সুশান্ত পাল
Every Woman adores a Fascist
নারী মাত্রই ক্ষমতার সামনে নতজানু, স্বেচ্ছায় সমর্পিত প্রাণা; পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক লৈঙ্গিক বিধান একমাত্র কারণ নয়, যেন প্রকৃতি পুরুষকে দিয়েছে শক্তির মদমত্ততা, নারীকে করেছে তার উপাসক, দমন ও দমিতের অনিবার্য অপরিবর্তনীয় নিয়তি এক! ভোগী ও ভোগ্যার আত্ম (self) ও অপরের (other) সমীকরণে ক্ষমতার স্পর্ধায় বলকায় Sadist পুরুষাঙ্গ। রাখঢাক না-রেখে উচ্চারিত হয় আগ্রাসী লৈঙ্গিক অভিলাষ–
It appears beyond contradiction that Nature has given us the right to carry out our wishes upon all women indifferently; it appears equally that we have the right to force her to submit to our wishes… It is beyond question that the right to establish laws which will force woman to yield to the orders of him who desires her; violence itself being one of the results of this right, we can legally employ it. Has not Nature proved to us that we have this right, by allotting us the strength necessary to force them to our desires?
নারীশরীরের ওপর একচ্ছত্র স্বেচ্ছাচার, হিংস্রতার হয়ে সওয়াল করলেন ধনীর ঘরের দুলাল মার্কুইস দ্য সাদে। যেহেতু, প্রকৃতিগত সূত্রেই পুরুষ দেহটি শক্তিমান, সুতরাং দুর্বল নারীশরীর স্বভাবতই পুরুষবীর্যের প্রায়োগিক ক্ষেত্র। হিংস্রতা, ক্ষমতা, বিকৃতির প্রকৃতিলিখন মুছে ফেলা যায় না কখনও। ধর্ষকাম পুরুষের সহজাত এক প্রবণতা, আত্মসমর্পণে মর্ষকামী নারী পরিতৃপ্ত– সামাজিক লিঙ্গবিধির তথাকথিত অনুশাসন অনেকাংশে সমর্থিত হল মনোবিদদের প্রকল্পনায় (সাদের পরিকল্পনা থেকে ফ্রয়েড সাহেব গড়ে তুললেন Sadism-এর তাত্ত্বিক প্রস্থাপনা); সমাজজীববিজ্ঞানীরা মানুষিক জিনে সংস্থাপিত করলেন রিরংসার ব্যাকরণনামা।
বলতে আপত্তি থাকার কথা নয় ধর্ষমর্ষকাম-ই (sadomasochism) পিতৃতান্ত্রিক যৌন বৈকল্য, আধিপত্যের মূল ভিত্তি। একদিকে তার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্যের হুংকার, বিপরীতে ন্যূন, ঊন-মানবীর অব্যক্ত যন্ত্রণা, অবমানিতের দহন লজ্জা, অবলার হীনাঙ্গ অস্তিত্বের মর্মবেদনা। ধর্ষক পুরুষের চাবুক ঝলকায়, হস্তগত বন্দিনী নারীর গলদেশাবদ্ধ কলার চেইন, ঘোষিত হয় বিবিধ আদেশ; অন্যদিকে দৈন্য ক্লেশ পীড়ন সয়ে শুধুই আজ্ঞাপালনের বাধকতা। পৌরুষের জয়গানেই নারী জীবনের সার্থকতা– যৌনতার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিকে উদোম করেছেন Andrea Dworkin। ‘Our Blood’ গ্রন্থে নারী তথা নারীত্বের অবস্থান সম্পর্কে বলছেন–
A Woman’s erotic femininity is measured by the degree to which she needs to be hurt, needs to be possessed, needs to be abused, needs to submit, needs to be beaten, needs to be humiliated, needs to be degraded.
পাঠক শিউরে উঠছেন নিশ্চিত– নারী পুরুষের একান্ত ব্যক্তিগত পবিত্র সৃষ্টিমুখর সংগমে ধর্ষমর্ষকামী যৌনতার সামাজিকীকরণের আরোপে। পণ্য অথবা পর্নোগ্রাফিতে নারীশরীরকে উপাদেয় বস্তু ছাড়া আর কী রূপেই বা দেখানো হয়। যৌনাঙ্গের কদাকার প্রদর্শন ছাড়া (সে ‘হার্ড’ অথবা ‘সফ্ট’ যে-রকম পণ্যগ্রাফি অথবা পর্নোগ্রাফি হোক-না-কেন!) নারীর মনন নির্মূল করা হয় পুরুষতান্ত্রিক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। গুটিয়ে যেতে যেতে সে সত্তাবিহীন যোনি, গুহ্যদ্বার, স্তনের প্রদর্শনীয় দ্রব্যে পরিণত হয়। সেলুলয়েড, টিভির পর্দা জুড়ে বোবা কান্না ও শূন্যতা, প্রতিরোধের সমস্ত চিহ্ন উধাও করে শীৎকার ছড়ায়। আমরা গোপনে ব্লু-ফিল্ম দেখি, ধর্ষকামী দিবাস্বপ্নের মর্দানিতে বুকের ছাতি বাড়াই। নারী হয়ে ওঠে শরীরী অস্তিত্বসর্বস্ব, দেহ ভিন্ন কুসুম-কে জানতে (মানিক বাবুর শশীর কথা মনে আসছে) অপারগ হই। স্যাডিস্ট ফ্যাসিস্ট পুরুষরা পর্নোগ্রাফির আউশভিৎশ ক্যাম্প থেকে আমাদের দৈনন্দিনে অনুপ্রবেশ করে। না-মানবী তখন নিশ্চিহ্নতার প্রতীক্ষায়।
Pornography is the graphic sexually explicit subordination of women, whether in pictures or in words…
‘Head fucking’ ইন্ডাস্ট্রি পর্নোগ্রাফি, সেক্স ম্যাগাজিন (Playboy, Rustler), আমাদের বঙ্গীয় বটতলার নিষিদ্ধ বই (পর্নো অপভ্রংশে ‘পানু’ নামে যার বিস্তার) মূলত পুরুষের নিমিত্ত পুরুষ দ্বারা নির্মিত, পরিচালিত, রচিত। এরা যে নারীর পক্ষ থেকে সমস্ত বিরোধিতাকে নির্মূল করে দিতে চায়, তাকে মনুষ্যেতরের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে চায় তা যে কোনও সেক্স ম্যাগাজিনের প্রকাশ্য প্রচ্ছদে প্রতীয়মান– পোষ্য সারমেয়র পর্যায়ভুক্ত হয়ে অবাধ্যতা দমনের বকলস পরে কুটিলচপলকামার্ত উছলে ঝলকে হাজির সেক্স কামিনী। সুতরাং, পর্নোগ্রাফিতে নারীর অমানবিকীকরণ সম্পূর্ণ হয়, সে এখানে কাম্যবস্তুতে পতিতা। পাশবিক স্তরে নামিয়ে এনে ধর্ষণে রক্তপাতে সে তৃপ্ত, মর্ষকাম আনন্দেই তার যৌনসম্ভোগের সার্থকতা– ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য লোপাট করে নীলছবিতে পশ্বাচারী ইতরতায় নারী পরিবেশন চলতে থাকে।
চিত্রপরিচালক Bonnie Sherr Klein ধর্ষকামী কর্তৃত্ববাদী পুরুষতন্ত্রের লিঙ্গ আধিপত্যের মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক ও আর্থিক দিকের বাস্তবতা উদ্ঘাটন করতে চেয়েছেন তাঁর ‘Not a Love Story: A Film About Pornography’ তথ্যচিত্রে। পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রি ১৯৮১ সালেই ৫ বিলিয়ন ডলার ব্যবসা করেছে প্রতিবছর। আর্থিক আনুকূল্য যে এখন শত-শত ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, নিশ্চিত সেই সম্ভাবনা। এই অর্থাগমের মূল্য চোকাতে হয়েছে যে শত সহস্র নারীশরীরকে, ধ্বস্ত হয়েছে তাদের মন; কেন সমাজের মধ্যেই পর্নোগ্রাফির চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে— পরিচালক খুঁজে পেতে চেয়েছেন সম্ভাব্য কারণ ও উত্তর। প্রকাশ্য যৌনসংসর্গের প্রদর্শনীশালা থেকে পর্নোগ্রাফি ফিল্মের স্টুডিয়ো হয়ে তিনি পৌঁছে গিয়েছেন মনশ্চিকিৎসকের চেম্বার থেকে সমাজতাত্ত্বিকের ড্রয়িং রুমে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তাড়া করে ফিরেছে। প্রবৃত্তির তাড়নাতে, না সামাজিক লৈঙ্গিক আগ্রাসনের বিধিবদ্ধতায় এক সপ্তাহে পর্নো ফিল্মের ব্যবসা ছাড়ায় প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার! স্বভাবের না প্রচলের অমোঘতায়, ভালোবাসাহীন দ্বেষময় যৌনোদ্দীপনায় কামার্ত হয়ে ওঠে উপভোক্তা পুরুষ। পাশবিক পীড়নের আদলে মেয়েদের মর্দন, দমন, ধর্ষণের উপভোগ কী ক্রেতা পুরুষের ব্যক্তিব্যাধি না ক্ষমতার অন্যতম অসুখ। এভাবেই তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের রাগ, ক্রোধের অনুভূতিগুলো বিবশ হয়ে যায়। বাস্তবে যখন ধর্ষণ সংগঠিত হয়, তখন তাই সামাজিকের মুখ থেকে নির্দ্বিধায় উচ্চারিত হয়– রেপ-টেপ তো কতই হয়, এসব সমাজ থেকে হারিয়ে যাওয়ার নয়! মেয়েটির চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তার হয়তো পরোক্ষ সম্মতি পুরুষাঙ্গকে উত্তেজিত করেছে, বাধ্য করেছে। মেয়েদের যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে তখন লোহার রড পর্যন্ত ঢুকিয়ে দেওয়া যায় অবলীলায়। অথচ, আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধে নারী অ-সুরবিনাশিনী সংস্থিতা! পরিচালকের মুখোমুখি লেখক Susan Griffin যথার্থই বলেন– ‘Pornography project women silence in the screen… Power of women body destroyed which is opposite from Religion.’
ফ্যাসিজমের ঘৃণার, হিংস্রতার উদগ্র মানসিকতার সঙ্গে কী পর্নোফিল্মের নৃশংস যৌনবিকারের কোনও মিলন বিন্দু আছে? সমাজতাত্ত্বিক Robin Morgan আমাদের দাঁড় করান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ার্ত সন্ধিক্ষণে। মিড-ক্লোজআপের স্থির নিশ্চল ক্যামেরা শুনে নেয় ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতির ধর্ষকাম বিস্তারের পরিকল্পনা। নাৎসি অধিকৃত পোল্যান্ডে পরিকল্পিতভাবে পর্নোগ্রাফি বিস্তারের উদ্যোগ গৃহীত হয়। মূলে ছিল নারীশরীরে সংগঠিত হিংস্রতা প্রদর্শনের মাধ্যমে ইহুদিদের ওপর ঘটে চলা নৃশংসতার প্রতিক্রিয়ায় বিবেক জাগরণের যে-কোনও সম্ভাবনার মূলোৎপাটন করা। ইহুদি ও নারী দুজনেই অ-মানুষ, কীট, তাদের ওপর যথেচ্ছাচার চলার বৈধতা অর্জন করা হয় মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, সমাজ থেকে, তার প্রজাতি সত্তা, তার প্রতিবেশী থেকে। ইন্দ্রিয়সর্বস্ব কামুক মানুষ মনুষ্যত্বের সমস্ত বোধ হারিয়ে ফেলে, তারা আর এক হতে পারে না। আর্য নারী তখন সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত হয়। এদিকে যে যত বেশি সুস্থ সবল নাৎসি, ফ্যাসিস্ট সন্তানের জন্ম দিতে পারে রাষ্ট্রের বিবেচনায় সেই পুরুষ-ই যথার্থ আর্য-বলবত্তার অধিকারী।
বন্ধু হিটলার এসেছেন ইতালি ভ্রমণে। সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন সুহৃদ মুসোলিনি। জনতা উদ্বেলিত, উত্তেজিত। এক ফ্রেমে দুই একনায়কের করমর্দনে, প্রফুল্লতায়, অমিত বলদৃপ্ত বাগাড়ম্বরে, কুচকাওয়াজে রণবাদ্যে অস্ত্রের ঝনঝনায় পেশিশক্তির সে এক উত্তুঙ্গ আস্ফালন। ইতালীয় চলচ্চিত্রকার Ettore Scola ১৯৩৮-এর রোম শহরের এক গণউন্মাদনের প্রেক্ষিতে তৈরি করলেন ‘A Special Day’ (1977)। ফ্যাসিস্ট শাসকদের কেন্দ্র করে জনতার এই গণহিস্টেরিয়া আরও বেশি করে নিঃসঙ্গ একা করে তোলে বেতার সাংবাদিক গ্রাব্রিয়েলকে। শাসকের ‘হ্যাঁ’-তে ‘হ্যাঁ’ মেলাতে পারে না বলে ফ্যাসিস্ট বাহিনীর সতর্ক নজরদারিতে তার অস্তিত্ব ঝুলে থাকে। উপরন্তু, শক্তি প্রকাশ যেখানে পৌরুষের একমাত্র চিহ্ন, সেখানে গ্রাব্রিয়েল খুঁজে চলেছে মানুষ তথা সমাজ-সভ্যতার অন্তর্নিহিত নির্যাস। ফ্যাসিবাদে নরম-সরম কোমল পুরুষ অচল। এখানে– ‘A Man must be a husband a father and a soldier… Muscle is count here when you are man.’ ছয় সন্তানের জননী আন্তোনিয়েতা-ও জনতার জমক উল্লাসে অংশীদার হতে পারে না। ফ্যাসিস্ট স্বামীর ঔরসে সপ্তম সন্তান জন্মদানের গর্ভপ্রস্তুতি সারে সে। যে স্বামীর সঙ্গে তার ন্যূনতম মানবিক অনুভূতিটুকু নেই, করুণা নেই, কথা হারিয়েছে, হাসি বিলীন শৈশবে; এখন শুধুই আদেশ পালন আর পিতৃভূমির প্রতি, স্বামীর প্রতি অনড় বিশ্বস্ত ভূমিকা পালন। স্যাডিস্ট, ফ্যাসিস্ট একনায়করা প্রশ্নহীন আনুগত্য-ই চায়। নারী তাদের বিবেচনায় ধী-শক্তিরহিত, বোধহীন মাংসপিণ্ডের শামিল। পর্নোফিল্মের লিঙ্গপতি পুরুষের ভায়োলেন্সের উদ্গার আমরা দেখতে শুনতে পাই Alexander Sokurov পরিচালিত Moloch (1999) সিনেমার এক নাটকীয় মুহূর্তে। ব্যাভারিয়ান আল্পস পর্বতমালার ধ্যানগম্ভীর অনুপম সৌন্দর্যে অবসর যাপন করছেন অ্যাডলফ্ হিটলার। কয়েকমাস পরেই জার্মান সেনা আক্রমণ শানাবে স্তালিনগ্রাদে। নিরিবিলি প্রকৃতির শান্ত-স্নিগ্ধ আবহে সাময়িক বিরতি যাপনেও হিটলার তার নারীবিদ্বেষকে আড়াল করতে পারেন না। জোসেফ গোয়েবেলস্কে পাশে বসিয়ে ব্যক্তিগত সচিব মার্টিন বরমানের প্রতি তাঁর নিঃসংশয় উক্তি–
Require comprehension from a woman? Neither the Nation, nor the Party, nor its leaders expect that of a woman. Comprehension is strictly a masculine faculty. The more stupid a woman is, the more expressive she is. It’s not by chance that the wives of great men were all idiots. Mozart’s wife, for example. A stupid cow.
আমৃত্যু সঙ্গিনী ইভা ব্রাউনের সামনে করা হিটলারের এই সিনেম্যাটিক সংলাপ প্রকৃতপক্ষে নারী সম্পর্কে ফ্যাসিস্ট মূল্যায়ন বিবৃত করে। আত্মসমর্পণের চেতনাকে সমাজ-জীববিজ্ঞানী, ফ্রয়েড সাহেব কি মর্ষকামিতা রূপে সংজ্ঞায়িত করবেন?
পাঠক ভাবতেই পারেন কাহিনিচিত্রের মধ্যে যেহেতু চিত্রপরিচালকের অবিসংবাদিত কর্তৃত্ব থাকে তাই হিটলারের সংলাপের মধ্যে সোকুরভের নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ প্রসূত হস্তক্ষেপ আছে, অর্থাৎ যাকে আমরা বলি পলিটিকাল কারেক্টনেস। ফ্যাসিস্ট নায়কের বিরুদ্ধে সিনেমা বানানো তাঁর লক্ষ্য। বিশেষত, এখন যখন নব্য নাৎসিবাদীরা হলোকাস্ট-কে বেমালুম কমিউনিস্ট প্রপাগ্যান্ডা রূপে নস্যাৎ করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তখন হিটলারের স্বহস্তে রচিত Mein Kampf (1925-27) গ্রন্থে মেয়েদের সম্পর্কে কী মূল্যায়ন করা হয়েছে পড়ে দেখা যেতে পারে। হিটলার বলছেন, “…Like the woman, whose psychic state is determined less by grounds of abstract reason than by an indefinable emotional longing for force which will complement her nature, and who, consequently, would rather bow to a strong man than dominate a weakling, likewise the masses love a commander more than a petitioner….।”
আসলে হিটলার মনে করতেন নারী ও পুরুষের সম্পর্ক ধর্ষমর্ষকামিতার। Sadist পুরুষের বিপরীতে Masochist মানসিকতার পতিপ্রাণা, পৌরুষভঞ্জক নারীর সহাবস্থান প্রাকৃতিক বিধান। পিতৃপুরুষের (Fatherland) দেশ জার্মানিতে তাই নারী ফুরিয়ে যাওয়ার অনিঃশেষ প্রতীক্ষায় দিন যাপন করে। সম্বল বলতে তার মৃত্যুর প্রতীক্ষা অথবা প্রিয়তম মানুষটি, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় যে জার্মান শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় প্যারিস পোল্যান্ড রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে বর্বরতার বোরে হয়েছে– তার ফেরা-না-ফেরার দোলাচলতা। ঘৃণার বেসাতি পারিবারিক সম্পর্ক মায়াশূন্য করে দেয়, পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক মানবীয় সম্পর্ক দোমড়ানো মোচরানো এক বিষাদশিকড়ে সমাজমানসে পরিব্যাপ্ত হয়। চিত্রপরিচালক রসেলিনি দেখেন, যুদ্ধপরবর্তী জার্মানে বারো বছরের এডমুন্ড চরম দারিদ্র্যের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পায় শয্যাশায়ী পিতাকে হত্যা করে, স্বয়ং আত্মহত্যার মাধ্যমে। শিশু আন্নার মা লেনি তার রণাঙ্গন ফেরত স্বামী হান্সের কাছে আকুল আকুতি জানায়— ‘I need love…I am perishing…’। ফ্যাসিবাদী ক্লীব সময়ে আত্মাহুতির আততি শোনা যায় স্বামী-স্ত্রী দুতরফেই– I don’t want to live anymore…। ঘৃণা বিদ্বেষ যুদ্ধে তাদের ভালোবাসা শুকিয়ে পাথর হয়েছে।
‘Germany, Year Zero’ (1948) ও ‘Germany, Pale Mother’ (1980) সিনেমা দুটি মানবিক সুচেতনা, নিভৃত পরিসর, বহুতার বাসভূমি তথা মানুষী জিজীবিষার প্রতিপক্ষে দাঁড় করিয়েছে চলমান শয়তান মেফিস্টোফিলিসকে। মানুষের মন, মানবসমাজের অন্তঃকরণে বিসরিত অন্ধকার! দারিদ্র্য ক্ষয় পতনের এক অনন্তর ফ্যাসিস্ট পরিচ্ছেদ!
প্রকৃতপক্ষে শৈশব থেকেই কি ক্ষমতার কাছে আমাদের মাথা নত করতে শেখানো হয়? বশ্যতার সংস্কৃতিতে আমরা প্রভু বন্দনার মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দিই আমাদের আত্মবিশ্বাস, কর্তৃত্বের কাছে মান্যতায় নিজেদের গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলি। কখনও কখনও উৎপীড়ক ঊর্ধ্বতনকে উপাসনা করি, সেই আজন্ম ভয় আমাদের চালক! মেরুদণ্ডহীনতার জীবন সহনীয় হয়ে ওঠে, কেননা আত্মঘৃণার বিবেক বন্ধক রাখা পিতৃতন্ত্রের জিম্মায়। ফলে, ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের সম্পর্কের উচ্চাবচ মাত্রা। কর্তৃত্ব আর অপরের জায়গা থেকেই তো নির্মিত হয় অভিভাবক-শিশু, মালিক-কর্মচারী, নারী-পুরুষ, রাষ্ট্রনায়ক-প্রজা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বাবু-বেশ্যার অবস্থান। সর্বত্রই হায়ারার্কির দুশ্ছেদ্য ফাঁদ! অবনত মানুষের অবস্থা দুঃসহ– ‘Dominance diminishes the power and the self of another; submission to dominance is self-diminishing.’ কর্তৃত্ববাদী মনস্তত্ত্বের সামাজিক অধিক্ষেত্রেই কী ফ্যাসিবাদের বীজ উপ্ত থাকে?
শাসকের দাপটের অস্ত্র, ক্ষমতার উৎস যে বন্দুক, পুরুষলিঙ্গের মাত্রান্তর ব্যতীত কোন সমূর্ততায় অথবা প্রতীকায়নে আমরা তাকে অস্বীকার করব! বিরোধিতার সব বীজ উপড়ে ফেলো; প্রত্যাঘাতের অণুমাত্রিক প্রাগ্ভাষ। চলুন ঝাড়খানীর জঙ্গলে। ক্ষমতার পাশা খেলায় পৌরাণিক বাজি দোপ্দি মেঝেনের কালোকিষ্টি গতর। মহাভারতের সভাপর্বের পাঞ্চালির বস্ত্রহরণের কাকতালে পাঠক বেপথু হবেন না। সেনা ক্যাম্পের অধিনায়কের নির্দেশে শুরু হয় অ্যাপ্রিহেন্ডেড প্রতিপক্ষ দোপ্দি মেঝেনকে সবক শেখাতে ‘বানানোর পালা’। মর্দানির নানা পালা সাঙ্গ হলে ‘নড়তে গিয়ে ও বোঝে এখনও ওর দু হাত দু খুঁটোয় এবং দু পা দু খুঁটোয় বাঁধা। পাছা ও কোমরের নীচে চটচটে কী যেন। ওরই রক্ত। শুধু মুখের ভেতর কাপড় নেই। …স্তন দুটি কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত, বৃন্ত ছিন্নভিন্ন। কত জন? চার-পাঁচ-ছয়-সাত– তারপর দোপ্দির হুঁশ ছিল না। …একটি বাধ্য হয়ে পা ফাঁক করে চিতিয়ে থাকা নিশ্চল দেহ। তার ওপর সক্রিয় মাংসের পিস্টন ওঠে ও নামে, ওঠে ও নামে।’ উলঙ্গ দোপ্দি মেঝেন তার উদলা দেহকেই উঠে দাঁড়ানোর অস্ত্র করে তোলে। ল্যাংটো আদিবাসী নারী থুতু ছেটায় ক্ষমতার উর্দিতে। এবার সে শাসককেই কাউন্টার করে। সম্বল তার আদিম, একান্ত নিজস্ব দেহ। ‘দ্রৌপদী দুই মর্দিত স্তনে সেনানায়ককে ঠেলতে থাকে এবং এই প্রথম সেনানায়ক নিরস্ত্র টার্গেটের সামনে দাঁড়াতে ভয় পান, ভীষণ ভয়। ধর্ষক-শাসকের সে এক সাময়িক পশ্চাদ্গমন!
ফ্যাসিস্টের মতো কাজকর্ম করাটা মনুষ্যধর্ম। দিনে কতবার আমরা ফ্যাসিস্টের মতো আচরণ করি— আর তার তীব্রতাই বা কতটা— এটাই দেখার বিষয়। অ্যাটাকগুলো কত ঘনঘন হচ্ছে আর সেগুলোর তীব্রতা কীরকম এগুলোর ওপরেই আমাদের নজর রাখতে হবে, ঠিক যেমন একজন অন্তঃসত্ত্বা খেয়াল রাখে তার ব্যথা কতটা ঘনঘন আর কতটা জোরে উঠছে।
(রুই জিঙ্ক, ‘ভালো ফ্যাসিস্ট হওয়ার সহজ উপায়’)
ফ্যাসিবাদের শ্রেণি চরিত্র বিচার করেছেন জর্জি ডিমিট্রভ— ‘জোগানদার পুঁজির (ফিনান্স ক্যাপিটাল) তরফের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী এবং সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী অংশের সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব’ হল ফ্যাসিবাদ। তবে বোধহয় ফ্যাসিজমকে শুধুমাত্র আর্থ-রাজনীতিক প্রেক্ষিতে বুঝতে চাইলে এই মতাদর্শ গঠন ও বিস্তারে সাংস্কৃতিক-মনস্তাত্ত্বিক দিকের ভূমিকা উপেক্ষিত রয়ে যাবে। চূড়ান্ত অর্থনৈতিক অরাজকতা ফ্যাসিবাদের সূতিকাগার, এই সত্য জেনেও প্রশ্ন থেকে যায় ফ্যাসিবাদ টিকে থাকে কী করে, তার ডালপালা ছড়ায় তো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার সম্মতিতেই? কোন্ সেই মনস্তাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক অভিঘাত ও প্রকল্প যা সাধারণ জনতাকে একক চেতনায় সংগঠিত করে? ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংস্রতাকে বৈধতা দেয়? নিকেশ অভিযানের এই মতাদর্শে স্বর্ণালী অতীতের পুননির্মাণ করে, বর্তমানে ‘অপর’ রূপে চিহ্নিত শত্রুকে খতম করে উজ্জ্বল আগামীর স্বপ্ন দেখানো হয়। সংকট পরিত্রাণে অনিবার্য হয়ে পড়ে লৌহমানব একনায়ক ফ্যুয়েরার আগমন। কোন প্রণোদনায়, কেন, কীভাবে ফ্যাসিস্ট শাসকের নির্দেশে জনতা গণহিস্টিরিয়ায় আবিষ্ট হয়ে ‘অপর’ সবাইকে গণহত্যায় নিঃশেষ করে দিতে চায়? ফ্যাসিবাদের গণমনস্তত্ত্ব জানা তাই প্রয়োজনীয়– সাংস্কৃতিক এই প্রকল্পের মূলে কোন প্রাণশক্তি নিহিত?
সমাজতাত্ত্বিক এরিক ফ্রম লিখেছেন ‘Escape from Freedom’। তিনি মুক্তি তথা স্বাধীনতা থেকে পলায়ন পরায়ণ প্রবণতা মানুষের মানসিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেছেন। তাঁর মতে, ব্যক্তি মানুষের মধ্যে রয়েছে দ্বি-বিধ সত্তা। একদিকে মুক্তির অপার তৃষ্ণা, অন্যদিকে স্বাধীনতা থেকে পশ্চাদ্পসারণ। ব্যক্তির এ এক উভয়সংকট যেন। বেঁধে বেঁধে থাকায় তার সুখ নেই, সে একক পরিচিতি পাওয়ায় আকুল। আবার নির্জনতায় সে ভয় পায়, নিঃসঙ্গতা তাকে পীড়িত করে। শিকড় লগ্নতার বিপরীতে উত্তরণ, সম্পর্কিত হওয়ার বিপরীতে আত্মতার খোঁজের টানাপোড়েনে বিদ্ধ মানুষের কাছে তখন থাকে তিনটি পথের সন্ধান। ফ্রম বলছেন গ্রাহী চরিত্রের (receptive character) সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা শক্তিশালী প্রভুর প্রতি আত্মসমর্পিত হয়ে নিশ্চিতি লাভ করে। দায়মুক্ত নিরাপদ জীবন তাদের কাম্য। পরনির্ভরশীলতা জীবনের প্রতিটি পদে প্রকট হয়ে ওঠে। ক্ষমতার ক্রীড়নক এরা। আধিপত্যকামী চরিত্রকে ফ্রম বলছেন শোষণকারী চরিত্র (exploitative character)। অন্যের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে স্বীয় স্বার্থের অনুকূলে কাজে লাগানো এদের চারিত্রিক প্রবণতা। অনেক সামাজিক জনতা আবার মৃত্যু, শব, ধ্বংস, নাশকতায় আকর্ষণ বোধ করে। এদের ফ্রম বলছেন শব-প্রেমী চরিত্র (necrophilous character)। তবে সব পথ নেতি-তে শেষ হয় না, ইতি-র পথও আছে। পারস্পরিক সহানুভূতি সৌহার্দ্য ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে সৃজনশীল সম্পর্ক স্থাপনের বীজও মানুষের চরিত্রে সন্নিবেশিত আছে। কোনও প্রবণতাই absolute নয় বলেই মনে হয়। মানুষের চরিত্র শুধুই একমাত্রাগত হতে পারে না, সে প্রতিদিনই হয়ে ওঠে। আর এখানেই সমাজ-সংস্কৃতির গুরুত্ব। সামাজিক রীতি নীতি আচার আচরণ সব কিছুর সমবায় যে সংস্কৃতি, তা-ই মানুষের চরিত্র গঠনে বড়ো ভূমিকা রাখে। একই সমাজের অন্তর্গত বিভিন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে অবশ্যই সামাজিক চরিত্রের (social character) সাধারণ বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকে। আদিবাসী সমাজের মাতৃতান্ত্রিক সমাজচরিত্র জার্মান সমাজের পিতৃতান্ত্রিক সমাজচরিত্র থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সুনিপুণ চতুরতায়, গভীর ষড়যন্ত্রে ফ্যাসিবাদী প্ররোচনা, প্রপাগ্যান্ডা ব্যক্তি চরিত্র ও সমাজ চরিত্রকে নিজের আনুকূল্যে ব্যবহার করে গড়ে তোলে ফ্যাসিবাদী গণমনস্তত্ত্ব।
একাত্মভবন (identification) ও অন্তঃক্ষেপণের (introjection) এই পারস্পরিকতাকে ফ্যাসিবাদী গণমনস্তত্ত্বে দেখার মাধ্যমে আমরা কি বলতে পারি যে, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ফ্যাসিবাদ-ও এক ধরণের ধর্ষমর্ষকামিতা; আধিপত্য ও সমর্পণের দ্ব্যণুক বিস্তার? কেননা, আমরা দেখেছি ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে জনগণ কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতার দেখানো পথেই চলে। আগ্রাসন, আগ্রাসকের সঙ্গে এক ধরণের আত্তিকরণ ঘটে যেন। অনেকেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে অপরকে দখল করতে, সমুচিত জবাব দিতে চায়, তারাই ফ্যাসিস্ট শাসক, ঝটিকাবাহিনীর মধ্যে নিজেদের আত্মরূপ দেখে। তারাই হিংসা, দমনকে স্থায়িত্ব দিতে চায়। শাসকের প্রতি বশ্যতা তো নিরাপত্তার চাহিদাবোধ থেকেই জন্ম নেয়। এই প্রক্রিয়ায় অনুগত জনতা ফ্যাসিস্ট শাসকের কর্তৃত্বকে বৈধতা প্রদান করে। জনতা নিজেও একসময় নিষ্ক্রিয় মর্ষকামী (masochist) থেকে ধর্ষকামী (sadist) হয়ে ওঠে। ঘৃণা-হিংসা-নিপীড়নের আদর্শ উসকে দেয় অবদমিত নাশকতার চেতনা। ব্ল্যাক শার্ট, ব্রাউন শার্ট, আধুনিক ভাড়াটে ট্রোল বাহিনী ও জনতা তখন একাকার হয়ে শ্বাপদ নখর-দন্ত বিস্তার করে– ‘গুপ্ত গুহা থেকে বেরিয়ে আসে পশুরা’…।
আধিপত্য + প্রভুত্ব = রাষ্ট্র
পুরসমাজ + রাজনৈতিক সমাজ = রাষ্ট্র
সম্মতি + পশুশক্তি = রাষ্ট্র
ইতালির জনগণ ফ্যাসিবাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল কীভাবে, কমিউনিস্ট কর্মী তথা তাত্ত্বিক গ্রামশি এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। অবশ্যই এক্ষেত্রে তাঁর প্রধান অবলম্বন মার্কসীয় দর্শন, লেনিনের কর্মপদ্ধতি ও চিন্তাবলি। মার্কসবাদের দর্শনকে তিনি সম্প্রসারণ করলেন আধিপত্য সংক্রান্ত মতবাদের অবতারণায়। ধ্রুপদী মার্কসবাদে যেখানে আর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদের প্রেক্ষাপটে সবকিছুকে মূল্যায়িত করা হয়, উপরিকাঠামো সেই ভিত্তি-র মানদণ্ডে নির্ধারিত বলে স্বীকৃত চর্চা– গ্রামশি সেখানে মানবীয় চেতনাকেও গুরুত্ব দিতে চাইলেন। তিনি বললেন, রাষ্ট্র শুধুমাত্র দমন, বলপ্রয়োগ, পীড়নের মাধ্যমে তার ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। মুসোলিনি, হিটলার শুধুমাত্র পশুশক্তি প্রয়োগ করে ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ কায়েম করলেন, আর জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেন– এতটা সহজ সূত্রে ফ্যাসিবাদের রাষ্ট্রীয় চরিত্রকে বিচার করা যায় না। এখানেই আলোচনাতে চলে এল আধিপত্য (হেজিমনি) সংক্রান্ত গ্রামশীয় ধারণা। তাঁর মতে, রাষ্ট্র নিপীড়ন, বল প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের থেকে ধনতান্ত্রিক শাসকের প্রতি সম্মতিও অর্জন করিয়ে নেয় তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সিভিল সোসাইটির দ্বারা। ধর্মীয় সংঘ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন রাষ্ট্রের মতাদর্শকে সূক্ষ্মভাবে সমগ্র জনতার মতাদর্শ রূপে গড়ে তোলে। ফলে, মানুষের চিন্তা, বুদ্ধি, সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়ে কর্তৃত্বকারী দর্শন আধিপত্য স্থাপন করে, শাসকের সমর্থন বলয় মজবুত হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের নিজস্ব শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি (Historic Bloc) থাকলেও তা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে প্রবহমান স্বতঃস্ফূর্ত দর্শনের (Sponteneous philosophy) প্রভাবে। এই চেতনা মূলত মানুষের প্রতিদিনের জীবনাভিজ্ঞতা প্রসূত। সাধারণ জ্ঞান, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বিবিধ মূল্যবোধ, পিছুটান এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। লোকধর্ম, সংস্কার, কুসংস্কার, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পাঁচমেশালি ভাবনায় স্বতঃস্ফূর্ত চেতনা দৃঢ়স্থায়ী হয়। এমনকি জনসাধারণের চেতনার এই জগতে এসে ভিড়তে পারে অপর কোনও ঊর্ধ্বতন শ্রেণির মতাদর্শ, মনোভাব। তখন অপর শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি, তার মতো হতে চাওয়া সাধারণের জীবন-ভাবনাকে পরিচালিত করে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এই চেতনা সাধারণ মানুষকে রাজনীতি বিমুখ করতে সক্রিয় হয়। স্বতঃস্ফূর্ত চেতনার এই জগৎকে কবজা করেই শাসক তার মতাদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ফ্যাসিবাদ, অথবা যে-কোনও রাষ্ট্র ঐতিহাসিক ব্লক ও স্বতঃস্ফূর্ত চেতনার অন্যোন্যতায় (interaction) গড়ে ওঠা সাধারণের ভাবজগৎ থেকে সম্মতি গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালায়। পৌরাণিক ইতিহাস, কুসংস্কার, সাংস্কৃতিক প্রতীক, আবেগ-অনুভূতি-মূল্যবোধ-বিশ্বাস সম্মতি গঠনের প্রক্রিয়ায় ব্যবহার্য উপাদান। পুরসমাজের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদেরও কাজে লাগায় শাসককুল। প্রাচীনতম পরম্পরার প্রতিভূ প্রথাগত বুদ্ধিজীবীরা (Traditional Intellectual) স্বাধীন শুদ্ধ স্বতন্ত্রতার বাহ্যভান ধরে থাকলেও, শ্রেণি আনুগত্যকে আড়াল করে রাখলেও তাঁরা মূলত শাসকের মতাদর্শকে সার্বিক সমাজের মতাদর্শ করে গড়ে তুলতে পরোক্ষে সহায়তা করে।
The security-lust, in the Nazi period as well as on our own, is probably most evident among the petite-bourgeoisie…
হাঙ্গেরিয়ান চিত্রপরিচালক ইস্তভান জাবোর উল্লিখিত পর্যালোচনা শিল্প, শিল্পীর সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক কেন্দ্রিক হলেও দেশে কালে সর্বজনীন মধ্যবিত্ত, পাতি বুর্জোয়ার মনস্তাত্ত্বিক সংকটকেই উন্মোচিত করে। দুর্বল মানুষের মতোই সাতে-পাঁচে না-থেকে নিরাপদ থাকার বাসনা শিল্পীকে বিপথগামী করে কর্তৃত্বের কাছে দাসখত লিখে দিতে হয়েছে— অসংখ্য প্রমাণে ইতিহাস তার সাক্ষ্য ধরে রেখেছে। গ্রামশি কথিত প্রথাগত বুদ্ধিজীবী (Traditional Intellectual) তাঁর খোলস ছেড়ে শাসকের অনুগ্রহভিক্ষু ও তার মতাদর্শবাহী মজুরে রূপান্তরিত হন। তিনি তখন ক্ষমতার পদলেহনকারী জৈব বুদ্ধিজীবী (Organic Intellectual)। পতনের শব্দ শোনা যায় না, অধোগতি যে স্বেচ্ছাকৃত নিয়তি!
জার্মান মহাকবি গ্যোয়টে রচনা করেছেন ‘ফাউস্ট’। প্রশ্ন সবসময় উঠেছে এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র মূলে কে? মহামতি সর্ববিদ্যাবিশারদ ফাউস্ট না কিংবদন্তির শয়তান মেফিস্তোফেলিস? একদিকে রয়েছেন জ্ঞানসাধক ফাউস্ত অন্যদিকে পার্থিব ভোগসুখকামী মেফিস্টোফিলিস; সত্য, সুন্দর ন্যায়পথাশ্রয়ীর প্রতি যত তার উপহাস ব্যঙ্গ। শিল্পীর চরিত্রের মধ্যেই রয়েছে তো এই নিরবচ্ছিন্ন দ্বন্দ্ব। হয়তো মহাকবি গ্যোয়টে বিক্ষত হয়েছেন বিপরীতমুখী দুই মানবীয় প্রবৃত্তির টানাপোড়েনে! ফাউস্ট ঊর্ধ্বে উঠতে চায় তো শয়তান তাকে নারী, ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে পাঁকে নিমজ্জিত করে রাখতে সচেষ্ট হয়। আর্তনাদে ফাউস্ট বলে ওঠেন—
আমার হৃদয়ে হায় দুই প্রাণ করে অধিবাস এক চায় অন্য হতে রহিতে সুদূর! এক চায়, প্রদীপ্ত ইন্দ্রিয়সহ বদ্ধ থাকি ধরিত্রীর বুকে ভুঞ্জিবারে স্থূলতম কাম! অন্য চায় মুক্ত হয়ে ধূলি হতে এই ধরণীর উচ্চে উঠে মহাশক্তিসহ পূর্বপিতৃপুরুষের অতি ঊর্ধ্ব মানসজগতে।
নারী, ক্ষমতার দুর্নিবার টানে মুনি-ঋষির সংকল্পও ভঙ্গ হয় অচিরেই।
প্রখ্যাত অভিনেতা গ্রুয়েন্ড্গেন্স্-এর জীবন অবলম্বনে ক্লাউস মান রচনা করেন ‘মেফিসটো’ উপন্যাস। ইস্তভান জাবো সাহিত্যকে নিয়ে এলেন সিনেমার সংরূপে। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তি পেল ‘মেফিসটো’ চলচ্চিত্র। নাৎসি জার্মানির শাসনকালে একজন অভিনেতা, নাম হেনড্রিক হোফ্গেন, শিল্পের প্রতি, আত্মজনদের প্রতি তাঁর চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা, ক্রূর স্বার্থপরতা ও অধঃপাত তাঁকে যুগপৎ ফাউস্ট ও মেফিসটোফিলিসের সঙ্গে একাত্ম করে দেয়। যশ, ক্ষমতা অর্জনের জন্য শয়তান ফ্যাসিস্ট শক্তির কাছে শিল্পীর স্বাধীন সত্তাকে বিকিয়ে দেন হোফ্গেন। ঘাপটি মেরে থাকা মেফিসটো সুযোগ বুঝে তাঁকে একাধারে ক্ষমতার প্রতি প্ররোচিত করে এবং আনত-ও করে। নৈতিকতার সঙ্গে আপসের মনোভাব শিল্পীকে নরকে নামায়, নারকীয় শক্তির স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করে। জাবো এখানে ফ্যাসিস্ট শাসনামলের থিয়েটার তথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শিল্পীর ভূমিকার ব্যবচ্ছেদ করেছেন, তাঁদের ছলকপটতা বাইরে টেনে এনেছেন।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও শিল্পীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা কীভাবে পরস্পরকে প্রভাবিত করে হিসাবনিকেশ চালায় তার ব্যক্তি প্রতীক হয়ে ওঠেন হেনড্রিক হোফ্গেন। তিনি আধুনিক কালের ফাউস্ট, যিনি শীর্ষস্পর্শী সাফল্যের জন্য, নাম-মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য মানবতা বিরোধী শক্তির কাছে শিল্পীর আত্মাকে বিক্রি করেন। ক্ষমতা, নিরাপত্তার লোভ নীতি-অনীতির সীমানাকে ধূসর করে দেয়। সততা, দায়বদ্ধতা উধাও হয়ে যায়। হোফ্গেন ‘মুখোশ’ (ইয়ুং কথিত persona-র কথা ভাবুন, মুখ মুখোশের ব্যবধান ঝাপসা হয়ে পরস্পর সীমান্ত অতিক্রম করছে) পরে মঞ্চে নামে বারংবার। নাটকের চরিত্রের প্রয়োজনের কথা মনে রেখেও আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না মুখোশের সহায়ে হোফ্গেন তাঁর একান্ত লুব্ধক সত্তা লুকিয়ে রাখতে চান। কিন্তু, আদৌ তা সম্ভবপর হয়? আসলে মুখোশের সঙ্গে একসময় তিনি একাত্ম হয়ে আত্মসত্তাহীন হয়ে পড়েন। বারংবার ছুটে যান আয়নার কাছে। গুলিয়ে গেছে তার বাস্তব-বিভ্রমের ছেদরেখা। টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে আত্মপরিচিতি। তিনি কে? ফাউস্ট? প্রকৃত শিল্পী, অভিনেতা? না, মেফিসটো; ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা, পার্থিব ভোগসুখে থাকা তাঁর অতিশয় কাম্য? জাবো সিনেমায় রেডিশ টোন সচেতনভাবেই ব্যবহার করেন। ফ্যাসিস্ট শাসকের ভয়ানক ফাঁদে বন্দি হোফ্গেন। থিয়েটারের প্রতি উত্তুঙ্গ আবেগ তাঁকে পৌঁছে দেয় ধ্বংসাত্মক শক্তির নিশানতলে। যথার্থ শিল্পী শাসকের প্রতি প্রশ্ন ছুড়েই সত্যের অহর্ণা করে; কিন্তু হোফ্গেন স্ব-সত্তা থেকে বিযুক্তি সম্পন্ন হয়েছে, তিনি এখন শাসকের স্তাবকে রূপান্তরিত। খ্যাতির শিখরে পৌঁছানো মাত্র হোফ্গেনের অধঃপতন সম্পূর্ণ হয়ে যায়। স্পটলাইটে বিদ্ধ বিধ্বস্ত হোফ্গেনের পর্বান্তর সম্পর্কে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, ‘… সুউচ্চ সুবিশাল এই অ্যামফিথিয়েটারটি পেতে হোফ্গেনকে নামতে হয় সিঁড়ি বেয়ে নীচে, অনেক নীচে, যেখানে স্পটলাইট যেন তাকে তাড়া করে নামিয়ে নিয়ে যায়। যে আলো তাকে এতদিন লালন করেছে, আশ্রয় দিয়েছে, সেই আলোই যেন এবার তাকে আক্রমণ করে নগ্ন করে দেয়, যাতে বেরিয়ে আসে সেই আর্ত উচ্চারণ: ‘ওরা কী চায় আমাদের কাছে? আমি তো একজন অভিনেতা মাত্র (I’m only an actor)।’ শাসকের মুখপত্র (পাত্র নয়) হয়ে শিল্পীর অনেক কিছুই করার থাকে; দর্শকের সামনে ন্যায়সংগত করে ঘৃণার আখ্যান পরিবেশন করা। ভয়ে-ভক্তিতে নুন খেয়ে গুণ গাওয়া প্রপাগ্যান্ডার উৎসমূল যখন নৈতিক স্খলন তখন স্বাভাবিকতার কর্কটীয় সংস্কৃতি; শুধুমাত্র সম্মোহিত জনতা জানে না হয় ক্ষয় কতদূর বিস্তৃত হয়েছে!
Now the wound is open…
১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দ। ইন্দোনেশিয়ায় ঘটল সেনা অভ্যুত্থান। ডাচ উপনিবেশবাদের কবল থেকে মুক্তিসংগ্রামের নেতা, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রবর্তক তথা স্বাধীন ইন্দোনেশিয়া রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ-কে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল সুহার্ত। শুরু হল ফ্যাসিবাদী একনায়ক শাসনের কালোদিন। নিষিদ্ধ রূপে ঘোষিত হল– ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি PKI, সমস্ত প্রকার শ্রমিক সংগঠন ও কৃষকদের স্বার্থে গড়ে ওঠা সমবায়। অথচ ঔপনিবেশিক শোষণের নাগপাশ মুক্ত হয়ে এই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ভূমিসংস্কার করে কৃষক হাতে পেয়েছিল জমি; খনি, তেল ও রবার শিল্পের জাতীয়করণ ঘটেছিল। ফলে, আমেরিকা তথা দক্ষিণপন্থী দেশগুলির চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীন সরকার। আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদতে সুহার্তর ষড়যন্ত্রে তাই পালাবদলের সংঘটনা। সেনাশাসক সুহার্ত শুরু করলেন কমিউনিস্ট নিকেশের নারকীয় অভিযান। পঞ্চশীলা যুবদল নামে প্যারামিলিটারি বাহিনী, স্থানীয় সমাজবিরোধী ও মগজ ধোলাইকৃত জনগণের একাংশ মিলে প্রায় দশলক্ষ কমিউনিস্ট নিধন করা হল। বিংশ শতকের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যাকে আমেরিকায় দেখা হল ‘Victory over Communism’। টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে বলা হল– ‘the west’s best news for year in Asia.’ নিউ ইয়র্ক টাইমস্-এর শিরোনামে উঠে এল– ‘A Gleam of Light in Asia।’
রাষ্ট্রদ্রোহী কমিউনিস্ট ছিল কারা? ভূমিহীন কৃষক, অভুক্ত শ্রমিক, দরিদ্র জনতা অভিবাসী চিনীয়, দেশপ্রেমী বুদ্ধিজীবী। নায়কের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলেন কারা? রক্তপিপাসু নরখাদক ঘাতকের দল। আজকের দিনেও তারা রাষ্ট্রবন্দিত জননায়ক। কমিউনিস্টরা যেন অশরীরী আত্মা। God hates Communist— সরবে ঘোষণা করেও ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা গেল কি? এককালের যুবা কমিউনিস্ট ঘাতকেরা আজ অশীতিপর। তবু, শতশত মানুষ মেরে অধিকাংশের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই; মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসেও। অন্যদিকে স্বজনহারা মানুষেরা অব্যক্ত যন্ত্রণাকে সঙ্গে করে জীবন বয়ে নিয়ে চলেছে। নীরবতা, শূন্যতার পাশাপাশি হন্তারকের গর্বিত চেতনাকে দর্শকের সামনে যথাযথ বাস্তবে হাজির করতে জোশুয়া ওপেনহাইমার ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে উপস্থিত হলেন ইন্দোনেশিয়ায়। ৪১ জন হত্যাকারীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে জানতে চাইলেন, বুঝতে চাইলেন গণহত্যার কারণ, তাদের মানসিক স্থিতি, রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী যোগসাজশ। তৈরি হল ‘The act of Killing’ (2012) তথ্যচিত্র। রাষ্ট্রীয় ভাষ্যে চেপে রাখা, ঢেকে রাখা সত্য উপর্যুপরি বেরিয়ে এল।
ঘাতকের নাম আনোয়ার কঙ্গো। নিজেকে ‘Gangster’ রূপে পরিচয় করাতেই অহংস্ফীত। তার সমীকরণে Gangster = Freeman। অবলীলায় সে জানায় Rolex পরে, জিনস্ পরে হলিউডি ওয়েস্টার্ন ছবির কায়দায় কীভাবে কমিউনিস্টদের কচুকাটা করেছে। সহযোগী হত্যাকারীদের সঙ্গে ক্যামেরার সামনে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত না হয়ে বীভৎস হত্যাকাণ্ড সংঘটনের যতদূর সম্ভব স্মৃতিধার্য অতীতের বাস্তবসম্মত পুনরাভিনয় করে চলে অপমানবীয় তৎপরতায়। কীভাবে কমিউনিস্ট সন্দেহে অগণিত মানুষের ধড় থেকে মস্তিষ্ক ছিন্ন হয়ে যায়, গুহ্যদ্বারে গাছের গুঁড়ি প্রবিষ্ট হয়, কোপানো হয়, নাড়িভুঁড়ি পেট থেকে খুবলে বের করে আনা হয়– হার্মান কোটো, আদি জুলকাদর, সফিত পারদেদে প্রমুখ নিধনকারী যতদূর সম্ভব অবিকল সজীবতায় গণহত্যার খুঁটিনাটি দৃশ্যরূপ নির্মাণ করার চেষ্টা করে। এই ঘৃণা হিংস্রতার উৎস কোথায়? জোশুয়ার ক্যামেরা গোপন রাখতে দেয় না কোনও কিছুই। ঘাতকের সংলাপ ঐতিহাসিক পালাবদলের অর্থনীতি রাজনীতি বিবৃত করে। দক্ষিণপন্থী শক্তির সঙ্গে জেনারেল সুহার্ত রচনা করে ফ্যাসিস্টিক পরিকল্পনা। কমিউনিস্টদের সম্পর্কে বলা হয়– ঈশ্বরের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী তারা ঘৃণ্য শয়তান, নিজেদের মধ্যে শয্যাসঙ্গিনী বিনিময় করে দাম্পত্য পবিত্রতা কলুষিত করে, সশস্ত্র অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ইন্দোনেশিয়ার সমাজ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ধ্বংসপ্রাপ্ত করার চক্রান্তে শামিল। এভাবেই নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার কমিউনিস্ট বিরোধী প্রপাগ্যান্ডা সাধারণ মানুষকে দ্বিধাগ্রস্ত করে। ফলে, সেনাশাসকরা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে নিধন যজ্ঞ শুরু করলে তখন প্রতিরোধের সম্ভাবনা অবশিষ্ট থাকে না। পেশিশক্তির আস্ফালন, হিংস্রতার এই সংস্কৃতি যে আমেরিকান পুরুষালি ‘র্যাম্বো’ সংস্কৃতির আমদানি– Gangster আনোয়ার কঙ্গো সেই সংকরায়ন প্রতিক্রিয়াকে বিবৃত করে– ‘Why do people watch James Bond? To see action. Why do people watch films about Nazis? To see power and sadism. We can do more sadistic….।’ ঘাতক বাহিনীর কমান্ডার আমির সিংহান খোলাখুলি স্বীকার করেন– ‘We did this because America taught us to hate communists.’ প্রতিদান দিয়েছে ইন্দোনেশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ অপহরণকারী স্যাম আঙ্কেল ও তার ইউরোপীয় সাঙ্গপাঙ্গ। খুনিদের নিখরচায় ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণের ব্যবস্থা থেকে সন্তান-সন্ততিদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রেখে মাল্টিপ্লেক্সে ঘুরে ঘুরে আয়েশে বৈভবে দিন কাটানোর আর্থিক উপঢৌকন ও নিরাপত্তার সুবন্দোবস্ত করে। পরম্পরায় কালান্তরে ঘাতক-প্রজন্ম জিইয়ে রাখে তারা।
রাষ্ট্র লিখিত ইতিহাসের প্রতিরোধী জনতার বিকল্প আখ্যানসন্ধানী পরিচালক জোশুয়া ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসের এই চূড়ান্ত অমানুষিক, ভয়াবহ দিককে দর্শকের সামনে উপস্থিত করে পশ্চিমি শক্তির কাছে আত্মসমর্পণকারী ফ্যাসিস্ট শক্তির বর্বরতার ইতিবৃত্ত রচনায় শুধু ক্ষান্ত থাকেননি, জল্লাদের উন্মত্ত উল্লাস যাদের নিঃস্ব করেছে, পশুশক্তির যে ভয় যৌথ-নির্জ্ঞানে চারিয়ে গিয়ে মানুষকে নীরব করে রেখেছে দশকের পর দশক– সেই নির্মম ভয়ার্ত নিঃশব্দতা সংরক্ষণ করতে চাইলেন তিনি, পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের দমিত মানুষের নিথর কান্নার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চাইলেন। শোক-নির্বাসিত মানুষের স্তব্ধতার নির্বেদ প্রণীত হল– ‘The Look of Silence’ (2014)। ইন্দোনেশীয় গণহত্যায় আত্মজন হারানো মানুষদের আস্তিত্বিক নিমগ্ন শূন্যতা জোশুয়ার এই তথ্যচিত্রে নিথর হয়ে রয়েছে। ‘The act of Killing’ তথ্যচিত্রের জন্য সংগৃহীত গণহত্যাকারীদের সাক্ষাৎকার দেখতে দেখতে আদি নামে মধ্যবয়সী দুই সন্তানের জনক অকস্মাৎ পাঁচ দশক পূর্বে তার বড়ো ভাই রামলির আততায়ীদের মুখোমুখি হয়ে যায়। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তারা পরিবারের সদস্যদের সামনেই নিজেদের ভয়ানক কীর্তিকলাপের বিবরণ দিয়ে চলে। রামলির হত্যাকারী ইনং ও অপর সহযোগী শয়তানি শৈত্যে পিশাচী রক্তপিপাসার বিবরণ দিয়ে চলে, উদ্দিষ্ট দর্শকসাধারণ– ‘Slit their throats collect the Blood. Two glasses was enough. Then drink it… If We didn’t drink human blood, we’d go crazy. Many went crazy।’ মানুষের রক্তের স্বাদ কেমন? ঘাতক সৈন্যর তৎক্ষণাৎ প্রত্যুত্তর– ‘Both salty and sweet.’ ধর্ষকামী দেশপ্রেমিক জানাতে ভোলে না– ‘If you cut off a women’s breast, it looks like a coconut milk filter full of holes.’ পৌঁছে যাই উত্তর সুমাত্রার সর্পিল নদীর পাড়ে। দেখছি একদল পিশাচ-মানুষ প্রতিবেশী মানুষের রক্তপান করছে পূতিগন্ধময় দগদগে পচন বুকে করে, ধর্ষকামী রাষ্ট্রশক্তির লেলিহান ক্ষমতার পরিপুষ্টি ঘটাতে। কোনও অনুশোচনা, উদ্বিগ্নতা, অপরাধবোধের জন্ম হয় না। বরং, আদি-র মতো তার পুত্রহারা মা রোহানি, শতায়ু, স্মৃতিভ্রংশ পিতা রুকুন গণহত্যার ভয়ে কুঁকড়ে থাকে, আত্মবিচ্ছেদে নিঃস্বন সমাহিত। দূর থেকে আমরা দর্শকরা ভাবি হলোকাস্টের ‘Survivor’-রা হয়তো শোক ভুলে ভালো আছে; মার্কেজের চরিত্রের ভয়ানক স্মৃতিভ্রংশতা তাঁদের স্বস্তি দিয়েছে বা! কিন্তু, দেখি হিংস্র সন্ত্রাস তাদের জীবনকে ক্লীব করে দিয়েছে, বেঁচে থাকার অভিনয়টুকু তারা করে চলে। কেননা, তা না হলে ঘাতকরা প্রস্তুত সর্পিল নদীতে ভাসিয়ে দেবে তারা ধড়বিহীন অবাধ্য লাশ। নদীর বহতাধারায় তখন রাষ্ট্রদ্রোহীর রক্তপ্লাবন। রামলির পিতা রুকুন তাঁর ঘর চিনতে পারে না, মৃত ছেলের নাম স্মরণে আনতে পারে না, মা রোহানির চোখের জল শুষে নিয়েছে অপরিবর্তনীয় দুঃসময়ের অকরুণ নিয়তি। মিডক্লোজআপে আদি মুখোমুখি আমাদের, যেমন করে এই কিছুক্ষণ পূর্বে ছিল ভ্রাতৃঘাতকের। তার নিঃসাড় পলকহীন দৃষ্টিপাত দানবিক রাষ্ট্রীয় নজরদারি থেকে গহীন নিঃস্বর অপলক সিক্ততা বিছিয়ে দেয়।
জোশুয়া বলছেন– “The look of Silence, is, I hope, a poem about a silence borne to terror– a poem not only about the necessity of breaking the silence, but also about the trauma that comes when silence is broken.
আজও ইন্দোনেশিয়ায় অন্ধকারের বুক চিরে ঘাতকসেনা বোঝাই ট্রাক নিশ্ছিদ্র টহল জারি রেখেছে। হননোদ্ধত ঘৃণার ইতিহাস ট্রমার যাবতীয় আয়োজন সত্ত্বেও নৈঃশব্দ্য নিশ্চিহ্ন করতে পারে না।
শেষে পোর্তুগিজ শিল্পী রুই জিংকের ভালো ফ্যাসিস্ট চেনার বহুবিধ পাঠ থেকে ফ্যাসিজমের সংজ্ঞা–
মানুষ যে কত পাশবিক হিংসার ঘটনা ঘটায়, সত্যি বলতে কি, কী কারণে সেগুলো ঘটাচ্ছে সেটা না জেনেই, এটা খুবই আশ্চর্যের। তারা শুধু এটাই জানে যে তারা অন্যদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছে। এই অভিযোগকারী আঙুল, যেটা সর্বদা অন্যদের মন্দে আর আমাদের ভালোতে বদলে দেয়, এটাই আমার কাছে ফ্যাসিজমের গোড়ার কথা।
অতএব, যেন আমাকে দেখি এবং নিজেকে দেখুন…
অন্যথায় হেমন্তের জড়িমা কাটিয়ে কুয়াশা ভেদ করে কুলপিতার প্রত্যাবর্তন পুনরাগত। তিনি– “লিখিত আইনের দুর্বলতা সহ্য করেন না বলে মুখে মুখে আইন করেন এবং রাষ্ট্রীয় ডিক্রির পিঠে বৃদ্ধাঙ্গুলির কালির ছাপ ঘষে দেন তাঁর স্বাক্ষর তথা চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় সিলমোহর হিসেবে। যদি তাঁর মনে হয় রাত তিনটার সময় আসলে ঘড়িতে সকাল আটটা বেজেছে তবে অমনি তিনি সেই মাফিক হুকুম করেন এবং দেশের সমস্ত স্থল, নৌ ও বিমানঘাঁটিগুলোতেও সাথে সাথে সকালের তুর্যবাদন ধ্বনিত হয়। দেশের মানুষ তাঁর মুখচ্ছবি উৎকীর্ণ দেখতে পায় মুদ্রায়, ডাকবিভাগের খাম বা কন্ডোমের লেবেলে যদিও তারা জানে এই ছবি আসলে তাঁর প্রতিকৃতির অনুকৃতির অনুকৃতির অনুকৃতি যা দেখেছে তাদের পিতাদের পিতাদের পিতাদের পিতাগণ।”
সহায়:
গ্রন্থ–
অবনীন্দ্রনাথ বেরা (সম্পাদিত), ‘চলচ্চিত্র সমালোচনা ৫০’, কলকাতা, সুজন প্রকাশনী, ২০১৬
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, ‘গোত্রপিতার হেমন্ত’ (‘দ্য অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক’ গ্রন্থের অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী), ঢাকা, সন্দেশ, ২০০৪
জর্জি ডিমিট্রভ, ‘শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য ফ্যাসিবাদ বিরোধী দুর্গ’, কলকাতা, এন বি এ, ২০১২
বদরুল আলম খান, ‘কেন পুনরায় মার্কস’, ঢাকা, প্রথমা প্রকাশন, ২০২৩
মঞ্জুর আহমদ, ‘মনোসমীক্ষণ মতধারা’, ঢাকা, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ২০১৬
মহাশ্বেতা দেবী, ‘ছোটগল্প সংকলন’, নয়াদিল্লি, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ১৯৯৪
যোহান ভোল্ফগাঙ্ গ্যোতে, ‘ফাউস্ট’ প্রথম ভাগ, (মূল জার্মান থেকে অনুবাদ: কানাই লাল গাঙ্গুলি), কলকাতা, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৬১
রুই জিঙ্ক, ‘ভালো ফ্যাসিস্ট হওয়ার সহজ উপায়’ (মূল পোর্তুগিজ থেকে অনুবাদ: ঋতা রায়), কলকাতা, ধানসিড়ি, ২০২৩
শোভনলাল দত্তগুপ্ত (সম্পাদিত), ‘আনতোনিও গ্রামশি বিচার-বিশ্লেষণ’, কলকাতা, পার্ল পাবলিশার্স, ১৯৯৩
সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘ফ্যাসিবাদ ভাবনা’, কলকাতা, একুশ শতক, ২০১০
সব্যসাচী সেন, ‘ক্ষমতা, শরীর ও যৌনতা’, কলকাতা, ক্রৌঞ্চদ্বীপ, ২০২১
সুকোমল সেন, ‘ফ্যাসিবাদ অতীত ও বর্তমান ভারতের প্রসঙ্গসহ’, কলকাতা, এন বি এ, ২০১২
সুদর্শনা সেন, কৃষ্ণদাস চট্টোপাধ্যায়, ‘লিঙ্গশ্লিষ্ট সমাজতত্ত্ব’ কলকাতা, কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি, ২০২৩
সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ফ্যাসিজম’, কলকাতা, মনফকিরা, ২০০৭
সৌরীন ভট্টাচার্য ও শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘আনতোনিও গ্রামশি নির্বাচিত রচনাসংগ্রহ’ (প্রথম খণ্ড), কলকাতা, পার্ল পাবলিশার্স, ১৯৯৩
Adlof Hitler, ‘Mein Kampf’ (trans: Ralph Manheim), A Mariner Book, Boston-New York, 1999
Erich Fromm, ‘Escape from Freedom’, New York, Avon Books, 1965
Geoffrey Gorer, ‘The life and ideas of the Marquis de Sade’, Great Britain, A Panther Book, 1963
Hannah Arendt, ‘The Origins of Totalitarianism’, Cleverland & New York, The World Publishing Company, 1962
Jairus Banaji (Ed.), ‘Fascism: Essay on Europe and India’, Haryana, Three Essays, 2013
Jason Stanley, ‘How Fascism Works: The Politics of Us and THEM’, New york, Random House, 2018
Leon Trotsky, ‘Fascism: What it is and how to Fight it, Mumbai, Sanage Publishing Home, 2020
Susan Griffin, ‘Pornography and Silence’, Great Britain, The Women’s Press, 1981
Sylvia Plath, ‘Daddy’ [Link: https://www.poetryfoundation.org/poems/48999/daddy-56d22aafa45b2]
Vijay Prashad (Ed.), ‘Strongmen’, New Delhi, Left Word, 2020
Wilhelm Reich, ‘The Mass Psychology of Fascism’, Delhi, Aakar Books, 2022
চলচ্চিত্র ও ওয়েব সিরিজ–
Alain Resnais, ‘Night and Fog’ (1955)
Alexander Sokurov, ‘Moloch’ (1999)
Bonnie Sherr Klein, ‘Not a Love Story: A Film about Pornography’ (1981)
Ettore Scola, ‘A Special Day’ (1977)
Helma Sanders-Brahms, ‘Germany, Pale Mother’(1980)
István Szabó, ‘Mephisto’ (1981)
Joshua Oppenheimer, ‘The Act of Killing’(2012)
‘The Look of Silence’ (2014)
Pier Paolo Passolini, ‘Saló, or the 120 Days of Sodom’ (1975)
Roberto Rossellini, ‘Germany, Year Zero’ (1948)
Joe Berlinger, ‘Hitler and the Nazis: Evil on Trial’ (2024-Netflix Series)
ইউটিউব ভিডিও–
Prabhat Patnaik speaks on ‘Neo-Liberalism and Neo-Facism’
[লিংক: https://youtu.be/S6a9ZJp5jHM?si=B5TVp0itfj1nwT0G]
শোভনলাল দত্তগুপ্ত – ‘ফ্যাসিবাদ ভাবনা : একটি অনুসন্ধান’
[লিংক: https://youtu.be/VSRe3yjU2vw?si=q6xB1FrkZIVggLvi]
প্রবন্ধে ব্যবহৃত চিত্র– অন্তর্জাল