আনোয়ার হোসেন
দু-দেশের দু-রকমের দু-টো ঘটনা দিয়ে শুরু করি। যদিও ঘটনা দু-টি মূলগতভাবে একই।একটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে কিছু কম বয়সী মুসলিম ছেলেকে জোর করে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হচ্ছে। আর-একটি ঘটনায় দেখা যাচ্ছে কিছু লোক রমজান মাসে খাবারের দোকান খুলে রাখার এবং রোজা না-রাখার অপরাধে দু-জনকে কান ধরে ওঠবোস করাচ্ছে। হ্যাঁ, এটাই মৌলবাদ।
মৌলবাদ (Fundamentalism) বলতে সাধারণত কোনো ধর্ম, মতবাদ বা আদর্শের মৌলিক শিক্ষাগুলোর কঠোর অনুসরণ ও ব্যাখ্যা বোঝায়। এটি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে কোনো ধর্মীয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক বিশ্বাসকে পরিবর্তন বা সংশোধন না করে মূল আকারে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। মৌলবাদীরা সাধারণত তাদের নিজস্ব মতবাদকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং অন্য যে কোনো পরিবর্তনকে অগ্রহণযোগ্য মনে করে। এবং নিজেদের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর গায়ের জোরে চাপাতে চায়। মৌলবাদীদের সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, যা তাদের চিন্তা-ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণে প্রকাশ পায়। মূলত, তারা কোনো ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা সামাজিক মতবাদকে আক্ষরিক ও কঠোরভাবে অনুসরণ করে এবং প্রগতি ও পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তার অবস্থান নেয়। মৌলবাদের কট্টরপন্থী রূপ সমাজে অসহিষ্ণুতা, সংঘাত ও দাঙ্গার কারণ হয়ে ওঠে।
আজকের আলোচনা ধর্মীয় মৌলবাদের উপরেই সীমিত রাখব। এবং আরও বিশেষ করে হিন্দু ধর্মীয় মৌলবাদ ও ইসলাম ধর্মীয় মৌলবাদের উপরেই। যে দুই ধর্মীয় মৌলবাদ একে অন্যকে সিঁড়ির মতো ব্যবহার করে ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিচ্ছে। প্রকৃত অর্থে, এই দুই মৌলবাদ, কে কতটা অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে পারে যেন তার প্রতিযোগিতা চলছে। যে মৌলবাদীরা যেখানে যতটা সংখ্যাগুরু সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার ও আগ্রাসন ততটাই মারাত্মক আকার ধারণ করছে। ফলে সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ যে কতখানি ভয়াবহ হতে পারে তার নিদর্শন এই উপমহাদেশের দেশগুলিতে ভুরিভুরি ঘটে চলেছে।
তার আগে মৌলবাদ ও মৌলবাদীদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে একটু জেনে নিই:
১. আক্ষরিক বিশ্বাস ও কঠোর অনুশাসন– মৌলবাদীরা তাদের ধর্মীয় বা মতাদর্শিক গ্রন্থ ও শিক্ষা অনুসারে জীবন পরিচালনা করতে চায়। তারা সাধারণত পরিবর্তন বা আধুনিকীকরণের বিরোধী।
২. অপরিবর্তনশীলতা ও রক্ষণশীলতা– মৌলবাদীরা বিশ্বাস করে যে তাদের মতবাদ চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়। নতুন ব্যাখ্যা বা আধুনিক চিন্তাধারাকে তারা সন্দেহের চোখে দেখে।
৩. অসহিষ্ণুতা– ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি তাদের মনোভাব সর্বদা কঠোর ও নেতিবাচক। তারা সমালোচনা গ্রহণ করতে চায় না এবং প্রায়ই ভিন্ন মতাবলম্বীদেরকে শত্রু মনে করে।
৪. কট্টরপন্থী মনোভাব– মৌলবাদীরা নিজেদের মতাদর্শকে একমাত্র সত্য বলে মনে করে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা জোরপূর্বক তাদের বিশ্বাস অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে চায়।
৫. সহজ সমাধান ও উগ্রতা– মৌলবাদীরা জটিল সামাজিক বা রাজনৈতিক সমস্যার সহজ ও সরল সমাধান খোঁজে। কিছু ক্ষেত্রে তারা সহিংস পদ্ধতির আশ্রয় নেয়।
৬. পরিচয় ও গোষ্ঠীগত ভাবনা– মৌলবাদীরা নিজেদের নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সঠিক ও পবিত্র মনে করে। বাইরের মানুষ বা অন্য গোষ্ঠীকে তারা শত্রু বা বিপজ্জনক মনে করে।
৭. প্রচার ও দীক্ষা দেওয়ার প্রবণতা– মৌলবাদীরা তাদের মতবাদ প্রচার করতে আগ্রহী থাকে। নতুন অনুসারী সংগ্রহ ও দীক্ষা দেওয়ার প্রতি তাদের ঝোঁক থাকে।
৮. আধুনিকতা ও বিজ্ঞানবিদ্বেষী মনোভাব– বিজ্ঞান ও আধুনিক চিন্তাধারার অনেক বিষয়কে তারা অবিশ্বাস করে বা অগ্রাহ্য করে। কিছু ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও আধুনিক চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে থাকে। প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও, তার নৈতিক দিক নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হতে পারে।
৯. গণতন্ত্র বিরোধিতা– গণতন্ত্রের মূল সুরের অন্যতম হল নিজের স্বাধীন মত প্রকাশ করা এবং অন্যের স্বাধীন মত প্রকাশ করতে বাধা না দেওয়া। মৌলবাদীরা সর্বদাই অন্যের মত প্রকাশ করতে দিতে চায় না, বরং বাধা দেয়, প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে।
১০. শক্তি প্রদর্শন করার মানসিকতা– এরা সর্বদাই সংখ্যালঘুদের ওপর দলবদ্ধভাবে আক্রমণ করার মানসিকতা মনে ও মননে লালন করে ও উপযুক্ত পরিবেশে তা বাস্তবায়িত করে।
যদিও সব মৌলবাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী হুবহু একরকম নয়, তবে উপরের বৈশিষ্ট্যগুলো সাধারণভাবে মৌলবাদী মানসিকতার পরিচয় বহন করে।
মৌলবাদ ও রাজনীতি একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের মতো বহুত্ববাদী ও সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যময় অঞ্চলে। এই উপমহাদেশে ধর্ম, জাতি ও ভাষার ভিত্তিতে বিভাজন দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে। মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো ধর্মীয় পরিচয়কে ব্যবহার করে ও সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করে আসছে এবং দুঃখজনক হলেও তারা তাতে সাফল্য লাভ করছে।
ব্রিটিশ শাসনামলে ‘বিভাজন ও শাসন’ (Divide and Rule) নীতির ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভক্তির বীজ বপন করা হয়। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের পর ভারতীয় জনগণকে বিভাজিত করে রাখার প্রয়োজনীয়তা ব্রিটিশরা আরও সম্যকভাবে উপলব্ধি করে। এবং হিন্দু-মুসলিম ধর্মবিশ্বাস দিয়ে যে এই বিভাজন সবচেয়ে কার্যকরীভাবে করা যায় তা তারা বুঝতে পারে ও প্রয়োগ করে। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তানের বিভাজনের মাধ্যমে তা পরিণতি পায়। তবুও মৌলবাদ থেমে যায়নি। বরং প্রবল প্রতাপে তা পল্লবিত হতে থাকল।
পাকিস্তান একটি ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেখানে ধর্মীয় মৌলবাদ রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৭০-এর দশকে জুলফিকার আলি) ভুট্টো ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহার তীব্রতর করেন। আর ১৯৮০-র দশকে জিয়াউল হকের শাসনামলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামিক আইন প্রণয়ন করা হয়। বর্তমানে বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠী পাকিস্তানের রাজনীতিতে সরাসরি প্রভাব বিস্তার করছে। সংখ্যালঘু হিন্দু ও খ্রিস্টান জনগণ ছাড়াও অন্যান্য মুসলিম সংখ্যালঘু যথা শিয়া, আহমদিয়া ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর উপর আক্রমণ সেখানে ঘটে চলেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতেও মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রভাব বিদ্যমান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তীকালে ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান ঘটে। বিশেষত, ১৯৮৮ সালে ইসলামিকরণ ও পরবর্তীকালে বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনের উত্থান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে জামাতপন্থী ও অন্যান্য মুসলিম ধর্মীয় মৌলবাদীরা সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতার চালিকাশক্তির জায়গা দখল করেছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অত্যাচার, নাস্তিক ও মুক্তমনাদের হত্যা আজকের বাংলাদেশে প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেও সেখানে মৌলবাদী রাজনীতির প্রভাব ক্রমশ লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। মূলত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়েছে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস, ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা, এবং সাম্প্রতিক সময়ের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলো মৌলবাদী রাজনীতির প্রকাশ্য দৃষ্টান্ত। শুধু মুসলিম সংখ্যালঘু নয়, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাও আক্রমণের নিশানা। গ্রাহাম স্টেইন ও তাঁর দুই শিশুপুত্রকে জিপের মধ্যে পুড়িয়ে মারার ঘটনা এখনও অবিস্মৃত। দলিতদের উপর জাতের নামে অত্যাচার, হত্যা ইত্যাদির উদাহরণ এখন নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্তমনা ও যুক্তিবাদী মানুষরাও এখানে হিন্দু মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার। এম এম কালবুর্গি, গোবিন্দ পানসারে, গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভোলকররা হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে নিহত হন।
মৌলবাদের রাজনৈতিক ব্যবহার বর্তমানে এই উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান, সামাজিক ন্যায়, দুর্নীতি নির্মূল, মানবিক মূল্যবোধ ও বিজ্ঞানের প্রসার, তথা সার্বিক উন্নয়ন এখন আর রাজনৈতিক দলগুলির প্রচারের বিষয় নয়। তাদের কাছে এখন মন্দির মসজিদ ইত্যাদি তৈরি করা অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই সুফল ভোগ করছে মুষ্টিমেয় কিছু কর্পোরেট গোষ্ঠী। তাদের সঞ্চয় ও মুনাফা একদিকে আকাশ ছুঁতে চলেছে, অন্যদিকে মধ্যবিত্তরা ক্রমে দরিদ্র ও দরিদ্ররা হতদরিদ্র হয়ে চলেছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলি তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য যথা– রাসায়নিক সার, জিন প্রযুক্তির বীজ, কীটনাশক ও কৃষি-সরঞ্জামের অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে পর্বতপ্রমাণ মুনাফা ঘরে তুলছে আর অন্যদিকে কৃষকের চাষের খরচ বাড়ছে ও কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম কৃষকরা পাচ্ছে না। শিল্পে সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক সংখ্যা প্রায় শূন্যের ঘরে ঠেকেছে। পরিবর্তে ন্যূনতম মজুরিতে অসংগঠিত শ্রমিক তথা চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক, ঠিকা শ্রমিক ইত্যাদি নিয়োজিত হচ্ছে। কর্পোরেটরা যাদের আবার দিনে বারো ঘণ্টা কাজ করার নিদান দিচ্ছে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ার ফলে যে বৃহত্তম সংখ্যক জনগণ, যারা প্রান্তিক অর্থনীতির মানুষ, শ্রমিক কৃষক ছোটো ব্যবসায়ী এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষেরা দিন দিন কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় এই বৃহত্তম সংখ্যক জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাবি আদায়ের আন্দোলনে শামিল হওয়া খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু কর্পোরেটদের মুনাফার হারের ঊর্ধ্বগতি বজায় রাখতে এই প্রকার গণ-আন্দোলনকে ঠেকিয়ে রাখতেই হবে। এমতাবস্থায় বৃহত্তর জনগণের ঐক্য বিনষ্ট করতে ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা অন্যতম কার্যকরী অস্ত্র। কর্পোরেট দ্বারা মনোনীত (মানুষ মনে করে, জনগণ দ্বারা নির্বাচিত) কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারগুলি তার সমস্ত প্রচারমাধ্যম ও মিডিয়া দ্বারা ধর্মীয় মৌলবাদের প্রসার ঘটানোতে উৎসাহী হয়ে পড়েছে। ফলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, হানাহানি ও দাঙ্গার ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমরা জানি, এবং দেখেছি, ধর্মীয় মৌলবাদ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জায়গায় কোনও-না-কোনও পর্যায়ে প্রবল প্রাণঘাতী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে। এই দাঙ্গায় মূলত সংখ্যালঘুদের মধ্যে (এবং সংখ্যাগুরুদের মধ্যেও) যারা দরিদ্র ও শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় ধনে ও প্রাণে। ছোটোখাটো দোকান বাড়ি জ্বলে যায়, পুড়ে যায়, ভেঙে যায়, কিন্তু কোনো বড়ো অট্টালিকা শপিং মল ইত্যাদির গায়ে সামান্য আঁচ পর্যন্ত লাগে না। মারা পড়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, কোনও নেতা মন্ত্রীদের গায়ে আঁচড়ও পড়ে না। কর্পোরেট ও নেতামন্ত্রীদের স্বার্থ চরিতার্থ হয়। সুরক্ষিত থাকে তাদের বিলাসবহুল যাপন।
ভোটবাজ রাজনৈতিক দলগুলির প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্নভাবে মৌলবাদী রাজনীতি ও ধর্মকে ব্যবহার করে জনগণের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভোট সংগ্রহের চেষ্টা, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পরিপন্থী ধর্মীয় আইনকে রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত করতে চাওয়া, চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর উত্থান ঘটিয়ে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করার প্রয়াস ইত্যাদি আজ আর পর্দার আড়ালে নেই। এই ভারতীয় উপমহাদেশে জনসমক্ষে দিনের আলোর মতো তা পরিষ্কার।
তাহলে বর্তমানের এই ভয়াবহ বাস্তব এবং ততোধিক ভয়াবহ ভবিষ্যত থেকে এই উপমহাদেশের মানুষদের উত্তরণের পথ কোথায়? পথ খুঁজতে গিয়ে কিছু গোল গোল সমাধান বেরিয়ে আসে বিশিষ্ট ও অবিশিষ্ট মানুষদের কাছ থেকে। যেমন–
- ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মীয় হস্তক্ষেপ কমাতে হবে। শিক্ষা ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
- আধুনিক, যুক্তিনির্ভর ও সহনশীল সমাজ গঠনের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার করা দরকার।
- গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করে ও আইনের শাসন নিশ্চিত করে মৌলবাদী কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করতে হবে ও ধর্মীয় সহনশীলতা ও বহুত্ববাদকে উৎসাহিত করতে হবে।
বিশিষ্ট মানুষেরা বললে অবশ্যই তা কার্যকরী বই-কি। প্রসঙ্গক্রমে, ছোটোবেলায় দাদুর কাছে শোনা একটা গল্প মনে পড়ে গেল। বক ধরার সহজ উপায়। দাদু বলেছিল, একটা মোমবাতি লাগবে আর একটা দেশলাই। দেশলাই কাঠি দিয়ে মোমবাতিটা জ্বালিয়ে চুপি চুপি বকের কাছে পৌঁছাতে হবে। তারপর আস্তে করে মোমবাতিটা বকের মাথায় বসিয়ে দিতে হবে। তারপর অপেক্ষা। কিছুক্ষণ পরে মোমবাতির মোম গলে বকের চোখে পড়বে এবং বক দু-চোখে আর কিছু দেখতে পাবে না। সেই সুযোগে বকের কাছে গিয়ে খপ করে তাকে ধরে ফেলতে হবে।
বর্তমান রাষ্ট্র যখন ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে তখন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রতিষ্ঠা কে করবে? শিক্ষা ও গণসচেতনতা বৃদ্ধি? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিজ্ঞান চেতনা বৃদ্ধি করার পরিবর্তে অ-বিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞান চর্চা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদতে আর কর্পোরেটদের কেনা মিডিয়া, গণসচেতনতার সর্বনাশ করে ছাড়ছে। আধুনিক যুক্তি নির্ভর ও সহনশীল সমাজ গঠনের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় মদতে উপমহাদেশের দেশগুলিতে ঘৃণা, অসহনশীলতা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে পরিকল্পনামাফিক। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রতিনিয়ত আক্রমণ করা হচ্ছে ও ধ্বংস করার চেষ্টা হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে না, যে এই কাজগুলো বকের মাথায় চুপি চুপি জ্বলন্ত মোমবাতি বসিয়ে দেওয়ার মতো সহজ? না, একেবারেই ব্যঙ্গ করছি না। বোঝাতে চাইছি যে উপরোক্ত কাজগুলি যারা করবে তারা কর্পোরেটের হাতের পুতুল। ব্যক্তিগত পরিসরে যেটুকু সম্ভব তা করা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদ নামক সমস্যার কারণ যেখানে কর্পোরেট শক্তি ও তার দোসর ভোটবাজ রাজনৈতিক দলগুলি তখন এই বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করার লড়াইয়ের অভিমুখ ঠিক করার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত জরুরি।
বৃহত্তর শ্রমজীবী জনগণ যেখানে বর্তমান ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ শিকার সেখানে তারাই এই লড়াইয়ের মূল যোদ্ধা ও আসল নেতৃত্ব। সেই বৃহত্তর জনতার চাহিদা কখনোই ধর্মীয় মৌলবাদ নয়। তাদের চাহিদা অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের চাহিদা। ভিক্ষার বদলে কাজ পাওয়ার চাহিদা। শিক্ষিত বেকারদের চাকরি পাওয়ার চাহিদা। শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির চাহিদা। কৃষকের সার বীজের দাম কমানো ও ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার চাহিদা। বিনামূল্যে উন্নতমানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার চাহিদা। এই চাহিদাগুলো নিয়ে ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করা সময়ের দাবি। কৃষক শ্রমিক সহ বেকার যুবক যুবতিকে এই সকল ন্যায্য গণ-আন্দোলনে যোগ করতে পারলে তাদেরকে ধর্মীয় মৌলবাদ নামক দানবের কবল থেকে বের করে আনা সম্ভব হবে। কর্পোরেট ও তার তাঁবেদার ভোটবাজ রাজনৈতিক দলগুলো যখন ধর্মীয় মৌলবাদ নামক সমস্যার নাটের গুরু তখন শুধু সম্প্রীতির বাঁশি বাজিয়ে একে দমন করা সম্ভব নয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হল যে রাজনৈতিক দলগুলি (ভোটবাজ ও ভোট বিরোধী) যারা এখনও সততার সঙ্গে ধর্মীয় মৌলবাদকে পরাজিত করতে চায় তারাও মধ্যবিত্ত মানসিকতার ঘেরাটোপে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। শ্রমজীবী জনগণের থেকে তাদের দূরত্ব ক্রমবর্ধমান। নীতির সংঘাত, নেতৃত্বের সংঘাত ও আত্মকেন্দ্রিকতায় ভুগে তারা বহুধাবিভক্ত। সমস্যার সমাধানে তাই সমস্ত জড়তা কাটিয়ে বৃহত্তর স্বার্থে, বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের স্বার্থে প্রগতিশীল জনগণের ও শ্রমজীবী মানুষের বৃহত্তর ঐক্য আজ সময়ের দাবি।
হিন্দু মৌলবাদ যেমন আমাদের দেশের প্রধান মৌলবাদী সমস্যা তেমনি ইসলামি মৌলবাদ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রধান মৌলবাদী সমস্যা। প্রধান মৌলবাদী সমস্যাকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে হবে অবশ্যই। তাই বলে অপ্রধান মৌলবাদ তথা সংখ্যালঘুর মৌলবাদকে ছাড় দেওয়া যাবে না কোনোভাবে। মৌলবাদ নামের এই আগাছা উপযুক্ত জল-হাওয়া পেলে দ্রুত পল্লবিত হয়ে মহিরুহের আকার ধারণ করবে।
একটা শোনা গল্প দিয়ে শেষ করি। একজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছেন পথ দিয়ে, তার হাতে ধরা একটি জীবন্ত হাঁস। যেতে যেতে সে হাঁসটার একটার পর একটা পালকগুলো ছিঁড়তে ছিঁড়তে চলেছে। হাঁস যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, মানুষটি আনন্দ পাচ্ছে। হাঁসের যন্ত্রণা দেখে আনন্দ পাচ্ছে। এই অবস্থায় হাঁসটিকে প্রশ্ন করা হল, তোমার তো ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। হাঁস কাতরাতে কাতরাতে উত্তর দিল, হ্যাঁ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তখন হাঁসটিকে বলা হল, আচ্ছা যদি তুমি ওই মানুষটির মতো হও আর যে মানুষটি তোমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে এবং আনন্দ পাচ্ছে সে যদি তোমার হাতে হাঁস হয়ে ঝুলে থাকে তখন তুমি কী করবে? হাঁস উত্তর দিল, আমিও তার পাখনাগুলো ছাড়াব এবং ছাড়াতে ছাড়াতে প্রচণ্ড আনন্দ পাব। ফলে আজ যারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু হয়ে বিভিন্ন দেশে অত্যাচারিত হচ্ছে তারাই যখন অন্য কোথাও সংখ্যাগুরু, সেখানে তারাও সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার করে একই রকম আনন্দ পাচ্ছে। তাই সংখ্যালঘুর মৌলবাদ ক্ষমতা পেলে একই রকম বিপজ্জনক হয়ে দেখা দেবে।