পরিচিতি সত্তা ও মৌলবাদ

 মহ. সিরাজুল ইসলাম

“পরিচিতি সত্তা” কথাটি বহুমুখী, যা সচরাচর ব্যক্তি বা ব্যষ্টিকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরিচিতি সত্তা ব্যক্তির বিশ্বাস, অনুভূতি, আবেগ ও স্বকীয়তা কেন্দ্রিক, যা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিচিতির মধ্য দিয়ে বিকশিত ও প্রকাশিত হয়। এমনকি তা ব্যক্তির বিশ্বাস জনগোষ্ঠী বা গোষ্ঠীভিত্তিকও হতে পারে। অনেকে পরিচিতি সত্তার ল্যাটিন প্রতিশব্দ “আইডেনন্টিটাস”-কে তার সমার্থক বলে গণ্য করেন, যা মূলত “অভেদাত্মক বা তাদাত্মক” পরিচয়কে সূচিত করে। ব্যক্তির এই “পরিচিতি সত্তা” দেশ, কাল, তাগিদ ও প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত এবং কার্যকরী হয়, যেমন– শিক্ষাগত, পরিবার ভিত্তিক, লিঙ্গগত, ধর্মীয়, জাতীয়, জাতিগত, রাজনৈতিক ও আরও অসংখ্য হতে পারে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এক বা একাধিক “পরিচিতি সত্তা” ব্যক্তির প্রতিভার দ্যুতি হিসেবে গণ্য হয়ে সমাজে বা জীবনে কার্যকারিতা লাভ করে। যদি পরিবারগত পরিচিতি সত্তার বিচার করি তবে দেখা যাবে যে, একজন ব্যক্তির পরিচিতি সত্তা সেখানে বহুমুখী, যেমন– পরিবারের একজন সদস্য একদিকে সে ব্যক্তি আবার অপরদিকে সে– ভ্রাতা, পিতা, শ্বশুর, পিতামহ, কর্তা, উপার্জনকারী, ক্রেতা-বিক্রেতা, নেতা, অভিনেতা আরও বহু কিছু হতে পারে, যা প্রয়োজনানুযায়ী কার্যকারিতা লাভ করে। শিক্ষাক্ষেত্রেও একজন ব্যক্তি একাধারে ছাত্র, শিক্ষক, পরীক্ষার্থী, ধার্মিক, খেলোয়াড়, বক্তা, বিতর্ককারী, কবি, লেখক, গল্পকার, ছন্দকার, গায়ক, গীতিকার, পরিবেশপ্রেমী বহু কিছুই হতে পারে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের দেশে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার বহুমুখী পরিচিতি সত্তা সর্বজন স্বীকৃত। তবে কখনও কখনও ব্যক্তি তার বিশেষ পরিচিতি সত্তাকে অধিক কার্যকরী করে থাকে, তা কখনও নিজ বা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে প্রস্ফুটিত হয়। একজন ব্যক্তির অসংখ্য পরিচিতি সত্তা থাকতে পারে সেটা আমরা আগেই বলেছি, তবে আমাদের সমাজে ব্যক্তির পরিচিতি সত্তা বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ বিশেষ পরিচিতি সত্তাকে নিয়ে নিজেকে বিকশিত করলে ও কখনও কখনও ব্যষ্টিসত্তার কাছে ব্যক্তি সত্তা প্রাধান্য লাভ করে। তাই এক দিক দিয়ে পরিচিতি সত্তা আত্মগত এবং ব্যাক্তিভিত্তিক কিন্তু অপর দিক দিয়ে তা সমাজ, রাষ্ট্র, জাতি বা জাতীয়তার প্রতীকও হয়। ব্যক্তিভিত্তিক পরিচিতি সত্তা যে ওকেহেতু ব্যক্তির স্বকীয় মর্যাদা প্রধান তাই দুইজন ব্যক্তির পরিচিতি সত্তাও ভিন্ন ভিন্ন হয়। সেজন্য দুজনের পরিচিতি সত্তা অভেদাত্মক হয় না যেমন– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলাম, দুজনই কবি। তাদের দুজনের কবিতার ধরন দু-রকম এবং তাদের দুজনের একটা নিজস্ব ঘরানা আছে। সেটা একে অপরের সঙ্গে মেলে না। এখানে একটা কথা বলা অতীব জরুরি যে, অভেদাত্মক পরিচিতি সত্তাকে নির্ণয় করা যায় ভেদাত্মক পরিচিতি সত্তা দিয়ে, যা তুলনাত্মক বললেও অত্যুক্তি হয় না। তাই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে বলতে হয় যে, ব্যক্তি পরিচিতি সত্তা যখন তাঁর স্বকীয়তাকে আঁকড়ে থাকে বা থাকতে চায় তখনই আপনা হতেই সে ভেদাত্মক হয়ে ওঠে, সেটা স্বাভাবিক; কিন্তু সেই “ভেদ” যদি “বিভেদে” পরিণত হয় তখনই তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সেটা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের হিতকারী হয় না। এরূপ পরিচিতি সত্তা অনভিপ্রেত। দার্শনিক যুক্তিতে ভেদের ধারণা না থাকলে অভেদকে বোঝা যায় না, যেমন– ফেল এর ধারণা না থাকলে পাসের ধারণার কার্যকারিতা থাকে না। অনুরূপ– আঁধার না থাকলে আলোর কোনও কদর থাকে না। এটা স্বাভাবিকতা এবং এ-ভেদ সর্বজন স্বীকৃত তাই তাতে সমস্যা থাকে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে– গোলাপ বা জবা দুটোই ফুল কিন্তু তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য একে অপরের ভিন্নধর্মী। এ ভেদ স্বভাবসিদ্ধ এবং স্বাভাবিক তাই দোষণীয় নয়। সমাজে এই ভেদ অহরহ কার্যকরী হয়ে থাকে, যেমন– খেলার সময় আমরা “হার-জিত” কথাটি ব্যবহার করি। “হার-জিত” ধারণা দু-টি পরস্পর বিরোধী হলেও একে অপরের পরিপূরক, তাই একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির কার্যকারিতা থাকে না। সমাজে এ ‘ধন্দ’ থাকবেই, তা হিতকরী এবং অতীব প্রয়োজনীয়। কিন্তু পরিচিতি সত্তার অভেদাত্মক নীতি যদি ‘ধন্দ’ থেকে দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয় তখন বড়ো মুশকিল। এরূপ হলে তুমি-আমি আলাদা বলে বিবেচিত হব। দু-টি বস্তু বা ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর ভেদ দোষণীয় নয়, কিন্তু সেই ভেদের ওপর ভিত্তি করে অভেদকে খুঁজে বের করা ও তাকে কার্যকরী করাটাই বর্তমানে ব্যক্তি ও সমাজের মূল চ্যালেঞ্জ। মনে রাখতে হবে পরিচিতি সত্তার ‘ভেদ’ মূলত কালিক, দৈশিক এবং প্রয়োজন ভিত্তিক মাত্র। উহা সনাতন বা চিরন্তন নয়। সেজন্য তাদের পারমার্থিক অস্তিত্ব নেই শুধুমাত্র ব্যাবহারিক অস্তিত্ব আছে, যেমন– এক একটা স্কুলের এক একটা পোশাক বিধি থাকে যা একটা স্কুল থেকে অন্য স্কুলের আলাদা, প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীর আলাদা আলাদা অভেদাত্মক পরিচিতি কার্ড (Identity Card) থাকে, যার দ্বারা প্রতিপন্ন হয় যে, সকল ছাত্র-ছাত্রী ঐ একটা বিশেষ স্কুলের। পরীক্ষার ক্ষেত্রেও ওই ভেদকে অনুসরণ করা হয় বলেই প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর রোল নম্বর আলাদা হয়। সেজন্য একদিক দিয়ে ভেদ রেখার মধ্য দিয়ে অভেদাত্মক পরিচিতি সত্তাকে চিহ্নিত করা হয় আবার অপরদিকে অভেদাত্মক পরিচিতি সত্তার মূল নির্ণয় হয়ে গেলে তখন আর ভেদ থাকে না, যেমন– বৃষ্টি যতক্ষণ ঝরে ততক্ষণ বৃষ্টির প্রতিটি কণা আলাদা বা পৃথক, কিন্তু যখন তা সমুদ্রে পতিত হয় তখন সে নিজেই সমুদ্র হয়ে ওঠে। এই “হয়ে ওঠাই” হল পরিচিতি সত্তার “পূর্ণতা লাভ”, যা দেশ-কালের অতীত এবং সর্বভেদ রহিত।

পরিচিতি সত্তার অভেদাত্মক দিক যখন উপেক্ষিত হয় তখন ভেদ্গত পরিচিতি সত্তা প্রকটিত থাকে, সে ভেদ ব্যক্তি, ব্যষ্টি বা সমাজ ও রাষ্ট্রগত হয় যা ক্ষুদ্র আমিত্বের প্রতিফলক মাত্র, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং অনভিপ্রেত। এই সত্তা ব্যক্তিগত এবং ব্যষ্টিগত দুই-ই হতে পারে, আর তখনই সংসারে, সমাজে বা রাষ্ট্রে সেই বিভেদ বোধ জাগ্রত হয়ে জীবন ও সমাজকে দুর্বিষহ করে তোলে। এর ফলে একে অপরের চোখের বালি স্বরূপ হয়ে ওঠে। সমাজে প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক এবং তা দোষণীয় নয়, বরং তা উপকারী। প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি বা সমাজের প্রগতি ত্বরান্বিত হয় নব নব উদ্ভাবন প্রক্রিয়ার দ্বারা, কিন্তু “প্রতিযোগিতা” যদি ব্যক্তি ও সমাজে “প্রতিদ্বন্দ্বিতায়” রূপান্তরিত হয় তখনই মহা বিপদ, তখন পরিচিতি সত্তা বিভেদের প্রাচীরকে চওড়া করে এবং একে অন্যের এই বিভেদের প্রাচীরকে অতিক্রম করতে পারে না। ব্যক্তি ও সমাজের পরিচিতি সত্তার সঙ্গে বিভেদাত্মক হয়ে ওঠার ফলে কথা কাটাকাটি থেকে শুরু করে হয়ে লাঠালাঠি ও পরিশেষে মাথা ফাটাফাটিতে পর্যবসিত হয়, যা মানুষের পাশবিক সত্তার বহিঃপ্রকাশ। এবং মানুষের, ব্যক্তির বা সমাজের বিনাশ ডেকে নিয়ে আসে, আর তখনই মৌলবাদ সেই ফাঁক দিয়ে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে অনুপ্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে বিকশিত হয়।

আমরা দৈনন্দিন জীবনে “মৌলবাদ” কথাটির সঙ্গে কম বেশি পরিচিত এবং একে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখি। কিন্তু আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর অর্থ নির্ণয় করলে বোঝা যায় “মৌলবাদ” কী এবং ব্যক্তি ও সমাজে তা কী সূচিত করে। এখানে এটি প্রণিধানযোগ্য বলে মনে করি যে, আমাদের দেশে বা সমাজে “মৌলবাদ” শব্দটি ছিল না এবং তার ব্যবহারও বিরল বলা যেতে পারে। আমাদের বাঙালি সমাজে, সাহিত্যে, ধর্মে ও দর্শনে কোথাও “মৌলবাদ” শব্দটি চোখে পড়ে না। আমাদের দেশ ও সমাজে বিভিন্নতা সভ্যতার আদি যুগ থেকেই স্বীকৃত। ধর্মে ও সমাজে আস্তিক ও নাস্তিক উভয়েরই সমান্তরাল বিচরণ, তাই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র কেহই “মৌলবাদ” কথাটি তাঁদের লেখনীতে কখনোই ব্যবহার করেননি। ভারতের সমাজ ও সাহিত্যে উদার মানবিকতার প্রতিফলন লক্ষণীয়, তাই আমাদের শাস্ত্র বলে– “বাদো বাদো জায়তে তত্ত্ববোধনম” অর্থাৎ বাদানুবাদের মধ্য দিয়েই প্রকৃত সত্যে উপনীত হওয়া যায়। এই উদারতা মজ্জাগত তাই ঋক্‌বেদ মন্ত্র হতে উচ্চারিত হয়– “আনো ভদ্র কৃতভো যন্তু বিশ্বতা”, অর্থাৎ সর্বত্র থেকে আমাদের মনে মহৎ চিন্তা ভাবনা আসুক (ঋক্‌বেদ: ১.৮৯.১)। এটি বিশ্বের সকল দিক থেকে জ্ঞান সম্মিলিত করে আমাদের জ্ঞানের ভান্ডার ও সমাজকে পরিপুষ্ট করার প্রেরণা দেয়, যা সারা বিশ্বে বিরল। আমাদের সংস্কৃতি কখনোই অন্য সংস্কৃতির চিন্তা ভাবনা, রীতি নীতি বা বিশ্বাসকে ঘৃণা করতে শেখায়নি, বরং অন্য সংস্কৃতির প্রতি তা সমানভাবে সহনশীল এবং শ্রদ্ধাশীল। মহা উপনিষদের এই বাণীগুলিই পারে সমগ্র পৃথিবীতে শান্তির বাতাবরণ তৈরি করতে, যদি আমরা সেগুলি মান্য করি।

ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ তাই যথার্থই বলেছেন, “যত মত তত পথ”। তার একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, “মত ভেদ” আর “মনের ভেদ” এক নয়। মতভেদ আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে স্বীকৃত, কিন্তু “মত ভেদ” যখন “মনের ভেদে” রূপান্তরিত হয় তখন তা বিপজ্জনক এবং ধ্বংসাত্মক। সে জন্য দক্ষিণ ভারতের বৈষ্ণব বাদ এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব বাদ এক নয়। শংকরের অদ্বৈতবাদীতত্ত্ব তাঁর ছাত্র রামানুজ যুক্তি সহকারে খণ্ডন করেছেন এবং বিশিষ্ট দ্বৈতবাদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। এভাবে দ্বৈতবাদ, শুদ্ধা দ্বৈতবাদ, একত্ববাদ, বহুত্ববাদ, যুক্তিবাদ, মার্কসবাদ, ধনবাদ, সমাজবাদ, সাম্যবাদ প্রভৃতি শব্দগুলি এবং মতবাদগুলি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, কিন্তু কখনোই “মৌলবাদ” শব্দটি সেই সময় শোনা যায়নি। অনেকে আবার মৌলবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে “Fundamentalism” শব্দটিকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু যুক্তি সহকারে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় দু-টি শব্দ ঠিক একই শ্রেণির নহে। ১৯২২ সালে আমেরিকায় সর্বপ্রথম “Fundamentalism” শব্দটিকে ব্যবহার করা হয় যা খ্রিস্টীয় প্রোটেস্ট্যান্টরা মূলত ব্যবহার করেছিল ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধাচরণ করতে, কিন্তু পরবর্তীকালে তা রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে, যা কখনোই অভিপ্রেত নয়।

আমাদের সমাজে বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকেও বঙ্গ সাহিত্য ও লেখনীতে এর দেখা পাওয়া যায় না। তবে যতদূর জানা যায় বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এই “মৌলবাদ” শব্দটির বহুল প্রচার ঘটে। আর যদি “মৌলবাদ” শব্দটির যৌক্তিক মূল্যায়ন করা যায় তবে এটা স্পষ্ট যে, “মৌলবাদ” কথাটি “মৌল” অর্থাৎ “মূল” এবং “বাদ” (যুক্তি বা মত)। এই দু-টি দিককে প্রতিফলিত করে। সঠিকভাবে বলতে গেলে– “মৌলবাদ” মূলত মূল মতকেই সূচিত করে এবং এই দিক দিয়ে “মৌলবাদ” হচ্ছে কোনও মতাদর্শের মূল নীতিগুলির প্রতি কঠিন ও কঠোর আনুগত্য প্রদর্শন এবং সেগুলির সুচারু অনুশীলন। যদি তাই হয়, তবে এই দৃষ্টিকোণ থেকে “মৌলবাদ”-কে মোটেই অন্যায় বা নিন্দনীয় বলা অনুচিত, যেমন– যাঁরা উপনিষদের অদ্বৈতবাদ তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য “ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা” তত্ত্বটিকে গ্রহণ করে তবে তা দোষণীয় হবে না বলে আমার বিশ্বাস। অনুরূপভাবে যাঁরা রামকৃষ্ণদেবের অনুসারী তাঁরা যদি রামকৃষ্ণ মিশনের মূল মতাদর্শ ও পথকে মেনে চলেন তবে তা কীভাবে নিন্দনীয় হবে? আবার মুসলিম সমাজে শরিয়তপন্থীরা যদি শরিয়তের বিধি ও নিয়মগুলি যথার্থভাবে পালন করেন বা অনুশীলন করেন তবে তাঁদের কর্মকে নিন্দনীয় বলা অনুচিত হবে। ওপরে প্রদত্ত দৃষ্টান্তগুলি এক একটি ঘরানা মাত্র যা বিশেষ ব্যক্তি বা শ্রেণির মধ্যে স্বীকৃতি লাভ করতেই পারে এবং তাতে কারও অসুবিধা হওয়ার কোনও কারণ নেই যদি না তা অপরের গণ্ডিকে বা মতাদর্শকে অযৌক্তিকভাবে আঘাত করে। এই ঘরানাগুলি মূলত তাদের সদস্যদের মতাদর্শ ও পরিচিতি সত্তার মধ্য দিয়ে সার্বিক হিতে কাজ করে মাত্র। কিন্তু তা না হয়ে যদি কোনও বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠী তাঁদের রক্ষণশীলতাকে প্রাধান্য দিয়ে আপন স্বার্থসিদ্ধি চরিতার্থ করার জন্য অন্যের ওপর সেগুলিকে চাপিয়ে দেয় জোরপূর্বকভাবে, তবে তা সঠিক হবে বলে মনে হয় না, বরং তা বৈরিতা ও ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি করে। তাই পরিচিতি সত্তার সঙ্গে সামগ্রিক কল্যাণের নীতির একটা সুসামঞ্জস্যতা দরকার যা ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী মানসিকতা প্রশমিত করবে। এজন্য চাই আত্মসংযম, উদার মানসিকতা এবং সহনশীলতা। একে অপরের পরিচিতি সত্তার স্বীয় গণ্ডিকে অতিক্রম করতে না পারলে তা তথাকথিত মৌলবাদকে উজ্জীবিত করবে যা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সকলের জন্য বিপদ ডেকে আনবে এবং ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। আজকাল রাজনৈতিক পরিচিতি সত্তার সঙ্গে ধর্মীয় পরিচিতি সত্তার এক বৈরিতা লক্ষণীয়, একে সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধি ও ক্ষমতা করায়ত্ত করার এক ধারালো অস্ত্র বলে গণ্য করলে অত্যুক্তি হয় না। এ যেন পরিচিতি সত্তার সাথে প্রভুত্ব বিস্তারের এক কৌশল যা আমাদের দেশে বহু শাখা প্রশাখায় বিন্যস্ত। বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনগুলিকে এক্ষেত্রে আপন আপন মূল্যবোধগুলির শুধু চর্চা নয় বরং চর্যার মধ্য দিয়ে সেগুলির বাস্তব রূপায়ণ ঘটাতে পারে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক সত্তার প্রকোপ থেকে সেগুলিকে মুক্ত করতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, বিভিন্ন ধর্ম যেমন– হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ইহুদি, ইসলাম সবগুলিই কম বেশি আজ ঐ-রূপ মৌলবাদের শিকার, তাদের কদর্য রূপ আর যাই হোক কখনোই ধর্মীয় বলে গণ্য করা যেতে পারে না। আমরা আগেই দেখেছি যে, আমাদের পরিচিতি সত্তা একটা বা দুটো নয় বরং অসংখ্য, যা বিভিন্ন সময়ে ও প্রেক্ষাপটে পৃথক পৃথকভাবে কার্যকারিতা লাভ করে। কখনও কখনও আমাদের এই পরিচিতি সত্তাগুলি নিজেদের মধ্যেও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, ব্যক্তি তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে, কখনও কখনও সেগুলো আমাদের আবেগ ও সহজাত প্রবৃত্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িত হয় যা ব্যক্তিকে বিষণ্ন ও উদ্‌বিগ্ন করে তোলে। মানুষ সেই, যে এই সমস্ত দ্বন্দ্বগুলির সুচারু সমাধান করে বৃহত্তর কল্যাণের দিকে ধাবিত হতে পারে এবং সমাজকে গড়তে পারে। ব্যক্তি সুন্দর হলে সমাজ সুন্দর হয় এবং সমাজ সুন্দর হলে রাষ্ট্রও সুন্দর হবে। এদিক দিয়ে লক্ষ করলে আমরা সবাই সুন্দরের পূজারী। সুন্দরের কোনও জাত হয় না, মন সুন্দর হলে সে জাতপাত নির্বিশেষে সবার কাছেই ধরা দেয়। আমরা অধরাকে ধরতে পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করি, কিন্তু যে সুন্দর আমাদের মধ্যে ও জগতে পরিব্যাপ্ত তাকে আমরা হেলায় এড়িয়ে যাই আমাদের অমনস্কতা এবং সংকীর্ণতার বেড়াজালের মধ্যে। তাই আমাদের উচিত ব্যক্তিসত্তা, পরিচিত সত্তা ও রাষ্ট্রীয় সত্তার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা এবং তা করতে পারলে জীবনে শান্তি ও আনন্দ আপনা হতেই আসবে, আর তখনই মানুষ হিসেবে আমাদের জীবন সার্থক হবে।

“সর্বে ভবন্তি সুখিনা, সর্বে সন্তু নিরাময়।”

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান