সুস্নাত দাশ
সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিস্ত-বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথই ছিলেন প্রথম ভারতীয় সাহিত্যিক যিনি সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের ধ্বংসাত্মক স্বরূপ উপলব্ধি করে সেই চণ্ড-ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে নিজের কণ্ঠকে সোচ্চার এবং লেখনীকে তীক্ষ্ণায়ুধ করেছিলেন। একজন সচেতন মানবতাবাদী লেখক রূপে রবীন্দ্রনাথ যে-কোনও ধরনের মানববিদ্বেষী মতাদর্শ, আগ্রাসনবাদ ও শান্তি বিঘ্নিতকারী শক্তির বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন। যুদ্ধের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ও শান্তির সপক্ষে তাঁর কবিকণ্ঠ ছিল সর্বদাই মুখর। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফ্যাসিবাদের স্বরূপ উপলব্ধিতে কবির কিছু বিলম্ব ঘটেছিল। আন্তর্জাতিক, বিশেষত ইউরোপীয় রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের অভাবে কবি ফ্যাসিবাদের মানবসভ্যতা-বিধ্বংসী চরিত্রের সঙ্গে এর সূচনা-পূর্বে পরিচিত হতে পারেননি; বরঞ্চ ভ্রমবশত হয়েছিলেন ফ্যাসিস্ত-চক্রান্তের শিকার। ইতালির ফ্যাসিস্ত শাসকশ্রেণি কবিকে ব্যবহার করেছিল নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো একজন বিশ্ব-ব্যক্তিত্বের কাছে কোনও ঘটনাই বেশিদিন গোপন থাকতে পারে না। ফ্যাসিবাদের মানবসভ্যতা-সংহারক আসল রূপও একদিন কবির কাছে প্রকাশিত হল। এ বিষয়ে অবশ্য সেদিন কবির প্রধানতম সহায়ক ও বন্ধু ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি মনীষী রম্যাঁ রলাঁ এবং তাঁর সাথি ফরাসি ‘ক্লার্তে’ (Clarte) বুদ্ধিজীবী-গোষ্ঠী। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে বাঙলা ও বাঙালির মানস-চেতনাকে যুক্ত করেছিলেন।
এক
প্রথম মহাযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৬ সালে জাপানেই রবীন্দ্রনাথ যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদ-বিরোধী বক্তৃতামালায় সর্বপ্রথম সুকঠোর ভাষায় জঙ্গি ন্যাশনালিজম, সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতা এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর অভিমত জ্ঞাপন করেছিলেন। যুদ্ধের মূল কারণ সম্পর্কে কবি তাঁর ঐ ভাষণে বলেন:
আসল সত্য কথাটা হচ্ছে, পাশ্চাত্য সভ্যতার উৎপত্তি এবং তার গোটা ইতিহাসের সার কথাটাই হচ্ছে– বিরোধ-সংঘর্ষ ও রাজ্য জয়ের ইতিহাস। এটা হচ্ছে যেন-এক দল লুঠেরা, যাদের সর্বদাই চাই শিকারের জোগান। বস্তুত, এই জাতিগুলি তাদের শিকার ও মৃগয়া ক্ষেত্রের প্রসারের জন্য নিজেদের মধ্যে অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছে।১ [ইংরাজি থেকে অনূদিত]
রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত এই বক্তৃতামালা পাঠ করার পরই ফরাসি মনীষী রম্যাঁ রলাঁ রবীন্দ্রনাথের প্রতি আকৃষ্ট হন। রলাঁ তাঁর ভগ্নীর সাহায্যে এর অংশ-বিশেষ ফরাসি ভাষায় তর্জমা করিয়ে তাঁর একটি রচনা প্রকাশ করলেন (১৯১৭)। সম্ভবত এরই ফলে আঁরি বারব্যুস প্রমুখ ফ্রান্সের প্রগতিশীল লেখকদেরও রবীন্দ্রনাথের রাজনীতিক চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ ঘটে।২
যুদ্ধাবসানের পর কিছু প্রগতিশীল ফরাসি বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আঁরি বারব্যুস ‘ক্লার্তে’ (Clarte) লেখকগোষ্ঠীর পত্তন করেন। এই গোষ্ঠীর লেখক ও বুদ্ধিজীবীরাই এক যুক্ত আবেদন ও ফতোয়া প্রকাশ করেছিলেন। বারব্যুস স্বয়ং তাঁর Le Luer Dans L’ Abime পুস্তিকায় তাঁদের সংঘের মূল উদ্দেশ্য এবং কার্যসূচির কথা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এর মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁরা ঘোষণা করলেন সর্বাত্মক জেহাদ বা যুদ্ধ। ‘যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’– এইটিই ছিল তাঁদের মূল আদর্শ ও লক্ষ্য।৩
‘ক্লার্তে’ নামকরণ হয়েছিল বারব্যুসের অন্যতম বিখ্যাত যুদ্ধ-বিরোধী উপন্যাস ‘Clarte’-এর নামানুসারে। বস্তুত, তাঁর এই উপন্যাসটি প্রকাশের অল্পকাল পরেই (১৯১৯ অক্টোবর থেকে) ‘Clarte গোষ্ঠীর’ কাজকর্ম পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। স্বল্পকালের মধ্যেই ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে এর শাখা কমিটি স্থাপিত হয়। বারব্যুস, মার্তিনে, আনাতোল ফ্রাঁস, জ্যুল রম্যাঁ, পল ক্যুটুর প্রমুখ প্রখ্যাত লেখক ও মনীষীরা ছিলেন মূল ফরাসি শাখার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। রম্যাঁ রলাঁ এই গোষ্ঠীর সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক হলেও এর প্রত্যক্ষ সদস্য ছিলেন না। তিনি আর-একটি স্বতন্ত্র ধারায় বিশ্বের বিবেকী বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।৪
‘ক্লার্তে’-গোষ্ঠী অবশ্যই ‘শান্তিবাদী’ বা ‘Pacifist’ ছিলেন না। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকে তাঁরা সমর্থন করতেন। তাঁদের ঘৃণা ছিল ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের’ বিরুদ্ধে, ‘ন্যায় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধের’ বিরুদ্ধে নয়। অপরদিকে রম্যাঁ রলাঁ অন্তত প্রথম দিকে ছিলেন পুরোমাত্রায় শাস্তিবাদী (Pacifist)। শান্তি বিঘ্নিতকারী যে-কোনও যুদ্ধের প্রতিই ছিল তাঁর সুতীব্র ঘৃণা। রবীন্দ্রনাথকেও তিনি স্বমতে আনার প্রচেষ্টা শুরু করেন।
এর প্রথম দৃষ্টান্ত রূপে বলা যায়, রলাঁ যখন যুদ্ধশেষে ‘চিন্তার স্বাধীনতার ঘোষণাবাণী’ (Declaration of Independence of Thought)-এর মাধ্যমে যুদ্ধের ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিবেকী বুদ্ধিজীবীদের সংঘবদ্ধ হবার আহ্বান জানালেন, তখন এই ঘোষণাবাণীটি পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথের সমর্থনের জন্য তিনি তাঁকে প্রথম পত্র লেখেন (১০ এপ্রিল, ১৯১৯)।৫ কিছু দিনের মধ্যেই ভারতবর্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথ এ ব্যাপারে তাঁর পূর্ণ আন্তরিক সমর্থন ও অভিনন্দন জানিয়ে রলাঁকে জবাবি পত্র লেখেন।৬
সম্ভবত ঐ জুন-জুলাই মাসের মধ্যেই বারব্যুস ‘ক্লার্তে’র ঘোষণাবাণীটিও রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং ‘ক্লার্তে’র ঐ ১৫ দফা ঘোষণাপত্রে (যা প্রধানত ছিল মানবাধিকার সংক্রান্ত ও শান্তিবাদী)৭ কবি স্বাক্ষরও করেছিলেন।
১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি। আঁরি বারব্যুস, মনাৎ ও মার্তিনে প্রমুখ বুদ্ধিজীবী নেতৃবৃন্দ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করলে ‘ক্লার্তে’ গোষ্ঠীর মধ্যেও বিরোধ ও সংঘাত দেখা দেয়। রম্যাঁ রলাঁ প্রথম দিকে ‘শিল্পীর চিন্তার স্বাধীনতা ও ব্যক্তি-অধিকার’কে দল ও রাজনীতি-নিরপেক্ষ রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। অপরদিকে তাঁর ঘনিষ্ঠ সুহৃদ বারব্যুস ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতায়’ বিশ্বাসী ছিলেন। একজন নিষ্ঠাবান ও সচেতন কমিউনিস্ট রূপে বারব্যুস তাই রলাঁর তথাকথিত ‘চিন্তার স্বাধীনতার’ ভাববাদী মোহজাল ভাঙতে অগ্রসর হন।৮ ১৯২১ সালের ২ ডিসেম্বর থেকে ১৯২২-এর মাঝামাঝি, এই প্রায় ছয় মাস ধরে রলাঁ-বারব্যুস আদর্শগত বিতর্ক চলে। ইতিমধ্যে ইউরোপের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একদিকে সদ্যোজাত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাষ্ট্রকে আঁতুড় ঘরেই হত্যা করার জন্য প্রতিবিপ্লবী পশ্চিমি রাষ্ট্রশক্তি জোটের চক্রান্ত ও আক্রমণ চলতে থাকে পুরোদমে; অপর-দিকে ইতালিতে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে বিশ্বের সামনে ভয়ংকর বিপদ রূপে আবির্ভূত হয়।
বারব্যুসের সঙ্গে তীব্র মতাদর্শগত বিতর্কের অবসানে অবশেষে রম্যাঁ রলাঁ পৃথিবীর সামনে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিপদকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। এরপর থেকে আজীবন ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামই ছিল তাঁর জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য। আর, অনুরূপভাবেই কবিসার্বভৌম রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সঠিক লক্ষ্যে পরিচালনা করার ক্ষেত্রেও এই মহান মনীষীর ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। বিশেষ করে দ্বিতীয়-বার ইতালি সফরের (১৯২৬) সময় যে-মারাত্মক বিভ্রান্তি ও প্রতারণার শিকার হন রবীন্দ্রনাথ তার থেকে তাঁকে মুক্ত হতে আন্তরিকভাবে সাহায্য করেছিলেন ফরাসি মনীষী রম্যাঁ রলাঁ।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলন সর্বপ্রথম শুরু করেন ও নেতৃত্ব দেন শুধু কমিউনিস্ট বা মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীগণ। অংসখ্য উদারনৈতিক বা মানবিক আদর্শানুসারী মধ্যপন্থী বা বুর্জোয়া দার্শনিক ও চিন্তাবিদগণ-ও ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে সমান সক্রিয় ছিলেন। বস্তুতই যে বিশিষ্ট মনীষী ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামে অন্যতম প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন– সেই রলাঁ অবশ্যই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য কিংবা মতাদর্শগত ভাবেও মার্কসবাদী ছিলেন না। কিন্তু একথা সত্য যে কমিউনিস্টরাই ছিলেন আর্ন্তজাতিক ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে। যেমন রলাঁর প্রধানতম সহযোগী আঁরি বারব্যুস ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কমিউনিস্ট নেতা ও বুদ্ধিজীবী।
দুই
ফ্যাসিস্ত ইতালি সফরে রবীন্দ্রনাথ এবং কিছু বিভ্রান্তি
পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে, ১৯২২-এর অক্টোবরে ইতালিতে মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়। কিন্তু ফ্যাসিবাদের উদ্ভব এবং তার ভয়াবহ পরিণাম ও বিপদের সর্বনাশা তাৎপর্য, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ও ইউরোপীয় রাজনীতির সূক্ষ্ম ও জটিল কার্যকারণ-সম্পর্ক, ভারতবর্ষের মতো অনগ্রসর দেশে বসে ঐ বিষয়ে প্রায় অনবহিত কবির পক্ষে সঠিকভাবে উপলব্ধি করা তৎকালে সত্যিই সম্ভব ছিল না। তাছাড়া কবি যখন তাঁর ‘বিশ্বভারতী’ এবং গঠনমূলক কাজ নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিলেন সেই সময়েই ধূর্ত মুসোলিনি অধ্যাপক তুচ্চি ও ফর্মিকি-কে ‘বিশ্বভারতী’তে ভিজিটিং প্রফেসর রূপে পাঠালেন (নভেম্বর, ১৯২৫)। আর সেই সঙ্গে পাঠালেন ‘বিশ্বভারতী’র জন্য ইতালীয় ভাষায় প্রকাশিত অসংখ্য মূল্যবান পুস্তকসম্ভার। স্বভাবতই কবি এর দ্বারা কিছুটা আকৃষ্ট হয়েছিলেন।৯ রলাঁ এবং রবীন্দ্রনাথের একান্ত কাছের মানুষ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের মতো কয়েকজন অবশ্য বিশ্বাস করতেন যে, ঐ দুজন তথাকথিত ‘ভারততত্ত্ববিদ’ ইতালীয় অধ্যাপক ছিলেন মুসোলিনির একান্ত অনুগত ফ্যাসিবাদী বুদ্ধিজীবী, যাঁরা কবিকে ইতালি ভ্রমণে প্ররোচিত করে তাঁর মুখ দিয়ে ফ্যাসিজম ও মুসোলিনির সমর্থনে প্রশংসাসূচক বিবৃতি আদায় করার জন্য ইতালির ফ্যাসিস্ত সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছিলেন।১০
বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবেই প্রতারিত হয়েছিলেন এবং ১৯২৬-এর মে-জুন মাসে তিনি সানন্দে ইতালি সফরেও যান। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন এটি একটি বে-সরকারী সফর; কিন্তু নেপলসে অবতরণ করেই তিনি সর্বপ্রথম জানতে পারেন যে, ইতালির ফ্যাসিস্ত সরকারের আমন্ত্রণেই তিনি এই সফরে এসেছেন। তখন অবশ্য তাঁর আর পশ্চাদ্পসরণের পথ ছিল না। এরপর চলল পুরোদস্তুর কণ্ডাকটেড ট্যুর। মুসোলিনির সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎকার, গঠনমূলক কর্মকাণ্ড পরিদর্শন এবং নানা শ্রেণির নারী-পুরুষের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় মুসোলিনির এবং ফ্যাসিজম-এর অকুণ্ঠ প্রশস্তি শ্রবণ, মোটামুটি এই ছিল নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথের ইতালি সফরের কর্মসূচি।
এর পরবর্তী ঘটনা সকলেরই জানা। ড. নেপাল মজুমদার১১ ও সৌরীন্দ্র মিত্র-র১২ গবেষণা থেকেই আমরা জানতে পারি যে, সৌজন্যবশত কিংবা কিছুটা প্রতারণা ও বিভ্রান্তির শিকারে পরিণত হয়ে সুসংহত ইতালির উদ্দেশে কবি যেসব প্রশস্তিবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন সেইসব নির্বিবাদে মুসোলিনির প্রতি আরোপ করে ফ্যাসিস্ত-প্রেস পরমানন্দে মিথ্যা প্রচার শুরু করে দিল এবং বিশ্ববাসীর মনে এমন ধারণার জন্ম দিল যে, রবীন্দ্রনাথ যেন ফ্যাসিবাদের একজন বড়ো সমর্থক। সংবাদ রূপে এগুলিকে সত্য মনে করে ইউরোপের ‘লিবারেল প্রেস’-এর মাধ্যমে, এমনকি সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে চালিত বেশ কিছু পত্র-পত্রিকাতেও, রবীন্দ্রনাথের এই ‘ফ্যাসিবাদকে সমর্থনের’ সংবাদ ফলাও করে প্রচারিত হল। অন্যদিকে, এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ইউরোপের পত্রপত্রিকা, এমনকি ভারতবর্ষের ‘অমৃতবাজার’, ‘পাইওনিয়র’ প্রভৃতি পত্রিকাগুলি এই অভাবনীয় ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে।১৩
এই প্রসঙ্গে সৌরীন্দ্র মিত্র-কৃত একটি গুরুতর বিভ্রান্তির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন। সৌরীন্দ্র মিত্র তাঁর গবেষণাগ্রন্থের একস্থানে রবীন্দ্রনাথের ইতালি সফর প্রসঙ্গে আলোচনাকালে বলেছেন:
…..শুধু য়ুরোপেই নয় স্বদেশেও ইতালি-সফর সম্বন্ধে পত্র-পত্রিকায় কিরূপ মন্তব্য প্রকাশিত হচ্ছিল। জার্নালের এক জায়গায় রলাঁ লিখেছেন যে, কবির বহুকালের সহযোগীরাও আলোচ্য বিষয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। রলাঁ ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঐ সময়ে কবির যে কয়েকটি রুষ্ট চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয় তাতে বোঝা যায় প্রবাসী ও মডার্ন রিভিয়্যুপত্রে যে মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলি তাঁর রচনা নয়, তাঁর পুত্র শ্রী অশোক চট্টোপাধ্যায়ের (প্রবাসী, আশ্বিন ১৩৩৩, বিবিধপ্রসঙ্গ এবং Modern Review, August, September 1926, Notes দ্রষ্টব্য)।১৪
সৌরীন্দ্র মিত্র-র এই ভাষ্য থেকে সাধারণ পাঠকদের মধ্যে বিভ্রম সৃষ্টি হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। উপরোক্ত বক্তব্য থেকে মনে হবে যে, রবীন্দ্রনাথের ইতালি সফর বা তাঁর সঙ্গে মুসোলিনির সাক্ষাৎকার অন্যান্য অনেক প্রগতিশীল পত্র-পত্রিকার মতো ‘প্রবাসী’ বা ‘মর্ডান রিভিয়্যু’-এর কাছেও অত্যন্ত অপছন্দ ছিল এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের অনুপস্থিতিতে তাঁর ‘সুযোগ্যপুত্র’ অশোক চট্টোপাধ্যায় পত্রিকা দুটির সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করে রবীন্দ্রনাথের ফ্যাসিস্ত-‘তোষণ নীতির’ (তখন এইভাবেই প্রচারিত হয়েছিল) তীব্র সমালোচনা শুরু করেন এবং তাতে কবি অত্যন্ত রুষ্ট হন। আমার ধারণা, উক্ত প্রসঙ্গে সৌরিন্দ্র মিত্র-র অতি স্বল্প-ব্যাখ্যামূলক আলোচনাই হল এই বিভ্রান্তির মূল কারণ।
প্রকৃত ঘটনা কিন্তু এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সাহিত্য-সমালোচক অবন্তী সান্যালের গবেষণামূলক একটি প্রবন্ধ১৫ এ বিষয়ে যথাযথ আলোকপাত করেছে। রামানন্দ-পুত্র অশোক চট্টোপাধ্যায় সে সময় মুসোলিনি বা ফ্যাসিজম বিরোধী তো ছিলেনই না, উপরন্তু বহু দিগ্ভ্রান্ত বুদ্ধিজীবীর মতো তিনিও ছিলেন মুসোলিনির গুণমুগ্ধদেরই একজন। সামগ্রিকভাবে প্রবাসী ও মর্ডান রিভিয়্যু-এর নীতিতে ফ্যাসিবাদের প্রতি কোনও পক্ষপাতিত্বই ছিল না। কিন্তু রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিদেশ সফরকালে (২৭ জুলাই, ১৯২৬-এ জেনেভা যাত্রা) এবং রবীন্দ্রনাথের ইতালি সফর শুরু হয়ে গেলে অশোক চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় প্রবাসী ও ‘মডার্ন রিভিয়্যু’-এর পাতায় আকস্মিকভাবে শুরু হয়ে গেল মুসোলিনি ও ফ্যাসিস্ত দলের ধারাবাহিক গুণকীর্তন। এই সময়কালে ‘প্রবাসী’ ও মর্ডান রিভিয়্যু পত্রিকা দুটিতে প্রকাশিত প্রাসঙ্গিক প্রতিবেদনগুলির একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ অবন্তী সান্যাল তাঁর পূর্বোক্ত গবেষণামূলক নিবন্ধে তুলে ধরেছেন।
‘প্রবাসী’-তে ১৩৩৩ সনের আষাঢ় সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের নেপেলস্ থেকে স্পেশাল ট্রেনে রোম যাত্রা, মুসোলিনির সঙ্গে সাক্ষাৎকার, রোম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আমন্ত্রণ পর্যন্ত সংবাদ-বিবরণ প্রকাশিত হয়। পরের মাসে শ্রাবণ সংখ্যায় ছাপা হয় মুসোলিনির একটি হাতে আঁকা মুখাবয়ব এবং মুসোলিনির প্রশস্তি। সম্ভবত ততদিনে এদেশে মুসোলিনি সম্পর্কিত উক্তির জন্যে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিরূপ সমালোচনার কথা (ইংলণ্ডের সংবাদপত্র ও ব্যক্তিগত চিঠিপত্র মারফৎ) ভালোভাবেই পৌঁছে গেছে। তারই জবাব দেওয়ার জন্যই যেন প্রবাসীতে লেখা হল: ‘নবোদিত অরুণের মতো ফ্যাসিস্ট দলের নেতা মুসোলিনির আবির্ভাব’, ‘জগতের সভায় উচ্চাসন অধিকার’, ‘ইতালির নবীন প্রাণে বিশ্বজয়ের উল্লাস’ ইত্যাদি। আরও বলা হল:
… আমাদের দেশের এই দুর্দশার দিনে এই মহা শক্তিশালী পুরুষের জীবনী ও কার্যকলাপ বিশেষভাবে আলোচিত হইবার যোগ্য। অবশ্য পৃথিবীতে নিন্দুকের অভাব নাই। রাজতন্ত্রপরায়ণ জাতি সমূহ নানা মিথ্যা অভিযোগে ইঁহার মহৎ জীবনকে কলংকিত করিবার প্রয়াস পাইতেছে। কিন্তু পুরুষত্ব ও তেজ জয়লাভ করিবেই। বর্তমান জগতের সর্বাপেক্ষা চিন্তাশীল কবি রবীন্দ্রনাথ এই শক্তিকে নমস্কার ও অভিনন্দন নিবেদন করিয়াছেন।
পরবর্তী ভাদ্র সংখ্যায় ‘বিবিধপ্রসঙ্গ’ বিভাগে ‘রবীন্দ্রনাথের সহিত শত্রুতা’ শিরোনামায় প্রকাশিত সংবাদ-নিবন্ধে বলা হল:
এবার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় ইতালিতে উক্ত দেশের রাষ্ট্রনেতা মুসোলিনির অতিথিরূপে অবস্থান করেন। মুসোলিনি ইউরোপের একজন মহাক্ষমতাশালী লোক এবং তাঁহাকে ইতালি-সম্রাট বলিলেও চলে। এহেন ব্যক্তির অতিথি হওয়া একজন বাঙালীর পক্ষে বিশেষ গৌরবের কথা, সন্দেহ নাই। মুসোলিনির শত্রু অনেক, এবং রবীন্দ্রনাথেরও শত্রুর অভাব নাই। এই সকল কারণে আমরা জনসাধারণকে রবীন্দ্রনাথ ও মুসোলিনির খবর বিশেষ সাবধানতার সহিত পাঠ ও বিচার করিতে অনুরোধ করি। দুইজনেরই জীবন, আদর্শ, পরস্পরের সম্বন্ধে মতামত প্রভৃতি নানা দিক দিয়া মিথ্যার সাহায্যে দুর্নাম রটাইবার চেষ্টা হইতেছে। এ চেষ্টা যাহারা করিতেছে তাহারা ভারতের বন্ধু নহে, আমাদের পক্ষে কবি ফিরিয়া আসার পূর্বে এসকল বিষয়ে কোনও মতামত পোষণ না করাই শ্রেয়।
ইতিমধ্যে আগস্টের প্রথমেই ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত কবির চিঠি ও প্রাসঙ্গিক সংবাদের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় রবীন্দ্রনাথের ফ্যাসিজম বিরোধিতার বার্তা প্রচারিত হয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের এই মত পরিবর্তনে সবথেকে অখুশি ও অসন্তষ্ট হন অশোক চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিস্ত ডিক্টেটর মুসোলিনির আতিথ্য গ্রহণ করায় ব্যথিত ও স্তম্ভিত ইয়োরোপীয় জনমতের মধ্যে যে-বিরূপতা জাগে সে-সম্পর্কে বক্রোক্তি করে প্রবাসী-র আশ্বিন সংখ্যায় (১৩৩৩) লেখা হল: “… রবীন্দ্রনাথ ইতালিতে বিপুল সম্মান ও অভ্যর্থনা লাভ করিয়াছেন। যদিও এখনও এদিক ওদিক দুই একজন প্রজাতন্ত্র ও সাধারণতন্ত্রবাদী, সাম্রাজ্য-তন্ত্রপরায়ণ ‘খুনে’ মুসোলিনির আতিথ্য গ্রহণ করিবার জন্য রবীন্দ্রনাথকে গালাগালি করিয়াছেন।” বহু বাগ্বিস্তারের পর রবীন্দ্রনাথের মতপরিবর্তন সম্পর্কে লেখকের মনের কথা স্পষ্ট করে বলা হল:
…. কবি পূর্বে ইতালীয় গভর্নমেন্টের আতিথ্য গ্রহণ করিয়া ও তৎপরে তাঁহাদিগের সমালোচনা করিয়া ইতালীয়দিগের মনে যে অসন্তোষের ভাব জাগ্রত করিয়াছেন তাহা ভারতের পক্ষে কোনও প্রকারেই লাভজনক হইতে পারে না। যে অতিথি ও যে আতিথ্য দান করে তাহাদের মধ্যে পরস্পর ব্যবহারের যে-আদর্শ তাহাও ইহাতে ক্ষুণ্ণ হইয়াছে।
রবীন্দ্রনাথ যখন ভিয়েনায় বসে ‘প্রবাসী’ ও ‘মডার্ন রিভিয়্যু’-এর পাতায় অশোক চট্টোপাধ্যায়ের এই সকল কীর্তি প্রশান্ত মহলানবীশ ও রথীন্দ্রনাথের মাধ্যমে অবহিত হলেন স্বভাবতই তখন তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট হন। সে-সময় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কবির সঙ্গেই ছিলেন। কবি প্রবাসী-র পাতাগুলো রামানন্দবাবুর হাতে দিয়ে বললেন: আপনার কাগজ থেকে কি এই ধরনের লেখা ডিজার্ব করি? তাঁর পুত্র ‘ফ্যাক্ট’ জানে না বলে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় অজুহাত দেখালেন। কয়েকদিন পরে জেনেভায় তিনি এক চিঠিতে জানালেন, তিনি ফিরে গিয়ে পুত্রের ‘ভুল’ সংশোধন করবেন।১৬ কিন্তু নিছক ‘ভুল’ বা ‘ফ্যাক্ট’ না-জানার অজুহাত রবীন্দ্রনাথ কিছুতেই মেনে নিলেন না। ২৫ অক্টোবর দেশের ঠিকানায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে এক চিঠিতে লিখলেন:
….. আপনার কাগজে এটা মতঘটিত প্রতিবাদ নয়, ব্যক্তিগত অবমাননা। …মডার্ন রিভিউ ও প্রবাসীতে যে-প্রসঙ্গে সমালোচনা বেরিয়েছে সে হচ্ছে ফ্যাসিস্ট দলের প্রতি আমার আতিথ্যবিরুদ্ধ ব্যবহার। সে-সম্বন্ধে আমার যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে বন্ধুরা কিছু পরিমাণে ক্ষুণ্ণ হতে পারেন; কিন্তু তাঁদের রক্ত অত্যন্ত বেশী গরম হয়ে উঠবার মতো বিষয় এটা নয়।… লেখাটাকে ‘ভুল’ বলেছেন? কিসের ভুল? ঘটনার ভুল? এ সম্পর্কে যেটুকু ঘটনা প্রাসঙ্গিক সে আমার চিঠিতেই আছে। কিন্তু লেখক ব্যঙ্গ করে বলেছেন, চিঠি আমার কিনা, তাঁর সন্দেহ রয়ে গেছে। অর্থাৎ তাঁর মতে চিঠি আমার এতই অযোগ্য যে এটাকে জাল বলে মনে করলেই আমার লজ্জা রক্ষা হয়। বোধহয় ইতালিতে কোনো ফ্যাসিস্ট কাগজেও এমন ছদ্ম-কুটিল অলঙ্কার প্রয়োগ করা হয়নি?১৭
সুতরাং অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র অশোক চট্টোপাধ্যায় সর্ম্পকে যে-তথ্য সৌরীন্দ্র মিত্র তাঁর গবেষণাগ্রন্থে পেশ করেছেন তা প্রকৃত তথ্য নয় বরং যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর।
যাই হোক, রবীন্দ্রনাথের ইতালি সফর নিয়ে বিভ্রান্তি যখন ঘনীভূত তখন রম্যাঁ রলাঁ কালিদাস নাগকে এক পত্রে (৭ জুলাই, ১৯২৬) লেখেন:
…. জাপানে প্রদত্ত স্বাজাত্যের বিরুদ্ধে সেই বক্তৃতা পাঠ করার পর য়ুরোপের একটি ক্ষুদ্র বিদগ্ধ গোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথকে গুরু বলে, ন্যায়ধর্ম ও মুক্তির বিগ্রহ বলে প্রণাম জানিয়ে আসছেন। ভেবে দেখো তাঁরা কী পরিমাণে বিভ্রান্ত হলেন যখন জানলেন য়ুরোপের সবচেয়ে ঘৃণ্য সেই পাশবিক নিপীড়ক–নরঘাতক, অমেন্দোলা ও মাত্তিয়োতির হত্যাকারী মুসোলিনির সরকারী অতিথি হলেন রবীন্দ্রনাথ।১৮
বলা বাহুল্য, ইউরোপের ‘একটি ক্ষুদ্র বিদগ্ধ গোষ্ঠী বলতে নিঃসন্দেহে রলাঁ এ-ক্ষেত্রে ফ্রান্সের ‘Clarte’ গোষ্ঠীর কথাই উল্লেখ করেছিলেন। যাহোক, রলাঁর আমন্ত্রণে কবি সদলে ইতালি সফর শেষে সুইজারল্যাণ্ডের ভিলেন্যুভ-এ এলেন তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতে; এ প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে রম্যাঁ রলাঁ তাঁর অবিস্মরণীয় জার্নাল বা স্মৃতিকথা ‘I will not rest’-এ লিখেছেন:
… আমি রবীন্দ্রনাথের চোখ খুলিবার চেষ্টা করিলাম। এ চেষ্টা আমার পক্ষে খুব সহজ হয় নাই। ফ্যাসিজমের আসল রূপ আমি তাঁহার নিকট খুলিয়া ধরিলাম। ইহার হিংস্রনীতির কবলে যাহারা পড়িয়াছে তাহাদের সহিত তাঁহার সংযোগ সাধন ঘটাইলাম। রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে বিচলিত হইলেন। যে-ফ্যাসিজম তখন তাঁহার নাম ভাঙাইতেছিল তাহার সহিত তিনি খোলাখুলিভাবে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করিলেন। ইতালীয় বন্ধুগণের নিকট এবং সি. এফ. এন্ড্রুজের নিকট লিখিত চিঠিতে তিনি তাঁহার মত পরিবর্তনের কথা ব্যক্ত করিলেন।১৯
রম্যাঁ রলাঁ সততার সঙ্গেই উল্লেখ করেছেন যে, ‘এ চেষ্টা আমার পক্ষে খুব সহজ হয় নাই।’ বাস্তবিকই ঘটনাও ছিল তাই। ভিলেন্যুভ্-এ রলাঁর কাছ থেকে প্রকৃত তথ্য অবহিত হয়ে ফ্যাসিস্ত-প্রেস তাঁর সম্বন্ধে যেসব মিথ্যা প্রচার করেছে তার প্রতিবাদ করতেই কবি শুধু রাজি হলেন। কিন্তু রলাঁ ঠিক এটুকুতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি একদিকে যেমন কবির বিরুদ্ধে সমস্ত মিথ্যা প্রচারের অবসান চেয়ে ছিলেন, তেমনি আশা করেছিলেন যে, ফ্যাসিবাদের দ্বারা যাঁরা উৎপীড়িত হয়েছেন অথবা স্বেচ্ছায় নির্বাসন বরণ করে ইউরোপের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছেন, সেই সব অগণিত রুদ্ধকণ্ঠ, হতশ্বাস ও ছিন্নমূল মানুষের হয়ে কবি উদাত্ত কণ্ঠে ইতালির ফ্যাসিস্ত সরকারকে ধিক্কার দেবেন।
কিন্তু সেই মুহূর্তেই রবীন্দ্রনাথ তা করতে সম্ভবত প্রস্তুত ছিলেন না। রলাঁর অনুরোধে প্রায় নিরুপায় হয়েই২০ ৩০শে জুন ভিলেন্যুভ্-এ কবি যে প্রবন্ধটি রচনা করলেন তাতে তিনি আবেগহীন তত্ত্বালোচনার ভাষাতেই শেষ পর্যন্ত পরোক্ষভাবে জানালেন যে, এই ফ্যাসিবাদকে তিনি সমর্থন করেন না। মুসোলিনি সম্বন্ধে যা লিখেছেন তার মধ্যে কিছু প্রশংসার আভাস আছে এবং আলোচনা-প্রসঙ্গে তিনি নেপোলিয়ন এবং আলেকজান্ডারেরও উল্লেখ করলেন, যদিও প্রবন্ধের শেষ কয়েক লাইনে কর্মবীরদের চেয়ে চিন্তানায়কদেরই যে তিনি বেশি মূল্য দেন সে কথারও উল্লেখ করলেন প্লেটোর মতো দার্শনিকসুলভ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে।২১
এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, উক্ত প্রবন্ধটিতে মুসোলিনি বা সামগ্রিকভাবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কিছু ছিল না; বরঞ্চ দুই বিশ্বখ্যাত বীর– নেপোলিয়ন ও আলেকজান্ডারের সঙ্গে মুসোলিনির তুলনা শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিস্তদেরই যে সাহায্য করবে, এরকম ধারণায় রলাঁ এবং তাঁর সঙ্গীরা নৈরাশ্যে প্রায় ভেঙে পড়েন। কেউ কেউ তো (যেমন, সম্পাদক দুয়ামেলে) কবির উপর ক্রোধে ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে যান। রলাঁ কবিকে এই প্রবন্ধ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানালে কবি রাজি হন। এরপর অসহিষ্ণু ও বিক্ষুদ্ধ রলাঁ তাঁর জার্নালে লিখলেন:
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তথ্যভিত্তিক কিছু বলতে কবি অনিচ্ছুক, কেননা তিনি বিচারে অক্ষম। তিনি কিছুই দেখেননি, কিছুই শোনেননি, কিছুই বোঝেননি, কিছুই জানেন না। অতএব তিনি হস্তপ্রক্ষালনপূর্বক দূরে সরে দাঁড়ালেন।২২
প্রকৃতপক্ষে, পরের মুখে ঝাল খাওয়ার স্বভাব কিংবা ব্যক্তিত্বহীনতা অন্তত রবীন্দ্রনাথের ছিল না। তাঁর ৩০ জুন (১৯২৬)-এর প্রবন্ধের ব্যাখ্যায় কবি রলাঁকে যে-কথা বলেছিলেন তার যৌক্তিকতা তো সত্যিই অস্বীকার করা যায় না। তিনি বলেছিলেন:
আমি যা বলেছি তার বেশি কিছু আর বলতে পারছি না, তার কারণ এর চেয়ে বেশি আর কিছু আমি দেখিনি।২৩
বস্তুতই, স্বেচ্ছায় হোক বা ঘটনাচক্রেই হোক রবীন্দ্রনাথ ইতালিতে গিয়েছিলেন সরকারের অতিথি হয়ে। তাঁকে যা দেখানো হয়েছে বা শোনানো হয়েছে তিনি তাই দেখেছেন বা শুনেছেন। এটাও অনস্বীকার্য যে, তাঁকে দেখানো হয়েছিল ফ্যাসিজমের একটা অলঙ্কৃত এবং সুসজ্জিত মঞ্চদৃশ্য। তিনি যা দেখেছেন বা শুনেছেন, অন্তত সেইসময়ে, তার মধ্যে মুসোলিনি বা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধতা করার মতো কিছুই ছিল না। ফ্যাসিস্ত নৃশংসতার বহু তথ্যই কবির অজ্ঞাত ছিল, অনেক কিছুই ফ্যাসিস্ত সরকার তাঁর কাছে গোপন করেছিল। সুতরাং যা তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বাইরে তেমন কিছু সম্পর্কে কবি মতামত প্রকাশ করতে চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক। রম্যাঁ রলাঁও সে কথা পরে সঠিকভাবে উপলব্ধি করে ‘রবীন্দ্রনাথের চোখ খুলিবার’ জন্য আয়োজন করেছিলেন।
কবি ভিলেন্যুভ্ থেকে বিদায় নেন ৪ জুলাই। তাঁর প্রথম যাওয়ার কথা ছিল জুরিখে, সেখান থেকে ভিয়েনায় এবং তারপর ইউরোপের অন্যান্য স্থানে। কবি ভিলেন্যুভ্ ত্যাগ করার পরদিনই রলাঁ ফ্যাসিস্ত সরকারের উৎপীড়নে দেশত্যাগী অধ্যাপক জিইসেপে সাল্ভেমিনিকে এক পত্রে (৫ জুলাই) অনুরোধ করেন যে, তিনি যেন ইতালিতে ফ্যাসিস্ত অত্যাচার ও নিপীড়নের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ কবিকে শোনান এবং তাঁকে ফ্যাসিস্ত-বিরোধী শিবিরে নিয়ে আসেন। কেননা, অপপ্রচারের দ্বারা ফ্যাসিস্ত-প্রেস রবীন্দ্রনাথকে স্বদলভুক্ত বলে ঘোষণা করেছে।২৪ রলাঁ অন্য একটি পত্রে আরও লেখেন,
আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে, কবি যথাসময়ে তাঁর মহান এবং কঠোর বাণী উচ্চারণ করবেন এবং চক্রান্তকারীদের সকল অপচেষ্টা বিধ্বস্ত হয়ে যাবে।২৫
রবীন্দ্রনাথকে ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা ও বিপদ সম্পর্কে অবহিত করে, তাঁকে ফ্যাসিস্ত-বিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে এভাবেই রম্যাঁ রলাঁর ভূমিকা সত্যিই অনস্বীকার্য। এমনকি, ভিলেন্যুভ-এ অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথের ৩০ জুনের প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যখন সাময়িকভাবে ক্ষুদ্ধ ও হতাশ, তখনও ফ্যাসিস্ত-প্রেসের অপপ্রচারে যাঁরা বিভ্রান্ত হয়েছেন তাঁদের রলাঁ বারবার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ঐ মিথ্যা প্রচারে তাঁরা যেন কর্ণপাত না করেন। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ফ্যাসিজমকে সমর্থন করা অসম্ভব। ১৯২৬-এর ৬ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে লেখা রলাঁর চিঠিপত্রে এই দৃঢ় বিশ্বাসই প্রতিফলিত হয়েছে।২৬
ইতিমধ্যে ভিয়েনায় অধ্যাপক সাল্ভেমিনি, অধ্যাপক সাল্ভাডোরি ও তাঁর স্ত্রী-আইনজীবী মদিল্লিয়ানি (যিনি মাত্তিয়োতি-হত্যামামলা পরিচালনা করার জন্য নির্যাতিত হন) এবং আরও দুই-একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি নিভৃতে কবির সঙ্গে আলাপ করে ফ্যাসিস্ত সরকারের অমানুষিক অত্যাচারের মর্মন্তুদ কাহিনি বিবৃত করেন।২৭ এসব কাহিনি শুনে কবি অত্যন্ত বিচলিত হলেন এবং রলাঁকে লিখলেন:
ইতালি সফরের ফলে আমার মনে যে মলিনতার স্পর্শ লেগেছিল সম্প্রতি এক মুক্তিস্নানে তা দূর হয়েছে। ফলাফল পরে জানতে পারবেন।২৮
এর পরেই ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’-এ কবির সেই ঐতিহাসিক প্রতিবাদলিপি প্রকাশিত হল। সি. এফ. এনড্রুজের কাছে লেখা যে-পত্র ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’-এ (লন্ডন, ৫ আগস্ট, ১৯২৬) প্রকাশিত হল তাতে কবি লিখলেন:
ফ্যাসিবাদের কর্মপদ্ধতি ও নীতির সঙ্গে সমগ্র মানবতাই সংশিষ্ট। যে আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করে, বিবেক-বিরোধী কাজ করতে মানুষকে বাধ্য করে এবং হিংস্র রক্তাক্ত পথে চলে বা গোপনে অপরাধ সংঘটিত করে– সে আন্দোলনকে আমি সমর্থন করতে পারি এমন উদ্ভট চিন্তা আসার কোনো কারণ নেই। আমি বরাবরই বলে এসেছি যে, পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলি সযত্নে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবকে লালন-পালন করে সারা পৃথিবীর সামনেই এক ভয়াবহ বিপদ সৃষ্টি করেছে।২৯ [ইংরাজি থেকে অনূদিত]
এছাড়া ‘ডেলি নিউজ’-এর প্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর ইতালি ভ্রমণের অভিজ্ঞতার বর্ণনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন:
যে মুহূর্তে আমি জেনেছি সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয়তাবাদের প্রতি অন্ধ আসক্তিই ফ্যাসিবাদের লক্ষ্যস্থল সেই মুহূর্তেই তার প্রতি আমার সমস্ত সহানুভূতি আমি প্রত্যাহার করে নিয়েছি। … যে সকল ইতালীয় আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা আমার বক্তব্যকে বিকৃত করেছেন। জানতে পারলাম এমন ধারণার নাকি সৃষ্টি হয়েছে যে ফ্যসিবাদের প্রতি আমার একটা নিরুচ্চার মুগ্ধতা ছিল। কাজেই তাঁর অনিচ্ছা নিয়েই আমি এই ভ্রান্ত ধারণার নিরসনে বাধ্য হলাম।৩০
[‘দ্য স্টার’ থেকে উদ্ধৃত অংশ; লন্ডন, ৫.৮.২৬]
রবীন্দ্রনাথ এই সর্বপ্রথম খোলাখুলি ও কঠোরভাবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করলেন। সম্ভবত তাঁকেই বাঙলা তথা ভারতবর্ষের প্রথম মানুষ বলা চলে যিনি বিশ্ব-ফ্যাসিবাদ-বিরোধী আন্দোলনে এমন প্রত্যক্ষভাবে সামিল হলেন। এরপর থেকেই আমৃত্যু রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ ও সামরিকবাদের বিরুদ্ধে তাঁর কন্ঠস্বরকে বারংবার উচ্চগ্রামে তুলে ধরেছিলেন।
এতৎসত্ত্বেও বিতর্ক অব্যাহত রইল। রবীন্দ্রনাথের ইতালি সফর সম্পর্কিত যাবতীয় বিভ্রান্তির অবশ্য অবসান ঘটার কথা ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’-এ তাঁর প্রতিবাদপত্র প্রকাশিত হবার পরেই। কিন্তু ১৯৩০ সালে মুসোলিনির উদ্দেশে লিখিত কবির চিঠির একটি খসড়ার উল্লেখ করে অধুনা দু-একজন গবেষক রবীন্দ্রনাথের ফ্যাসিস্ত-বিরোধিতার যথার্থতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন ও সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য হল– ১৯২৬ সালের ঘটনার পরেও, ১৯৩০ সালে, কবি মুসোলিনির সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে আপস করে নিতে চেয়েছিলেন। তথ্য-প্রমাণ স্বরূপ তাঁরা ১৯৩০ সালে লিখিত রবীন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত সেই পত্রের উল্লেখ করেছেন। এই চিঠির আলোচনা প্রসঙ্গে ঐ গবেষকরা এমন কথা বলতে চেয়েছেন যার অর্থ দাঁড়ায়– রবীন্দ্রনাথ ইতালির ফ্যাসিস্ত-শাসন ও ফ্যাসিজম সম্পর্কে তাঁর বিবৃতি ইত্যাদিতে ইতিপূর্বে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তা প্রত্যাহার করে নিয়েই তিনি যেন মুসোলিনির সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে চেয়েছিলেন, এমনকি ভবিষ্যতে কবি ফ্যাসিজম বা ইতালির ফ্যাসিস্ত-শাসন বা আগ্রাসন সম্পর্কে তাঁর স্বাধীন মতামত ও সমালোচনার অধিকারও এজন্য পরিত্যাগ করতে আগ্রহী ছিলেন।৩১
বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এই জাতীয় ভ্রমাত্মক উদ্ভট গবেষণা-সিদ্ধান্ত এবং অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও খণ্ডিত দৃষ্টির পরিচায়ক। ১৯৩৬ সালে ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণ এবং এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ কবির বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা আমরা সকলেই জানি, তা সত্ত্বেও কবির বিরুদ্ধে এই সব অসংগত অভিযোগ উত্থাপিত হয় কী করে?
এ কথা সত্য যে, ১৯৩০-এর নভেম্বর মাসে কবি ‘বিশ্বভারতীর’ জন্য অর্থসংগ্রহের উদ্দেশ্য আমেরিকায় যান। সেখানেই তাঁর সঙ্গে ‘ইতালি কেলেঙ্কারি’-র নায়ক সেই অধ্যাপক ফর্মিকি-র (যাকে কবি ছাড়া তাঁর আর সমস্ত সহযোগীই ‘ফ্যাসিস্ত চর’ মনে করতেন কিন্তু কবি এই ইতালীয় অধ্যাপক সম্পর্কে অন্তরে কিছুটা দুর্বলতা পোষণ করতেন, এটা অনেকেরই জানা।) সাক্ষাৎ ঘটে। হয়তো ফর্মিকিই কবির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ খুঁজছিলেন। এর পর প্রকৃত অর্থেই রোরুদ্যমান ফর্মিকির প্ররোচনায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর একান্ত সচিব অমিয় চক্রবর্তীকে দিয়ে মুসোলিনিকে পাঠানোর জন্য একটি চিঠির খসড়া তৈরি করেন (শান্তিনিকেতনের ‘রবীন্দ্রভবনে’ এই চিঠির খসড়া সযত্নে রক্ষিত আছে)।৩২
আমেরিকা থেকে প্রেরিত এক পত্রে ১৯৩০ সালের ২১ নভেম্বর কবি তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখেন:
…চিঠিটা এই সঙ্গে পাঠাই। যদি দ্বিধার কারণ না থাকে পাঠিয়ে দিস্। চিরটাকাল ইতালির সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে রাখা ঠিক নয়।৩৩
পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লেখা এই পত্র পাঠাবার সময় কবি মুসোলিনিকে লেখা অমিয় চক্রবর্তীর খসড়া করা চিঠিটিও সংযোজিত করে দেন।
বস্তুতই, খসড়া করা চিঠিটিতে এমন কোনও বাক্য ছিল না যার দ্বারা রবীন্দ্রনাথের ফ্যাসিবাদের প্রতি সমর্থনকে সূচিত করে। বরঞ্চ এমন কিছু বাক্য ছিল যার দ্বারা স্পষ্ট করে না-বললেও ইতালির শাসনব্যবস্থা ও ফ্যাসিজম সম্পর্কে তাঁর পূর্ব ধারণা ও মতের যে বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয়নি, এই কথাটিই সুকৌশলে বাক্য-বিন্যাসের মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন।৩৪
যাহোক, বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক ড. নেপাল মজুমদারের মতে, এই চিঠি মুসোলিনিকে আর পাঠানো হয়নি। সম্ভবত কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ইতালি নিয়ে নতুন আর একটি উৎপাত সৃষ্টির ঝুঁকি নিতে চাননি। এ চিঠি পাঠানো হলে মুসোলিনি ও ফর্মিকি এর পূর্ণ সুযোগ নিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে এই খবর ‘রয়টার’-কে দিয়ে বিশ্বভারতীর সঙ্গে পুনরায় একটি জমকালো সম্পর্ক স্থাপনে নিশ্চয় তৎপর হয়ে উঠতেন; কিন্তু তা ঘটেনি।
কবি সম্পর্কে বর্তমান গবেষকদের উক্ত অভিমত এবং অভিযোগ তাই গ্রহণযোগ্য নয়। একথাও সত্যি যে, ১৯২৬-এর পর থেকে কবি ফ্যাসিবাদের সঙ্গে কোনও আপসই করেননি। কিন্তু এটাও লক্ষণীয় যে, মতাদর্শরূপে ফ্যসিবাদের বিরুদ্ধে তিনি যতই সোচ্চার হোন না কেন, ইতালির ফ্যাসিস্ত-নায়ক মুসোলিনি সম্পর্কে তিনি ব্যক্তিগতভাবে তেমন কোনও কঠোর মনোভাব প্রায় প্রকাশই করেননি। এর কারণ কি? অনুমিত হয়, মুসোলিনির ব্যক্তিত্ব ও সৌজন্যবোধ রবীন্দ্রনাথকে অনেকখানি প্রভাবিত করেছিল। রম্যাঁ রলাঁর মতে, এটা কবির অতি সারল্য এবং অনভিজ্ঞতার পরিচায়ক। গবেষক সৌরীন্দ্র মিত্র মনে করেন “আজ হয়তো অনেকেই আবিসিনিয়ার যুদ্ধ থেকে আরম্ভ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত মুসোলিনির ভূমিকার কথা স্মরণ করে রলাঁর অভ্রান্ত ঐতিহাসিক দৃষ্টির তারিফ করবেন কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ সত্য হবে না। …মুসোলিনি-চরিত্রে দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও তাঁর মধ্যে অসাধারণত্ব কিছু ছিল একথা বিশ্বাস করবার মতো ব্যক্তি সে সময় যে ফ্যাসিবিরোধীদের মধ্যেই অনেকে ছিলেন তার অনেক নজির আছে।”৩৫ সম্ভবত রবীন্দ্রনাথও ছিলেন তাঁদের মতো একজন, অন্তত ১৯৩৬ সালে ইতালি কর্তৃক আবিসিনিয়া দখল করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত।
এ প্রসঙ্গে গবেষক ড. নেপাল মজুমদার যা লিখেছেন তা প্রণিধানযোগ্য:
১৯২৮-২৯ সালের পর ইউরোপে মুসোলিনি ও ইতালির ফ্যাসিস্ত-শাসন সম্পর্কে উত্তেজনা অনেকটা শান্ত বা থিতিয়ে এসেছিল। পৃথিবীর সব বড়ো বড়ো রাষ্ট্রই তাকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশেষ করে, ভারতবর্ষের রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলের একটা বড়ো অংশের মধ্যে মুসোলিনিও ফ্যাসিজম সম্পর্কে তখন একটা উচ্চ ধারণা ও রঙিন প্রত্যাশার শিহরণ জাগছে (মুষ্টিমেয় কমিউনিস্ট ও সোশ্যালিস্টরা ছাড়া)। এমন কি গান্ধিজি, পণ্ডিত মালব্য, সুভাষচন্দ্র প্রমুখ কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারাও অনেকে ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণের আগে পর্যন্ত মুসোলিনির ও ফ্যাসিজমের প্রকৃত চরিত্ররূপ সঠিক উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি। কেউ কেউ মুসোলিনি ও ফ্যাসিস্ত মতাদর্শের প্রকাশে উচ্চ প্রশংসা করেছেন।৩৬
উল্লেখ্য যে বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের মধ্যেও ফ্যাসিজম সম্পর্কে মোহ সেই সময় কিছু কম ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতালীয় ভাষা-সাহিত্যের অধ্যাপক পি. এন. রায় (প্রমথনাথ রায়), অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা সেই সময় মুসোলিনি এবং ফ্যাসিস্তশাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্র কাঠামো সম্পর্কে প্রশংসাসূচক প্রবন্ধাদি লিখে চলেছিলেন ‘Modern Review’-এর পাতায়।৩৭ এই সবকিছুই হয়তো রবীন্দ্রনাথকে সাময়িকভাবে প্রভাবিত করেছিল, এই অনুমান অসঙ্গত নয়।
যাহোক, এসব সত্ত্বেও নানা ধরনের বিভ্রান্তি কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একজন আপসহীন বিবেকবান সংগ্রামী যোদ্ধারূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং বিশ্ব-ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের যোগদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের উদাত্ত কণ্ঠস্বর শোনা যেতে থাকে ১৯২৭ সাল থেকেই। ১৯২৭-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি, প্যারিসের স্যালবুলিয়েতে আঁরি বারব্যুস ও রম্যাঁ রলাঁর নেতৃত্বে প্রথম ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের প্রাক্কালে (১৯২৭) বারব্যুস একটি মর্মস্পর্শী চিঠিসহ রবীন্দ্রনাথের কাছে স্বাক্ষর প্রার্থনা করে ‘মুক্ত চেতনার প্রতি আবেদন’ (The Appeal to the Free Spirits) ঘোষণাপত্রটি পাঠান। এই ঘোষণাপত্রে ভারতবর্ষ থেকে একমাত্র রবীন্দ্রনাথই স্বাক্ষর করে সানন্দচিত্তে বারব্যুসের নিকট একটি জবাবিপত্র প্রেরণ করেন।৩৮ এই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল:
….আমরা সর্বত্র লক্ষ্য করছি যে ফ্যাসিবাদের নামে, স্বাধীনতার সমস্ত বিজয়কে হয় ধ্বংস নতুবা বিপদাপন্ন করা হচ্ছে। সংগঠন গড়ার অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের ও বিবেকের স্বাধীনতা– যা শত শত বৎসরের আত্মত্যাগ ও আয়াসে আর্জিত হয়েছে– আজ সেই সবকিছুকেই নির্দয়ভাবে নির্মূল করা হচ্ছে। প্রগতির এই দেউলিয়া অবস্থায় আমরা আর নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকতে পারি না।
আমাদের ধারণা, ইদানীংকালে পৃথিবীতে মনীষা ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে যে যতটুকু প্রভাব বিস্তারে সক্ষম, তাঁদের সকলকে ফ্যাসিবাদের বর্বর অভিযানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে একটি সংগঠনে মিলিত হতে আহ্বান জানানোর সময় এসেছে…।৩৯
অল্পকালের মধ্যেই ইউরোপ তথা সমগ্র পৃথিবীব্যাপী সেই ভয়ংকর অর্থনৈতিক সংকট (১৯২৯-৩০) শুরু হয়ে যায়। এর পরই বিশ্বপরিস্থিতি ক্রমশই ঘোরালো হয়ে উঠতে থাকে এবং সেই সঙ্গে পুরোদমে চলতে থাকে যুদ্ধ-প্রস্তুতিও। জার্মানিতে ‘নাৎসিবাদ’ আত্মপ্রকাশ করে, যা এক নতুন ধরনের উগ্র ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর।
তথ্যসূত্র:
১. নেপাল মজুমদার, ‘রবীন্দ্রনাথ : কয়েকটি রাজনীতিক প্রসঙ্গ’, ১৯৮৫ পৃ. ১৭
২. তদেব; পৃ. ৪৩
৩. তদেব, পৃ. ৪২-৪৩
৪. তদেব
৫. তদেব; পৃ. ৪৪
৬. ‘Modern Review’; July, 1919; p. 81
৭. নেপাল মজুমদার, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৯৭-৯৮
৮. রম্যাঁ রলাঁ, ‘শিল্পীর নবজন্ম’; (সরোজ দত্ত-কৃত বঙ্গানুবাদ); পৃ. ২৬-২৭
৯. নেপাল মজুমদার, পূর্বোক্ত; পৃ. ৪৮-৮৯
১০. সৌরীন্দ্র মিত্র, ‘খ্যাতি-অখ্যাতির নেপথ্যে’, আনন্দ ১৯৭৭, পৃ. ৫১০-২৩
১১. নেপাল মজুমদার, ‘ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ’, ২য় এবং ৩য় খণ্ড, কলকাতা, ১৯৮৮ ও ১৯৯১
১২. সৌরীন্দ্র মিত্র, পূর্বোক্ত, (‘রবীন্দ্রনাথ ও রম্যাঁ রলাঁ’ শীর্ষক অধ্যায় দ্রষ্টব্য)
১৩. দ্র. নেপাল মজুমদার, ‘ভারতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ’, ২য় খণ্ড
১৪. সৌরীন্দ্র মিত্র, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫১১
১৫. অবন্তী সান্যাল, ‘রবীন্দ্রনাথের ইতালি সফর’, ‘এক্ষণ’, শারদীয়, ১৩৮৪
১৬. নির্মলকুমারী মহলানবীশ, ‘কবির সঙ্গে য়ুরোপে’, কলকাতা পৃ. ২০৮
১৭. তদেব
১৮. সৌরীন্দ্র মিত্র, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫১১
১৯. রম্যাঁ রলাঁ, ‘শিল্পীর নবজন্ম’, (সরোজ দত্ত-কৃত বঙ্গানুবাদ); পৃ. ৬৩
২০. সৌরীন্দ্র মিত্র, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫১১-১৩
২১. তদেব, পৃ. ৫১২
২২. তদেব; পৃ. ৫১৪
২৩. তদেব
২৪. তদেব; পৃ. ৫২০
২৫. তদেব; পৃ. ৫২১
২৬. সৌরীন্দ্র মিত্র, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫২০
২৭. নেপাল মজুমদার, ‘ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ’ ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩০-৩৫
২৮. সৌরীন্দ্র মিত্র, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫২০
২৯. ‘Anti-Fascist Traditions in Bengal’, Published by Indo-G.D.R. Friendship Society, Calcutta, 1975; p. 3
৩০. ‘বাংলার ফ্যাসিস্ত-বিরোধী ঐতিহ্য’, মনীষা গ্রন্থালয় কর্তৃক প্রকাশিত সংকলন, কলকাতা, ১৯৭৫; পৃ. ৯-১০
৩১. নেপাল মজুমদার, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৩
৩২. তদেব: পৃ. ৬৪-৬৫
৩৩. তদেব; পৃ. ৬৫
৩৪. তদেব; পৃ. ৬৭
৩৫. সৌরীন্দ্র মিত্র, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫২৪
৩৬. নেপাল মজুমদার, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬৭-৬৮
৩৭. তদেব; পৃ. ৬৯
৩৮. তদেব; পৃ. ২০
৩৯. ‘Anti-Fascist Traditions in Bengal’, op.cit. p. 5