অনিরুদ্ধ আকাশ
সলতে পাকানোর আগে
কী ঘটেছে? যা ঘটেছে তা খুবই সরল। জনসংখ্যার যে অংশটি নৃশংস এবং মূর্খ (এবং এই দু-টি গুণ সাধারণত একসঙ্গে থাকে), তারা বাকিদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে। হত্যা, নির্যাতন, কারাবাস এবং সশস্ত্র বাহিনীর সন্ত্রাসের মাধ্যমে তারা জাতির বুদ্ধিমান ও মানবিক অংশকে দমন করেছে এবং ফাদারল্যান্ডের গৌরব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ক্ষমতা দখল করেছে।
(১৯৩৩-এর জার্মানি সম্পর্কে বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর ‘মূর্খতার জয়’ প্রবন্ধে।)
জুলাই ২০২৪-এ বাংলাদেশে সংঘটিত কোটা ব্যবস্থা-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো অপ্রত্যাশিত বা ক্ষণস্থায়ী ঘটনা নয়; বরং এটি একটি সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিক পরিণতি। এই আন্দোলনের বীজ নিহিত রয়েছে প্রায় তিন দশক পূর্বে, এক সুচিন্তিত ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনার গর্ভে। বর্তমান সময়ের একদফা সরকার-বিরোধী আন্দোলন, অথবা তার পূর্ববর্তী নয় দফা আন্দোলন এবং সাম্প্রতিক অন্যান্য ছাত্র আন্দোলনের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে হলে আমাদের অবশ্যই ইতিহাসের পাতায় ফিরে তাকাতে হবে— সেই সূচনালগ্নে, যখন এই সংকটের মূল প্রোথিত হয়েছিল।
রাজনৈতিক ইতিহাসচর্চা বা হিস্টোরিওগ্রাফির একটি গভীর তাৎপর্য রয়েছে। সার্বিকভাবে বিবেচনায় নিলে, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অভিব্যক্তি, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা, নাট্যকলা ও সংগীত— সবই একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শকে শানিত করে এবং এর যাত্রাপথে মূল জনস্রোতকে সম্পৃক্ত করে। অন্যদিকে, ঐতিহাসিক কোনো সংগ্রামে একজন অবিসংবাদিত নেতৃত্বের অধীনে অর্জিত বিজয় যুগে যুগে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকে এবং জনগণকে তার অংশিদারে পরিণত করে। এই প্রেক্ষাপটে বিগত ৫৪ বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দু-টি দল সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে— আওয়ামি লিগ ও বিএনপি। তারা একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বিজয়ের চেতনাভিত্তিক রাজনৈতিক বয়ানকে সামনে রেখে জনগণকে সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় যে, হেফাজত, জামায়াত, ইসলামি আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলনসহ অন্যান্য সুসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি— যাদের রয়েছে প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী, ব্যাপক আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, অর্থনৈতিক সম্পদ এবং সশস্ত্র ক্যাডার— তারা এই অঙ্গনে তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। এর মূলে রয়েছে তাদের ঐতিহাসিক বিজয়গাথার অভাব। এ কারণে তারা একটি সুদূরপ্রসারী ও সুপরিকল্পিত কৌশল গ্রহণ করেছে, যার মূল লক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সঙ্গে যে-কোনো মূল্যে একটি গণসম্পৃক্ত প্রত্যক্ষ সংঘাতে লিপ্ত হয়ে বিজয় অর্জন।
প্রসঙ্গ : কোটা ব্যবস্থা
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি প্রবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সদ্য স্বাধীন দেশের প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য সকল রাষ্ট্রীয় দপ্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা এবং তা ধারাবাহিকভাবে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। নারী ক্ষমতায়নের অগ্রাধিকার প্রদানের লক্ষ্যে ১০% নারী কোটা, ১% প্রতিবন্ধী কোটা, ৫% আদিবাসী কোটা, ১০% জেলা কোটা ও পোষ্য কোটাও সংযোজিত হয়। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা অতিক্রান্ত হওয়ায় সরকার (আওয়ামি লিগ) ৩০% কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য প্রযোজ্য ঘোষণা করে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে শেখ হাসিনা সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষ্যে এই কোটার সুযোগ মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের জন্যও প্রসারিত করেন। এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ছিল এবং একে আওয়ামি লিগের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বলয়কে শক্তিশালী করার কৌশল হিসেবেই অনেকে দেখেছেন। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে ‘আওয়ামি বিরোধী’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী’— এই দু-টি ধারণা একে অপরের সমার্থক হয়ে ওঠে। সময়ের পরিক্রমায় ছাত্রসমাজের মনস্তত্ত্ব ও সাংস্কৃতিক জগতে পরিবর্তন আসতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলিম পাস করা ছাত্রদের ভর্তির সুযোগ অব্যাহত থাকায় মাদ্রাসা-ভিত্তিক শিক্ষার্থীরা, বিশেষত জামায়াত ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ‘তায়মিরুল মিল্লাত’ থেকে আসা ছাত্ররা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শিবিরের প্রভাব বৃদ্ধির অন্যতম উৎস হয়ে ওঠে। ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে ঘটে যাওয়া রেজিম পরিবর্তনের পেছনেও সেই শক্তির প্ররোচনা রয়েছে, যারা বিগত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে মুক্তিযুদ্ধপন্থী শক্তিকে নানা সন্দেহ, অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের মাধ্যমে প্রান্তে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত। এদের একটি অংশ প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়া, বেসরকারি টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মাধ্যম নিয়ন্ত্রণও করে।
জামায়াত-শিবির-এর ছাত্রসংগঠন ইসলামি ছাত্রশিবির সর্বপ্রথম ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে কোটা সংস্কারের দাবি তোলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় তারা সাধারণ ছাত্রের ছদ্মবেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তীকালে ২০০৮ ও ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে তাদের দ্বারা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ধর্মীয় কার্যক্রম, তাফসির, দাওয়াহ সফর ও শিক্ষা সহায়তার আড়ালে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বয়ানের বিস্তার ঘটে। পুলিশের ও ছাত্রলিগের বাধার মুখেও তারা তাদের কার্যক্রম থামায়নি, বরং সমান্তরালভাবে তা অব্যাহত ছিল। এই ধারাবাহিকতার ফলস্বরূপ ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে কোটা সংস্কারের আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের গণদাবি হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের প্রধান অন্তরায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বয়ান সরকার ও আওয়ামি লিগবিরোধী এক প্রবল মতবাদে রূপ নেয়, যার পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধটি বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার প্রতীক, তার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণাস্থল। তবে বর্তমানে এখানে ইসলামি ছাত্রশিবিরের ক্রিয়াশীলতা দৃশ্যমান। ধর্মীয় আবরণে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এই সংগঠনের বৈশিষ্ট্য। তাদের ‘ছাত্রী সংঘ’ নামক শাখা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে আল-বদর ও রাজাকার বাহিনীর আদর্শিক ধারাবাহিকতায় অবস্থান করছে। তাদের কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মসূচির পরিবর্তে ইসলামি শিক্ষা ও আমল চর্চার নামে ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারের কৌশল পরিলক্ষিত হয়। মওদুদিবাদী দর্শনকে তারা এক সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কাঠামোয় রূপান্তরিত করেছে, যা বাংলাদেশের সংবিধান প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে সাংঘর্ষিক। তাদের মতে, ‘বাংলাদেশি মুসলমানের পরিচয়ে ধর্মীয় ভাবাদর্শই মুখ্য, রাষ্ট্রীয় বা সাংস্কৃতিক পরিচয় গৌণ।’ এই মতাদর্শ রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের সাথে সংঘাত সৃষ্টিকারী এক প্রকার সংগঠিত মতবাদী আন্দোলন, যা সামাজিক সম্প্রীতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিএনপি-জামায়াত-শিবির জোটসহ হেযবুত তাহরির ও খিলাফতপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সংশ্লিষ্টতা বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে ছাত্রশিবিরের বক্তব্য ছিল, কোটাব্যবস্থার পুনর্বহাল একটি অবিবেচিত সিদ্ধান্ত এবং এটি মেধাবী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একধরনের প্রহসন। তাই তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের চলমান কোটা-বিরোধী আন্দোলনের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে আন্দোলনে পাশে থাকার আহ্বান জানায়। ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল জাহিদুল ইসলাম এক যৌথ বিবৃতিতে জানান,
অবৈধ সরকার কর্তৃক আদালতকে ব্যবহার করে একটি মীমাংসিত ইস্যুকে পুনরায় সামনে নিয়ে আসা হীন উদ্দেশ্যের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। ছাত্রশিবির একটি আদর্শিক সংগঠন হিসেবে ছাত্রসমাজের সকল ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সবসময় শিক্ষার্থীদের পাশে ছিল, এখনো আছে এবং থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
এই বিবৃতি থেকে তাদের আদর্শিক অবস্থানের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও মূল্যবোধের বিপরীতে একধরনের বিকল্প ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দর্শন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে নির্দেশ করে।
তোমারে বধিবে যে
গত দুই দশকে বাংলাদেশের সমাজে পরিবার কাঠামোর ভেতরে এক নিঃশব্দ, অথচ বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটে গেছে। এই সূক্ষ্ম পরিবর্তনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন না করলে, ধর্মীয় গোঁড়ামির শেকড় ও নব্য মৌলবাদের উত্থানের সুপ্ত বীজকে বোঝা দুরূহ। নব্বইয়ের দশকের সূচনায় বাংলাদেশ পঁচাত্তর-পরবর্তী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রপরিকাঠামোয় পদচারণার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রান্তিক অঞ্চল থেকে শহরমুখী যোগাযোগব্যবস্থার প্রসারে যৌথ পরিবারগুলো জ্যামিতিক হারে বিস্তার লাভ করে এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চল কিংবা দূরবর্তী মফস্সল থেকে মানুষের শহরকেন্দ্রিক অভিসরণ ঘটে। এই চলমানতার সবচেয়ে গভীর অভিঘাত পড়ে আমাদের সাংস্কৃতিক যাপনচিত্রে। কারণ, একটি জনপদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বহনের প্রধান বাহক তো সেই জনপদের মানুষই। সমাজে যদি মহৎ সাহিত্য, উচ্চমার্গের শিল্পচর্চা, তত্ত্বনির্ভর দর্শন, কিংবা প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক ভাবনার উপযুক্ত সমাদর, সমালোচনা বা পৃষ্ঠপোষকতা না থাকে— তাহলে সেখানে বিকাশ হয় সাংস্কৃতিক দৈত্যাকারতা। এর ফলে গজিয়ে ওঠে তথাকথিত ‘কালচারাল জাইগান্টিক এনিমেল’— যেমন হিরো আলম, আজহারি, বিসিএস প্রিলি, মোটিভেশনাল স্পিচ, টিকটক সেলিব্রেটি, ক্রিম আপা ইত্যাদি— এদের উত্থান মূলত সংস্কৃতির উপনদীতে ভেসে থাকা জঞ্জালের মতো।
প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসচর্চা ও সংস্কৃতি-নির্ভর যাপন অভিভাবকহীন হয়ে পড়ায় তা ক্রমশ ‘ডোয়ার্ফিজম’-এর শিকার হয়। এই ফাঁকে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে তোলে মৌলবাদী ছাত্র সংগঠনসমূহ। তাদের কৌশল ছিল সরল— শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, পরীক্ষার ফি বা উচ্চশিক্ষার ব্যয়ভার বহন এবং ‘আখেরাতের পুঁজি’ হিসেবে দুনিয়াকে ত্যাগ করার অনুপ্রেরণা দেওয়া। কারণ, মওদুদিবাদী দর্শনে দীক্ষিত যে কেউ মধ্যপ্রাচ্যের আল-আজহার বা লন্ডনের বার-অ্যাট-ল ডিগ্রি অর্জন করতে পারবে, সংগঠনের ছায়া যদি তার সঙ্গে থাকে। এসব স্লিপার সেল কার্যক্রম চলতে থাকে আড়ালে, সংগঠনেরই অর্থায়নে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক কোচিং সেন্টার যেমন— রেটিনা, ফোকাস, কনক্রিট, অপটিমাম, সোনালিকা— দেশজুড়ে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করে এবং হাজার হাজার শিবিরকর্মীকে নিয়োগ দেয়। ইসলামি ব্যাংক, ইবনে সিনা হাসপাতাল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, হোটেল, এনজিও, ট্রাভেল এজেন্সি, এমনকি এয়ারলাইন্স— সব কিছুই ছিল এক বৃহৎ অর্থনৈতিক জালের অন্তর্ভুক্ত। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হল, এসব প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহণ করে সমাজের প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষ— প্রগতিশীল বা রক্ষণশীল নির্বিশেষে। অন্যদিকে, দেশের প্রায় প্রতিটি পাড়ায়-মহল্লায়, এমনকি নদী দখল করেও গড়ে উঠেছে অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান— মসজিদ, হিফজ-মাদ্রাসা, কওমি, খারেজি, লিল্লাহ বোর্ডিং প্রভৃতি। ঘরে ঘরে আবেগ ও সহানুভূতি টইটম্বুর থাকায় এই প্রতিষ্ঠানগুলো ফুলে ফেঁপে ওঠে দান, অনুদান ও বিদেশি সাহায্যে।
বিগত এক দশকে আওয়ামি রাজনীতির ছায়ায় হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ‘হাইব্রিড’ নেতারা জনপ্রিয়তা অর্জনের হাতিয়ার বানিয়েছেন এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সমাজে এখন অনেকের কাছে জনহিতকর স্থায়ী কীর্তির একমাত্র প্রকাশ ‘একটি হিফজখানা’ কিংবা ‘মাদ্রাসা’ স্থাপন। কিন্তু একটি সমাজের আলোকিত ভবিষ্যত নির্মাণের জন্য প্রয়োজন তার ভূমিজ সংস্কৃতি, শিল্প ও রাজনীতির অনাবাদি জমিকে চাষ করা। অথচ আমরা এখন সেই জমির প্রতি উদাসীন। মাসে দশ টাকা মসজিদ-মাদ্রাসায় চাঁদা না দিলে পাপ হবে বলে বিবেচনা করি, কিন্তু একটি ছোটো পত্রিকা, সাহিত্যচর্চার সংগঠন, নাটকের দল কিংবা পাঠাগারের জন্য পাঁচ টাকাও ব্যয় করি না— সমাজের প্রতি এ কেমন ন্যায্যতা? নব্বইয়ের দশকে পরিবার কাঠামোয় শিশুদের সংগীত শিক্ষা, পাড়ার নাটক বা খেলাধুলায় অংশগ্রহণ ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু আজ তা প্রায় বিলুপ্ত। আমাদের জীবনধারায় অনুভূমিক বিস্তারের বদলে এখন উল্লম্ব সম্প্রসারণ— বহুতল ভবন উঠছে, কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে পারস্পরিক সম্পর্ক, বিশ্বাস আর মানবিক সংযোগ। ফলে সংস্কৃতির সাথে সমাজের বর্তমান দূরত্ব মহাসাগরীয়।
এইভাবেই শিল্প ও সাহিত্যকে ধীরে ধীরে সমাজ থেকে প্রান্তচ্যুত করার মধ্য দিয়েই সূচনা হয় সামাজিক অবক্ষয় ও মননস্খলনের। আজকের বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের অধিকাংশ শিক্ষক— প্রায় ৯৫ শতাংশ— শিল্প-সাহিত্যচর্চাকে অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক এবং ‘উপদ্রব’ হিসেবে গণ্য করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা বা সাহিত্যচর্চা কেবল সময়ের অপচয় নয়, বরং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নিষিদ্ধ— হারাম। তরুণ বয়সে যদি কেউ এসব চর্চায় অনুরাগী থেকেও থাকেন, তবে এখন তারা তা ‘ভুল পথ’ বলে স্বীকার করে তওবা করে নিয়েছেন— এমনটিই যেন এক প্রচলিত আত্মবর্ণনা হয়ে উঠেছে। গত তিন দশকে সমাজে এমন এক প্রথা গড়ে উঠেছে যা সমাজচেতনার নামে মৌলবাদী চিন্তার অনুকূলে পরিবেশ তৈরি করছে। সমাজের বিত্তবান শ্রেণি— উচ্চপদস্থ আমলা, পেশাজীবী বা ব্যবসায়ীরা— আজ ‘সামাজিক দায়িত্ব’ পালনের নামে কওমি বা খারেজি ধাঁচের একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাকে গণ্য করছেন আঞ্চলিক সংস্কৃতি উন্নয়নের উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে। এটি হতে পারে হিফজখানা, দাওরা, ফাজিল কিংবা কামেল— ব্যক্তি ও বিত্ত অনুযায়ী ভিন্নরূপে। অথচ একটি আধুনিক বিদ্যালয়, সংগীত শিক্ষাকেন্দ্র কিংবা পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা যেখানে জটিল ও সময়সাপেক্ষ, সেখানে একটি মাদ্রাসা গড়ে তোলা নিতান্তই সহজ— সমর্থ ব্যক্তির জন্য অর্থ, জমি ও লোকবল কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। আমরা অবশ্যই এধরনের ধর্মীয় উদ্যোগ ও মূল্যবোধের বিরোধিতা করি না; তবে সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিজস্ব সংস্কৃতি, সাহিত্য ও শিল্পবোধকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগই বা কই?
আমাদের ছাত্রসমাজের অবস্থাও ক্রমাগত সংকটজনক হয়ে উঠছে। পাঠ্যক্রমের বাইরে তাদের সময়জুড়ে জেগে থাকে কেবল এক পরকেন্দ্রিক ‘পুনরুত্থান’-এর আকাঙ্ক্ষা, যেখানে স্বর্গীয় পুরস্কারই একমাত্র প্রাপ্তিযোগ্য। তারা হয়ে উঠছে ভার্চুয়াল ‘জিহাদ’-এর যোদ্ধা, আর তাদের নিজ প্রজন্মের শ্রেষ্ঠত্ব যাচাইয়ের মানদণ্ড হয়ে উঠছে ঈশ্বরকেন্দ্রিক আনুগত্য, ভিন্নমতের প্রতি তীব্র বিরাগ এবং বয়ানের জড়তা। এই প্রজন্ম কোনো সৃজনশীল পথ-নির্দেশনা পাচ্ছে না সমাজের অগ্রজদের কাছ থেকে। ফলে জাতির মনন, কল্পনাশক্তি ও শিল্পবোধের জায়গাগুলোতে গড়ে উঠছে একধরনের সাংস্কৃতিক অপুষ্টি— যেখানে স্থাপত্য নেই, কেবল নির্মাণ; ঐতিহ্য নেই, কেবল ইতিহাসবিমুখতা। যে মাঠে খেলার আনন্দ জন্মাত, তা এখন খালি পড়ে থাকে। যে মফস্সলে নাট্যদল ছিল, তা হয়তো এখনো আছে, তবে একটি প্রোডাকশন করাই হয়ে উঠেছে কষ্টসাধ্য। নাট্যশিল্পীরা এমনকি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আজ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে শহিদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিজয় দিবসে শহিদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ কিংবা মোমবাতি প্রজ্বলন— এসবও যেন শরিয়াহবিরোধী, হারাম কর্ম। এই জনপদের মনস্তত্ত্ব যে কীভাবে তার ভূমিজ সত্তা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে এক বিকল্প, আমদানি করা পরিচয়বাদের শরণ নিয়েছে— তা বোঝার জন্য এই বাংলাভূমিই এক প্রতীকী পাঠশালা।
বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির চূড়ান্ত ডাক এসেছিল ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মার্চে। আজ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দে এসে যখন এই ঐতিহাসিক দিনটিকে উচ্চারণ করাও কিছু মহলে নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে, আর একই দিনে নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরির রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র বায়তুল মোকাররম থেকে ‘মার্চ ফর খিলাফত’-এর নামে প্রকাশ্য কর্মসূচি পালনের সাহস দেখায়— তখন এটুকু অনুধাবন করা কঠিন হয় না যে, এই দ্বন্দ্বের মূল উৎস আসলে কোথায় নিহিত। গত ১৫ মার্চ, শাহবাগে আয়োজিত হয় ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ নামক একটি সমাবেশ, যা কার্যত ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিপক্ষ বলেই নিজেদের অবস্থানকে উপস্থাপন করে। সেই মঞ্চে স্লোগান ওঠে— ‘শাহবাগ নিপাত যাক, রাজাকার মুক্তি পাক’; ‘কাদের মোল্লা দিচ্ছে ডাক, শাহবাগ নিপাত যাক’; ‘গোলাম আজম, নিজামি দিচ্ছে ডাক, শাহবাগ নিপাত যাক’। এই মুহূর্তগুলো নিছক কাকতালীয় নয়; বরং স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে ৫ আগস্টের প্রকৃত লক্ষ্য কী ছিল এবং এই বাংলাভূমিতে আগামী দিনে কোন্ শক্তি সক্রিয় হতে চায়।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতের ভয়াবহ ‘অপারেশন সার্চলাইট’, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা— সবকিছু আমরা একটি জাতীয়তাবাদী আবেগের মোড়কে ব্যাখ্যা করে এসেছি। অথচ পাকিস্তান কখনোই এই যুদ্ধের বাস্তবতা, আমাদের স্বাধীনতা কিংবা সার্বভৌম ভূখণ্ডকে মেনে নেয়নি। সে জন্যই হয়তো ঘটেছিল ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, এক-এগারোর জরুরি অবস্থা, ২৫ ফেব্রুয়ারির পিলখানা হত্যাযজ্ঞ, কিংবা শাপলা চত্বরের অভিযান। এমনকি ৫ আগস্টের কথিত ‘গণঅভ্যুত্থান’-ও ছিল একটি পরিকল্পিত ব্যর্থ প্রয়াস— রাষ্ট্রের ভিত নাড়িয়ে দেবার। অপারেশন সার্চলাইট ছিল একটি নির্দিষ্ট ‘পার্জিং প্রজেক্ট’— যার অনুপ্রেরণা এসেছিল মার্কিন সিআইএ-নির্দেশিত ‘জাকার্তা মেথড’ থেকে। লক্ষ্য ছিল আওয়ামি লিগপন্থী নেতা-কর্মী, হিন্দু এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের নিধন করা, তাদের হত্যা বা দেশান্তরে বাধ্য করে একটি সাংস্কৃতিক ও জনতাত্ত্বিক নির্মূল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। এটি নিছক একটি সামরিক অভিযান নয়, বরং এক ঘৃণ্য জাতিগত নির্মূল প্রকল্প।
পাকিস্তান জন্মলগ্ন থেকেই সিআইএ-এর ছত্রছায়ায় কাজ করা একটি রাষ্ট্র— একটি সায়োপস (psy-ops) এবং কিলিং মেশিন, যার লক্ষ্য ছিল এই অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি করা। তারা কাজ করেছে আমেরিকান ডিপ স্টেটের ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে। উদ্দেশ্য ছিল— বাংলাদেশ থেকে আওয়ামি ঘরানার রাজনীতি নির্মূল করা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করা, ধর্মীয় মৌলবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এক গভীর সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরি করা এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রধারণাকে ধ্বংস করে শরিয়াহ ও খিলাফতের নামে জেহাদি জোন প্রতিষ্ঠা করা— যেখান থেকে ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি গোলযোগ ছড়ানো সম্ভব হয়। সাম্প্রতিক চিন সফরে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্ব যেভাবে বাংলাদেশকে ‘সেভেন সিস্টার্স’-এর একমাত্র সমুদ্রপথের অভিভাবক বলে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায় যে ভূ-রাজনৈতিক জটিলতা আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
অপারেশন সার্চলাইট যা শুরু করেছিল, তা এখনও কোনো-না-কোনোরূপে চলমান। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ— ৭১-এর অর্জন— এটি বাঙালির জাতীয় চেতনার সর্বশ্রেষ্ঠ বহিঃপ্রকাশ। এটি কোনো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কল্পিত প্রকল্প নয়। অথচ বিপরীত শক্তি, যারা চায় বাংলাদেশকে একটি হিজবুত, লস্কর, আরসা, খিলাফতি মডেলে রূপান্তর করতে, তাদের লক্ষ্য এখনো বাংলাদেশকে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক-জেহাদি প্রজেক্টের অংশে পরিণত করা। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানি সামরিক অভিযান ছিল মূলত হিন্দু ও আওয়ামি নিধনের পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এই সত্য প্রতিফলিত হয় ১২ অক্টোবর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্কিন সিআইএ গোয়েন্দা রিপোর্টে, যার শিরোনাম ছিল: ‘গোয়েন্দা স্মারক– পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি’। প্রসঙ্গত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া-উল-হক উক্তিটি স্মরণীয় :
পাকিস্তান ইসরায়েলের মতো, একটি আদর্শিক রাষ্ট্র। ইসরায়েল থেকে ইহুদি ধর্মকে বিতাড়িত করুন, তাহলে এটি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। পাকিস্তান থেকে ইসলামকে বিতাড়িত করুন এবং এটিকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করুন, এটি ভেঙে পড়বে।
বাংলাদেশও কি এমনই একটি আদর্শিক ভূখণ্ড? আদৌ নয়। এই রাষ্ট্রের জন্ম কোনো ধর্মীয় দার্শনিক বা তত্ত্বের ভিত্তিতে হয়নি, হয়নি কোনো ধর্মগুরুর ঐশী আহ্বানে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ন ঘটেছে হাজার বছরের পুরনো বাঙালি সংস্কৃতি, গাঙ্গেয় অববাহিকায় গড়ে ওঠা কৃষ্টি, ভাষা এবং জাতিসত্তার অভিন্ন বুননে। এটি একটি সাংস্কৃতিক ও ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র— যেখানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এই ভূখণ্ডের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। ধরুন, কোনোদিন এই রাষ্ট্র থেকে ইসলাম বিতাড়িত হল (যা কল্পনাতীত ও বাস্তবতাবিরুদ্ধ), তাহলেও এই রাষ্ট্র ভেঙে পড়বে না। কিন্তু যদি বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক চৈতন্যকে নিঃশেষ করতে চাওয়া হয়, তাহলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ— ইরাক, সিরিয়া কিংবা আফগানিস্তানের মতো রাষ্ট্রভাঙনের উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে তখন স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এরই প্রাথমিক আলামত ইতোমধ্যে আমরা বাংলার ভূপ্রান্তরে প্রত্যক্ষ করছি।
লালমনিরহাট শহরের বিডিআর রোডের শিশু পার্ক সংলগ্ন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি বিশাল ম্যুরাল ছিল— যেখানে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭ মার্চের ভাষণ, মুজিবনগর সরকার, মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকা, বীরশ্রেষ্ঠদের অবদান, বিজয়ের উল্লাস— সব কিছু শিল্পিতভাবে অঙ্কিত ছিল। ২০২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চে, স্বাধীনতা দিবসে, জেলা প্রশাসক এইচ এম রাকিব হায়দারের নির্দেশে প্রথমে সেটিকে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়, এটি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাইয়ের তথাকথিত গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এরপর ৩১ মার্চ, ইদের প্রাক্কালে, ওই ম্যুরাল সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলা হয়। শুধুমাত্র লালমনিরহাটেই নয়— সারা দেশে এমন শতাধিক উদাহরণ তৈরি হয়েছে, যেখানে পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ধ্বংস করা হয়েছে। ২০২৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি একযোগে সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ স্মারক ও বীরশ্রেষ্ঠদের প্রতিকৃতি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে ফেলার ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির ঐতিহাসিক মুজিব ভবন দ্বিতীয় দফায় পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। ভবনের ধ্বংসাবশেষ— ইট, রড, বৈদ্যুতিক তার, কাঠ— সব লুট করে নিয়ে যায় তথাকথিত ‘তৌহিদি জনতা’।
এইসব ঘটনা নির্ভেজাল বার্তা দেয়— রাষ্ট্রযন্ত্র কোন্ অভিমুখে এগোচ্ছে এবং কাদের রাজনৈতিক চেতনার পুনরুত্থান ঘটাতে চায়। ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যারা পরাজিত হয়েছিল, আজ তারাই কি রাষ্ট্রক্ষমতার অলিখিত অভিভাবক? ৫ আগস্টের পর থেকে যে ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নির্মূল উৎসব’ শুরু হয়েছিল, তা যে প্রায় সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের ভাস্কর্য পার্ক, বিজয় স্মরণীর ম্যুরাল, শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ও মূর্তি— সবই ধ্বংস করা হয়েছে। এমনকি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের সেই ঘর, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার, তাকেও রাষ্ট্রের নীরব সম্মতিতে পুড়িয়ে নিঃশেষ করা হয়। এরা বিশ্বাস করে, পাকিস্তান ভেঙে যে অপরাধ বঙ্গবন্ধু করেছিলেন, তার প্রতীকগুলো বাংলার মাটিতে টিকে থাকতে পারে না। তাই তারা শুধু শেখ মুজিব নয়— এই রাষ্ট্রের মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ, ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংবেদনশীলতা— সবকিছুই নির্মূল করতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হল— এদেশে বহুত্ববাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার যে বয়ান আমরা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করেছি, তার বাস্তব প্রয়োগ কোথায়? আমরা বলি— বাংলাদেশ একটি ‘শত ফুলের বাগান’, যেখানে বাঙালি, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান, আদিবাসী— সব জাতিসত্তা একত্রে সহাবস্থান করে। কিন্তু গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই চার মূল স্তম্ভ— যাদের ভিত্তিতে এ রাষ্ট্র গঠিত— তা কি আজও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত? না কি এসব কেবল সংবিধানের পৃষ্ঠায় আটকে থাকা অলিখিত প্রত্যয় মাত্র? পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে আজ আমাদের উপলব্ধি করতে হয়— ঘৃণার উঠান যতটা প্রশস্ত হয়েছে, ততটাই সংকুচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চর্চা। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন থেকে আমরা কতটা দূরে সরে এসেছি, তা আর অজানা নয়।
প্রজন্ম চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চ
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি জাতি রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু করেছিল। ২৫ মার্চের কালরাত্রি ও ২৬ মার্চের ভোররাতে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই গণনৃশংসতার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, আর তৎক্ষণাৎ সর্বস্তরের মানুষ অস্ত্র হাতে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্ত আর দুই লক্ষাধিক নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি অর্জন করে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র— বাংলাদেশ।
তবে এদেশের কিছু আত্মবিক্রয়কারী মানুষ সেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল; তারা পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগী হিসেবে সরাসরি গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং শারীরিক নির্যাতনের মতো ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধে অংশগ্রহণ করে। স্বাধীনতার প্রথম দশকেই ইতিহাস মোড় নেয় এক ভয়াবহ বিপরীত গন্তব্যে— ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে জাতীয় চার নেতাও নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ইতিহাসের এই কালো অধ্যায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়— যে শক্তিগুলো মুক্তিযুদ্ধের পরাজয়ে ক্ষুব্ধ ছিল, তারা কখনোই হারিয়ে যায়নি; বরং নিভৃতে থেকে সময়ের প্রতীক্ষা করছিল। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামি লিগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিল জামায়াতে ইসলামি, যাদের আদর্শিক ভিত্তি ছিল পাকিস্তানপন্থা এবং মৌলবাদ। ফলে মওদুদিবাদের রাজনৈতিক শক্তি শুধু পাকিস্তানের পতনের সাথে বিলীন হয়নি— তা এদেশেও প্রোথিত ছিল।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত, চরম আর্থ-সামাজিক সংকটে নিমজ্জিত। এর মধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্র গঠন এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে আন্তর্জাতিক মিত্রশক্তিগুলোর সঙ্গে নির্বিচারে কূটনৈতিক বোঝাপড়ায় এগোতে হয়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে চিন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশগুলোর বিরূপ অবস্থান এবং জাতিসংঘে সদস্যপদ অর্জনের কূটনৈতিক চাপে শেখ মুজিব যুদ্ধাপরাধীদের প্রত্যক্ষ বিচার থেকে কৌশলগত কারণে বিরত থাকেন। তবুও তিনি ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে একটি যুদ্ধাপরাধবিরোধী আইন প্রণয়ন করেন, যা পরবর্তীতে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে সংশোধিত হয় এবং ২০১০ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামি লিগের নির্বাচনি অঙ্গীকার অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি প্রথম রায়ে আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে আদালত। পরবর্তী সময়ে ৫ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার রায় ঘোষিত হয়, যেখানে তাকে ৩টি অপরাধে ১৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ২টি অপরাধে যাবজ্জীবন দণ্ড প্রদান করা হয়। কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা ও আলুব্দি গ্রামে ৩৪৪ জন নিরীহ মানুষ হত্যাসহ ৬টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি প্রমাণিত হয় এবং সেই অনুযায়ী আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এতসব নিষ্ঠুর অপরাধ— ধর্ষণ, গণহত্যা, নারকীয় পৈশাচিকতার পরেও একজন অপরাধীর শুধুমাত্র যাবজ্জীবন সাজা জাতির কাছে ছিল এক চরম হতাশা। এই বিচারকে অসম্পূর্ণ ও আপসকামী বলে মনে করে দেশের আপামর জনতা। ফলস্বরূপ, একবিন্দু রক্তপাত ছাড়াই গণআন্দোলনের বর্ণাঢ্য এক অধ্যায় সূচিত হয়— শুরু হয় শাহবাগ আন্দোলন, যেখানে সহস্র মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে ন্যায়বিচারের দাবিতে ক্ষোভ ও প্রত্যয়।
২০১৩ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি— এক ঐতিহাসিক দিন। সেদিন ঢাকার শাহবাগে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান বিচারে আব্দুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে এক মানববন্ধনে জড়ো হয় ব্লগার, এক্টিভিস্ট, চিন্তাশীল তরুণ, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জমায়েত বাড়তে থাকে, যেন ইতিহাসের এক নতুন প্রত্যুষে পা রাখে বাংলাদেশ। একসময় এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, রূপ নেয় এক বিস্তৃত গণবিক্ষোভে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা উল্লেখযোগ্য বিক্ষোভ ও সমাবেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল— সিলেটের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, চট্টগ্রামের প্রেসক্লাব চত্বর, রাজশাহির আলুপট্টি মোড়, খুলনার শিববাড়ি মোড়, বরিশালের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, বগুড়ার সাতমাথা, যশোরের চিত্রা মোড়, কুমিল্লার কান্দিরপাড়, কুষ্টিয়ার থানা মোড় ইত্যাদি। শাহবাগে অনেকেই ঘোষণা করেন— তারা মৃত্যুদণ্ডের রায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনস্থল ছাড়বেন না।
অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আনিসুল হক বলেছিলেন, ‘কাদের মোল্লার সাজা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সুযোগ এখনও রয়েছে।’ শেষ পর্যন্ত, সরকার জনতার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। বিচারপ্রক্রিয়া চলমান রাখার লক্ষ্যে সর্বোচ্চ ৬০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তির বিধান রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন লাভ করে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এর সংশোধনী। এতে আসামির পাশাপাশি সরকারেরও আপিল করার সমান সুযোগ রাখা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৩, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কাদের মোল্লাকে খুন ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে এবং মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়। ১২ ডিসেম্বর ২০১৩, রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
সমাবেশের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ-প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ অ-সামরিক, কিন্তু তা ছিল সাহসী ও সুসংগঠিত। আন্দোলনকারীরা তাদের অবস্থান তুলে ধরতে বেছে নিয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধবিরোধী স্লোগান, কবিতা, গান, পথনাটক ইত্যাদি। পোড়ানো হয় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের কুশপুত্তলিকা। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি, জামায়াতে ইসলামির রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, জামায়াত ও শিবির পরিচালিত এবং মালিকানাধীন সব প্রতিষ্ঠান বয়কট ও বাজেয়াপ্ত করার দাবি ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে। শাহবাগ হয়ে ওঠে এক তারুণ্যমুখর অগ্নিশিখা— মনে হয় যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন করে জ্বলে উঠেছে। “ক তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার”, “গ তে গোলাম আজম, তুই রাজাকার”, “ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই”— এই ধরনের স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর।
এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দলীয় রাজনীতির বাইরে এনে সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠা করা। এ ছিল মুক্তিযুদ্ধের একটি নতুন ব্যাখ্যা, যা দলনিরপেক্ষ ছিল, প্রগতিশীল ছিল, এবং মূলত ছিল একটি সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ। কিন্তু এই সফলতাই ভীত করে তোলে মৌলবাদপুষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকে। ভয় পেয়ে যায় ‘চিকেন-হার্টেড’ বিএনপি, আইএসআই-এর এজেন্টরা এবং তারা ইসলামি সন্ত্রাসবাদকে ব্যবহার করে শাহবাগের বিপক্ষে আঘাত হানার চেষ্টা করে। সেই প্রচ্ছন্ন চাপে এই সাংস্কৃতিক জাগরণ ধীরে ধীরে রাজনীতির আবহে মিশে যেতে বাধ্য হয়। আজকের দিনে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়— শাহবাগ বনাম শাপলা আন্দোলন শুধুই যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রশ্ন নয়, এটি বাঙালি মুসলমানের গভীর সাংস্কৃতিক সংকটের বহিঃপ্রকাশ। এই সংকটের শিকড় মিলে যায় তিতুমির-হাজি শরিয়তুল্লাহর ওয়াহবি আন্দোলন পর্যন্ত।
শাহবাগ বনাম শাপলা— এ এক সাংস্কৃতিক দ্বৈরথ, যেখানে তরুণ প্রজন্মের আশা আর বার্ধক্যের ভীতি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। শাহবাগের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন শহুরে মধ্যবিত্ত, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, ছাত্র, লেখক, বুদ্ধিজীবী, যারা কোনো রাজনৈতিক দলের অনুগামী ছিলেন না। ইতিহাস বলে, এমন অরাজনৈতিক শক্তির আন্দোলনের ব্যর্থতার উদাহরণ খুবই কম। এই লড়াই মূলত মৌলবাদের বিরুদ্ধে একটি গৃহযুদ্ধ, একটি সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। শাহবাগিদের কাছে চার্যাপদ, মহাভারত, মনসামঙ্গল— এসবই উত্তরাধিকার, যেখানে কারবালার আবেদন তুচ্ছ। তবে, যুদ্ধটা মনে রাখা জরুরি— এটি আওয়ামি লিগ বনাম হেফাজত কিংবা কওমি বনাম জেনারেল শিক্ষার মধ্যেকার নয়; এটি একটি মৌলিক সাংস্কৃতিক লড়াই, যা ইরান ও আফগানিস্তানে পরাজয় বরণ করেছে প্রগতিশীল সংস্কৃতির মাধ্যমে। পশ্চিমা ফ্যাসিবাদ স্বৈরাচার বিরোধিতার নামে শাপলাকে দীর্ঘদিন ধরে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, তাকে শক্তিশালী করেছে। তাই আজ দরকার একটি ঘোষিত সাংস্কৃতিক যুদ্ধ— স্বকীয়তা রক্ষার সংগ্রাম। বাঙালি, আদিবাসী গারো, হাজং, কোচ, বানাই, মারমা, বম, আস্তিক, নির্দ্বিধ, হাছন, লালন, জালাল, বাউল, সহজিয়া, সুফিবাদী— এই বহুত্ববাদী সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সম্মিলিত নামই ‘শাহবাগি’।
আওয়ামমি লিগ শাসনে মৌলবাদকে তোষণ করে যখন বারবার আপসের রাজনীতি করা হল, তখন স্বাধীনতাবিরোধী জঙ্গিবাদী শক্তিরাই ৫ আগস্টের পর ক্ষমতার মূল বৃত্তে জায়গা করে নিল। নিঃসন্দেহে ২৪ জুলাই ঢাকাসহ সারাদেশে প্রগতিশীল সংস্কৃতিমনা মানুষদের নেতৃত্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন এক নতুন মাত্রা পায়। আন্দোলনটি হয়ে ওঠে একটি গণজাগরণের রূপক, যেখানে সরকারবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন এমনকি আওয়ামি ঘরানার বহু মানুষ, বামপন্থী ছাত্রজনতা এবং জনসাধারণের বিস্তৃত অংশ। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জমিন যেন মুহূর্তেই খসে পড়েছিল চোখের পলকে— কিন্তু এর দায় তো সরকারেরই! কারণ, এক ধরনের সচেতন নির্লিপ্ততায় আওয়ামি লিগ নিজেদের ধীরে ধীরে জনগণের প্রাত্যহিক যাপন ও সাংস্কৃতিক অভ্যস্ততা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল এক পা, এক পা করে।
আওয়ামি পতনের সম্ভাবনাই কেবল এই জাতির একমাত্র দুর্ভাবনা নয়— বরং তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা এক নৈরাজ্যবাদী, বাঙালি জাতীয়তাবাদবিরোধী প্রবণতাই আজ অধিকতর বিপজ্জনক। এমন বাস্তবতায় আওয়ামি লিগের ভূমিকা ও দায় এড়ানো কঠিন। বিএনপি— যার অভ্যন্তরে যেমন রয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ডানপন্থা, তেমনি রয়েছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা চেতনারও কিছু স্তর। এমন একটি শক্তির মোকাবিলা করে আগামীতে আওয়ামি লিগের আবার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনে তেমন বেগ হওয়ার কথা ছিল না। এমনকি তারা যদি পনেরো বছরের শাসন পর্ব শেষে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় নির্বাচন ছেড়েও দিত, তাতে কি সত্যিই বড়ো কোনো ক্ষতি হত?
এই দীর্ঘ শাসনপর্বেই তো গড়ে উঠেছে এক বিরাট শ্রেণি— যাদের কেউ ব্লগার, কেউ কলামিস্ট, কেউ সাংবাদিক, কেউ টকশো-সেলিব্রিটি— যাঁরা হয়ে উঠেছেন প্রভাবশালী জনমত নির্মাতা। বিস্ময়করভাবে, এঁদের অনেকেই হয়ে উঠেছেন অ্যান্টি-আওয়ামি রূপে জনপ্রিয়— যেন বুদ্ধিজীবী নয়, কোনো ঘুমপাড়ানি পিলের মতো। তবে প্রশ্ন ওঠে— যদি দেশে সত্যিকার অর্থে বাক্স্বাধীনতা না থাকত, তবে কীভাবে আসিফ নজরুল, আলী রিয়াজের মতো ব্যক্তিত্বরা ডানপন্থীদের প্রিয় হয়ে উঠলেন, কীভাবে তাঁরা অবাধে লেখালেখি করতে পারলেন? প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তচিন্তার মানুষদের যেন আজ কোনো দল নেই। বাক্স্বাধীনতা যদি মানে হয়— আমি এমন কিছু বলব যা আপনি শুনতে চান না, যা হয়তো আপনার গা জ্বালাবে, তবু আমি তা বলার স্বাধীনতা রাখব এবং রাষ্ট্র কিংবা জনতার কোনো গোষ্ঠী আমাকে দমন করতে আসবে না— তবে প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলাদেশে কি এই শর্ত পূরণ হয়?
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটি গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই আন্দোলন যদি হয় প্রতারণা ও নৈরাজ্যবাদে পরিপুষ্ট, তাহলে প্রশ্ন ওঠে— এই রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্র কি আদতে বদলেছে? না কি সেই শাসকশ্রেণিই ফ্যাসিবাদী রূপ ধারণ করে টিকে থাকার শেষ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে? তাহলে কি বলা যাবে, চব্বিশের ছাত্রজনতা আদতে কোনো ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রাম করেনি? বরং তারা যেন নিজেই ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচার হবার এক অনাহূত অধিকার অর্জনের সংগ্রামে নেমেছিল?
হেফাজতের উত্থান
২০০৮ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনের ফলস্বরূপ ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামি লিগ ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং ‘নারীনীতি’ ঘোষণা করে। প্রগতিশীল এই নীতির বিরোধিতা করে কয়েকটি ছোটো ছোটো ধর্মান্ধ, উগ্রবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। কওমি মাদ্রাসাগুলোর ঘনিষ্ঠতায় হাটহাজারি মাদ্রাসার প্রধান আল্লামা শফির নেতৃত্বে অরাজনৈতিক ব্যানারে গড়ে তোলে হেফাজতে ইসলাম। ২০১০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি এই সংগঠনটি চট্টগ্রামের প্রায় একশত কওমি মাদ্রাসার শিক্ষককে নিয়ে গঠিত হয়। হাটহাজারি মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। ২০১০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতার মাধ্যমে হেফাজতের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে তারা ‘বাংলাদেশ নারী উন্নয়ন নীতি (২০০৯)’-এর কয়েকটি ধারা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে এর তীব্র বিরোধিতা করে।
যে সকল দল এই ব্যানারে যুক্ত হয়, তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। হেফাজতে ইসলাম নামে সংগঠনটির অস্তিত্ব একাত্তরে না থাকায় তারা এক ধরনের আড়াল তৈরি করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে, বিশেষত মাদ্রাসা থেকে উত্তীর্ণ জনগণের মধ্যে সমর্থন লাভে সক্ষম হয়। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের প্রয়াস হিসেবে তারা মধ্যযুগীয় ১৩ দফা দাবি নিয়ে রাজপথে নামে। ইসলাম ও রাসুল (সা.)-কে কটূক্তিকারী নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসির দাবিতে তারা ব্যাপক আন্দোলন ও সমাবেশ শুরু করে। এ প্রেক্ষাপটে হেফাজত তাদের ১৩ দফা দাবি উপস্থাপন করে। শাহবাগে ব্লগার, অ্যাক্টিভিস্ট ও সংস্কৃতিকর্মীদের আন্দোলন নিয়ে গণমাধ্যম এবং রাজনীতির ময়দানে হেফাজতসহ সমমনা দলগুলো প্রবল আপত্তি তোলে এবং ক্রমে তা সহিংসতায় রূপ নেয়। এর ফলে সরকারের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয় এবং হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচির প্রেক্ষিতে শাহবাগ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
হেফাজতের ১৩ দফা :
১। সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কুরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল।
২। আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কটূক্তি রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।
৩। শাহবাগ আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক ও রাসুল (সা.)-কে অবমাননাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের অপপ্রচার বন্ধ এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ।
৪। ব্যক্তি ও বাক্স্বাধীনতার নামে সব ধরনের বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ নিষিদ্ধ।
৫। ইসলামবিরোধী নারীনীতি ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি বাতিল করে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
৬। কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের সব প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা।
৭। মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।
৮। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং ওয়াজ-নসিহতসহ ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান বন্ধ করা।
৯। রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাঁড়ি, টুপি ও ইসলামি সংস্কৃতি নিয়ে উপহাস এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় পোশাক ব্যবহারের মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।
১০। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মান্তকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
১১। রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসা ছাত্র ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ ও গণহত্যা বন্ধ করা।
১২। দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ এবং মসজিদের ইমাম-খতিবদের হুমকি-ধমকি ও ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।
১৩। অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসা ছাত্র এবং রাসুলপ্রেমিক জনতাকে মুক্তি, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণ এবং দুষ্কৃতকারীদের বিচার ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।
(সূত্র : উইকিপিডিয়া)
৫ মে ২০১৩ তারিখে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে সমবেত হয়ে হেফাজত ঘোষণা করে যে, ১৩ দফা দাবি মানা না হলে তারা ঢাকা দখল করে নেবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামি লিগ দক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করে হেফাজতকে শাপলা চত্বর ছাড়তে বাধ্য করে। দেশ রক্ষা পায় তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকে, বর্বরশাসনের কবল থেকে এবং মধ্যযুগীয় অন্ধকারে পতনের হাত থেকে।
হেফাজতে ইসলাম ধর্মভিত্তিক একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী হলেও তারা শুরুতে জামায়াতবিরোধী অবস্থানে ছিল। জামায়াতের রাজনীতি মওদুদিবাদকে কেন্দ্র করে পরিচালিত এবং তা ওয়াহাবি মতাদর্শে প্রভাবিত। জামায়াতে ইসলামি আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সৌদি আরব, তুরস্ক ও মিশরের মতো ইসলামি মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত এবং এর গভীরে রয়েছে মার্কিন সিআইএ-প্রভাব। হেফাজত মূলত ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক; তারা আন্তর্জাতিক নয়। জামায়াত মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন এবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলোকে ভিত্তি করে রাজনীতি করে, আর হেফাজতের শক্তিকেন্দ্র কওমি মাদ্রাসার ছাত্ররা। যদিও শুরুতে হেফাজত জামায়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে রাজনৈতিক চাপ ও আর্থিক সহযোগিতার বিনিময়ে তারা জামায়াতের সঙ্গে এক প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়। ওই বছর জামায়াত-বিএনপি-হেফাজতের যৌথ সহিংস তাণ্ডব ও তা থেকে উৎসারিত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থানের ফলে, ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও পরপর পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামি লিগের পরাজয় ঘটে। এই পরিস্থিতি আওয়ামি লিগকে রাজনীতির নতুন মূল্যায়ন ও কৌশল নির্ধারণে বাধ্য করে। ফলে দলটি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বিভক্ত করার পদক্ষেপ নেয় এবং কৌশলে হেফাজতকে জামায়াত থেকে আলাদা করতে সক্ষম হয়।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ২৫ থেকে ২৮ মার্চ ২০২১ তারিখের মধ্যে হেফাজতে ইসলামসহ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহি, মুন্সিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, নোয়াখালি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামে ব্যাপক সহিংসতা চালায়। অজুহাত ছিল: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর। তারা মোদিকে ২০০২ খ্রিস্টাব্দের গুজরাট দাঙ্গার জন্য দায়ী করে এবং তাঁর আগমনকে কেন্দ্র করে চার দিনব্যাপী তাণ্ডব চালায়। হেফাজতের এই সহিংসতা দমন করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের গুলিতে ১৩ জন নিহত হয়। এই ১৩টি প্রাণের দায় নিঃসন্দেহে হেফাজতের।
তারা আগুন দিয়েছে যানবাহনে, ভূমি অফিসসহ একাধিক সরকারি কার্যালয়ে, প্রেসক্লাবে, গ্রন্থাগারে, হিন্দু মন্দিরে এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে। আজও যে ‘মব কালচার’ বাংলাদেশে বিরাজ করছে, তাতে হিজবুত, শিবির ও হেফাজতিদের লক্ষ্য একেবারে স্পষ্ট— তারা ধ্বংস করতে চায় বাংলাদেশের মূল চেতনা: বঙ্গবন্ধু, অসাম্প্রদায়িকতা, আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞান, মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন, স্মারক ম্যুরাল এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রতীক ধানমণ্ডি ৩২। তারা প্রকৃতপক্ষে প্রগতির বিরোধী শক্তি।
বাঙালি সত্তা এবং পয়লা বৈশাখ হারাম তত্ত্ব
পয়লা বৈশাখে চারুকলার আয়োজনে সর্বজনীন আনন্দ শোভাযাত্রার বর্তমান রূপ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিত হয় ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে। এর আগে এ-টি ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিত ছিল। ক্ষমতার বাইরে থেকে রাষ্ট্রক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এমন শক্তির মাধ্যমে পয়লা বৈশাখের এই শোভাযাত্রায় নানা প্রতীক ও মোটিফ ব্যবহার করে একটি সাংস্কৃতিক বয়ান নির্মাণ করা হয়েছিল। তারও এক দশক আগে, স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে শাহবাগ, চারুকলা ও আজিজ মার্কেটকে কেন্দ্র করে একটি বিপ্লবী, সৃজনশীল তরুণ বলয় গড়ে উঠেছিল, যেখানে ছিলেন— রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, তসলিমা নাসরিন, মহাদেব সাহা, মোহাম্মদ রফিক, মোহন রায়হান, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী ও নুরুল হুদা প্রমুখ প্রগতিশীল কবি। কবিতা ও নাটকের মাধ্যমে তারা স্বৈরশাসককে প্রতিহত করছিলেন এবং গণমানুষের সামনে তার মুখোশ উন্মোচন করছিলেন।
বাঙালি সত্তা ও পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণের সকল আনুষ্ঠানিকতা ও যাপনকে ‘হারাম’ আখ্যা দিয়ে আসছে হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এবং একটি ক্রমবর্ধমান প্রতিনিধিত্বশীল শ্রেণি। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এসব উৎসব মূলত হিন্দু ধর্মীয় আচার ও সংস্কৃতির অংশ। মঙ্গল শোভাযাত্রার মোটিফ— প্যাঁচা, টেপা পুতুল, বাঘ-সিংহের মুখোশ— তাদের মতে, হিন্দু প্রতীক, যা বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, বরং বিদআত। এরা নিজেদের ‘বাঙালি’ নয়, বরং ‘বাংলাদেশি মুসলমান’ হিসেবে পরিচয় দিতে সচেষ্ট। এই মানসিকতা বিগত এক দশকে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। গণমাধ্যম, ধর্মীয় মাহফিল ও কওমি বয়ানের মাধ্যমে এই বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, অথচ রাষ্ট্রযন্ত্র কার্যত নীরব সমর্থনে থেকেছে। রাজধানীসহ সারাদেশে বৈশাখী অনুষ্ঠান সন্ধ্যার আগেই শেষ করার সরকারি নির্দেশ ছিল। গ্রামীণ এলাকায় বৈশাখী বা অষ্টমীর মেলা ক্রমশ লুপ্তপ্রায় হয়ে পড়ছিল। কোথাও কোথাও বাউলদের চুল কেটে নেওয়া হয়েছে, সুফিদের ‘শরিয়ত বিরোধী’ বলা হয়েছে, তাঁদের মাজারে হামলা হয়েছে। এই সকল ঘটনার বিপরীতে রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া ছিল উদ্বেগজনকভাবে নিরুত্তাপ। অথচ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের ‘রঙিন বিপ্লব’ পরবর্তী সময়ে পয়লা বৈশাখে ফ্যাসিবাদের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনার ব্যঙ্গচিত্র শোভাযাত্রায় প্রদর্শিত হলেও ইসলামপন্থী দলগুলো এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ জানায়নি, বরং সেই পরিচিত ‘মূর্তি হারাম’ ফতোয়াও উচ্চারিত হয়নি।
বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ভূমিজ সংস্কৃতি মৌলবাদী গোষ্ঠীর স্বার্থের পরিপন্থী। ইসলামি মৌলবাদের একটি আন্তর্জাতিক রূপ রয়েছে, যার মডেল হল আরব জগৎ ও মধ্যপ্রাচ্য। অথচ আরবের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সমাজ বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। বাংলাদেশের রয়েছে একটি বহুমাত্রিক, বহুভাষিক ও বহুপথের সংস্কৃতি, যেখানে মানবতাবোধ এবং ভিন্নধর্মাবলম্বীদের প্রতি উদারতা দীর্ঘকাল ধরে সহাবস্থান করে আসছে। আরব সমাজে এমন উদাহরণ বিরল। আমাদের দেশে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের পাশাপাশি শক্তিশালী বামপন্থী ও সাম্যবাদী আন্দোলনও ছিল, যেটি এখন এক ধরনের ডিহাইড্রেড, ক্ষীণ ও ক্ষয়িষ্ণু দশায় পৌঁছেছে। বিগত এক দশকে এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিগুলো কেন এতটা দুর্বল হয়ে পড়ল, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণের সময় এসেছে।
বিশ্বায়িত ভোগবাদী সংস্কৃতি এবং একটি সাংস্কৃতিক সমসত্ততা গড়ে তোলার প্রেক্ষাপটে মৌলবাদী তৎপরতা আরও তীব্র হয়েছে। তবে একইসঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতিচর্চায়ও নতুন করে আগ্রহ দেখা দিচ্ছে। রাজনৈতিক আন্দোলনে স্থানীয় সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটি ক্রমশ গুরুত্ব পাচ্ছে। আমাদের সংস্কৃতিতে ধর্মীয় চেতনা কখনোই একক আধিপত্য বিস্তার করেনি; বরং অসাম্প্রদায়িক মনোভাব, মানবিক মূল্যবোধ ও উদারতা আমাদের লোকজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি অসাম্প্রদায়িকতা, বাস্তবে তার অনুশীলন বা ‘যাপন’ আজও প্রশ্নসাপেক্ষ। হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক বা সংখ্যাগরিষ্ঠ-সংখ্যালঘু আধিপত্যের সংঘাতকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতার যে একমাত্রিক বয়ান প্রচলিত, তার বাইরে গিয়ে আমাদের নতুনভাবে ভাবতে হবে। ৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে মাজার ও দরগাহ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে সুফিবাদী মুসলমানদের ‘সংখ্যালঘু’ বলে চিহ্নিত করা হয়নি, অথচ মূলধারার বাইরে থাকা এই সম্প্রদায়ের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে। বহুত্ববাদের নামে যে নতুন রাষ্ট্রীয় বয়ান তৈরি হচ্ছে, তা কি সত্যিই সমাজে সাম্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে?
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পূর্ণ হলেও বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি নির্মূল হয়নি ধর্মান্ধতা, উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অপশক্তি। এর মূল কারণ ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন। বহুদলীয় গণতন্ত্রের আড়ালে পরাজিত ধর্মান্ধ দল— মুসলিম লিগ, জামায়াতে ইসলামি, নেজামে ইসলামসহ অন্যান্য উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একটি নতুন রাজনৈতিক বলয়। ১৯৭৫ থেকে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত টানা ৩৩ বছর ধরে পাকিস্তান, সৌদি আরব, তুরস্ক ও আমেরিকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থনে এরা বাংলাদেশকে একটি ‘আফগানমুখী’ রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে গোপন রাজনীতি পরিচালনা করে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করে, এনজিও ও বিদেশি অর্থায়নের নামে গ্রামে-গঞ্জে গিয়ে ধর্ম প্রচারের আড়ালে ছড়ানো হয় ধর্মীয় উগ্রতা, কূপমণ্ডূকতা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষ। সেই সময় ঢাকার রাজপথে উচ্চারিত হয়েছিল— ‘আমরা হব তালেবান/ বাংলা হবে আফগান।’ এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখন দৃশ্যমান। আজকের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থানের পেছনে রয়েছে সেই ৩৩ বছরের বিষাক্ত বীজরোপণ, যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ভিন্নমত দমনের সংস্কৃতিও।
জুলাই ও আগস্ট মুসাবিদা
৫ আগস্ট ২০২৪-এ বাংলাদেশের বুকে কোনো অলৌকিক নৈরাজ্য নেমে আসেনি। নির্দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে অনেক প্রেক্ষাপট স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছিল— এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। তবে আজকের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন ও নতুন অভিপ্রায়ের ইঙ্গিত দেয়।
১৯৭৫-এর সেই মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পরে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামি লিগ রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫-এর পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলেন ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ সময় বাংলাদেশে চলছিল সামরিক শাসন, একের পর এক ক্যু, এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে আপসহীন আওয়ামি নেতৃবৃন্দকে নির্মম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে সময় পার করতে হয়েছিল। সুচারুভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী নব্বইয়ের গণআন্দোলনে আওয়ামি লিগের ছাত্র ও যুব সংগঠন রাজপথে সক্রিয় ও লড়াকু ভূমিকা পালন করেছিল। দলীয় নেতৃত্বে তখন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সারির সংগঠক, যোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীরা। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামি লিগ সরকার গঠন করে। দীর্ঘ ২১ বছর পরে বাংলাদেশের আকাশে উদিত হয় এক নতুন প্রভাত। সেই দিন বাতাসে বেজে উঠেছিল—
শোনো, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি। বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।
নতুন করে জেগে ওঠে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন— মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নতুন যাত্রা। ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়— বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করে আওয়ামি লিগ সরকার। জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিলুপ্ত করে বিচারিক কার্যক্রম শুরু করা হয় এবং খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কিন্তু ২০০১ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামি লিগ বিএনপি-জামায়াত জোটের কাছে পরাজিত হলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া থেমে যায়। একইসাথে স্থবির হয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে দেশের যাত্রা। এরপর শুরু হয় জঙ্গিবাদের উত্থান, রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, এবং ৬৪ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণের মতো ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। এই সময়কাল ছিল স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি জামায়াতের সরাসরি সরকারে অংশগ্রহণের এক অন্ধকার অধ্যায়। তারপর আসে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যার দুই বছরের শাসনকাল অতিক্রম করে দেশ আবার নির্বাচনের মুখোমুখি হয়।
২০০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামি লিগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এর পেছনে বড়ো একটি কারণ ছিল দলটির সময়োপযোগী নির্বাচনি ইস্তাহার ও তরুণ সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থন। ২০০১ থেকে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছিল— যারা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তারাই একাত্তরের শহিদদের রক্তে রাঙানো পতাকা পায়ে পিষে রাষ্ট্র পরিচালনা করছিল। জাতি একপ্রকার ঐকমত্য হয়ে এর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল। সেইসাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছিল।
প্যাসকেলের সেই বিখ্যাত সূত্র— একটি আবদ্ধ পাত্রে তরল বা গ্যাসীয় পদার্থে চাপ প্রয়োগ করলে তা পাত্রের সর্বত্র সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে— প্রকৃত অর্থে বঙ্গসমাজে খাটে। যখন শিল্প, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য রাষ্ট্রীয় চাপের ফলে সংকুচিত হয়ে পড়ে, তখন তার প্রতিক্রিয়ায় ভিন্নধারার শক্তি বা প্রবণতা সমাজে গড়ে ওঠে। বাংলার উনসত্তর হাজার গ্রামে যখন পালাগান, যাত্রা, নাটকসহ লোক সংস্কৃতির উপাদানগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল, তখন ধর্মীয় উগ্রবাদের ভূমি যেন ক্রমশ উর্বর হয়ে উঠছিল। বিগত এক দশকে দেশের সর্বত্র যাত্রা, পালা বা বৈশাখী আয়োজন করতে হলে পুলিশের অনুমতি বা নিরাপত্তার দরকার হত। একই সময় পাড়ায়-মহল্লায় তরুণদের উদ্যোগে ইসলামিক তাফসির মাহফিল, জলসা ও সম্মেলনের মাধ্যমে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যারা ক্রমেই ধর্মান্ধ এবং মতভেদ-বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে উঠছে। এখন অনেক তরুণের কাছে একটি খেলাধুলার আয়োজনের চেয়ে তাফসিরুল মাহফিল আয়োজন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই আয়োজন বাস্তবায়ন করতে লক্ষ লক্ষ টাকা অনায়াসে তোলা যায়, যা পরে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নানা কাজে ব্যবহার হয়।
এই সংস্কৃতির শিকড় বেশি পুরানো নয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তারুণ্যের চিত্র ছিল জীবনমুখী ও প্রাণবন্ত— একটি ক্যানভাসে আঁকা রূপসি বাংলার মতো। যেখানে কৃষক-কৃষাণীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠে কাজ করে, মাঝির গানে মন ভরে, তরুণ-তরুণীরা প্রেমে-সংগ্রামে হাতে হাত রেখে হাসে, হাঁটে। সেখানে থাকে বাউল, সুফিবাদ, সহজিয়া সাধনা, মিলাদ-মাহফিল, অষ্টমী স্নান, দুর্গাপূজা, বড়োদিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা— তবেই তো তা আমার বাংলা। মাঝি গাইবে— ‘পুবাল হাওয়া পশ্চিমে যাও, কাবার পথে বইয়া, যাও রে বইয়া, এই গরিবের সালামখানি লইয়া’, আবার শোনা যাবে— ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া, শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে, আমার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে ভ্রমর কইয়ো গিয়া।’ কিন্তু এই যে ভয়াবহ বিদ্বেষের মিছিল— এত ব্যাপকভাবে বঙ্গজনসমাজে আগে কখনো দেখা যায়নি।
মোটাদাগে যদি বিচার করি, তবে নারীবাদ থেকে সুফিবাদ, ভাস্কর্য থেকে রবীন্দ্রনাথ, বড়োদিন থেকে মূর্তিপূজা, পয়লা বৈশাখ থেকে যাত্রাপালা, মারফতি গান থেকে হিন্দুত্ববাদ, আদিবাসী সংস্কৃতি থেকে গ্রামীণ পার্বণ— সবকিছুই যদি ইসলামি ভাবধারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বিবেচিত হয়, তবে জাগে এক মৌলিক প্রশ্ন: ইসলাম নিজেই কি তবে একমাত্র সহ্যহীনতা ও বিদ্বেষের অন্য নাম? তা তো হতে পারে না। এ-এক মৌলবাদী রাজনীতির নির্মাণ। আসলে গত এক দশকে, সোশ্যাল মিডিয়ার মরুচারিত ভার্চুয়াল ভূমিতে এক বিশেষ ‘বয়ান’ নির্মাণ করা হয়েছে— যেখানে বাংলাদেশের জন্মকথা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এক ছায়া-আখ্যানের আকারে তুলে ধরা হয়েছে। যারা গত ৫৪ বছরে এই রাষ্ট্রকে মেনে নিতে পারেনি, তারাই সেই ব্যাখ্যার রূপকার। তাদের অভিযোগ— ‘আওয়ামি লিগের ইতিহাস বানানো, ভারতের কলমে রচিত।’ কিন্তু যারা এ কথা বলে, তারাই কখনো বলেনি— তাহলে প্রকৃত ইতিহাস কে লিখেছে? …কেউ না। শুধু ছড়ানো হয়েছে বিভ্রান্তির বিষবাষ্প— যাতে তরুণ মনে জন্ম নেয় সন্দেহ, যেন মুক্তিযুদ্ধ এক দলীয় কল্পকাহিনি।
ফলে দেখা গেল— রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে আওয়ামি লিগ পাঠ্যসূচিতে মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিষ্ঠা করেছে বটে, কিন্তু সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় থেকে গেছে এক আত্মঘাতী দুর্বলতা। সেক্যুলার রাজনীতির বৃহৎ ব্যানার যদিও আওয়ামি লিগের হাতেই ছিল, তথাপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়— সংস্কৃতির মানুষেরা তাদের থেকে ছিটকে গেছেন অনেক দূরে। কেন এই দূরত্ব, কেন এই নিঃশব্দ সন্দেহ? যেদিন আওয়ামি লিগ চিৎকার করছিল— ‘বাঘ আসছে, বাঘ আসছে’, সেদিন সংস্কৃতি সমাজ তাকিয়েছিল নীরব বিস্ময়ে। ‘জামাত-শিবির-রাজাকার’ নামক আতঙ্ক এত বেশি ব্যবহৃত, যে এক সময় তা পরিণত হয়েছে নিছক এক প্রতিধ্বনিতে। যখন শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন— ‘এই আন্দোলনের পেছনে জামাত-শিবির’, তখন জনমন তা নিতান্তই রাজনীতির ভাষ্য ভেবেছিল।
গত এক দশকে দলীয়নীতিতে প্রগতিশীল মানুষদের মনে জন্মেছে বিরক্তি, এমনকি গোপন লজ্জা— কারণ তাঁদের লেখা, তাঁদের কথা, তাঁদের শিল্পকর্মই যেন হয়ে ওঠে এক নতুন অপরাধ। পয়লা বৈশাখের উৎসব, যেটি ছিল সাধারণ মানুষের প্রাণের রং, তা পরিণত হল প্রোটোকলঘেরা শোভাযাত্রায়। আউল-বাউল হারিয়ে গেল, কৃষকের হাসি নিঃসাড় হল। সাথে নির্মাণ হল আর-এক বয়ান— পয়লা বৈশাখ আসলে হিন্দুদের উৎসব, মুসলমানের জন্য তা ‘হারাম’। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনঘন হেফাজতের সঙ্গে বৈঠক, তাদের প্রতি নমনীয়তা, বারবার সংস্কৃতিচর্চার উপর নিয়ন্ত্রণ— সব মিলিয়ে সাংস্কৃতিক মহল হয়ে পড়ল নিঃসঙ্গ ও হতাশ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেন এক অদৃশ্য শেকল হয়ে আঁকড়ে ধরল চিন্তার স্বাধীনতা। তার বলি হল নাস্তিক, নারী, হিন্দু, বাউল, কবি, চিত্রকর। কিন্তু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সেই আইন ছিল নির্বাক। যারা মুক্তচিন্তা করত, তারা দেশ ছাড়ল— পলায়নপর এক ব্যথায়। লালনের ভাস্কর্য অপসারণ, সুপ্রিম কোর্ট থেকে জাস্টিসিয়া সরিয়ে ফেলা, ৫৬০টি মডেল মসজিদের কৌশলগত নির্মাণ— এসবই ছিল মৌলবাদ তুষ্টির নীরব মঞ্জুরি। এ এক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত প্রতিক্রিয়া— যেখানে ঘাতকের চেয়ে বিদ্বিষ্ট হল চিন্তক।
হেফাজতের সঙ্গে আঁতাত করে আওয়ামি লিগ হয়তো মনে করেছিল কৌশলী বিজয় লাভ করবে। কিন্তু সেই হাত ধরার বিনিময়ে বাদ দিতে হল পাঠ্যবইয়ের অসাম্প্রদায়িক উপাদান। বিনা নীতিতে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা পেল মাস্টার্সের স্বীকৃতি। তারা চেয়েছিল ভাস্কর্য সরানো, পেয়েছেও। কিন্তু এত ত্যাগের পরও লাভের খাতায় জমা পড়ল শূন্য। হেফাজতের নেতৃত্ব চলে যায় জামাতপন্থীদের হাতে, ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ ব্যর্থ হল— রাজনীতি ফিরে যায় শূন্য বিন্দুতে। তবে এই চোরাগোপ্তা সম্পর্ক সমাজে গড়ে তোলে এক বিষাক্ত মৌলবাদী পরিসর। পাঠ্যবইয়ে কমে যায় রবীন্দ্রনাথ, কমে যায় নজরুল, কমে যায় লালন। বুড়িগঙ্গায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাসে, ভাঙে, পোড়ে। প্রগতিশীলেরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। সংখ্যালঘুরা হারায় সাহস। ধর্মান্ধরা জেগে ওঠে সংগঠিতভাবে। সংস্কৃতিচর্চা থেকে সরে আসে রাষ্ট্র ও সমাজ। আর, যাদের সঙ্গে আপস করা হল, তাদের কাছ থেকে মিলল না একটিও ভোট।
এমতাবস্থায় ভবিষ্যতের জন্য চাই এক সাহসী জাগরণ— যেখানে গর্জে উঠবে সত্য, মুছে যাবে ভয়ের কুয়াশা। মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত দ্বিতীয় অধ্যায় এখনো অপেক্ষমাণ। এখন প্রতীক্ষা সত্যিকার এক বাঙালি রেনেসাঁস-এর। ধর্মান্ধতার রাজনীতি, সংস্কৃতি ও রীতি— যেখানে সবকিছুকেই দিতে হবে বিসর্জন।
মরার উপর খাঁড়ার ঘা
আর সেই রেনেসাঁস-এর ঠিক দক্ষিণ প্রান্তে, নাফ নদীর কিনারায়, মানবিক এক শরণার্থী সংকট— রোহিঙ্গা সমস্যা আজ হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক কূটনীতির আগ্নেয়গিরি। মিয়ানমারের আরাকান এখন আরাকান আর্মির হাতে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এই লাখো রোহিঙ্গার মধ্যে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা। মালাক্কা প্রণালী হয়ে চিনের জ্বালানি প্রবাহ, বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নৌসেনা— সবই যুক্ত হয়ে যাচ্ছে এক ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে। জর্জ সোরোসের ছায়া, ইউক্রেন মডেলের পদচিহ্ন— সবই আজ দৃশ্যমান ঢাকায়। এই দেশে, গড়ে তোলা হচ্ছে মিলিশিয়া, তৈরি হচ্ছে ছায়াযুদ্ধের সম্ভাবনা। যদি ভারত কখনো হামলা চালায়, তবে পাকিস্তান ও আমেরিকা সেই ভূখণ্ডেই প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করবে। এই পরিকল্পনা তাৎক্ষণিক নয়— এর গভীরতা কয়েক দশকের। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দেওয়ার পেছনে এই তাত্ত্বিক কাঠামোই কাজ করেছে— যাতে ভারত বাধ্য হয় আগ্রাসনে, আর দুনিয়া পায় এক নতুন দক্ষিণ-এশীয় মানচিত্র। স্মরণীয় এক বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেছিলেন:
যদি বলি, সেন্ট মার্টিন বা দেশ কাউকে লিজ দেব, তাহলে ক্ষমতায় থাকতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সেটা আমার দ্বারা হবে না।
ক্ষমতা হারানোর এক বছর আগে, ২১ জুন ২০২৩, গণভবনে দাঁড়িয়ে উচ্চারিত এই দৃপ্ত বাক্য।
শেখ হাসিনার সীমানা পেরিয়ে দেখলেও বোঝা যায়— রোহিঙ্গা সমস্যা, ইউনুসবিরোধী মামলাগুলো, পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের পিছু হটা, আর আমেরিকার চিন-বিরোধী তৎপরতা— সবকিছুর মাঝে গ্রন্থিত আছে এক বৃহৎ ভূ-রাজনৈতিক মেঘ। চিন, মাত্র তিন দশকে ৮০০ মিলিয়নের বেশি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করে আজ বিশ্ব-শক্তিতে পরিণত। তার এই উত্থান চ্যালেঞ্জ করছে মার্কিন শ্রেষ্ঠত্বকে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে এবার জমছে নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি। বিশ্বযুদ্ধের মেঘ ঘনাচ্ছে আকাশে। এই যুদ্ধের ছকে, চিনের রক্তনালীতে যদি তেল বন্ধ করতে হয়— তবে প্রথম নজর দিতে হবে সেন্ট মার্টিনের দ্বীপে। এই প্রবাল দ্বীপ আজ কেবল একটি ভূখণ্ড নয়— এ এক কৌশলগত চাবিকাঠি, বিশ্বরাজনীতির নতুন দিগন্তে।
বাংলাদেশে আজ ইন্দো-প্যাসিফিক যুদ্ধকৌশল, দ্য গ্রেট রিসেট, এবং ডিপ স্টেটের গভীর ষড়যন্ত্র একই ছাদের নীচে এসে মিলিত হয়েছে। ঢাকার রাজপথ থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগরের গভীর জলরাশি পর্যন্ত— এক অদৃশ্য আগ্নেয়গিরির উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। ডিপ স্টেট, গ্লোবালাইজেশন ও ওপেন সোসাইটির নামে পরিচালিত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাসের যে নয়া বিশ্ব ব্যবস্থাপনার রূপরেখা, তার মূল লক্ষ্য হল— সমগ্র বিশ্বে একটি অভিন্ন রাষ্ট্র, একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং একটি উচ্চ-প্রোফাইল সমাজ গঠন করা। বাকিসব জনগোষ্ঠী পরিণত হবে অধিকৃত ও নিয়ন্ত্রিত শ্রেণিতে। এই মহাপরিকল্পনার নামকরণ করা হয়েছে ‘দ্য গ্রেট রিসেট’। এই রিসেটের মাধ্যমে অধীনস্থ সকল দেশের কৃষ্টি, ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, রাজনীতি, স্বাধীনতা, গৌরব, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্বকীয়তা ধূলিসাৎ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে যে ‘রিসেট বাটন’ বিষয়ক আলোচনা হয়েছিল, তা এই বৃহৎ পরিকল্পনারই অংশ। এ পরিকল্পনার প্রধান বাস্তবায়ক হিসাবে কাজ করছেন জর্জ সোরোস এবং মার্কিন ডিপ স্টেটের নেতৃত্বাধীন গ্লোবালিস্ট রাজনীতিকগণ। নোবেল শান্তি পুরস্কারও এই প্রকল্পের একটি কার্যকর উপাদান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ভূখণ্ড— পাকিস্তান, মিয়ানমার, তিব্বত এবং বাংলাদেশ— যেখানে এই তথাকথিত শান্তির বীজ রোপিত হয়েছে, সেখানে সংঘাতের উত্তাপ ক্রমাগত বেড়েছে। এ থেকেই অনুধাবন করা যায়, কত গভীরে ও সুসংগঠিতভাবে এই পরিকল্পনার শিকড় বিস্তৃত হয়েছে। বস্তুতপক্ষে, ‘উয়োক’-সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিহীনতার আগ্রাসন সারা বিশ্বের মাটির গভীরে প্রোথিত জাতিসত্তা, স্থানিক-জীবনপ্রণালী, ঐতিহ্য ও মনোভাব ধ্বংস করে দিতে সচেষ্ট।
আবার একই সময়ে পার্শ্ববর্তী রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসন এবং আরাকানি জনগণের অধিকারের দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যে জান্তাবিরোধী সংঘাত আরও তীব্রতর হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি রাখাইনের অধিকাংশ অঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমার জান্তার উপর চাপ বৃদ্ধির কৌশল হিসেবে আরাকান আর্মিকে পরোক্ষ সমর্থন এবং পরবর্তীতে ব্যবহারের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশকে ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে বলে আলোচনা ছড়িয়েছে। প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাংলাদেশ আরাকান আর্মিকে ‘মানবিক’ বা ‘নন-লেথাল’ (অ-মারাত্মক) সামরিক সহায়তা প্রদান করবে। এ বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষত এক্স-এ (প্রাক্তন ট্যুইটার) ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। পরিকল্পনায় বাংলাদেশের সর্ব-দক্ষিণ উপকূল ব্যবহার করে আরাকান আর্মির জন্য রসদ সরবরাহ, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি, এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরকে ড্রোন স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করে মিয়ানমারের বন্দরগুলির ওপর নজরদারি করার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পাশাপাশি, রোহিঙ্গা সমস্যা এবং জাতিসংঘকে কাজে লাগিয়ে রাখাইনে একটি মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার কূটনৈতিক উদ্যোগের কথাও আলোচিত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, মানবিক করিডোরের আড়ালে এ সহায়তাকে জাতিসংঘের ছত্রচ্ছায়ায় এনে বৈধতা প্রদান করা হবে।
যদিও প্রাথমিকভাবে এসব সহায়তা অসামরিক প্রকৃতির বলে মনে হতে পারে, তথাপি এর অপব্যবহারের সম্ভাবনা প্রবল এবং বাংলাদেশের একটি জটিল ও বিপজ্জনক ‘ডার্টি ওয়ার’-এ জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি অত্যন্ত বাস্তব। বিগত রমজান মাসে, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উপস্থিতিতে ইফতার মাহফিলে উত্থাপিত মানবিক করিডোরের প্রস্তাব, বাংলাদেশকে একপ্রকার ‘স্টিকি ডার্টি ওয়ার’-এর গভীরে টেনে নেওয়ার একটি সুপরিকল্পিত প্রয়াস হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। ফলস্বরূপ, এই ভূখণ্ডের রাজনৈতিক মানচিত্রের নতুনায়নও ত্বরান্বিত হতে পারে।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতীতে বহুবার বিদ্রোহী গোষ্ঠী বা স্থানীয় বাহিনীকে পরোক্ষভাবে সহায়তা দিয়ে দেশ বা অঞ্চলগুলোকে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত ও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ ধরনের সহায়তা সাধারণত অস্ত্র সরবরাহ, প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য এবং লজিস্টিক সহায়তার মাধ্যমে শুরু হয়, যা আপাতত নিরীহ বা অ-মারাত্মক মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে সিআইএ-এর নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে ‘ডার্টি ওয়ার’-এ পরিণত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সিরিয়ায় ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ নামে যুক্তরাষ্ট্র ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (FSA), পরবর্তীতে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (SDF) এবং কুর্দি মিলিশিয়া YPG-কে সহায়তা প্রদান করে। এর ফলে যদিও আইসিস (ISIS)-এর শক্তি হ্রাস পায়, তবে সিরিয়ার অভ্যন্তরে রাশিয়া-সমর্থিত আসাদ সরকার, তুরস্ক, কুর্দি গোষ্ঠী এবং ইরানপন্থী মিলিশিয়ার মধ্যে বহুমুখী সংঘাতের সূত্রপাত হয়। স্মরণীয় যে, ইতিহাসের পৃষ্ঠা রক্তমাখা উদাহরণে ভরা। সিরিয়ায় ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ নামে শুরু হয়েছিল নন-লেথাল সহায়তা। ফলাফল?— এক বহুপক্ষীয় গৃহযুদ্ধ, রাষ্ট্রের ভাঙন, এবং একটি চিরস্থায়ী বিপর্যয়। আজ সিরিয়া একটি ছিন্নভিন্ন ভূখণ্ড; কাল কি সেই ভাগ্য বাংলাদেশেরও হতে পারে?
উপসংহার
বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতা, ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সাংস্কৃতিক জটিলতা পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। একদিকে রয়েছে ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের বিষবৃক্ষ, যা রাজনৈতিক আপস ও আত্মঘাতী কৌশলের ফলে সমাজে শেকড় গেড়েছে। অন্যদিকে রয়েছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির চাপ ও ষড়যন্ত্র। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সামনে উন্মুক্ত দু-টি পথ— এক, আপস করে আত্মবিস্মৃত ও নিয়ন্ত্রিত একটি রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া; দুই, নিজেদের ঐতিহাসিক আত্মপরিচয়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে একটি আত্মনির্ভর, প্রগতিশীল ও স্বাধীনচেতা জাতি হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা। দ্বিতীয় পথটি কঠিন, ত্যাগসাধ্য এবং সংঘাতপূর্ণ। তবু এটিই ভবিষ্যতের পথ— কারণ এই পথেই রয়েছে আমাদের অস্তিত্বের রক্ষা, জাতিসত্তার মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা।
আজ, প্রয়োজন একটি নতুন সাংস্কৃতিক জাগরণ— যা কেবল শিল্প-সাহিত্য নয়, বরং জাতির চিন্তা, চেতনা ও মূল্যবোধের গভীর পুনর্জন্ম ঘটাবে। প্রয়োজন এমন এক রাজনৈতিক ঐক্য, যা ধর্মীয় বিভাজনকে অতিক্রম করে মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা পাবে। নতুন প্রজন্মকে সত্য ইতিহাস, যুক্তিবাদী শিক্ষা এবং সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক অনুশীলনের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রকেও প্রস্তুত থাকতে হবে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায়— সুপরিকল্পিত কূটনৈতিক কৌশল, জাতীয় ঐক্য এবং দৃঢ় প্রস্তুতির মাধ্যমে।
এখন সময় এসেছে— বাঙালির জাতিসত্তার পুনর্জাগরণ ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত অঙ্গীকার সম্পন্ন করা। শুধু অতীতের ব্যর্থতার বিচার বিশ্লেষণ আর যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন ভবিষ্যতের জন্য একটি শক্তিশালী, সুস্পষ্ট এবং আদর্শনির্ভর রূপরেখা নির্মাণ। সুনামি আসবেই— কিন্তু একটি সুশৃঙ্খল, ঐক্যবদ্ধ, শিক্ষিত ও চেতনায় জাগ্রত জাতি কোনো সুনামির সামনেই মাথা নত করে না।