কে নিরপেক্ষতার নীতি পরিহার করে মিত্রপক্ষকে সমর্থনসূচক জনযুদ্ধনীতি সেই সময়ে নির্দ্বিধায় গৃহীত হয়েছিল তাঁদের কাছে। সেই নীতিকে খোলাখুলি কবিতায় রূপ দিয়েছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। জাপানের বিমান-হানাই কলকাতায় তথা বাংলায় যুদ্ধের নিকটতম অভিজ্ঞতা ছিল বলে জাপানের নামও বারবার এসেছে তাঁর কবিতায়–
বজ্রকণ্ঠে তোলো আওয়াজ রুখবো দস্যুদলকে আজ দেবে না জাপানী উড়োজাহাজ ভারতবর্ষে ছুঁড়ে স্বরাজ।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের আর একটি কবিতা–
এ যুদ্ধ দুনিয়ার দুটি দলে এ যুদ্ধ মুক্তি ও শৃঙ্খলে জনগণশক্তির জয় হলে আমাদের স্বদেশেরও নিশ্চিত স্বাধিকার। কমরেড ধরো আজ হাতিয়ার।
যে-যুদ্ধের কথা এখানে বলা হয়েছে সে যুদ্ধ, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথা মনে আসে একটি বিশেষ কারণে। তিনি ছিলেন স্বাধীন মতের মানুষ এবং আত্মসমালোচক। জাপান ছাড়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অপরাপর ফ্যাসিবিরোধী শক্তি, জার্মানি ও ইতালি-র নাম যখন বিস্ময়করভাবে বাঙালি সাম্যবাদীদের রচনায় প্রধানতই অনুল্লেখিত তখন হেমাঙ্গ বিশ্বাস কিন্তু তিন ফ্যাসিবাদী শক্তিকেই সমানভাবে বিদ্ধ করেছেন তাঁর গানে–
আমরা দিব না দিব না দিব না দস্যুকে পথ ছেড়ে দিব না। ঐ দস্যুর দল আসে হুঁশিয়ার মুসোলিনি তোজো আর হিটলার ধরো ধরো হাতিয়ার, ক্ষুরধার তলোয়ার–
(‘উজানগাঙ বাইয়া’)
যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষ একই ঘটনার দুটি দিক তা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানে সরল ভাষায় উচ্চারিত হয়েছে। তাই জাপানের বোমা আর ক্ষেতের ফসল লুঠ হয়ে যাওয়ার আর্ততা ধ্বনিত হয়েছে এই গানে–
ও চাষা ভাই– তোর সোনার ধানে বর্গী নামে দেখরে চাহিয়া। তোর লুঠে নেয় ফসল দেশ বিদেশি ধনিক, বণিক ফ্যাসি দস্যুদল। পঙ্গপালে দলে দলে ছাইলো দুনিয়া। জাপানের হাওয়াই জাহাজ আসমান হতে মোদের বুকে হানছে কলের বাজ।
(‘উজানগাঙ বাইয়া’)
এরকম অনেক গানই লিখেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। কিন্তু তাঁর আত্মসমালোচনাতেই আমরা এই যুদ্ধ ও মন্বন্তর-ভিত্তিক গান ও কবিতাগুলির অসম্পূর্ণতার দিকটি পরিষ্কার বুঝে নিতে পারি– “দেশে তখন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। ওদিকে বর্মা সীমান্তে জাপানী ফ্যাসিস্টরা আগতপ্রায়। আমাদের পার্টির তখনকার ‘জনযুদ্ধ’ লাইন তত্ত্বগতভাবে ঠিকই ছিল, কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের মারাত্মক ভুল থেকে গেলো। সশস্ত্র গণবাহিনী তৈরি করে নিজেদের স্বতন্ত্র শক্তি বজায় রেখে ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধপ্রয়াসে সহায়তা করার বদলে আমরা বৃটিশের যুদ্ধ প্রয়াসেরই লেজুড় হয়ে উঠলাম।… আমার-আমাদের সবারই-এই সময়কার রচনায় এই সবই প্রতিফলিত হয়েছে। দুর্ভিক্ষ নিয়ে লেখা গানে কবিতায় কেবল মজুতদারের কথা, কেবল উৎপাদন বাড়ানোর কথা, কিন্তু যে-ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এ-দুর্ভিক্ষ তৈরি করলো তার বিরুদ্ধে একটা কথাও নেই।” (‘উজানগাঙ বাইয়া’)। এইভাবে যুদ্ধের একটা দিক অনুল্লেখিত থেকে যেত এই রচনাগুলিতে।
চারের দশকের অন্যতম কবিকন্ঠ ছিল তরুণ সুকান্ত ভট্টাচার্যের। তাঁর অনেক কবিতাতেই যুদ্ধ প্রসঙ্গ আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে জার্মানি এবং জাপানকে শত্রুরূপে চিহ্নিত করতে কোনো দ্বিধা হয়নি কবির। আপাত লঘুভঙ্গিতে রচিত একটি ছোটো কবিতায় কবি লিখেছেন–
জাপানী গো জাপানী ভারতবর্ষে আসতে কি শেষ ধরে গেল হাঁপানী? জার্মানী গো জার্মানী তুমি ছিলে অজেয় বীর এ কথা আজ আর মানি?
(‘দেয়ালিকা’: পূর্বাভাস)
এইভাবে প্রধানত চারের দশকের, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন যে বাংলা কবিতার ধারায় ফ্যাসিবাদ বিরুদ্ধতার উল্লেখ পাওয়া যায়, সেখানে একটি কথা স্পষ্ট। কবিরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লিখেছেন অবশ্যই কিন্তু তাঁদের কবিতায় প্রধানত জাপান-এর নামই করা হয়েছে; তুলনায় জার্মানি বা ইতালি-র নাম করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদের সামগ্রিক নিষ্ঠুরতার আন্তর্জাতিক স্বরূপ তাঁদের কবিতায় সেভাবে দেখা দেয়নি। সেজন্যই ফ্যাসিবাদের তুলনায় মন্বন্তর-চিত্র বড়ো হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রকৃত ফ্যাসিবাদে যেভাবে হিটলার জার্মানি-তে ইহুদিদের প্রতি শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে অমানবিক আচরণ করেছিলেন, তা ভারতীয়রা চোখের সামনে দেখেননি। ইতালি-র আবিসিনিয়া আক্রমণও ঘটেনি তাঁদের সামনে। কিন্তু ১৯৪২-এ কলকাতায় জাপানি বোমা পড়েছিল– সেই অভিজ্ঞতা ছিল প্রত্যক্ষ। তা ছাড়াও ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে বলতে গেলেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ-শাসকের পক্ষে বলা হয়ে যায়– এই পরিস্থিতিগত জটিলতাও তাঁদের মনে কিছুটা ছাপ ফেলেছিল অবশ্যই। তা সত্ত্বেও বাংলা কবিতায় ফ্যাসিবাদের যে ছাপ পড়েছে, সেখানে প্রধান হয়েছে সামগ্রিকভাবে অত্যাচারের অভিজ্ঞতা।
নিবন্ধের শেষে যে দুই কবির কথা বলব, তাঁরা তিরিশের কালপর্বের কবি। তাঁদের কাছে ফ্যাসিবাদ কেবল কমিউনিস্ট-বিরোধী এবং সোভিয়েত সাধারণতন্ত্র-বিরোধী জার্মানি ও ইতালি-র আগ্রাসী আচরণই ছিল না। তাঁদের কাছে যে-কোনও দেশের মানবতাবাদ-বিরোধী নিষ্ঠুর-শক্তির আস্ফালনই ফ্যাসিবাদরূপে প্রতিভাত হয়েছিল। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘সংবর্ত’ সংকলনের কবিতাগুলিতে বারবার ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার বাণী উচ্চারিত হয়েছে তীব্রভাবে। যুদ্ধ শুরু হবার আগে থেকেই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে এসেছেন। ‘সংবর্ত’ নামের কবিতাটিতে আমরা দেখেছি তিনি জার্মানি, ইতালি আর আমেরিকা-ইংল্যান্ড-ফ্রান্স-এর মধ্যে যুদ্ধবাজ দেশ হিসেবে কোনো তফাত করেননি। আণবিক বোমা সম্পর্কে তাঁর বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। যুদ্ধ-বিরোধী এই কবি ‘১৯৪৫’ নামের কবিতায় যুদ্ধশেষের যে-পরিস্থিতির রূপরেখা এঁকেছেন তাকে বলতে পারি আন্তর্জাতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এক বাঙালি কবির প্রজ্ঞাদৃষ্টিতে উদ্ভাসিত ভবিষ্যৎ–
তুমি বলেছিলে জয় হবে, জয় হবে: নাট্সী পিশাচও অবিনশ্বর নয়। জার্মানি আজ ম্রিয়মাণ পরাভবে; পশ্চিমে নাকি আগত অরুণোদয়। অন্তত রুষবাহিনী বন্যাবেগে কবলিত করে শোষিত দেশের মাটি। বিভীষণদের উচ্ছেদে ওঠে জেগে স্বাধীন প্যারিস, যথারীতি পরিপাটী। এবারে সময়ে, শান্তিতে সহযোগী মার্কিন ঢালে সমানে শোণিত, টাকা। ধনিক যুগের প্রধান ভুক্তভোগী ইংলন্ডেই সমাজতন্ত্র পাকা।
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা থেকে এই উপলব্ধি ঘটে যে, ফ্যাসিজম কেবল জার্মানি-ইতালি-জাপান-এ সীমাবদ্ধ নয়। ফ্যাসিজম নয় কেবল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন একটি রাষ্ট্র-নীতি নয়। যে-কোনো রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে ফ্যাসিজম-এর কোনো পার্থক্য নেই।
জীবনানন্দ দাশ। ‘বিশ্বকবি’ অভিধা তাঁর প্রতি প্রযুক্ত না হলেও তিনিও বিশ্বের কবিই ছিলেন, কেবলই বাংলার কবি নন। বিশ্বযুদ্ধের বৈনাশিকতা তাঁর কবিমনকে মানবীয় সভ্যতার ধ্বংসের সার্বিক সত্যের দিক থেকে নাড়া দিয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঘটনাবলি ছিল এই সত্যের বৃহত্তম সমকালীন দৃষ্টান্ত। তাই তাঁর ক্ষোভ, কষ্ট, হতাশা– সবই প্রকাশ পেয়েছিল ঐ মহাযুদ্ধের ঘটনাবলির উল্লেখ-ভাষায়। উদাহরণ–
কুইলিং বানাল কি নিজ নাম হিটলার সাত কাণাকড়ি দিয়ে তাহা কিনে নিয়ে হয়ে গেল লাল।
(‘সৃষ্টির তীরে’, সাতটি তারার তিমির)
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে নরওয়ে-র শাসক কুইসলিং দেশদ্রোহী হয়ে হিটলার-এর পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর আরও একটি কবিতা–
সার্থবাহ, অই দিকে নীল, সমুদ্রের পরিবর্তে আটলান্টিক চার্টার নিখিল মরুভূমি
(‘সূর্য তামসী', সাতটি তারার তিমির)
‘আটলান্টিক চার্টার’-এ বলা হয়েছিল যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের জয় হলে উপনিবেশ দেশগুলিকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে। কিন্তু যুদ্ধের শেষে এই সনদ ভারতের পক্ষে প্রযুক্ত নয় বলে ঘোষণা করেন চার্চিল। এ-ছিল বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টান্ত। কবি লিখেছেন,
দিগন্তে কি ধর্মঘট? চিমনি... পাখির মতন অনায়াসে নীলিমায় ছড়ায়েছে। এখানে নদীর স্থির কাকচক্ষু জলে ঘুরুনো সিঁড়ির মতো আকাশ পর্যন্ত মেঘ সব উঠে গেছে অনুভব করে প্রকৃতির সাথে মিলিত হতেই, অমিলনের সূর্যরোলে জ্যোতির্ময় এলুমিনিয়ম অনুভব করে আমি দুই তিন চার পাঁচ ছয়টি এরোপ্লেন গুনে নীলিমা দেখার ছলে শতাব্দীর প্রেতাত্মাকে দেখেছি অরুণে।
(‘ভোর ও ছয়টি বমার: ১৯৪২’, অন্যান্য কবিতা)
জীবনানন্দের এই কবিতায় ফ্যাসিজম যেন কোনো স্বতন্ত্র রাষ্ট্রনীতি নয়। যেন মুসোলিনি আর হিটলার-এর আগ্রাসনে কোনো স্বতন্ত্র নাম নয়। ফ্যাসিবাদ হল বিশ্বব্যাপ্ত বৈনাশিক যুদ্ধের অভিধা। সেখানে আকাশের নীলে বোমারু এরোপ্লেন চিরকাল শান্তিকে বিনষ্ট করতে থাকবে। এ-ই হল চিরকালীন ফ্যাসিবাদ।