সুশান্ত পাল
‘আজ দুর্গার অধিবাস, কাল দুর্গার বিয়ে’ ছড়ায় অপরাপর বিজয়া সংগীতের মতো বিষণ্ণ সুর বেজে উঠেছে। আমাদের বাংলাদেশের কন্যাবিদায়ের অশ্রুপ্লাবিত বিষাদঘন ছবি করুণরসে জারিত করে উন্মনা করে তুলেছে প্রিয়জনের অন্তঃকরণকে। স্নেহের নিধিকে ছাড়তে মন চায় না। রোরুদ্যমানা বালিকার বিয়োগ ব্যথায় আকুল সবাই– মা, বাপ, পিসি, ভাই। কলহ-মধুর সম্পর্ক ছিল যার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি, সেই মুখরা বোনটিও আসন্ন বিচ্ছেদ লগ্নে বাক্শূন্য, অশ্রুসজলধারা নির্বাধ। ছড়াকার সেই কিশোরীর একাকিত্বের যন্ত্রণাকে প্রকাশ করলেন শেষ দু-টি চরণে—
বোন কাঁদেন বোন কাঁদেন খাটের খুরো ধরে সেই যে বোন গাল দিয়েছেন ভাতারখাকী বলে।।১
রবীন্দ্রনাথ যখন ‘ছেলেভুলানো ছড়া’ প্রবন্ধে উল্লিখিত ছড়ার প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন, তখন ‘ভাতারখাকী’ শব্দটি পালটে বসালেন ‘স্বামী খাকী’। অন্যত্র লিখলেন— ‘ভর্তৃখাদিকা’। কিন্তু কেন এই পরিবর্তন?
রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাষায়:
কন্যাটির মুখে এমন ভাষা ব্যবহার হওয়া উচিত হয় না যাহা আমি ভদ্রসমাজে উচ্চারণ করিতে কুণ্ঠিত বোধ করিতেছি। তথাপি সে ছত্রটি একেবারেই বাদ দিতে পারিতেছি না। কারণ তাহার মধ্যে কতকটা ইতর ভাষা আছে বটে, কিন্তু তদপেক্ষা অনেক অধিক পরিমাণে বিশুদ্ধ করুণ রস আছে।… আমরা সেই গালিটিকে অপেক্ষাকৃত অনতিরূঢ় ভাষায় পরিবর্তন করিয়া নিম্নে ছন্দ পূরণ করিয়া দিলাম।২
সুতরাং, ভদ্রসমাজের রুচিবোধে লোকসাহিত্যের ‘ইতর’ শব্দ গ্রহণযোগ্য নয় বলেই রবীন্দ্রনাথকৃত এই সংমার্জন-সংবর্জন-সম্পাদন। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক— একমাত্র ভদ্রলোকের রুচি সাহিত্যবিচারের আবশ্যিক শর্ত তথা মানদণ্ড? তাঁদের গ্রহণযোগ্য ভাষা-ই রচনার একমাত্র উপযোগী উপাদান? আমরা কী তবে বক্তা, প্রেক্ষিত, উদ্দেশ্য-উপলক্ষ্য, শ্রোতার বৈভিন্ন্য, তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-শ্রেণিগত বিশিষ্টতা ভুলে একমাত্রিক ভাষিক-নির্দেশ ও নন্দনতাত্ত্বিক কাঠামোয় ভদ্রলোকোচিত সাহিত্য রচনায় ও পাঠে প্রবৃত্ত হব?
নাগরিক রুচির বিপরীতে মৌখিক সাহিত্য স্থূল-অমার্জিত-অগভীর বিবেচনায় হয়-তা সংশোধিত হয়েছে, অথবা ‘গ্রাম্যতা’ চিহ্নায়ণে ভদ্রসমাজবৃত্ত থেকে হয়েছে ঠাঁই নাড়া। অথচ, ক্ষমতাশীলের নন্দনতত্ত্ব, তার সুন্দর-ইতর শাব্দিক বাছবিচারের নজরদারিতে, গোঁড়ামিতে লোকসৃষ্ট সাহিত্যের মূল্যায়ন কী আদৌ নৈর্ব্যক্তিক? শ্রমজীবী স্ববৃত্তাবদ্ধ মানুষের সুন্দর-অসুন্দর-রুচি-তৃপ্তি-কামনা-বাসনা, আবেগের অভিব্যক্তি কী ভদ্রলোকের শৈলী-ব্যাকরণের নিয়ম মেনে চলবে? যৌথ-জীবনে যৌথ-স্রষ্টায় রচিত যৌথ-ভোক্তা কর্তৃক গ্রহিষ্ণু লোকসাহিত্য একাধারে সরল ও স্বতঃস্ফূর্ত, মাটিলিপ্ত জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত। কর্তৃত্বপরায়ণ ‘বিশুদ্ধতার’ হেজিমনিক বেড়ি এখানে অচল। প্রকৃতপক্ষে— ‘ভদ্রশ্রেণির উপভোগ বা Consumption-এর জন্য পরম্পরাগত ওইসব রচনা রচিতও হয়নি। ফলে এসব রচনায় গ্রাম্য শব্দ, ব্যাকরণদুষ্ট, অর্থাৎ ভদ্র সমাজের ব্যাকরণে অগ্রহণযোগ্য শব্দ প্রচুর আছে, কোথাও কোথাও উদ্দাম উল্লাসের মধ্যে কিংবা নিছক প্রতীক প্রয়োগে যে রুচির পরিচয় পাওয়া যায় তাও ভদ্রসমাজে প্রকাশ্যভাবে প্রচারিত রুচির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।’৩ নাগরিক সৌন্দর্যচেতনা যেন মৌলবাদের মতোই চরমপন্থী, অহংস্ফীত, আবেগমুখী হয়ে এ-সব রচনা-ভাষা প্রত্যাখ্যান তৎপর। যদুনাথ সরকার লিখছেন— ‘সাহিত্যের উপকরণ অর্থাৎ সর্বোচ্চ চিন্তা, মহৎ ভাব গ্রাম্যভাষায় ঠিক ব্যক্ত করা যায় না। যে ভাষা আমাদের হৃদয়কে অনন্তের সঙ্গে যোগ করিয়া দিবে তাহাকে অতি সূক্ষ্ম অতি কোমল ভাবগুলি প্রকাশ করিতে হইবে। সরল কথায় ওই কাজ করা যাইতে পারে, কিন্তু গ্রাম্য কথায় নহে। গ্রাম্য ভাষা সাহিত্যের ভাষা হইতে পারে না।’৪
‘ভদ্র’ এবং ‘ইতরের’ সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের মতো ভাষার জগতে ‘সাধু’ ও ‘শূদ্র’ শব্দের বিভেদের বিরুদ্ধে, মুখের ভাষা-কে লেখার ভাষায় অনুপ্রবেশের স্বপক্ষে সোচ্চার হয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী। ঈশ্বর গুপ্ত, কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্যারীচাঁদ মিত্রের প্রচেষ্টা সার্থকমণ্ডিত হয়েছিল ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত চলতি ভাষার লেখায়। কিন্তু, অভিজাত সাহিত্যতন্ত্রের বিধিনিষেধ-কে প্রমথ চৌধুরী-ও অতিক্রম করতে অসফল হলেন। তিনি সাহিত্য-উপযোগী ভাষার দিক্নির্দেশ করছেন—
ইতর কথার উদাহরণ দেওয়াটা সুরুচিসংগত নয় বলে আমি খাস কলকাত্তাই ভাষার ইতরতার বিশেষ পরিচয় এখানে দিতে পারলুম না। কলকাতার লোকের আটহাত আটপৌরে ধুতির মতো তাদের ভাষাও বি-কচ্ছ, এবং সেই কারণেই তার সাহায্যে ভদ্রতা রক্ষা হয় না। স্ত্রীর প্রতি ম-কারাদি প্রয়োগ করা, যাদের জঙ্গল কেটে কলকাতায় বাস সেই-সকল ভদ্রলোকেরই মুখে সাজে, বাঙালি ভদ্রলোকের মুখে সাজে না। এই কারণেই বাঙালে ভাষা কিংবা কলকাত্তাই ভাষা, এ উভয়ের কোনোটিই অবিকল লেখার ভাষা হতে পারে না। আমি যে-প্রাদেশিক ভাষাকে দক্ষিনদেশী ভাষা বলি, সেই ভাষাই সম্পূর্ণরূপে সাহিত্যের পক্ষে উপযোগী।৫
আসলে মান্য ভাষা রূপে বিবেচিত ‘দক্ষিণদেশী ভাষা’ বলতে প্রমথ বাবু কলকাতা-সন্নিহিত যে রাঢ় ভাষাঞ্চল-কে চিহ্নিত করেছেন তার মূলেও রয়েছে আধিপত্যের যোগসাজশ। নগর কলকাতার অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দাপট।
অন্যদিকে অভিজাত ক্ষমতার একমাত্রিক স্বর থেকে স্বতন্ত্র যৌথ প্রয়াসে রচিত লোকসাহিত্য ছিল কর্মজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত, অবসর যাপন ও আমোদ প্রমোদ বিনোদনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। তারা দেবতাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে পারে, ক্ষমতাবানকে অশ্লীল ভঙ্গি। অ-সুন্দর গেঁয়ো রূপে দাগিয়ে দিলেও লোকসমাজ ভদ্রসমাজের নন্দন-রুচির আকার-বিকারকে পরোয়া করেনি। তথাকথিত অ(?)-শ্লীল ভাষা, গালাগাল, যৌন-ইঙ্গিত, পরিকল্পনা, ভ্যাংচানিতে প্রবাদ, ছড়া, বিয়ের গান, তরজা গান, জাগ গান আনুষ্ঠানিক সাহিত্য বিচারের আদর্শিক মানকে তুচ্ছ করে ছুড়ে ফেলে দিতে চেয়েছে প্রতাপের উল্লম্বিত (vertically) অবরোহী অনুশাসন। মূলানুগত্যের নাগরিক সাহিত্যাদর্শের প্রতি উপেক্ষায়, কোনও দায়বদ্ধতা ছাড়াই লোকসাধারণের মুখে-মুখে তৈরি বিভিন্ন কথামালা-ছড়া আবরু-বিহীন ভাষায় সরল বলনে-চলনে অনুভূমিক (horizontally) বিস্তারে ছড়িয়ে পড়েছে। মৌখিক সাহিত্য চরিত্র স্বভাবতই উদার ও অ-মূলানুসারী।
এক্ষণে ভদ্রলোকের ‘শ্লীল’ ভাষায় গঠিত সাহিত্যের একদম উলটো দিকে অক্ষরজ্ঞানহীন দরিদ্র প্রান্তিক জনপদবাসী তপশিলি, মুসলিম নারীদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া, তাদেরই রচিত ছড়াগুলি প্রাসঙ্গিক কারণেই উদ্ধৃত করব। বিশিষ্ট লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও গবেষক মুহম্মদ আয়ুব হোসেন উদ্ধারিনী মাঝি, সুখবিলাসিনী দাস, অষ্টা ঘোষ মুখোপাধ্যায়, বালি দাস, বুলা দাস, শংকরী দাস প্রমুখ গ্রাম্য-মেয়েদের কাছ থেকে ছড়াগুলি সংগ্রহ করে ‘বিচিত্র লোকসাহিত্য’ নামের গ্রন্থে সংকলিত করেছেন। ছড়াগুলি অবিকৃত অবস্থায় মুদ্রিত হয়েছে বলে গবেষক দাবি করেছেন। কেননা, ভদ্রলোকের রুচি-শালীনতায় বিগর্হিত শব্দ, উপমা, প্রতীক পরিমার্জনা বিহীন অবিকল থেকেছে। যৌবন রসসম্ভোগে, অবৈধ যৌনকার্যকলাপে প্রেম-পিরিতির ছলা-কলায় ‘টাটকা’ ‘সতেজ’ ছড়াগুলি পাঠ করে বা শুনে ভদ্রলোক শিউরে উঠে কানে আঙুল দিতে পারেন, অথবা অশ্লীলতার তকমা সেঁটে তাচ্ছিল্য, ঘৃণা পোষণ করতে। যেমনভাবে, বড়ু চণ্ডীদাস বৈষ্ণবীয় সমাজে মহাজন পদকর্তার সম্মান লাভ করেননি। তাঁর নরনারীর মিলনদৃশ্যে— ‘ঘন তন জঘন মরদিল করে/ নানা পরকার কৈল রাধা নখঘাত ডরে।।/ …নিতম্ব পরসি জঘনত দিল হাথ। / অতি ঊতরলমতী হৈল জগন্নাথ।।’৬— আধ্যাত্মিকতার চাদর বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘অন্নদামঙ্গল’ রচিয়তা রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের কাব্যকুশলতাকে অকুণ্ঠ স্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেও দ্বিধা দেখা গিয়েছে তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যের আদিরস উপলব্ধির ক্ষেত্রে। যখন— ‘চুম্বন চুচু কৃতি শীৎকৃতি শিহরণ/ কোকিল কুহরে গলায়ে।’৭— ভদ্রলোক পাঠক তখন রসাবেশের ‘উথলিল নব তরঙ্গে’-র আবেশ ছেড়ে ভারতচন্দ্রকে মহিমান্বিত করেছেন— ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’— চরণের লিখিয়ে রূপে। অন্নদাশঙ্কর রায় যথার্থ বলেছেন— ‘আদিরস আদিকাল হতেই জীবনের তথা সাহিত্যের অঙ্গ। তাকে বাদ দিয়ে বা তুচ্ছ করে জীবনও হয় না, সাহিত্যও হয় না।’৮ বিচিত্র সাহিত্যের মহিলা ছড়াকাররা বৈধ-অবৈধ প্রণয়ক্রীড়াকে তাদের সমাজভাষায়, লিঙ্গ-ভাষিক বৈচিত্র্যে, সহজাত জৈবিক-জীবন-অন্বিষ্টতায় আমাদের সামনে হাজির করেছেন। নাগরিক সভ্যতার নারী দেহকে পণ্য করে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক পর্ন-সাহিত্যের বিপ্রতীপে এইসব ছড়ায় ক্ষেত্রবিশেষে গ্রামীণ মেয়েদের যৌনাচারে স্বাধীনতার দিকটি উচ্চকিত। একজন নিম্নবর্গীয় নারী স্বাধিকারে ঘোষণা করতে পারে—
কাচের বাটি সারি সারি। ভাঙলে জোড়াতে পারি।। তুমি রাতে যাও ঢেমনির বাড়ি। আমিও কুল মজাতে পারি।৯
অবস্থান্তরে দেহোপজীবিনী সদর্পে লৈঙ্গিক ক্ষমতার রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে—
আমি গায়লার নারী সুন্দরী, হয়েছি কড়ুই রাঁড়ি। কেশেপুর আমার বাড়ি, এক বিছানায় শুয়ে আমি, একশো মরদ আমি পার করি।।১০
সিমোন দ্য ব্যোভেয়ার সঙ্গম-কে রণক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর মতে এই সমরে পুরুষাঙ্গের অস্ত্রে নারী অধিকৃত হয়। নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকা নারী যৌনাঙ্গটি পুরুষ আধিপত্য গ্রহণের আধার হয়ে ওঠে। বিছানায় পুরুষটি কর্তৃত্বশীল ভূমিকা পালন করে, নিজের কামকে চেটেপুটে সম্ভোগে পরিপূর্ণ করে নারীকে অধীনস্থ করে দস্তুর মতো। ব্যোভেয়ার শয্যা নিয়ন্ত্রণের পৌরুষ প্রকাশের কার্যক্রম, পুরুষ কর্তৃক নির্ধারিত সঙ্গমের কৌশলে নারীর পরাজয় দেখেছেন। বলছেন:
বাল্যকাল থেকেই উচ্চমন্যতা ও হীনম্মন্যতার ধারণা দু-টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; উঁচু গাছে ওঠা কৃতিত্ব; স্বর্গ পৃথিবীর ওপরে, নরক নীচে; পড়ে যাওয়া, নীচে নামা ব্যর্থতা; ওপরে ওঠা সাফল্য; কুস্তিতে জিততে হলে প্রতিপক্ষের কাঁধ মাটির সাথে লাগিয়ে দিতে হয়। এতে নারীটি পড়ে থাকে পরাজয়ের ভঙ্গিতে; তার চেয়েও খারাপ হচ্ছে পুরুষটি তার ওপর, চড়ে থাকে যেভাবে সে চাবুক হাতে বল্গা ধরে চড়ে কোনও পশুর ওপর।’১১
ক্যাথেরিন ম্যাকেনিনের মতানুযায়ী– ‘নারী কামে সক্রিয় সম্ভোগী হতে পারে না, কোনও সংস্কৃতিই চায় না কামে নারী উদ্যোগী ভূমিকা নিক…।১২
মৌলবাদী মতাদর্শের মতোই পুরুষতন্ত্র সর্বদাই বিপরীত লিঙ্গের মানবীর অস্তিত্বকে ‘ভ্যাজাইনা’ ও ‘বুবসে’ সংকুচিত করতে চেয়েছে। খণ্ডিত সত্তা! নিম্নবর্গীয় কেশপুরের গায়লার নারী কিন্তু এক বগ্গা যৌনক্রীড়ায় মেয়েদের উদ্যোগী ভূমিকাকে সামনে এনে লিঙ্গ-রাজনীতিতে অপর বয়ান রচনা করেছে। সম্প্রতি মাদ্রাজ হাইকোর্ট একটি রায়ে এক বিবাহিত নারীর স্বমেহন করা ও পর্নফিল্ম দেখাকে ব্যক্তিগত পরিসরের অধিকার রূপে চিহ্নিত করে স্বামীর আনা বিবাহবিচ্ছেদের মামলা খারিজ করেছে (আনন্দবাজার পত্রিকা ২১ মার্চ, ২০২৫)। ‘লাস্ট স্টোরিস’ চলচ্চিত্রে আমরা দেখি দাম্পত্য যৌনতায় অতৃপ্ত মেঘা নামের মেয়েটি কৃত্রিম পুরুষাঙ্গের মাধ্যমে যৌনক্ষুধা মেটাতে চাইছে। অশালীনতার অভিযোগ উঠেছে সহসাই।
নিম্নবর্গীয় নারীরা তাদের ছড়ায় তাদের প্রাত্যহিক ভাষায় যৌনবিধি, জনন প্রক্রিয়ার কৃৎকৌশলকে বলে চলেছে—
অ-ছুঁয়াচ হয়েছে আমার, কাপড়ে আছে নিশেনা। চার পাঁচ দিন সবুর কর, তার পরেতে নেই মানা।। তুই আমার ভালোবাসা, এখন হচ্ছে মাথা ঘষা। সেই জমিতে বীজ ফেলবে, ফসল তখন হবে খাসা।।১৩
উনিশ শতকের শীলিত বাবু সাহিত্য জমিদার নন্দনদের, অভিজাত বাড়ির প্রণয়-কেচ্ছা আড়ালে-অন্তরালে আভাসে লুকোতে ব্যস্ত যেন, গ্রাম্যসাহিত্যে সমাজ-নিষিদ্ধ প্রেম প্রকাশে খুঁতখুতানি নেই; ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ মনোভাব থেকে মুক্ত। দেওর-বৌদি ও শাশুড়ি-জামাইয়ের সমাজ-গর্হিত সম্পর্ক ছড়াকার গোপন করেননি। পাশাপাশি দু-টি ছড়া—
ঘর নিকালাম, দুয়োর নিকালাম দিয়াল থাকল বাসি। সোনার মতো স্বামী থাকতে, দেওরের সাথে আছি।। দেওর আমার অতি খাসা, যদি করে বিয়ে। ভরা যৌবুনে মরব আমি, গলায় দড়ি দিয়ে।।১৪
ভাগ্যে ঘরে জামাই এল, তাই শাশুড়ির পেট হল। গিজাং কি মজার কথা লো, কি মজার কথা।।১৫
ছড়াকার প্রান্ত্যেবাসী নারী উচ্চবর্গীয় বামুন ঠাকুর, দেবতা, পৌরাণিক চরিত্রকে নিয়ে ব্যঙ্গ-পরিহাস করতে পিছ-পা হননি, ক্যারিকেচারে মাটিতে নামিয়ে এনেছেন। একদিকে তা যেমন ভদ্রলোকদের লাম্পট্য উদোম করে, অন্যদিকে দেব-দেবীর রক্তমাংসল মানবায়ন ঘটে। চর্যাপদে আমরা দেখেছিলাম বামুন ঠাকুরের প্রতি বাঁকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন চঞ্চলা ডোম বধূ। রসিক নাগর বামুন ঠাকুরকে নিয়ে দু-টি ছড়াচিত্র এরূপ—
ওহে নাগরী, পরেছ ঘাঘরী, যমুনায় করিছ স্নান। তোমার বুকের শ্রীফল দুটি আমায় করো দান।। ওহে ও বামুন ঠাকুর, করছি এখন স্নান। স্নান সেরে ঘরে ফিরে, করব শ্রীফল দান।।১৬
ও পারে ঘুঘু চরে, ঘুঘুর পায়ে নূপুর। ঠ্যাং তুলে মাং মেরে গেল, চেতলার ঠাকুর।।১৭
পাড়া-গাঁয়ের ছোঁড়ার সঙ্গে অভেদাত্মকতায় কেষ্ট ঠাকুরের সঙ্গে রঙ্গ-তামাশা মৌলবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে যখন-তখন—
ও কালো ছোঁড়া। যাস আমাদের পাড়া। হাতের বাঁশি কেড়ে নিয়ে, মুচ্ড়ে দিব বাড়া।।১৮
‘বানুবিবির পালা’-য় দেখি মৌলবি সাহেবের যৌনকাতরতা—
মৌলুবি কেউ দেখলে তারে, কামাবে যে দাড়ি। মান অপমান ভুলে মৌলুবি যাবে বানুর বাড়ি।১৯
একটি ছড়া পড়ে চমকে উঠতে হয়— এক দেহপসারিনি দ্রৌপদীর পাঁচজন স্বামী থাকার বিষয়টিকে যুক্তির ঢাল করে তাঁকে ‘বেশ্যার’ সম-পঙ্ক্তিভুক্ত করে বলছে—
দিন ভাতারি বেশ্যা নারী, পাঁচ ভাতারি কৃষ্ণা ছুঁড়ি। বেশ্যারা দিন দিন ভাতার বদল করে। মাস অন্তর কৃষ্ণা ছুঁড়ি ভাতার বদল করে। পাঁচ ভাতার থাকতে ছুঁড়ি কর্ণকেও চায়। বলি আমি তাই দুজনে তো একই, কৃষ্ণা আবার সতী নাকি।।২০
মধুসূদন দত্ত ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের ‘নীলধ্বজের প্রতি জনা’ পত্রে দ্রৌপদীকে ‘ভ্রষ্টা রমণী’ রূপে ও তার শাশুড়ি ভোজবালা কুন্তী-কে ‘কুলটা’, ‘বেশ্যা’ রূপে আখ্যায়িত করেছেন রাজ্ঞী জনার জবানিতে; পুরাণ-মহাকাব্যের একানুগত পাঠের সমান্তরালে প্রেক্ষিত নির্ভর ব্যক্তিক, লৌকিক দৃষ্টিকোণ বর্ণাশ্রম শাসিত অজর শব্দার্থের ভিত টলিয়ে দেয় নিশ্চিত।
বিচিত্র ছড়ার উৎস-উদ্ভব সম্পর্কে মুহম্মদ আয়ুব হোসেন-এর মতটি হল—
মানব-মানবীরা দেখেছিল, মেঘ হতে বৃষ্টি ঝরে। মেঘের দেবতাকে পুরুষ কল্পনা করে, বৃষ্টির জল প্রার্থনার জন্য, সেদিনের যুবতি মেয়েরা তাকে তুষ্ট করার জন্য উলঙ্গ হয়ে নৃত্য করে জল প্রার্থনা করত। জল প্রার্থনার ভাষাগুলি ছিল আদিরসাত্মক।২১
সুতরাং, নিঃসন্দেহে এ-কথা বলা যায় নিম্নবর্গীয় মেয়েরা তাদের স্ববৃত্তাবদ্ধ সমাজের জীবনচর্যায়, আচারে, রীতিতে অভ্যস্ত ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে বেরিয়ে এসে পুরুষের শ্রমভাগী হয়েছেন। কথকের মর্যাদায় ছড়ায়-ছড়ায় সমাজচিত্রের অন্তঃসার প্রকাশ করেছেন। ভদ্রলোকের অনড় নন্দনচেতনায় এই সব ছড়া প্রবাদ অবজ্ঞায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে অ-গভীর, অ-সুন্দর, অ-শ্লীল রূপে বর্গীকৃত হয়েছে।
উনিশ শতকীয় ভদ্রবিত্ত অবশ্য তাদের ঘরের ‘ভদ্র’ মহিলাদের অন্তঃপুরিকা থেকে শর্তসাপেক্ষে, পুরুষের বেধে দেওয়া সীমানায় পা-রাখার অনুমতি দিয়েছেন; য়ুরোপীয় নবাদর্শে দীক্ষিত ভদ্রলোকের উপযোগী ‘উৎকৃষ্ট গৃহিণী ও মাতা’ তৈরির জন্যে ‘মাগী’ ‘দাসী’-র পরিবর্তে প্রয়োজন ‘জেন্টেল লেডি’। আদব-কায়দা, সহবত শেখার পাশাপাশি আশা করা হয়েছিল— ‘নারী শিক্ষিত হয়ে ঘরে ঘরে নেপোলিয়ান, জর্জ ওয়াশিংটন প্রসব করবে; পুত্রদের করে তুলবে মহাপুরুষ, স্বামীদের করবে শিক্ষিত সেবা।’২২ ও-দিকে রক্ষণশীলদের মুখপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ সমাজ রসাতলে যাওয়ার ভয় দেখায়। অসূর্য্যস্পর্শা অন্দরমহলের গণ্ডি ডিঙোলে ‘কামাতুর’ পুরুষ-‘খাদক’ ‘তাহাদিগকে বলাৎকার করিবে’।২৩ এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের আবহে নারীদের জন্য, নারী সম্পাদনায় প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকার নাম স্মতর্ব্য— ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’, ‘অবলাবান্ধব’, ‘দাসী’, ‘পরিচারিকা’ ইত্যাদি। ভদ্র-মহিলাদের পারিবারিক ‘সামাজিক’ অবস্থান সহজেই অনুমেয়।
কলেজ, ইউনিভারসিটি থেকে আঁতেল-আসরে ক্ষমতাসীন নন্দনতত্ত্ব বাজার গরম করে। কিন্তু, অন্ত্যজ লোকসাধারণ এবং সভ্যতাগর্বী মেট্রোপলিটন ভদ্রবিত্তের ভাষা-সাহিত্য-নন্দনতত্ত্ব স্ব-স্ব পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ করাই ঐতিহ্যিক বিশুদ্ধতার ওকালতি করা, বৈচিত্র্য-বিরোধী তথা একমুখী যাজকতন্ত্রীয় সাহিত্যবিচারের প্রতিষেধক হয়ে উঠতে পারে।
দুই
১৯৬৪-তে প্রকাশিত হল ‘মাতৃহারা মাতৃতান্ত্রিক মাতৃহন্তারক কবিদের কবিতা সংকলন’। মেইনস্ট্রিম-মিডিয়ায় কলকাতার শালীন বুদ্ধিজীবী সমাজ ঘৃণা বর্ষণ করলেন সংকলনভুক্ত কবিতা ও তার রচয়িতাদের প্রতি। প্রশ্ন করা হল— কেন এখনও পুলিশ প্রশাসন নীরব? এস্টাবলিশমেন্ট তথা ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো এই কবিতা সংকলনের রচয়িতারা বাংলা সাহিত্যে হাংরি জেনারেশন নামে (কু?)-খ্যাত। হাংরিরা নিজেদের সাহিত্য-সম্পর্কে অকপটে অননুকরণীয় ভাষায় বললেন—
কাউকে প্রভাবিত করা পরিচালিত করার মতো ভণ্ডামিতে বিশ্বাস করি না অন্যের মুক্তির কথা বলি না অন্যের মুক্তির উপায় আমরা জানি না আমাদের হাতে অমরত্বের নিশান নাই আমাদের শ্লীলতা নাই অশ্লীলতাও নাই আমরা মুখ এবং পোঁদ দুদিক দিয়ে কথা বলি না অভিজ্ঞতা ভিন্ন কোনও সত্য আছে মনে করি না।২৪
অস্তিত্বকে, জীবনকে, সমাজকে সম্যক বুঝতে পরিক্রমণ চলল সর্বত্র। প্রবৃত্তির তাড়নায়, চেতন-অবচেতনার সংঘাতে, অস্বভাবী যৌন কামনা ও মূল্যবোধে ক্ষয়িত সমাজ-মানুষ-আত্ম-র বিশ্লেষণে ঘুরে বেড়ালেন তাঁরা শ্মশান থেকে পতিতালয়ে; স্থবির ক্ষয়িষ্ণু সমাজ, পারিবারিক ঔচিত্যবোধে ফাটলের তামসে স্বপ্ন-সাধে কত অসংগতি, আদিম জৈবচেতনার অনিস্তার আমোঘ টানে ব্যক্তি ও সমাজ বিকার-কে হাংরিয়ানরা উদলা করে নাগরিক পরিপাট্য-মননে রচিত আধিপত্যশীল, প্রথাগত, কর্তৃত্বকারী সাহিত্যধারাকে ধ্বস্ত করলেন। ‘শব্দ’ ও ‘বস্তু’-র ষড়যন্ত্রময় অবস্থান তাঁরা ভেঙে দিতে চাইলেন। কেননা, এযাবৎ মধ্যবিত্ত তৃপ্তির জন্য রচিত মধ্যবিত্তকৃত শুচিবায়ুগ্রস্ত সাহিত্য ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেন না, পরোক্ষে তাঁরা প্রচলিত প্রতাপের সেবাদাস হয়ে ওঠেন। ফলে কবি এস্টাবলিশমেন্টের কাছে মাথা নত করে ক্ষমতার দেখানো মূল্যবোধকে সর্বোৎকৃষ্ট রূপে প্রচার করেন। ক্ষমতার সংরূপ যৌনতাকে অবদমন করতে শেখায়, আত্মকণ্ডূয়নের মাধ্যমে সত্য-কে উন্মোচিত না-করে লুকাতে শেখায়। ‘ভাষা হয়ে যায় ক্ষমতার রক্ষিতা।’২৫ ক্ষমতার নির্দেশিত গণ্ডিতে শব্দ-বাক্য প্রতীক, উপমা, উৎপ্রেক্ষায় আবদ্ধ হয়ে থাকে। অথচ ‘লক্ষণ রেখার বাইরে নিষিদ্ধ এলাকা। বিপদ অপেক্ষা করে সেখানে। ভাষা যখন নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকে পড়ে, সে কাজ ক্ষমতার কাছে বিদ্রোহ, অপরাধ। কিন্তু ভাষা সেই নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকে মুক্তি পায়।’২৬ ক্ষমতা কোনও কালেই বেআদবি সহ্য করে না। হাংরি জেনারেশনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাবাদী লেখা সম্পর্কে চূড়ান্ত আক্রমণ শানিত হল। হাংরিয়ান শৈলেশ্বর ঘোষ তাঁদের প্রতি অভিযোগের ফিরিস্তি শুনিয়েছেন। মারাত্মক কয়েকটি—
- এইসব অপোগণ্ডের দল নোংরামি করাকেই সাহিত্য বলে মনে করে
- ওঃ এ তো আমেরিকায় ছাপা পত্রিকাগুলির কপি করা মাল
- উল্লুকরা শুধু মাস্টারবেট করে
- যৌনাঙ্গ পূজক
- শুয়োরের বাচ্চাদের কি মা মাসি নাই
- পুলিশ, পুলিশ কী মরে গেছে২৭
না, পুলিশ কখনোই মরে পড়ে থাকে না; ক্ষমতার নুন খায় তারা, অবাধ্যতা এবং আত্ম-বিবেচনা তাদের সার্ভিস-রুলে নেই। ক্ষমতা-কে নিশ্ছিদ্র করা তাদের সাংবিধানিক ও ঐহিক কর্তব্য। তাই, ১৯৬৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর একে-একে হাংরিয়ানরা গ্রেপ্তার হলেন। অপরাধ তাঁদের— অশ্লীল সাহিত্য রচনা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। প্রখ্যাত বোহেমিয়ান কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আদালতে হাংরি দলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে তাঁদের ‘উল্লুকের দল’ বলে দেবেশ রায়ের ‘বিলম্বিত সওয়াল’-কে যথার্থ প্রমাণ করেছেন। দেবেশের স্বীকারোক্তি—
পুলিশ ঠিকই বুঝেছিল এই লেখাগুলি নৈরাজ্যিক, শব্দের দ্বারা সাজানো সমাজকেও এরা অস্বীকার করছে, ফিরে যেতে চাইছে আদিতে— যেখানে শুধুমাত্র একটি স্থূল অর্থেই শব্দ ব্যবহৃত হতে থাকে আর তাই পরোক্ষভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা শব্দের তথাকথিত সামাজিক ব্যবহারের বিরুদ্ধেই।২৮
‘ক্ষমতার রক্ষিতা’ ভাষার অন্তস্তলে অন্তর্ঘাত করে তাকে ‘বিমোচিত’ করে হাংরিরা লেখাকে রক্তমাংসের করে তুলতে চেয়েছেন। লেখা হবে প্রত্যক্ষ, সরাসরি— ‘স্ত্রীলোকের সঙ্গে পুরুষলোকের চূড়ান্ত কম্যুনিকেশন হয় যেমন যোনিলিঙ্গের যোগাযোগে তেমন …।’২৯ ক্ষমতাশীল নন্দনতত্ত্বের মধ্যবিত্তোচিত ভাষিক শুচিবায়ুগ্রস্ততা, আকার-ইশারার রহস্যাবৃত মায়াময় কুয়াশা ভেদ করে হাংরি জেনারেশন ‘ক্ষমতার কারাগারে বন্দি আত্মার কারাভাষ্য’ রচনা করেন। কবিতা তাই হয়ে ওঠে ‘যোনির থালার’ মতন; প্রসব থেকে গর্ভপাত; অবদমিত কামনার উদ্দিষ্ট বিবর; রক্তমাংসে সজীব বাসনার কারুপথ নয়, রিরংসা-স্পন্দিত আলো-আঁধারির আধার। মুখব্যাদিত সেই প্রকাশ কিছুই গোপন করে না।
‘স্খলিত গলিত’ সভ্যতার কদর্য বীভৎসা মুখচ্ছবি, মানুষিক মূল্যবোধের পচনশীল উৎকট গন্ধের সিনথেসিসে হাংরিদের কবিতা সময়ের যুগ্ম-সংবেদন হয়ে উঠল। স্থিতুময়, ঝামেলা-এড়ানো নাগরিক চোখ-কান-নাক বন্ধ রাখলেও পতন রুধিবে কে? ‘তিন বিধবা’ কবিতায় শৈলেশ্বর ঘোষ লিখলেন—
তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছে পুণ্যধর্মহীন রহস্যতলায়, হে ঘোড়া পরিবহনযোগ্য রাস্তা বহুদূর শূন্য পড়ে আছে।৩০
সময়ের কোথাও কোনও ‘কান্তিময় আলো’ নেই। Beauty is truth অথবা Truth is Beauty— আপ্তবাক্যের মতো শুধু বাণীর সংকলন মনে হয়। হননোদ্যত সময়ের ঔরসে সত্য-শিব-সুন্দর গর্ভবতী হয়ে আগামীতে বিকলাঙ্গ সন্তান প্রসব করবে নিশ্চয়। অনিকেত মানুষ ভারবাহী পশুর মতো সিসিফাসের বোঝা বহন করে চলেছে, চলবে— যেন এক সর্বগ্রাসী শূন্যতার বোধিঘাত।
ষাট-সত্তরের দশকের ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গে বিরাজ করছে এক অনতিক্রম্য নৈরাশ্য থেকে শুরু করে সমাজবদলের আন্দোলনের নানা মত-পথের ভ্রান্তি। রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন, বেকারি, খাদ্যসংকট সমান্তরালে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভদ্র শহুরে মেকিপনা, নকল বিপ্লবীর আস্ফালন সময়কে জটিল করে তুলেছে। কল্লোল যেমন বাংলা সাহিত্যকে পৌঁছে দিয়েছিল ড্রয়িংরুম থেকে বস্তিতে, হাংরিরা নিজেরা পৌঁছে আত্মপরায়ণ মধ্যবিত্তকে নিয়ে ফেললেন গণিকালয়ে। সমগ্র সমাজ যখন পতিত, পতনের মুখোমুখি তখন বাজারের মেয়ের ঘর থেকে উঠে আসা উল্লাস অথবা নৈঃশব্দ্য অন্ধ-বধির সমাজকে জুতোপেটা করে। ফালগুনি রায় ‘কাঠের ফুল’ গল্পে আমাদের নিয়ে ফেললেন এক বেশ্যালয়ে—
কাঁদতে কাঁদতে সংকেত তার প্যান্টের বোতামে হাত দিল– না না সে কি কথা গো সে কি কথা গো আমরা তো আর গেরস্ত বউ নই যে মাস পয়লায় স্বামীর ইয়ে চুষব আর শেষ মাসে পাড়াতুতো দ্যাওরের পয়সায় সিনেমায় গিয়ে তাদের কাছে বুকের আঁচল খসাব ‘আঃ বেড়ে বল্লি– মাইরি তুই মহিলা সাহিত্যিক হলি না কেন শুক্লা ফাটিয়ে দিতিস– কি রিয়ালিটি’ বলতে বলতে জামা প্যান্ট খুলে সংকেত তার রিয়েল চামড়ার অবয়ব নিয়ে উঠে দাঁড়াল– সংগে সংগে শুক্লা ওঃ মাগো একি ওটা কি ঝুলছে তোমার যন্তরের পাশে– শুক্লার কথায় সংকেতের দিকে তাকিয়ে দেখি সংকেতের নগ্ন কোমরে একটা শক্ত দড়ি বাঁধা আর সংকেতের পুরুষাঙ্গর উত্থিত আকৃতি প্রায় এরকম হওয়াতে বোঝা যাচ্ছে না কোনটা লিঙ্গ কোনটা পিস্তল– তোমার দুটো নাকি বলতে বলতে শুক্লা সংকেতের দিকে এগিয়ে গিয়েই– কি বন্দুক-পিস্তল-পুলিশ পুলিশ….।৩১
আমাদের মনে পড়বে সত্তর কাঁপানো স্লোগান— ‘বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস’। পুরুষাঙ্গ ও বন্দুকের নল যখন একসঙ্গে ঝুলে থাকে তখন বোঝা যায় জটিল সময়ের বুকে কেউ কেউ বিভ্রান্ত, কেউ-বা দিশাহারা, কোথাও-বা অতিবিপ্লবী নপুংসকতার আস্ফালন; পরিবর্তনের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার।
সর্বব্যাপ্ত ভাঙন, নিঃসীম শূন্যতা, স্বপ্নহীনতায় আস্তীর্ণ যন্ত্রণার ‘মড়ক’-কে সুবো আচার্য বিবৃত করছেন—
আমাকে অনুসরণ করে শবযাত্রা, আমার মাথায় ফুটে ওঠে সেক্স ও দুর্বোধ্য কবিতা, আমার থুথু প্রমাণ করে আমার বমি প্রমাণ করে আমার মৃত্যু প্রমাণ করে আমার জীবন।৩২
সামাজিক স্থবিরতাকে ভাঙতে হাংরি জেনারেশন আধিপত্যকারী শব্দার্থতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্বে অন্তর্ঘাত করে ‘ক্ষমতার রক্ষিতা’ শব্দের নান্দনিক সৌন্দর্য বিচারের মাত্রা প্রসারিত করেছেন। পরিবর্তন-বিমুখতা তো নিঃসন্দিগ্ধ এক মৌলবাদী প্রত্যয়। হাংরিরা সত্য উন্মোচনের অধৈর্যে অনড় সেই প্রত্যয়টিকে ধূলিসাৎ করতে চেয়েছেন। ক্ষুধার্ত কবি শৈলেশ্বর তাই আমাদের সামনে আয়না ধরেছেন—
এসো রমণশীল মানুষ, সূত্র ধরে খুঁজে যাও তোমার বংশানুক্রমিক অপরাধীদের।৩৩
শব্দ ব্রহ্মের ন্যায় অটল নয়, অস্থির; বিমোচিত শব্দে-ভাষায় খুঁজে যেতে হবে অস্তিত্বের সারাৎসার ব্যক্তি ও সমাজের অন্যোন্য টানাপোড়েনে।
তিন
কবি ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যাদর্শ বিচার-বিশ্লেষণ কালে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন—
যাহা আদর্শ, যাহা কমনীয়, যাহা আকাঙ্ক্ষিত, তাহা কবির সামগ্রী। কিন্তু যাহা প্রকৃত, যাহা প্রত্যক্ষ, যারা প্রাপ্ত তাহাই বা নয় কেন? তাহাতে কি কিছু রস নাই? কিছু সৌন্দর্য নাই? আছে বই-কি!৩৪
যৌনতা-ও মানব অস্তিত্বের অপরিহার্য সত্য; অনিস্তার রমণের অমোঘ টান। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে যৌন-সম্ভোগের বর্ণনা আদিরসসম্ভোগে বিধৃত। দেবতা থেকে ঋষির অবৈধ সঙ্গমের কাহিনি বিস্তৃত পুরাণ থেকে মহাকাব্যে। গুরুপত্নীর সঙ্গে দেবতাদের রাজা ইন্দ্রের সঙ্গম, ভ্রাতৃবধূর গর্ভে মহাভারত প্রণেতা ব্যাসদেবের ঔরসজাত সন্তানের জন্মদান, কুমারী কুন্তীর সন্তান প্রসব থেকে বিষ্ণু-মহেশ্বরের সমলিঙ্গ-মহামিলনে বনদেবতা সবরমিলাই ষষ্ট বা আইয়াপ্পার আবির্ভাবের অতিকথনে কোথাও বিন্দুমাত্র সংকোচ পরিলক্ষিত হয় না।
আমাদের কলিঙ্গ, খাজুরাহোর মন্দির গাত্রে তো মিথুন-মূর্তির ছড়াছড়ি। সেখানে আলিঙ্গন, চুম্বন, মুখমেহন, যোনিলেহন, যৌথ-যৌনাচারের নির্বাধ প্রকাশ। কামনার বাহ্যদ্বারের অভ্যন্তরে দেবতার অবস্থানে নেমে আসেনি ধর্মীয় অনুশাসনের খড়্গাঘাত। মহাত্মা গান্ধি, যমুনালাল বাজাজ অবশ্য চেয়েছিলেন খাজুরাহোর মূর্তিগুলি ভেঙে ফেলতে; কেননা মানুষের চারিত্রিক বিশুদ্ধতাকে তা নষ্ট করে। নন্দলাল বসুকে এ-বিষয়ে অনুরোধ করলে শিল্পাচার্য স্পষ্ট ভাষায় বলেন—
জীবনে কাম মোক্ষেরই ধাপমাত্র। ধর্ম, অর্থ, কামের পরে চতুর্থ বর্গে মোক্ষ। সন্তান জন্মানো কখনো অশ্লীল নয়। বাপ-মা আত্মীয়স্বজনের সবাই জানে ছেলে কী করে হয়। সামাজিকতার আবরণে একে আড়াল করে রাখা যায় মাত্র। কিন্তু শিল্পে এসব বাধা চলবে না। বিশেষত এ যখন হয়ে ওঠে শিল্পকর্ম তখন সে আগুন। পূজা মন্দিরে তার স্থান। তাকে ছোঁবার জো নাই। নবজাতক শিশুর মতো সে নতুন সৃষ্টি। সকল নাগালের বাইরে।৩৫
আমাদের দেশে যৌনতা বিষয়ক সমাদৃত ও সমৃদ্ধ text আছে। ‘কামসূত্র’, ‘কোকশাস্ত্র’-তে বিবিধ যৌনতার বর্ণনা আছে। বিভিন্ন অবস্থানে সম্ভোগের পরিকল্পনা লিপিবদ্ধ আছে। বাৎস্যায়ন তো এমনকি ধর্ষকামী আচরণের নিদর্শন দিয়েছেন তাঁর মিথুন মুদ্রার বর্ণনায়। তার মধ্যে একটি মুদ্রা ‘গোযুথিকা’— যেখানে একজন নারীকে যৌনতৃপ্তিদানে রত পাঁচজন পুরুষ। কোকশাস্ত্রে বাৎস্যায়নের সম্প্রসারণ ঘটিয়ে, একটি নতুন বিষয়ের উল্লেখ করা হয়– ‘নারীক্ষোভন’— এখানে রমণীর কামস্থানে পুরুষের অঙ্গুলিচালনার দৃশ্যায়ন আছে। নারীকে যৌনবস্তু রূপে হাজির করলেও এইসব text কামকলা সম্পর্কে কোনও নিষেধের বাঁধ মানেনি। সমকাম-ও প্রাচীন গ্রন্থাবলিতে উল্লেখিত, বিভিন্ন নামে— ‘তৃতীয়া প্রকৃতি’ (কামসূত্র), ‘প্রকীর্ণ মৈথুন’ (স্কন্দ পুরাণ), ‘অসেক্য’ (সুশ্রুতসংহিতা) …।’৩৬
কিন্তু, আঠারো শতক থেকে ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতা, ব্রাহ্মীয় শুদ্ধাচার ভিক্টোরীয় পিউরিটান নৈতিকাদর্শে দেহ ও যৌনতা সম্পর্কে এক ধরনের নিষিদ্ধতা আরোপ করল। সাহিত্য, ভাষা থেকে যৌন অনুষঙ্গের উল্লেখ বর্জিত হল। আসলে আধুনিক যন্ত্রসভ্যতায় শ্রমশক্তি জোগানের প্রয়োজনে একদিন খ্রিস্টীয় মূল্যবোধ তথা ভিক্টোরীয় বিশুদ্ধতাবাদীর আধিপত্যশীল বয়ানে যৌনতার এযাবৎ অনেকান্ত বৈচিত্র্য নিষিদ্ধ ঘোষণা হল। বহুগামী, যৌথ যৌনাচারের পরিবর্তে একগামী দাম্পত্যের যৌনতা প্রাকৃতিক তথা সুস্থ তথা স্বাভাবিক রূপে গৃহীত হল। এবং এই যৌনতা অবশ্যই উৎপাদক— ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা।’ পুঁজির উদ্বৃত্তায়নে চাই শ্রমশক্তির জোগান, তাই সন্তান উৎপাদন। ফলে, অনুৎপাদক বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক, সমকামী, হিজড়ে ‘বিকৃত’ রূপে বর্গীভূত হল। বহুস্বরীয় যৌনতা বাতিল হয়ে একস্বরীয়, কেন্দ্রীভূত মৌলবাদী যৌনতার ডিসকোর্স প্রাধান্য পেল। ‘কামের শিল্পকলা’ মুক্ত যৌনচর্চার স্থলে আত্মসংযমের যৌনাদর্শে ঘোষিত হল— বীর্যবান হও, অতএব বীর্য ধারণ করো। যৌনতার ক্ষেত্রে কার্পণ্য আমদানির এই ইউরোপীয় আত্মশাসনের ভঙ্গিমাকে আত্তীকৃত করে আমাদের কলকাতাকেন্দ্রিক ভদ্রবিত্ত সাহিত্যের ধারায় যৌনতা বিদায় নিল। জাতীয়তাবাদী বাবু সাহিত্যিকেরা আদর্শ নির্মল দাম্পত্য জীবনের পরাকাষ্ঠার নির্মল ছবি আঁকলেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাঠ্যপুস্তক রচিত হল; পাকপ্রণালী সংস্কৃত হল। রান্নার বইতে বাজার ছেয়ে গেল। স্বাস্থ্যবান, আত্মসংযত, সদাচারী নাগরিকের আগমনের মূলেই আসলে ‘যৌনতার কিপটেমি’-র দর্শন। অবদমিত অবাধ যৌনতার সাহিত্য কিন্তু সমান্তরালে সংগুপ্ত থেকে অ-স্মার্ত জনতাকে আকর্ষণ করে চলেছে সে-সময়েও। ‘বটতলার সাহিত্য’ নামে এগুলির জনপ্রিয়তা বিশুদ্ধাচারী ভদ্রলোকি সংস্কৃতির মেকি আমদানিকৃত নৈতিকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে। অঞ্জন বসু ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত ‘কামিনী গোপন’ ও ‘যামিনী যাপন’ নামের একটি কাব্যের উদ্ধৃতির উল্লেখ করেছেন যেখানে নিরুপমা নামের এক রমণী কামকলায় স্বামীকে উদ্বেজিত করছে। এ-যেন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের’ উত্তরসূরি—
থমকে থমকে ধনি। তালে তালে নাচে চমকে মণি।।... কভু খুলে দেয় বুকের বাস। প্রমদা পুরায় পতির আশ।। সুখের নাচের কেমন ছটা। নিতম্ব দোলনে কেমন ঘটা।। যৌবনে বিশাল নিতম্বদ্বয়। হেলিছে দুলিছে স্থির না রয়।। পতি জানু মাঝে জঘন দিয়া। সঘন নাড়িছে মদন প্রিয়া।। প্রাণেশ প্রাণেতে প্রফুল্ল মনে। কাঁপায় জঘন নিতম্ব সনে।।৩৭
যৌনতার কর্তৃত্বকারী ডিসকোর্সে প্রান্তিক হয়ে যাওয়া মুক্ত যৌনতার অবাধ প্রকাশ ফিরে ফিরে আসে আধিপত্যকারী বাংলা সাহিত্যের সমান্তরে। ষাটের দশকের হাংরিদের লেখায় আমরা দেখেছি অনুচ্চার্য রমণের পুনর্বাসন। তবে, হাংরি জেনারেশনের এককালের সহযাত্রী বিনয় মজুমদার রচিত ‘বাল্মীকির কবিতা’ এ-ধারায় অনন্য ব্যতিক্রম। কবি তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত কামাভিসার থেকে রমণকলা চর্চার নিবিড়, শান্ত, আনন্দঘন মুহূর্তে আমাদের সন্নিবিষ্ট করেন। শিশুর সারল্যে যৌনমিলনের খুঁটিনাটি বর্ণনা করে চলেন। উপমান কবিতার শরীরকে কখনও অশ্লীল করে তোলে না, পর্নগ্রাফির মতো ইন্দ্রিয় সজাগ, উত্তিষ্ঠমান হয়ে পড়ে না দেহ-মন; কামনার উছলতা ঝিলিক হয়ে গর্জায় না; নীলিমার নীলে প্রশান্তিতে লীন হয়ে যায়। ‘প্রিয়াপ্রতারিত’ শূন্যতায় কবি দেহ-মনের আশ্রয়ের তরে চলে আসেন দেহোপজীবিনী আলয়ে—
এখন বিশেষ কোনো ব্যথা নেই, প্রেম নেই, মাঝে মাঝে তীর্থক্ষেত্রে যাই। ইঁদারাটি দেখে আসি, আমি হাওয়া হয়ে গিয়ে। সেই পুণ্য ইঁদারাতে ঢুকি। তাতে কিছু কাজ হয় হৃদয়ে সুস্থতা আসে, ঈশ্বরে বিশ্বাস ফিরে আসে।৩৮
(‘সাম্প্রতিক’)
ঐশ্বরিক মহিমা যুক্ত হলে যৌনতা তখন হয়ে ওঠে সর্বজনীন। ঈশ্বর, প্রেম ও যৌনতার বোধ পরস্পর বিবিক্ত নয়; বরং প্রেমময় যৌনতার অনির্বচনীয় আনন্দানুভূতি তো ঐশ্বরিক হয়ে ওঠে— কবি যে খুঁজে ফেরেন সমগ্র মানুষ— ‘আমার ভিতরে/ গাছপালা আছে কিনা জলাভূমি আছে কিনা…’— আনন্দিত মিথুন হয়ে ওঠে শূন্যতা বিদারী। স্বয়ং পরমব্রহ্ম তো স্বীয় সত্তাকে দ্বিধাবিভক্ত করে মিলনে পরমানন্দ লাভ করেছিলেন।
‘বাল্মীকির কবিতা’-বলিতে উদ্দিষ্ট রমণীদের বিনয় ‘ফুল’, ‘চাঁদ’, ‘নদী’, ‘দেবী’ রূপে সম্বোধন করেছেন বারংবার। নারী এখানে প্রকৃতি হয়ে ওঠে, উপগত পুরুষ প্রকৃতির মাঝে মিশে গিয়ে এই পৃথিবীকে করে তোলে উর্বরা শস্যশালিনী। গণিকা-কে দেবীর আসনে বসিয়ে তাঁর ‘লোকোত্তর সাধনা’ এই কবিতাগুলিকে পর্ন হতে দেয়নি। ঈশ্বরী প্রকৃতির সঙ্গে এক অনন্যপূর্ব মিলনে আমাদের সাক্ষী করছেন কবি:
ফুলের ঘরের পাশে আরো বহু ঘর আছে, প্রতিটি ঘরেই নদী আছে, তারা সব আমার খাওয়ায় খুব সহযোগিতাই করে থাকে সর্বদাই, ফুল যেই বলে ‘আজ একবার বসি’ অমনি সে নদীদের একজন বালতিতে জল এনে দেয়। আমরা খাওয়ার পরে সেই জলে কলা গুহা ধুই।৩৯
(‘যৌবন কাহিনি’)
...কিছুক্ষণ আনন্দের চরম মাত্রায় থেকে শেষে ছলক ছলক করে জল ঝরে গেলে আমি চাঁদের বুকেই শুয়ে পড়ি।৪০
(‘কবিতার খসড়া /১৮’)
একমাত্র শুদ্ধ দেহাতিরিক্ত ইন্দ্রিয়বিবর্জিত বায়বীয় প্রেমের ধ্বজা যাঁরা ওড়ান, প্রশান্ত সৌম্য-স্পষ্ট স্বরে কবি তাঁদের প্রতি বলেন—
এত বেশি সুখ আর কোনো কিছুতেই নেই; কবিতায় গানে এত বেশি সুখ নেই; অনেক দৃশ্যই আমি জীবনে দেখেছি তবুও দেবীর দেহ, দেবীর বাতাবি গ্লাস সকলের সেরা। এদের মতন এত সৌন্দর্য রোমাঞ্চ আর কোনও কিছুতেই পাইনি, পাব না,...।৪১
(‘আরো বেশি ঘন ঘন’)
সত্যের এরূপ স্বচ্ছ-সরল উচ্চারণ সংস্কৃতির জ্যাঠামশাই, শ্লীল সাহিত্যের জিম্মাদাররা মেনে নেবেন কেন! তাঁরা ‘শেষের কবিতা’ পড়েন, ‘গীতগোবিন্দম’-এ মজে থাকেন, ‘কুমারসম্ভবম্’-এ ঐতিহ্যের শিকড় সন্ধান করেন এবং লরেন্স থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে অবচেতনে রঞ্জন রশ্মি ফেলেন। আবার হাংরিয়ান তথা বিনয়ের লেখা পোড়ানোর নিদান দেন। ১৯৭৭ সালে ‘বাল্মীকির কবিতা’-র প্রথম প্রকাশক ‘বিশ্ববাণী’-র কাছে পুলিশি নির্দেশ এসেছিল— এ বই যেন বাজারের মুখ না দেখে। প্রকাশ হয়ে গেলে বইটির ৫৫ থেকে ৭২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলার হুকুম আসে। বিজ্ঞাপনবিহীন অর্ধদগ্ধ ‘বাল্মীকির কবিতা’ কট্টর মৌলবাদী মানসিকতার মুখোমুখি হয়েও সেদিন নিঃশেষিত হয়েছিল সমস্ত কপি। বাল্মীকির কবিতা কিন্তু ‘রামায়ণ’-ও, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন ‘আমাদের ঘরের সামগ্রী।’ বিনয় মজুমদার রচিত ‘বাল্মীকির কবিতা’ সমগ্র ‘মানুষী-সত্তার’ নির্মোক উন্মোচন।
চার
ঘন কালো গোঁফের মধ্য দিয়ে ইশর সিংয়ের মুখে হাসি দেখা দিল। সে বলল— ‘হোনে দে আজ জুল্ম’।— সে আরও অত্যাচার শুরু করল। কলবন্তের ওপরের ঠোঁট দাঁতের নীচে কচকচাতে লাগল, কানের লতি কামড়াল, উঁচু বুক কচলাল, ভারী পাছায় সশব্দে চাপড় মারল, দুই গালে পরিপূর্ণ মুখ দিয়ে চুমা খেতে লাগল। কলবন্তের দুই স্তন চুষে চুষে লালায় ভরে দিল। কলবন্ত জ্বলন্ত আগুনে টগবগ করতে লাগল। কিন্তু এত কিছু করেও ইশর সিং নিজেকে উত্তপ্ত করতে পারল না, যত কিছু কামকলা তার জানা ছিল সব প্রয়োগ করেও কোনো ফল হল না। কলবন্তের শরীরের সমস্ত তার তীব্রভাবে ঝন্ঝন্ করছিল, শিরায় শিরায় আগুন জ্বলছিল, কিন্তু আজ তাকে তৃপ্ত করতে অক্ষম হল ইশর সিং। অনাবশ্যক ছেড়ছাড়ে বিরক্ত হ’য়ে সে বলল— ‘ইশর সিংহা, কাফী ফেট্ চুকা, অব পাত্তা ফেক্।’৪২
শিথিল নিস্তেজ হীনাঙ্গ-অস্তিত্ব ইশর সিং রূপান্তরিত হয়েছে ক্লীবপুরুষে। যৌন সম্ভোগে নিঃসাড় অক্ষম সে। অনতিপূর্বেই এক দাঙ্গায় একটি মেয়েকে লুট করে সে যখন নিজের যৌনক্ষুৎপিপাসা বলাৎকারের মাধ্যমে নিংড়ে নিতে চাইছিল তখনই ঘটেছে বিপর্যয়; লুটের মেয়েটি যে মড়া— ‘বিলকুল ঠাণ্ডা গোস্ত…।’ ধর্ষক ইশরকে শেষ পর্যন্ত বরফশীতল মাংসপিণ্ডে পরিণত করে দেয় মরা মেয়েটি। প্রাণহীন, মাংসের ভোগ্যপিণ্ড নারীশরীরটি লুব্ধকের অস্তিত্বকে গহীন শূন্যতায় নিক্ষিপ্ত করে…।
গল্পের নাম ‘ঠান্ডা গোস্ত’। রচয়িতা সাদাত হাসান মান্টো। পাকিস্তানি কোর্ট গল্পটিকে অশ্লীল বিবেচিত করে মান্টোর সঙ্গে সঙ্গে গল্পের প্রকাশককে জরিমানা প্রদানের শাস্তি ধার্য করে। কেননা, এর ভাষা স্থূল, নোংরা, ইতর যৌন আচরণে ভরপুর, হিংস্রতার উদ্রেককারী; সর্বোপরি ধর্মীয় তথা সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। মান্টোর ওপর ধর্মীয় মৌলবাদ, রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও সাহিত্যের কলাকৈবল্যবাদের দিক থেকে বারংবার আক্রমণ শানানো হয়েছে। তাঁর গল্পে কেন পতিতারা উঠে আসে বারেবারে? মান্টোর জবাব ছিল— সমাজের ধনপতিরা যতদিন যৌনশোষণ চালাবে ঘরে-বাইরে, ততদিন দ্বিচারী সামাজিক, পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের ভালো মুখোশ ছিঁড়ে ফেলবেন তিনি। রক্ষিতার কাছে তো কেউ আর ঈশ্বর প্রার্থনায় যায় না। প্রেমহীন নরনারীর অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক যখন শুধুই যৌনসর্বস্ব, রক্তমাংসের অবশেষে পরিণত হয় তখন তাঁর ‘আফসানা’-য় ভয়াবহ বিকৃতি মুখব্যাদান করবেই। আসলে নিজের বিকারের প্রতিচ্ছবি কেই-বা দেখতে চায়। মান্টোর সাহিত্য হয়ে উঠেছিল কালের আরশি। জাত-ধর্ম নির্বিশেষে দাঙ্গার নারকীয় বীভৎসতা দেখে তাঁর কলম নির্বাক থাকেনি। বরং সময়-সমাজ-মানুষকে তার অবিকল বাস্তবতায় হাজির করেছেন মান্টো সদর্পে। সমাজ যখন পূতিগন্ধময় উপশল্য হয়ে ওঠে, তখন সাহিত্যিকের দায়িত্ব ভাগাড়ে লাশ হয়ে পড়ে থাকা, অথবা মৃতবৎ ধুঁকতে থাকা ঊন-মানুষের কাতরানি, ভণ্ডামি, নির্লজ্জতা ও শকুন-রাজনীতির ওত পেতে বসে থাকার আখ্যান বিশ্বস্ত রূপে উত্থাপন করা। মান্টো তাঁর আফসানা-র বিষয়বস্তু ও ভাষায় অনালোকিত, কটু দুর্গন্ধময়তার দরজা খুলে দিয়েছেন।
‘খোল্-দো’ শব্দবন্ধে মৃতপ্রায় সাকিনার শরীরে দেখা গিয়েছিল মর্মান্তিক প্রতিক্রিয়া: সে যন্ত্রের মতো নিষ্প্রাণ হাতে সালোয়ারের দড়ি খুলে নিম্নাঙ্গ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এ-সমাজ, এই দুঃসময়, ভাঙাভাঙির স্বদেশভাগ ও তার ধর্ম, রাজনীতি তো সাকিনা-কে পশুপ্রবৃত্তির পূর্তিতে যৌনাঙ্গের দ্বার খুলে রাখার সবক শিখিয়েছে। আদিম অন্ধকারের উৎসমুখ খুলে দিয়েছিলেন মান্টো। ধর্ম-রাজনীতির রক্তচক্ষুকে হেলায় উপেক্ষা করে তিনি স্বতন্ত্র, আজাদ।
আজাদি শব্দেই তো মৌলবাদের যত আপত্তি; অস্বস্তি, ভয়। অন্ধানুগত্যের হুকুম এখানে অচল।
তথ্যসূত্র:
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘লোকসাহিত্য’ (শ্রী সনৎকুমার মিত্র সম্পাদিত), কলকাতা, সাহিত্য প্রকাশ পৃঃ সাতাশ
২. ঐ, পৃঃ ১৯
৩. পবিত্র সরকার, ‘লোকসংস্কৃতির নন্দনতত্ত্ব’, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, পৃঃ ৩০
৪. যদুনাথ সরকার, ‘বাংলার নবজাগরণ’, ঢাকা, দিব্যপ্রকাশ, পৃঃ ৮৪
৫. প্রমথ চৌধুরী, ‘বঙ্গভাষা বনাম বাবু-বাংলা ওরফে সাধুভাষা’, “প্রবন্ধ সংগ্রহ”, কলকাতা, বিশ্বভারতী, পৃঃ ২৬৮
৬. উদ্ধৃত, অঞ্জন বসু, ‘অধ্যাত্ম চেতনায় যৌনতা’, কলকাতা, প্রাচ্য পাশ্চাত্য, পৃঃ ৯০
৭. উদ্ধৃত, মুহম্মদ আয়ুব হোসেন, ‘বিচিত্র লোকসাহিত্য’, কলকাতা, গাঙচিল, পৃঃ ৭৯
৮. উদ্ধৃত, ঐ, পৃঃ ৮৩
৯. উদ্ধৃত, ঐ, পৃঃ ৯২
১০. উদ্ধৃত, ঐ, পৃঃ ১২৬
১১. উদ্ধৃত, হুমায়ুন আজাদ, ‘নারী’, কলকাতা, কাকলী প্রকাশন, পৃঃ ২২৯
১২. ঐ, পৃঃ ২২৮
১৩. উদ্ধৃত, মুহম্মদ আয়ুব হোসেন, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৯৪
১৪. ঐ, পৃঃ ৯৩
১৫. ঐ, পৃঃ ১০৬
১৬. ঐ, পৃঃ ১০৩
১৭. ঐ, পৃঃ ১১০
১৮. ঐ, পৃঃ ১৩১
১৯. ঐ, পৃঃ ১৯৬
২০. ঐ, পৃঃ ১২২
২১. ঐ, পৃঃ ১১-১২
২২. উদ্ধৃত, অঞ্জন বসু, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৩১১
২৩. ঐ, পৃঃ ৩১০
২৪. সমীর চৌধুরী (সম্পাদিত), ‘হাংরি জেনারেশন রচনা সংকলন’, কলকাতা, কথা ও কাহিনী, পৃঃ তিন
২৫. শৈলেশ্বর ঘোষ, ‘ভাষা বিমোচন’, কলকাতা, প্রতিভাস, পৃঃ ১৩
২৬. ঐ, পৃঃ ১৪
২৭. শৈলেশ্বর ঘোষ, ‘প্রতিবাদের সাহিত্য’, কলকাতা, প্রতিভাস, পৃঃ ৪৮-৪৯
২৮. উদ্ধৃত, সমীর চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃঃ উনিশ
২৯. শৈলেশ্বর ঘোষ, ‘প্রতিবাদের সাহিত্য’, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৫০
৩০. উদ্ধৃত, সমীর চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃঃ উনিশ
৩১. ঐ, পৃঃ ৯০
৩২. ঐ, পৃঃ ১০৫
৩৩. শৈলেশ্বর ঘোষ, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, কলকাতা, প্রতিভাস, পৃঃ ২৭
৩৪. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনরচিত ও কবিত্ব’, “বঙ্কিম রচনাবলী” পঞ্চম খণ্ড, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, পৃঃ ৪৮
৩৫. উদ্ধৃত, অঞ্জন বসু, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৮৩
৩৬. ঐ, পৃঃ ৩০৯
৩৭. ঐ, পৃঃ ৯১
৩৮. বিনয় মজুমদার, ‘বাল্মীকির কবিতা’, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, পৃঃ ৫৪
৩৯. ঐ, পৃঃ ৫৬
৪০. ঐ, পৃঃ ৬১
৪১. ঐ, পৃঃ ৬২
৪২. সাদাৎ হাসান মান্টো, ‘খুলে দাও নির্বাচিত গল্প সংকলন’, (অনুবাদ: কিরণশঙ্কর মৈত্র), কলকাতা, প্যাপিরাস, পৃঃ ৭০
সহায়ক গ্রন্থ:
অঞ্জন বসু, ‘অধ্যাত্ম চেতনায় যৌনতা’, কলকাতা, প্রাচ্য পাশ্চাত্য, ২০২৫
আশরাফ সিদ্দিকী, ‘লোক-সাহিত্য’ (প্রথম খণ্ড), কলকাতা, নয়া উদ্যোগ, ২০১২
‘লোক-সাহিত্য’ (দ্বিতীয় খণ্ড), কলকাতা, নয়া উদ্যোগ, ২০১৩
আশুতোষ ভট্টাচার্য, ‘বাংলার লোকসাহিত্য’ (চতুর্থ খণ্ড), কলকাতা, ক্যালকাটা বুক হাউস, ১৯৬৬
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (অলোক রায় সম্পাদিত), কলকাতা, ভারবি, ২০১৮
ওয়াকিল আহমেদ, ‘বাংলার লোক-সংস্কৃতি’, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৬৫
ক্ষেত্র গুপ্ত, ‘লোকসৃষ্টির নন্দনতত্ত্ব’ কলকাতা, লোকসংস্কৃতি গবেষণা পরিষদ, ২০০২
পবিত্র সরকার, ‘লোকসংস্কৃতির নন্দনতত্ত্ব’, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০১
প্রদ্যোত ঘোষ, ‘মুসলিম সমাজের বিবাহের লোকাচার ও গীত সংকলন’, কলকাতা, পুস্তক বিপণি, ২০২২
প্রমথ চৌধুরী, ‘প্রবন্ধ সংগ্রহ’, কলকাতা, বিশ্বভারতী, ২০১০
বিনয় ঘোষ, ‘বাংলার লোকসংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব’, কলকাতা, অরুণা প্রকাশনী, ১৯৭৯
মুহম্মদ আয়ুব হোসেন, ‘বিচিত্র লোকসাহিত্য’, কলকাতা, গাঙচিল, ২০২১
মৌ ভট্টাচার্য (সম্পাদিত), ‘বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ’, কলকাতা, আনন্দ, ২০১১
মোমেন চৌধুরী, ‘বাঙালির ঐতিহ্য মৌখিক সাহিত্য’, ঢাকা, পুথিনিলয়, ২০১৬
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘বঙ্কিমচন্দ্র রচনাবলী’ (পঞ্চম খণ্ড), কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০১৬
বিনয় মজুমদার, ‘বাল্মীকির কবিতা’, কলকাতা, দে’জ পাবলিশিং, ২০০৪
বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলাদেশের সঙ প্রসঙ্গে, কলকাতা, মনীষা, ১৯৯৬
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘লোক সাহিত্য’, (সনৎ কুমার মিত্র সম্পাদিত), কলকাতা, সাহিত্য প্রকাশ ২০১৭
শৈলেশ্বর ঘোষ, ‘প্রতিবাদের সাহিত্য’, কলকাতা, প্রতিভাস, ১৯৯৭
‘ভাষা বিমোচন’, ঐ, ২০০৭
‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, ঐ, ১৯৯৯
সমীর চৌধুরী (সম্পাদিত), ‘হাংরি জেনারেশন রচনা সংকলন’, কলকাতা, কথা ও কাহিনী, ১৯৯৮
সাদাৎ হাসান মন্টো, ‘খুলে দাও নির্বাচিত গল্প সংকলন’ (কিরণশঙ্কর মৈত্র অনূদিত), কলকাতা, প্যাপিরাস, ২০০৭
সিমোন দ্য বোভেয়ার, ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ (কঙ্কর সিংহ অনূদিত), কলকাতা, র্যাডিক্যাল, ২০১১
সুকুমার রায়, ‘সুকুমার সাহিত্য সমগ্র’ (তৃতীয় খণ্ড), কলকাতা, আনন্দ ২০১১
হুমায়ুন আজাদ, ‘নারী’, কলকাতা, কাকলী প্রকাশনী, ২০১৭
Andrea Dworkin, ‘Intercourse’, New York, Basic Books, 2006 (pdf)
Michel Foucault, ‘The Use of Pleasure’ (Volume 2 of The History of Sexuality), New York, Vintage Books, 1995 (pdf)
‘The ‘Care of the Self’ (Volume 3 of The History of Sexuality), New York, Pantheon Books, 1986 (pdf)
সিনেমা:
Jaromil Jires, ‘The Joke’, (1969)
Deepa Mehta, ‘Fire’ (1996)
Rituparno Ghosh, ‘Chitrangada: The Crowning Wish’ (2012)
Hansal Mehta, ‘Aligarh’ (2015)
Anand Patwardhan, ‘Reason’ (2018)
Nandita Das, ‘Manto’ (2018)
Anurag Kashyap, Zoya Akhtar, Dibakar Banerjee, Karan Johar, ‘Lust Stories’ (2018)
Sajin Baabu, ‘Biriyaani’ (2020)
Jafar Panahi, ‘No Bears’ (2022)
Salim Sadiq, ‘Joyland’ (2022)
Imtiaz Ali, ‘Amar Singh Chamkila’ (2024)
Edward Berger, Conclave (2024)
Mohammad Rasoulof, ‘The Seed of the Sacred Fig’ (2024)