মৌলবাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

ভবানীপ্রসাদ সাহু


Fundamentalism ও মৌলবাদের অন্যতম দু-টি আভিধানিক অর্থ হল যথাক্রমে, ‘বাইবেল বা অন্য ধর্মশাস্ত্রের বিজ্ঞানবিরুদ্ধ উক্তিতেও অন্ধবিশ্বাস’ এবং ‘ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে জাত সংকীর্ণ মতবাদ’। এ ধরনের সংজ্ঞা থেকে মৌলবাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি দিক স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, যেমন তা ধর্মের সঙ্গে (অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে) সংশ্লিষ্ট, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি তার সম্পৃক্ত দিক, এটি একটি বিজ্ঞানবিরুদ্ধ ও সংকীর্ণ চিন্তা। স্পষ্টতই মানুষের চেতনা ও সমাজের উত্তরণের বিরোধী এটি এবং যাদের মধ্যে এই অন্ধবিশ্বাস, গোঁড়ামি, বিজ্ঞানবিরুদ্ধতা ও সংকীর্ণতা দেখা যায়, তাদেরই সাধারণভাবে মৌলবাদী বলা যায়।

‘Fundamental’ কথাটিরও অর্থ ‘আদিম’ বা ‘মূল’। মৌলবাদ কথার ভাবগত অর্থ তাই মূল বা শিকড়ে ফিরে যাওয়ার তত্ত্ব। কথাটি এখন সাধারণভাবে ব্যাপক ব্যবহৃত হতে হতে একটি নিন্দাসূচক কথায় পরিণত হলেও, এই শিকড়ে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা মানুষের কমবেশি থাকেই। অ্যালেক্স হেলির বিখ্যাত বই ‘The Root’ (বাংলা অনুবাদ– ‘শেকড়ের সন্ধানে’) এই প্রবণতারই ফসল। কিন্তু তা মৌলবাদ নয়। নিজের অতীতকে জানা, নিজ ধর্মীয় বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রথমদিকের ইতিহাস জানা তথা নিজের উৎস সম্পর্কে আগ্রহ বরং একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ও মানবিক ইতিবাচক লক্ষণ। কিন্তু যখন তা তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ঐ আদিম প্রাচীন মূল দিকেই ফিরে যাওয়ার কথা অন্ধভাবে বিশ্বাস করা ও করানো হয় অর্থাৎ পরিবর্তিত পরিবেশ-পরিস্থিতি জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঐ মৌলিক আদিমতার পরিমার্জনা ও রূপান্তরকে অস্বীকার করা হয় তখন তা মৌলবাদ বা মৌলবাদী তত্ত্বে পরিণত হয়। এর সঙ্গে পরমত-অসহিষ্ণুতা, নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবা, এই তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সংকীর্ণস্বার্থ সিদ্ধি করা এবং তার জন্য অনৈতিহাসিক মিথ্যাচারের সঙ্গে হিংস্র উগ্র অন্ধ আচরণ করা– ইত্যাদিও মিশে থাকে। এটি অবশ্যই মানুষ ও তার সভ্যতার বিরোধী। এটি প্রগতি ও বিকাশের পথ রোধ করে। বাইবেল ও জিশুকে অভ্রান্ত ধরা, কোরানকে হুবহু অনুসরণ করার কথা ভাবা, হিন্দুধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ ভেবে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা– ইত্যাদি এরই ফসল। এইভাবে বিশেষ কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে কেন্দ্র করে সাধারণত মৌলবাদ তথা ধর্মীয় মৌলবাদ সৃষ্টি হলেও, কোনও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক তত্ত্ব কিংবা বিশেষ কোনও মতাদর্শে অন্ধ গোঁড়া উগ্র বিশ্বাসও মৌলবাদী মানসিকতারই বিশেষ রূপ।

আমেরিকায় প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সৃষ্টি হওয়া Fundamentalism-এর পূর্ববর্তী সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে এর কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। যেমন–

(১) এটি অবশ্যই ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্তভাবে যুক্ত। প্রাতিষ্ঠানিক একটি ধর্মে (এখানে খ্রিস্টধর্মে) বিশ্বাস তার প্রাথমিক ভিত্তি। তাকে আরও গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত করাই তার লক্ষ্য।

(২) এটি আসল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থকে (তথা মৌলিক প্রাথমিক দিকগুলিকে) অপরিবর্তনীয়, সমালোচনার ঊর্ধ্বে, সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধিকারী হিসেবে মনে করে এবং এই মনে করার মধ্যে কোনও আপস করতে সে প্রস্তুত নয়। এ কারণে তার কাজের মধ্যেও ধর্মান্ধতার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং Funda-mentalism বা মৌলবাদ নামটি এ কারণেই হয়েছে।

(৩) কোনও নতুন ধরনের বৈজ্ঞানিক চিন্তা,– তা সে বির্বতনবাদ থেকে সাম্যবাদ বা কম্যুনিজম যাই-ই হোক না কেন, যা ঐ ধর্ম তথা ধর্মগ্রন্থের ভিত্তিমূলে নাড়া দিতে চায়, তার প্রতিক্রিয়ায় তার জন্ম ও তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক কথায় যুক্তিবোধ ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করেই তার সৃষ্টি ও টিকে থাকা। এটি চূড়ান্তভাবে অবৈজ্ঞানিক ও প্রতিক্রিয়াশীল।

(৪) ধর্মীয় ক্ষেত্রেও উদারনীতি, আধুনিকতা ও ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি সহিষ্ণুতা– এ সবেরও সেটি বিরোধী। তাই ধর্মীয় সংকীর্ণতা তার কাজকর্মের মধ্যে প্রকাশ পায়।

(৫) কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সৃষ্টি তথা ধর্মীয় আন্দোলন মানুষের সমাজ-ইতিহাসের বিশেষ পর্যায়ে তার অগ্রগমন ও সংস্কারের পথ সুগম করলেও ফান্ডামেন্টালিজম-এর ক্রিয়াকাণ্ডের মধ্যে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার, এমনকি পশ্চাদ্গমনের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

এখন থেকে আড়াই হাজার বছর আগে বৌদ্ধ বা জৈনধর্মের, দু-হাজার বছর আগে খ্রিস্টধর্মের, দেড়হাজার বছর আগে ইসলাম ধর্মের বা পাঁচশো বছর আগে শিখধর্মের সৃষ্টি, এমনকি হিন্দুধর্মের মধ্যে ব্রাহ্মধর্ম, ভক্তি আন্দোলন বা বৈষ্ণবধর্ম ইত্যাদির সৃষ্টি এবং খ্রিস্টধর্মে প্রোটেস্টান্টিজমের জন্ম ইত্যাদির মধ্যে তখনকার ধর্মীয় আবিলতা, সামাজিক অবক্ষয় ও অনাচার, সামাজিক পীড়ন ও শোষণ, ইত্যাদির বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই রূপ পেয়েছিল। ঈশ্বর বিশ্বাস বা বিশেষ ধর্মীয় আধ্যাত্মিক বিশ্বাসকে অবলম্বন করে বিশেষ কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তার নেতৃত্ব দিলেও, ধর্ম ও সমাজের প্রসঙ্গে সেগুলির ইতিবাচক কিছু সংস্কারমূলক দিকও ছিল। কিন্তু বিগত শতাব্দীতে এই যে ফান্ডামেন্টালিজম নামে সংগঠিত ধর্মীয় আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যার অবশেষ এখনও আছে এবং ভারতসহ নানা দেশে ভিন্ন পরিবেশে যা মূলত একই চরিত্র নিয়ে আরও উগ্রভাবে মাথা চাড়া দিয়েছে, তার মধ্যে ঐ ধরনের কোনও ইতিবাচক দিক আবিষ্কার করা দুরূহ। বরং তা প্রগতিশীল সংস্কারইচ্ছার বা বৈপ্লবিক প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে তার প্রতিক্রিয়াতেই জন্মলাভ করেছে।

(৬) দ্বিধাহীন বিশ্বাস ও প্রশ্নহীন আনুগত্য তথা চূড়ান্ত কর্তৃত্ববাদ তার অন্যতম সম্পৃক্ত দিক। প্রাচীন ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মগ্রন্থগুলিকে নিজেরা তো প্রশ্ন করেই না, অন্য কেউ তার চেষ্টা করলেও তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য করতে থাকে। কেন পরিবর্তিত পরিবেশ পরিস্থিতি ও উন্নততর জ্ঞানের আলোয় তাদের বিচার করা যাবে না, ‘পাপ’ করলে ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নামক কিছু মনগড়া ধর্মীয় অনুষ্ঠান করলে সব অপরাধ থেকে মুক্ত হওয়া যায় কিনা, কোনও মেয়ে ‘কুমারী’ থাকলেও বাচ্চার জন্ম দিতে পারে কিনা, অলৌকিক ক্ষমতা বলে কিছু আছে কিনা, শীঘ্রই জিশুর আবার আসা সম্ভব কিনা এবং যুগান্তে জিশুর পুনরভ্যুত্থান হওয়াও আদৌ সম্ভব কিনা– এ জাতীয় প্রশ্ন করার মানসিকতাই Fundamentalist-দের ছিল না। আর এদের মধ্যে একটি তো, অর্থাৎ জিশুর শীঘ্রই মর্ত্যে আবির্ভূত হয়ে মানবজাতিকে উদ্ধার করার বিশ্বাসটিতো, ইতিমধ্যে ভুলই প্রমাণিত হয়েছে; প্রায় দেড়শো বছর কেটে গেল, ‘তিনি’ আর এলেন না।

(৭) এটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণিবিভাজন ও বৈষম্য, নারী-পুরুষ দ্বন্দ্ব তথা পুরুষ আধিপত্য ইত্যাদিকে অস্বীকার করে। কৃত্রিম ধর্মই তার প্রধান বিবেচ্য। এ ক্ষেত্রে একই ধর্মমতাবলম্বী বিভিন্ন ব্যক্তিদের সে পারস্পরিক সুহৃদ বলে ভাবতে শেখায়, যদিও তাদের মধ্যে বৈষম্য ও শাসক-শাসিতের বিভাজন রয়েছে। এই বৈষম্য ও বিভাজনকে দূর করা দূরে থাক, তাকে কমিয়ে তোলার আন্দোলনেরও সে বিরোধী। এরই একটি বহিঃপ্রকাশ ঘটে কট্টর কম্যুনিজম-বিরোধিতার মধ্যে। সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানোর মতো নানা পদক্ষেপ নিয়ে সে শাসকশ্রেণির হাতকে শক্তও করতে চায়। সব মিলিয়ে ফান্ডামেন্টালিজম হচ্ছে শাসক শ্রেণির স্বার্থবাহী, জনস্বার্থবিরোধী, পুরুষ আধিপত্যকামী একটি মতবাদ।

(৮) আমেরিকার Fundamentalist-দের আর-একটি দিকও গুরুত্বপূর্ণ যে, তারা তাদের কাজকর্ম বা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা বা রাষ্ট্রযন্ত্রের শীর্ষে বসার চেষ্টা করেনি। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ও রাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা তারা অবশ্যই করেছে (প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানো বা কঠোর কমিউনিস্ট-বিরোধী বৈদেশিক নীতির জন্য আন্দোলন করার মতো কাজকর্মের মধ্যে), কিন্তু তাদের নীতি ও বিশ্বাস অনুযায়ী নিজেরা নেতৃত্ব দখল করে সমগ্র রাষ্ট্রকে পরিচালিত করা, কিংবা খ্রিস্টান বা ফান্ডামেন্টালিস্ট রাষ্ট্র গড়ে তোলা– এমন আশা বা দাবি তারা করেনি, অন্তত তা ততটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি।

আমেরিকার ফান্ডামেন্টালিস্টদের এই সব বৈশিষ্ট্য– বিশেষত প্রথম সাতটি চারিত্রিক দিক যাদের মধ্যে দেখা যায়, তাদেরই সাধারণভাবে মৌলবাদী হিসেবে এবং এ ধরনের মানসিক ও তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াকে মৌলবাদ হিসেবে অভিহিত করা যায়। সাংগঠনিকভাবে ব্যাপারটি মূলত ধর্মীয় পরিমণ্ডলে সীমিত থাকলেও, ব্যাপকতর অর্থে এই ধরনের মানসিকতাকেই মৌলবাদী মানসিকতা বলা যায়। সব সময় তা যে ধর্ম ও ঈশ্বর-বিশ্বাসের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে বা থাকছে, তার কোনও মানে নেই। রাজনৈতিক মতাদর্শগত ক্ষেত্রেও এই মানসিকতার প্রসার ঘটতে পারে এবং তা ঘটেছেও। এমন কি মার্কসবাদ নামক যে দার্শনিক চিন্তা চূড়ান্ত অর্থে ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তাকে ও বাস্তব অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সব কিছু বিচার করার কথা বলে, ঐ মার্কসবাদকে সামনে খাড়া করে রেখেও এমন মৌলবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। সহজভাবে বললে ব্যাপকতর অর্থে এইভাবে মৌলবাদকে দু-টি মোটা দাগে ভাগ করা যায়– ধর্মীয় মৌলবাদ ও রাজনৈতিক মৌলবাদ।

এখনকার ধর্মীয় মৌলবাদ সম্পর্কে আরও কিছু কথা বলার আগে অন্যান্য কয়েকটি প্রাসঙ্গিক দিকেরও উল্লেখ করা দরকার। সম্প্রতি যাদের মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে (যেমন আন্তর্জাতিক খ্রিস্টীয় বা ইসলামি মৌলবাদীরা কিংবা ভারতের হিন্দু মৌলবাদীরা) তাদের ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্যও সৃষ্টি হয়েছে, যেমন–

(১) বর্তমানে এটি আরও জঙ্গি ও হিংস্র। আমেরিকার ঐ ফান্ডামেন্টালিস্টরা নিজেরা প্রত্যক্ষভাবে দাঙ্গার জন্ম দিয়েছে, মানুষ খুন করেছে বা শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে– এমনটি নয়। অবশ্য তাদের একেবারে নিরীহ ভাবারও কারণ নেই, কারণ আমেরিকায় ম্যাকার্থিবাদের সৃষ্টিতে এবং বিপুল সংখ্যক কমিউনিস্ট নিধনে তাদের পরোক্ষ ভূমিকা ও উৎসাহ ছিলই। তবু তা ঘটেছে তাদের সৃষ্টির পরবর্তী পর্যায়ে। শুরুর দিকে ধর্মরক্ষা ও ধর্মবিরোধী বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াই ছিল প্রধান দিক। কিন্তু এখনকার হিন্দু-মুসলিম ইত্যাদি ধর্মীয় মৌলবাদীরা এই ধরনের মানসিকতার সঙ্গে গুণগতভাবে উচ্চতর ও লক্ষণীয় মাত্রায় প্রত্যক্ষভাবে হিংস্রতাকেও সংযুক্ত করেছে। ১৯৭৮-এ ইরানে ইসলামি মৌলবাদীদের হাতে ৫৮ জন আমেরিকানের বন্দি থাকার উদাহরণ কিংবা আফগানি-স্থানে রুশ সামরিক উপদেষ্টাদের হত্যার ঘটনা জানা আছে। এ-ও জানা আছে যে হিরোসিমা-নাগাসাকিতে যত মানুষ বোমার আঘাতে মারা গেছিলেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ এই ভারতেই ধর্মকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছেন; তারই ধারাবাহিকতায় ‘রামরথ’ বের করে দাঙ্গার উস্কানি দিতে এই মৌলবাদীরা এখনও কোনও ইতস্তত করে না। পরিণতি জানা সত্ত্বেও অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙার উসকানি দিতে তাদের হৃদয়ে এতটুকু ভালোবাসা ও মনুষ্যত্ব জাগে না। (অযোধ্যার পরে আসছে মথুরা, বারাণসী ও আরও কয়েকশত ‘উসকানি’– অর্থাৎ হিন্দু মৌলবাদের অন্তহীন অমনুষ্যত্ব।) কোরানকে অপমানের ছুতো তুলে মুক্তমনা ব্যক্তিদের হত্যা করতে বা হত্যার ফতোয়া দিতে, কিংবা তথাকথিত নৈতিকতার সামান্য বিচ্যুতিতে নৃশংস শাস্তি দিতে, এদের হাত এতটুকু কাঁপে না।

Fundamentalism-এর ঐতিহ্যে এই ভয়াবহ মাত্রায় হিংস্রতার সংযোজন সাম্প্রতিক মৌলবাদীদের একটি বিশেষ কৃতিত্ব। এবং এক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তার যথেষ্ট মিল রয়েছে। (ফ্যাসিবাদ প্রথম দেখা দেয় ১৯১১তে ইটালিতে এবং ফ্যাসিবাদের সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব বর্তমান শতাব্দীর চতুর্থ দশকে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্যাসিবাদকে ফাইন্যান্স পুঁজির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল একনায়কতন্ত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। এদিক থেকে ধর্মীয় মৌলবাদের সঙ্গে তার কিছু তফাত হয়তো রয়েছে। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী হিংস্রতা সহ নানা দিকে তাদের মিলও প্রচুর।) 

(২) এখনকার মৌলবাদীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল তথা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা ধর্মের মূল ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র। এই ব্যক্তিগত বা শ্রেণিগত স্বার্থসিদ্ধির সংকীর্ণ মানসিকতা মৌলবাদী সংকীর্ণতাকে আরও মরিয়া, জঙ্গি ও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে। সাম্প্রদায়িক মুসলিম লিগের মৌলবাদী উত্তরাধিকারী জামাতে ইসলামি (যেমন তার বাংলাদেশি সংস্করণ) কিংবা আর এস এস-ভি এইচ পি-বিজেপি চক্র রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছে এবং বিশেষ দেশে বা রাজ্যে তারা ক্ষমতা দখল করতে ইচ্ছুক। ধর্মরক্ষার চেয়ে গদিতে বসার আকাঙ্ক্ষাই স্পষ্ট হচ্ছে, যদিও আগেও ধর্মরক্ষার নামে সিংহাসনে বসার উদাহরণ ছিলই। এখন সব ধর্মের মৌলবাদী সংস্থার মধ্যে এমন রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারটা সর্বজনীন না হলেও, Fundamentalism-এর রাজনৈতিকীকরণ সাম্প্রতিক মৌলবাদের অন্যতম একটি পার্শ্ববৈশিষ্ট্য।

তবে মৌলবাদের রাজনৈতিকীকরণ ও রাজনৈতিক মৌলবাদ– এ দু-টি ভিন্ন জিনিস। মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের তথা মানসিকতার দিক থেকে তারা অভিন্ন কিন্তু মৌলবাদের রাজনৈতিকীকরণ আসলে ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের সাম্প্রতিক আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ। আমেরিকার Fundamentalist-দের প্রধানতম কাজের ক্ষেত্র ছিল ধর্ম (এখানে খ্রিস্ট ধর্ম)। তার কিছু রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ হয়তো ছিল, কিন্তু তা ছিল গৌণ একটি দিক। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টি বা জামাতে ইসলামিদের কাজের ক্ষেত্র ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে আরও অনেক স্পষ্টভাবে ও সুনির্দিষ্টভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রসারিত; ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে পাল্লা বিচারে ধর্মের দিকে পাল্লা ভারী তো নয়ই, বরং উলটোটাই,– অন্তত সমান তো বটেই। অন্যদিকে রাজনৈতিক মৌলবাদের ক্ষেত্রে ধর্মের ব্যাপারটি নগন্য এমনকি শূন্যও হতে পারে, যেমন ‘মার্কসীয় মৌলবাদীদের’ ক্ষেত্রে। ‘মৌলবাদের রাজনৈতিকীকরণ’ কথার মধ্যে আসলে ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনৈতিকীকরণকেই বোঝানো হচ্ছে,– ধর্মীয় মৌলবাদের ক্ষেত্রে যা আগে এমনভাবে ছিল না। অন্যদিকে ‘রাজনৈতিক মৌলবাদ’ বলতে রাজনৈতিক দলের মধ্যে মৌলবাদী কিছু মানসিকতার প্রতিফলনকে বোঝানো হচ্ছে মাত্র যা কাম্য নয়। বিশেষত যাঁরা মার্কসবাদের মতো দর্শনের কথা বলেন তাঁদের ক্ষেত্রে এবং সাধারণভাবে সমস্ত ধরনের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের পরিপ্রেক্ষিতে।

‘মৌলবাদ’ কথাটি স্বাধীনভাবে এখনও শুধুমাত্র ধর্মীয় মৌলবাদকেই বোঝায়। যদি তার আগে অন্য কোনও বিশেষণ বসানো হয় তবে তা কিছু ভিন্নতর তাৎপর্য বহন করতে পারে, যেমন সাম্প্রদায়িক মৌলবাদ, রাজনৈতিক মৌলবাদ। এমনকি মৌলবাদের আরও সাধারণীকরণ করে অর্থনৈতিক মৌলবাদ, যুক্তিবাদী মৌলবাদ ইত্যাদি কথাগুলিকেও ব্যবহার করা যায়, যদি অর্থনীতি ও যুক্তিবাদের নাম করে একই রকম গোঁড়ামি, অসহিষ্ণুতা, সামাজিক ক্ষতিকর প্রভাব ইত্যাদি একই রকম ভাবে দেখা যায়।

আবার মৌলবাদ-মৌলবাদী কথাগুলি ব্যবহৃত হতে হতে অনেক সময় অনেকের দ্বারা শুধুমাত্র ‘গোঁড়ামি’ বোঝাতেই সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়। (যেমন, “শঙ্করাচার্যের ফতোয়ায় রবিবার কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে মহিলার বেদপাঠ নিষিদ্ধ হওয়ায়  স্তম্ভিত বহু সংগঠন। তাদের সম্মিলিত মঞ্চ ‘মানব সংহতি’-র তরফে আজ ক্ষোভ জানিয়ে বলা হয়েছে, এই ফতোয়া হিন্দু মৌলবাদেরই দম্ভ। বাংলার মানুষ তা মেনে নেবে না।…” আজকাল, ১৮ জানুয়ারি, ১৯৯৪)

হিন্দু, ইসলাম, খ্রিস্ট, শিখ ইত্যাদি নানা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মমতকে কেন্দ্র করে যখন মৌলবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তখন তা ধর্মীয় মৌলবাদ। এই ধরনের প্রায় সব ধর্মই ঈশ্বর নামক এক অলীক ও মানুষেরই মনগড়া শক্তিতে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ধর্মীয় মৌলবাদীরা সবাই সাধারণভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসী এটি বলাটা বাহুল্য মাত্র। তবে তাদের সবার ক্ষেত্রে এই বিশ্বাস আন্তরিক না-ও হতে পারে। যেমন ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু বা মুসলিম মৌলবাদীদের সবাই পরম ঈশ্বরভক্ত কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এদের অনেকের ক্ষেত্রেই ঈশ্বর ও ধর্মকে সামনে দাঁড় করিয়ে অর্থাৎ সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের ভুলিয়ে, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ধান্দাটিই বড়ো। এ ধরনের তথাকথিত মৌলবাদীরা আসলে প্রকৃত মৌলবাদীর মর্যাদা পাওয়ারও যোগ্য নয়, তাদের আরও নিকৃষ্টতর কোনও বিশেষণে ভূষিত করা যায় এবং উচিতও। একজন বিশুদ্ধ মৌলবাদী, তার সমস্ত সংকীর্ণতা ও প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র নিয়েও, ঐশ্বরিক শক্তিতে বিশ্বাসের ব্যাপারে অন্তত অটল। তার এই অনড় অটল বিশ্বাস বা ভক্তিই তাকে মৌলবাদী করেছে,– ঐশ্বরিক গ্রন্থের সামান্য অমর্যাদা সে সহ্য করে না বা তার ভিত্তিটাকে নাড়াতে উপক্রম যে-ই করে (কোনও মানুষ বা তত্ত্ব) তাকে সে নিজের কাছের বলে গ্রহণ করতে পারে না। তারই জন্য তার মধ্য থেকে উদারতা ও অন্যের প্রতি সহিষ্ণুতা বিনষ্ট হয়, এ কারণেই সে প্রয়োজনে নিজেকে ও নিজের সমাজকে দু-এক হাজার বছর পিছিয়ে নিয়ে যেতেও রাজি। হিন্দু মৌলবাদীরা বেদকে, মুসলিম মৌলবাদীরা কোরানকে, খ্রিস্টান মৌলবাদীরা বাইবেলকে সনাতন, অপৌরুষেয়, সমালোচনা ও পরিমার্জনার ঊর্ধ্বে সর্বোচ্চ নেতৃত্ব-দায়ী একটি ভিন্ন সত্তা হিসেবে মনে করে। কিন্তু বেদ বা কোরানকে শ্রদ্ধার সঙ্গেও হুবহু না মেনে চলা এবং তাদের সম্পর্কে সামান্য কিছুও না জানা (স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় ‘চার পুরুষ ধরে এক খণ্ড বেদও না দেখা’) ধর্মীয় মৌলবাদীর অভাব নেই। ওরা আসলে মৌলবাদের পচা ডোবায় ভেসে থাকা পচা পাতার মতো।

ধর্মীয় মৌলবাদীদের থেকে রাজনৈতিক মৌলবাদীদের একটি বড়ো তফাত এখানে যে, রাজনৈতিক মৌলবাদীরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী নাও হতে পারে, এমনকি ঈশ্বরে অবিশ্বাসী বা তথাকথিত ‘নাস্তিক’ (অন্তত বাহ্যিকভাবে) হতে পারে। ধর্মনিরপেক্ষ কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা মার্কসবাদের নাম করে, কিছু কিছু রাজনৈতিক দল বা তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে এই লক্ষণ যখন দেখা যায়, তখন ধর্মীয় মৌলবাদীদের থেকে তাদের এই পার্থক্যের দিকটি পরিষ্কার হয়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তারাও ঈশ্বরের পরিবর্তে তাদের পিতৃসুলভ তত্ত্বটিকে একই ভঙ্গিমায় একই আসনে বসায়।

‘মাকর্সবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা সত্য’– এই ধরনের পোস্টার ও প্রচার বাংলায় এখন বেশ দেখা যাচ্ছে। তথাকথিত মার্কসবাদী বা কমিউনিস্টদের মধ্যে অন্যত্রও এই মানসিকতার রকমফের দুর্লভ নয়। (যথাসম্ভব বিশ্বের নানা স্থানে মার্কসবাদ বা কম্যুনিজম ও সমাজতন্ত্রের তথাকথিত বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে আপন তত্ত্বের মাহাত্ম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার তাড়নায় তা করা হয়েছে।) মাকর্সবাদকে এইভাবে বিচ্ছিন্নভাবে ‘সর্বশক্তিমান’ হিসেবে ব্যাপক প্রচার করার বালখিল্যসুলভ (কিংবা অমার্কসীয়) প্রচেষ্টার মধ্যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরে ভক্তির দিকটিই ভিন্নভাবে পরিস্ফুট হয়। মার্কস নিজেও কখনও তাঁর নিজের ‘তত্ত্বকে’ সর্বশক্তিমান হিসেবে দাবি বা প্রচার করেছেন বলে জানা নেই। বরং যে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন তার ভিত্তি, ঐ অনুযায়ী মার্কসের তত্ত্বেরও যুগোপযোগী পরিবর্তন, বৈজ্ঞানিক পরিমার্জনা ও গোঁড়ামিযুক্ত সমালোচনা সুস্থ ও অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। এই রাজনৈতিক মৌলবাদীরা (এক্ষেত্রে আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে মার্কসীয় মৌলবাদীরা) ধর্মীয় মৌলবাদীদের মতো অন্যান্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতেও বাধ্য। তাদের ঐ মৌলবাদী চরিত্রেরই একটি বহিঃপ্রকাশ মার্কসবাদকে সর্বশক্তিমান হিসেবে প্রচার করার মধ্যে। অথবা কোনও ধরনের সমালোচনা পর্যালোচনা ও পরিমার্জনার মানসিকতা ও যোগ্যতা অর্জন না করে এবং সেগুলিকে মুক্ত মনে গ্রহণ না করার মানসিকতা নিয়ে, অন্ধভাবে নিজেদের আঁকড়ে রাখা তত্ত্বকে সর্বশক্তিমান হিসেবে গণ্য করার সঙ্গে সঙ্গে মৌলবাদী চরিত্রও তারা অর্জন করে ফেলে (একই ধরনের অন্ধবিশ্বাস, হিংস্রতা, পরমত অসহিষ্ণুতা, সংকীর্ণতা তথা অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি, মূল রাজনৈতিক গ্রন্থটিকে সর্বোচ্চ ভাবা ইত্যাদি)। কিংবা উভয়ই। প্রকৃত বিচারে এই গোঁড়ামি মার্কসবাদ অনুসরণে নিজেদের অক্ষমতা ও ভণ্ডামি এবং হয়তো বা তজ্জনিত হতাশারই বহিঃপ্রকাশ।

বিজ্ঞানে চরম সত্য বলে কোনও কিছু নেই। একটি বিশেষ সময়ে তখনকার জ্ঞান অনুযায়ী এবং তথ্য, যুক্তি, প্রমাণের সাহায্যে কোনও তত্ত্বকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক মন সর্বদাই তার বিকাশের জন্য আগ্রহী এবং পরবর্তীকালে নতুনতর তথ্য-প্রমাণের সাহায্যে পুরোনো সত্য পালটে নতুন একটি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট। (এমন কি আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, কোয়ান্টাম তত্ত্ব ইত্যাদির আরও বিকাশে বিশুদ্ধ বস্তুবাদী দর্শনের বর্তমান রূপটিও পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।) উপযুক্ত তথ্য-যুক্তি ও প্রমাণের সাহায্যে নতুনতর সত্য প্রতিষ্ঠিত করা গেলে বিজ্ঞানীরা নির্দ্বিধায় তাকে গ্রহণ করেন এবং পুরোনো ‘সত্য’-কে মোহমুক্ত ভাবে বিসর্জন দেন। অন্ধবিশ্বাসী, গোঁড়া বা মৌলবাদীদের থেকে তাঁদের এখানেই বড়ো তফাত। তাই বেদ বাইবেল বা কোরানের শিক্ষাকে অপরিবর্তনীয় ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে বলে গণ্য করা যেমন ধর্মীয় মৌলবাদের বড়ো একটি লক্ষণ, তেমনই গান্ধিবাদ বা মার্কসবাদকে অপরিবর্তনীয় ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে বলে গণ্য করাটাও রাজনৈতিক মৌলবাদের লক্ষণ।

একইভাবে ‘সর্বশক্তিমান’ কথাটিও অবৈজ্ঞানিক ধারণার বহিঃপ্রকাশ। যে ধারণা ও কল্পনা থেকে ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান হিসেবে কিছু মানুষ শ্রদ্ধা ও ভয় করেছে, ঐ ধরনের ধারণা ও কল্পনা থেকেই কোনও তত্ত্বকে একই ভাবে সর্বশক্তিমান বলার প্রবণতা জন্মায়। প্রকৃতি, পৃথিবী ও সমাজের সমস্ত সমস্যার সমাধান মার্কসবাদ বা এই জাতীয় একটি তত্ত্ব করে ফেলতে সক্ষম, এটি ভাবতে ভালো লাগলেও লাগতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা থেকে তা বহু দূরে। বড়োজোর বলা যেতে পারে এই সব সমস্যার সমাধানে এ ধরনের একটি তত্ত্ব বর্তমান জ্ঞানে ও পরিবেশে সব চেয়ে বেশি কার্যকরী হিসেবে প্রচেষ্টা চালাতে সক্ষম। ভবিষ্যতে আরও কার্যকরী, আরও বিজ্ঞানসম্মত কোনও তত্ত্ব মানুষ জানতেই পারে। কিন্তু এখনই একটিকে সর্বশক্তিমান হিসেবে ঘোষণা করার মধ্যে ভবিষ্যতের ঐ সত্যকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করার মানসিকতাটিকে নষ্ট করা হয়, মনকে ঐ ভাবে সত্যিকারে প্রস্তুত করাও যায় না।

“মার্কসীয় মতবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা সত্য”– এ কথাটি লেনিনের। (‘The Marxian doctrine is omnipotent because it is true’– Three sources and three component parts of Marxism, V I Lenin) যেহেতু লেনিন বলেছেন, অতএব কথাটি প্রচারযোগ্য, এই বিচারের চেয়ে লেনিন কেন বলেছেন এবং তার পেছনে যুক্তি কতটা রয়েছে,– এ ধরনের বিচার করাই যুক্তিযুক্ত। আর সত্যি কথা বলতে কি, বিচ্ছিন্নভাবে শুধু এই কথাগুলিকে বড়ো বড়ো করে তুলে ধরলে ভুল বোঝার সম্ভাবনাই বেশি। কোনও বিশেষ তত্ত্ব বা মতবাদ সম্পর্কে এমন সার্টিফিকেট প্রচার করার চেয়ে, বাস্তব কাজ ও আচার আচরণের মধ্যে ঐ তত্ত্ব বা মতবাদের যাথার্থ্য ও যৌক্তিকতা প্রমাণ করাটাই কাম্য ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। কাজে তা না করে, নিজেদের গোষ্ঠীভুক্ত ব্যক্তিদের ঐ তত্ত্বে প্রকৃত শিক্ষিত করার চেয়ে অন্য সংকীর্ণ ধান্দায় নিয়োজিত করাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে, এমন কি যাঁরা এ কথাগুলি প্রচার করছেন তাঁরা আদৌ ঐ তত্ত্বকে আত্মস্থ করে সৎভাবে কাজ করেন কিনা– এই বিতর্কের সৃষ্টি যেখানে হয়েছে– সেখানে তাঁদের এই আচমকা প্রচার একটি ভান ও প্রতারণা বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

লেনিন ঐ একই লেখায় আরও মন্তব্য করেছেন, “মার্কসবাদে ‘গোঁড়ামি’ জাতীয় কোনও কিছু নেই…”। (“There is nothing resembling ‘sectarianism’ is Marxism, in the sense of its being hide bound, petrified doctrine, a doctrine which arose away from the highroad of development of world civilisation.”) ভাববাদী দর্শনের বিপরীতে এবং অবশ্যই মৌলবাদী চিন্তাভাবনার বিপরীতে স্পষ্টভাবে যে তত্ত্ব গোঁড়ামি বর্জন করার কথা বলে, সেই তত্ত্বের প্রতিই গোঁড়ামি থাকাটা সেই তত্ত্বেরই বিরোধী। মাকর্সবাদের– বা যথার্থভাবে বললে বলা উচিত মার্কসীয় দর্শনের, যাথার্থ্য এখানেই যে, সে নিজের প্রতি সহ সর্বত্র এই গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হওয়ার কথা বলে এবং এও বলে যে, প্রকৃতিতে সব কিছুই পরিবর্তনশীল, কোনও কিছুই স্থির নয় ইত্যাদি। এখনও অবধি জানা বিভিন্ন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসীয় দর্শনকে তার বিপুল বিস্তারী দিক নিয়ে, এ কারণেই যথার্থ ও বিজ্ঞানসম্মত হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

কিছু সত্য আছে যা চরম সত্য (absolute truth)। যেমন ত্রিভুজের তিনকোণের সমষ্টি ১৮০ ডিগ্রি ইত্যাদি জাতীয় জ্যামিতিক সত্য কিংবা কাউকে দেখিয়ে যদি বলা যায় তার ঠাকুরদা-ঠাকুমা বা বাবার মা ছিলেন তবে তা চরম সত্যই। লেনিনও তাঁর Materialism and Empirico-Criticism গ্রন্থে চরম সত্যের উদাহরণে বলেছেন, ‘না খেয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না’ এবং ‘শুধুমাত্র প্লেটোনিক প্রেমের সাহায্যে বাচ্চার জন্ম হবে না’, এগুলি চরম সত্য। কোনও প্রমাণিত ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কেও তা একইভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু এই ধরনের উদাহরণই চরম সত্য কিনা তা নিয়েও বিতর্ক উঠতে উঠতে পারে। যেমন কেউ যদি না খায়, তবে তাকে ইনজেকশান করে পুষ্টির জোগান দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়। তাই– ‘পুষ্টি ছাড়া মানুষ বেশিদিন বাঁচে না’– এটি হয়তো চরম সত্য। (কিন্তু এতেও ফাঁকি খুঁজে পাওয়া সম্ভব।) আবার বর্তমানে যখন কৃত্রিম প্রজনন ও টেস্ট টিউব বেবি ইত্যাদির বিপুল অগ্রগতি ঘটছে, যেখানে দু-একশো বছর পরে নারী পুরুষ প্লেটোনিক প্রেম করে গেলেও মানব সমাজে শিশুর জন্ম হবে না তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তা অসম্ভব নয় বলেই মনে হয়। সেক্ষেত্রে লেনিনের কথাটি ভুল বলে প্রতিষ্ঠিত হবে। যেহেতু লেনিন বলেছিলেন ‘প্লেটোনিক প্রেম করে গেলে বাচ্চার জন্ম হবে না– এ মন্তব্যটি একটি চরম সত্য’, তাই ভবিষ্যতের ঐ রকম সম্ভাবনাকেও নস্যাৎ করাটা মৌলবাদী চিন্তার একটি প্রকাশ হিসেবেই বলা যায়। লেনিনের সময় কৃত্রিম প্রজনন সম্পর্কিত মানুষের জ্ঞান বর্তমান অবস্থার মতো আদৌ ছিল না। তাই লেনিন উদাহরণ দিতে গিয়ে এমন কথা বলেছিলেন। তখনকার পরিবেশ ও জ্ঞানের স্তরে সেটাই সত্য ছিল। কিন্তু তাঁর মন্তব্যই চরম সত্য তা নয়। একইভাবে ভবিষ্যতে এমন কৃত্রিম প্রজননে জাত কোনও প্রাণী বা মানুষের প্রচলিত অর্থে সুর্নির্দিষ্ট বাবা-মা, ঠাকুমা-ঠাকুরদা না-ও থাকতে পারেন। সেক্ষেত্রেও পূর্বোক্ত মন্তব্যটি পরম সত্য নয় বলে প্রমাণিত হয়। পরবর্তীকালে নতুন জ্ঞান পুরোনো সত্যকে এইভাবেই বাতিল করে বা পরিমার্জিত করে। মৌলবাদী মানসিকতা এই পরিবর্তন ও পরিমার্জনাকে গ্রহণ করতে চায় না, যেমন চায়নি আমেরিকার ‘Fundamentalist’-রা বাইবেলের ক্ষেত্রে বা মুসলিম মৌলবাদীরা চায় না কোরানের প্রসঙ্গে কিংবা হিন্দুরা বেদ উপনিষদ জাতীয় ধর্মগ্রন্থ প্রসঙ্গে।

‘সত্য’ (Truth) সম্পর্কে পূর্বোক্ত কিছু চরম সত্য (যাও হয়তো আপাত) ছাড়া, সাধারণভাবে কোনও কিছুকে এইভাবে চিহ্নিত করা অবৈজ্ঞানিক। মরিস কর্নফোর্থ মন্তব্য করেছেন, “সাধারণভাবে, বিজ্ঞান চরম সত্যে আদৌ আগ্রহী নয়। প্রকৃতপক্ষে একবার যদি কোনও সিদ্ধান্তকে চরম সত্য হিসেবে বলে দেওয়া হয়, তাহলে পরবর্তী অনুসন্ধানের সমস্ত দরজাই বন্ধ করে দেওয়া হয়: চরম সত্যই যদি জানা হয়ে যায়, তবে তো আরও গবেষণার কোনও প্রয়োজনই থাকে না, চরম সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার বা জেনে নেওয়ার দাবি তাই প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান-বিরোধী, কারণ এমন দাবি আমাদের আরও গবেষণা চালাতে, আমাদের জ্ঞানের বিকাশ ঘটাতে, সত্যের কম কাছাকাছি অবস্থা থেকে বেশি কাছাকাছি অবস্থায় পৌঁছোতে, অন্য কথায় বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের বাধা দেয়।”

বিচ্ছিন্নভাবে মার্কসবাদকে ‘ইহা সত্য’ বলার মধ্যে ঐ চরম সত্য জেনে ফেলার দাবিই যেন বোঝায়। মার্কসবাদের সত্যতা ও চমৎকারিত্ব এইখানেই যে, কোনও কিছুই যে ঐভাবে সত্য নয়, এটি উপলব্ধি করতে তা আমাদের শেখায় এবং মৌলবাদের এই কোনও কিছুর মধ্যে সে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতেও দ্বিধা করে না। ‘অ্যান্টি ডুরিং’-এ এঙ্গেলস যেমন বলেছেন, “প্রকৃতপক্ষে ‘ভুল’ ও ‘ঠিক’ এই কথাগুলির মতো গোঁড়া ও নীতিগত ভাবপ্রকাশকে বৈজ্ঞানিক কাজ নিয়ম করেই এড়িয়ে চলে, যদিও এই ধরনের কথার সঙ্গে কাজেকর্মে আমরা সর্বত্রই পরিচিত হই… এদের মাধ্যমে একটি সর্বোচ্চ চিন্তার সর্বোচ্চ ফলাফলকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে; যে চেষ্টায় এক একটি উক্তির ব্যবসা করার শূন্যগর্ভ প্রবণতা থাকে।” (“Really scientific works therefore as a rule avoid such dogmatic and moral expressions as error and truth, while these expressions meet us everywhere in works…in which empty phrase mongering attempts to impose on us as the sovereign result of sovereign thought.”) সুবিধাজনকভাবে এইভাবে এক একটি উক্তি বা ফ্রেজ (phase) তুলে নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে তার প্রচার করার প্রবণতা না থাকলেই ভালো।

সত্য সম্পর্কে এ ধরনের বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি এটিও বারংবার মনে রাখা দরকার এবং আবারও বলা দরকার যে, মার্কসবাদের মতো কোনও তত্ত্বই হোক বা পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে জাতীয় কোনও বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণই হোক বা বিবর্তনবাদের মতো কোনও যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্তই হোক, যেটি সাম্প্রতিক জ্ঞান ও তথ্যের পরিপূর্ণ প্রয়োগ ঘটিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সেগুলিকে তখনকার মতো সত্য বলে গ্রহণ না করাটাও গোঁড়ামি, যা মৌলবাদী মানসিকতার সঙ্গে যুক্ত এবং যা মৌলবাদী ক্রিয়াকাণ্ডের জনক। সেগুলিকে “আরও সংশোধন করতে হবে, তাদের উন্নতি ঘটাতে হবে, নতুন অভিজ্ঞতা ও নতুন জ্ঞানের আলোয় তাদের নতুন করে ব্যাখ্যা করতে হবে। কিন্তু এই কারণেই সেগুলি অসত্য নয়: সেগুলি আংশিক ও তুলনামূলকভাবে সত্যের কাছাকাছি।” (“They require to be corrected, improved upon, restated in the light of new experience and new knowledge. But they are not for that reason untrue they are partial, relative, approximate truth.” – Dialectical Materialism, Maurice Cornforth) ব্যাপারটি মার্কসবাদ সম্পর্কেও সত্যি। রাজনৈতিক অন্ধবিশ্বাস ও অসূয়া থেকে মুক্ত হয়ে ব্যাপারটি উপলব্ধি করলে, লেনিনের একটি বাক্যকে আক্ষরিক অর্থে ও বিচ্ছিন্নভাবে প্রচার করার প্রয়োজনীয়তা কমে আসে।)

[ সংক্ষেপিত প্রবন্ধ ‘মৌলবাদের উৎস সন্ধানে’ (১৯৯৬) গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। ]

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান