বাউল গানের সংকলন ‘হারামণি’ গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “আমাদের দেশের ইতিহাস আজ পর্যন্ত প্রয়োজনের মধ্যে নয়, পরন্তু মানুষের অন্তরতর গভীর সত্যের মধ্যে মিলনের সাধনাকে বহন করে এসেচে। বাউল সাহিত্যে বাউল সম্প্রদায়ের সেই সাধনা দেখি,— এ জিনিস হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই, একত্র হয়েচে অথচ কেউ কাউকে আঘাত করেনি। এই মিলনে সভা-সমিতির প্রতিষ্ঠা হয়নি, এই মিলনে গান জেগেছে, সেই গানের ভাষা ও সুর অশিক্ষিত মাধুর্য্যে সরস। এই গানের ভাষায় ও সুরে হিন্দু মুসলমানের কন্ঠ মিলেচে, কোরান পুরাণে ঝগড়া বাধেনি। এই মিলনেই ভারতের সভ্যতার সত্য পরিচয়, বিবাদে বিরোধে বর্বরতা।” রবীন্দ্রনাথের কল্পিত আদর্শ মহামানবের সাগরসংগম ভারততীর্থে আজ অসভ্য বর্বরদের পদসঞ্চার। মত-পথ-ভাব-চেতনার বহুবিচিত্র প্রবাহ ও তার অন্তর্লীন যোগসাধনের মূলোচ্ছেদ করে তাঁরা প্রয়োজনের বর্তমান নির্মাণ করতে চায়। ‘বিবিধের মাঝে মিলনের’ ভারতীয় ঐতিহ্য আজ সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর প্রতিযোগিতামূলক মৌলবাদী কার্যক্রমে ধ্বংস করে চলেছে মানবের অন্তরতর সত্য। প্রীতি-প্রেম-সৌহার্দ্য হারাতে বসেছে পরিকল্পিত কোরান-পুরাণের বিবাদে। মননবিহীন মন্ত্র আজ সোল্লাস চিৎকার, দমনের স্লোগান। বর্ণবাদ মনুবাদী মানসিকতা মানুষকে থাকবন্দি করতে চাইছে ধর্ম, জাতপাত, কুলীন-অশুচির বিচারভেদে। কট্টর ঐস্লামিক সন্ত্রাসীরা জেহাদ ঘোষণা করেছে সভ্যতা তথা এযাবৎ যাবতীয় মানবিক অর্জনের বিরুদ্ধে। পহেলগাঁও-তে বর্বরতা আতঙ্কিত শিহরিত করেছে আমাদের। গাজায় জায়নবাদীদের পরিকল্পিত গণহত্যা পূর্বাপর সমস্ত মানবীয় নৃশংসতা ও ক্রূরতার সীমা অতিক্রম করেছে। আমেরিকার রেস্তোরাঁয় শপিংমলে স্কুলে বন্দুকবাজ খ্রিস্টীয় মৌলবাদীরা মাঝে মাঝেই কেড়ে নিচ্ছে কতশত সাধারণ নাগরিকের প্রাণ। উধাও মানুষ, ঘৃণার পিঠে প্রতি-ঘৃণা আজ প্রকাশ্য। মানব-বিনষ্টির, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’-র এই কালো-সময়ে নিশ্চিত ফিরে যেতে হবে শিকড়ে। সভ্যতার মূল, আবহমান মানবোচিত সংস্কৃতির প্রাণ যেখানে: অনাদি অনন্তের উৎসে সীমা অসীমের কেন্দ্রে সেথায়; মানুষ যেখানে মূল। শাস্ত্রাচার লোকাচারের গণ্ডি ছাড়িয়ে মুক্ত মানুষ যেখানে। “মানুষ ছাড়া খ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।”
দৌড় থামিয়ে আত্মসন্ধানে মগ্ন হওয়ার সময় আজ। গোলকায়ন আমাদের ছুটিয়ে মারছে। ভোগ্যপণ্য চাইতে চাইতে কিনতে কিনতে আমরা পণ্যদাস হয়ে পড়ছি। হুজুগে মেতে ভুলেছি আমাদের অস্তিত্ব। অনালম্ব সত্তা আমাদের কেনা যায় সহজে, বশ মানানো যায়, ঘুম পাড়ানো যায়, বুকে পোরা যায় প্রতিহিংসার বারুদ। ছুটতে ছুটতে কখন যে জীবনবিচ্ছিন্ন, আত্মপরিচয়বিহীন হয়ে পড়েছি, সংবিৎ নেই তারও। নাগরিক আমরা ভাবি বি-জ্ঞাপনে ভর-ভরন্ত আমাদের অভিজ্ঞান। জাত-বর্ণ-অর্থ-শিক্ষা, সর্বোপরি ধর্মীয় একানুগত্যের কত-না অনমনীয় অনড় ঘোষণা; রাজনৈতিক আনুগত্য অথবা নিরপেক্ষতার ভানের। কিন্তু, উল্লাসে, বিদ্বেষে, মৈথুনের রবরবায় নিজেকে জানা? ওখানেই রয়েছে মস্ত ফাঁকি।
আমাদের উপনিষদ তো বলেছে— “আত্মানং বিদ্ধি”— নিজেকে জানো। আর আর্যেতর সহজপথের সাধকেরা বলেছেন, আপনাকে জানলেই জগতকে চেনা যায়, পরমপুরুষকে পাওয়া যায় আপনার আপনে। মন্ত্রতন্ত্র জপতপ তসবিহ নামাজে উপাসনালয়ে অযোধ্যা, বারাণসী, মক্কা, মদিনায় মানুষ অধরা-কে খুঁজে ফেরে। ‘বেদ বিধি শাস্ত্র কানার’ এই হাটবাজারে ‘মানুষ রতন’ পাওয়া বড়ো দায়। মানবতন্ত্র পণ্ডকারী বৈচিত্র্য-বিরোধী একমুখী, পরিবর্তন বিমুখ, অসহিষ্ণু, স্থাণু, শাস্ত্রসর্বস্ব ধর্মের মধ্যেই মৌলবাদী কাঠামো বর্তমান। শাস্ত্র এখানে মূল, ও তার ব্যাখ্যাতা কর্তৃত্বকারীর কেন্দ্রীয় নির্দেশ মেনে চলাই হল ধর্মের পথে থাকা। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা চরম, ন্যূনতম দ্বিধা বিভক্তি দ্রোহের শামিল, জ্ঞান স্বয়ম্ভূ তাই প্রশ্ন অচল। ওপর থেকে সরাসরি নীচে নেমে আসে কর্তব্যাবলি অথবা ফতোয়া; অনুসারী-ভক্তি-ভয়ে পরিবারবাহিত বিশ্বাসে আজ্ঞা পালন হয় যথাযথ। মূলগত জ্ঞান-শাস্ত্রের ব্যাখ্যাকারীরা অপর ধর্মীয় মৌলিক-প্রত্যয় থেকে, আচার-রীতি থেকে স্ব-মূলের পৃথকত্ব বজায় রাখে, অথবা তুলনীয় শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে। তাই, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম মূলেই বিভেদাচারের খোপে মানুষকে অসহিষ্ণু করে। সহজ মানুষের সন্ধানী তাই বলেছেন—
যতসব কানার হাট বাজার বেদ বিধি শাস্ত্র কানা, আর এক কানা মন আমার। পণ্ডিত কানা অহংকারে, সাধু কানা অবিচারে, কানায় কানায় যুক্তি করে, যেতে চায়রে ভব পার। কেউবা হয়ে দিন কানা পরের দোষে দিচ্ছে হানা, রাতকানা কেউ শুয়ে শুয়ে ঘুমের ঘোরে দেয় বাহার। কানায় কয় কানারে কানা, আমার পথে চলে আয় না, আচ্ছা মরি ববুয়ানা, তোর পথে কি আছে সার। কানায় কানায় ঠেলাঠেলি, বেশ করতেছে গালাগালি, মনমোহন কেন কানা হইলি, অন্ধ হয়ে থাকে এবার। আন্ধার খেলা ধান্ধার মেলা, বোবায় খাইছে রসগোল্লা, অন্ধা ধান্ধা, বোবা কানা, মজা লুটে নিছে তার।।
অনুমানের কল্পলোকে সহজপথের মানুষের বিশ্বাস নেই। বিশ্বাস নেই মানুষ সৃষ্ট ভেদাভেদে, পূজা-রোজায় মূর্তি-প্রতিমা বিধি-বিধানে। বাহ্য ঈশ্বর তাঁদের উপাস্য নয়, বিশ্বনাথকে অন্তরে উপলব্ধি তাঁদের সাধন-ভজনের মূলে। অন্তরের প্রেমিকপুরুষকে সহজপথিক প্রেমে আপন করে নিতে চেয়েছেন। জ্ঞান ও কর্মের চেয়ে প্রেমভক্তির অনাবিল যোগ-ধ্যানে ভেসে চলে সহজ মানুষের সাধনতরি। মানুষ হয়ে ‘মানুষরতন’ খুঁজে ফেরে খ্যাপা— “যাঁকে সকলের চেয়ে জানবার তাঁকেই সকলের চেয়ে না জানবার বেদনা”— তাঁকে ঘুরিয়ে মারে। পথে পথে তিনি পা মেলান। সকল বিভেদাচারকে তুচ্ছ মনে করে তিনি জাত-মান-কুল হারান। কীর্তি মান যশকে নিরর্থক, হিন্দুয়ানি মুসলমানি শাস্ত্র-শরিয়তকে অন্তঃসারশূন্য মনে করে মরার আগে মরে শমন জ্বালা জুরাতে চান। প্রথাগত ধর্মের পরাকাষ্ঠা গণ্ডির বাঁধন ছাড়িয়ে অহং লোপের সাধনায়। বেশ-ভাষা-ভাবে সকলকে জড়িয়ে ‘জ্যান্তে মরা’ এই দিবানা পাগলরা মানবসত্যের ওপর তাঁদের ধর্ম মেলাতে চেয়েছেন। নির্মল অন্তরে আরস পেতেছেন পড়শি ঈশ্বরকে ছুঁয়ে দেখতে। বিদ্বেষ বিষ নাশ করে মানবসাম্যের এই বাণী একসময় উচ্চবর্ণীয়, মুখ্যধর্মীয় প্রতাপ, ফতোয়া ও সামন্ততান্ত্রিক নিগড়তা থেকে মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। সমন্বয়ধর্মী এই পথ কায়াযোগে বিশ্বযোগ সাধনার। সাধনার কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। ‘মনের মানুষ’, ‘অটল মানুষ’, ‘সহজ মানুষ’, ‘সোনার মানুষ’, ‘অধর মানুষ’, ‘রসের মানুষ’। নিজের মাঝে, মানুষের মাঝে সহজিয়া চাতক-হৃদয়ে পরম মানুষের খোঁজ করেন। এই অকালে ডুব দিতে হবে তাই লোকায়তের অন্তরে। যেখানে আছে আমার আমি, সহজ আমি, মানুষ আমি।
অথচ, মানুষ নিজেই গিয়েছে হারিয়ে। নানা নামচিহ্নের খোপে স্ফীত হয়ে চলেছে জনসংখ্যা। ভূতগ্রস্ত ঘাতক আত্মকণ্ডূয়নের কাছে আত্মসমর্পণ না-করে হাতে হাত ধরে মূলে ফিরতে হবে আজ; মানুষিক ভাষা, সংস্কৃতির কাছে। ঘৃণা-বিদ্বেষে বিষাক্ত, সবেতেই মুনাফা খোঁজা, পাঁচমেশালি কালচারে কিম্ভূতকিমাকার এই সময়ের উজানে পথ হাঁটতে হবে আজ। ডাক এসেছে— ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’
মানুষ খুঁজে লোকসংস্কৃতির মূলে ফিরতে চেয়েই অভিক্ষেপ এবারের বৈশাখের বিষয় করল মৌলবাদ। আমরাও শেকড় সন্ধানী, তবে ফিরতে চাইছি সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির মূলে; একরোখা আগ্রাসী মৌলবাদী আক্রমণের বিপরীতে সংশয়-অন্বিত মুক্তচেতনা, তথা মানুষ-ভজনার ধর্মে। জাত বিকিয়ে যেখানে হিন্দু গোঁসাইকে মুরশিদ মনে করেন মুসলমান শিষ্য, মুসলমান ফকিরকে একমাত্র আরাধ্য রূপে প্রাণে ধরেন হিন্দু মুরিদ। ভাঙাভাঙি ভাগাভাগির সময়ে মানবঅর্হণা অ-মূল্য। মিলনের আজ বড়ো প্রয়োজন।