ধর্মীয় মৌলবাদ ও আজকের নারী-আন্দোলন 

মালিনী ভট্টাচার্য 

‘মৌলবাদ’ কথাটির  ব্যাখ্যাবিশ্লেষণে এখানে যাব না। অবশ্যই কথাটি আসে বিশুদ্ধতার ধারণা থেকে, এবং কোনো একটি ধর্মের খাঁটি চেহারাসম্বন্ধে বদ্ধমূল সংস্কারকেই আমরা সাদাকথায় ধর্মীয় মৌলবাদ বলে চিহ্নিত করে থাকি। একে সংস্কার এইজন্যেই বলছি যে যদি কোনো  সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মুখ থেকেও ধর্মের অনাদি বচন নিঃসৃত হয়ে থাকে, তা আমাদের বোধের আওতার বাইরে। আর সমাজে তার যাঁরা ধারক ও বাহক তাঁরা তার শুদ্ধতা হুবহু রক্ষা করছেন কিনা তাও আমাদের জানার উপায় নেই। নইলে তার নানারকম ব্যাখ্যা হয় কেন?

যাই হোক, আমাদের দেশে নারী আন্দোলনের ইতিহাস মোটামুটি নানাবিধ ধর্মীয় মৌলবাদ— বিশেষভাবে হিন্দু ও ইস্লামিক মৌলবাদের মধ্যে— যে লিঙ্গ-অসাম্যের ছক রয়েছে তার বিরোধিতা করেই সামনে এগিয়েছে। আমাদের সংবিধানে মেয়েদের সমানাধিকার স্বীকৃত। কিন্তু সমাজে এখনো ধর্মীয় মৌলবাদের প্রভাব থেকেই যাচ্ছে। যাকে ‘পারিবারিক আইন’ বলা হয় সবার ধর্মাচরণের সম-অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়াই তার উদ্দেশ্য। আবার একথাও সত্য যে সংসারে মেয়েদের অবস্থানকে দীর্ঘদিন মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা হয়েছে বলে সবরকম পারিবারিক আইনের মধ্যেই তাদের প্রতি কিছু অবিচার ঘটছে, যা সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতির বিপরীতে যাচ্ছে। অতএব নারী-আন্দোলনের গতিমুখ থাকবে এইসব অবিচার দূর করার দিকে। 

আজকের দিনে যখন এত লড়াইয়ের পরেও আমরা দেখছি এদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের প্রভাব কমতির দিকে না গিয়ে বরং বাড়তির দিকেই যাচ্ছে, তখন তার নতুন আকৃতিগুলি নারী-আন্দোলনের কতগুলি বিষয়কেও জটিলতর রূপ দিচ্ছে। আমাদের দীর্ঘদিনের অবস্থানগুলিকে আরও গভীরে গিয়ে যাচাই করতে হচ্ছে, আমাদের রণকৌশলকে নতুন চিন্তার নিরিখে সাজাতে হচ্ছে, যদিও নারী-আন্দোলনের রণনীতির ক্ষেত্রে কোনো সমঝোতা হতে পারে না। এই পরিস্থিতির দু-তিনটি উদাহরণ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করাই বর্তমান নিবন্ধটির উদ্দেশ্য। 

কয়েকবছর আগে কর্ণাটকে বিজেপি-র সরকারের আমলে হঠাৎ করেই কয়েকটি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে মুসলিম পড়ুয়াদের হিজাব পরে কলেজে আসা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল। তারও কিছু আগে ইরানে মৌলবাদী সরকারের বিরুদ্ধে এক বিপুল গণবিক্ষোভ হয়েছিল মাহসা আমিনি নামে কুর্দ জাতিগোষ্ঠীর একটি ২২ বছরের মেয়ে হিজাব না পরে বাইরে বেরোনোর অপরাধে ইরান সরকারের ‘নীতিরক্ষক পুলিশে-র হাতে গ্রেফতার হলে এবং হেফাজতে তার অপমৃত্যু হলে। ইরানের মেয়েরা প্রকাশ্যে হিজাবের বহ্ন্যুৎসব করে এবং লম্বা চুল কেটে ফেলে অপমানজনক এই নজরদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। অনেক পুরুষও তাদের  প্রতিবাদে শামিল হন। 

কর্নাটকের হিন্দুত্ববাদী সরকার এবং আর এস এস সেই নজির তুলে প্রমাণ করতে চাইল মুসলিমমাত্রেই মৌলবাদী ও ধর্মান্ধ। কলেজ-পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা তাই নারী-মুক্তির সপক্ষে মুসলিম মৌলবাদের বিরুদ্ধে এক আপসহীন পদক্ষেপ। এটাও তাদের বক্তব্য ছিল যে কলেজে হিজাবের ব্যবহার অনুমোদন করা ‘মুসলিম-তোষণে’-র একটি উদাহরণ এবং বিদ্যায়তনে সবার অভিন্ন পোষাকের নিয়মের ব্যত্যয়। হিজাব, বোরখা, ঘুংঘট ইত্যাদি যে-প্রথাগুলি মেয়েদের বাইরের জগতে স্বচ্ছন্দে চলাফেরার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে নারী-আন্দোলন সবসময়েই তার বিরোধিতা করেছে। আমাদের দেশেও বাইরের জগতের কাজে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে মুসলিম সমাজের মেয়েরা নিজেরাই হিজাব/ বোরখার ফতোয়াকে অস্বীকার করেছেন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখায় তার যথেষ্ট প্রমাণ পাই আমরা। তবে এমন সব বিধান এদেশে বিশেষভাবে ইসলামিক সংস্কৃতির অবদান নয়। 

অনেক প্রাচীন কালেও বড়ো ঘরের অন্তঃপুরিকারা অসূর্যম্পর্শ্যা ছিলেন তার প্রমাণ আমাদের ইতিহাসে রয়েছে। আবার হিন্দু বিবাহিত মেয়েদের ভব্যতার চিহ্ন হিসাবেই আজও পরিগণিত হয় শাঁখাসিঁদুর। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মেয়েদের আচরণীয় এইসব বিশেষ প্রথা যে ঐ সমাজে তাদের তুলনায় হীন অবস্থার চিহ্ন তাতে সন্দেহ নেই। আবার এর একটি উলটো শ্রেণিগত দিকও রয়েছে; আধুনিক কালের একটি উদাহরণ, উনিশ শতকের গোড়ায় ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজার সেই কুখ্যাত হুকুমনামা যার বলে ঐ রাজ্যের দলিত নারীরা দেহের উর্ধ্বাংশ ঢাকার অনুমতি পেতেন বিশেষ একটি করপ্রদানের বিনিময়ে। অর্থাৎ, কোন্‌ মেয়ের ভব্যতার অধিকার আছে আর কার নেই প্রথাবদ্ধ সমাজে তাও ঠিক করার ভার সমাজের কর্তাব্যক্তিদের ওপরেই। নারী-আন্দোলন এধরনের বিভাজনের বিপক্ষে এই কারণেই যে মেয়েদের সমানাধিকারের একটি অর্থ অবশ্যই কীসে ভব্যতা বজায় থাকবে তা নিজেরা ঠিক করার অধিকার। 

সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে নানা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসবের কিছু পরিবর্তন হয়েছে, কিছু কিছু রয়ে গেছে। কিন্তু এর উলটো উদাহরণও রয়েছে। সাম্প্রতিক কালে ফ্রান্সে অভিবাসী মুসলিম মহিলারা হিজাবের বিরুদ্ধে সরকারি ফতোয়া মানতে অস্বীকার করেছেন সংখ্যালঘুর সাংস্কৃতিক অধিকারে হস্তক্ষেপের অভিযোগে। এতে একথাই প্রমাণিত হয় যে ওপর থেকে ফতোয়া দিয়ে সমাজসংস্কার করা যায় না, বরং সংখ্যালঘুর মনে তা সন্দেহের জন্ম দেয়, সেই সমাজের কট্টরপন্থীদেরই প্রভাববিস্তারের সুবিধা করে দেয়। কর্ণাটকে হিজাবের ক্ষেত্রেও নারী-আন্দোলনকে ভাবতে হয়েছে সরকারের প্রচারিত প্রগতিশীলতার বিপরীতে এর প্রকৃত সামাজিক ফলটা কী। 

অনেক ছাত্রী এদের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন ছিল যারা তাদের সমাজের প্রথম প্রজন্মের কলেজ-পড়ুয়া। অনেকের অভিভাবকেরা হয়তো অনেক দোমনার পরেই এদের লেখাপড়া করতে পাঠাচ্ছিলেন। তাঁদের একটি বড়ো অংশ হিজাব-ছাড়া ছাত্রীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢোকার অনুমতি না পাওয়ায় তাদের কলেজ থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। যারা লেখাপড়া করে বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেত, হয়তো নিজেরাই নিজেদের জীবনের হাল ধরতে প্রস্তুত হত, তারাই বাড়িতে বসে থাকার দণ্ডে দণ্ডিত হল। তদুপরি নিঃসন্দেহে তাদের রাষ্ট্র ঠেলে দিল সেই গোঁড়া মোল্লাদের আওতায় যারা প্রথম থেকেই মেয়েদের স্কুলকলেজে গিয়ে পড়াশুনো করা দুচক্ষে দেখতে পারে না। হিজাব ইসলামের আবশ্যিক অঙ্গ কিনা তা নিয়ে সম্প্রদায়ের মধ্যেই দ্বিমত থাকলেও কট্টরপন্থী মতের প্রাধান্য প্রচার করার সুযোগ রাষ্ট্রই করে দিল।   

একটি বিষয়কে তার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে  সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা আর এস এস-বিজেপির অনেক পুরোনো কায়দা। এই প্রচারের জবাব দেওয়া তাই আমাদের পক্ষে জরুরি। এমন অনেক প্রগতিশীল মানুষও আছেন যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার যুক্তিতে হিজাব পরে কলেজে আসাকে যতটা অস্বস্তিকর মনে করেন ততোটাই করেন মন্দির থেকে টিকাতিলক ধারণ করে কবচমাদুলি পরে হিন্দুর বা মাথায় পাগড়ি পরে শিখ ছাত্রের কলেজে আসার বিষয়গুলিকে। কিন্তু প্রশ্ন কলেজপ্রাঙ্গণে শেষোক্তগুলোকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কোনো ছাত্রের শিক্ষার অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করতে পারবেন কী? স্কার্টব্লাউজ/ শাড়ি/ সালোয়ার-কামিজের সুবিধামতো বৈকল্পিক ব্যবহার ইউনিফর্মের নামে বন্ধ করতে পারবেন কী?    

যাঁরা মনে করেন ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ দেবার দায় থেকে সংখ্যালঘুদেরও ছাড় পাওয়া উচিত নয় তাঁদের একটু মনে করাতে চাই যে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার দায় অর্পণ করা হয়েছে ব্যক্তিকে নয়, রাষ্ট্রকে। এবং রাষ্ট্রের কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি ঝোঁক থাকা চলবে না এই কারণেই, যাতে প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় বিশ্বাসপালনের অধিকারকে রাষ্ট্র সুরক্ষিত রাখতে পারে। বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুর ধর্মীয় অধিকারকে রক্ষা করার বিশেষ দায় সবসময়েই থেকে যায়। সম্প্রদায়ের ভিতর থেকে যেখানে ধর্মীয় সংস্কারের দাবি উঠছে সেখানে তার প্রতি রাষ্ট্রকে নিশ্চয়ই সহানুভূতিশীল হতে হবে। কিন্তু কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্র যখন জবরদস্তি সংখ্যালঘুর কোনো আচার-আচরণকে সংশোধন করতে চায় তখন সেখানে সংখ্যালঘুর পশ্চাদ্‌পদতার চাইতে রাষ্ট্রের অভিসন্ধির প্রশ্নটাই বড়ো হয়ে দাঁড়ায় না কী?

একটি মেয়ে যখন শাঁখাসিঁদুর পরে বা বাইরে বেরোনোর সময়ে হিজাব লাগায় তখন তার গূঢ় কারণ যাই হোক, সে বলতেই পারে সে ধর্মীয় চোখরাঙ্গানির ফলে বা মজ্জাগত পারিবারিক অভ্যাসের ধারাবাহিকতায় তা করছে না, নিজের মনের খুশিতেই করছে। সেখানে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের জায়গা কোথায়? আবার এইসব কিছুর বাইরে গিয়ে যদি সে নিজস্ব ইচ্ছাতেই এই আচারগুলিকে ত্যাগ করে এবং তার জন্য সমাজের কাছে লাঞ্ছিত হয় তাহলে রাষ্ট্রের অবশ্যই একটা দায় জন্মায় তার স্ব-নির্বাচনকে নিরাপত্তা দেবার। কিন্তু হিজাব পরার অজুহাতে তাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকতে না দিয়ে রাষ্ট্র যদি ধর্মনিরপেক্ষতার ঢাক বাজায় তাহলে তার বিরোধিতা করা সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষেরই কর্তব্য। নারী-আন্দোলনের কর্মীরা মেয়েদের স্বাধীন চলাফেরার প্রতিপন্থী যে-কোনো ফতোয়ার বিরোধী হলেও এক্ষেত্রে মেয়েদের শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নটিকেই তাদের প্রচারের মূল বিষয় করতে হয়েছে। 

আমার দ্বিতীয় উদাহরণ, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের সংবিধানের ৪৪ ধারায় প্রস্তাবিত ‘সমান দেওয়ানি বিধি’ চালু করার উদ্যোগসমূহ। কেন্দ্রীয়ভাবে এটা করার পথে বাধা থাকায় বিজেপি-পরিচালিত রাজ্যগুলিতে তারা ইতিমধ্যেই তা করতে শুরু করেছে, যেমন উত্তরাখণ্ডে। পারিবারিক আইনগুলির বৃহৎ অংশ জুড়ে আছে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব ও যৌথ সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা নিয়ে আচরণীয় বিধিব্যবস্থার কথা। বিভিন্নধরনের ধর্মীয় মৌলবাদের প্রভাব বহাল থাকায় যে অবধারিত লিঙ্গ-অসাম্যের কাঁটা সেগুলির মধ্যে থেকে গেছে তা আগেই বলেছি আর আমাদের নারী-আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব যে বরাবরই এই পারিবারিক বিষয়গুলিতেও মেয়েদের সম-অধিকাররক্ষার দাবি মেয়েদের মধ্য থেকেই উঠেছে।    

কিন্তু বর্তমান সময়ে যখন শাসকদলের কাছে এদেশের মুসলিমসম্প্রদায় ‘বহিরাগত’ এবং ‘অপর’ পরিচয়ে চিহ্নিত হচ্ছে এবং অহরহই ‘সংখ্যালঘুতোষণ’ বন্ধ করে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার নামে তাদের ওপর নানাবিধ আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে, তখন সেই পরিস্থিতিতে ‘সমান দেওয়ানি বিধি’ বলতে সংবিধান কী বুঝিয়েছে, নারী-আন্দোলনে সেই দাবি কীভাবে উঠেছে তার আরও গভীর বিশ্লেষণ দরকার হয়ে পড়ে। সংবিধানের ৪৪ ধারা পরিবারের মধ্যে ধর্মীয় আচার-আচরণ তুলে দিয়ে সমান দেওয়ানি বিধি চালু করার কথা  বলেনি। বরং ভারতীয় আইনব্যবস্থার ইতিহাস দেখায় পারিবারিক আইনগুলির মধ্যে ন্যায়ের যে ঘাটতি আছে (বিশেষত মেয়েদের প্রতি) তার প্রতিকারে পারিবারিক আইনের পাশাপাশিই বিভিন্ন সময়ে কিছু প্রগতিশীল আইন তৈরির সুযোগ কীভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। 

আমাদের দেওয়ানি আইনের অনেকটা ও ফৌজদারি আইনের সবটাই ধর্মনিরপেক্ষ। তার সঙ্গে নানাসময়ে সামাজিক আন্দোলন বা নারী-আন্দোলনের সঙ্গে তাল রেখে এসেছে সিভিল বিবাহ আইন (১৯৫৬), পণপ্রথাবিরোধী আইন (১৯৬১) বা গার্হস্থ্য হিংসা থেকে মেয়েদের সুরক্ষার আইন (২০০৫), যার সুবিধা ধর্মনির্বিশেষে সব মেয়েই পেতে পারে। আমরা মনে করি এই আইনগুলির প্রচার এবং সেগুলি কার্যকরী করার পদক্ষেপ যে-কোনো গণতান্ত্রিক সরকারের অবশ্যকর্তব্য। জাতধর্ম না মেনে বিয়ে-করা দম্পতিদের ওপর পারিবারিক সম্মানের নামে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয় তা বন্ধ করার জন্য একটি ধর্মনিরপেক্ষ আইনের খসড়া সরকারের গুমঘরে বেশকিছু বছর ধরে পড়ে আছে। আমরা মনে করি তা অবিলম্বে আইনে পরিণত হওয়া দরকার। 

ডানিয়েল লতিফির মতো আইনবিদ‌ জানিয়েছেন যে মুসলিম মৌলবাদের তোষণে রাজীব গান্ধির আমলে যে মুসলিম মহিলা আইন প্রণীত হয়েছিল তারপরেও সে আইনে মুসলিম মেয়েরা ন্যায্য খোরপোশ থেকে বঞ্চিত হলে তাদের ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৫ ধারা অনুযায়ী সেই সুবিধা দেওয়া সম্ভব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা করাও গেছে। নারী-আন্দোলন এবং বামপন্থী দলগুলি সেসময়ে তবু ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে এই  নতুন আইন করার প্রবল বিরোধিতা করেছিল। সে আন্দোলনে এগিয়ে এসেছিলেন বহু মুসলিম মহিলা এবং পুরুষও। কিন্তু যে বিজেপি সরকার কিছুদিন আগে বিতর্কিত মুসলিম মহিলা আইন রদ করেছে বলে বাহ্বাস্ফোট করছিল তারা ধর্মনির্বিশেষে স্বামীপরিত্যক্ত মেয়েদের ন্যায্য খোরপোশ পাবার জন্য কী আইনি ব্যবস্থা  নিয়েছে?  

সেটা তো তারা করেইনি, বরং তারা তালাক-ই-বিদ্দৎ বা তাৎক্ষণিক তিন তালাক রদ করা-সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পালন করার নামে তিন তালাকের উচ্চারণকেই ফৌজদারি অপরাধে পরিণত করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে একটি আইন তড়িঘড়ি পাশ করিয়ে নিল। এটিও আমার বক্তব্যের আর-একটি উদাহরণ। আগের কোনো সরকার যে সংখ্যালঘু সমাজকে ছুঁতে পারেনি সেই সমাজের নারীকে পুরুষের অত্যাচার থেকে বাঁচাল ছাপান্ন ইঞ্চি ছাতি, এই প্রচার খুব চলল। কিছু মুসলিম মহিলাকেও জোগাড় করা গেল, যারা এ আইনে মামলা করে ফেললেন এবং জোর গলায় বলতে লাগলেন এ আইন তাঁদের বাঁচিয়েছে। মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হল নারী আন্দোলন ও প্রগতিশীল সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা তালাক-ই-বিদ্দৎ বিরোধী কার্যক্রমকে।  

সেই ইতিহাস এখানে একটু মনে করা যাক। তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা যে মেয়েদের চূড়ান্ত দুর্দশার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে এমনই কয়েকটি মেয়ের হয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেই কিছু সংস্কারকামী সংস্থা, প্রতিবাদী মেয়েদের কিছু সংগঠন, কিছু শরিয়তি আইনবিশেষজ্ঞ মানুষ এই মেয়েদের সাহায্য করেন মামলাগুলি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে। ২০১৭ সালের ঐতিহাসিক রায়ে যে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত তালাক-ই-বিদ্দৎ বা তাৎক্ষণিক তিন তালাককে রদ করল, তার কৃতিত্ব কারো প্রাপ্য হলে তা এইসব প্রগতিশীল সংগঠন ও ব্যক্তির, যাঁরা অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের স্বঘোষিত অভিভাবকত্ব, মুসলিম সমাজের কট্টরপন্থীদের চোখরাঙানি অগ্রাহ্য করে ভারতে প্রচলিত এই কুপ্রথা দূর করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। 

তখনও শাসকদলে মুসলিম নারীকে নিয়ে সহানুভূতির এই বান ডাকেনি। সুপ্রিম কোর্ট তাদের একটি হলফনামা পেশ করতে বলার পরেই সরকার জানিয়ে দেয় যে আদালতের রায়ে যদি তাৎক্ষণিক তিন তালাক বাতিল হয় তাতে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এটা তাদের মঞ্চে নামার একটা সুযোগও করে দিল। এর অল্পদিন পরেই তারা ল’ কমিশনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ অবান্তর একটি প্রশ্নমালা তৈরি করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে জনমত যাচাইয়ের কাজে নেমে পড়ল যদিও এই প্রসঙ্গটি সুপ্রিম কোর্টের বিচার্য বিষয়ের মধ্যেই ছিল না। 

এটা তারা ভালোই জানত যখন তিন তালাক নিয়েই মুসলিম সমাজে বিতর্ক চলছে তখন যদি একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির আশঙ্কাকে জাগিয়ে তোলা যায় তাহলে ঐ সমাজের কট্টরবাদীরাই জো পেয়ে যাবে, এবং তিন তালাক রদ করার পক্ষে যারা লড়াই করছিলেন ধর্মবিরোধী বলে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। অর্থাৎ আদতে মুসলিম সমাজে কোনো অগ্রগামী সংস্কার হোক এটা বিজেপি বা আর এস এস চায় না। মোল্লাতন্ত্রের প্রভাব কমলে তাদের অসুবিধাই; ওরা পশ্চাদ্‌পদ, ওরা কট্টর বলে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ চাগিয়ে তোলার সুযোগ তাহলে কমে যাবে। যা সুপ্রিম কোর্টের বিধানে ইতিমধ্যেই রদ হয়ে গেছে তাকে ফৌজদারি বিধির মধ্যে টেনে এনে তার জন্য শাস্তিবিধান করা কি সুপ্রিম কোর্টের রায়কে অস্বীকার করা নয়?    

নারী আন্দোলনের চাহিদা শুধু একটি সম্প্রদায়ের মেয়েদের দুর্দশার নিরসনে আবদ্ধ ছিল না। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আমাদের একথা বুঝতে শিখিয়েছিল যে তালাক-ই-বিদ্দৎ মেয়েদের যে অসম্মান ও অসহায়তা ঘটায় তা সম্প্রদায়নির্বিশেষে বিবাহিত মেয়েদের প্রতি অবিচারের একটি বিশেষ উদাহরণমাত্র। আমাদের অভিজ্ঞতাতেই কি আমরা দেখি না লক্ষ লক্ষ হিন্দু মেয়েকে বিচ্ছেদের কোনো প্রস্তাবনা ব্যতিরেকেই স্বামীর দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে খোরপোশের ব্যবস্থাছাড়া সন্তানসহ নিতান্ত দুর্দশায় দিনগুজরান করতে? 

হিন্দু আইনে বহুবিবাহ সিদ্ধ নয়, তবু সেই স্বামীদের অনেককে বিবাহবিচ্ছেদ ছাড়াই দ্বিতীয় সংসার পাততেও দেখা যায়, কারণ তারা জানে যে প্রথম স্ত্রী এই নালিশ নিয়ে পুলিশের কাছে যাবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। অবলীলায় স্ত্রীত্যাগ যদি ফৌজদারি অপরাধ হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনের আওতায় কি মুসলিমধর্মাবলম্বী পুরুষ ছাড়া অন্যদেরও আসা উচিত নয়? না, মেয়েরা কিন্তু তেমন দাবি তোলেননি। হিন্দুমুসলিমনির্বিশেষে খোরপোশের আইন আরও সহজ হোক আরও সমতামুখী হোক, ঘর থেকে তাড়ানো-সহ নানাবিধ গার্হস্থ্য হিংসার থেকে মেয়েদের সুরক্ষা দেবার যেসব আইন আছে তার পরিকাঠামো আরও সবল হোক এটাই ছিল লড়াই।  

এও আশা করা হয়েছিল যে তালাক-ই-বিদ্দৎ রদ হয়ে যাবার পরে বিবাহবিচ্ছেদে মুসলিম মেয়েদের সম অধিকারের কথা মাথায় রেখে তালাকের পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে মুসলিম সমাজের মধ্যে এবং সাধারণভাবে জনাবর্তে আরও আলোচনা হোক, একটি স্বচ্ছ সুষ্ঠু পদ্ধতি তার থেকে বেরিয়ে আসুক। অন্যান্য মুসলিম-প্রধান বা ইসলামিক দেশে কীভাবে তালাকের প্রসঙ্গটি এসেছে, সেখানে এবিষয়ে কীধরনের আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, বা মেয়েরা কতোটা অধিকার পেয়েছেন এগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি সিদ্ধান্ত হোক। নারী-আন্দোলন থেকে এই দাবিও ওঠে যে অনুরূপভাবে বহুবিবাহপ্রথারও পর্যালোচনা করে সমাজের মধ্য থেকেই তা তুলে দেওয়ার দিকে এগোনো উচিত। আমাদের দেশে মুসলিম সমাজে এই প্রথা উঠে যাবার মুখে। তাহলে এর আইনি অনুমোদনের খোলসটুকু ধরে রাখার কী কারণ আছে মোল্লাতন্ত্রের মানসিক শান্তি রক্ষা করা ব্যতীত?  এখান থেকেই আবার ফিরব সমান দেওয়ানি বিধির প্রসঙ্গে। 

বিজেপি-আর এস এস সরকারের সমাজসংস্কারের বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে শরিয়তি আইনের দু-টি ধারাকে ঘিরে; একটি পুরুষের বহুবিবাহ-সংক্রান্ত এবং অন্যটি মেয়েদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স-সংক্রান্ত। দু-টি প্রথাই আপত্তিজনক এবং তার সংশোধন হওয়া উচিত। কিন্তু যাঁদের চোখে হিন্দু পারিবারিক আইনটিই প্রগতিশীল পারিবারিক আইনের মডেল তাঁদের কাছে প্রশ্ন: বর্তমানে যত মুসলিম একাধিক বিবাহ করেন তার সংখ্যা কি এক স্ত্রী পরিত্যাগ করে যত হিন্দু দ্বিতীয়ার সঙ্গে সংসার পাতেন তার চেয়ে বেশি? সব মুসলিম মেয়েরই কি পনেরো বছর বয়স হলেই বিয়ে হয়ে যায়? না অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে-থাকা অশিক্ষিত হিন্দু-মুসলিম সব পরিবারেই মেয়েদের ছোটোবয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়াটা একটা অভিশাপ? তাহলে গোড়ার কারণগুলিকে দূর করার ন্যূনতম চেষ্টা বাতিল করে মুসলিমদের মৌলবাদ ও ‘মজ্জাগত’ পশ্চাদ্‌পদতাকেই মেয়েদের সব দুঃখদুর্দশার মূল বলে চিহ্নিত করে সমান দেওয়ানি বিধির জয়গানে গলা মেলানোর বদলে বিষয়টিকে তার সামগ্রিকতাতেই দেখা উচিত নয় কি? সমান দেওয়ানি বিধি চালু হলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের নিজস্ব ধর্মাচরণগুলির কী হবে সেপ্রশ্নই বা সরকার এড়িয়ে যাচ্ছে কেন? 

বিজেপি দেওয়ানি বিধির ব্যাপারে আসর গরম করতে শুরু করার আগে থেকেই নারী-আন্দোলনের বক্তব্য ছিল,  সম্প্রদায়নির্বিশেষে দেশের সমস্ত মানুষের ওপর একই দেওয়ানি বিধি চাপিয়ে দিলেই যে পরিবার ও সমাজের মধ্যে নারীপুরুষের মধ্যে বৈষম্যের অবসান ঘটবে তা নয়। সংবিধানের ৪৪ ধারার প্রতিপাদ্যও তা ছিল না। পরিবারের ভিতর বৈষম্যের অবসানে চাই ‘সম অধিকার সম আইন’। তার মানে এই যে, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব, দত্তকগ্রহণের নিয়ম ও সম্পত্তির বাঁটোয়ারা এই সব ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্মের পারিবারিক আইনগুলিতে মেয়েদের প্রতি বিভিন্নধরনের বৈষম্য আছে তা কাটিয়ে সংবিধানে উল্লিখিত অধিকারগুলিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। 

প্রতি সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে ‘সম অধিকারে’-র বিষয়টি মাথায় রেখে বৈষম্যমূলক প্রথাগুলির সংস্কারের উদ্যোগ তারা নিজেরাই যদি নেয় তাহলেই শুধু একাজ করা যাবে। এটা শুধু মেয়েদের ব্যাপার নয়, ঐ সমাজে যাঁরা আগুয়ান, যাঁরা প্রভাবশালী তাঁদেরও কাজ। এর তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব দেখা না গেলেও এটা যে নেহাত নারীসংগঠনগুলির দিবাস্বপ্ন ছিল না তার প্রমাণ পরবর্তী সময়ে সুপ্রিম কোর্টে তিন তালাকের মামলাগুলি। মুসলিম সমাজের ভিতর থেকে সংস্কারের প্রচেষ্টাই তাতে ফলিত। এবিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় এই প্রচেষ্টার পক্ষেই গিয়েছিল। কিন্তু রায়ের সম্ভাব্য সুফলকে বিজেপির আনা ফৌজদারি আইন বিশ বাঁও জলে ঠেলে দিয়ে মুসলিম মহিলাদের জন্য একটি অপ্রাসঙ্গিক আলাদা পদক্ষেপের মাধ্যমে মুসলিম কট্টরপন্থীদের প্রতিক্রিয়াকেই উজ্জীবিত করল। 

সংবিধানের ৪৪তম ধারাটি নির্দেশক নীতিগুলির অন্তর্ভুক্ত; তা কাম্য বলে স্বীকৃতি পেলেও এখনই রাষ্ট্রের দ্বারা অবশ্যপালনীয় এমনটা নয়। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বলতে বিজেপি যা বোঝায় সংবিধানরচয়িতাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে তা মেলেও না। বস্তুত বিজেপি এই ভ্রান্ত ধারণারই প্রচার চায় যে বিগত পঞ্চাশের দশকে যেহেতু হিন্দু পারিবারিক আইনের কিছু সংশোধন হয়েছিল যা শরিয়তি আইনে সেসময়ে করা যায়নি, সেইহেতু প্রথমটিই এখন রাষ্ট্রের আদর্শ হওয়া উচিত এবং সেই আদর্শটিকেই মুসলিম সমাজের ওপর চাপিয়ে দিতে হবে। এই ‘আদর্শ’ আইন যে সংশোধনের পরেও অভিভাবকত্ব, দত্তকগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়ে লিঙ্গবৈষম্য থেকে মুক্ত নয়, এর মধ্যে যে এখনও বিবাহকালে কন্যার সম্মতি গ্রহণের বা বিবাহোত্তর সম্পত্তিতে স্ত্রীর স্বাভাবিক অধিকারের ধারণাটিই নেই, হিন্দুত্ববাদীরা তা কখনোই স্বীকার করতে রাজি হবে না।       

তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে গেছে যে সেসময়ে বিজেপি-আর এস এস-এর পূর্বসূরি জনসংঘ এবং তাদের আরাধ্য নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হিন্দু পারিবারিক আইনের সংশোধনে, বিশেষত বিবাহবিচ্ছেদকে আইনি স্বীকৃতি দেবার প্রস্তাবে, হিন্দুধর্ম লোপ পাবে এই জিগির তুলে তা ঠেকানোর লক্ষ্যে বহু চেষ্টা করেছিলেন যার ফলে আম্বেদকরের আমলে তা পাশ করানো যায়নি। সেদিনের গণতান্ত্রিক শিশুরাষ্ট্রের কাছে সন্ত্রস্ত সংখ্যালঘু মানুষকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়াটা প্রাথমিক ছিল বলেই সেই মুহূর্তে শরিয়তি আইন সংশোধন করা মুলতুবি রাখা হয়েছিল এটা বিজেপি আর এস এস-এর মতো কর্তৃত্ববাদী শক্তির কাছে বোধগম্য না হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ ভারতে তখন সংখ্যালঘু মানুষকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে শান্তি ফেরানো গিয়েছিল আর পাকিস্তানে ভাষাগত সংখ্যালঘুদের সন্ত্রস্ত রাখার চেষ্টা যে পরে সেই রাষ্ট্রকেই দ্বিখণ্ডিত করেছিল, এতো আমরা চোখের ওপরেই দেখলাম। আবার এটাও মানতে হবে যে হিন্দুসম্প্রদায়ের মধ্যে মুক্তিমনস্ক নারীপুরুষের একটি শক্তিশালী পরিসর থাকাতেই শেষপর্যন্ত হিন্দু কোড বিল পাশ করানো গিয়েছিল।  

স্বাধীন দেশের প্রথম মন্ত্রীসভা থেকে আম্বেদকরের একটি সাধারণ বিবাহবিধি চালু করার প্রস্তাবটি কয়েক বছর পরে Special Marriage Act পাশ হওয়ার মধ্য দিয়ে  আংশিক সাফল্য পায়। তার মধ্যে স্পষ্টভাবে হদিস মেলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির অন্তঃসারটিকে সংবিধানপ্রণেতারা কী চোখে দেখেছিলেন। হিন্দুত্ববাদীরা এবং কংগ্রেসের মধ্যে তাঁদের অনুগামীরা সংসদে এ আইনকেও রুখে দেবার অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু একে আমরা বলব প্রকৃত ‘অভিন্ন বিধি’-র একটি প্রাথমিক উদাহরণ। জাতিবর্ণনির্বিশেষে প্রাপ্তবয়স্ক নারীপুরুষ পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে এ আইনে কোনো ধর্মীয় আচার পালন না করেই। এর উদ্দেশ্য কেউ যদি নিজের সম্প্রদায়ের প্রথাগুলির বদলে ধর্মনিরপেক্ষ পদ্ধতিতে বিবাহকেই বেছে নিতে চায় তাহলে তার সেই অধিকার সুনিশ্চিত করা। বিজেপি-শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের নারীপুরুষের ঐচ্ছিক বিবাহ ঠেকাতে নানা নতুন শর্তের আরোপ করে যে আদর্শ আইনটিকে অর্থহীন করে দেবার চেষ্টা চলছে।

এদেশে মুসলিম মৌলবাদের বৃদ্ধি নিয়ে যাঁরা শঙ্কিত, উপরের উদাহরণগুলি থেকে তাঁদের আমি একথাই বলতে চাই যে এর একটি বড়ো কারণ হিন্দু মৌলবাদের ভয়। সেটা এদেশে বরাবরই ছিল, ইসলাম-সহ সব ধর্মের মৌলবাদের মতোই অনিবার্যভাবে তারও নানা রূপ ছিল, শৈবপন্থী, বিষ্ণুপন্থী, রামপন্থী ইত্যাদি। তাদের নিজেদের মধ্যে মাথা-ফাটাফাটিও কম ছিল না। এইসব পন্থাভুক্ত মহন্ত-মঠাধীশদের একাংশ এখন আর এস এস-এর কুক্ষিগত। আবার অনেকে তাদের বিরোধীও বটে। কিন্তু আর এস এস নিজেদের হিন্দুত্বের একচেটিয়া অধিকারী মনে করলেও তাদের হিন্দু মৌলবাদী না বলে রাজনৈতিক মৌলবাদী অর্থাৎ ফ্যাসিবাদীই আমি বলব। থাকবন্দি সমাজে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রই তাদের হিন্দুরাষ্ট্র। তাদের কল্পিত রাষ্ট্রকে এমনকী ভারতের সব হিন্দুর রাষ্ট্রও বলা যাবে না। সংঘপরিবারের এই অধিকতর বিপজ্জনক আধুনিক  মৌলবাদ মেয়েদের ও সংখ্যালঘুদের পক্ষেই নয়, সব গণতান্ত্রিক মানুষের পক্ষেই আজ নতুন সংকট ডেকে আনছে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান