সেমন্তী বসু
(ভাষান্তর : মানস মুখোপাধ্যায়)
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যবর্তী আমাদের দেশের সংবাদপত্রে আফ্রিকা সম্পর্কিত খবর থেকে আমরা প্রায়শই বঞ্চিত হই। বড়ো ঘটনাগুলো কখনও কখনও প্রথম পাতায় স্থান পায় ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে তা ভেতরের পাতায় ছোটো খবরে পরিণত হয় এবং শেষমেশ অদৃশ্য হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহগুলিতে প্রায় সব প্রধান ভারতীয় দৈনিকেই কঙ্গো ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক (ডিআর)-এর যুদ্ধ ও সহিংসতার খবর প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু কয়েক দিন পরেই সেই খবরগুলি প্রকাশ হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্যই, সংবাদের সচেতন পাঠকেরা কেউই মনে করবেন না যে সংবাদপত্র বা সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগরিদম থেকে খবরগুলি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার অর্থ হল কঙ্গো ডিআর-এর যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে। অন্য যে কোনও ঘটনার মতোই, আফ্রিকার খবরগুলিও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে যাতে সেগুলো আবার সংবাদমাধ্যমে স্থান পায় এবং সংবাদ পরিবেশক ও সম্পাদকরা সেগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। এখানে দ্রষ্টব্য হল, আফ্রিকার মতো বিশাল ও ভৌগোলিকভাবে বৈচিত্র্যময় একটি মহাদেশ যার স্থানীয় নানান সূক্ষ্মতা, তথা আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র রয়েছে, তা আজকের গ্লোবাল সাউথের সাথে যুক্ত অনেক বৈচিত্র্যময় ঘটনার গতানুগতিকতার মাঝে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। এই নিবন্ধটিও শুরুতেই স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যে, আফ্রিকায় মৌলবাদ এক বিশাল ও বৈচিত্র্যময় বিষয়, এর প্রতিটি সূক্ষ্ম দিক ধরা প্রায় অসম্ভব। তবে আফ্রিকা মহাদেশের জটিল সামাজিক-রাজনৈতিক অতীত ও বর্তমানকে উপেক্ষা না করে বরং তা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস থাকবে এই নিবন্ধে। আমাদের চেষ্টা হবে বর্তমান মৌলবাদী শক্তিগুলোর মূল উৎস সম্পর্কে অনুসন্ধান করা এবং পৃথক ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর চেয়ে বডড়ো কাঠামোগত কারণগুলির উপর মনোনিবেশ করা।
এটি প্রতীয়মান যে, গত দুই দশক বা তার কিছু বেশি সময় ধরে বিশ্বের গৃহযুদ্ধ ও সহিংস বিদ্রোহী ঘটনাগুলোর একটি বড়ো অংশ আফ্রিকায় ঘটেছে। তবে এটা বলার পরেও মনে রাখা জরুরি যে আফ্রিকার দেশগুলিকে বৈশ্বিক পত্রপত্রিকায় যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ চিত্র দিয়ে চিত্রিত করা হলেও, বিভিন্ন আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যুদ্ধের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। যদিও ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো যে সীমানা তৈরি করেছিল তা সর্বক্ষেত্রে জটিল জাতিগত সত্তাকে আমলে আনেনি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আফ্রিকার বেশিরভাগ সংঘাত সাধারণত বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং সরকার-সমর্থিত মিলিশিয়াদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাতের রূপ নেয়। বর্তমানে কঙ্গো ডিআর-এ যুদ্ধ চলছে, যেখানে রুয়ান্ডা-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণের খবর রয়েছে, যদিও ১৯৯৮ সালে ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার মধ্যে যুদ্ধ এই ধরনের সংঘাতের ব্যতিক্রম হতে পারে। ২০২৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, সেন্টার ফর প্রিভেন্টিভ অ্যাকশন দ্বারা পরিচালিত গ্লোবাল কনফ্লিক্ট ট্র্যাকার ওয়েবসাইট অনুসারে, আফ্রিকা মহাদেশে আটটি সহিংস সংঘাত চলমান। লিবিয়া ও সুদানের মতো কিছু সংঘাত যা কিনা আসলে সরকারি বাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ, সেখানে কঙ্গো ডিআর-এর সংঘাতের মতো কিছু সংঘাত হল আন্তঃসীমান্ত। তবে এই সমস্ত সংঘাতের একটি সাধারণ কারণ হল, বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ, তবে অন্যান্য কারণও অনুপস্থিত নয়।
সমস্যা সম্ভবত এই সরলীকৃত সীমানা চিহ্নিতকরণে নিহিত। ঐতিহাসিক পটভূমিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উপাদানগুলির পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করতে সম্ভবত আফ্রিকায় স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মৌলবাদের উত্থানকে বুঝতে সাহায্য করবে। দারিদ্র্য, প্রান্তিকীকরণ ও বৈষম্যের মতো অন্তর্নিহিত কারণগুলির পাশাপাশি দুর্বল শাসন, জাতিগত অবিচার ও চরমপন্থী মতাদর্শের বিস্তারের মতো কাঠামোগত কারণগুলির বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে প্রকৃত সূত্র পাওয়া সম্ভব। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে, আফ্রিকান সরকারগুলি প্রায়শই ঔপনিবেশিক অসম ও অস্থায়ী সম্পদ আহরণের প্রথা অব্যাহত রেখেছিল, যা শাসক শ্রেণিকে লাভবান করলেও বেশিরভাগ নাগরিক, বিশেষ করে দুর্বল সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলির ক্ষতি করেছিল। এটা আরও জটিল হয়ে উঠেছিল এই কারণে যে শাসন ব্যবস্থা প্রায়ই জাতি সত্তার মানসিকতায় সংগঠিত হত। এই জাতিগত পরিচয়কে কেবল শ্রেণি, রাষ্ট্র ও ক্ষমতার মতো অন্যান্য গতিশীলতার সাথে তুলনা করেই বোঝা সম্ভব। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন এবং সেই ক্ষমতার সুসংহতকরণের স্বার্থে কখনও কখনও যেমন জাতিগত আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, তেমনই শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও অভিযোগ প্রকাশের অস্ত্র হিসাবেও তার ব্যবহার দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্টিন ডোরনবোস (১৯৯১, ১৯৯৮, ২০১৭) তাঁর কাজে দেখিয়েছেন যে সমষ্টিগত জাতিগত পরিচয়ের প্রকাশ মুক্তির অস্ত্র হতে পারে, যা সামাজিক আন্দোলনগুলোর জন্য সংহতি ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি তৈরি করে; তবে এটি আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক বা মৌলবাদী রাজনীতির জন্মও দিতে পারে। বর্তমানে কঙ্গো ডিআর-এর সংঘাত এই জটিলতার একটি উদাহরণ।
বর্তমান সংঘাতের শিকড় প্রায় ত্রিশ বছর আগে প্রতিবেশি রুয়ান্ডায় ১৯৯৪ সালের গণহত্যাকে মনে করিয়ে দেয়। আসলে, কঙ্গো ডিআর-এর খনিজ-সমৃদ্ধ পূর্বাঞ্চল গত ত্রিশ বছর ধরে প্রায় অবিরাম সংঘাতের মধ্যে রয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারির শেষে, সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধের পর, বিদ্রোহী এম২৩ গোষ্ঠী রুয়ান্ডা সীমান্তবর্তী কিভু অঞ্চলের বেশ কয়েকটি বড়ো শহর দখল করে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল গোমা। এম২৩ গোষ্ঠীটি জাতিগত তুতসিদের নেতৃত্বে পরিচালিত বলে জানা যায়। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যায় জাতিগত হুতু চরমপন্থীরা তুতসিদের ব্যাপক হত্যা করেছিল। জার্মান ও বেলজিয়ান ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অধীনে, তুতসি রাজারা তাদের হুতু প্রজাদের উপর শাসন বজায় রেখেছিল। ঔপনিবেশিক যুগের আগে, তুতসিরা সাধারণত সামাজিক ব্যবস্থায় উচ্চ স্তরে অবস্থান করত যেখানে হুতুরা ছিল নিম্নবর্গীয়। তবে গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সামাজিক গতিশীলতা বজায় ছিল। ১৯৩০-এর দশকে, বেলজিয়ান ঔপনিবেশিক প্রশাসন জাতিসত্তার নিরিখে পরিচয়পত্র চালু করে। এর ফলে অস্থিরতা ও অসন্তোষ তীব্র হয়েছিল এবং হুতু ও তুতসিদের মধ্যে উত্তেজনা আরও ঘনীভূত হয়েছিল। স্বাধীনতার আগেই, ১৯৫৯ সালে, হুতুরা ঔপনিবেশিক প্রশাসন ও তার থেকে অসমভাবে পক্ষপাতিত্ব পাওয়া তুতসি অভিজাতদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে হুতু বিপ্লব শেষ পর্যন্ত ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা নিয়ে আসে এবং তাদের নিজস্ব ক্ষমতা ও শাসন প্রতিষ্ঠা করে। অনেক তুতসি বুরুন্ডিতে পালিয়ে যায়, যা রুয়ান্ডা থেকে আলাদা হয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে। এখানে তুতসিরা ক্ষমতা সংহত করেছিল।
১৯৭৩ সালে, রুয়ান্ডার সেনাবাহিনীর প্রধান হুতু জাতিভুক্ত জুভেনাল হাবিয়ারিমানা, একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রুয়ান্ডার নিয়ন্ত্রণ নেন। তিনি একটি একদলীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সকল সরকারি চাকরিতে জাতিগত কোটা নীতি প্রবর্তন করা হয়। ১৯৮০-এর দশকের শেষ নাগাদ, লক্ষাধিক রুয়ান্ডান তুতসি শরণার্থীতে পরিণত হয়। তারা তাদের আন্তর্জাতিক আইনি অধিকার ফিরে পেতে রুয়ান্ডায় ফিরে যাওয়ার দাবি জানাতে থাকে, তবে জুভেনাল হাবিয়ারিমানার বক্তব্য ছিল যে জনসংখ্যার চাপ ইতিমধ্যেই বেশি এবং অর্থনৈতিক সুযোগ নেহাতই কম, তাই তুতসি শরণার্থীদের বড়ো সংখ্যায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। ১৯৮৮ সালে, উগান্ডার কাম্পালায় রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (আরপিএফ) প্রতিষ্ঠিত হয়, যার লক্ষ্য ছিল নির্বাসিত রুয়ান্ডানদের ফিরিয়ে আনা এবং রুয়ান্ডান সরকারের সংস্কার। এর মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রসঙ্গ অন্তর্ভুক্ত ছিল। আরপিএফ মূলত উগান্ডায় নির্বাসিত তুতসিদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। ১৯৯০ সালের ১ অক্টোবর, আরপিএফ উগান্ডা থেকে রুয়ান্ডায় একটি বড়ো আক্রমণ চালায়। আরপিএফের আক্রমণ ও সরকারের উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণার কারণে, দেশের ভেতরে সকল তুতসিকে আরপিএফের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং বিরোধী দলগুলোর হুতু সদস্যদের দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মিডিয়া, বিশেষ করে রেডিওয়, অপ্রমাণিত গুজব ছড়াতে থাকে, যা জাতিগত সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
১৯৯৪ সালের ৬ এপ্রিল, রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানা ও বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট এন্টারিয়ামিরাকে বহনকারী একটি বিমান কিগালি বিমানবন্দরে দুর্ঘটনাগ্রস্থ হয় এবং যাত্রীদের সবাই নিহত হয়। ৬ এপ্রিল রাতেই, রুয়ান্ডান সশস্ত্র বাহিনী ও ‘ইন্টেরাহামওয়ে’ মিলিশিয়া রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে তুতসি ও মধ্যপন্থী হুতু রাজনীতিবিদদের হত্যা শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী আগাথে উইলিঙ্গিয়ামানা ও তাকে রক্ষার দায়িত্বে থাকা ১০ জন বেলজিয়ান শান্তিরক্ষী ৭ এপ্রিল নিজ বাড়িতে রুয়ান্ডান সরকারি সৈন্যদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন। পরের একশো দিনের মধ্যে, হুতু চরমপন্থীরা বিপুল সংখ্যক তুতসি ও মধ্যপন্থী হুতুকে হত্যা করে। পল কাগামের নেতৃত্বে তুতসি নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাহিনীর অগ্রগতির সাথে গণহত্যা শেষ হয়। তিনিই এখন রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট। প্রতিশোধের ভয়ে হুতুরা তখন সীমান্ত পেরিয়ে বর্তমান কঙ্গো ডিআর-এ পালিয়ে গেছে। এই ঘটনা জাতিগত উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে, কারণ পূর্বাঞ্চলে একটি প্রান্তিক তুতসি গোষ্ঠী ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে পড়ে। রুয়ান্ডার সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে দুইবার কঙ্গো ডিআর-এ আক্রমণ করেছে এবং কারণ হিসেবে তারা গণহত্যার জন্য দায়ী কিছু মানুষকে আটকের কথা বলেছে। ত্রিশ বছর সংঘাতের পর, হুতু গোষ্ঠীগুলোর অন্যতম, ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস ফর দ্য লিবারেশন অফ রুয়ান্ডা (এফডিএলআর), যাদের মধ্যে রুয়ান্ডার গণহত্যার জন্য দায়ী কিছু লোকও রয়েছে, এখনও সক্রিয় রয়েছে। রুয়ান্ডা এফডিএলআরকে ‘গণহত্যার মিলিশিয়া’ বলে বর্ণনা করে এবং বলে যে এর অস্তিত্ব তাদের নিজেদের অঞ্চলের জন্য হুমকির কারণ। এম২৩-এর নেতা সুলতানি মাকেঙ্গা একজন কঙ্গোলিজ তুতসি, যিনি পূর্বে রুয়ান্ডান সেনাবাহিনীতে কর্মরত থেকেছেন। রুয়ান্ডা অতীতে ধারাবাহিকভাবে এম২৩-কে সমর্থন করার কথা অস্বীকার করেছে, কিন্তু ২০১২ সাল থেকে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা তাদের অস্ত্র, লজিস্টিক সহায়তা এবং এমনকি বিদ্রোহীদের কমান্ড দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন। এই স্তরবিন্যস্ত ঘটনাটির বর্ণনা এই কারণে করা হল যে ইতিহাস এবং জটিল ঔপনিবেশিক ও নব্য-ঔপনিবেশিক সম্পর্কের মধ্যে সংযোগগুলি অস্বীকার করে আফ্রিকায় মৌলবাদী শক্তিকে বোঝা প্রায় অসম্ভব, এবং এটি এই সংক্রান্ত অনেক উদাহরণের অন্যতম।
এই জটিল এবং বহুস্তরীয় ঘটনাশৃঙ্খল আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন বিবেচনাধীন অঞ্চলের খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যকে বিবেচনায় আনা হয়। কঙ্গো ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক (ডি আর) উন্নত ইলেকট্রনিক্স উৎপাদনে ব্যবহৃত বিশ্বের কিছু বৃহত্তম ধাতু এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। কোবাল্ট, তামা, দস্তা এবং অন্যান্য খনিজের উপর বিশ্বের নির্ভরশীলতা যত বেড়েছে, ততই স্থানীয় এবং বাহ্যিক গোষ্ঠীগুলি কঙ্গোর সংঘাতে জড়িত হওয়ার ইন্ধন পেয়েছে। কঙ্গোর মাটিতে পাওয়া প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ— বিশেষ করে মূল্যবান খনিজ— সংঘাতকে আন্তর্জাতিক রূপ দিয়েছে। মার্কিন কোম্পানিগুলি একসময় কঙ্গোতে বিশাল কোবাল্ট খনির মালিক ছিল, তবে ২০১০-এর দশকের পর তার বেশিরভাগই চিনা কোম্পানিগুলির কাছে বিক্রি হয়ে যায়। বেইজিংয়ের সাথে সংযুক্ত চিনা কোম্পানিগুলি এখন কঙ্গো ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকের বিদেশি মালিকানাধীন কোবাল্ট, ইউরেনিয়াম এবং তামা খনির সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। কঙ্গোলীয় সরকার চিনা ড্রোন এবং অস্ত্রের সাহায্য নিয়ে এম২৩ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সিয়েরা লিওন এবং লিবিয়ায় ঔপনিবেশিক সময় থেকে প্রাকৃতিক সম্পদের শোষণ অব্যাহত রয়েছে। এখানে উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে নব্য-ঔপনিবেশিক কুশীলবদের যোগ হয়েছে মাত্র। বিদেশি কুশীলবেরা প্রায়শই আফ্রিকায় রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক বিষয়গুলিকে প্রভাবিত করতে সচেষ্ট। এখানে উল্লেখ্য, স্নায়ুযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই এখানকার বেশ কয়েকটি অত্যাচারী শাসনকে বৈধতা ও সমর্থন দিয়েছিল, যেমন জায়ারের মোবুতু সেসে সেকো এবং লাইবেরিয়ার স্যামুয়েল ডো। এরিক টৌসেন্ট এবং অন্যান্য অনেক লেখক জানিয়েছেন, পশ্চিমা পররাষ্ট্রনীতি আফ্রিকায় শুধুমাত্র দারিদ্র্য এবং অসমতা সৃষ্টি করেনি, সেইসঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের ঋণ, শর্ত সমন্বিত অর্থনৈতিক নীতি সংস্কার, বেসরকারীকরণ এবং বাণিজ্য উদারীকরণ তথা নব্য-উদারনৈতিক কর্মসূচি রূপায়ণের ইচ্ছাকৃত কৌশল প্রয়োগ করেছে।
আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক শাসনের স্বাভাবিক ফলস্বরূপ উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতি সত্তাকে শিথিল করেছে, যা দুর্বল রাষ্ট্রগুলিতে একটি রাজনৈতিক ছাপ রেখে গেছে। এই রাষ্ট্রগুলি তাই আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থার উপর সীমিত নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতী এবং ঔপনিবেশিক শাসন থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জাতিগত বিভাজন, কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ব এবং পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধ। দুর্বল রাজনৈতিক ভিত্তির কারণেই নতুন জাতীয় নেতারা দুর্নীতির টানে বহিরাগত সাম্রাজ্যবাদী পৃষ্ঠপোষকদের সমর্থনের প্রতি সংবেদনশীল। আফ্রিকান জাতীয় আন্দোলনগুলি ঔপনিবেশিক যুগে তুলনামূলকভাবে দেরিতে সূচিত হওয়ায় নতুনভাবে তৈরি রাষ্ট্রীয় যন্ত্র এবং দুর্বল জাতীয় পরিচয় নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। কার্যক্ষেত্রে শাসনক্ষমতা জোগাড় করার সময় এদের জাতিগত গোষ্ঠীগুলির পারস্পরিক সংঘাতকেই কাজে লাগাতে হত। লুণ্ঠন এবং ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার পুঁজিবাদের স্বাভাবিক ব্যবস্থা হিসাবে এখানে প্রসারিত হয়েছে যা আফ্রিকায় রাষ্ট্র এবং অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে দুর্বল করার কারণ। ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দারিদ্র্য, সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ, জাতিগত সংঘাত এবং সহিংসতার ঘটনাগুলি আফ্রিকায় মৌলবাদের, বিশেষত ধর্মীয় মৌলবাদের প্রসার ঘটিয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংক উল্লেখ করেছে যে সাব-সাহারান আফ্রিকা বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র অঞ্চল, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ দিনে এক ডলারেরও কম অর্থে জীবিকা নির্বাহ করে। গিফোর্ড, ক্রস এবং মার্শালের মতো বেশ কয়েকজন পণ্ডিত জনগণের দারিদ্র্য এবং তাদের খ্রিস্টান মৌলবাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টানবাদ, যা ১৯৭০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশে জনপ্রিয় হয়েছিল তা ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে আফ্রিকায় পাড়ি দেয় এবং প্রচুর অনুসারী লাভ করে। ধর্মীয় মৌলবাদ শব্দটি প্রায়শই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এরা একটি কঠোর ভাবধারাকে অনুসরণ করে এবং খোলামেলা ধর্মীয় নীতিগুলিকে প্রত্যাখ্যান করে। কেন্দ্রীয় গোষ্ঠী এবং প্রতিপক্ষ সহনশীল গোষ্ঠীর সঙ্গে তার পৃথকত্বের সাপেক্ষে এখানে সম্প্রদায়বাদ শব্দটিকে ব্যবহার করা যেতে পারে। ধর্মীয় মৌলবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল পবিত্র গ্রন্থের প্রতি কঠোর আনুগত্য, যা তাদের মতে, অমোঘ এবং সমালোচনার ঊর্ধ্বে। যেমন, মৌলবাদীদের অবশ্যই তাদের পবিত্র গ্রন্থের প্রতি পরম বিশ্বাসী হতে হবে এবং নিজেদের বিশ্বাসকে অন্যদের উপর প্রয়োগ করার জন্য তাদের নিজস্ব ক্ষমতার প্রতি আস্থা রাখতে হবে। যেহেতু তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিটি প্রশ্নাতীত, সেহেতু তাকে অন্যের উপর চাপানো স্বাভাবিক। আফ্রিকায় ফেইথ গসপেল এবং ইভাঞ্জেলিক্যাল আন্দোলনগুলি ঈশ্বর এবং বাইবেলে পরম বিশ্বাস প্রচার করে। গিফোর্ড (১৯৯১) প্রসঙ্গত বলেছেন, এটি প্রায় ‘উন্নয়নের বিরুদ্ধে জিহাদ’।
খ্রিস্টধর্মের এই রূপটি আফ্রিকা জুড়ে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি পেয়েছে— কেনিয়া, নাইজেরিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলিতে বাইবেল কলেজগুলিতে এসবই শেখানো হয়। উন্নয়নের উপর এর প্রতিক্রিয়া অপরিসীম। এটি সাধারণত বাইবেলের apocalyptic অংশগুলি যেমন, ড্যানিয়েল, রিভিলেশন, ইজেকিয়েল, জোয়েল, জেফানিয়াহ এবং জাকারিয়াহের কিছু অংশ থেকে সংগঠিত। যেহেতু এই apocalyptic অংশগুলি মহামারি, দুর্ভিক্ষ এবং সব ধরনের বিপর্যয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়, সেহেতু dispensationalist খ্রিস্টানরা সব ধরনের কষ্ট এবং বঞ্চনাকে ঈশ্বর নির্দিষ্ট হিসাবে দেখে থাকে, যেগুলি এড়ানো সম্ভব নয়। তাই, এই ধারণা দারিদ্র্য, অসুস্থতা এবং বঞ্চনার সম্মুখে নিষ্ক্রিয়তা বা আত্মসমর্পণ আহ্বান করে। জার্মান ইভাঞ্জেলিস্ট রাইনহার্ড বোনকের ১৯৯১ সালে নাইজেরিয়ার কানোতে পরিকল্পিত ক্রুসেড আধুনিক আফ্রিকাকে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ ধর্মীয় দাঙ্গার দিকে নিয়ে যায়। ক্রুসেডগুলি মূলত ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যা লক্ষ লক্ষ অনুসারীকে মঞ্চে ধর্মীয় বক্তাদের কথা শোনার জন্য আহ্বান করা হত। এই অনুষ্ঠানে বক্তৃতাগুলি প্রায়শই ধর্মান্তরকরণ প্রচেষ্টা এবং অনুসারীদের তাদের ভাবাদর্শে দীক্ষিত করার উপর কেন্দ্রীভূত হয়। বোঝানো হয়, তাদের সমস্যাগুলি আসলে বিশ্ব ব্যবস্থার শেষের ইঙ্গিত, এমতাবস্থায় apocalyptic দর্শন অনুসরণ করে ঈশ্বরের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণই বিধেয়। গিফোর্ড (১৯৯১) যেমন উল্লেখ করেছেন, এই ধরনের বর্ণনা exclusionist ভাবনার জন্ম দেয় যা অন্য কোনও ধর্ম অনুসরণকারী, এমনকি তাদের ব্যতীত অন্যান্য খ্রিস্টানদেরও প্রত্যাখ্যান করে।
একইভাবে, ইসলামিক মৌলবাদও ১৯৮০-এর দশক পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আফ্রিকান দেশকে সহিংস সংঘাতের দিকে নিয়ে গেছে। ২০১৪ সালের এপ্রিলে নাইজেরিয়ার চিবোকে ২৭৪ স্কুলছাত্রী অপহরণের পর বোকো হারাম নামে গোষ্ঠীটি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। এর আগে এবং তারপর থেকে, গোষ্ঠীটি হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, হাজার হাজার মানুষকে অপহরণ করেছে এবং প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে। বোকো হারাম সাধারণত ইসলামিক চরমপন্থার সঙ্গে যুক্ত কারণ এর নামটির অর্থ হল পশ্চিমা শিক্ষা নিষিদ্ধ করা। এর নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলিতে কঠোর শরিয়া আইন প্রয়োগের আহ্বান থেকে অনেককে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে এটি মূলত একটি মৌলবাদী বিদ্রোহ। ২০০২ সালে গোষ্ঠীটির আত্মপ্রকাশ ঘটে, এটি জামা-আত আহল আস-সুন্নাহ লিদ-দাওয়াহ ওয়াল-জিহাদ (আরবিতে ‘প্রচার ও জিহাদের জন্য সুন্নাহর লোকদের গোষ্ঠী’) নামে পরিচিতি পায়। নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ধর্মীয় অভিজাতদের মধ্যে তারা দুর্নীতি, অসমতা, বেকারত্ব এবং ব্যর্থ শাসনের বিরুদ্ধে প্রচার করে। উত্তর নাইজেরিয়ার পুনর্জাগরণ সংক্রান্ত তাদের আহ্বানের সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন কালে ইসলামিক ধর্মীয় নেতাদের অনুরূপ প্রচেষ্টার সাদৃশ্য থাকায় তারা স্থানীয়দের থেকে বোকো হারাম নামটি অর্জন করেছিল। স্থানীয়রা ব্রিটিশ শাসনকালেও নাইজেরিয়ার সংস্কৃতি এবং সাধারণের জীবিকা পশ্চিমা প্রভাব দ্বারা আশঙ্কিত হতে দেখেছিল।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে, ঔপনিবেশিক শাসনকালে দক্ষিণ নাইজেরিয়ায় পাশ্চাত্যকরণের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ায় তা উত্তরের তুলনায় অধিক সমৃদ্ধ হয়েছিল। পশ্চিমা শাসন এবং আমলাতন্ত্রের সাথে তার পরিচিতি এবং সেখানে পশ্চিমা শিক্ষা ও চিকিৎসা পদ্ধতি বলবৎ থাকার তাৎপর্য হল যে স্বাধীনোত্তর কালে দক্ষিণ নাইজেরিয়া নব্য-উদারনৈতিক আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণার সাথে অনেক দ্রুত মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল। তুলনামূলকভাবে, উত্তরাঞ্চল উন্নয়নের নিরিখে পশ্চাদ্গামী এবং দরিদ্র ছিল। দক্ষিণাঞ্চল বেশিরভাগই তেল সমৃদ্ধ নাইজার ডেল্টার উপর অবস্থিত, ফলে নাইজেরিয়ার সিংহভাগ সম্পদে তার অবদান রয়েছে। এখানে যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে নাইজেরিয়ায় সম্পদের বণ্টন সমানভাবে হয়নি, পরিণামে যখন খ্রিস্টান দক্ষিণাঞ্চল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাক্ষী হয়েছে, তখন এটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তরাঞ্চলে অনুপস্থিত ছিল। সম্পদের ব্যাপক আহরণ এবং অস্থায়ী উন্নয়ন মডেলগুলির উপস্থিতি সত্ত্বেও আফ্রিকার বেশিরভাগ অংশ চরম জলবায়ু, দুর্ভিক্ষ, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৬০-এর দশক থেকে, চাদ লেক ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে, এর অববাহিকায় যাদের বাস করে তাদের জীবিকা এবং জীবনযাত্রার অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। ফলস্বরূপ, উত্তর নাইজেরিয়া মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছে, যার ফলে অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ধরনের চরম অবস্থা প্রায়শই মৌলবাদের উত্থানের দ্বারা প্রতিফলিত হয় এবং সরাসরি বোকো হারাম গোষ্ঠীর প্রভাব বৃদ্ধির সাথে যুক্ত করা যেতে পারে।
২০০২ সালে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সাত বছর নাইজেরিয়ার সরকারের এটিকে উপেক্ষা করার নীতি আপাতভাবে যথেষ্ট শান্তিবাদী বলে মনে হয়েছিল। যদিও শুরু থেকেই বোকো হারাম ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের বিরুদ্ধে ছিল; একে তারা দুর্নীতি, খ্রিস্টান-আধিপত্য এবং পশ্চিমা প্রভাবের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। ২০০৯ সালে, এই গোষ্ঠী এবং নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের কালে বোকো হারাম নেতা মুহাম্মদ ইউসুফ আটক অবস্থায় বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়। এই ঘটনাটি বোকো হারামের রাষ্ট্রের প্রতি পূর্ব-বিদ্যমান শত্রুতাকে সহিংসতার প্রকৃত অজুহাতে রূপান্তরিত করে। সংগঠনের হামলা আরও নিয়মিত এবং নৃশংস হয়ে ওঠে। নাইজেরিয়া এবং প্রতিবেশী দেশগুলিতে অনেক বেসামরিক মানুষজন, মুসলিম এবং খ্রিস্টান উভয়ই, হত্যার শিকার হয়। নাইজেরিয়া ছাড়াও, বোকো হারাম যে দেশগুলিতে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে নাইজার, বুর্কিনা ফাসো, চাদ এবং ক্যামেরুন। ২০১৪ সালে, গোষ্ঠীটি তার নাম পরিবর্তন করে ওয়িলায়াত গারব ইফ্রিকিয়াহ (আরবিতে ‘ইসলামিক স্টেটের পশ্চিম আফ্রিকা প্রদেশ’) রাখে যাতে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক ইসলামিক স্টেটের সাথে এর সম্পৃক্ততা প্রতিফলিত হয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে, ইসলামিক স্টেট আফ্রিকার বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত রয়েছে। আফ্রিকায় ইসলামিক স্টেটের বেশিরভাগ অগ্রগতি এই গোষ্ঠীগুলির কাজের মাধ্যমে ত্বরান্বিত হয়েছিল, বিশেষত সাহেল অঞ্চল এবং আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলে। এই অঞ্চলগুলি ইতিমধ্যেই আল-কায়েদার মতো গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত ছিল। সেনেগাল থেকে ইরিত্রিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত, সাহারা থেকে উত্তরে এবং আফ্রিকার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল থেকে দক্ষিণে অবস্থিত, সাহেল অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর, জটিল নিরাপত্তা এবং মানবিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। শতাব্দী ধরে, সাহেল একটি সভ্যতার মহাসড়ক ছিল। পূর্বদিকে অভিবাসনের রুটগুলি বেশ কয়েকটি প্রাক্-ঔপনিবেশিক রাজ্য, নাইজার নদী বরাবর মালি এবং সোঙ্গাই সাম্রাজ্য, চাদ হ্রদের চারপাশে বর্নু রাজ্য, পূর্ব চাদের ওয়াদ্দাই সুলতানাত এবং বর্তমান সুদানের দারফুর সুলতানাতকে সংযুক্ত করেছিল। তীর্থযাত্রীরা মক্কায় পৌঁছানোর জন্য এই পথই অনুসরণ করত। ইতিহাসের বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে, পশ্চিম আফ্রিকার ফুলানি এবং হাউসা সম্প্রদায়ের প্রায় সম্পূর্ণ অংশই একটি উন্নত জীবনের সন্ধানে পূর্বদিকে অভিবাসন করে। এরা এখন ইথিওপিয়ার সীমান্ত বরাবর পূর্ব সুদানের প্রধান জাতিগত গোষ্ঠী। এদের সঙ্গে উদার ধারণাগুলিও সর্বত্র বিস্তার হয়েছিল। পশ্চিম আফ্রিকার সুফি পণ্ডিতরা সাহেল বেল্ট বরাবর সুদান পর্যন্ত প্রচুর সংখ্যক অনুসারী তৈরি করেছিলেন। আজ অবশ্যই, পশ্চিমা কৌশলীরা এই জটিল ইতিহাসগুলিকে উপেক্ষা করতে পছন্দ করেন, সাহেলকে কেবল একটি দুর্ভাগ্যজনক, শুষ্ক, দারিদ্র্যপীড়িত যুদ্ধের মঞ্চ হিসাবে দেখেন, যেখানে তাদের মিত্ররা জিহাদিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে।
তবে, এটাও সত্য যে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বিশেষ করে ২০০০-এর দশকের শুরুর দিক থেকে, মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলির তীব্র সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছে সাহেল অঞ্চল। অস্থিতিশীল সরকার এবং মৌলবাদী গোষ্ঠী ও সরকারি বাহিনীর মধ্যে চলমান সংঘাত এই অঞ্চলকে দারিদ্র্য ও সংকটের গোলকধাঁধায় ফেলেছে। এটিই সম্ভবত এই অঞ্চল থেকে এই গোষ্ঠীগুলিতে উচ্চ সংখ্যায় নিয়োগের কারণ। তদুপরি, এই অঞ্চলটি পশ্চিমা এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশে উচ্চ মাত্রার বাস্তুচ্যুতি এবং অভিবাসনও দেখেছে। ২০১২ সালে লিবিয়ায় গাদ্দাফি শাসনের পতন এবং মালিতে তুয়ারেগ সংখ্যালঘুদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের সাথে সাথে এই অঞ্চলটি একটি রাজনৈতিক শক্তি শূন্যতার মুখোমুখি হয়েছিল। পরে এই শক্তি শূন্যতা মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলির দ্বারা পূরণ হয়। শুধুমাত্র ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠীই নয়, রাশিয়ান সরকারি অর্থপুষ্ট বেসরকারি মিলিশিয়া, ওয়াগনার গ্রুপও আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদে রাশিয়ার কবজা কায়েম করতে এখানে সক্রিয় থেকেছে। সাহেলের মতোই, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, জিবুতি, সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া এবং সুদানকে নিয়ে তৈরি আফ্রিকার হর্ন নামে পরিচিত অঞ্চলটিও ইসলামিক মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলির, বিশেষ করে আল শাবাবের বিদ্রোহ এবং সহিংসতার সাক্ষী থেকেছে। আল শাবাব সাম্প্রতিক অতীতে বেসামরিক নাগরিকদের উপর কিছু মরণঘাতী সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে, বিশেষ করে ২০১৩ সালের ওয়েস্টগেট মল হামলা এবং ২০১৫ সালে কেনিয়ার গারিসা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে হামলা, যেখানে বহু মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল।
এটা স্পষ্ট যে আফ্রিকায় ক্রমবর্ধমান মৌলবাদের শিকড় এবং কাঠামো গভীরে প্রোথিত। এটাও স্পষ্ট যে চলমান সহিংসতা দারিদ্র্য এবং উন্নয়নহীনতার একটি আবর্তনের মধ্যে এনে ফেলেছে যা ইতিমধ্যেই সবচেয়ে সংবেদনশীল প্রান্তিক মানুষদের প্রভাবিত করেছে। ২০১৪ সালে আল জাজিরার জন্য লেখা নিবন্ধে, জেসিকা হর্ন চিবোকে বোকো হারামের স্কুলছাত্রীদের অপহরণের আংশিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে মৌলবাদী সহিংসতার লৈঙ্গিক প্রকৃতির উপর জোর দেন। হর্ন লিখেছেন, ‘গত দশকে ধর্মীয় মৌলবাদীরা আফ্রিকা অঞ্চল জুড়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য নারীর অধিকারকে “নরম লক্ষ্য” হিসাবে ব্যবহার করেছে।’ সশস্ত্র সংঘাত এবং ধর্মীয় ও জাতিগত মৌলবাদের সম্মিলন প্রায়শই নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে নাটকীয়ভাবে খাদের কিনারে এনে ফেলেছে। যৌথ পরিচয়ের সংজ্ঞা লিঙ্গের প্রতি একটি দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিয়েছে, যেখানে মুসলিম বা খ্রিস্টানদের দেহাবয়ব এবং আচরণের ধারণা নিহিত রয়েছে। এটি আংশিকভাবে, যৌনতা এবং নারীদের জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলিকে প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রণ করার উপর জোর দেয়। এটি বিশেষ ক্ষেত্রে পুরুষদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা হ্রাস করতেও পারে, যার প্রতিক্রিয়ায় পরিবারে নারীদের নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছাকে শক্তিশালী করতে পারে। জাতীয়তাবাদ, জাতিসত্তাগত এবং ধর্মীয় ধারণাগুলিও মৌলবাদী ধারণার আদলে পিতৃতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ বলবৎ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। স্বভাবতই সাধারণ নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, যেকোনও মৌলবাদী শক্তি শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়, তেমন আফ্রিকাতেও বেশ কয়েকটি নারীবাদী আন্দোলন সমানভাবে রাষ্ট্রীয় এবং অতিরাষ্ট্রীয় পিতৃতান্ত্রিক আস্ফালনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য উঠে এসেছে। এখানে উদাহরণ হিসাবে, সাবা মাহমুদের পলিটিক্স অফ পিটি: দ্য ইসলামিক রিভাইভাল অ্যান্ড দ্য ফেমিনিস্ট সাবজেক্ট–এর চমৎকার কাজকে উল্লেখ করা যায়। তিনি তালিকা করে দেখিয়েছেন, কায়রোতে মিশরীয় নারীরা কীভাবে তাদের পরিচিতি খুঁজে পায় এবং কীভাবেই বা প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর মধ্যে কাজ করতে করতে তারা পিতৃতন্ত্রের বিরোধিতা করে।
২০১২ সালের একটি সাক্ষাৎকারে, নাইজেরিয়ান নোবেল বিজয়ী ওলে সোয়িঙ্কা বলেছিলেন ‘মৌলবাদ আসলে একটা অসুখ । আমি এটাকে এইচআইভির মতো একটা বিপজ্জনক ভাইরাস হিসাবে বিবেচনা করি। এইচআইভি এইডস যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তা অচিরেই অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। মৌলবাদও ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন প্রকৃতিতে আধ্যাত্মিক এবং মানসিক অসুখ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।’ সোয়িঙ্কার কথাগুলি যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহী কারণ তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে মৌলবাদ একবার জেগে উঠলে তা ছড়িয়ে পড়তে এবং ধ্বংসলীলা চালাতে বাধ্য। তবে, এই ধরনের শক্তিকে প্রতিহত করতে হলে তাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে। যেমন, আফ্রিকার ক্ষেত্রে সেখানকার ইতিহাসের স্তরগুলি উন্মোচন করে এবং প্রতিটি ঘটনার কার্য–কারণকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।