দেবনারায়ণ মোদক
ধর্ম বলতে ঠিক কী বোঝায়? ধার্মিকতাই বা কী? ধর্মান্ধতার সঙ্গে তার পৃথকীকরণের উপায় কী? এসব প্রশ্ন নিয়ে বিতর্কের কোনও অন্ত নেই। মৌলবাদ-এর আলোচনায় অবধারিতভাবেই এগুলি এসে পড়ে এ কারণেই যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের ধর্মবিশ্বাস ও তৎসম্পর্কিত আচার-আচরণের সঙ্গে তা জড়িয়ে পড়েছে। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, অন্য ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা বা বিদ্বেষ, নিজের ধর্মকে অপরের উপর চাপিয়ে দেওয়া, ধর্মের নামে কঠিন-কঠোর বিধান বা নিয়ম ব্যবস্থা জারি করা ইত্যাদি নানাবিধ প্রয়াসের সঙ্গে মৌলবাদ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়ার সঙ্গে তার যোগসাধন সমগ্র বিষয়টাকে অন্য মাত্রা প্রদান করেছে। স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক রাজনৈতিক পরিসরে তা গুরুতর আলোচনার বিষয়ীভূত হয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্য মনে রাখতে হয় যে, একটি ধারণা (concept) হিসেবে মৌলবাদ অবশ্য সেই তুলনায় ব্যাপকতর। ‘ধর্মীয় গোঁড়ামি’ (religious orthodoxy) থেকে উদ্ভূত এমনতরো ভাবনাগুলিকে বড়োজোর ‘ধর্মীয় মৌলবাদ’ (religious fundamentalism) বলা যেতে পারে। পাশাপাশি আরও নানা ধরনের ‘অধর্মীয়’ (non religious) বা ‘সেকুলার’ (secular) মৌলবাদের কথাও এ-ধরনের আলোচনায় অনিবার্যভাবেই উঠে আসে। বলা হয় যে, ‘মৌলবাদ’ এখন আর কেবলমাত্র ধর্মীয় গোঁড়ামিতেই সীমায়িত নয়, রাজনৈতিক, জাতিগত, বর্ণগত, লিঙ্গগত ইত্যাদি নানা প্রকরণে তার অস্তিত্ব আমরা টের পাই। তাই বৃহত্তর প্রেক্ষিতে এ বিষয়ে আলোচনা জরুরি। এতদ্সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে, ধর্মকেই মৌলবাদের অন্যতম প্রধান উৎস ভূমি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে তো বটেই, পৃথিবীর নানা অংশেই তা মৌলবাদের প্রসারের এক উর্বর ক্ষেত্র (fertile soil) হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। সময়ের দাবি মেনে তাই এখন সাম্প্রতিক কালের ঘটনা প্রবাহের দিকে নজর রেখে কিছুটা হলেও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে ‘মৌলবাদ’-এর সুলুক সন্ধান অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে তাই সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহের একটি রূপরেখা উপস্থাপনের বিনম্র প্রয়াস গৃহীত হয়েছে।
এক
প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, ইংরেজি Fundamentalism শব্দটির বাংলা অনুবাদে ‘মৌলবাদ’ কথাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলা ভাষার পুরোনো অভিধানগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করলে এ কথাটি প্রতীয়মান হয় যে, বাংলায় শব্দটির ব্যবহার তুলনামূলক ভাবে সাম্প্রতিক এবং সেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে উদ্ভূত সংকীর্ণতা বোঝাতেই তা প্রযুক্ত। মূল ইংরাজি শব্দে অবশ্য তার ব্যাপকতর প্রয়োগ লক্ষণীয়। সে-সব আলোচনার গভীরে না গিয়ে বলি যে, মৌলবাদ আদতে ‘মূল-জাত’ এবং জীবনের নানা ক্ষেত্রেই বিভিন্ন অর্থে তা প্রযুক্ত হতে পারে। তাই, মনে রাখা দরকার যে, বিষয়টি আপাত নিরীহ হলেও তা আদতে বেশ দুরূহ। ভবানীপ্রসাদ সাহু জানিয়েছেন যে, অভিধানে ‘মৌল’ কথাটির অর্থ নানাভাবে বিবৃত হয়েছে– যেগুলির মধ্যে ‘মূল থেকে আগত’, ‘আদিম’, ‘প্রাচীন’ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। বিমলকৃষ্ণ মতিলালের মত উদ্ধৃত করে তিনি ‘মূল থেকে মৌল’ এই সূত্রের সংস্কৃত-ঘেঁষা চরিত্রের উল্লেখ করেছেন। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের বক্তব্য উল্লেখ করে তিনি– ‘ভিত্তি থেকে ভৈত্তিকতা’-র সূত্রের কথা উল্লেখ করেছেন এবং সে ক্ষেত্রে কীভাবে foundation কথাটি গুরুত্ব পেয়েছে তার উল্লেখ করেছেন।১ বলাবাহুল্য যে, এসব নিয়ে নানা কথার অবকাশ রয়েছে। তবে একথা অস্বীকার করি কীভাবে যে, আমাদের দেশে ও কালে এই শব্দটির প্রয়োগে ভিন্নতর তাৎপর্য রয়েছে। দূর অতীতের কথা ছেড়ে দিয়েও বলি যে, এমনকি আমাদের বিশ শতকের সাহিত্য-সংস্কৃতি বা সমাজবিজ্ঞান চর্চাতেও শব্দটি তেমনভাবে আলোচিত হয়নি। অতীতে ধর্মীয় গোঁড়ামি, সংস্কার, বিশ্বাস-ব্যবস্থা ইত্যাদি শব্দগুলি নানাভাবে আলোচনায় এলেও ‘মৌলবাদ’ শব্দটি তেমনভাবে আসেনি। সাম্প্রতিক অতীতের প্রেক্ষাপটেই যেহেতু এমনতরো আলোচনার বাড়বাড়ন্ত, তাই ধারণাগত প্রশ্নেও আমাদের সেদিকে কমবেশি দৃষ্টিপাত করতে হয়।
সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ‘মৌলবাদ’ সম্পর্কিত আলাপ আলোচনা পৃথিবীর সর্বত্র যে একই রকম তা নয়– সে কথা বলাই বাহুল্য। আমাদের দেশের ঘটনা প্রবাহে চোখ রেখে বলি যে, বিশেষত ১৯৮০ দশক থেকেই রাম-জন্মভূমি ও বাবরি মসজিদ সম্পর্কিত বিতর্ককে কেন্দ্র করে ‘ধর্মীয় মৌলবাদ’ এদেশে নতুনভাবে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করে। ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’, ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’ প্রমুখ সংগঠন সমূহের কার্যকলাপ এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ (BJP)-র উত্থান ও ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রক্রিয়াটি এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর বিতর্কিত সৌধটি ভেঙে ফেলা এবং তৎপরবর্তী সময়ে সেখানে মন্দির নির্মাণের রাজনীতিতে প্রবণতাগুলি স্পষ্টতর হয়ে উঠতে থাকে। ভারতীয় রাজনীতিতে ২০১৪ পরবর্তী সময়কাল যে এক্ষেত্রে দিক্নির্দেশক তা বলার অপেক্ষা রাখে না।২
অনুরূপভাবে দ্বিতীয় ঘটনা প্রবাহ হিসেবে এই উপমহাদেশে তো বটেই– বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষিতে ইসলামি মৌলবাদ-এর পুনরুত্থান ও বিস্তারের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘আল-কায়দা’ সহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন সমূহের দ্বারা সংগঠিত সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, ৯/১১ এর রোমহর্ষক ঘটনা এবং তৎপরবর্তী ঘটনা প্রবাহের কথাও এক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ভাবতে অবাক লাগে যে, এরকম একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে (Clash of Civilization) বা ‘সভ্যতার সংঘাত’ সম্পর্কিত তত্ত্বও সামনে এসে পড়ে। আমরা ভুলতে বসি রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত ‘সভ্যতার সংকট’-এর কথাও। এক্ষেত্রে কোনও বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়েও বলি যে, উল্লিখিত দুই আপাত-বিরোধী প্রবণতা আমাদের দেশে তো বটেই, বিশ্বব্যাপী ‘ধর্মীয় মৌলবাদ’ সম্পর্কিত আলাপ আলোচনাকে একেবারে সামনে নিয়ে এসেছে।৩
এখানেই অবশ্য শেষ নয়, বিভিন্ন ধরনের ‘ধর্মীয় মৌলবাদ’ যেমন এই সময়কালে বিশ্বময় নিজেদের শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে তেমনি আবার একটু অন্যরকম শোনালেও সত্য যে, মতান্ধ ধর্মীয় মৌলবাদের পাশাপাশি ‘অন্য ধরনের মৌলবাদ’ যাকে ‘অ-ধর্মীয়’ (non-religious) বা ‘সেকুলার’ (secular) মৌলবাদও বলা যেতে পারে– সে সম্পর্কেও আলাপ আলোচনা সামনে এসেছে। উল্লেখ্য যে, ধর্মীয় মৌলবাদকে আমরা যদি theocratic fundamentalism বলি, সে ক্ষেত্রে এগুলিকে secular fundamentalism আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। এগুলি যে অবশ্যই এক ধরনের নয়– সে কথা আমরা আগেই বলেছি। জাতি, বর্ণ ও লিঙ্গগত মৌলবাদ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক অবস্থানকেও এই পর্যায়ভুক্ত করা যেতে পারে। অধ্যাপক শোভনলাল দত্তগুপ্ত একাধিক উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করতে উদ্যোগী হয়েছেন। প্রথমেই তিনি আমাদের দেশে বর্তমানে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় অধিষ্ঠিত শাসকদের কর্ম-প্রক্রিয়ার উল্লেখ করে দুই ধরনের মৌলবাদকে চিহ্নিত করেছেন– যা আপাতদৃষ্টিতে পৃথক মনে হলেও গভীর বিশ্লেষণে তাদের মধ্যে মিলটি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তিনি লিখেছেন, “মৌলবাদ কথাটির সঙ্গে যে ভাবনাটা জড়িয়ে আছে তা প্রথমত (অত্যন্ত নেতিবাচক অর্থে) অসহিষ্ণুতার ভাবনা। ভিন্নমতকে আমি প্রশ্রয় দেব না আমি সহিষ্ণুতার বিরোধী।” ব্যাখ্যা করে তিনি দেখিয়েছেন যে, “মৌলবাদ হল একটি একরৈখিক ভাবনা, একটি একদর্শী ভাবনাচিন্তা।” এর থেকে এ-কথাটি স্পষ্ট যে, তা যেমন ধর্মকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে, তেমনই অপরাপর যেকোনও ক্ষেত্রেই তা প্রকটিত হতে পারে।৪
সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেও ‘মৌলবাদ’-এর অপরাপর প্রকরণসমূহকে বুঝে নেওয়া যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে অধ্যাপক দত্তগুপ্ত সমাজতন্ত্র এর যে ‘ধাঁচা’ বা ‘মডেল’ সোভিয়েত ব্যবস্থাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল– তার উল্লেখ করে সেখানেও এক ধরনের ‘মৌলবাদ’-এর উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, সেখানেও যে এক-রৈখিকতা বা একদর্শিতা কালপ্রবাহে মূল প্রবণতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে তাও মৌলবাদেরই নামান্তর।৫ ভবানীপ্রসাদ সাহু এই প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, এই ধরনের ‘রাজনৈতিক মৌলবাদ’-এর সঙ্গে ‘ধর্মীয় মৌলবাদ’-এর মূল তফাত এটাই যে– “রাজনৈতিক মৌলবাদীরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী নাও হতে পারে, এমনকি ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বা তথাকথিত নাস্তিক (অন্তত বাহ্যিকভাবে) হতে পারে।” উদাহরণ দিয়ে তিনি, ‘মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান– কারণ ইহা সত্য’– এই ধরনের পোস্টার ও প্রচারের উল্লেখ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, “বিজ্ঞানে চরম সত্য বলে কোনও কিছু নেই। একটি বিশেষ সময়ে তখনকার জ্ঞান অনুযায়ী এবং তথ্য যুক্তি ও প্রমাণের সাহায্যে কোনও তত্ত্বকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক মন সর্বদাই তার বিকাশের জন্য আগ্রহী এবং পরবর্তীকালে নতুনতর তথ্য প্রমাণের সাহায্যে পুরোনো সত্য পালটে নতুন একটি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট।”৬ বস্তুতপক্ষে, মার্কসবাদের গতিশীলতার ধারণা একথারই সমর্থন ঘোষণা করে। তাই ‘মার্কসবাদ-এর অভ্রান্ততা’, ‘সমাজতন্ত্রের অনিবার্যতা’, ‘পার্টিতন্ত্রের অমোঘ কর্তৃত্ব’-এর তত্ত্বও এক্ষেত্রে এক ধরনের মৌলবাদকে উৎসাহিত করেছে বলেই মনে করা হয়।
প্রাসঙ্গিকভাবেই বলতে হয় আমাদের বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস-ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্তি-নিষ্ঠা তথা বৈজ্ঞানিক ভাবনার অনিবার্য সংঘাতের কথা যা আমরা সচরাচর এড়িয়ে চলতে চাই। বলা বাহুল্য যে, এই দুইয়ের মধ্যেকার পার্থক্য তা সে যত সূক্ষ্মই হোক না কেন– তা কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আসলে আমাদের বিশ্বাস-ব্যবস্থা, তা সে ধর্মীয় বা অন্যরকম যাই হোক না কেন– তা প্রায়শই অবৈজ্ঞানিক এবং তা যখন নিজেকে ‘অভ্রান্ত সত্য’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিতে চায়, তখনই তা মৌলবাদের রূপ পরিগ্রহ করে। হিটলার, মুসোলিনি প্রমুখ ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রনায়কেরাও এভাবে এক এক ধরনের মৌলবাদকে হাতিয়ার করে নিজেদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন।
এক্ষেত্রে আরও বলতে হয় যে, অনেকেই পুনরুত্থানবাদ (revivalism)-এর সঙ্গে মৌলবাদকে এক আসনে বসাতে চেয়েছেন। এই দুয়ের মধ্যে অনেকটা সাদৃশ্য থাকায় তারা এ-দু-টিকে সমার্থক বলে মনে করেছেন। কিন্তু গভীর বিশ্লেষণে একথা প্রতীয়মান হয় যে, অনেক বিষয়ে মিল থাকলেও তাদের মধ্যে অমিলও বড়ো কম নয়। মৌলবাদ সচরাচর অতীতচারী– একথা মেনে নিয়ে বলি যে, কালপ্রবাহে নতুনতর বিষয়কে আশ্রয় করেও মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। ধর্মীয় ও সেকুলার উভয় ধরনের মৌলবাদের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। একইভাবে ধর্ম সংস্কার (religious reform) এবং তৎসম্পর্কিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও এই পার্থক্য লক্ষণীয়। সব মিলিয়ে বলতে হয় যে, মৌলবাদের ক্ষেত্রে এক ধরনের ‘সামূহিকতাবাদ’ বা ‘সামগ্রিকতাবাদ’(totalitarianism)-এর উপস্থিতি যেন অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং সেক্ষেত্রে ‘অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি’ (culture of intolerance)-এর প্রাধান্য লক্ষণীয় হয়।
দুই
মৌলবাদ প্রসঙ্গে এমনতরো প্রাথমিক আলোচনার প্রেক্ষিতে তার কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিতকরণ– আমাদের সমস্যার গভীরে প্রবেশের সহায়ক হতে পারে। ‘অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি’ যে মৌলবাদ-এর প্রধান প্রেরণা– সে কথা ইতিমধ্যেই আমরা নানাভাবে ব্যক্ত করেছি। ‘ধর্মীয় মৌলবাদ’-এর ক্ষেত্রে তা যেমন মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে আশ্রয় করে ধর্মান্ধতার রূপ পরিগ্রহ করে, বিভিন্ন ধরনের অনুশাসন বা আচার ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করে ‘ধর্মীয় সহনশীলতা’ (religious tolerance)-এর ঐতিহ্যগুলির অবনমন ঘটাতে চায়; সেকুলার মৌলবাদ তেমনই গড়ে তুলতে চায় কোনও না কোনও ধরনের ‘গোঁড়া মতবাদ’ (orthodoxy) যা ‘ভিন্ন স্বর’ (other voices)-গুলিকে স্তব্ধ করে দিতে উদ্যত হয়। একটু অতি সরলীকরণের ঝুঁকি নিয়েই বলি যে, ‘মৌলবাদ’-এর কণ্ঠস্বর সর্বত্রই প্রায় একই রকম: “ঈশ্বর-মার্কস-হিটলার– এরা কেউই ভুল করতে পারে না, তালিবানদের ক্ষেত্রেও যেন একই কথা।” মৌলবাদ-এর এই মৌলিক ভাবনার কথা মনে রেখে তার বৈশিষ্ট্যসমূহকে নিম্নরূপে সুনির্দিষ্ট করা যেতে পারে।
- ‘মূল’ থেকে ‘মৌল’ অর্থাৎ ‘গোঁড়ার কথা’ থেকেই মৌলবাদ-এর যাত্রা শুরু হয়।
- মৌলবাদীরা যেহেতু নিজেদের অবস্থানকে সর্বদাই ‘অভ্রান্ত’ বলে প্রচার করে, তাই তার কোনও বিরোধিতা তারা বরদাস্ত করে না। ভিন্ন স্বর সেখানে সর্বদাই প্রত্যাখ্যাত।
- ‘মৌলবাদ’ একধরনের ‘মতাদর্শগত সমরূপতা’ (doctrinal conformity) এর দাবি করে। তাই একটি ছকে বাঁধা প্রকরণে তা নিজেকে সংহত করতে চায়।
- আলাপ আলোচনা বা মত বিনিময়ের ভাষা (language of conversation)-র একটি ‘নিজস্ব প্রকরণ’ থাকে। মৌলবাদীরা সেই ভাষায় মোটেই অভ্যস্ত নয়। ‘সংলাপ’ (dialogue)-এর পরিবর্তে নিজের মত অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাই তাদের দস্তুর।
- ‘মৌলবাদ’-এর মধ্যে এক ধরনের ‘শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা’ (sense of superiority) যেন অন্তর্লীন থাকে, তাই অন্যদের লঘু করে দেখা বা দেখানোর প্রচেষ্টা এখানে যেন মজ্জাগত।
- মৌলবাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতিটিও অবৈজ্ঞানিক এই অর্থে যে, তাদের সিদ্ধান্তগুলি যেন ‘পূর্ব নির্ধারিত’ (pre-determined) এবং অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি যেন কোনও না কোনও ভাবে তাকে মান্যতা প্রদানের প্রয়াস মাত্র। ব্যাখ্যা করে বলতে হয় যে, যুক্তিবাদী তথা বৈজ্ঞানিক অনুশীলন পদ্ধতিতে অনুসন্ধানের (investigation) পথ বেয়েই সিদ্ধান্তে (conclusion) উপনীত হওয়া সম্ভব। এখানে যেন ‘উলট-পুরাণ’ অর্থাৎ ‘ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া’ (putting the horse before the cart)-র প্রয়াস।
- মৌলবাদে ‘যৌক্তিকতা’ (reasoning)-এর স্থান নেই, ‘বিশ্বাস ব্যবস্থা’ (belief system)-ই মৌলবাদের উদ্ভব ও বিকাশের ‘উর্বর জমি’ (fertile soil) হিসেবে বিবেচিত।
- ‘সামূহিকতাবাদ’ বা ‘সামগ্রিকতাবাদ’ (totalitarianism) মৌলবাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যা ‘অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি’-কে আশ্রয় করে সব ধরনের বিরুদ্ধ-স্বর-কে স্তব্ধ করে আপন শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনে তৎপর।
‘মৌলবাদ’-এর উপরোক্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সমূহের কথা প্রসঙ্গে এ কথা মনে রাখা জরুরি যে, মৌলবাদ একটি অত্যন্ত জটিল ও বিতর্কিত বিষয়– তা যেমন প্রধানত ধর্ম-বিশ্বাস সঞ্জাত; তেমনই আবার জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও– বিশেষত সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, পরিব্যপ্ত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মৌলবাদের ইতিহাস পর্যালোচনায় অবশ্য তার উদ্ভবের ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসের দিকটিই প্রাধান্য পেয়েছে। ভবানীপ্রসাদ সাহু তাই মৌলবাদের বৈশিষ্ট্য নিরূপণে মার্কিন দেশের ইতিহাসের অভিজ্ঞতার নিরিখে এরকম কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বিবৃত করেছেন–
- এটি অবশ্যই ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
- এটি আসল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থকে অপরিবর্তনীয়– সমালোচনার ঊর্ধ্বে– সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধিকারী হিসেবে মনে করে।
- কোনও নতুন ধরনের বৈজ্ঞানিক চিন্তা– যা ওই ধর্ম তথা ধর্মগ্রন্থের ভিত্তিমুলে নাড়া দিতে চায়– তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে তা ঝাঁপিয়ে পড়ে।
- ধর্মীয় ক্ষেত্রেও উদারনীতি, আধুনিকতা ও ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি সহিষ্ণুতা– এসবেরও সেটি বিরোধী।
- এক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার, এমনকি পশ্চাৎ গমনের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দ্বিধাহীন বিশ্বাস ও প্রশ্নহীন আনুগত্য তথা ‘চূড়ান্ত কর্তৃত্ববাদ’ তার অন্যতম সম্পৃক্ত দিক।
- এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণি বিভাজন, নারী-পুরুষ দ্বন্দ্ব তথা পুরুষ আধিপত্যের বাস্তবতা অস্বীকার করে। এটি শাসক শ্রেণির স্বার্থবাহী, জনস্বার্থ বিরোধী ও পুরুষ আধিপত্যকামী একটি মতবাদ।৭
এখানেই শেষ নয়, ধর্মীয় মৌলবাদের জঙ্গি ও হিংস্র রূপটির দিকেও সাহু আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তার সাদৃশ্যগুলি চিহ্নিত করেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি রাজনীতি ও মৌলবাদের আন্তঃসম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন এবং ‘মৌলবাদের রাজনীতিকরণ’ ও ‘রাজনৈতিক মৌলবাদ’-এর মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন।৭ এবংবিধ আলোচনার গভীরে না গিয়েও বলি যে, রাজনীতি কখনোই মহাশূন্যে ক্রিয়াশীল হয় না। নির্দিষ্ট কোনও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতেই তা ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের আকাঙ্ক্ষায় শাসককুল যে মৌলবাদী ধ্যান ধারণার আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে– তা বোধ করি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু মূল প্রশ্ন এটাই যে, শাসকদের এই উদ্যোগ বৃহত্তর সমাজে কীভাবে মান্যতা লাভ করে? সাধারণভাবে বিষয়টি কিন্তু এমন নয় যে, সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক শক্তিসমূহ সর্বদাই পেশিশক্তির প্রদর্শনের মাধ্যমে সমাজে মৌলবাদী ভাবধারা প্রতিষ্ঠায় উদ্যত। বরং বিপরীতভাবে একথাই সত্য যে, বৃহত্তর সমাজে মানুষের মনের গভীরে এমন কিছু চিন্তা-ভাবনা বা তার রসদ থাকে, তা সে ধর্মীয় বা অন্য যা কিছুই হোক না কেন– সেগুলোর সুচারু ব্যবহারে স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল কোনও এক খণ্ডিত সময়ের জন্য হলেও এক ধরনের ‘সম্মতি’ আদায়ে সমর্থ হয়ে ওঠে। এমনতরো সম্মতি নির্মাণের প্রক্রিয়া কখনও বা এতটাই গভীর হয়ে ওঠে যে, মৌলবাদ-এর হিংস্র রূপটিও তখন বৃহত্তর সমাজে আর ততটা নিন্দনীয় বলে মনে হয় না। আপাতদৃষ্টিতে অবাক হওয়ার মতো ঘটনা এই যে, মৌলবাদী শাসকেরা যখন নিজেদের ‘কার্যক্রম’ (agenda) রূপায়ণে হিংসাশ্রয়ী নানা উদ্যোগের মাধ্যমে ‘সন্ত্রাসের সংস্কৃতি’ (culture of terror) গড়ে তোলে এবং তা নিয়ে ‘সুশীল সমাজ’ (civil society) ও ‘গণমাধ্যম’ (mass media)-এ ধিক্কার ওঠে। তারপরেও নানাভাবে মৌলবাদীদের পক্ষেই জনসমর্থন প্রতিফলিত হয়। উল্লেখ্য যে– হিটলার মুসোলিনি সহ তাবৎ ফ্যাসিবাদী তথা মৌলবাদী শাসকদেরই একটা সময় পর্যন্ত জনসমর্থনের কোনও অভাব হয়নি। তাই প্রয়োজন হল বৃহত্তর সমাজে তথা জনমানসে মৌলবাদের প্রতি এই সমর্থনের ভিত্তিটি খুঁজে বার করা। অধ্যাপক শোভনলাল দত্তগুপ্ত এই প্রসঙ্গে লিখেছেন :
মৌলবাদ যখন প্রত্যয় পায়, সাধারণ মানুষের মনের একেবারে গভীরে এরা স্থান করে নেয়। সেই স্থানগুলি স্পর্শ করে সেই বিষয়গুলিকে তারা ধরার চেষ্টা করে –তাহলেই মৌলবাদ স্থিত হয়। এটা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয় অর্থাৎ মানুষের মনের গভীরে কতকগুলি খুব দুর্বল স্পর্শকাতর স্থান রয়েছে– সেই স্থানগুলি এরা ধরে। মৌলবাদ প্রসারিত হয়।৮
বলা বাহুল্য যে, ধর্মবিশ্বাস হল মানুষের মনের গভীরে এমনই এক দুর্বল ও স্পর্শকাতর স্থান যেখানে মৌলবাদ তুলনামূলকভাবে বেশি করে হাতছানি দিতে পারে। তাই মৌলবাদের আলোচনায় ধর্মীয় মৌলবাদের কথাই ঘুরে ফিরে এসে পড়ে। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে, ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের ঈশ্বর-বিশ্বাসের গভীরতা ও আবেগ এতটাই বেশি যে, তা সর্বদা যৌক্তিকতার কোষ্ঠীপাথরে বিচার্য বলে বিবেচিত হয় না। তাই ‘ধর্মীয় মৌলবাদ’-এর মোকাবিলায় সামগ্রিকভাবে ধর্ম-বিশ্বাসকে আঘাত করাই সঠিক পথ বলে অনেকেই মনে করেন না। এখানেই এসে পড়ে ধর্ম ধার্মিকতা ও ধর্মান্ধতার মধ্যেকার পার্থক্য নির্ণয়ের প্রাসঙ্গিকতা এবং তৎ-প্রেক্ষিতে মৌলবাদের বিপদ মোকাবিলার ইতিকর্তব্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয় সমূহ।
তিন
এখন প্রশ্ন হল এই যে, ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই মৌলবাদ অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করে, এ-বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ না থাকলেও ‘ধর্ম’ বলতে ঠিক কী বোঝায়– তা নিয়ে বিতর্কের কোনও অন্ত নেই। এমনকি ইংরেজি শব্দ ‘Religion’-এর বাংলা তরজমা হিসেবে ‘ধর্ম’ ও তার অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা নিয়েও ভিন্ন মতের অবকাশ রয়েছে । বর্তমান নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে সে-সব আলোচনার গভীরে না গিয়েও আমরা বলতে পারি যে, বস্তুতপক্ষে ধর্ম হল এক ধরনের ‘বিশ্বাস ব্যবস্থা’ (belief system) যা অসংখ্য মানুষের জীবনচর্চাকে কমবেশি প্রভাবিত করে বা নিয়ন্ত্রণ করে। অবশ্য ব্যক্তিগত ধর্ম বিশ্বাস ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতের নানা ধরনের প্রকাশ এমন কি টানাপোড়েনও এক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পরিভাষার ক্ষেত্রেও নানা ধরনের পার্থক্য নজর কাড়ে। এতদ্সত্ত্বেও বলতে হয় যে, বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই কোনও না কোনও অর্থে ‘ধর্মবিশ্বাসী’। আবার প্রচলিত অর্থে ধর্মবিশ্বাসী সব মানুষই নিজেদের মতো করে কোনও ‘অতিপ্রাকৃত সর্বশক্তিমান ঈশ্বর’-এর ধারণায় আস্থাশীল। সেদিক থেকে বলা চলে যে, ধর্মবিশ্বাসী মানুষের কাছে ধর্ম ও ঈশ্বর ভাবনা প্রায় অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কে যুক্ত। সাধারণভাবে ধরে নেওয়া যায় যে, ধর্মবিশ্বাসী মানুষেরা নিজেদের ধর্মীয় নীতিসমূহ ও মূল্যবোধ অনুসরণেই জীবন নির্বাহ করে থাকেন এবং তাদের কাছে নিষ্ঠাভরে ধর্মাচরণের অপর নামই হল ‘ধার্মিকতা’। বলা বাহুল্য যে, এটি তাদের কাছে ‘আদর্শ কর্মপন্থা’-ও বটে, কারণ এটিকেই তারা ‘মুক্তি’ বা ‘মোক্ষ’ লাভের অনন্য পন্থা বলেই মনে করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ধর্ম বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, কিন্তু যৌক্তিক বিচারধারায় আস্থাশীল এমন মানুষজন অনেক রয়েছেন যাদের ‘নাস্তিক’ (atheist) বলে অভিহিত করা হয়– তাদের সংখ্যাও বড়ো কম নয়, যদিও ‘আস্তিক’ (theistic) মানুষের তুলনায় তাদের সংখ্যা অনেক কম। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হয় যে, ধর্মবিশ্বাসী মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাসের গভীরতা ও আবেগ সচরাচর এত বেশি হয় যে– এ বিষয়ে তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ যৌক্তিক কোষ্ঠীপাথরে বিবেচ্য নয়। তাই নাস্তিকেরা যখন আস্তিক মানুষদের সমালোচনায় অবতীর্ণ হন, তখন তাদের বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হয়। ভবানীপ্রসাদ সাহু এই প্রসঙ্গে লিখেছেন–
ধর্মবিশ্বাস বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, আবেগ ও চেতনায় এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, যাঁরা ধর্মের অনড়, অচল অবস্থার বিরোধিতা করেন, তার ভ্রান্তির কথা আলোচনা করেন– তারা আগেভাগেই বলে রাখেন: বিশেষ কোনও ধর্ম মতাবলম্বীদের বিন্দুমাত্র আঘাত করার কোনও ইচ্ছা নেই ইত্যাদি; এবং তাদের বিরোধিতার প্রধান বিষয় থাকে ধর্মান্ধতা, উগ্র ধর্মীয়-সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় একগুঁয়েমি বা ধর্মীয় হিংস্রতা ইত্যাদি।৯
এখানেই এসে পড়ে ধার্মিকতা ও ধর্মান্ধতার মধ্যেকার পার্থক্য নির্ণয়ের প্রশ্ন ও তার প্রয়োজনীয়তার কথা। ‘ধর্মান্ধ’ বলতে ঠিক কাদের বোঝানো যাবে তা নিয়ে ‘নানা মুনির নানা মত’ থাকলেও সাধারণভাবে বলা চলে যে, নিজের ধর্মকে পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সত্য ধর্ম এবং অন্য ধর্মকে নিকৃষ্ট ও অসত্য ধর্ম হিসেবে প্রতিপাদনে যারা অগ্রণী তাদেরকেই যথার্থ অর্থে ‘ধর্মান্ধ’ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, সেক্ষেত্রে ধর্মীয় নীতি বা মূল্যবোধ অনুসরণের তুলনায়, আচার-সর্বস্বতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় এবং নিজেদের ধর্মীয় আচার-আচরণ অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার তৎপরতা লক্ষ্যণীয় হয়। ‘ধর্মান্ধ’ ব্যক্তিরা কখনোই ধর্মীয় আচার-ব্যবস্থার যৌক্তিকতা বিচারে আগ্রহী হয় না। তারা ধর্মের নামে কঠোর অনুশাসন কায়েম করতে চায় এবং নিজের ধর্মকে অপরের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। এদিক থেকে বলা যায় যে, ‘ধার্মিকতা’ যেমন এক ধরনের জীবনশৈলী প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী; ‘ধর্মান্ধতা’ তেমনই প্রকটিত করে তোলে এক ধরনের ‘মানসিক ব্যাধি’। সেদিক থেকে প্রথমটি ‘ইতিবাচক’, দ্বিতীয়টি অবশ্যই ‘নেতিবাচক’। প্রাসঙ্গিকভাবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ধর্মমোহ’ কবিতার কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন –
ধর্মের বেশে মোহ এসে যারে ধরে, অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে। নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর, ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর। শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো, শাস্ত্র মানে না, মানে মানুষের ভালো।১০
উল্লেখ্য যে, সমাজবিজ্ঞানীর প্রজ্ঞা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘ধর্মান্ধতা’-র স্বরূপটি উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাই তিনি বলতে পেরেছিলেন– ’ধর্ম কারার প্রাচীরে বজ্র হানো / এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো’। ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন: “মানুষ বলেই মানুষের যে মূল্য সেইটিকে সহজ প্রীতির সঙ্গে স্বীকার করাই প্রকৃত ধর্মবুদ্ধি”। ‘মানুষের ধর্ম’ শীর্ষক রচনাতে এ বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞান এক্ষেত্রে দিক্নির্দেশক। আপন সাহিত্যকর্মে তিনি নিপুণভাবে ধর্মীয় মৌলবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটনে ব্রতী হয়েছিলেন। এ-বিষয়ে বিশদ আলোচনায় রাজীব সরকার দেখিয়েছেন, ‘অচলায়তন’ নাটকের ‘মহাপঞ্চক’; ‘বিসর্জন’-এর ‘রঘুপতি’; ‘মালিনী’-র ‘ক্ষেত্রঙ্কর’ কীভাবে ধর্মান্ধতার প্রতিভূ হয়ে উঠেছেন। ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কলম ঝলসে উঠেছে তার ‘চতুরঙ্গ’, ‘গোরা’ প্রভৃতি উপন্যাসেও। বলা বাহুল্য যে, এসব নিয়ে পৃথক লেখালেখি অনেক হয়েছে এবং আরও অনুশীলনের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।১১
প্রসঙ্গত এসেই পড়ে স্বামী বিবেকানন্দের ‘শিকাগো বক্তৃতা’-র কথাও। ১১ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩ ‘শিকাগো ধর্ম-মহাসভা’-র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অভ্যর্থনার উত্তরে তিনি বলেছিলেন: “সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা ও এসবের ফলস্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহু কাল ধরে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পৃথিবীতে এরা তাণ্ডব চালিয়েছে, বহুবার পৃথিবীকে নরশোনিতে সিক্ত করেছে, সভ্যতা সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে এবং সমগ্র মানবজাতিকে নানা সময় বিভ্রান্তি ও হতাশায় নিমগ্ন করেছে। এই সব ধর্মোন্মাদ পিশাচ যদি না থাকত, তবে মানব সমাজ আজ যে অবস্থায় উপনীত হয়েছে, তার থেকে কত সুন্দর হয়ে উঠতে পারত। এরা তা করতে দেয়নি।” বলাবাহুল্য যে, বিবেকানন্দের এই অভিজ্ঞানে একদিকে যেমন ‘ধার্মিকতা’ ও ‘ধর্মান্ধতা’-র ভেদরেখাটি স্পষ্ট, অন্যদিকে তেমনি ধর্মীয় মৌলবাদের স্বরূপটিও কমবেশি উদ্ঘাটিত।১২
তাই ধার্মিকতা ও ধর্মান্ধতা যে এক বিষয় নয়– এ কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ধার্মিক বোঝে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ধর্মীয় রীতিনীতি প্রয়োগের তারতম্যগুলিকে; কিন্তু ধর্মান্ধ তা বোঝে না। ধার্মিক ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান আহরণে আগ্রহী; ধর্মান্ধ অন্ধ-আবেগে অজ্ঞানতাকেই হাতিয়ার করে। ধার্মিক ব্যক্তির সিদ্ধান্ত সু-বিবেচনাপ্রসূত; ধর্মান্ধ ব্যক্তি আবেগতাড়িত। ধার্মিক নিজে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেন, ধর্মান্ধ নিজে তা মানে না অথচ অন্যকে দোষারোপ করতে পিছপা হন না। ধার্মিক মানুষকে ভালবাসে, ধর্মান্ধ ঘৃণা ও বিদ্বেষের সংস্কৃতি লালন করে। ধার্মিক ও ধর্মান্ধ ব্যক্তির মধ্যে এমনতরো পার্থক্যের কথা মনে রেখেও বলতে হয় যে, ধার্মিক মানুষও অনেক সময় উদার বা কট্টরপন্থী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রেও ধর্মান্ধদের থেকে তার পার্থক্য বিধানে বিশেষ সমস্যা হয় না, কারণ ধার্মিক মানুষ সাধারণত ধর্মভীরু হন, তারা আপন ধর্মপালনে তৎপর থাকেন এবং কিছু ক্ষেত্রে অনুদার হলেও তারা সাধারণভাবে কুযুক্তিপরায়ন বা হিংস্র প্রকৃতির হন না। কাজী জামাল আহমেদ তার ‘ধর্ম, ধার্মিক, ধর্মান্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে–
ধর্ম হল একটি বিশ্বাস ব্যবস্থা যা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। ধার্মিক ব্যক্তিগণ তাদের ধর্মের মূল্যবোধ ও নীতিগুলো অনুসরণ করে জীবন যাপন করেন। ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা অতিমাত্রায় ধর্মচর্চা করতে চায় এবং অন্যদের উপর সেগুলো চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। সেটা ভুল কি শুদ্ধ তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন মনে করেন না।
ধর্ম ধার্মিক ব্যক্তিদের জীবনে শান্তি ও ঐক্য আনতে পারে। ...অন্যদিকে ধর্মান্ধতা সমাজে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এটি মানুষকে সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতার দিকে ঠেলে দেয়।১৩
এসব তো গেল ব্যক্তিগতস্তরে ধর্ম বিষয়ে অবস্থান সম্পর্কিত আলোচনা, যার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের গতিপ্রকৃতি সবসময় এক রকমের হয় না। মৌলবাদের যথার্থ উৎসভূমি চিহ্নিত করতে হলে তাই প্রাতিষ্ঠানিকতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হয় এবং সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্ম মতের কথা অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে। প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই আপনার ধর্মমতের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি যে অন্তর্লীন থাকে– সে কথা আমরা আগেই বলেছি। অন্যথায় তার বিশেষ অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা প্রতিষ্ঠা পায় না। আবার প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ই নিজেদের বিধি-বিধানগুলিকে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবিকলভাবে প্রয়োগ করতে চায়। ‘বহুত্ববাদী’ (pluralist) সমাজে তা অনিবার্যভাবে সংঘাতের বাতাবরণ সৃষ্টি করে এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতি বিনষ্ট হয়। এরকম এক বাস্তব পরিস্থিতিতে ‘ধর্ম’ যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করার ‘হাতিয়ার’ হয়ে ওঠে তখন তা ‘মৌলবাদ’-এর নামান্তর হয়। উল্লেখ্য যে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মৌলবাদীদের অনুপ্রবেশ রাষ্ট্রপরিচালনায় বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অন্তরায় হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই তখন গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরাচার, মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিবর্তে বাক্স্বাধীনতা হরণ, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গণ-অংশগ্রহণের পরিবর্তে সুযোগের সংকোচন ইত্যাদি অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। অন্যভাবে বলি যে, সবকিছুই যেখানে ধর্মের নামে চাপিয়ে দেওয়া হয়; সেখানে ভিন্ন মতের অবকাশ থাকে না। তাই ধর্মের যত উদারনৈতিক ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক না কেন, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র কখনও যথার্থ অর্থে গণতান্ত্রিক হতে পারে না। সর্বোপরি একথা মনে রাখা জরুরি যে মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তির প্রশ্নটি সম্পূর্ণভাবেই ‘ইহ-জাগতিক’, অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গেই তা অধিকতর সম্পৃক্ত, তা কোনও ধর্মীয় বিধি ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
চার
ধর্ম, ধার্মিকতা ও ধর্মান্ধতা সম্পর্কিত এই আলোচনায় একথা সুস্পষ্ট যে, সাধারণভাবে ‘ধর্ম’-কেই ‘মৌলবাদ’-এর প্রধান উৎসভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা গেলেও গভীর বিশ্লেষণের ধর্মান্ধতাই এক্ষেত্রে চরম বিপদের কারণ হয়ে ওঠে। তাই ‘মৌলবাদ’ প্রতিহতকরণের ভাবনায় সামগ্রিকভাবে ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ, বিশেষত ভারতের মতো দেশগুলিতে কতখানি সহায়ক বা আদৌ সহায়ক কিনা তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। এক্ষেত্রে, দু-টি পরস্পর বিরোধী দিক থেকে আমাদের ভাবনাকে প্রসারিত করার সুযোগ রয়েছে। প্রথমত, একথা মনে রাখতে হয় যে, ভারতের মতো সমাজে ধর্ম একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের সামগ্রিক জীবনযন্ত্রণার প্রেক্ষিতে ধর্মকে আশ্রয় করেই নতুনভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা সঞ্চয় করেন। ধর্ম তাদের কাছে কতখানি ‘আফিং’-এর মতো বা কতদূর পর্যন্ত ‘হৃদয়হীন জগতের হৃদয়’ সে বিতর্কে না গিয়েও বলি যে, অনেকের কাছেই এটি এমন এক ধরনের ‘বিশ্বাস ব্যবস্থা’– যা তাদের চেতনার জগতকে নানাভাবেই আন্দোলিত করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অসৎকর্ম থেকে তাদের নিবৃত্ত হতে সহায়তা করে। এটি তাদের ‘পাপ-পুণ্যবোধ’ বা ‘মোক্ষলাভ’ ইত্যাদি নানা জটিল প্রশ্ন এর সঙ্গে সংপৃক্ত এবং তার সঙ্গে মৌলবাদ’-এর সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই। অন্য দিক থেকে বলি যে, ধর্মান্ধতা প্রসূত ‘মৌলবাদ’ তা সে যতই নিন্দনীয় হোক না কেন, এক কথায় তাকে খারিজ করা চলে না। কারণ বৃহত্তর সমাজে তার কম-বেশি গ্রহণীয়তা ব্যতিরেকে তা ‘বিপজ্জনক’ হয়ে উঠতে পারে না। মৌলবাদের ক্ষেত্রে সম্মতি নির্মাণের এই প্রয়াসে ‘ধর্ম’ বোধকরি সর্বাধিক ‘সহায়ক উপাদান’ হয়ে উঠতে পারে। ধর্মের নামে উন্মাদনা সৃষ্টি মৌলবাদী ক্রিয়া কাণ্ডে তাই দ্রুত সফলতা পেতে পারে এবং এই প্রক্রিয়ায় ধর্মপ্রাণ মানুষদেরও বিভ্রান্তির শিকার হতে হয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় মৌলবাদ-এর বিপদকে তাই লঘু করে দেখার কোনও সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতা এবং আপসকামিতা বিপরীত ফল প্রদান করতে পারে।।
মৌলবাদের প্রধান আশ্রয় যে ‘অজ্ঞতা’ (ignorance) একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। তাই সাধারণভাবে একথা মনে করা হয় যে, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বৃহত্তর সমাজে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসার ঘটাতে পারে এবং তা মৌলবাদী অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে ‘বর্ম’ হিসেবে কাজ করতে পারে। এই লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম প্রধান শর্ত হিসেবে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিযুক্তিকরনের প্রয়োজনীয়তার কথাও বেশ জোরের সঙ্গেই বলা হয়ে থাকে। প্রাসঙ্গিকভাবে একথাও স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে যে, একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক কাঠামো– যেখানে দারিদ্র-বিমোচন, অশিক্ষা ও বেকারত্ব দূরীকরণ, গ্রামীণ-উন্নয়ন ও গণ-অংশগ্রহণ প্রভৃতি বিষয়সমূহ প্রাধান্য পেতে পারে তা মৌলবাদ-এর উত্থানের বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। সব মিলিয়ে বলতে চাওয়া হয় যে, একটি আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, গণতান্ত্রিক, উন্নত আর্থসামাজিক কাঠামোতে মৌলবাদ শিকড় বিস্তার করতে পারে না। আপাতদৃষ্টিতে মৌলবাদ-এর বিপদ মোকাবিলায় এসবের কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে আমাদের দেশে এবং অন্যত্র মৌলবাদের বিকাশধারা আমাদের এসব নিয়ে নতুনভাবে ভেবে দেখার প্রেরণা জোগায়। কেবলমাত্র ছকে বাধা কিছু ‘চর্বিত-চর্বন’-এ সীমায়িত না থেকে ইতিহাস-ভূগোল থেকে শুরু করে জনবিন্যাস ও তাদের মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি নতুন ভাবে পর্যালোচনা করে এ-বিষয়ে স্ট্র্যাটেজি নির্ণয় আজকের দিনে সংশ্লিষ্ট মহলের গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে বিবেচিত হতে পারে।
প্রাসঙ্গিকভাবে একই রকমের কথা বলা যেতে পারে জাতপাত গত বা বর্ণগত মৌলবাদ প্রসঙ্গেও। জাতি (Nation) ও জাতিসত্তা (nationality) প্রসঙ্গে যেমন বৃহৎ জাতীয়তা (great nationalism) এবং ক্ষুদ্র জাতীয়তা (little nationalism) নিয়ে নানা কথা রয়েছে, তেমনই আবার আজকের দিনে অসংখ্য গোষ্ঠীসত্তা নিজেদের পরিচিতি সত্তা(identity) নিয়ে রাজনীতিতে অবতীর্ণ হয়েছে। বলা বাহুল্য যে, মৌলবাদের থাবা সেখানেও বিভিন্ন প্রকরণে বিস্তৃত। কিন্তু এক্ষেত্রে মূল প্রশ্নটি এই যে, ‘বৃহত্তর পরিচিতি’-র দোহাই পেড়ে সেগুলিকে অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়া কতখানি সম্ভব– তা নিয়ে নতুনতর ভাবনার অবকাশ রয়েছে।
‘মৌলবাদ’-এর আরও নানাপ্রকরণের কথাও আলোচনায় এসেছে। বাম রাজনীতি প্রসঙ্গেও কথা উঠেছে, তার ‘যান্ত্রিক ধারণা’, ‘নির্ধারণবাদী অবস্থান’ এবং ‘কর্তৃত্ববাদী মডেল’ ঘিরে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পরবর্তী সময়কালে ‘মার্কসবাদ’-এর যেসব একরৈখিক ভাবনা নিয়ে কথা উঠেছে, তার প্রেক্ষাপটে মার্কস-চর্চার এক নব দিগন্ত যেন লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সেখানেও যেন দ্বিবিধ লক্ষ্য বিকাশমান। একটি অবশ্যই নিজেদেরকে মৌলবাদী লক্ষণ থেকে মুক্ত করার প্রক্রিয়া এবং অন্যটি হল বৃহত্তর সামাজিক রাজনৈতিক পরিসরে মৌলবাদের বিরুদ্ধে সামগ্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান।
পরিশেষে বলি যে, মৌলবাদ একটি জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয় তার রকম ফেরও বড়ো কম নয়। আপাত বিরোধী নানা বিষয়কে আশ্রয় করেই মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। রাজনৈতিক বিচারে সেগুলির মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়াও দুরূহ কোনও বিষয় নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল ও তা কুক্ষিগত রাখার প্রেক্ষিতে বিচার করলে সহজেই বোধগম্য হয় যে, তা এক ‘অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি’-কে লালন করে হিংসার সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে, গণতান্ত্রিকতার পরিবর্তে স্বৈরাচারী ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় এবং শেষ বিচারে তা নিজেকে ‘ইতিহাসের পশ্চাদ্গামী পদক্ষেপ’ হিসেবেই প্রতিপন্ন করে। সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগমনের তাগিদে, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের দুর্দশা মোচনে এবং চিন্তায় মুক্তির লক্ষ্যে মৌলবাদ প্রতিহতকরণের নবতর কর্মসূচি উদ্ভাবন তাই জরুরি এবং তার জন্য বোধ করি সর্বাধিক প্রয়োজন মুক্ত চিন্তার। ছকে বাঁধা কর্মসূচিতে নয়, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত নতুনতর চিন্তা প্রণালীতে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
সূত্রনির্দেশ :
১. ভবানীপ্রসাদ সাহু, ‘মৌলবাদ এর উৎস সন্ধানে’, উজ্জ্বল সাহিত্য মন্দির, কলকাতা, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা: ১০৯-১২
২. Tapan Basu et. al., ‘Khaki Shorts Saffron Flags : A Critique of the Hindu Right’, Orient Longman, New Delhi, 1993; A.G. Noorani, ‘The RSS and the BJP : A Division of Labour’, Leftword Books, New Delhi, 2000 ; জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘মহাকাব্য ও মৌলবাদ’, অ্যালায়েড পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৯০, ইত্যাদি
৩. Ninan Koshy, ‘The War on Terror : Reordering the World’, Leftword Books, New Delhi, 2002; Debnarayan Modak (ed.) ‘Terrorism : Concepts and Problems’, Progressive Publishers, Kolkata, 2009 ; Samuel P. Huntington, ‘The Clash of Civilisation and Remaking of World Order’, Simon and Schuster, New York, 1996, etc.
৪. শোভনলাল দত্তগুপ্ত, ‘মৌলবাদ এখন’, “অনীক” (৫২ বর্ষ, ৩-৪ সংখ্যা) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা: ১০৯-১২
৫. পূর্বোক্ত
৬. ভবানীপ্রসাদ সাহু, ‘প্রাগুক্ত’, পৃষ্ঠা: ৩৩-৩৫
৭. পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা: ৩৫-৩৬
৮. শোভনলাল দত্তগুপ্ত, ‘প্রাগুক্ত’, পৃষ্ঠা: ১০৯-১২
৯. ভবানীপ্রসাদ সাহু, ‘ধর্মের উৎস সন্ধানে’, প্রবাহ, কলকাতা, ১৯৫৯ পৃষ্ঠা: ১২
১০. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, “ধর্মমোহ”, ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’, দ্বিতীয় খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, কলকাতা, ১৯৮২, পৃষ্ঠা: ৯৭৮
১১. দেবনারায়ণ মোদক, ‘সমাজ চিন্তক রবীন্দ্রনাথ: সমকালের দর্পণে’, “একুশ শতক”, কলকাতা ২০২১ পৃষ্ঠা: ৮৫-৯৭; রাজীব সরকার, ‘ধর্মমোহের যুগের রবীন্দ্রদর্শন’, “যুগান্তর”, সাহিত্য সাময়িকী, ৯ মে ২০১৯ (অনলাইন সংস্করণ)
১২. ভবানীপ্রসাদ সাহু, ‘মৌলবাদের উৎস সন্ধানে’, (প্রাগুক্ত), পৃষ্ঠা: ১০-১১ ; দেবনারায়ণ মোদক, ‘বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার ১২৫ বছর : একটি পুনর্নিরীক্ষণ সমাজ জিজ্ঞাসা’ (দশম বর্ষ ১-২সংখ্যা ২০১৭) বিদ্যাসাগর সমাজবিজ্ঞান কেন্দ্র, মেদিনীপুর, পৃষ্ঠা: ৪০-৪৯; দেবনারায়ণ মোদক, ‘রাজনীতি ও ভারত ভাবনা’, নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, ২০১৫ পৃষ্ঠা: ৯৯-১১৮
১৩. কাজী কামাল আহমেদ, ‘ধর্ম, ধার্মিকতা, ধর্মান্ধতা’, মাত্রা প্রকাশ, ঢাকা, বাংলাদেশ, ২০২৩