নিম্নবর্গের সাহিত্য ও ফ্যাসিবাদী গোসা

সীমন্ত নন্দী

বাংলা সাহিত্যে ছোটোগল্পের ধারার প্রকৃত সূচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাধ্যমে ঘটে। তাঁর গল্পে উচ্চবর্ণের দ্বারা নিম্নবর্ণের উপর শোষণকে উপজীব্য করে কিছু রচনা তৈরি হলেও, সেই গল্পগুলোতে জীবন্ত নিম্নবর্গ শ্রেণির চরিত্রগুলি খুব কমই পাওয়া যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকরা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন, যেখানে নিম্নবর্গ শ্রেণির চরিত্রগুলি বেশি করে উপস্থিত হয়। বলা হয়ে থাকে যে বাংলা ছোটোগল্পে প্রথমবারের মতো নিম্নবর্গ শ্রেণির চিত্র তুলে ধরেন শৈলজানন্দ তাঁর ‘মা’ (১৩৩০) গল্পে, যা একজন সাঁওতাল যুবকের কুলি হয়ে ওঠার কাহিনি। কল্লোল গোষ্ঠীর উপস্থিতির দুই দশক পরে মহাশ্বেতা দেবী ‘ঝাঁসির রাণী’ (১৯৫৬) লিখে বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন। সময়ের সাথে সাথে তাঁর লেখনী আরও শক্তিশালী হয় এবং সামাজিক অভিজ্ঞতা ও সহানুভূতি দিয়ে তিনি উপন্যাসের বিষয়বস্তুকে বৈচিত্র্যময় করে তোলেন। ইতিহাসচেতনা, মধ্যবিত্ত জীবনের অনুসন্ধান, আদিবাসী শোষণ, বিদ্রোহ এবং কৃষকের ভূমি আন্দোলন তাঁর রচনায় স্থান পায়। 

মহাশ্বেতা দেবীর অন্যতম শক্তিশালী গল্প হল ‘দ্রৌপদী’, যেখানে আদিবাসী ও নিম্নবর্গ শ্রেণির শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে গল্পের কাঠামো গড়ে উঠেছে। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র দ্রৌপদী, যিনি সাঁওতাল উপজাতির বিদ্রোহের প্রতিনিধি। তিনি এবং তার স্বামী দুলন, মহাজন ও শোষক শ্রেণির প্রতিনিধি সূর্য শাহু ও তার ছেলেকে হত্যার অভিযোগে সমস্ত পুলিশ বিভাগ, বিশেষ করে ক্যাপ্টেন অর্জন সিং-এর কাছে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হয়ে ওঠেন। গল্পে পুলিশ ইউনিফর্ম পরা দুই সদস্যের সংলাপে উল্লেখ করা হয় যে দ্রৌপদী একজন ‘মোস্ট নটোরিয়াস’ নারী। ১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন অর্জন সিং-এর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর ‘বাকুলি অপারেশন’ থেকে পালাতে সমর্থ হন দ্রৌপদী ও তাঁর স্বামী। কিন্তু পরবর্তীতে স্বজাতি দুখীরামের বিশ্বাসঘাতকতায় দুলন পুলিশের হাতে নিহত হয় এবং দ্রৌপদী একাই সংগ্রাম চালিয়ে যান। তবে, সহকর্মী সোমাই ও বধুনার বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি বেশিদিন আত্মগোপনে থাকতে পারেন না। এক সময় তাঁকে পুলিশের জালে ধরা পরতে হয়।

দ্রৌপদী গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁকে বর্বরভাবে ধর্ষণ করা হয়। মহাশ্বেতা দেবী তাঁর নগ্ন দেহের প্রতিটা ক্ষতচিহ্নের বিস্তারিত বর্ণনা দেন– রক্তে ভেজা যোনি, এবং আহত স্তন। এরপরও দ্রৌপদী চুপ থাকে এবং সেনাপতির সামনে উলঙ্গ অবস্থায় হাসি মুখে দাঁড়ায়। এই হাসি এতটাই তীব্র যে পাঠককে থামতে এবং মহাভারতের দ্রৌপদী চরিত্রের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মহাভারতে যখন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করা হয়, তখন শ্রীকৃষ্ণের সাহায্য এসে পৌঁছায়। কিন্তু মহাশ্বেতার গল্পের দ্রৌপদীর কোনো কৃষ্ণের প্রয়োজন হয়নি। মহাশ্বেতা দেবী এখানে ‘পুরুষ নারীর রক্ষক’ এই ধারণার উপর কঠোর আঘাত হেনেছেন।

এই লেখায় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সিলেবাসে ১৯৯৯ থেকে পাঠ্য ছিল। সম্প্রতি ‘ওভারসাইট কমিটি’ বিনা নোটিশে এই গল্পটিকে সিলেবাসের ‘কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক’ থেকে বাদ দিয়েছেন। সেইসঙ্গে দুই দলিত লেখিকা, বামা ফাউস্তিনা সুসাইরাজ এবং সুকির্থারানি, কোনও সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই সিলেবাস থেকে বাদ পড়েছেন এবং তাদের জায়গায় উচ্চবর্ণীয় লেখিকা রমাবাই স্থান পেয়েছেন। এতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের ১৫ জন সদস্য তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, এটি শিক্ষাক্ষেত্রের বিরুদ্ধে ‘ম্যাক্সিমাম ভ্যান্ডালিজম’। যৌথ বিবৃতিতে তারা উল্লেখ করেছেন যে ওভারসাইট কমিটি দলিত, আদিবাসী, নারী এবং যৌন সংখ্যালঘুদের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করছে এবং এই গোষ্ঠীগুলির প্রতিনিধিকে সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছে। সমালোচনার আরও একটি বিষয় হল যে, ওভারসাইট কমিটিতে কোনো দলিত বা আদিবাসী প্রতিনিধি নেই, যারা এ ধরনের সংবেদনশীল বিষয়গুলি বুঝতে সক্ষম। এই প্রথমবার নয়, কমিটি সরকারি ক্ষমতায় সংঘ পরিবারের আদর্শ অনুসরণকারী ভারতীয় জনতা পার্টি আসার পর থেকেই তাদের দক্ষিণপন্থী মনোভাব প্রকাশ করেছে। ২০১৯ সালে, তারা একটি ইংরেজি সিলেবাস থেকে ‘মানিবেন আলিয়াস বিবিজান’ পাঠ্যটি বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছিল, কারণ এতে গুজরাট দাঙ্গার জন্য বজরং দলকেই দায়ী করা হয়েছিল। তারা নন্দিনী সুন্দরের লেখা একটি বইয়ের অংশ পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু অ্যাকাডেমিক কমিটির আপত্তির কারণে তা সম্ভব হয়নি।

কেন্দ্রীয় সিলেবাস থেকে দলিত, আদিবাসী, নারী, যৌন সংখ্যালঘু এবং ধর্মনিরপেক্ষ ধারণার জোরপূর্বক অপসারণ আসলে সংঘ পরিবারের নতুন ভারত নির্মাণের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আরএসএস প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই একটি মনুবাদী সংগঠন, যারা ভারতের সংবিধানে প্রদত্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের ধারাকে অস্বীকার করে আসছে। তারা সংবিধানকে বাতিল করে ‘মনুসংহিতা’-কে ভারতের স্বাভাবিক ‘হিন্দু আইন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, সংবিধান পাস হওয়ার ঠিক পরদিন, আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এ সংবিধানের তীব্র সমালোচনা করে উল্লেখ করে যে, সংবিধানে ভারতীয় ঐতিহ্য, আইন এবং ভাষাকে সঠিকভাবে স্থান দেওয়া হয়নি। বিনায়ক দামোদর সাভারকর এই অভাবটি উল্লেখ করে বলেছেন যে ভারতবাসী যুগ যুগ ধরে মনুস্মৃতিকেই ‘ভারতীয় আইন’ হিসেবে গ্রহণ করেছে। যখন আম্বেদকরের নেতৃত্বে সংবিধান কার্যকর হয়, তার পরদিন ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকায় আরএসএস তাত্ত্বিক শংকর শুভ আইয়ার লেখেন যে, এমনকি অবিশ্বাসী হিন্দুরাও জীবনের কোনো-না-কোনো ক্ষেত্রে মনুস্মৃতির বিধান মেনে চলে।

‘দ্রৌপদী’ গল্পটিকে বাতিল করার পেছনে কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে যে এতে হিন্দু ধর্মের অপমান করা হয়েছে, এবং ‘দ্রৌপদী’ নাম ব্যবহার করে হিন্দু পুরাণকে অবমাননা করা হয়েছে। এই ‘অপমান’ এবং ‘অবমাননা’-র পেছনের সত্যিকার কারণ খুঁজে দেখা গুরুত্বপূর্ণ। 

‘দ্রৌপদী’ গল্পটি সমাজের বাবু শ্রেণি ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর মধ্যেকার সংগ্রামের কথা তুলে ধরছে। সংবিধানের সংস্থান অনুযায়ী দেশের প্রতিটি মানুষের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সমান মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হলেও দ্রোপদীদের মতো সাঁওতাল আদিবাসীদের ভাষাকে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ বাবু-বিবিরা বোঝেন না বা বুঝতে চান না। বরং তারা তা অবজ্ঞা করে। বাবু-বিবিদের বেশিরভাগই উচ্চবর্ণের হওয়ায় প্রশাসনে উচ্চবর্ণীয় সংস্কৃতি প্রভাবশালী এবং নিম্নবর্গের প্রতিনিধিত্বের অভাব স্পষ্ট। উচ্চবর্ণের ভাষা এই জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা নরেন্দ্র মোদির ‘ওয়ান নেশন, ওয়ান ইন্ডিয়া’ নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আরএসএস-এর ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ ধারণা এই ঐক্যের প্রচেষ্টায় বিভাজন সৃষ্টি করছে। দ্রৌপদী গল্পের বাদ পড়া দেখাচ্ছে কীভাবে দীর্ঘদিন ধরে বাবু-বিবিদের হিন্দি বা ইংরেজি জনগোষ্ঠীর ভাষার উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, ফলে অনেক ভাষা বিলুপ্তির পথে।

‘দ্রৌপদী’ আসলে এ পার্থক্যগুলি এবং প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আতঙ্কের মূল কারণগুলি চিহ্নিত করে। প্রচারিত হয় যে দেশে কোনো ‘জাতীয়’ ভাষা নেই, অথচ আড়ালে জনগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতিকে নির্মূল করা হচ্ছে। ‘দ্রৌপদী’ ছোটোগল্পটি সমাজের কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রাখে। আমাদের আর-একবার করে দেশ, কাল, সময়, সমাজ, মানুষ– সবকিছুকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেং সে ভাবনা কী এতই বিপজ্জনক?

গেরুয়া রং শক্তি ও সাহসের প্রতীক হলেও, গেরুয়াকরণ নিয়ে এত অস্বস্তি কেন? এই প্রশ্নটি আজ সাধারণ মানুষের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। সমস্যার মূল আসলে উদ্দেশ্য ও ভাবাদর্শে। ২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, ভারতের বিদেশ মন্ত্রক ‘অখণ্ড মানবতাবাদ’ শিরোনামের একটি ই-বুক প্রকাশ করে, যা জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা ও আরএসএস-এর প্রধান চিন্তাবিদ দিনদয়াল উপাধ্যায়ের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রকাশ করা হয়। এতে হিন্দু ভাবনাকে ভারতের ভাবনা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা বিজেপির রাজনৈতিক দলীয় মতাদর্শ। এই বই প্রকাশের সময় তৎকালীন মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ভারতের জন্য একমাত্র বিকল্প হিসেবে বিজেপির কথা বলেছিলেন। সমস্যার মূল হল, এই লেখনীর মাধ্যমে বিজেপির মতাদর্শকে ভারতের ভাবাদর্শ হিসেবে প্রচার করা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক মতামতকে অস্বীকার করার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা। ভারত বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, সর্বজনীনতা, এবং অন্তর্ভুক্তিতে বিশ্বাস করে। সংবিধানে জাতিগত বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও ধর্মনিরপেক্ষতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু যখন প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফরে গিয়ে বা বিদেশি প্রতিনিধিদের গীতা উপহার দেন, তখন গেরুয়াকরণের উদ্দেশ্য ও ভাবাদর্শ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রধানমন্ত্রী তার একমুখী ধর্মীয় ভাবনা সরকারি অর্থ ব্যবহার করে প্রসারিত করছেন বলেও মনে করা হয়।

বিজেপি ভারতের ইতিহাসকে নতুনভাবে লেখার চেষ্টা করছে, যা আসলে গেরুয়াকরণের ইতিহাস হবে। এ কারণেই তারা কেন্দ্রীয় স্কুলপাঠ্য বইয়ের সমাজ বিজ্ঞানের সিলেবাস থেকে গান্ধির হত্যা, আরএসএসের নিষিদ্ধকরণ, ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গার মতো বিষয়গুলো বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। এনসিইআরটি ‘Democracy and Diversity’, ‘Popular Struggles and Movements’, ‘Challenges to Democracy’ প্রভৃতি অংশও বাদ দেয়ার কথা বলেছে। পাঠ্যক্রমের অতিরিক্তভারের অছিলায় ডারউইনের তত্ত্বসহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ধারণা বাতিল হয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আম্বেদকর, গান্ধি, ইকবালসহ সংবিধানের কিছু অংশ এবং দলিত লেখকদের লেখা ইংরেজি সিলেবাস থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। একইভাবে ভারতের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস তাদের নিজস্ব যুক্তি দিয়ে পরিবর্তন হচ্ছে। তাদের আদি গুরু সাভারকারকে অন্তর্ভুক্ত করার অনুমোদন দেখা যাচ্ছে।

ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন আনা কঠিন। কিন্তু সিলেবাসে রাজনৈতিক মতাদর্শ গুঁজে দেওয়া খুবই সহজ। কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যে পরীক্ষানিরিক্ষা শুরু করেছে, তার প্রভাব আজ দেখা যাবে না। কিন্তু কয়েকদশক পর একটা আস্ত প্রজন্মকে এর জন্য ভুগতে হবে। ভারতের সংবিধানের ৪২ নম্বর ধারা শিক্ষা বিষয়ে আলোচনা করে। ভারত একটি ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর রাষ্ট্র, যেখানে রাজ্য ও কেন্দ্রের জন্য কিছু ক্ষমতা নির্ধারিত আছে। সংবিধান এই ক্ষমতাগুলিকে ভাগ করে দিয়েছে। ৪২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে যে শিক্ষা রাজ্যের বিষয়। তাই প্রতিটি রাজ্য তাদের নিজস্ব শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করতে পারে, যা নির্দিষ্ট কমিটির মাধ্যমে সরকারের কাছে পৌঁছায়। ১৯৭৬ সালে এই ধারায় সংশোধন এনে শিক্ষা যৌথ বিষয় বা কনকারেন্ট লিস্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্যের সমানাধিকার বজায় থাকে। এর উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্র ও রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা।

মহাশ্বেতা দেবী দীর্ঘদিনের স্থবিরতাকে ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন, একেবারে নিঃসংশয়ে। তিনি যেন একটি শক্ত আঘাত করেছিলেন সমাজের উপর। গ্রাম ভারত পুনরায় তার পুরানো চেহারা নিয়ে ফিরে আসে। যখন বাংলার গল্প ও উপন্যাসগুলো প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছিল, সেখানকার মানুষের মুখ ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে পড়ছিল, তখন গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে মহাশ্বেতা দেবী বালিগঞ্জ স্টেশন রোডের বাড়ি থেকে নীচে নেমে এসেছিলেন বাংলার পথে, ভারতের মাটিতে। তিনি নিজেই বলতেন, ‘মানুষের কাছে যাও। মানুষকে নিয়েই লিখো।’ তাঁর গল্পের বিষয়বস্তুতে ছিল নানা শ্রেণির মানুষ। আজও তিনি বেঁচে আছেন বীরসার দেশে, ছত্রিশগড়ের অরণ্যে, সিংভূমের পাহাড়ে কিংবা ভাগনাডিহির প্রান্তরে।

উগ্র হিন্দুত্ববাদের মধ্যে দেশীয় উৎসের পাশাপাশি বিদেশি প্রভাবকেও বোঝা প্রয়োজন। ১৯৩০-এর দশকে, হিন্দু জাতীয়তাবাদ ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদ থেকে সরাসরি অনুপ্রাণিত হয়ে ‘অপর’ মানুষদের ‘শত্রু’ হিসেবে দেখতে শুরু করে। এই সময়ের নেতারা বারবার মুসোলিনি ও হিটলারসহ ফ্যাসিস্ট শাসক এবং তাঁদের সমাজব্যবস্থার প্রশংসা করেছিলেন। এই ধারা আজও বজায় রয়েছে। ফলে, ভারতীয় সমাজে উদ্‌বেগের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে। ফ্যাসিস্ট প্রবণতা রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে শিকড় গাড়তে ব্যস্ত এবং পাশাপাশি মৌলবাদী আদর্শকে বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। জাতীয়তাবাদকে ফ্যাসিবাদের সর্বগ্রাসিতার সাথে মিশিয়ে এমন এক মানসিকতা তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে, যেখানে বিভেদের বিষবৃক্ষ যত্নসহকারে লালন করা হচ্ছে।

সিলেবাস কমিটি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক এবং উচ্চবর্ণ কেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ কায়েমের মধ্য দিয়ে সংঘ পরিবার স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে তাদের আর মুখোশ পরে থাকার প্রয়োজন নেই। তারা তাদের প্রকৃত চেহারা প্রকাশ্যে আনতে কোনো দ্বিধা বোধ করছে না।

তথ্যসূত্র:

‘গেরুয়া দুঃস্বপ্ন: ফ্যাসিবাদ বিরোধী ইসতেহার,’ অর্ণব সাহা, হাওয়াকল পাবলিশার্স, কলকাতা বইমেলা, ২০২৪

‘গ্রামশির চিন্তা’, ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, পি গোবিন্দ পিল্লাই, ভাষান্তর: সৌভিক ঘোষ, মার্ক্সবাদী পথ, কলকাতা, জানুয়ারি, ২০২৩

‘পড়াশোনায় জলাঞ্জলি’, ভারতের ছাত্র ফেডারেশন: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আঞ্চলিক কমিটি, কলকাতা, নভেম্বর, ২০২২

‘অপর: লেখা ও কথার সংকলন’, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, অনুস্টুপ প্রকাশনী, কলকাতা, ফেব্রুয়ারি, ২০২২

‘প্রতিবাদী আদিবাসী ও শোষিত অন্ত্যজ নারী: মহাশ্বেতা দেবীর গল্পে’, কৌশিকোত্তম প্রামানিক, International Research Journal of Interdisciplinary & Multidisciplinary 

‘Studies ‘(IRJIMS), Volume-II, Issue-IV, May 2016, Page No. 14-20, Scholar Publications, Karimganj

‘দ্রৌপদী’, মহাশ্বেতা দেবী, আপানপাঠ ওয়েবজিন, সেপ্টেম্বর, ২০২১

‘একে নারী, তায় সাঁওতাল, তায় নকশাল– ‘দ্রৌপদী’ বিপজ্জনক না হয়ে পারে’, পীযূষ দত্ত, চার নম্বর প্লাটফর্ম ওয়েবপত্র, সেপ্টেম্বর, ২০২১

‘শিক্ষায় গেরুয়াকরণের শিকার মহাশ্বেতা দেবী’, মৃণালকান্তি দাস, বর্তমান পত্রিকা

‘সরকার বদলালে সিলেবাসও বদলায়, জানে ভারত’, গৌতম হোড়, DW, ২০২৩

‘হিন্দুত্ববাদ-ফ্যাসিবাদ যোগাসাজশ ১৯৩০-র দশক’, মারিয়া কাসোলারি, অনুবাদক: শুভাশিস ঘোষ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, জানুয়ারি, ২০০১

‘Gruesome sexual content, Army in poor light’– why DU removed 3 English texts from syllabus, Soniya Agarwal, August, 2021

‘DU Syllabus Row: Political Tension and Ideological Warfare’, DU beat, 2019

‘Casteist Censorship or Academic Healing?’, DU beat, 2021

‘Our History, Their History, Whose History?’, Romila Thapar, Seagull Books, 2023

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান