মতাদর্শিক মৌলবাদ

সন্তোষ কুমার পাল

আলোচ‍্য প্রবন্ধে আমরা মতাদর্শিক মৌলবাদ (ideological fundamentalism)-এর প্রসঙ্গটি বোঝার চেষ্টা করব। প্রথমে মতাদর্শ (ideology)-এর তত্ত্ব-তালাশ করব। এর উৎপত্তিসূত্র, ধরন-ধারণ বোঝার চেষ্টা করব। তারপর মৌলবাদ (fundamentalism)-এর কিছু খোঁজ-খবর নেব। সবশেষে সোভিয়েত মার্কসবাদের বিরুদ্ধে কথিত মতাদর্শিক মৌলবাদের বিচার-বিশ্লেষণ করব।

এক

প্রথমেই বলি, বুৎপত্তির বিচারে ‘ideology’ (অধিকতর ভালো পরিভাষার অভাবে আমরা এর বঙ্গানুবাদ ‘মতাদর্শ’ করছি) বলতে কোনও ধ‍্যানধারণা, নিয়ম-নীতি তথা কর্মপরিকল্পনাকে বোঝায়। লিখিত ইতিহাসে আমরা এই পরিভাষাটি প্রথম পাই অ্যান্তোইন ডেসটুত্ত ডি ত্রাসে (Antoine Destutt de Tracy)-র ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে লেখা একটি রচনায়। নৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক বিজ্ঞানের নিশ্চিত ভিত্তির অনুসন্ধান কালে ‘ধারণা তথা মতরাজির বিজ্ঞান’ (a science of ideas) অর্থে ‘আইডিওলজি’ শব্দটি ব‍্যবহার করেন। এখানে বলে রাখি, ধারণা (idea) বলতে আমরা বর্তমানে ঘটমান বাস্তবতার প্রতিবেদনকে বুঝি, যেখানে মতাদর্শ ধারণাগুচ্ছের বিজ্ঞান হলেও তার গতিমুখ কিন্তু বর্তমানের চেয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের দিকেই বেশি থাকে– এটা মনে রাখা প্রয়োজন। আর একটা সমগোত্রীয় পরিভাষা আদর্শ (ideal) আদর্শ বলতে কোনও এক মূল্যের পরাকাষ্ঠা বা লক্ষ্যকে বোঝায়, যাকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরে নিয়ে জীবনে চলার চেষ্টা করি। মতাদর্শ তার থেকে যে বেশ আলাদা তা আমরা পরের আলোচনাতেই বুঝতে পারব। যাই হোক, দর্শনের ছাত্র হিসেবে আমাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় মনে হয়, ত্রাসে অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক জন লকের জ্ঞানতত্ত্ব অনুসরণ করে মতাদর্শের ভিত্তি খুঁজে পেয়েছেন এই দু-টি বাস্তবতায়: (১) জগতের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় যে সংবেদনগুচ্ছ আমরা পেয়ে থাকি তাই জ্ঞানের প্রাথমিক ভিত্তি; এবং (২) এই সংবেদনগুচ্ছ থেকেই আমরা যাবতীয় ধারণা গঠন করি। তিনি সাধারণ জনগণের যুক্তিহীন নিছক আবেগ-তাড়িত বিচারধারার বিপরীতে এই অভিজ্ঞতাবাদী বিচারধারাকে সামনে আনতে এই শব্দটি ব‍্যবহার করেন। অন্য দিকে একই সঙ্গে, ত্রাসে মতাদর্শ বলতে ব‍্যক্তিস্বাধীনতা, ব‍্যক্তিগত সম্পত্তি, সাংবিধানিকতা এবং মুক্ত বাজারের ভাবনাগুচ্ছের কথাও বলতে শুরু করেন। ফলত তাঁর কাছে উদারনীতিই সেই মতাদর্শ যা আমাদের পরিচালিত করবে। পরবর্তীতে বিবর্তন ও রূপান্তর হতে হতে ‘মতাদর্শ’ পরিভাষাটি আজ নানাবিধ ব‍্যঞ্জনা লাভ করেছে।

এম. হ‍্যামিলটন ১৯৮৭-তে লিখছেন: “An ideology is a system of collectively held normative and reputedly factual ideas and beliefs and attitudes advocating particular pattern of social relationships and arrangements, and/or aimed at justifying a particular pattern of conduct, which its proponents seek to promote, realize, pursue or maintain.” এখানে “reputedly factual” বিশেষণটি বিতর্কিত বলে আমার মনে হয়। অনেক মতাদর্শ বা ভাবনা দলবদ্ধভাবে প্রচার করার ব‍্যবস্থা হতে পারে, যা সম্মানিত বা বহুল-স্বীকৃত নয়, বরং তা অনেকখানি ছদ্ম-প্রকৃতির: “মধু তিষ্ঠতি জিহ্বাগ্রে হৃদয়ে তু হলাহলম্”! তাই আলথুজের সহ অনেকেই মনে করেন, মতাদর্শ নিছক কিছু ধারণার সমষ্টিমাত্র নয়, তা এমন অনেক ধারণাও হতে পারে যা আমাদের সমাজের ক্ষমতা-সম্পর্কগুলিকে আড়াল করে, নয়তো সপক্ষে যুক্তি হিসেবে কাজ করে। (conceal, distort, or justify power relations in a society)। উইলয়ার্ড এ মুল্লিনস আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে মতাদর্শকে ইউটোপিয়া ও ঐতিহাসিক মিথের থেকে আলাদা করে বুঝতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি মতাদর্শের চারটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন: (১) জ্ঞানের বাস্তবতা থেকে অধিক শক্তিশালী হবে; (২) একজনের মূল্য বিচারে পথপ্রদর্শক হবে, আদর্শনিষ্ঠ হবে; (৩) কোনও বিশেষ ধরনের কর্মানুষ্ঠানে প্রণোদনা দেবে; এবং (৪) কোনও এক ধরনের সংগতি এই সব ভাবনা তথা কর্মের মধ্যে থাকবে। এই প্রসঙ্গে টেরি ইগলটনের কথা না বললেই নয়। তিনি মতাদর্শের বেশ কয়েকটি পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। নীচের কয়েকটি তাদের অন্তর্ভুক্ত:

(১) আমাদের সমাজজীবনে অর্থ, সংকেত ও মূল‍্য উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া;

(২) কোনও এক সামাজিক গোষ্ঠির পরিচয়-জ্ঞাপক ধারণাগুচ্ছ;

(৩) এমন ভাবনাগুচ্ছ যা প্রভুত্বকারী রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বৈধতাদানে সাহায্য করে;

(৪) এমন ভ্রান্ত ধারণাগুচ্ছ যা প্রভুত্বকারী রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বৈধতাদানে সাহায্য করে;

(৫) তন্ত্রবদ্ধ তথা সুচারুভাবে, মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে মিথ্যা তথা অর্ধ-সত্যের প্রচার করে;

(৬) ইহা সামাজিক তথা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য গঠন করা ধারণাগুচ্ছ;

(৭) এমন প্রক্রিয়া যা আমাদের সম্পর্ক-গুলিকে সামাজিক কাঠামোয় রূপান্তরিত করতে চায়।

(৮) এমন এক অবিচ্ছেদ্য মাধ্যম যার মধ্য দিয়েই ব‍্যক্তিকে বাঁচাতে হয়। (আলথুজের তো বলেই দিয়েছেন, আমরা মতাদর্শের কোলেই জন্মলাভ করি!)

(৯) এ-এক পূর্বে-স্থির-করা কর্মে প্রবৃত্তকারী বিশ্বাসগুচ্ছ।

(১০) ঘটনা বা বিষয়রাজিকে তাদের তৈরি পরিভাষার মধ্যেই ইহা বুঝতে ও বোঝাতে চায়।

পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন, লুই আলথুজের আমাদের কল্পিত সত্তা বা সত্তার ধারণাকে বাস্তব বলে বিশ্বাস করার প্রকরণকে মতাদর্শ বলেছেন। তিনি যে ‘interpellation’ এর কথা বলেছেন তা আসলে সেই প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে আমরা সামাজিকভাবে বেড়ে উঠি। এই প্রক্রিয়ায় অর্ধসত‍্য ও মিথ‍্যা মিলে মিশে আমাদের মধ্যে এমন এক বিশ্বাসের জন্ম দেয় যাতে সত্যিই মনে হয় ভারতে “হিন্দু খতরে মে হ‍্যাঁয়”, ঠিক যেমন এখন বাংলাদেশ মানে “ইসলাম খতরে মে হ‍্যাঁয়”! অন‍্যত্র তিনি এরূপ বলতেও পিছপা হননি: ‘‘Man is an ideological animal by nature’’ আর মার্কিন দার্শনিক এরিক হোফার একটি বিশেষ মতাদর্শের সমর্থকদের একাত্মকারী কয়েকটি প্রকরণের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন: টার্গেট গ্রুপের প্রতি কারণে-অকারণে ঘৃণা, নির্বিচার অনুকরণ, জোর-জবরদস্তি খাটানো, ভাবাদর্শের নির্দিষ্ট পরিকল্পনার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অ্যাকশানে নেমে পড়া, অবিশ্বাসের আবহ সৃষ্টি এবং উপযুক্ত নেতৃত্বকে সামনে আনা যে এইসব উপাদানের প্রতিমূর্তি হয়ে জনগণকে ঐ নির্দিষ্ট বিশ্বাসে নির্বিচারে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে। স‍্যালি হ‍্যাসলাঙ্গের সুন্দর বলেছেন: “The function of ideology is to stabilize and perpetute dominance through masking or illusion.”

প্রসঙ্গক্রমে মতাদর্শ ও তত্ত্ব (theory)-এর পার্থক্যের বিষয়টিও মনে রাখা চাই। মতাদর্শে আদর্শ কথাটি আছে বটে, কিন্তু ইহা আরও বড়ো মাপের জটিল বিশ্বাসগুচ্ছকে বোঝায়, যার কথা বিভিন্নভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। অন‍্য দিকে, তত্ত্ব হল কোনও এক বিশেষ ধরনের বিষয় বা ঘটনা-শৃঙ্খলের যুক্তি ও তথ্যনির্ভর ব‍্যাখ‍্যান, যেমন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের তত্ত্ব। পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ রূপ সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তিশীল বলে তত্ত্বকে প্রায়শই বৈজ্ঞানিক বলা হয়। বিপরীতে মতাদর্শের মধ্যে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকে না বলেই তা বিতর্কিত, সমস্যা-সংকুল।

দুই

এবার আসি মৌলবাদ (fundamentalism)-এর কথায়। মৌলবাদ বলতে মূল বিষয়কে আক্ষরিকভাবে গ্রহণ করে তার অনুশীলনকে বোঝায়। ধর্মীয় গ্রন্থ-মূলকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে ব‍্যক্তি তথা সমাজ-জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার যে যাজকতন্ত্র তাই-ই মৌলবাদের প্রথম প্রকাশ। যদিও পরবর্তী কালে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক তথা অর্থনৈতিক– ইত‍্যাদি নানা কিসিমের মৌলবাদের কথা উঠেছে, তথাপি মূলগত বিচারে এবং ঐতিহাসিকভাবে ধর্মীয় মৌলবাদই মডেল হিসেবে পিছনে থেকেছে। মৌলবাদ বিষয়-মূলে নির্বিচারে আস্থা রাখে, তাকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে মানে। তাই এক অর্থে মৌলবাদকে কখনও সমর্থনযোগ্য মনে হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হল, পরবর্তী অভিজ্ঞতা, নূতন তথ্য-প্রমাণ, যুক্তি তথা মানবতার আলোকে কোনোরূপ পরিবর্তনের সুযোগ দিতে রাজি নয় এই বিচার-ধারা। মূলকে আক্ষরিকভাবে, যান্ত্রিকভাবে গ্রহণ করে সবকিছু মেনে চলতে জোরাজুরি করে। স্থান-কাল-পাত্রকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে নিজেকে অভ্রান্ত, কখনও-বা অপৌরুষেয় ভাবতে থাকে। মূল-বিষয় ভাবনার স্বাভিমান যুক্তিহীন জনতার আবেগমথিত হয়ে, আরও সংবদ্ধ হয়ে, কখনও কখনও তা সর্বগ্রাসী হয়ে উঠে।

মৌলবাদের উৎপত্তিসূত্র বুঝতে একটু লিখিত ইতিহাসের সাহায্য নেওয়া যাক। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে (১৯১০-১৫) অজ্ঞাতনামা লেখকদের বারো খণ্ডের “দ‍্য ফান্ডামেন্টালস” শিরোনামে একটি বাইবেল-ভিত্তিক খ্রিস্ট-সাহিত্য প্রকাশিত হয়। এই সময়কাল থেকে প্রিণ্ট মিডিয়া “মৌলবাদ” পরিভাষাটি প্রথম ব‍্যবহার করে উত্তর অ্যামেরিকার প্রোটেস্টান্ট গোষ্ঠীদের বোঝাতে। এঁরা বাইবেলের উদার ব‍্যাখ‍্যার প্রস্তাব আনে। আর এতে বিচলিত হয়ে গোঁড়া সংরক্ষণবাদীরা খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের কুমারী মাতৃত্ব (the Virgin birth) তথা জিশুর দৈহিক পুনরুত্থান (the Resurrection) সহ বেশ কয়েকটি বিশ্বাসকে মৌলিক বলে জোরের সাথে প্রচার করতে থাকেন। তাঁরা তাঁদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের কোনও ব‍্যাখ‍্যারই প্রয়োজন অনুভব করেননি, কেননা তাঁরা মনে করতেন, এসবের অর্থ আক্ষরিক, স্বয়ংপ্রকাশ। তাই কোনও ভিন্ন মত সামনে এলে এঁরা সহনশীলতার সব সীমা অতিক্রম করে যেতেও পিছপা হন না। সমস্যা ঠিক এখানেই। তাই আমাদের পুনরাবলোকন।

সমাজবিজ্ঞানী টি. এন. মদন বলেন, মৌলবাদীরা নিজেদের স্থির করা যে কোনও বিচারধারা, আদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গিকে একমাত্র সত্য বলে মনে করে, বাকি সব কিছুকে সরাসরি অস্বীকার করে। তবে সব মৌলবাদ হুবহু এক হয় না, নতুন নতুন কলেবরে নিজেকে প্রকাশ করে। কখনও বা বিভ্রম-সৃষ্টিকারী আড়ালের সাহায্য নিয়ে পিছনে থেকে কাজ করে যেতে থাকে। তবে তাদের মধ্যে অবশ্যই এক পারিবারিক সাদৃশ্য থাকে। কিছু বৈশিষ্ট্য অবশ্যই আমরা খুঁজে পেতে পারি যার মধ্য দিয়ে দৃষ্টিপাত করলে মৌলবাদকে চেনা যায়। যেমন, যদিও শেষমেষ এটি এক সমষ্টিগত বিষয়, তথাপি ক‍্যারিশম‍্যাটিক নেতা ছাড়া এর বাস্তবায়ন আমরা সাধারণভাবে দেখি না। ইরানে বিগত শতকের আটের দশকে আয়োতোল্লা খোমৈনী, শিখদের সন্ত ভিন্দ্রানওয়ালে– এঁদের বাদ দিয়ে সংশ্লিষ্ট মৌলবাদকে আমরা পাই কই! তবে নেতারা সব সময় ধর্ম-জগত থেকে উঠে আসবেন এমনটা নাও হতে পারে। ভারতীয় উপমহাদেশে মহম্মদ আলি জিন্নাহ কিন্তু সেরূপ ধর্মপ্রাণ ছিলেন না, ধর্ম-জগত থেকেও আবির্ভূত হননি। আবার জামাত-ই-ইসলামি-র প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা মৌদুদি ছিলেন সাংবাদিক, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-এর প্রতিষ্ঠাতা কে বি হেগওয়াড় ডাক্তার ছিলেন। দ্বিতীয়ত, আবেগ-সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে, অর্ধ-সত্য, কখনও বা মিথ্যাকে এই প্রকরণ সত‍্য বলে গোয়েবেলসীয় প্রচার স্বল্প-শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করে। জনগণের চেতনার স্তর, বিশেষ করে যুক্তিবুদ্ধি ও বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব, বিকল্প স্বচ্ছ, প্রগতিশীল বিচারধারার অনুপস্থিতি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত, হতাশা ইত্যাদি মৌলবাদের অগ্রগমনে অনুঘটকের কাজ করে।  

আগেই বলা হয়েছে, মৌলবাদ নানা কিসিমের হতে পারে। আর্চবিশপ অফ ওয়েলস একপেশে শূন্যবাদী নাস্তিকতা (atheism)-কেও মৌলবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, বলেছেন খ্রিস্টীয়, নাস্তিক বা ইসলামি, যেকোনও প্রকারেরই হোক না কেন মৌলবাদ প্রায়শই বিপজ্জনক‌ হয়ে থাকে। ফ্রান্সে শিরস্ত্রাণ পরিধান সরকারি বিদ‍্যালয়ে ব‍্যান করা ‌বা আমেরিকায় হিজাব পরার বিরোধিতা করাও মৌলবাদের নামান্তর! কেউ কেউ এ ধরনের বাড়াবাড়িকে সেকুলার ফান্ডামেন্টালিজমও বলে থাকেন। আবার অর্থনীতিতে ‘মার্কেট ফান্ডামেন্টালিজমের’ কথাও উঠেছে: বাজার-মৌলবাদের ভাবনায়, মুক্ত বাজারের পুঁজিবাদ বা আজকের ক্রোনি পুঁজিবাদও আর একধরনের মৌলবাদ। অর্থনীতিবিদ জন কুইগ্গিন (John Quiggin) বলছেন, বাজার-অর্থনীতির বাইরে গিয়ে কিছু প্রস্তাব করলেই অবাস্তব নির্বিচার দাবি বলে উড়িয়ে দেওয়া হয় কখনও কখনও! প্রস্তাবককে সত্যিকারের অর্থনীতির মানুষ বলেই স্বীকার না করার এই গোঁড়ামিই অর্থনীতির মৌলবাদ। অনুরূপ সাংস্কৃতিক মৌলবাদের চরম বিকৃত প্রকাশ আমরা লক্ষ করেছি হিটলারের জার্মান স্বাজাত‍্যভিমানে। আবার ইম‍্যানুয়েল কান্টের মতো যাঁরা নীতি-নৈতিকতাকে ‘হয় সাদা, নয়তো কালো’ পদ্ধতিতে বিচার করেন তাঁরাও মৌলবাদী অন‍্য এক অর্থে। স্থান-কাল-পাত্রের বিশেষত্বকে একেবারে বাতিল করে কেবল ‘ক‍্যাটিগোরিক‍্যাল ইম্পারেটিভে’-র ভাষায় নৈতিকতাকে সংজ্ঞায়িত করাকে নৈতিক মৌলবাদ বলাই যায়!

অনেকে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে অভিন্ন মনে করেন। তা কিন্তু ঠিক নয়। সাম্প্রদায়িকতা এমন এক ভাবাদর্শ যা ধর্ম, সংস্কৃতি বা মূল্যবোধের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিভেদ সৃষ্টি করে। যদিও উভয়ই ধর্মকে ব‍্যবহার করে, তথাপি এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। যেমন: (১) মৌলবাদের লক্ষ্য প্রাচীনপন্থী ধর্মীয় গোঁড়ামিকে শক্তিশালী করা এবং এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতার আধিপত্য কায়েম করা। অন‍্যদিকে, সাম্প্রদায়িকতা ধর্মীয় আবেগকে সেক‍্যুলার লক্ষ্য হাসিল করতেও ব‍্যবহার করতে পারে। (২) পদ্ধতি হিসেবে সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত আচার-বিচারকে মানতে জোরাজুরি করে মৌলবাদ। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ধর্মীয় পরিচয়কে রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের জন‍্যই ব‍্যবহার করে। (৩) বিশ্ববীক্ষার প্রশ্নে ধর্মীয় ধ‍্যান-ধারণা অনুযায়ী সমাজকে গঠন করতে চায় মৌলবাদ। সাম্প্রদায়িকতা কিন্তু সবসময় ধর্মীয় আচার-বিচার-অনুষ্ঠানকে কঠোরভাবে মেনে চলে না, চলতে কাউকে বাধ‍্যও করে না। তাঁরা চায় ক্ষমতা।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, মৌলবাদকে যদিও প্রায়শই নঞর্থক দৃষ্টিতে দেখা হয় তথাপি এর কয়েকটি সদর্থক দিকের কথাও বলেছেন রোডেরিক হিন্ডেরি (Roderick Hindery)। অনেক সময় হাজার কথার ফুলঝুরিতে কোনও ফল ফলে না। তখন রাশি রাশি অভিমতের দোদুল্যমানতা ও তজ্জনিত হতাশা কাটিয়ে একটা এসপার-ওসপার করতে প্রাণশক্তি জোগায় এই মৌলবাদ। তিনি “vitality, enthusiasm, willingness to back up words with actions, and the avoidance of facile compromise”-এর কথা বলেছেন।

তিন

এবার আমরা মূল আলোচ‍্য মতাদর্শিক মৌলবাদে আসতে পারি। আগের আলোচনা থেকেই স্পষ্ট মতাদর্শিক মৌলবাদের ক্ষেত্র অনেক। সীমিত পরিসরের কথা মাথায় রেখে আমি এখানে মৌলবাদের দৃষ্টান্তস্থল হিসেবে আমরা সোভিয়েত মার্কসবাদের বিচার-বিশ্লেষণ করব, কেননা অনেকেই মার্কসবাদের বিরুদ্ধে না হলেও, বিশেষ করে সোভিয়েতবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত মৌলবাদের অভিযোগ তুলেছেন।

বলা বাহুল্য, কার্ল মার্কস তাঁর তথ‍্যনিষ্ঠ গবেষণার মাধ্যমে সমাজ-পরিবর্তনের মূল নীতি-সূত্রগুলি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। এ কাজ করতে গিয়ে একই সঙ্গে তিনি তৎকালীন পুঁজিবাদের উত্থান ও বিকাশ-পর্বকে নির্মোহ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে তার থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের এক নির্দিষ্ট রূপরেখা দিয়েছেন। আবার তাকেও অতিক্রম করে শেষে আমাদের কমিউনিজমে উত্তরণের পূর্বাভাস দিয়েছেন, যেখানে পৌঁছুলে সব ধরনের বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তি আসবে বলে তিনি বিশ্বাস ব‍্যক্ত করেছেন। অন্তত দু-টি বিষয় এখানে নজর করার মতো: রাজনৈতিক অর্থনীতি যে সমাজের মূল চালিকাশক্তি তা তিনি আমাদের শিখিয়েছেন। আর তিনি দর্শনকে নিজের পায়ে সঠিক পথে চলতে শিখিয়েছেন। যাই হোক, এসব বৌদ্ধিক চর্চায় সঙ্গে তিনি পেয়েছিলেন অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু ফ্রেডরিক এঙ্গেলসকে। দু-জন ভিন্ন ব‍্যক্তি হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে ছোটখাটো ব‍্যাপারে কিঞ্চিৎ মতপার্থক্য থাকলেও মূল বিচার-বিশ্লেষণে একমত। তাই আমরা মার্কস-এঙ্গেলস একসাথে উচ্চারণ করি।

যাই হোক, মার্কসের মৃত্যুর পর প্রথম ‘মার্কসবাদ’ শব্দটি ব্যবহার শুরু হয়। পরবর্তীকালে লেনিন মার্কসবাদের ব্যাপক ব্যবহার শুরু করেন। ‘সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল’-এর পর থেকে মার্কসবাদকে এক সংহত ও স্বয়ংসম্পূর্ণ তাত্ত্বিক চেহারা দেওয়া শুরু হয়। গেয়র্গি প্লেখানভ ১৮৯৪ সালে মার্কসবাদকে ‘একটি সামগ্রিক বিশ্ববীক্ষা’ রূপে উল্লেখ করেন। এই সোভিয়েত তথা সরকারি মার্কসবাদের বিরুদ্ধেই মূলত মৌলবাদের অভিযোগ উঠেছে।

মার্কস-এঙ্গেলসের এই বিচার-ধারাকে ভিত্তি করে লেনিন তার বাস্তবায়ন করেছেন নিজেদের বোধবুদ্ধি মোতাবেক। মার্কসীয় তত্ত্বের অনুশীলনের এই প্রাক্সিস কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লব সংঘটিত করেছে, পৃথিবীর বুকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-কাঠামোর জন্ম দিয়েছে। এই দৃষ্টান্ত পরবর্তীতে চিন, কিউবা সহ বিভিন্ন দেশে পুঁজিবাদের জাল ছিন্ন করে মানবমুক্তির নতুন পথ দেখিয়েছে। নভেম্বর বিপ্লবের বিজয় ও সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম যেমন বিশ্ববাসীর সামনে সম্পূর্ণ নতুন দিগন্ত খুলে দেয়, তেমনি এই সূত্রেই তন্ত্রবদ্ধ “সোভিয়েত মার্কসবাদ” আমাদের সামনে আসে। বলশেভিক নেতৃত্ব তথা সোভিয়েত সরকার মার্কসবাদকে কোডিফাই করে তাদের মতো করে বিশ্বে প্রচার করেছে, এবং আমরা “অফিসিয়াল” এই মার্কসবাদকে একমাত্র ধ্রুব সত্য বলে মেনে নিয়েছি। মার্কস-এঙ্গেলসের যেসব অনুসন্ধান ও রচনাকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে সেগুলিকেই তারা সামনে এনেছে, এবং কমিউনিষ্ট ইন্টারন‍্যাশালের মাধ্যমে সারা বিশ্বে প্রচার করেছে। মার্কসবাদকে বিজ্ঞান হিসেবে আমরা পেয়েছি। কিন্তু এই অফিসিয়াল মার্কসবাদের যে তাত্ত্বিক কাঠামো তা ক্রমশ তাকে বদ্ধতন্ত্রে পরিণত করেছে, বিজ্ঞানের খোলা-মুখ (open-endedness/tentativeness) প্রকরণটি গুরুত্ব হারিয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে মার্কসবাদের মতাদর্শ ক্রমশ মৌলবাদের দিকে এগিয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

আমরা জানি, প্রচলিত মতাদর্শগুলিকে মার্কস ‘ফল্‌স্‌ কনসাসনেস’ বলেছেন। প্রকৃত বস্তুবাদী দর্শনের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে তিনি রাজনৈতিক অর্থনীতিকে সবকিছুর ভিত্তি (base) বলেছেন, আর আমাদের চেতনা ও তদ্গত যাবতীয় বিচার-আচারকে উপরিকাঠামো (superstructure) বলেছেন, যার মধ্যে ধর্ম, সংস্কৃতি, অধ‍্যাত্ম‍্য-ভাবনা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। যদিও মার্কস উপরিকাঠামোর কিছুটা স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করেছেন, তথাপি অর্থনীতিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে এই সোভিয়েত মার্কসবাদ।

আমাদের এই বিচার-মঞ্চে ফরাসি মার্কসবাদী আলথুজের ও ইতালীয় মার্কসবাদী গ্রামশির কথা প্রথমেই আসে। এঁনারা উপরিকাঠামোর উপর সমধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এবং সোভিয়েত-মার্কসবাদের বাইরে গিয়ে কথা বলার জন‍্য এঁরা বিতর্কিত হয়ে গেছেন, কারণে-অকারণে সমালোচিত হয়েছেন বার বার। যদিও পদ্ধতিগত দিক থেকে আলথুজের ও গ্রামশি দু-জন ভিন্ন পথের পথিক, তথাপি জনগণের সম্মতি অর্জনের ব‍্যাপারে উপরিকাঠামোর অবদানকে আরও গভীরে বোঝা দরকার। আলথুজের তো মনে করেন, আজন্ম আমরা নানা ধরনের মতাদর্শের শিকার। বাড়ির পরিবেশ, ক্লাব, শিক্ষাঙ্গন, পুলিশ-প্রশাসন এসবের মধ্যে দিয়েই আমাদের চেতনা বিকশিত হয়, এসব মতাদর্শিক ধ‍্যানধারণার মধ্য দিয়েই তা আমাদের মধ্যে ধীরে ধীরে অনুপ্রবেশ করে, চিন্তা চেতনার মজ্জায় গেঁথে যায়, আলথুজেরের ভাষায়, “interpellate” করে।

আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জীবনের শেষের দিকে, বিংশ শতকের আটের-নয়ের দশকে প্রকাশিত তাঁর “Philosophy of the Encounter” প্রবন্ধটি। মৌলবাদকে প্রশ্রয়দানকারী যাবতীয় এক্সক্লুসিভ বাইনারির বিরোধিতা করেন। চিন্তা-জগতের বিকাশকে বস্তুবাদ-ভাববাদের বাইনারিতে বোঝার বিরোধিতা করেন তিনি। তিনি বলতে শুরু করেন, কোনও দর্শনকে একেবারে ভাববাদী বলা, বা কোনও বিচারধারাকে সম্পূর্ণ বস্তুবাদী বলা যথোচিত নয়। ভাববাদের মধ্যেও কিছু বস্তুবাদী উপাদান বা প্রবণতা (tendencies) থাকতে পারে, যা সোভিয়েত মার্কসবাদীর বুঝতে পারেনি। সোভিয়েতবাদের এই বহির্ভূক্তিবাদই মতাদর্শগত মৌলবাদের জন্ম দিয়েছে। যদিও নাৎসিবাদ ও সোভিয়েত মার্কসবাদ এই দুই মতাদর্শ তুলনীয় নয়, ঠিক যেমন হিটলার ও স্তালিনকে একাসনে বসানো যায় না, তথাপি কাঠামোগতভাবে তারা কাছাকাছি বলে অনেক সমালোচনা করেছেন। অনেকে বলেন, মার্কসবাদ সবকিছুর সম্পূর্ণ ব‍্যাখ‍্যান, গ্রাণ্ড ন‍্যারেটিভ– এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে এর বৈজ্ঞানিক চরিত্র তথা খোলা-মুখ প্রকরণটিকে গুরুত্ব দিতে হবে, এবং মার্কসবাদের চর্চা ও অনুশীলনকে যুগোপযোগী করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বর্তমানে মার্কস-এঙ্গেলসের সম্পূর্ণ রচনাবলির যে আনএডিটেড Marx-Engels-Gesamteausgabe [MEGA] ভ‍্যলুমগুলি প্রকাশিত হচ্ছে তাতে নজর রাখলেই বোঝা যায় মার্কসবাদ কোনও বদ্ধতন্ত্র নয়, এর মধ্যে অনেক বিচিত্রধর্মী বিচার-বিশ্লেষণ, পদ্ধতিগত উপাদান আছে যা একদিকে আমাদের কথিত মৌলবাদ থেকে উদ্ধার করতে পারে, অন‍্যদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন প্রাক্সিসের সন্ধান দিতে পারে। 

প্রসঙ্গত আর একটি কথা না তুললে এই পর্যালোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তিনি হলেন ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা, যিনি ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে সাবেক সোভিয়েতের পতনের ঠিক পরের বছরই ‘দ্য এন্ড অফ হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ লিখে সমাজ-পরিবর্তনের পথের “শেষ দাঁড়ি” টেনে দিয়ে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের চূড়ান্ত জয় ও চির-স্থিতির ‘নিদান’ হেঁকে দিলেন! অবশ্য জ্যাক দেরিদা, নোয়াম চমস্কি, স্লাভক জিজেক প্রমুখ চিন্তকদের সমালোচনা ও দক্ষিণ আমেরিকার নূতন নূতন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং পশ্চাদ্‌পদ মৌলবাদের দৌরাত্ম্য তাঁকে বাধ্য করেছে শেষ নিদান ফিরিয়ে নিতে। এঁরা কম্যুনিজম-বিরোধী প্রচার-দলের সদস্য, এঁরা মার্কসবাদের পদ্ধতি-প্রকরণ জেনে-বুঝে, বা না বুঝে উদ্দেশ্য-প্রণোদিত হয়ে এসব কথা বলছেন– একথা মেনে নিয়েও আমার দুটো কথা বলার আছে: ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র আজকের মানুষের কাছে স্বতঃসত্য, তাই এই প্রকরণগুলিকে কীভাবে মার্কসবাদে পুনঃস্থাপিত করা যায় তা দেখতে হবে। বাজারের ভূমিকাকে একবারে বাদ দিলে চলবে না। কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রেখেই বাজারকে উন্মুক্ত রাখলে ব্যক্তিগত সৃজনশীলতাকে আর একটু স্বীকৃতি জানানো যায় না কি?

পরিশেষে বলি, মৌলবাদের অভিযোগ থেকে মার্কসবাদকে মুক্ত করতে হলে একে নিছক বদ্ধতন্ত্র হিসেবে না দেখে অন্তর্ভুক্তিবাদ (inclusivism)-এর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে  হবে।১০ বিশেষ করে, জাত-পাত ও পরিচিতি প্রশ্নে শতধা-বিভক্ত ভারতীয় সমাজে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি শ্রেণি-ধারণার সঙ্গে মেলানোর প্রশ্ন রয়েছে। তবে তা করতে গিয়ে মার্কসবাদের মূল উদ্দেশ্য-লক্ষ্য সম্পর্কে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়লেও কিন্তু চলবে না। আর কর্মসূচির স্থির করতে গিয়ে আজকের পুঁজিবাদের বিশ্বায়িত চরিত্রকে মাথায় রাখতে হবে।

পরিশেষে বলি, মার্কস-এঙ্গেলসের যে সব লেখাপত্র সাবেকি সোভিয়েত ইউনিয়নের মূলত সরকারি সৌজন্যে প্রকাশিত হয়েছে তা ‘নির্বাচিত’ রচনাবলি মাত্র। সাম্প্রতিক কালে MEGA গবেষণা-প্রকল্প এই প্রথম ১১৪ খণ্ডে তাঁদের সমগ্র রচনাবলি প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে (যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক প্রকাশিত হয়েছে)। আমরা আশা করছি, তাঁদের সব লেখাপত্র (ঠিক যেমন ঠিক সেভাবে) প্রকাশ পেলে মার্কসবাদের আরও নূতন নূতন দিগন্ত খুলে যাবে, অনেক না-পাওয়া উত্তরও হয়তো পাওয়া যাবে, মৌলবাদের অভিযোগও তখন গুরুত্ব হারাবে। 

উল্লেখপঞ্জি :

১. এম. হ‍্যামিলটন. ‘পোলেটিক‍্যাল স্টাডিজ’. ৩৫ (১), পৃ. ৩৭

২. উইলার্ড এ. মুল্লিনস. ‘অন দ‍্য কনসেপ্ট অফ আইডিওলজি ইন পোলোটিক‍্যাল সায়েন্স’. অ্যামেরিকান পোলোটিক‍্যাল সায়েন্স রিভিউ, ৬৬ (২), পৃ. ৪৯৮-৫১০

৩. টেরি ইগলটন. ‘আইডিওলজি: অ্যান ইন্ট্রোডাকশেন’. লন্ডন: ভার্সো, ১৯৯১, পৃ.১

৪. লুই আলথুজের. ‘আইডিওলজি অ্যান্ড আইডিওলজিক‍্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস’. ১৯৭০.

৫. এরিক হোফার. ‘দ‍্য ট্রু বিলিভার’. অধ‍্যায় ১৫. নিউ ইয়র্ক: হারপার-কলিন্স, ১৯৫১

৬. স‍্যালি হাসলাঙ্গের: ‘কালচার অ্যান্ড ক্রিটিক’. স‍্যালি হাসলাঙ্গের ও ক্লারে চেম্বার্স এডি. ‘আইডিওলজি অ্যান্ড কালচার’. অ্যারিস্টটল সোসাইটি সাপ্লিমেন্টারি ভলিউম, ১৯০, ২০১৭, পৃ. ১৫০

৭. টি. এন. মদন. ‘মর্ডান মিথস, লকড মাইন্ডস: সেকুলারিজম অ্যান্ড ফান্ডামেন্টালিজম ইন ইন্ডিয়া’. অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস. ১৯৯৭, অধ‍্যায় ১

৮. রোডেরিক হেন্ডেরি. ‘কম্পারেটিভ এথিকস, আইডিওলজিজ অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল থট’. জার্নাল অফ রিলিজিয়াস এথিকস. ৩৬(২), পৃ.২১৫-৩১

৯. লুই আলথুজের. ‘ফিলোসফি অফ দ‍্য এনকাউন্টার: লেটার রাইটিংস ১৯৭৮-৮৭’. লন্ডন: ভার্সো, ২০০৬

১০. সন্তোষ কুমার পাল. ‘মার্কসবাদ ও তার পর্যালোচনা’. ফিলোসফি অ্যান্ড দ‍্য লাইফওয়ার্ল্ড. ভলিউম-২৬ (২০২৩-২৪), পৃ. ২৯

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান