আমাদের ভাষাসমস্যা

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

আমরা বঙ্গদেশবাসী। আমাদের কথাবার্তার, ভয় ভালোবাসার চিন্তাকল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। দুঃখের বিষয়, জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধের ন্যায় এই সোজা কথাটিকেও আমাদের মধ্যে এক সম্প্রদায়কে বুঝাইয়া দিলেও তাঁহারা জোর করিয়া বুঝিতে চাহেন না। তাই মধ্যে মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা কী কিংবা কী হইবে, তাহার আলোচনা সাময়িক পত্রিকাদিতে দেখিতে পাওয়া যায়। হা আমাদের সূক্ষ্ম বুদ্ধি!

মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষা কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া পরান আকুল করে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষার ধ্বনির জন্য প্রবাসীর কান পিয়াসি থাকে? মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষায় কল্পনা-সুন্দরী তাহার মন-মজানো ভাবের ছবি আঁকে? কাহার হৃদয় এত পাষাণ যে মাতৃভাষার অনুরাগ তাহাতে জাগে না? পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনা করিয়া দেখ মাতৃভাষার উন্নতি ব্যতীত কোনও জাতি কখনও কি বড়ো হইতে পারিয়াছে? আরব পারস্যকে জয় করিয়াছিল। পারস্য আরবের ধর্মের নিকট মাথা নিচু করিয়াছিল, কিন্তু আরবের ভাষা লয় নাই; শুধু লইয়াছিল, উহার ধর্মভাব আর কতকগুলি শব্দ তাই আনোয়ারী, ফারদৌসী, সাদী, হাফিয, নিযামী, যামী, সানাই, রূমী প্রমুখ কবি ও সাধক বুলবুল কুলের কলতানে আজ ইরানের কুঞ্জকানন মুখরিত। যে দিন ওয়াইক্লিফ লাটিন ছাড়িয়া ইংরেজি ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করিলেন, সেই দিন ইংরেজির ভাগ্য-লক্ষ্মী সুপ্রসন্ন হইল। যতদিন পর্যন্ত জার্মানিতে জার্মান ভাষা অসভ্য ভাষা বলিয়া পরিগণিত ছিল, ততদিন পর্যন্ত জার্মানির জাতীয় জীবনের বিকাশ হয় নাই। বেশি দূর যাইতে হইবে না। আমাদেরই প্রতিবেশী আমাদের হিন্দুস্থানি মুসলমান ভাইগণ সংখ্যায় এত অল্প হইয়াও এত উন্নত কেন? আর আমরা সংখ্যায় এত বেশি হইয়াও এত অবনত কেন? ইহার একমাত্র কারণ তাঁহারা মাতৃভাষার প্রতি অনুরক্ত আর আমরা মাতৃভাষার প্রতি বিরক্ত। হিন্দুস্থানি আলিমগণ উর্দু ভাষায় কোরানশরীফের অনুবাদ এবং তফসীর, ফিকহ, হদীস, তসউউফ, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, ভ্রমণ-বৃত্তান্ত, কাব্য, উপন্যাস প্রভৃতি বিষয়ে বহু মৌলিক গ্রন্থ রচনা করিয়া কিংবা এতদ্‌বিষয়ক আরবি, পারসি ও ইংরেজি প্রভৃতি ভাষার গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশ করিয়া উর্দু ভাষায় সর্বাঙ্গসুন্দর ইসলামি সাহিত্যের সৃষ্টি করিয়াছেন। কিন্তু দুই চারিজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ব্যতীত আমাদের মৌলবি মৌলানাগণ বঙ্গ ভাষায় গ্রন্থ রচনা করা দূরে থাকুক, বঙ্গভাষা কাফেরী ভাষা, তাহাতে ধর্ম গ্রন্থের অনুবাদ করিলে ধর্ম-গ্রন্থের অমর্যাদা করা হয় ইত্যাদি রূপ প্রলাপ উক্তি করিতে ছাড়েন না। বিশুদ্ধ রূপে বাংলা বলা বা লেখা তাঁহারা অপবাদজনক মনে করেন। ফলে তাঁহাদের ধর্মবিষয়ক বক্তৃতা শুনিয়া সামান্য বাংলা-জানা শ্রোতারা পর্যন্ত হাসিবে কি কাঁদিবে, তাহা ঠিক করিতে পারে না। তাঁহাদের বাংলা ভাষায় যেমন দখল উর্দুতেও তেমন। স্কুলের ন্যায় যে পর্যন্ত বাংলার মাদ্রাসায়ও বাংলা ভাষা অবশ্যপাঠ্য দেশীয় ভাষা রূপে স্থান না পাইবে, সে পর্যন্ত আমাদের এ দুরবস্থা ঘুচিবে না। যে পর্যন্ত আরবি পারসি জানা মুসলমান লেখক বাংলা ভাষার সেবায় কলম না ধরিবেন, সে পর্যন্ত কিছুতেই বঙ্গীয়-মুসলমান-সাহিত্য গঠিত হইবে না।

সে দিন অতি নিকট, যে দিন বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভাষার স্থান অধিকার করিবে। বিদেশীয় ভাষার সাহায্যে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চার মতন সৃষ্টিছাড়া প্রথা কখনও টিকিতে পারে না। যতদিন পর্যন্ত তাহা না হইতেছে, ততদিন পর্যন্ত আমাদিগকে একটি সময়োপযোগী শিক্ষাপ্রণালী অবলম্বন করিতে হইবে। স্কুলের ছাত্রদের জন্য তৃতীয় মান পর্যন্ত কেবলমাত্র বাংলা থাকিবে। চতুর্থ মান হইতে ইংরেজি আরম্ভ হইবে। পঞ্চম মান হইতে classical language শুরু হইবে। মুসলমান ছাত্রের পক্ষে কোন classical language লওয়া উচিত, ইহার উত্তরে প্রত্যেক মুসলমান এক বাক্যে বলিতে বাধ্য হইবেন– আরবি। আল্লাহ্‌-র শেষ প্রত্যাদেশ আরবিতে। আল্লাহ্‌র শেষ নবি আরবি। আমরা সেই নবির উন্মত (মণ্ডলী)। সেই শেষ প্রত্যাদেশের উত্তরাধিকারী। অনুবাদে মূলের ছায়া পাওয়া যায় মাত্র; মূলের প্রাণ অনুবাদে থাকিতে পারে না। যদি ইসলাম ধর্মকে তাহার প্রাথমিক যুগের অনাবিল অবস্থায় বজায় রাখা আবশ্যক বলিয়া মনে হয়, যদি শত দেশ ভেদ এবং সহস্র ভাষাভেদ সত্ত্বেও ইসলামের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অক্ষুণ্ণ রাখা কর্তব্য বলিয়া মনে হয়, তবে মুসলমানকে তাহার কোরআন হাদীস মূল ভাষায় পড়িতে হইবে, পড়িয়া বুঝিতে হইবে, বুঝিয়া মজিতে হইবে। যদি মরুকে নগর করিবার, পশুকে মানুষ করিবার, অন্ধকে চক্ষুষ্মান্‌ করিবার, কাঙ্গালকে আমীর করিবার, ভীরুকে বীর করিবার আমোঘ মন্ত্র শিখিতে চাও তবে আরবি কোরআন শিখ। যেমন প্রত্যেক খ্রিস্টান বালক তাহার বাইবেল জানে, যে পর্যন্ত মুসলমান বালক তেমনই তাহার কোরআন শরীফকে না জানিবে, সে পর্যন্ত মুসলমান সমাজ জাগিবে না। সমস্ত জগতের বদলে যে মুসলমান তাহার কোরআন ছাড়িতে প্রস্তুত ছিল না, আজ দেখ সেই মুসলমান সন্তান সংস্কৃত, পারসি কিংবা পালি ভাষার বিনিময়ে কিরূপে তাহার কোরআনকে বর্জন করিতেছে। হা ধিক্ আমাদের মৌখিক ধর্মানুরাগকে! হা ধিক্ আমাদের দুনিয়া-পূজাকে! আমি বলি না মুসলমান কূপমণ্ডূক হইয়া কেবল আরবি সাহিত্যই আলোচনা করিবে। জগতের জ্ঞান-ভাণ্ডার মুসলমানেরই জন্য। ধর্মগুরু এইরূপ বলিয়াছেন যে, “বিজ্ঞান মুসলমানের হারানো ধন, যেখানে পাও তাহাকে গ্রহণ কর।” পুনশ্চ, “জ্ঞান অনুসন্ধান কর, যদিও তাহা চীন দেশে হয়।” আমি শুধু এইটুকু বলিতে চাই আগে ঘরের খবর জান, পরে পরের খবর জানিও।

স্কুলের ন্যায় মাদ্রাসায়ও দেশীয় ভাষা, প্রধান ভাষা ও দ্বিতীয় ভাষা এই তিন ভাষার চর্চা হইবে। মাদ্রাসাতেও স্কুলের ন্যায় ১ম হইতে ১০ম পর্যন্ত দশ মানে জুনিয়ার বিভাগ এবং ১ম বর্ষ হইতে ৬ষ্ঠ বর্ষ পর্যন্ত ছয় বর্ষে সিনিয়ার বিভাগ রাখিতে হইবে। ১ম ২য় ও তৃতীয় মানে কেবলমাত্র বাংলা ভাষা শিক্ষা দেওয়া হইবে। চতুর্থ মান হইতে আরবি ভাষা এবং পঞ্চম মান হইতে দ্বিতীয় ভাষা আরম্ভ হইবে। এক্ষণে জিজ্ঞাস্য, দ্বিতীয় ভাষা কী হওয়া উচিত? আমি বলি ইংরেজি। ইংরেজি ভাষার সাহায্যে আমাদের মৌলবি সাহেবগণ আধুনিক দর্শন, বিজ্ঞানের তত্ত্ব পাইবেন। যদি আমাদের আলিমকুল কূফূরী ফৎওযারূপ প্রচণ্ড দণ্ড দ্বারা আমাদের ইংরেজি শিক্ষিত সমাজকে ভীতচকিত ও দলিতমথিত করিয়া ইসলামের অপ্রতিহত ক্ষমতার পরিচয় দিতে না গিয়া, বাস্তবিক তাহাদের হৃদয়রাজ্যে ভক্তির আসন লাভ করিতে চান; যদি তাঁহারা ক্রমবর্ধনশীল শিক্ষিত সমাজকে ইসলামের গণ্ডি হইতে খারিজ করিয়া না দিয়া তাহাদের প্রকৃত ধর্মোপদেশক হইতে চান, তবে তাঁহাদিগকে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপক্ক হইতেই হইবে। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরিতেছে বলিলে যাঁহাদের মতে অতি ভালো মুসলমানও কাফের হইয়া যায়, পৃথিবী মাছের পিঠে আছে, পৃথিবীর চারিদিকে কাফ পাহাড় দিয়া ঘেরা ইত্যাদিরূপ বালকোচিত মত যাঁহারা আজও গম্ভীরভাবে প্রচার করেন, তাঁহাদিগকে তাঁহাদের সমস্ত ধার্মিকতা সত্ত্বেও শিক্ষিত সমাজ ভক্তি করিতে অক্ষম।

স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সর্বত্রই উর্দু বা পারসি বৈকল্পিক বিষয় (optional subject) থাকিলে মুসলমান ছাত্রগণের ভাষা সমস্যার সমাধান হয়। যাহাতে উর্দু বা পারসি বৈকল্পিক বিষয় হইতে পারে, তজ্জন্য আমাদিগকে শিক্ষাবিভাগের কর্তৃপক্ষগণকে সম্মত করাইতে হইবে।

অনেক দিন পূর্বে উর্দু বনাম বাংলা মোকদ্দমা বাংলার মুসলমান সমাজের ভিতর উঠিয়াছিল, তাহাতে বাংলার ডিক্রি হইয়া মোকদ্দমা নিষ্পত্তি হইয়া যায়; বর্তমানে আবার সেই মোকদ্দমার ছানি বিচারের জন্য উর্দু পক্ষকে বিস্তর সওয়াল জওয়াব করিতে শুনিতেছি। কিন্তু ন্যায়বান বিচারক দেখিবেন যে উর্দু বাংলার দখল উত্ত্যক্তে কিছুতেই খাস দখল পাইতে পারে না; দখল বাংলারই থাকিবে, তবে উর্দু বাংলার অধীনে উপযুক্ত করে ইচ্ছাধীন প্রজাই স্বত্বে কিছু ভূমি বন্দোবস্ত পাইতে পারে মাত্র।

বাংলা ভাষা চাই-ই। মুহম্মদ ই-বখতিয়ারের বাংলা জয়ের পরে যখন হইতে মুসলমান বুঝিল এই চিরহরিত ফলশস্যা-পূরিতা নদ-নদী ভূষিতা বঙ্গভূমি শুধু জয় করিয়া ফেলিয়া যাইবার জিনিস নহে; এদেশ কর্মের জন্য, এ দেশ ভোগের জন্য, এ দেশ জীবনের জন্য, এ দেশ মরণের জন্য, তখন হইতে মুসলমান জানিয়াছে বাংলা চাই। তাই বাংলার পাঠান বাদশাহগণ বাংলা ভাষাকে আদর করিতে লাগিলেন। যে ভাষা দেশের উচ্চ শ্রেণির অবজ্ঞাত ছিল, তাহা বাদশাহের দরবারে ঠাঁই পাইল। নসরৎ শাহ, হোসেন শাহ, পরাগল খাঁ, ছুটি খাঁর নাম বাঙালি ভুলিতে পারিবে না। বাদশাহের দেখাদেখি আমির ওমরা বাংলার খাতির করিলেন। আমির ওমরার দেখাদেখি সাধারণে বাংলার আদর করিল। গোঁড়া ব্রাহ্মণের অভিসম্পাত ও চোখ রাঙানিকে ভয় না করিয়া বাঙালি নবীন উৎসাহে তাঁহার প্রিয় ধর্ম পুস্তকগুলি বাংলায় অনুবাদ করিল, কত দেশ প্রচলিত ধর্মকথা বাংলায় প্রকাশ করিল, কত মর্মগাথা বাংলায় প্রচার করিল। মুসলমানও চুপ করিয়া থাকে নাই। হিন্দুর রামায়ণ আছে; মুসলমানের “জঙ্গ নামা” আছে। হিন্দুর মহাভারত আছে, মুসলমানের “কাসাসোল আম্বিয়া” আছে। হিন্দুর মহাজন পদাবলি আছে; মুসলমানের মারফতী গান আছে। হিন্দুর বিদ্যাসুন্দর আছে; মুসলমানের “পদ্মাবতী” আছে।

এই পুথি সাহিত্যকে ঘৃণা করিলে চলিবে না। ইহাই বাঙালি মুসলমানের খাঁটি সাহিত্য। সেই সময়ের কথিত ভাষায় পুথিগুলি রচিত হইয়াছিল। তখন পারসি রাজ-ভাষা। মুসলমানেরা বাংলা দেশে নূতন ভাব ও নূতন জিনিস আনিয়াছিলেন। এই নূতন ভাব ও নূতন জিনিসের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের পারসি নাম বাংলা ভাষায় ঢুকিয়া পড়িল। রাজভাষার প্রভাব কথিত ভাষার উপর হওয়া স্বাভাবিক। এখন যেমন বাঙালি চলিত ভাষায় ইংরেজির বুকনি ঝাড়েন, তখন ঝাড়িতেন পারসির বুকনি। মুসলমান সেই পারসির ‘আমেজ’ দেওয়া কথিত ভাষাতেই পুথি লিখিতেন। হিন্দু কিন্তু লিখিবার সময় যথাসাধ্য পারসি বর্জন করিয়া শুদ্ধ বাংলা ব্যবহার করিতেন। এখনও বাংলা ভাষায় প্রায় দুই হাজার পারসি বা পারসিগত আরবি শব্দ পারসি প্রভাবের পরিচয় দিতেছে।

গুটিকতক শিক্ষিত লোককে ছাড়িয়া দিলে, এখনও এই পুথি সাহিত্যই বাংলার বিশাল মুসলমান-সমাজের আনন্দ ও শিক্ষা সম্পাদন করিতেছে। পুথি-পাঠক যখন সুর করিয়া পুথি পড়িতে থাকে তখন শ্রোতৃবর্গ কখনও কারবালার শহিদগণের দুঃখে গলিয়া যায়, কখনও আমির হামজার বা রোস্তমের বীরত্বে মাতিয়া উঠে, কখনও বা হাতেমের দয়ায় ভিজিয়া যায়। বেচারাদের আহার নিদ্রার কথা, ঘর সংসারের কথা, চিরদৈন্যের কথা আর মনে থাকে না। দীনেশবাবুর “বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের” ন্যায় কে আমাদের এই পুথি সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করিবে?

যদি পলাশি ক্ষেত্রে বাংলার মুসলমানের ভাগ্য-বিপর্যয় না ঘটিত, তবে হয়তো এই পুথির ভাষাই বাংলার হিন্দু-মুসলমানের পুস্তকের ভাষা হইত। যাউক সে কথা। অতীতকে যখন আমরা বদলাইতে পারিব না, তখন সে কথা লইয়া বেশি আলোচনায় লাভ কি? এখন বর্তমানে আমরা বুঝিয়াছি পুথির ভাষা আর চলিবে না। তাহার সময় গিয়াছে। অতীত যুগের জীব-কঙ্কালের ন্যায় তাহাকে কেবল দেখিবার জন্য রাখিয়া দাও। এখন আমাদের শিক্ষিত সমাজের রুচি সাধু ভাষার দিকে। এখন এই ভাষাই চলিবে। ইহাতেই লেখাপড়া করিতে হইবে। ইহাতেই আমাদের ভাবী বাঙলার মুসলমান সাহিত্য রচনা করিতে হইবে।

আর এক কথা। মুসলমানের ধর্ম দেশগত বা জাতিগত ধর্ম নহে। তাহা সর্বজনীন ধর্ম। মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য তাহার ধর্ম তাহার প্রতিবেশীকে বুঝাইয়া দেওয়া। সাহিত্যের ভিতর দিয়া আমাদিগকে ইসলামের মহত্ত্ব, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব, ইসলামের সৌন্দর্য প্রচার করিতে হইবে। এ কথা অস্বীকার করিবার জো নাই যে বাঙালি হিন্দু মুসলমান ধর্ম অপেক্ষা খ্রিস্টান ধর্মের অধিক পক্ষপাতী। সে কি খ্রিস্টান ইংরাজি সাহিত্যের প্রভাবে নহে? প্রচারের উদ্দেশ্যে আমাদিগকে আমাদিগের প্রতিবেশীর ভাষা গ্রহণ করিতে হইবে। যে ভাষা তাঁহাদিগের মর্ম স্পর্শ করে, সেই ভাষা ব্যবহার করিতে হইবে। হিন্দুর ভাষায় ইসলামি ভাব ফুটাইতে হইবে। কবি কি সুন্দর বলিয়াছেন–

সুখন কষ বহবে দী গোঈ চে ইবরানী চে সুরিযানী।                                                                                 মকাঁ কষ বহবে হক্ জোঈ চে জাবল্‌কা চে জাবল্‌সা।।
ধর্মের তরে আছে সব বাণী, কি বা সে হিন্দু কিবা সুরিয়ানী।                                                                   সত্যের তরে খোঁজ সব ঠাঁই, পূর্ব-পশ্চিম কোন ভেদ নাই।

মুসলমানি বাংলার কটমট বুলি বাংলার হিন্দুর কানে স্থান পাইবে না, অন্তরে তো নয়ই। খোদা, পয়গম্বর বেহেশ্‌ত, দোজখ, ফেরেশ্‌তা, নামাজ, রোজা প্রভৃতি পারসি শব্দ ব্যবহার করিতে যদি আপত্তি না থাকে, তবে ঈশ্বর, স্বর্গ, নরক, উপাসনা, উপবাস প্রভৃতি শব্দ ব্যবহারে আপত্তি কেন? পানি, চাচা, নানা, দাদা, ফুফু প্রভৃতি শব্দগুলি তো হিন্দি বা রাজপুতানি ইহাদের জন্য এত মারামারি কেন?

মুসলমানি বাঙলা বাংলাদেশে প্রাদেশিক বুলির ন্যায় চলিত ভাষায় থাকিতে পারে, কিন্তু তাহা সাহিত্যের ভাষা হইবে না। জলকে পথ নির্দেশ করিয়া দিতে হয় না। সে আপনার পথ আপনি চিনিয়া লয়। বাঙলার মুসলমানের মন আপনিই জানিতে পারিয়াছে কোন ভাষায় তাহাকে সাহিত্য রচিতে হইবে। এখন মৌলানা, মৌলবি ও পণ্ডিত, যিনিই বঙ্গ ভাষায় স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া কিছু লিখিতেছেন, তিনিই সাধু ভাষা ব্যবহার করিতেছেন। দুই এক জন যদি কেহ মুসলমানি বাংলা চালাইতে চেষ্টা করেন বা তাহাতে বই লেখেন, তাহা শুধু কলমের জোরে। ইহাদেরই সমশ্রেণীর মহাত্মারা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কলমের জোরে উর্দু করিয়া দিতে চান। কখনও কখনও আমার মনে হয় হয়তো ইহাদের কলম বনমানুষের হাড়ে তৈরি, তাহা না হইলে এত গুণ কোথা হইতে আসিল।

বনমানুষের হাড়ে কত গুণ?                                                                                                             নুনকে বানায় চুণ, চুণকে বানায় বেগুন।

এখানে এক নূতন সমস্যা উপস্থিত হইতেছে। বর্তমানে বাংলা লেখকগণের মধ্যে ভাষার রীতি (style) লইয়া তিন দলের সৃষ্টি হইয়াছে। একদল কলিকাতার বিভাষাকে সামান্য একটু মাজিয়া ঘষিয়া চালাইতে চান। এই দলের চাঁই “সবুজ পত্রের” সম্পাদক প্রমথবাবু। আমি রবিবাবুকে এই দলের প্রধান বলিয়া মনে করি। ইহাদিগকে চরমপন্থী বলা যাইতে পারে। দ্বিতীয় দল সাবেক দল। ইহারা ভাষার কোনও পরিবর্তন সহ্য করিতে পারেন না। “সাহিত্য” পত্রিকা এই দলের মুখপাত্র। ইহারা প্রাচীন পন্থী। তৃতীয় দল সকলের বোধগম্য সহজ সরল বাংলা প্রচলন করিতে চান। পরলোকগত অক্ষয়কুমার সরকার ও মহা-মহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রভৃতি এই মতাবলম্বী। ইহাদিগকে মধ্যপন্থী বলা যাইতে পারে। এই তিন দলের মধ্যে কোন্ দলে আমরা যাইব? এই প্রশ্নের একটি গা-জোরি উত্তর না দিয়া ধীর ভাবে আলোচনা করিয়া দেখা যাউক কোন্ দলে আমাদের যাওয়া উচিত।

যেমন রাজনীতিক্ষেত্রে অভিজাত তন্ত্র (Aristocracy) এবং গণতন্ত্র (Democracy) আছে, ভাষাক্ষেত্রেও তদ্রূপ অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্র আছে। ভারতীয় ভাষা হইতে আমি ইহার উদাহরণ দিতেছি। যে সময় ঋষিগণের মধ্যে বৈদিক ভাষা প্রচলিত ছিল, সেই  সময় সাধারণ আর্যগণের মধ্যে বৈদিক হইতে কিছু বিভিন্ন লৌকিক ভাষা প্রচলিত ছিল। বৈদিক ছিল অভিজাতর ভাষা, লৌকিক ছিল গণতন্ত্রের ভাষা। ঋষিরা বলিলেন “লৌকিক ভাষা অগ্রাহ্য অকথ্য। ন ম্লেচ্ছতবৈ। নাপভাষিতবৈ। ম্লেচ্ছ ভাষা ব্যবহার করিও না। অপভাষা ব্যবহার করিও না। যদি কর প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে।” ঋষিরা বলিলেন, “খবরদার! ব্যঞ্জনের উচ্চারণে কিংবা স্বরের উচ্চারণে যদি এক চুল পরিমাণ এদিক ওদিক হয়, তবে আর তোমার রক্ষা নাই। দেখ না অসুরেরা ‘হে অরয়ঃ হে অরয়ঃ’ স্থানে ‘হেলয়ঃ হেলয়ঃ’ বলিয়াছিল, তাই তাহারা ধ্বংস হইয়া গেল। দেখ না বৃত্রের পিতা পুত্রেষ্টি যজ্ঞে ইন্দ্রশত্রু শব্দ বলিতে স্বরে অপরাধ করিয়াছিল। তাই বৃত্র ইন্দ্রের জেতা না হইয়া ইন্দ্রই বৃত্রের নিহন্তা হইল।” ঋষিদিগের শত সহস্র দোহাইতেও কিন্তু বৈদিক ভাষা পূজা অর্চনায় ছাড়া অন্যত্র লৌকিক ভাষার নিকট টিকিতে পারিল না। গণতন্ত্রের নিকট অভিজাততন্ত্রের পরাজয় হইল।

পরবর্তীকালে উচ্চ বর্ণেরা লৌকিক ভাষাকে মার্জিত করিয়া সংস্কৃত করিয়া লইল। সাধারণে লৌকিক ভাষা পালি ব্যবহার করিতে লাগিল। ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রকারেরা বলিলেন, “ন ম্লেচ্ছভাষাং শিক্ষেত– ম্লেচ্ছভাষা শিখিও না।” তখন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দুর্দশা, বৌদ্ধ ধর্ম তাহার নবীন তেজে দণ্ডায়মান। কেহ ব্রাহ্মণের কথা শুনিল না। বৌদ্ধ গণতন্ত্রের পক্ষ হইল। পালি ভাষা এক বিপুল সাহিত্যের ভাষা হইল। গণতন্ত্রের নিকট অভিতাজতন্ত্রের পরাজয় হইল।

আর এক যুগ আসিল। এখন রাজশক্তি বৌদ্ধ। বৌদ্ধ এখন অভিজাততন্ত্রের দিকে। বৌদ্ধ এখন ধর্মের দোহাই দিয়া পালিকে ধরিয়া রাখিতে চাহিল; তখন কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষ লইল জৈন ধর্ম। তখন লৌকিক ভাষা প্রাকৃত। পালি প্রাকৃতের নিকট তিষ্ঠিতে পারিল না। গণতন্ত্রের নিকট অভিজাততন্ত্রের পরাজয় হইল।

আর এক যুগ আসিল। এ-যুগ অন্ধকারময়। এ যুগে উচ্চ শ্রেণির প্রাকৃত নিম্ন শ্রেণির অপভ্রংশের নিকট পরাজিত হইল। এই অপভ্রংশ হইল বাংলা, ওড়িয়া, আসামি, হিন্দি, গুজরাতি, মারহাঠি প্রভৃতি দেশীয় ভাষাসমূহের জননী।

তারপর আধুনিক যুগ। এ যুগে পণ্ডিতেরা সাধারণের ভাষাকে মাজিয়া ঘষিয়া সাধু ভাষা করিয়া লইলেন, বিশাল জনসাধারণের ভাষাকে ইতর ভাষা বলিয়া ফেলিয়া রাখিলেন। বর্তমানে এই ইতর ভাষা পণ্ডিতের ভাষার উপর আত্মপ্রতিষ্ঠা করিতে চাহিতেছে। পণ্ডিত তাঁহার অন্ধ সংস্কৃত ভক্তির জন্য বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের দুর্বহ শিকলে বাঁধিতে চাহিতেছেন। আর ইতর ভাষা সেই শিকলকে কাটিতে চাহিতেছে। তাহার চেষ্টা ফলবতী হইবে কি? যদি ভারতের ভাষা ইতিহাসের শিক্ষা মিথ্যা না হয়, তবে নিশ্চয়ই একদিন এই ইতর ভাষা সাধু ভাষাকে, যেমন লৌকিক বৈদিককে, পালি সংস্কৃতকে, প্রাকৃত পালিকে, অপভ্রংশ প্রাকৃতকে ঠেলিয়া দিয়াছিল সেইরূপে ঠেলিয়া ফেলিবে। সাধুভাষা মৃত ভাষারূপে পুস্তকে ঠাঁই পাইবে। যেমন মিলটন, জনসন প্রভৃতির লাটিন-বহুল ভাষা এখন কেবল কেতাবি ভাষা হইয়া রহিয়াছে। এখনকার সাধু ভাষার অবস্থাও সেই রূপ হইবে। পরিণামে চরম পন্থারই জয় হইবে। তবে মধ্যম পন্থা বর্তমান পরিবর্তনশীল যুগের (Transitional period এর) উপযুক্ত ভাষা বটে। একেবারে নি হইতে সা-তে সুর নামাইতে গেলে অনেকের কানে বেখাপ্পা লাগিবে নিশ্চয়ই।

ভাষাবিজ্ঞান শিক্ষাদান করে যে বহু প্রাদেশিক বিভাষার মধ্যে যে বিভাষায় বহু সদ্‌ গ্রন্থ রচিত হয় বা যাহা রাজশক্তির আশ্রয় পায়, তাহা সাহিত্যের ভাষা হইয়া উঠে। জীবজগতের ন্যায় বিভাষাগুলির মধ্যেও যোগ্যতমের পরিত্রাণ নীতি চলিয়া আসিতেছে। সাহিত্যিক শক্তিতে নবদ্বীপের বুলি সমস্ত বাংলায় সাহিত্যের ভাষা হইয়া উঠিয়াছিল। এখন পুনরায় সাহিত্যিক শক্তিতেও রাজশক্তির আশ্রয়ে কলিকাতার বুলি বাংলা সাহিত্যের ভাষা হইয়া উঠিতেছে। এখন বাংলার বিভিন্ন জেলার ভদ্রলোক আপোসে কথাবার্তার জন্য কলিকাতার বুলিই ব্যবহার করেন। সাহিত্যিক ভাষা হইয়া উঠিবার ইহাই সূচনা। তারপর রবিবাবু প্রমুখ কলিকাতাবাসী সাহিত্যিক গণের প্রভাবে কলিকাতার বিভাষা সাহিত্যের ভাষার স্থান অধিকার করিতে চলিয়াছে।

ভাষার-রীতি সম্বন্ধে আর একটি কথা বলিয়া এ সম্বন্ধে আমার বক্তব্য শেষ করিতেছি। এক দল অন্ধ সংস্কৃতভক্ত বাংলা ভাষার মধ্যে প্রচলিত আরবি পারসি শব্দগুলিকে যাবনিক বলিয়া বর্জন করিতে চাহেন। আমি বলি আগে তাঁহারা বাংলা দেশ হইতে যবনকে দূর করুক, পরে ভাষা হইতে যাবনিক শব্দগুলি দূর করিবেন। যখন সংস্কৃত ভাষা হোরা, কেন্দ্র, জামিত্র, দীনার প্রভৃতি গ্রিক শব্দ এবং ইকবাল, মুকাবিলা প্রভৃতি আরবি শব্দ গ্রহণ করিয়াছে, তখন বাংলা ভাষার বেলায় আপত্তি কেন? ঐ সকল আরবি পারসি শব্দ বাংলা ভাষার অস্থিমজ্জাগত হইয়াছে। ভাষা হইতে ইহাদিগকে তাড়ানো সহজ ব্যাপার হইবে না। দোয়াত, কলম, কাগজ, জামা, কামিজ, কমর, বগল প্রভৃতি আইন আদালতে প্রচলিত সর্বসাধারণের সহজবোধ্য হাজার খানিক শব্দ ত্যাগ করিয়া নূতন শব্দ গড়িলে তাহা নামের জোরে পুস্তকে চলিতে পারে বটে, কিন্তু তাহা ভাষায় চলিবে না। বাংলা ভাষায় আরবি, পারসি, তুরকি, ইংরাজি, ফরাসি, পর্তুগিজ প্রভৃতি যে কোনও ভাষার শব্দ বেমালুম খাপ খাইয়া গিয়াছে, তাহারা নিজদের দখলি স্বত্ববলে বাংলা ভাষায় থাকিবে। তাহাদিগকে তাড়াইতে গেলে জুলুম করা হইবে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান