ভারতের মানবতাধর্ম


ক্ষিতিমোহন সেন

পৃথিবীর কোলে গাছপালা পশু-পক্ষী কীটপতঙ্গ সবাই জন্মাল। মানুষ জন্মাল কিন্তু একটা বিশেষ মহিমা নিয়ে। নারায়ণ ঋষি তাই ‘অথর্ববেদে’ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করছেন এই মহিমাটি মানুষকে কে দিল? ‘কো মম্‌হানং’ (১০, ২, ১২)। এই মহিমার সঙ্গে সঙ্গেই কি মানুষকে দেওয়া হল ক্রমাগত এগিয়ে চলবার ইচ্ছা, প্রকাশ করবার ব্যাকুলতা। ‘গাতু কো অস্মিন কঃ কেতুম্’ (ওই)। তাই বায়ু যেমন এক মুহূর্ত স্থির থাকতে পারে না তেমনি মানবের মনও কোনও আরামের বাঁধনেই আপনাকে কোনোমতে বাঁধা দিতে চায় না। ‘কথং বাতো নেলয়তি কথং ন রমতে মনঃ’ (ওই, ১০, ৭, ৩৭)। বোঝাই যাচ্ছে সব আপদের গোড়া ওই মন। যে মনটি দেওয়াতেই মানুষের এই বৈশিষ্ট্য সেই মনটি তার মধ্যে দিল কে? ‘কে অস্মিন নিহিতং মনঃ’ (ওই, ১০, ২, ১৯)। তার মধ্যে যেন কে এক আত্মাওয়ালা ভূতকে দিল বসিয়ে, ‘তস্মিন্ যদ্‌ যক্ষমাত্মন্বৎ (ওই, ১০, ২, ৩২)। তাই তো চলল মানুষের সাহিত্য-নৃত্য-গীতের জন্য ব্যাকুলতা (ওই, ১০, ২, ১৭)। এই সবই যেন এক ভূতের অর্থাৎ যক্ষের কাণ্ড। কিছুতেই তার আর সন্তোষ নেই।

বাউলদের গান শুনেছিলাম– ‘আরো কিছু আছে রে মন, পরদা সরা’। এই যে আরও কিছুর জন্য ব্যাকুলতা আর পরদা সরাবার জন্যে তাগিদ পশু-পক্ষীর নেই, আছে মানুষের। এই পরদা সরাবার চেষ্টার মধ্যেই মানুষের ধর্মের মূল।

ধর্মের আদিতে ছিল ভয়, তারপর এল লোভ, তারপর এল প্রেম। তাই আমাদের ধর্মের আদিম যুগে ভয় ও লোভেরই পরিচয় বেশি মেলে। ক্রমে ভক্ত ও ভাগবতেরা প্রেম ও ভক্তিকে ধর্মের জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন। ‘ঋগ্বেদের’ ঋষিরা ধন-জন-সুখ-সমৃদ্ধি প্রার্থনা করেছেন ইন্দ্র-চন্দ্র-বায়ু-বরুণের কাছে। স্বর্গই তখন তাঁদের ছিল কাম্য। পৃথিবীর দিকে মানুষের দিকে ভালো করে তাঁরা তখন তাকিয়ে দেখেননি। কিন্তু আর্যদের আসবার আগেও এদেশে দ্রাবিড় প্রভৃতি জাতের বিরাট সভ্যতা ছিল। তাঁদের সংস্কৃতির ধারা ছিল অন্য রকমের। নারীর প্রাধান্যের সঙ্গে তাঁদের মধ্যে ছিল পৃথিবীর প্রতি মমতা, মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা। ক্রমে যখন এই দুয়ের মিলন ঘটল তখন এদেশে একটা অপূর্ব অধ্যাত্ম ঐশ্বর্যের সৃষ্টি হল। বেদের মধ্যেই ক্রমে উত্তর ভাগে সেই মিলনের পরিচয় মেলে।

সেই যুগের অবৈদিক সংস্কৃতির কতকটা পরিচয় মেলে জৈন-বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মের আদি খুঁজলে। পণ্ডিতদের মধ্যে জৈনাদি ধর্মের আদি বেদ হতেও প্রাচীন। ভারতের জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে মানুষই প্রধান। ইন্দ্রাদি দেবতারা আছেন মানুষেরই মহত্ত্ব প্রকাশের জন্য। জৈনদের চতুর্বিংশ তীর্থংকর সবাই মানুষ। বৌদ্ধদের বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব অর্হতরাও সবাই মানুষ। দেবতারা এই মানুষেরই উপর ছত্রধারণ করছেন, পুষ্পবৃষ্টি করছেন। তুলসীদাস তো পরম ভাগবত, তাঁর রামায়ণ অর্থাৎ ‘রামচরিতমানসে’ রামই হলেন পরমভজনীয়। দেবতারাও রামায়ণে আছেন বটে কিন্তু আছেন শুধু মহামানবের উৎসবাদিতে ছত্র ধরতে, পুষ্পবৃষ্টি করতে বা শঙ্খ বাজিয়ে মানবের মহত্ত্ব ঘোষণা করতে।

‘ঋগ্বেদে’ সবই দেবতাদের কথা। শুধু দশম মণ্ডলে পুরুষসূক্তটি (১০, ৯০) দেখলে দেখা যায় মানুষের মাহাত্ম্য। কিন্তু দশম মণ্ডলটি ‘ঋগ্বেদের’ সবচেয়ে আধুনিক অংশ। তখন আর্যপূর্ব সংস্কৃতির সঙ্গে আর্যসংস্কৃতি সম্মিলন এদেশে ঘটেছে। উপনিষৎ ও ‘অথর্ব বেদ’ সেই যুগের। ‘অথর্বে’ আমরা মানুষের জয়গান দেখতে পাই। ‘অথর্বের’ ঋষিরা অনেক সময় দেবতাদের কথা না বলে মানুষেরই জয়গান করেছেন (১০, ২; ১১, ৮ ইত্যাদি)। স্কম্ভ-সূক্তগুলিতেও মানুষের মহিমা বার বার ঘোষিত হয়েছে। ‘অথর্বে’ দেখা যায় স্বর্গের বদলে পৃথিবীরই জয়গান। দ্বাদশ কাণ্ডের আরম্ভের তেষট্টিটি ঋক-ই পৃথিবীর মহিমা গান। ধার্মিক লোকের জয়গান না করে পঞ্চদশ কাণ্ডের আগাগোড়া সবটাতেই ব্রাত্য অর্থাৎ ব্রতহীন সহজ মানুষেরই মহিমা আথর্বণ ঋষিদের কণ্ঠে ধ্বনিত হল।

তাঁরা বললেন, মানুষের চেয়ে মহত্তর আর কি-ই বা আছে। তপস্যা, সাধনা, ব্রত, শ্রদ্ধা সবই তো মানুষেরই মধ্যে (অথর্ব ১০, ৭, ১)। পৃথিবী- দ্যৌঃ-অন্তরিক্ষ সবই এই মানুষেরই মধ্যে (ওই, ১০, ৭, ৩)। এই-সব কথাই হাজার হাজার বছর পরে যোগী-নাথ-বাউলরা নতুন করে বললেন। যেমন দেখা যাচ্ছে মৃত্যু মানুষের মধ্যে আছে, তেমনি অমৃতও রয়েছে মানুষেরই মধ্যে। মানুষেরই নাড়ীর মধ্যে নেচে চলেছে সমুদ্রের স্পন্দন (ওই, ১০, ৭, ৩৫)। খুঁজে দেখলে মানুষেরই মধ্যে ঋক্, যজু, সাম সর্ব বেদই মিলবে (ওই, ১০, ৭, ২০)। সব দেবতা, ভূত-ভবিষ্যৎ সর্বলোক এই মানুষেরই মধ্যে (ওই, ১০, ৭, ২২)। ব্রহ্মও এই মানুষেরই মধ্যে। মানুষের মধ্যে ব্রহ্মকে যিনি দেখতে পেয়েছেন তিনিই ব্রহ্মকে তাঁর পরমস্থানে উপলব্ধি করেছেন (ওই, ১০, ৭, ১৭)। এই রহস্য সকলে কেন উপলব্ধি করে না? তাতেও কুৎস ঋষি বলছেন সবাই দেখতে চায় এই চর্মচক্ষু দিয়ে, মন দিয়ে উপলব্ধি করে কয়জন, ‘পশ্যন্তি সর্বে চক্ষুষা ন সর্বে মনসা বিদুঃ’ (ওই, ১০, ৮, ১৪)।

পুরাণে আমরা ইন্দ্র-চন্দ্র-বায়ু-বরুণের জায়গায় শিব এবং বিষ্ণুরই মহিমা শুনতে পেয়েছি। শিব ও বিষ্ণুকে ভক্তেরা আপন মন দিয়ে মানুষরূপেই রচনা করেছিলেন। তাঁদের ঘর-বাড়ি আছে, ছেলেপুলে আছে, চাকর-বাকর সবই আছে। ভগবতী বাপের বাড়ি যাবেন, কার্তিক গণেশ সঙ্গে চললেন, মহাদেব তাই ব্যাকুল। তিনদিনের বেশি দেবী বাপের বাড়িতে যে থাকবেন তার জো কি। নন্দী-ভৃঙ্গী সবাই শিবের আজ্ঞায় তল্‌পি-তল্‌পা বাঁধতে লেগে গেলেন।

কাজেই শৈব বৈষ্ণব প্রভৃতি ধর্মসাধনার মধ্যে মানব-রসেরই পরিপূর্ণ স্বাদ মেলে। পুরাণে এই-সব দেবতা ছাড়া আছেন রাম কৃষ্ণ প্রভৃতি অবতার। তাঁরা দেবতা হলেও মানুষ। এই-সব অবতারবাদের মধ্যেও দেখা যায় মানুষই বড়ো, দেবতাই ছোটো, বৈকুণ্ঠের বিষ্ণু হতে ব্রজের কৃষ্ণ মহত্তর। তারপর নবদ্বীপে যে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু জন্মালেন তাঁর মাধুর্যে ও মহিমায় বৃন্দাবন বৈকুণ্ঠ দুইই গেল নিষ্প্রভ হয়ে।

কেউ কেউ বলতে পারেন এঁরা সবাই তো মানুষ হলেও অবতার। এঁদের মধ্যে যে মহত্ত্ব তা তো সাধারণ মানুষের মহত্ত্ব নয়। তাই সাধারণ মানুষের মহত্ত্বও ঘোষিত হয়েছিল ‘অথর্বের’ ঋষিদেরই মুখে। তারপর তার পরিচয় পাই উপনিষদগুলির মধ্যে। উপনিষদের ঋষিরা বার বার বলেছেন সর্বত্র যে সর্বব্যাপী পরমপুরুষ বিরাজিত, আমার মধ্যেও তিনিই বিরাজমান। সর্বমানুষের অন্তরস্থিত সেই পুরুষ যে তেজোময় অমৃতময় এই কথা একবার বলে ‘বৃহদারণ্যক’ উপনিষদের মন খুশি হল না, আঠাশ বার এই কথাটি পর পর উচ্চারণ করে তবে তিনি ছাড়লেন। ‘কঠোপনিষৎ’ তো সোজাসুজিই বললেন মানুষ হতে আর মহত্তর কিছুই নেই, মানুষই চরম কথা, মানুষই পরমাগতি– ‘পুরুষান্ন পরং কিঞ্চিৎ সা কাষ্ঠা সা পরা গতিঃ’ (৬, ৮)।

‘অথর্ববেদের’ নৃ-সূক্ত ও স্বম্ভ-সূক্তের কথা বলেছি। তার একটু নমুনাও দেওয়া দরকার। ‘অথর্বের’ দশম কাণ্ডের দ্বিতীয় সূক্তে ও একাদশ কাণ্ডের দশম সুক্তে মানুষেরই মহত্ত্ব ঘোষিত হয়েছে। দশম কাণ্ডের দ্বিতীয় সূক্তের শেষ কথা, এই অপূর্ব মানবদেহের স্বর্ণমন্দিরে এসে ব্রহ্ম অধিষ্ঠান করলেন, তাই কিছুতেই এই মানবমন্দিরের আর পরাজয় নেই। ‘পুরং হিরণ্ময়ীং ব্রহ্ম আধিবেশাপরাজিতাম্।।’ (অথর্ব, ১০, ২, ৩৩)

সেই সঙ্গে সঙ্গে ‘আনন্দ, আমোদ, প্রমোদ, সকল রসের রসিক মানবের মন হাসি খেলা নৃত্য সবই এই মানবদেহ-মন্দিরে এসে করল প্রবেশ’ (ওই, ১১, ১০, ২৪)।

আনন্দা মোদাঃ প্রমুদোভী মোদমুদশ্চ যে।                                                                                                       হসো নরিষ্টা নৃত্তানি শরীরমনুপ্রাবিশন্।।


সেইজন্যই যে মর্ম জানে সে মানুষকেই বলে ব্রহ্ম। ‘তস্মাদ্‌ বৈ বিদ্বান্‌ পুরুষমিদং ব্রহ্মেতি মন্যতে।।’ (ওই, ১১, ১০, ৩২)

মন্দির-ভেদে তাঁকেই কোথাও স্ত্রীরূপে কোথাও পুরুষরূপে কোথাও কুমাররূপে কোথাও কুমারীরূপে, কোথাও বৃদ্ধরূপে দেখি, অথচ তাঁকে চিনতে পারিনে (ওই, ১০, ৮, ২৭)।

চিনতে যে পারিনে তাতে লজ্জিত হবার কিছু নেই, কারণ যা প্রত্যক্ষ অর্থাৎ যা চোখে দেখছি তারও গভীরতার যে অন্ত নেই। ‘আবিঃ সন্নিহিতং গুহা।।’ (ওই, ১০, ৮, ৬)

পিতামহ ভীষ্ম তাই যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘গভীরতম সত্য তোমাকে বলি, মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছুই নাই।’

গুহ্যং ব্রহ্মত দিদং বো ব্রবীমি।
ন মানুষাচ্ছ্রে ষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ।। (মহাভারত, শান্তিপর্ব ৩০০, ২০)

এই তত্ত্বই তো হাজার হাজার বছর পরে চণ্ডীদাস বললেন:

শুনহ মানুষ ভাই,
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।

‘মুণ্ডক উপনিষৎ’ বলেছিলেন, মানুষই বিশ্ব। পুরুষ এবেদং বিশ্বম্ (২, ১, ১০)।

হাজার হাজার বছর পরে বাউলদের ভাষাতেও দেখা গেল: ‘যা আছে ভাণ্ডে তা আছে ব্রহ্মাণ্ডে’।

বেদ-পুরাণে মানবতাধর্মের মহিমা বার বার ঘোষিত হয়েছে। যে জৈন-বৌদ্ধদের মধ্যে মানবমাহাত্ম্যের আদি-ঘোষণা তাঁদের উত্তরপুরুষেরাও চুপ করে থাকেননি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের চর্যাপদগুলিতে এবং প্রবোধবাবুর দোহাকোষ১ দেখলে দেখা যায় মহাযান মতের উত্তরযুগেও মানুষই হল সারতত্ত্ব। এই দেহের মধ্যেই গঙ্গা-যমুনা নদ-নদী-সাগর। মানুষের বাইরে সত্যকে বৃথা খুঁজে মরা, সারতত্ত্ব এই মানুষেরই মধ্যে। এই শরীরের মধ্যেই অশরীর পরমতত্ত্ব আছেন লুকিয়ে। ‘অশরীর কোই শরীরহি লুক্‌কো’।

জৈন সাধক মুনি রামসিংহ খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর লোক। তাঁর পাহুড় দোহার মধ্যেও এই সব কথাই আরও চমৎকার করে বলা। কবীর প্রভৃতি সাধকেরা তার পাঁচশো বছর পরে যা বলেছেন তার সবই পাওয়া যায় এই মুনি রামসিংহের পাহুড় দোহাগুলিতে। নামপন্থে ও যোগীদের মধ্যেও এই সবই দেখা যায়।

ভারতে যখন মুসলমান ধর্মসাধকেরা এলেন তখন স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে এই দেশের ধর্মসাধনার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটল। তখন এই দেশের সাধকেরা এবং তাঁরা উভয় দলই নিজ নিজ অধ্যাত্ম সম্পদ পরস্পরকে দেখাতে প্রবৃত্ত হলেন। এমন অবস্থায় আমাদের যাগযজ্ঞ শ্রুতিস্মৃতি দেখিয়ে বা তাঁদের কোরান-হাদিস দেখিয়ে তো কোনও লাভ নেই। এক দলের এই-সব কথা আর এক দল মানতে চাইবেন কেন। কাজেই দুই দলই প্রেম-ভক্তি ও ভক্তদের কথা, মানবতাধর্মের কথা প্রভৃতি বলতে লাগলেন। তখন লাহোরের হুজবেরি, আজমিরের মৈনুদ্দিন চিশ্‌তি প্রভৃতি সাধকেরা ধরলেন সুফিদের প্রেমধর্ম। আমাদের দিকে গুরু রামানন্দও মানবতাধর্ম ও প্রেম-ভক্তিরই জয়গান করলেন। ‘গ্রন্থসাহেবে’-এ দেখা যায় গুরু রামানন্দ দেবমন্দিরে যাচ্ছিলেন দেবতাকে খুঁজতে। গুরু দেখিয়ে দিলেন সেই দেবতা মন্দিরে নেই, আছেন মানুষের হৃদয়ের মধ্যেই। প্রেমে ও ভক্তিতে হয় তাঁর সঙ্গে মিলন। এই-সব কথা সর্বধর্মের সর্বলোকেরই মান্য।

এই প্রেম ভক্তির সাধনা তখন উত্তর ভারতের চেয়ে দক্ষিণ ভারতেই ছিল বেশি করে। ‘পদ্মপুরাণ’ বলেছেন ভক্তির উৎপত্তি দ্রাবিড়ে, কর্ণাটে তাঁর হল বৃদ্ধি, মহারাষ্ট্রে কিছুকাল বাস করে গুজরাটে এসে হলেন ভক্তি জীর্ণ।

উৎপন্না দ্রবিড়ে চাহং কর্ণাটে বৃদ্ধিমাগতা।
স্থিতা কিঞ্চিন মহারাষ্ট্রে গুর্জরে জীর্ণতাং গতা।।


রামানন্দ দক্ষিণের এই প্রেমধর্মকে উত্তরভারতের কায়া-সাধনার সঙ্গে যুক্ত করলেন। এই যুক্তবেণীতে যে ধর্মের সাধনা চলল, তার আদি-অন্ত সবই মানুষকে নিয়ে। কবীর, রবিদাস, দাদূ, রজ্জব প্রভৃতি সবাই এই যুক্তধারারই সাধক। তবে এর মধ্যে কবীরের তুলনা নেই। ভক্তেরাও বলেন ভক্তির উৎপত্তি হয়েছিল দক্ষিণে দ্রাবিড় দেশে, রামানন্দ তা আনলেন এই উত্তরভারতে, কবীর সেই ধর্ম করলেন সর্বত্র প্রচার।

ভক্তি দ্রাবিড় উপজী লায়ে রামানন্দ।
প্রগট কিয়ো কবীরনে সপ্তদ্বীপ নৌখণ্ড।।


প্রেমভক্তিবাদী মানবতাধর্মের দুইটি প্রধান দল ছিল তখন এই দেশে। একদল শাস্ত্র আচার প্রভৃতির সঙ্গে রফা করে চলেছেন। শৈব ভাগবত মতের মধ্যে তাঁরা পাশুপত সদাশিব প্রভৃতি মতবাদী। কাশ্মীরের অভিনবগুপ্ত উৎপলাচার্য প্রভৃতি এই দলের। মহিম্নস্তব-রচয়িতা আচার্য পুষ্পদন্তাদিও এই শাস্ত্রমানা দলেরই লোক। আর জঙ্গম-ধর্মগুরু বসব প্রভৃতি হলেন স্বাধীন ভাবে শৈবধর্মের সাধক। শাস্ত্র-আচার-জাতি-পঙ্‌ক্তি এ-সব কিছুই তাঁরা মানেননি। তাঁর মতে মানুষের মধ্যেই শিব, মানুষের মধ্যেই শাস্ত্র, মানুষের মধ্যেই বিশ্বচরাচর। প্রত্যেক মানুষ জঙ্গম বিশ্ব ও বিশ্বনাথ। এরচেয়ে বড়ো মানবতার কথা আর কী হতে পারে।

বেদ-শাস্ত্র ও মন্দিরের দেবতার কাছে হিন্দু-মুসলমান ভেদ আছে। এই মানবদেবতার উপাসনায় সেরূপ ভেদ থাকবার কথা নয়। এই দেবতার উপাসনায় যাঁরা এলেন তাঁদের কেউ-বা হিন্দুকুলে কেউ-বা মুসলমানকুলে জন্মেছেন। এই দেবতার উপাসনায় জাতি পঙ্‌ক্তির কোনো বাছবিচার নেই। ব্রাহ্মণ রামানন্দ আছেন, মুচি রবিদাস আছেন, নাপিত সেনা আছেন, কসাই সদনা আছেন, মুসলমান কবীর দাদূ রজ্জব আছেন। বাউলরা এই নরদেবতার উপাসক বলেই তাঁদের মধ্যে জাতপাতের বিচার নেই।

বৈষ্ণব ভাগবতদের মধ্যে রামানুজ, মাধব, নিম্বার্ক, বিষ্ণুস্বামী প্রভৃতি শাস্ত্রমানাদের দল, যদিও তাঁরা মানবভাবেই ভগবানকে সাধনা করেছেন। রামানন্দ এদের মধ্যে হতেই বের হয়ে এলেন এবং খুব একটা স্বাধীনধারার প্রবর্তন করলেন। কবীর রবিদাস নানক দাদূ প্রভৃতি সেই স্বাধীন ধারার সাধক। এই-সব সন্তদের ও বাংলার বাউলদের মতামতে যে-রকম স্বাধীনতা দেখতে পাওয়া যায় সে-রকম স্বাধীনতা জগতে দুর্লভ।

যে-কোনও ক্ষেত্রেই স্বাধীন ভাবটা রাজপুরুষেরা পছন্দ করেন না। এইজন্য মুসলমান-রাজারা অনেকসময় শাস্ত্রপন্থী শৈব ও বৈষ্ণবদের সাহায্য করেছেন কিন্তু স্বাধীন মতবাদী ভক্তেরা অনেক নিগ্রহ তাঁদের কাছে সহ্য করতে বাধ্য হয়েছেন।

এই-সব ভক্তের দলই মানবতার শ্রেষ্ঠ উপাসক। ইউরোপে যাঁরা ধর্মকে আক্রমণ করেছেন তাঁদের প্রধান অস্ত্র ছিল এই যে, ধর্মের নামে মানুষ আপনাকেই বড়ো করে কল্পনা করে তাকেই ভগবান বলে তাঁর পূজা করে। তার নাম Anthropomorphism বা মানুষীকরণ। পাশ্চাত্য দেশের ভক্তেরা অনেকে এই অভিযোগে ভয় পেতেন। কিন্তু এই দেশে ভক্তেরা বললেন, “তাই তো বটে। বিশ্বসত্যের অনন্ত দিক। আমরা মানুষ। মানুষ-দিক ছাড়া আমরা কী করে উপলব্ধি করব?” এই-সব কথা সবচেয়ে চমৎকার করে প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নির্ভয়ে বাল্মীকির মুখে শোনালেন:

দেবতার স্তবগীতে দেবেরে মানব করি আনে,
তুলিব দেবতা করি মানুষেরে মোর ছন্দে গানে। (‘কথা ও কাহিনী’)

কলিকাতায় দর্শনসভায় সভাপতিরূপে এই কথাই তিনি সুন্দর করে বলেছেন ভক্তদের বাণীর সাহায্যে। আর অক্সফোর্ডে তাঁর হিবার্ট বক্তৃতা Religion of Man হল এই সত্যের চরম ঘোষণা।
ভাগবতেরা চিরদিনই নিঃসংকোচেই মানব-ভাবেই ভগবানকে চেয়েছেন। দাস্য সখ্য বাৎসল্য মাধুর্য প্রভৃতি মানব-ভাব দিয়েই তাঁরা ভগবানকে চেয়েছেন। তাই তাঁদের কবিতা বা গান শুনলে হঠাৎ ধরতে পারা যায় না এগুলি কি মানুষকে বলা হয়েছে না ভগবানকে নিবেদন করা কথা। এই বিষয়টা চমৎকার করে বুঝিয়ে বললেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বৈষ্ণব কবিতা’-য়:

দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই
প্রিয়জনে– প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই
তাই দিই দেবতারে; আর পাব কোথা!
দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা। (‘সোনার তরী’)


তাই গীতাঞ্জলিতে দেবতা খুঁজতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখলেন দেবতা মন্দিরে নেই। তিনি আছেন সেই মানুষেরই মধ্যে যে মানুষ খেটে খেটে মরছে, চাষ করছে (নং ১১৯)। ভারতের মহামানবের সাগরতীরে পুণ্যতীর্থে সেই ‘নর-দেবতা’-কেই তিনি গভীর শ্রদ্ধায় প্রণাম করেছেন (নং ১০৬)। ভক্ত দাদূও (১৫৪৪ খ্রি.) এই ‘নর-নারায়ণের’ নামেই মানবকে প্রণাম করেছিলেন (চিতাবনী অঙ্গ্ ১১)। তাঁর ২৭৯ নং পদ এই নর-নারায়ণেরই গান (রাগ টোড়ি)। মানবের মধ্যেই সর্বদেবতার দেবতা (দাদূ, পরচা অঙ্গ্, ১৩)। নিজাম এসে দাদূর কাছে ভগবানের স্তবগান শুনতে চাইলেন। দাদূ তাঁকে মানুষের গানেই শুনিয়ে দিলেন সেই দেবস্তুতি– ‘ইযাঈ রহিমানবে’। অর্থাৎ ওরে এখানেই সেই দয়াময় (রাগ বেলাবল, পদ ৩৫৩)। কবীর বললেন, ঘটে ঘটে ব্রহ্মই দীপ্যমান (মৎসম্পাদিত ‘কবীর’, ২।৩৩)। সর্ববিশ্ব সকল অবতার স্বয়ং অনন্ত এই মানববিগ্রহেরই কাছে করজোড়ে দণ্ডায়মান (ওই, ৪।৫১)। কৃচ্ছ্র কৃত্রিমতায় যে ধর্মসাধনা তা মিছে, নয়ন খুলে আনন্দে পরমসুন্দরকে দেখাই হল সাধনা (ওই, ১।৭৬)। যে এই পরম দেবতাকে জেনেছে, তার কাছে স্বর্গলোভ ও নরকভয় দুই-ই মিথ্যা (ওই, ২।১১)। সহজ জীবনযাত্রাই তাঁর শ্রেষ্ঠ উপাসনা (ওই, ১।৭৬; ১।২২)। মুক্তি একটা বৃথা কল্পনা মাত্র। তিনি যে দিন আমায় মুক্তি দিলেন সে দিন তাঁর কাছে আরও আপনাকে প্রেমে দিলাম ধরা (ওই, ৪।৪০)। ‘খেয়া’-র ‘মুক্তিপাশ’ কবিতায় এই কথাই রবীন্দ্রনাথ অপূর্বভাবে বলেছেন। তথাকথিত সন্ন্যাস বা পেশাদারি ধর্মজীবন কবীর পছন্দ করেননি। তিনি বললেন, জীবনে সহজ হও, প্রেমে আপনাকে ধন্য করো। কারণ ভগবান পেশাদার কীর্তনিয়াদের থেকে বিশ ক্রোশ দূরে থাকেন, সন্ন্যাসীদের থেকে থাকেন তিনি ত্রিশ ক্রোশ দূরে– ‘কিরতনিয়া সো কোসবিস সন্ন্যাসী সো তীস।’ (‘কবীরসাখী’ পারখ, ২৪) অথচ তিনি গৃহীর ও প্রেমীর হৃদয়ে-বাইরে সর্বত্র আনন্দে করেন বিরাজ (ওই)। কবীরের দুঃখ ছিল এই, এমন মানুষজন্ম পেয়েও মানুষ তার স্বাধীন মুক্ত বিচার ব্যবহার করতে পারল না। পশুর মতো কেউ গুরুর পিছনে, কেউ বেদ ও শাস্ত্রের পিছনে, কেউ-বা সমাজের পিছনে, কেউ-বা কামের পিছনে ছুটেছে। এই তো সংসারের হাল। যার স্বাধীন মুক্ত বিচার, মানুষ হল সে-ই।

গুরুপশু কুলপশু কামপশু বেদপশু সংসার।
মানুষ সোই জানিয়ে জাকে স্বাধীন মুক্ত বিচার।।
(ওই, বিচার অঙ্গ্, ১৯)


এইরকম সহজ মুক্ত ও স্বাধীন হলেই আমাদের জন্ম হয় সার্থক। তখনই আমরা ভগবানের সঙ্গে প্রেমে মিলতে পারি। ভগবান অপার, ভক্তিতে আমরাও কি অপার নই। তিনি অনির্বচনীয়, প্রেমে আমরাই কি অনির্বচনীয় নই। তিনি গুণাতীত, আমরাও কি প্রেমের বলে নিরঞ্জন নই। তিনি পূর্ণ, ভক্তিতে প্রেমে আমরাই বা পূর্ণ নই কীসে। দাদূ বলেন, প্রেমে ভক্তিতে তাঁর ও আমার মধ্যে কোথাও নেই তারতম্য, কোথাও নেই টানাটানি। এই তো নর-নারায়ণের সহজ যোগ (দাদূ, পরচা অঙ্গ্, ২৪৫-২৪৮)। এখানেই নর-নারায়ণের মহাতীর্থ।

এই মানবদেবতার কথা সেই যুগে সাধু ও সাধকেরাই বলেছেন, আজ এই দেবতার কথা সাহিত্যে কবিতায় বক্তৃতায় জনে-জনের মুখে। কিন্তু আজও কি এই দেবতার যথার্থ পূজা শুরু হয়েছে? আজকার দিনে এই দেবতার যে দুঃখ-দুর্গতি-নিগ্রহ নানাভাবে চলছে এমন আর কোনও দিন হয়নি। ধর্মগুরুদের গাল দিলেই তো মানবের দুঃখ ঘুচবে না। আজ রাজনীতিতে অর্থনীতিতে সাম্প্রদায়িকতায় নানাভাবে চলেছে এই দেবতারই নির্যাতন। কবীর দুঃখ করে বলেছিলেন, “হে দেবতা, আজও তোমার প্রতিষ্ঠা হয়নি, তোমার উপাসক আজও এসে দেননি দেখা।” আজকার দিনে আরও বেদনার সঙ্গে কবীরের ভাষাতেই বলতে হয় ‘হে অপ্রতিষ্ঠিত দেবতা, কে করে তোমার সেবা?’

অন্‌গঢ়িয়া দেবা
কৌন করে তেরী সেবা।। (‘মৎসম্পাদিত কবীর’, ২। ৩৭)
পূর্বাশা, আশ্বিন ১৩৫০

তথ্যসূত্র :

১. ‘দোহাকোষের ব্যাখ্যা ও অনুবাদ’: ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান