পৃথ্বীরাজ সাহা
ভূমিকা— ফ্যাসিবাদ আজ?
আজকের পরিপ্রেক্ষিতে যদি ফ্যাসিবাদ নিয়ে ভাবতে হয়, কয়েকটি সুপরিচিত চিত্রের আগমন অবশ্যম্ভাবী— কোনও এক লৌহমানবের দাম্ভিক উপস্থিতি, কোনও এক সর্বগ্রাসী শাসনের অবিরাম উপদ্রব, কোনও এক ক্ষমতার নগ্ন আগ্রাসন, কোনও এক জাতির দ্বারা ‘অপর’ জাতির নির্লজ্জ শোষণ, এবং সর্বোপরি, ইতিহাসের কোনও এক কলঙ্কিত অধ্যায়। ফ্যাসিবাদের আলোচনায় এই ‘এক’-এর গুরুত্ব অপরিসীম, এই ‘এক’-এর প্রাধান্যের উপরেই প্রোথিত রয়েছে ফ্যাসিবাদের প্রচলিত চিত্র-সমূহ। সমাজ মননে ধারণার ভেকধারী শিল্পীর তুলির টানে ফুটে ওঠা এই চিত্র-সমূহকে আমরা নস্যাৎ করতে পারি না, কারণ যাহা দৃশ্যমান, তাহা সর্বগ্রাহ্য সত্য রূপেই সাধারণত প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু চোখে বিশ্লেষকের চশমা তুলে নিলে আবার শুধু দৃশ্যের আলোয় (অথবা অন্ধকারে) মোহিত হয়ে থাকাও সমুচিত ঠাউর হয় না। তখন কর্তব্য হয়ে ওঠে দৃশ্যমানতার ঊর্ধ্বে গিয়ে শিল্পীর সেই তুলির টানগুলিকে শনাক্ত করা, যার দ্বারা দৃশ্যপট নির্মিত হয়েছে। তখন যাত্রাপথ হয়ে দাঁড়ায় উপস্থিতি থেকে উত্থানের দিকে গমন করার।
এই প্রবন্ধও কিছুটা সেই পথেই এগোবার চেষ্টা করবে, যে পথে ফ্যাসিবাদের প্রচলিত ছবিগুলির উপস্থিতির ঊর্ধ্বে গিয়ে তার উত্থানের প্রক্রিয়ার আলোচনা করা হবে। তবে ফ্যাসিবাদের উত্থানের যে আলোচনা আমরা এই প্রবন্ধে করব, তা পূর্ণাঙ্গ রূপেই একটি তাত্ত্বিক আলোচনা, যেখানে ইতিহাস অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে, কিন্তু তা একেবারেই তত্ত্বের সহায়ক রূপে। ফ্যাসিবাদের উত্থানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এই প্রবন্ধের উদ্দ্যেশ্য নয়। বরং ফ্যাসিবাদের উত্থানের বৃহত্তর তাত্ত্বিক আঙ্গিকে যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলির উত্তর আমরা খোঁজার চেষ্টা করব সেগুলি হল— ফ্যাসিবাদের উত্থান তথা প্রসার কী প্রকারে সম্ভব হয় এবং আজকের যুগে তার নবরূপকে কীভাবে ভাবা যায়?
একবিংশ শতাব্দীর সমাজ গবেষণার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলির সম্মুখীন না হলে ফ্যাসিবাদ জড়িত কোনও আলোচনাই এগিয়ে নিয়ে চলা সম্ভব নয়। এই প্রশ্নগুলির সম্মুখীন হওয়ার লক্ষ্যে আমাদের সূচনাভূমি হবে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। কীভাবে অর্থনীতির সাথে ফ্যাসিবাদ ওতপ্রোতভাবে লিপ্ত থেকেছে, এবং কীভাবে আজকের প্রেক্ষিতে প্রযুক্তি সেই সম্পর্কের এক অন্যতম স্তম্ভ রূপে প্রকাশ পাচ্ছে, তার তত্ত্বায়নই এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য। এই তত্ত্বায়নের যাত্রায় প্রথমে আমরা ফ্যাসিবাদের বিদ্যমান তত্ত্বগুলির উপর আলোকপাত করব। অর্থনীতির সাথে ফ্যাসিবাদের সম্পর্কের তত্ত্বায়ন হবে আমাদের দ্বিতীয় পদক্ষেপ; শেষে আমরা দেখাব আজকের দিনে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অর্থনীতির সাথে ফ্যাসিবাদের মেলবন্ধন কীভাবে নবরূপে প্রকাশিত হচ্ছে।
ফ্যাসিবাদের তত্ত্ব : একটি পর্যালোচনা
বলা বাহুল্য যে ফ্যাসিবাদ একটি বহুস্তরীয় এবং অত্যন্ত বিতর্কিত রাজনৈতিক মতবাদ, যা ব্যাখ্যা করার জন্য বিভিন্ন তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে।১ সময়ের সাথে গবেষকরা এর উৎস, বৈশিষ্ট্য এবং জনপ্রিয়তার কারণগুলোকে নানা দৃষ্টিকোণ (অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, সমাজবৈজ্ঞানিক) থেকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। এই বিবিধ তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন দিককে আলোকিত করে, তবে আমাদের মনে হয় না যে এর মধ্যে কোনও একক তত্ত্ব ফ্যাসিবাদের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে। এক প্রকার মার্কসীয় তত্ত্ব, যেমন অ্যান্তোনিয়ো গ্রামশি, জর্জি দিমিত্রভ এবং লিয়োন ট্রটস্কির কাজ, ফ্যাসিবাদকে প্রতিক্রিয়াশীল একটি আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে যা মূলত পুঁজিবাদী শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। এই দৃষ্টিকোণ অনুসারে, ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক সংকট এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের হুমকির প্রতিক্রিয়া হিসেবে উদ্ভূত হয়। এই ফ্রেমওয়ার্ক ফ্যাসিবাদের বস্তুগত ভিত্তি এবং শ্রেণি সংগ্রামের সাথে এর সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। এটি দেখায় কীভাবে এলিট তথা পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি শ্রমিক আন্দোলন দমন করতে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ফ্যাসিবাদী শাসনকে সমর্থন করেছে। তবে, এই দৃষ্টিভঙ্গি অতিমাত্রায় নির্ধারণবাদের দায়ে সমালোচিত হয়েছে, যা ফ্যাসিবাদকে শুধুমাত্র পুঁজিবাদের একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখে। অনেকের মতে এটি জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ এবং সামরিকবাদকে অবমূল্যায়ন করে, যা ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের কেন্দ্রীয় উপাদান। তদুপরি, কেন ফ্যাসিবাদ নন-এলিট জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল, তার ব্যাখ্যা এই তত্ত্বে কিছুটা অনুপস্থিত।
সেই প্রেক্ষিতে ফ্যাসিবাদকে বোঝার আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব, যা থিওডর অ্যাডোর্নো, ভিলহেলম রাইস এবং এরিক ফ্রম-এর কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই চিন্তাবিদরা ফ্যাসিবাদের জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তিত্ব, দমন করার আকাঙ্ক্ষা এবং ভিড়ের মনস্তত্ত্বকে চিহ্নিত করেন। রাইস, উদাহরণস্বরূপ, ফ্যাসিবাদের আকর্ষণকে যৌনদমন এবং পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক কাঠামোর সাথে যুক্ত করেন, যা কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য বাড়ায়। একইভাবে, অ্যাডোর্নোর অথরিটেরিয়ান পার্সনালিটি তত্ত্বটি প্রস্তাব করে যে, যারা কঠোর সাংগঠনিক প্রবণতা পোষণ করে, তারা ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট। মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব ফ্যাসিবাদ কেন বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমির লোকেদের আকৃষ্ট করে তা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে এবং প্রচার, ভয় ও আবেগের ব্যবহারের উপর গুরুত্বারোপ করে। তবে, এই তত্ত্বগুলোর সমালোচনা হয়েছে, কারণ এগুলো কাঠামোগত এবং ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর সাথে একটি দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করতে ব্যর্থ। এই দৃষ্টিভঙ্গি ফ্যাসিবাদকে ব্যক্তি-নির্ভর ব্যাখ্যায় সীমাবদ্ধ করার ঝুঁকি সৃষ্টি করে এবং বৃহত্তর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার গুরুত্বকে উপেক্ষা করে।
ফ্যাসিবাদের সাধারণ তত্ত্বগুলো, যেমন রজার গ্রিফিন, স্ট্যানলি পেইন এবং রবার্ট প্যাক্সটনের কাজ, এই মতাদর্শকে সংজ্ঞায়িত করতে এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। গ্রিফিন ফ্যাসিবাদকে “প্যালিনজেনেটিক আল্ট্রান্যাশনালিজম” হিসেবে বর্ণনা করেন, যা জাতীয় পুনর্জন্মের একটি কল্পিত দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে। প্যাক্সটনের পদ্ধতি ফ্যাসিবাদের বিকাশের বিভিন্ন ধাপকে তুলে ধরে, আন্দোলন থেকে শাসন ব্যবস্থায় পরিণত হওয়া পর্যন্ত। এই তত্ত্বগুলো বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিবাদী আন্দোলনগুলোর তুলনা করার জন্য একটি বিস্তৃত কাঠামো প্রদান করে। তবে, এই কাঠামোগুলো অতিমাত্রায় বিস্তৃত হওয়ার ঝুঁকি বহন করে, কারণ এটি বৈচিত্র্যময় আন্দোলনগুলিকে এককভাবে ফ্যাসিবাদ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। তদুপরি, এই তত্ত্বগুলো প্রায়ই ফ্যাসিবাদের আদর্শিক মূল সংজ্ঞায়িত করার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, কিন্তু এর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে না।
সাংস্কৃতিক এবং আদর্শিক তত্ত্ব, যা জিভ স্টার্নহেল, এমিলিও জেনটাইল এবং জর্জ মোসের মতো গবেষকদের দ্বারা প্রভাবিত, ফ্যাসিবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক শিকড়ের উপর জোর দেয়। এই চিন্তাবিদরা ফ্যাসিবাদের উৎস হিসেবে জাতীয়তাবাদ, রোমান্টিসিজম এবং অ্যান্টি-এনলাইটেনমেন্ট চিন্তাধারাকে চিহ্নিত করেন। জেনটাইল, উদাহরণস্বরূপ, ফ্যাসিবাদকে “রাজনৈতিক ধর্ম” হিসেবে বর্ণনা করেন, যুক্তি দেন যে এটি গণমানুষকে আচার-অনুষ্ঠান, মিথ এবং প্রতীকের মাধ্যমে সক্রিয় করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি ফ্যাসিবাদের আদর্শিক আকর্ষণ এবং সাংস্কৃতিক প্রভাবকে ধারণ করে, এটি কীভাবে জাতীয় মহত্ত্ব এবং পরিচয়ের মিথ ব্যবহার করে সমর্থন জোগাড় করেছিল তা ব্যাখ্যা করে। তবে, সাংস্কৃতিক তত্ত্বগুলোর সমালোচনা হয়েছে যে, এগুলো ফ্যাসিবাদের উত্থানের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মাত্রাগুলোকে অবমূল্যায়ন করে এবং পরিবর্তে বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের উপর গুরুত্বারোপ করে।
সমাজবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ফ্যাসিবাদকে বোঝার আর-একটি পদ্ধতি, যা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং ভিড়-সমাজের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। উদাহরণস্বরূপ, সেমুর মার্টিন লিপসেট যুক্তি দিয়েছেন যে ফ্যাসিবাদ সেই “র্যাডিকাল মধ্যবিত্ত” শ্রেণিকে আকর্ষণ করেছিল, যাঁরা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং তাঁদের সামাজিক মর্যাদা ক্ষয়ের জন্য এক প্রকার নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করেছিলেন। হান্না আরেন্ট দেখিয়েছেন কীভাবে ফ্যাসিবাদ বিচ্ছিন্ন সমাজে, যেখানে ব্যক্তি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান এবং সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন, সফল হয়েছিল। এই তত্ত্বগুলো নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক সংকটের মাধ্যমে সংঘটিত সামাজিক পরিবর্তনের সাথে ফ্যাসিবাদের সম্পর্ক স্থাপন করে। তবে, সমাজবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সমালোচনা হয়েছে যে, এগুলো প্রেক্ষাপটের জটিলতাগুলোকে সাধারণীকরণ করার ঝুঁকি তৈরি করে এবং ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থানে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক শর্তগুলোকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না।
অতএব আমরা যা দেখলাম, ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন তত্ত্ব তার বহুমুখী প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে, যা অর্থনৈতিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং আদর্শিক মাত্রাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত। এই বিভিন্ন তাত্ত্বিক অবস্থানের ফ্যাসিবাদ গবেষণায় গুরুত্ব আমাদের কাছে অপরিসীম, কারণ এই প্রতিটি অবস্থানই ফ্যাসিবাদের আলোচনার এক-একটি বিশেষ দিক আমাদের কাছে তুলে ধরেছে। তবে আমরা এও দেখলাম যে প্রতিটি তত্ত্ব মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করলেও, কোনও একক তাত্ত্বিক পদ্ধতি ফ্যাসিবাদের সম্পূর্ণ জটিলতাকে বিশ্লেষণ করতে অক্ষম। সেক্ষেত্রে একটি সমন্বিত বিশ্লেষণ-পদ্ধতির প্রয়োজন যা এই বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে একটি পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে নিয়ে আসতে পারে, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণকে সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সমাজবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সংযুক্ত করতে পারে এবং তদুপরি বিশ্লেষণ-পদ্ধতির ক্ষেত্রেও ‘এক’-এর ঊর্ধ্বে গিয়ে ভিন্নতা, বহুতা তথা বৈচিত্র্যের পাথেয় হতে পারে। এই প্রবন্ধের ভূমিকা আমাদের দেখায় যে ফ্যাসিবাদের প্রধান চিহ্নায়ক হল ‘এক’-এর প্রাধান্য। এই অ-ফ্যাসিবাদী আখ্যান লেখার প্রথম পদক্ষেপ তাই হবে বিশ্লেষণের পদ্ধতিগত ক্ষেত্রের এক-কেন্দ্রিক অদ্বৈতবাদী প্রবণতার ঊর্ধ্বে যাওয়া।
পরম পারস্পরিকতার দর্শনে ফ্যাসিবাদ ও অর্থনীতি— এক অনির্ধারণবাদী আখ্যান
এক-এর যুক্তির ঊর্ধ্বে গিয়ে ফ্যাসিবাদ ও অর্থনীতির আলোচনার জন্য আমরা এখানে পরম পারস্পরিকতার জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থানের উপস্থাপন করব। পরম পারস্পরিকতার জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থান স্টিফেন রেস্নিক এবং রিচার্ড উল্ফ কর্তৃক বিকশিত একটি সমালোচনামূলক পদ্ধতিগত এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক উদ্ভাবন যা তাদের ভিন্নধর্মী মার্ক্সীয় তত্ত্বকাঠামো স্থাপন করতে সাহায্য করে।২ আলথুসারের দ্বারা অনুপ্রাণিত পরম পারস্পরিকতার দর্শন সামাজিক ঘটনাবলির বোঝাপড়ার জন্য সংকীর্ণ এক-নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিকে নাকচ করে জানান দেয় যে প্রতিটি সামাজিক প্রক্রিয়া (অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক) একই সঙ্গে অন্যদের দ্বারা গঠিত এবং অন্যদের গঠনকারী। সনাতন মার্কসীয় কাঠামোর বিপরীতে, যা প্রায়ই অর্থনীতিকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে অন্যান্য ক্ষেত্রকে (যেমন রাজনীতি ও সংস্কৃতি) নির্ধারণ করে, পরম পারস্পরিকতার অবস্থান কোনও একক ক্ষেত্রের অগ্রাধিকারকে অস্বীকার করে। বরং এটি বলে যে সমস্ত প্রক্রিয়া জটিল এবং পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে সহ-নির্ধারিত। এই দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার আন্তঃসম্পর্ক বোঝার একটি সূক্ষ্ম পদ্ধতি প্রদান করে এক-ভিত্তিক সংকীর্ণতার এবং নির্ধারণবাদের সীমাবদ্ধতাগুলি সমাধান করতে চায়।
এই প্রবন্ধের ক্ষেত্রে পরম পারস্পরিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল এর সারমূলবাদের প্রত্যাখ্যান, যেখানে কোনও একক কারণ বা প্রক্রিয়া শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে না। বলা বাহুল্য যে এরকম জ্ঞানতাত্তিক অবস্থান ফ্যাসিবাদী দর্শনের থকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে বিচরণ করে। তাই ফ্যাসিবাদকে বুঝতে গেলে এই অবস্থান নেওয়া খুব একটা অনুচিত হবে না। ফ্যাসিবাদের সাথে লড়াই খালি মাঠে-ময়দানে নয়, ভাবনার জগতেও যে করতে হয়, সেটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। মার্কসের ‘থিসিস্ অন ফয়ের্বাকের একাদশতম থিসিস্’ তা আমাদের বারংবার স্মরণ করিয়ে দেয়— “দার্শনিকরা এতদিন পর্যন্ত কেবল বিভিন্ন উপায়ে পৃথিবীর ব্যাখ্যা দিয়েছেন; কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তা পরিবর্তন করা”।৩ সেই কারণে যখন আমরা অর্থনীতির সাথে ফ্যাসিবাদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব, তা পূর্বোল্লেখিত মার্কসীয় অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলির মতো নির্ধারণবাদী রূপ ধারণ করার চেষ্টা করবে না, বরঞ্চ পরিস্থিতি এবং সম্পর্কনির্ভরতার ওপর জোর দিয়ে এমন একটি কাঠামো সরবরাহ করার চেষ্টা করবে যা সমাজের বৈচিত্র্য এবং গতিশীলতাকে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম। পরম পারস্পরিকতার অবস্থান থেকে এই প্রবন্ধ যখন মার্কসীয় অর্থনৈতিক আঙ্গিকে ফ্যাসিবাদের তত্ত্বায়নে লিপ্ত হবে, তখন তা কখনই শুধুমাত্র অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং অন্যান্য সামাজিক প্রক্রিয়ার সম্পর্কের মধ্য দিয়েই তার অস্তিত্ব প্রকাশিত হবে। রেস্নিক ও উল্ফ–এর মার্কসীয় তত্ত্বের কাছে আমরা ঋণী কারণ পরম পারস্পরিকতার অবস্থান তাঁদের শ্রেণি নিয়ে সমালোচনার ভিত্তি তৈরি করে, যা তাঁরা কেবল এক সমসত্ত্ব গোষ্ঠী ভিত্তিক অর্থনৈতিক শ্রেণি হিসেবে নয়, বরং উদ্বৃত্ত শ্রম সম্পাদন, আহরণ (তথা বণ্টন ও প্রাপ্তি)-র একটি প্রক্রিয়া হিসেবে পুনর্নির্মাণ করেন, যা সামাজিক সম্পর্কের জালে গভীরভাবে প্রোথিত।৪
পূর্বোল্লেখিত মার্ক্সীয় তত্ত্বগুলি ফ্যাসিবাদকে পুঁজিবাদের স্বার্থরক্ষাকারী প্রতিক্রিয়াশীল একটি আন্দোলন হিসেবে বোঝার চেষ্টা করেছে। আমরা এই তত্ত্বগুলির মূল ভাবনার সাথে দ্বিমত পোষণ করব না, কারণ মুসোলিনি, হিটলার বা জেনারেল ফ্রাঙ্কোর ইতিহাস আংশিকভাবে এই তত্ত্বগুলির প্রস্তাবনার পক্ষেই কথা বলে। তবে আমরা অবশ্যই এই তত্ত্বগুলির প্রস্তাবিত সারমূলবাদী অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করব। আমাদের পরম পারস্পরিকতার জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থান থেকে, প্রথমেই অর্থনীতি এবং পুঁজিবাদের ধারণাটা বোঝা জরুরি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতি হল একটি বিকেন্দ্রীভূত-বিভক্ত ক্ষেত্র যেখানে বিভিন্ন প্রক্রিয়া— অর্থনৈতিক (শ্রেণি বা না-শ্রেণি), রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক— পরস্পরের গঠন প্রক্রিয়ায় জড়িত। যখন এই বিভক্ত ক্ষেত্রকে পুঁজিবাদ বলা হয়, তখন সেটি একটি বিশেষ অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে (পুঁজিবাদী শ্রেণি প্রক্রিয়াকে) আধিপত্যকারী ভূমিকায় স্থাপন করার কাজ।৫ গিব্সন-গ্রাহাম যেমন দেখান যে সামাজিক বাস্তবতার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী শ্রেণি প্রক্রিয়ার অবস্থান আদতে হিমশৈলের চূড়ামাত্র, তাই তা দিয়ে সামাজিক বাস্তবতার সম্পূর্ণ অনুধাবন অসম্ভব, তবুও তা করা হয়।৬
পুঁজিবাদী শ্রেণি প্রক্রিয়ার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গঠনে একটি অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য রয়েছে। একদিকে এর শোষণমূলক উৎপাদন প্রক্রিয়া, যা প্রত্যক্ষ উৎপাদকদের তাদের উদ্বৃত্ত শ্রমের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। অন্যদিকে এর বাজার কাঠামো, যা উদার গণতন্ত্রের প্রচারিত সাম্যের অধিকারের মাধ্যমে সকলকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে। এই বৈপরীত্য জনগণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের সম্ভাবনা উন্মোচন করে। অন্তর্ভুক্তির প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও জনগণ ধারাবাহিকভাবে বঞ্চনার নেতিবাচক প্রভাব বহন করে চলে। অর্থনৈতিক বঞ্চনা আবার রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের বঞ্চনার সাথে যুক্ত থাকে। এর ফলে একটি বিচ্ছিন্ন এবং অসন্তুষ্ট সমাজ তৈরি হয়, যা পুঁজিবাদের সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি থেকে প্রবঞ্চিত ও বৈষম্য, দারিদ্র্য এবং কল্যাণের অবনতির মতো সামাজিক সমস্যা দ্বারা জর্জরিত। পুঁজিবাদের অন্তরে সৃষ্ট এই অসন্তোষ থেকে জন্ম নেয় ক্রোধ, এবং তা তার সৃষ্টিকর্তা পুঁজিবাদের জন্যই এবার সংকটের পরিস্থিতি তৈরি করে, যা সামাল দেওয়া হয়ে ওঠে অনিবার্য। এই পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদ নামক পুঁজিবাদের (ক্ষমতাধরদের) বিকল্প চেতনা আবির্ভূত হয়, যা জনগণকে বিশ্বাস করায় যে উদার গণতন্ত্র পুঁজিবাদের প্রতিশ্রুত সমৃদ্ধির পথে অন্তরায়। এর পরিবর্তে লৌহমুষ্টির শক্তিশালী শাসন প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই লৌহমুষ্টির শাসন আর-একটি নতুন প্রতিশ্রুতি দেয়, আর-একটি নতুন আশা সৃষ্টি করে— তবে এবার সরাসরি কল্যাণ বা সমৃদ্ধির নয়, বরং জাতির ‘পুনরায় মহান’ হবার, যার দ্বারাই আসবে সুখ-সমৃদ্ধি। একইসঙ্গে, এই মহান হওয়ার প্রক্রিয়ার পরিপন্থী হতে পারে যে ‘অপর’-রা, তাদের চিহ্নিতকরণ হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী, যাতে তাদের নির্মূল করা যায়। সেদিনের মুসোলিনি-হিটলার-ফ্র্যাঙ্কো হন বা আজকের ট্রাম্প-এর্দোগান-বলসোনারো, ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উত্থানের তথা প্রসারের গল্প একই। ফ্যাসিবাদের উত্থান একটি দ্বিমুখী অস্ত্রের মতো কাজ করে। একদিকে, বিচ্ছিন্ন জনগণ জাতির সাথে একীকরণের অনুভূতি পায়, যা তাদের নিরাপত্তার ধারণা দেয়, উদার অর্থনীতির পোস্টারবয় রবিনসন ক্রুসোর একাকীত্বের বিপরীতে। অন্যদিকে, এই ক্রোধ এবং অসন্তোষকে ‘অপর’-দের প্রতি প্রবাহিত করার একটি সুযোগ তৈরি হয়। ফলে যা সামনে দৃশ্যমান হয় তা হল ফ্যাসিবাদ, কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে এবং টিকে থাকে সেই পুঁজিবাদের শোষণমূলক উৎপাদন প্রক্রিয়া। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষণ বজায় থাকে, কিন্তু এর কারণে তৈরি অসন্তোষ আর নিয়োগকর্তাদের দিকে প্রবাহিত হয় না। কারণ, এখন জনগণের সমষ্টিগত বিশ্বাস “জাতিকে পুনরায় মহান” করার প্রক্রিয়াকে এবং সেই প্রক্রিয়ার সাফল্যর মাপকাঠি রূপে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাই বছরের পর বছর বেকারত্বের হার বাড়লেও জনগণ জিডিপি বৃদ্ধিতে আনন্দিত হয়ে ওঠে,৭ মানবোন্নয়নের সমস্ত সূচক হ্রাসমান হলেও সামরিক সাফল্যর হাসি ফুটে ওঠে জনগণের মুখে, শাসকরা শ্রমদিবস বাড়ানোর প্রস্তাব অম্লানবদনে করেও প্রশংসার পাত্ররূপেই প্রতিষ্ঠিত হন। সেদিকে কোনও খেদ নেই, কারণ আপনার সামনে আছে একটি ‘অপর’— ইহুদি বা মুসলমান বা সমকামী বা অভিবাসী বা সংরক্ষিত দলিত— যার প্রতি আপনি সহজেই আপনার ঘৃণা তথা খেদ তথা রাগ প্রবাহিত করতে পারেন। এবং সেই অপরদের আভরণে কখন যে শ্রমিকের অধিকারের জন্য লড়তে থাকা ব্যক্তিরাও ঢুকে যান, তা আপনি ধরতেও পারেন না।
সনাতন মার্কসীয় তত্ত্বগুলি একটি পর্যায়ে ফ্যাসিবাদের পুঁজিবাদকে সহায়ক রূপে বোঝার ক্ষেত্রে যথার্থ ছিল। তবে সেখানের আলোচনা প্রধানত কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণি বা সমসত্ত্ব জনগোষ্ঠীর ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল এবং ফ্যাসিবাদের উত্থানের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ভিত্তিকে একটি নির্ধারক ভূমিকা প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু পরম পারস্পারিকতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা দেখাতে পারি যে এটি জনগোষ্ঠী হিসেবে শ্রেণির বিষয় নয়, বরং শ্রেণিকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বোঝার বিষয়, বিশেষত আজকের প্রেক্ষিতে পুঁজিবাদী শ্রেণি প্রক্রিয়া, যা ফ্যাসিবাদের উত্থানকে উদ্দীপিত করে। অন্যদিকে, এটি আবার কেবল অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার বিষয়ও নয়, কারণ ফ্যাসিবাদের উত্থান ও টিকে থাকার ক্ষেত্রে আস্থা এবং ঘৃণা সৃষ্টির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলি সমগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই প্রক্রিয়াগুলির শিকড় মনস্তত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান এবং রাজনীতির ডিসকোর্সে রয়েছে, যা আমরা আগেই দেখেছি। এবং মনে রাখতে হবে, এগুলি এমন প্রক্রিয়া যা পারস্পরিক গঠনক্রিয়ার মাধ্যমে একসঙ্গে কাজ করে, কোনো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য না দিয়ে। এই ধরনের বোঝাপড়া সম্ভব শুধুমাত্র পরম পারস্পরিকতার জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, যা এই বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে সম্পর্কস্থাপনের আখ্যান তুলে ধরে একটি সমন্বিত বিশ্লেষণ-পদ্ধতির প্রস্তাবনা করতে পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটি বিকল্প রাজনীতি পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শুরুতেই বলেছিলাম যে পুঁজিবাদ একটি আধিপত্যকারী বাস্তবতার উপস্থাপনা, যা প্রকৃতপক্ষে বিকেন্দ্রীভূত এবং বিভক্ত। পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ সংকট ফ্যাসিবাদের রূপ নেয়, কারণ কোথাও পুঁজিবাদ নিজেকে এমন একটি একক বাস্তবতার চূড়ান্ত পর্যায় হিসেবে উপস্থাপন করেছে, যা যে-কোনও মূল্যে রক্ষা করা আবশ্যক। কিন্তু এই আধিপত্যকারী উপস্থাপনা অন্য সমস্ত সম্ভাবনাগুলিকে প্রাক্রুদ্ধ করার বিনিময়ে ঘটে, যেগুলি বাস্তবে বিদ্যমান।৮ পরম পারস্পরিকতার দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে সেই সম্ভাবনাগুলি আমাদের সামনে উন্মুক্ত হয়। যখন এটি জনগণের জন্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, তখন তারা পুঁজিবাদের সংকট থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেতে ফ্যাসিবাদের লৌহমুষ্টির দিকে নয়, বরং কোনও উত্তর-পুঁজিবাদী লাল গোলাপের দিকে ঝুঁকতে পারেন।
ক্ষমতার প্রযুক্তি— প্রযুক্তির ক্ষমতা : ফ্যাসিবাদের নবরূপ
আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জড়িত শ্রেণি প্রক্রিয়া এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কীভাবে ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং তার টিকে থাকায় সাহায্য করে, যা আবার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখে। তবে মনে রাখতে হবে যে পুঁজিবাদী উৎপাদনের সামাজিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার একটি দিক যেমন হল তার সহায়ক রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং পারিপার্শ্বিক সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের কাঠামো, তেমন অন্যটি হল প্রযুক্তি। পুঁজিবাদের প্রসার বহুলাংশেই প্রযুক্তিগত বিপ্লবের দ্বারা ত্বরান্বিত হয়েছে। স্টিম ইঞ্জিনের যুগ থেকে সেই প্রসারের সঙ্গী হয়ে এখন আমরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে প্রযুক্তির সাম্প্রতিকতম নিদর্শন কল্পনা এবং বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য প্রকৃত অর্থেই মুছে ফেলার চেষ্টায় লিপ্ত। হ্যাঁ, আজ আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর যুগে পৌঁছেছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির একটি অভূতপূর্ব বিকাশ, যেখানে আমরা (অন্তত আংশিকভাবে) যন্ত্রকে কেবলমাত্র একটি উৎপাদনের সরঞ্জাম থেকে উৎপাদনের কারক রূপে অবতীর্ণ হতে দেখতে পাচ্ছি। এটি পুঁজিবাদের সাফল্যের সর্বোত্তম সহায়ক হিসেবেও প্রশংসিত হচ্ছে। তবে, এই অংশে আমরা এই সাম্প্রতিক প্রযুক্তিগত বিপ্লব সম্পর্কে একটি সতর্কবার্তা উত্থাপন করব, যা তার সম্ভাব্য ফ্যাসিবাদী প্রবণতাগুলিকে নির্দেশ করে। আমরা দেখব, কীভাবে আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ এই প্রযুক্তি ক্ষমতার সাথে আবদ্ধ হয়ে শক্তিশালীদের ক্ষমতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার সম্ভাবনা বহন করে, এবং তদুপরি ফ্যাসিবাদের নবরূপের দিশা দেয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফ্যাসিবাদী প্রবণতাগুলি মূলত ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক বিভাজনকে গভীরতর করার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেমগুলি বহুলাংশেই তাদের প্রশিক্ষণ-ডেটাসেটগুলিতে অন্তর্নিহিত পক্ষপাতমূলক তথ্যের উপর ভিত্তি করে কাজ করে, যা বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্যগুলোর স্বাভাবিকীকরণের পথ আরও প্রশস্ত করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, চাকরিতে প্রার্থী বাছাই, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ভবিষ্যদ্বাণীমূলক পদ্ধতি বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনেক সময় জাতি, লিঙ্গ এবং সামাজিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গি আরও জোরদার হয়, যা ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের সাথে মিলে যায়।৯ আরও গভীরভাবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার “সমাধানমূলক দক্ষতা” সমাজের জটিল সমস্যাগুলিকে ন্যায়বিচারের প্রশ্নের বাইরে সরিয়ে কেবলমাত্র দক্ষতার সমস্যায় পরিণত করে। এটি বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তির বিপরীতে নিয়ন্ত্রণ এবং আদর্শকরণের প্রবণতা তৈরি করে। ড্যান ম্যাককুইলানের বইয়ে আমরা দেখতে পাই কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা চালিত মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সামাজিক সমস্যাকে ন্যায়বিচারের চেয়ে কেবল অপ্টিমাইজেশনের সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, এবং কিছু পরিমাপযোগ্য মাপকাঠির মানদণ্ডে মূল্যায়িত হয়।১০ এইভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি প্রায়ই সামাজিক সমস্যা সমাধানের নামে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে, যা ফ্যাসিবাদী শাসনের একটি বৈশিষ্ট্য। একই সঙ্গে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা “অপর” সৃষ্টি করে সমাজের বিভাজন আরও গভীর করে। প্রেডিক্টিভ পলিসিং বা নজরদারি সিস্টেম ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কৃত্রিমভাবে একটি “ঝুঁকিপূর্ণ” শ্রেণি তৈরি করতে পারে, যেখানে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চিনে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত ফেসিয়াল রেকগ্নিশন সিস্টেম তার জলজ্যান্ত উদহারণ। এই পদ্ধতি ফ্যাসিবাদী শাসনের কাঠামোতে ব্যবহার করা যেতেই পারে “শত্রু” বা “অপর” সৃষ্টি করার জন্য, যার ফলে জনগণের ক্ষোভ ও বিদ্রোহ অন্যদিকে চালিত করা যায়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণে সহায়ক হতে পারে। নজরদারি সিস্টেম, গোপন তথ্য সংগ্রহ এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হলে এটি ফ্যাসিবাদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সাথে সরাসরি সংযুক্ত হয়ে যায়। এ ধরনের প্রযুক্তি শাসকদের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে, যেখানে সাধারণ জনগণের ওপর দমনমূলক ব্যবস্থা আরোপ করা হয়।
এই প্রবণতাগুলি দেখায় যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কেবলমাত্র একটি প্রযুক্তিগত উন্নতি নয়, বরং এটি সামাজিক শক্তির সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই ক্ষমতা শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত নয় বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করে, কারণ এই প্রযুক্তি একাধারে আপেক্ষিক উদ্বৃত্ত মূল্যের আহরণের দ্বারা পুঁজিবাদের প্রসারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, আবার ফ্যাসিবাদের সম্ভাব্য নবরূপের ঝুঁকি তৈরি করে। তাহলে কি এর অর্থ এই যে আমরা আবার সেই লুডাইট ভ্রান্তিকে পাথেয় করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করব? এই প্রবন্ধের বক্তব্য তা নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপার সম্ভাবনা রয়েছে, যা বৃহত্তর কল্যাণের জন্য লালন করতে হবে, এবং এর ফ্যাসিবাদী প্রবণতাগুলি নির্মূল করতে হবে। সেক্ষেত্রে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরির পদ্ধতির প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশ্বজুড়ে কোডাররা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বহুত্বের যুক্তিতে স্থাপন করার জন্য কাজ করে চলেছেন, যাতে এটি এক-এর ধারণায় সীমাবদ্ধ না হয়। আমাদের মতে, আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফ্যাসিস্তবিরোধী রাজনীতি এটাই হওয়া উচিত। এমনভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করা উচিত যাতে সেটি এক-মুখী নির্ধারক পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে না হয়, বরং বহুমুখী পরম পারস্পরিকতার পদ্ধতির ভিত্তিতে তৈরি হয়, যা সমাজের বহুত্বের প্রকাশ ধারণ করে বৃহত্তর কল্যাণের জন্য কাজ করতে পারে।১১
শেষ থেকে হোক শুরু
এই প্রবন্ধে আমরা ফ্যাসিবাদের একটি অ-ফ্যাসিবাদী তথা অনির্ধারণবাদী তত্ত্বায়নের প্রচেষ্টা করেছি, যেখানে ফ্যাসিবাদের উত্থান ও টিকে থাকার প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া (অবশ্যই না-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াগুলির সাথে সংযোগে) এবং পুঁজিবাদের আধিপত্যশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভূমিকায় আলোকপাত করা হয়েছে। আমরা এও দেখানোর চেষ্টা করেছি, ফ্যাসিবাদ শুধুই ইতিহাস নয়; এর প্রবণতাগুলি বর্তমান সময়ে বিভিন্ন রূপে ও ক্ষেত্রে, এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ প্রযুক্তির মধ্যেও উপস্থিত রয়েছে। তবে, এই প্রবন্ধের মূল যুক্তি, যা প্রথম পরিচ্ছেদ থেকেই আমরা বলার চেষ্টা করেছি, তা হল যে ফ্যাসিবাদ প্রধানত “এক”-এর প্রাধান্যের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়। সেটাই তার মৌলিক শক্তি, সেটাই তার মৌলবাদ। তাই যে-কোনও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী রাজনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত এই “এক”-এর প্রাধান্য ভাঙা এবং জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে— অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক— “বহু”-র যুক্তিকে গ্রহণ করা। সেটাই হবে ফ্যাসিবাদের অ-মৌলায়ন, সেটাই হবে ফ্যাসিবাদের শেষের শুরু।
তথ্যসূত্র ও টীকা:
১. ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন তত্ত্বের উপর আলোচনার জন্য দেখতে পারেন Ahmed (2023)।
২. বাংলায় পরম পারস্পরিকতার (Overdetermination) বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন, রাজনীতির ভূত-ভবিষ্যৎ: প্রতিরোধ-পুনর্নির্মাণ– রূপান্তর (অনুপ ধর ও অঞ্জন চক্রবর্তী, ২০২৩: পৃঃ ১৩৪-১৩৭)। মূল ভাবনার জন্য দেখুন Resnick, S. A., & Wolff, R. D. (1989)।
৩. এটি মার্কসবাদী চিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র, যা বেশিরভাগ দার্শনিকদের মতে তাত্ত্বিক আলোচনা থেকে বাস্তব কার্যক্রমের দিকে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়। কিন্তু এই সূত্রটিকে কেউ এভাবেও পড়তে পারেন যে, এটি আদতে প্রথাগত ব্যাখ্যার বদলের কথা বলছে– সেটাই হয়তো মার্কসীয় চর্চা-চর্যার ক্ষেত্র।
৪. শ্রেণি-প্রক্রিয়ার বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন: রাজনীতির ভূত-ভবিষ্যৎ: প্রতিরোধ-পুনর্নির্মাণ– রূপান্তর (অনুপ ধর ও অঞ্জন চক্রবর্তী,২০২৩: পৃঃ ৮৭-১১০) এবং মার্কসবাদ– একটি প্রাথমিক পাঠ (রিচার্ড ডি উল্ফ, ২০২০)
৫. আধিপত্য-র বিষয়ে বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন: রাজনীতির ভূত-ভবিষ্যৎ: প্রতিরোধ-পুনর্নির্মাণ– রূপান্তর (অনুপ ধর ও অঞ্জন চক্রবর্তী, ২০২৩: পৃঃ ১৫৭-১৭০)
৬. Gibson-Graham, J. K. (1997).
৭. দেখতে পারেন আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির স্টেট অব্ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া-র বিভিন্ন গবেষণাপত্র— বিশেষত ২০১৮-র। https://azimpremjiuniversity.edu.in/state-of-working-india-reports।
৮. প্রাক্রুদ্ধি প্রক্রিয়ার বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন: রাজনীতির ভূত-ভবিষ্যৎ: প্রতিরোধ -পুনর্নির্মাণ– রূপান্তর (অনুপ ধর ও অঞ্জন চক্রবর্তী, ২০২৩: পৃঃ ১৪০)
৯. ‘কোডেড বায়াস’ নামক তথ্যচিত্রটি এই প্রক্রিয়ার এক আকর্ষক নিদর্শন দেয়। উৎসাহী পাঠক জয় বুওলামউইনির গবেষণা দেখতে পারেন।
১০. দেখুন McQuillan (2022).
১১. ক্যাপিটাল-এ এই রাজনীতির ধারণাই মার্কস মেশিন ও প্রযুক্তি সম্পর্কে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। বিষয়টি মেশিনের নয়, বরং কারা মেশিনের মালিক এবং কী উদ্দেশ্যে সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে তা গুরুত্বপূর্ণ (Marx, 1983 [1867])।
গ্রন্থসূচি:
Ahmed, S. (2023). ‘Fascism as an ideological form: a critical theory’. Critical Sociology, 49(4-5), 669-687.
Gibson-Graham, J. K. (1997). ‘The end of capitalism (as we knew it): A feminist critique of political economy’. Capital & Class, 21(2), 186-188.
Marx, K. (1983 [1867]). Capital– A Critique of Political Economy: Volume 1. Progress Publishers. Moscow.
McQuillan, D. (2022). Resisting AI: an anti-fascist approach to artificial intelligence. Policy Press.
Resnick, S. A., & Wolff, R. D. (1989). Knowledge and class: A Marxian critique of political economy. University of Chicago Press.
অনুপ ধর ও অঞ্জন চক্রবর্তী (২০২৩). রাজনীতির ভূত-ভবিষ্যৎ: প্রতিরোধ- পুনর্নির্মাণ– রূপান্তর । আনন্দ: কলকাতা।
রিচার্ড ডি উল্ফ (২০২০). মার্ক্সবাদ– একটি প্রাথমিক পাঠ (অনুবাদক: অণির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ও অঞ্জন চক্রবর্তী)। অনুষ্টুপ, কলকাতা।