নেপাল মজুমদার
ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণের (২রা অক্টোবর, ১৯৩৫) পর থেকেই ইউরোপে প্রায় সর্বত্রই ফ্যাসিস্টরা সংঘবদ্ধ ও উগ্র মারমূর্তিতে দেখা দিতে থাকে। ৫ই মে (১৯৩৬), আবিসিনিয়ার পতন ঘটে। ঐ দিনই রোমে ‘পিয়াজ ভেনেজিয়া’ প্রাসাদ থেকে মুসোলিনি সদম্ভে ঘোষণা করে, ‘আবিসিনিয়া ন্যায়ত ইতালিরই, কারণ ইতালি তার তরবারির জোরে ও সভ্যতার শক্তিতেই তা অধিকার করেছে। সভ্যতা ও বর্বরতার দ্বন্দ্বে, সভ্যতাই জয়লাভ করেছে।’
আবিসিনায়ার পতনের পর বিশ্বপরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি ঘটতে থাকে। বস্তুতপক্ষে ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি বড়ো বড়ো সাম্রাজ্যবাদী দেশ ‘শান্তি ও নিরপেক্ষতার’ অজুহাতে ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলিকে বাধা না দিয়ে তোয়াজ করেই চলেছিল। ১৫ই জুলাই (১৯৩৬) ইতালির বিরুদ্ধে ‘স্যাংশন্’ (যা নামে মাত্রই ছিল) প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ঐ দিনই ‘রেডিও রোম’ সংবাদ প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন হয়েছিল। এই সংবাদে রোমে মহোল্লাস পড়ে যায়। তার দু-তিন দিন পরেই– ১৮ই জুলাই স্পেনে ফ্যাসিস্ট অভ্যুত্থান শুরু হয়। ঐ দিনই বিদ্রোহী ফ্যাসিস্ট নেতা জেনারেল ফ্রাঙ্কো তার মূর সৈন্যের সাহায্যে স্পেনের বৈধ রিপাবলিকান সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে বেশ কিছুকাল থেকেই এই অভ্যুত্থানের গোপন ষড়যন্ত্র চলেছিল এবং হিটলার ও মুসোলিনি তলেতলে এই বিদ্রোহের জন্য ফ্রাঙ্কোকে উস্কানি ও মদৎ যুগিয়ে যাচ্ছিল। ১৮ই জুলাই অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলি প্রকাশ্যেই একজোটে বিদ্রোহী ফ্রাঙ্কোকে সাহায্য করতে থাকে। ফলে, স্পেনের নগরে-বন্দরে-শহরে বিদ্রোহী ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে স্পেনের জনগণ ও সরকারপক্ষীয় সৈন্যদের তুমুল লড়াই চলতে থাকে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে এই ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলে।
এদিকে স্পেনে ফ্যাসিস্টদের সংঘবদ্ধ আক্রমণের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীতে তুমুল আলোড়ন ও আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ফ্যাসিস্ট বোমারু বিমানগুলি রাত্রির অন্ধকারে মাদ্রিদ, বার্সালোনা প্রভৃতি নগর ও শহরগুলিতে প্রবল বোমা বর্ষণ করে সব কিছু বিধ্বস্ত করতে শুরু করে। এমন কি বিদ্যালয়, হাসপাতাল, এ্যাম্বুলেন্স্, রেড্ক্রস, শুশ্রূষাকেন্দ্র ও শিশু-আবাসগুলিও রেহাই পেল না। স্পেনে ফ্যাসিস্টদের এই বীভৎস নারকীয় তাণ্ডবলীলার বিরুদ্ধে জগতের গণতন্ত্রবাদী ও বিবেকী শিল্পীরা দলে দলে সশস্ত্র প্রতিরোধ-সংগ্রামে এগিয়ে আসেন। এই সময়ই তাঁদের অস্ত্রচালনা ও সামরিক শিক্ষা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাহিনীতে সংগঠিত করা হয়।
এখানে উল্লেখযোগ্য, বিদ্রোহী ফ্যাসিস্ট নেতা ফ্রাঙ্কোর পক্ষে প্রায় ৬০ হাজার ইতালীয় ও ৩০ হাজার জার্মান সৈন্য লড়াই করেছিল। তাছাড়া স্পেনের সমস্ত জলভাগে ও উপকূল ঘিরে জার্মান ও ইতালীয় যুদ্ধ-জাহাজগুলি স্পেন সরকারকে বিচ্ছিন্ন ও পর্যুদস্ত করবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।
অপরদিকে আন্তর্জাতিক বাহিনীতে শুরুতেই প্রায় ৪০ হাজার সৈন্য স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করতে আসেন। প্রায় ৪০০০ ফরাসি, ৪০০০ ইতালীয় ও জার্মানি, ৫০০ ইংরেজ ও অনান্য দেশের লোক ছিলেন। এক কথায় ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান, স্পেন, চেক, সুইস, হাঙ্গেরিয়ান, বুলগেরিয়ান, ইতালীয়ান, সার্ব, মেক্সিকান, মিশরি, আরবি, তুর্কি এমন কি ইন্দোচিনেরও কয়েকজন যোগদান করেন। বলা বাহুল্য, এই সব স্বেচ্ছাসৈনিকরা অধিকাংশই লেখক, শিল্পী, ভাস্কর, অভিনেতা, সঙ্গীতজ্ঞ, ছাত্র, যুবক ও শ্রমিক ছিলেন এবং তাঁদের অধিকাংশেরই কোনও সামরিক শিক্ষা ছিল না। কিন্তু যখন শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ফ্যাসিস্ট বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-সংগ্রামের ডাক এল, তখন কলম, রঙ-তুলি-ইজেল, পিয়ানো-ভয়োলিন-গীটার ফেলে দিয়ে রাইফেল ও সঙ্গীন হাতে দলে দলে তাঁরা ছুটে গেলেন স্পেনের রণাঙ্গনে। সে এক অপূর্ব মহিমাময় দৃশ্য। রক্ত ও বারুদের গন্ধ ও ধোঁয়ার অন্ধকারে এই সব বিবেকী শিল্পীর প্রজ্জ্বলিত মহান অন্তরাত্মার বিচ্ছুরিত আলোকে জগৎ আলোকিত হয়ে উঠল।
স্পেনের বিখ্যাত কবি এবং আধুনিক ইউরোপের শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম ফ্রেডারিকো গার্সিয়া লোর্কা বিদ্রোহী ফ্যাসিস্টদের গুলিতে নিহত হন। স্পেনের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ বেহালাবাদক পাব্লো কসালস্ প্রকাশ্যে গণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন করার জন্যও অনুরূপভাবে ফ্যাসিস্ট পশুদের হাতে নিহত হন। এমনিভাবে স্পেনের কত যে লেখক, শিল্পী ও বিবেকী বুদ্ধিজীবী এই যুদ্ধে নিহত হন তার আর ইয়ত্তা নেই।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যে-সব লেখক-শিল্পীরা আন্তর্জাতিক বাহিনীতে যোগ দেন, তাঁদের মধ্যে যে দুইজন প্রখ্যাত শিল্পী প্রথমেই প্রাণ দেন তাঁরা দুজনেই ছিলেন ইংরেজ। একজন নারী ও অপরজন পুরুষ– নাম, ফেলিসিয়া ব্রাউন ও র্যালফ্ ফক্স। ফেলিসিয়া ব্রাউন ছিলেন ইংলণ্ডের একজন প্রখ্যাত নারী ভাস্কর। তিনি অবকাশ-সম্ভোগের জন্য যখন স্পেনে যান তখন সেখানে বিদ্রোহ শুরু হয়। তিনি স্বয়ং আগ্রহী হয়ে সরকারপক্ষে যোগ দিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করেন এবং বিদ্রোহীদের গুলিতে রণক্ষেত্রেই প্রাণ দেন। ইতিমধ্যে পৃথিবীর দেশে দেশে স্পেনের ফ্যাসিস্ট আক্রমণ নিয়ে তুমুল আন্দোলন চলতে থাকে এবং আন্তর্জাতিক বাহিনীতে যোগ দেবার জন্য দলে দলে স্বেচ্ছাসৈনিকেরা স্পেন অভিমুখে রওনা হন। ‘শাক্লতওয়ালা কলাম’ নামে গঠিত ইংলণ্ডেরও একটি বাহিনী এই আন্তর্জাতিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে স্পেনে যুদ্ধ করতে আসেন। প্রখ্যাত মার্কসবাদী তরুণ সাহিত্য-সমালোচক র্যালফ্ ফক্স ও ক্রীস্টোফার কড্ওয়েল্ প্রমুখ বহু কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পী এই বাহিনীতে ছিলেন। কিছুদিন পর মাদ্রিদ আক্রমণকালে র্যালফ্ ফক্স লড়াই করবার সময় বিদ্রোহীদের গুলিতে নিহত হন। পরে অনুরূপভাবে কড্ওয়েলও (আসল নাম Christopher St. Jhon Sprigg) নিহত হন। উল্লেখযোগ্য, কড্ওয়েলের সুবিখ্যাত “Illusion and Reality” গ্রন্থটি তখন যন্ত্রস্থ ছিল। তাছাড়া ইংলণ্ডের প্রখ্যাত লেখক-শিল্পীদের মধ্যে এইচ. জি. ওয়েলস্, নর্মান এঞ্জেলস্, জি.ডি. এইচ. কোল, ই. এম. ফরস্টার, ডেলাসল বার্নস্, জুলিয়ান হ্যাক্স্লি, গিল্বার্ট মারে, ভার্জিনিয়া উলফ্, জন স্ট্যাচি এবং স্টিফেন্ স্পেন্ডার প্রমুখ অনেকেই স্পেনের ফ্যাসিস্ট বর্বরতার তীব্র নিন্দা করে গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে লেখনী ধারণ করেন। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাহিনীতে বিখ্যাত ফরাসী সাহিত্যিক আঁদ্রে মালরো এবং আঁদ্রে মার্তি, জেনারেল লুকাস্ এবং বিখ্যাত মার্কিন সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্রমুখ বিস্তর খ্যাত-অখ্যাত লেখক-শিল্পীরাও যোগদান করেন।
পরাধীন ভারতবর্ষের পক্ষে এই আন্তর্জাতিক বাহিনীতে যোগদান করা সম্ভবপর না হলেও স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি জানিয়ে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে যে তীব্র ফ্যাসি-বিরোধী আন্দোলনের জোয়ার এসেছিল ভারতবাসী মাত্রেই তার জন্য গৌরব অনুভব না করে পারবেন না।
স্মরণ রাখা দরকার, ফ্যাসিজমের সূচনাকাল থেকেই রলাঁ ও বারব্যুসই ফ্যাসিজমের ভয়াবহ পরিণিত এবং তার ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী-নীতি ও সাম্রাজ্যলালসা সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে সারা পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ ও ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। স্পেনে প্রতিবিপ্লব শুরু হলে অল্পকাল পরেই ফ্যাসিস্টদের পৈশাচিক তাণ্ডবলীলাকে প্রতিরোধ করার জন্য রলাঁ এক আকুল আবেদন জানান (২০শে নভেম্বর ১৯৩৬)। তাছাড়া ভারতবর্ষে এই আন্দোলনকে ব্যাপকতর করে তুলবার জন্য League Against Fascism and War-এর পক্ষে রলাঁ ও পল্ল্যাঁজভাঁ উভয়েই ফৈয়জপুর কংগ্রেসে কংগ্রেস-প্রতিনিধিদের উদ্দেশে এক আবেদনবাণী পাঠিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, রলাঁর পূর্ব আবেদনটি ভারতবর্ষে বহুল প্রচারের জন্য সংঘের পক্ষ থেকে ফ্রান্সিস জ্যুরদ্যাঁ তা রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে এক পত্র দেন (১লা ডিসেম্বর, ১৯৩৬)। পত্রটি এই:
Dear friend,
We are enclosing herewith an eloquent appeal addressed to the conscience of the world by Romain Rolland.
We feel sure that you will associate yourself with this appeal and therefore we make so bold as to ask you to send us a few lines expressing your opinion on the terrible bombardment which the civilian population in Madrid has endured already for so many days.
We attach particularly great value to such personal declaration from you. Its publication in the press and particularly in Spain will be and important testimony to world opinion and a mark of solidarity with the Spanish people.
Thanking you in anticipation.
Yours sincerely.
For the World Committee Against War and Fascism
P.P. Francis Jourdain
[দ্র. ‘Modern Review’, January 1937, pp. 120, 105 ]
রলাঁর আবেদনটির (২০শে নভেম্বর, ১৯৩৬) মর্মার্থ ছিল এই :
মাদ্রিদের ধূমায়িত প্রস্তরস্তূপ হইতে আর্তের ভয়ার্ত ক্রন্দন উঠিতেছে। যে গর্বিতা নগরী এককালে অর্ধজগতের অধিশ্বরী ছিল এবং যাহা অধুনা পাশ্চাত্য সভ্যতার এক আলোকোজ্জ্বল কেন্দ্র– আজ আফ্রিকার মূর এবং ‘বিদেশি বাহিনী’ আসিয়া তাহা অগ্নিতে দগ্ধ করিতেছে ও রক্তের প্লাবন বহাইতেছে। তাহাদের বিদ্রোহী নেতারা যে-স্পেনের হিতৈষী বলিয়া দাবি করিতেছে– সেই স্পেনকেই লুণ্ঠনে তাহারা রত হইয়াছে এবং স্পেনের সভ্যতা পদতলে দলিত করিতেছে।…
সহস্র সহস্র নারী ও শিশু নিহত, অঙ্গহীন এবং জীবন্ত দগ্ধ হইয়াছে। শহরের সর্বাপেক্ষা জনবহুল অঞ্চলই বোমা বর্ষণের লক্ষ্যস্থল। হাসপাতাল রেহাই পাইতেছে না। গৌরবময় সুরম্য অট্টালিকাগুলি অগ্নিশিখা লেহন করিতেছে; আজ ডিউক অব আলবার প্রাসাদ, কাল প্রাদো-র বহু শতাব্দীর কারুশিল্প বোমার আঘাতে ভাঙিয়া পড়িতেছে। সমগ্র অধিবাসীসহ ভালস্কুইজ মৃত।…
যে বীর্যবতী নগরীর প্রাচীন রাজন্যবৃন্দ আরব অভিযান হইতে ইয়োরোপকে রক্ষা করিয়াছেন, আজ তাহার বেদনার দিনে, হিটলার ও মুসোলিনি আফ্রিকান ফ্রাঙ্কোর ‘গবর্নমেন্ট’কে সমর্থন করিতেছেন এবং ঐ ব্যক্তি ইতালি ও জার্মান ফ্যাসিস্টগণ প্রদত্ত অস্ত্রে স্পেনকে হত্যা করিতেছে। বিনিময়ে ফ্রাঙ্কো স্পেনের ঐশ্বর্য ও সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি তাহাদের হাতে তুলিয়া দিতেছে। এই উন্মাদেরা দেখিতেছে না, যে রক্তের মূল্যে তাহারা আজ যে পাপাভিসন্ধি চরিতার্থ করিতেছে, একদিন তাহা ফিরিয়া আসিয়া তাহাদের অধিবাসীদের উপরই বর্ষিত হইবে; অদ্যকার উচ্ছৃঙ্খল বর্বরতা মাদ্রিদ ও বার্সালোনার (কারণ কাল বার্সালোনা ধ্বংস হইবে) পরে রোম, বার্লিন, লণ্ডন এবং পারীর দিকে ধাবিত হইবে। ইউরোপের মহান জাতিগুলি– যাহারা সভ্যতার মাতৃভূমি, তাহারা আজ ক্ষুধিত শার্দুলের মতো পরস্পরকে পৈশাচিক আনন্দে ভক্ষণ করিতেছে; জাতির সুসন্তানগণ পরস্পরের গলায় ছুরি দিতেছে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, উপস্থিত ও অনাগত দুঃখভারাক্রান্ত হইয়া উঠিতেছে।…
মনুষ্যত্ব! মনুষ্যত্ব! আজ তোমার দ্বারে আমি ভিখারি। এসো, স্পেনকে সাহায্য করো। আমাদের সাহায্য করো। তোমাদের সাহায্য করো। কেন না তুমি আমি সকলেই আজ বিপন্ন!…
এই সকল নর-নারী, বালক-বালিকা এবং জগতের শিল্প ও ঐশ্বর্যসম্ভার নষ্ট হইতে দিও না। আজ যদি তুমি নীরব থাকো, কাল তোমার পুত্রকন্যা, তোমার স্ত্রী, তোমার জীবনের যাহা কিছু প্রিয় ও পবিত্র, তাহাও একে একে মৃত্যুমুখে পতিত হইবে। আজ যদি তোমরা হাসপাতাল, যাদুঘর, শিশুদের ক্রীড়াউদ্যান, ঘন জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে বোমাবর্ষণ বন্ধ না করো তাহা হইলে হে জগতের অধিবাসীবৃন্দ, শীঘ্র হউক বিলম্বে হউক, তোমাদের ভাগ্যও অনুরূপ হইবে। এই সূচনায় তোমরা যদি ইহা নিভাইয়া না ফেলো, তাহা হইলে এই প্রলয়ানলের ধ্বংসের গতি আর কে সংযত করিবে? সমগ্র জগৎ ইহার কবলে পড়িবে।…
সময় নাই! অতি দ্রুত প্রস্তুত হও! উঠো, জাগো, কথা বলো, চীৎকার করো, কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হও! আমরা যদি যুদ্ধ বন্ধ না-ও করিতে পারি, তথাপি যাহাতে আন্তর্জাতিক বিধি-ব্যবস্থা সকলে সম্মান করিতে বাধ্য হয়, সে ব্যবস্থা করিতে তো পারি। এসো আমরা নির্দোষ ও নিরুপায়কে রক্ষা করি! জাতি দল বা ধর্মের উর্ধ্বে উঠিয়া সর্বজনীন কল্যাণের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া সকল মানব একযোগে পীড়িতের সাহায্যে ও সেবায় হস্ত প্রসারিত করুক। ভয়াবহ রণক্ষেত্রের মধ্যে দাঁড়াইয়া সকল শ্রেণির পীড়িত, সকল শ্রেণির জীবিত মানবের ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনকে সুদৃঢ় করিয়া তুলিতে হইবে।
[দ্র. ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ৪ঠা মাঘ, ১৩৪৩, ১৭ই জানুয়ারী, ১৯৩৭]
রলাঁর এই আবেদন ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক মহলেই অপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল। অবশ্য এই ব্যাপারে কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ গ্রহণের আগেই বাংলা দেশের কমিউনিস্ট ও সোশ্যালিস্টরাই প্রথম আন্দোলন শুরু করেন। লক্ষ্ণৌ-কংগ্রেসের (১৯৩৬) পূর্ব মুহূর্তে কলকাতায় কমিউনিস্ট, কংগ্রেস-সোশ্যালিস্ট, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরাই যুদ্ধ ও ফ্যাসি-বিরোধী সংঘের একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেন। এর অনতিকাল পরেই বিশ্বশান্তি কংগ্রেস এবং বাংলাদেশে এঁরাই আবিসিনিয়া, প্যালেস্টাইন ও স্পেনের ব্যাপারে প্রধান নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক বাহিনীর অসীম বীরত্বের ও আত্মোৎসর্গের সংবাদে তাদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা ও উৎসাহ উদ্দীপনার সঞ্চার হয়।১ ক্রমে স্পেনের পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকলে– বিশেষত রলাঁর ঐ আবেদনবাণীর পর, স্পেনে সক্রিয় সাহায্য পাঠাবার জন্য তাঁরা অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠলেন। অল্পকাল পরে তাঁদেরই উদ্যোগে League Against Fascism And War-এর সর্বভারতীয় কমিটি গঠিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ তখন কলকাতায়। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী প্রমুখেরা এই কমিটির সভাপতিপদ গ্রহণে অনুরোধ নিয়ে কবির নিকট উপস্থিত হন। কবি সংবাদপত্রযোগে সব খবরই পাচ্ছিলেন; স্পেনের দুঃখে কবির হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়। কবি সানন্দে এই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে স্পেনে ফ্যাসিস্ট বর্বরতার তীব্র নিন্দা ও ভর্ৎসনা করে স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকারের সাহায্যের জন্য দেশবাসীর উদ্দেশে এক আকুল-উদাত্ত আহ্বান জানান।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই কমিটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় সংঘের মর্যাদা ও গুরুত্ব খুবই বেড়ে যায়। অধ্যাপক কে. টি. শাহ ও সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যথাক্রমে কমিটির চেয়ারম্যান ও জেনারেল সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। L.A. Fascism and War-এর ভারতীয় শাখা কমিটির বিশিষ্ট সদস্যরা ছিলেন : আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, সরোজিনী নাইডু, এস. ব্রেলভি (সম্পাদক, ‘বম্বে ক্রনিকেল’) কে. শান্তনম (সম্পাদক, মাদ্রাজ ‘ডেলি এক্সপ্রেস’), আর.এস.রুইকর (সহঃসভাপতি নিঃ ভাঃ ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস), তুষারকান্তি ঘোষ, ডঃ ধীরেন সেন, অধ্যাপক সুরেন্দ্র গোস্বামী (সম্পাদক, বঃ প্রগতি লেখক সংঘ) সাজ্জাদ জহীর (সাধারণ সম্পাদক, নিঃ ভাঃ প্রগতি লেখক সংঘ), ইন্দুলাল যাজ্ঞিক, স্বামী সহজানন্দ (সম্পাদক, নিঃ ভাঃ কিষাণ সভা), এন. জি. রঙ্গ (সভাপতি, নিঃ ভাঃ কিষাণ সভা), এস.এ. ডাঙ্গে, পি. ওয়াই, দেশপাণ্ডে, ডাঃ সুমন্ত মেটা, মিঞা ইফ্তিকারউদ্দীন, কমলা দেবী, জয়প্রকাশ নারায়ণ, দেবেন সেন, নবকৃষ্ণ চৌধুরী ও ডাঃ সুরেশ ব্যানার্জী প্রমুখ আরও অনেকে।
স্পেনে ফ্যাসি বিরোধী সংগ্রামে পূর্ণ সহানুভূতি এবং অর্থ ও উপকরণাদি দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করবার আবেদন জানিয়ে এই সময় সংঘের পক্ষ থেকে বারব্যুস্ রলাঁ ও রবীন্দ্রনাথের ছবি ও আবেদনবাণীসহ SPAIN নামে একটি প্রচার-পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। বর্তমানে এই অমূল্য দলিলটি বাজারে প্রায় দুষ্প্রাপ্য বললেই চলে। রবীন্দ্রনাথের আবেদনবাণীটি ছিল এই:
TO THE CONSCIENCE OF HUMANITY
In Spain, the world civilisation is being menaced and trampled under foot. Against the democratic government of the Spanish people Franco has raised the standard of revolt. International Fascism is pouring men and money in aid of the rebels. Moors and foreign legionaries are sweeping over the beautiful plains of Spain, trailing behind them death, hunger and desolation. …
Madrid, the proud centre of culture and art is in flames. Her priceles trseasures of art are being bombed by the rebels, Even hospitals and creches are not spared. Women and children are murdered, made homeless and destitute. …
The devastating tide of International Fascism must be checked. In Spain this inhuman recrudescence of obscurantism, of racial prejudice, of rapine and glorification of war must be given the final rebuff. Civilisation must be saved from its being swamped by barbarism. …
At this hour of the supreme trial and suffering of the Spanish people, I appeal to the conscince of humanity. …
Help the peoples’ front in Spain, help the Government of the people, cry in million voices ‘Halt’ to reaction, come in your millions to the aid of democracy, to the succour of civilisation and culture.
[‘The Statesman’, 3rd March, 1937]
এর কয়েকদিন পর– ১১ই মার্চ (১৯৩৭) যুদ্ধ ও ফ্যাসি-বিরোধী সংঘের উদ্যোগে কলকাতায় এলবার্ট হলে স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকারের সাহায্যের আবেদন জানিয়ে এক বিরাট জনসভা হয়। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অধ্যাপক সুরেন গোস্বামী, অধ্যাপক হীরেন মুখোপাধ্যায়, গুণদা মজুমদার, ডাঃ রামমনোহর লোহিয়া প্রমুখ সংঘের কর্মকর্তারা স্পেনের ফ্যাসি-বিরোধী সংগ্রামের তাৎপর্যটি ব্যাখ্যা করে স্পেন-সাহায্য-তহবিলে দেশবাসীকে অকাতরে সাহায্য করবার আবেদন জানান। সরোজিনী নাইডু সভায় সভানেত্রীর আসন গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর ভাষণের শুরুতেই বলেন :
“স্পেনের শোচনীয় অবস্থা সম্পর্কে আজ এই সভা আহূত হইয়াছে; আজকাল প্রায়শই জিজ্ঞাসা করা হইয়া থাকে, আমরা নিজেদের সংগ্রাম লইয়া ব্যস্ত, আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক কলহ বর্তমান রহিয়াছে এবং এই সাম্প্রদায়িক কলহকে অন্তর্বিপ্লব বলা যাইতে পারে– আমরা কেন এই দূরদেশস্থ স্পেনবাসীর জন্য শক্তিক্ষয় ও সহানুভূতি প্রকাশ করিতে যাই? আমরা ঐ সুদূর সমুদ্রতীরবর্তী অজ্ঞাত, অখ্যাত ও মধ্যযুগীয় একটা দেশের জন্য– যে-দেশের আধুনিক ইতিহাসে কোনো মূল্য নাই– যে-দেশে আমেরিকার পরিব্রাজকগণ নানা দৃশ্য ও ষাঁড়ের লড়াই দেখিতে যায়– সেই দেশের ব্যাপার লইয়া আমরা কেন এত মাথা ঘামাইব? কিন্তু কে ভাবিয়াছিল যে এই ক্ষুদ্র দেশটিতে, যে-দেশ পৃথিবীর আধুনিক যুগের ভাবধারার প্রভাব হইতে সর্বদাই বহুদূরে দাঁড়াইয়া থাকিত, সেই দেশে দুই বিরুদ্ধ শক্তির সংগ্রাম দেখা দিবে। কে ভাবিয়াছিল যে, ইহা চক্ষের পলকে এখন দুই বিরুদ্ধ শক্তির সংগ্রামের কেন্দ্রস্থল হইয়া দাঁড়াইবে, যাহাদের মধ্যে ভারতবাসীকেও অবশ্যই একটি বাছিয়া লইতে হইবে। আমি সর্বদাই এই কথা বলিয়া থাকি যে, যেখানে– যে-সংগ্রামে গণতন্ত্রের নীতি ও অধিকার বিপন্ন সে-সংগ্রাম পৃথিবীর যে কোনও স্থানেই হউক না কেন তাহা হইতে ভারত কখনও বিচ্ছিন্ন ও নিস্পৃহ থাকিতে পারে না। এই জন্যই আমরা আজ এইখানে সমবেত হইয়াছি; সমবেত হইয়াছি এই জন্য নয় যে, স্পেন আমাদের সাহায্যের জন্য আবেদন জানাইয়াছে। পরিশেষে স্পেনের ভাগ্যে যাহাই থাকুক না কেন সেই ভাগ্যের সহিত আমাদের ভাগ্যও জড়িত আছে বলিয়াই আমরা এখানে সমবেত হইয়াছি।
…যাহারা আজ গণতন্ত্রের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামরত, তাহাদের পশ্চাতে যে আমাদের সংঘশক্তি রহিয়াছে, এই কথা সামান্য অঙ্গুলি-সংকেতে জানাইয়া দেওয়াও আমি পণ্ডিত জওহরলালের মতো সম্মানের কাজ বলিয়া মনে করি। স্পেনের ভাগ্যে কি আছে তাহা লইয়াও আমি বিব্রত নই। আমি বিব্রত এইজন্য, সমগ্র ইয়োরোপ স্পেনের এই আন্তবিপ্লবের শোণিত-সমুদ্রে নিজেরই ভবিষ্যতের চিত্র দেখিতে উদ্যত।”
[‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ২৮শে ফাল্গুন, ১৩৪৩, ১২ই মার্চ, ১৯৩৭]
এই দিনই সভায় স্পেন-সাহায্য-তহবিলের উদ্বোধন হয়।
ঐ সময়ই কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল এবং League Against Fascism And War-এর সারা ভারত কমিটির উদ্যোগে স্পেন-সাহায্য কমিটি গঠিত হয়। স্পেনের সংগ্রামরত জনগণের জন্য সাহায্য সংগ্রহ এবং এই সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য ও শিক্ষাটি জনসাধারণের মধ্যে ব্যাখ্যা করবার উদ্দেশ্যে বাংলা কমিটি কলকাতায় একসপ্তাহব্যাপী সভা-সমিতি-মিছিলের কার্যসূচী গ্রহণ করেন। ১২ এপ্রিল (১৯৩৭), বঙ্গীয় স্পেন-সাহায্য কমিটির উদ্যোগে কলেজ স্কোয়ারে ‘স্পেন-সপ্তাহের’ প্রথম দিবস উপলক্ষে এক বিরাট জনসভা হয়। ‘বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘের’ সম্পাদক সুরেন গোস্বামী সভায় সভাপতিত্ব করেন। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গুণদা মজুমদার প্রমুখ কমিটির নেতৃস্থানীয়দের কয়েকজনই সভায় বক্তৃতা করেন। পরদিন ওয়েলিংটন স্কোয়ারে দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন হয়। কলকাতার ছাত্র ও যুবসমাজ এবং আগুয়ান শ্রমিকশ্রেণিই এই আন্দোলনে যে গৌরবজনক ভূমিকা গ্রহণ করেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বলা বাহুল্য, স্পেনের ব্যাপারে দীর্ঘকাল ভারতে এই আন্দোলন চলেছিল। শুধু আবিসিনিয়া ও স্পেনের ক্ষেত্রেই নয়, এর অনতিকাল পরে ফ্যাসিস্ট শক্তি যখন চিন, সুদেতন ও চোকোশ্লোভাকিয়া আক্রমণ করে তখনও রবীন্দ্রনাথ এবং এই ‘যুদ্ধ ও ফ্যাসি-বিরোধী সংঘই’ তার প্রতিবাদে দেশে প্রবল আন্দোলন চালিয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র:
১. ৩০শে জানুয়ারী (১৯৩৭) শনিবার কলকাতা ‘মহৎ আশ্রমে’ বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘের উদ্যোগে Ralph Fox-এর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে এক জনসভা হয়। সত্যেন মজুমদার, অধ্যাপক হীরেন মুখোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, প্রবোধ সান্যাল প্রমুখ বিভিন্ন বক্তা তাঁর মহান আত্মদান ও সাহিত্যকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেন।
[দ্র. ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ৩রা ফ্রেব্রুয়ারি, ১৯৩৭]
[রচনাটি “লেখা ও রেখা” পত্রিকার শ্রাবণ-আশ্বিন, ১৩৭৫ সংখ্যায় প্রকাশিত। লেখকের বানানরীতি বজায় রাখা হয়েছে।]