ধর্মীয় মৌলবাদের দার্শনিক পর্যালোচনা 

উমা চট্টোপাধ্যায় 

বর্তমান পরিস্থিতিতে মৌলবাদ (Fundamentalism) যে-কোনও প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। তদনুসারে সংস্কৃতি, ভাষা, শিল্প— সর্বত্রই মৌলবাদের প্রাসঙ্গিকতা লক্ষ করা যাচ্ছে। যদিও সব ধরনের মৌলবাদ অশান্তির কারণ নয়, ধর্মীয় মৌলবাদ ভয়াবহভাবে হিংসা, বিদ্রোহ এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের জন্ম দিচ্ছে। ফলে, ধর্মীয় মৌলবাদের আলোচনা চিন্তাশীল মানুষের কাছে বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে।

যখন মৌলবাদের কারণে যুদ্ধ শুরু হয়, তখন সেনাবাহিনীর আদেশ মেনে যুদ্ধে অংশ নেওয়া স্বাভাবিক বিষয় বলে বিবেচিত হয়। অনেক সাধারণ মানুষ মনে করেন এটাই উচিত। কিন্তু চিন্তাশীল, মননশীল মানুষ এই পরিণতিকে সহজে মেনে নিতে পারেন না। অথচ বাস্তবে তাঁদের তা সহ্য করতেই হয়। তাঁরা মৌলবাদের প্রভাব নিয়ে বিচলিত থাকেন এবং গভীরভাবে চিন্তা করেন। আমাদের এই প্রবন্ধে মৌলবাদের আলোচনা সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই।

আমরা এখানে মূলত ধর্মীয় মৌলবাদের পর্যালোচনায় মনোযোগ দেব। উপসংহারে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখাব— যদিও অন্যান্য প্রকারের মৌলবাদ কিছু ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, তথাপি ধর্মীয় মৌলবাদ নামে কোনও সুসংগঠিত ও গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। সাধারণ মানুষ এই বিষয়ে গভীরভাবে প্রবেশ না করায়, প্রায়শই ভয়াবহ সংঘর্ষ ও যুদ্ধের মুখোমুখি হন এবং মনে করেন মৌলবাদ এমন এক অমোঘ সত্য, যা কখনোই বিলুপ্ত হবে না। ফলে মৌলবাদের পরিণতি মেনে নিয়ে তা সহ্য করাই একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়। এতে সামাজিক Secularism (ধর্মনিরপেক্ষতা) ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু মৌলবাদ নয়। তবে মৌলবাদ আদৌ স্বীকার্য কি না, তা আমরা আলোচনার মাধ্যমেই নির্ণয় করতে পারি।

‘মৌলবাদ’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Fundamentalism প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯২০ সালে, এক জন ব্যাপ্টিস্ট (যিনি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত) সাংবাদিকের দ্বারা। ওই সাংবাদিক খ্রিস্টধর্মের কিছু মূল তত্ত্ব— যেমন বাইবেলের অব্যর্থতা, পাপের ধারণা, জিশুর কুমারী মেরির গর্ভে জন্ম, বাইবেলের নির্ভুলতা এবং খ্রিস্টের পুনরুত্থান (Resurrection)— এই সবকিছুকেই খ্রিস্টধর্মের ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। এসব তত্ত্বকে ঘিরেই ‘Fundamentalism’ বা ‘মৌলবাদ’ ধারণার উদ্ভব হয়। পরবর্তীকালে এই শব্দটি শুধু খ্রিস্টধর্মেই সীমাবদ্ধ না থেকে ইসলামি মৌলবাদ, হিন্দু মৌলবাদ, শিখ মৌলবাদ ইত্যাদি নানা ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হতে থাকে।

এই ধর্মীয় মৌলবাদ স্বীকৃতি পাওয়ার পরই একাধিক প্রতিপক্ষ মতবাদের উত্থান ঘটে— যেমন, Scientism, Skepticism, Postmodernism, Existentialism, Pluralism, Liberalism, Secularism প্রভৃতি। যদিও এই সব মতবাদ একই রকম নয় এবং প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করে, তবুও এদের একটি মৌলিক মিল রয়েছে— এরা সবাই মুক্তচিন্তার পক্ষপাতী। এদের অভিমত হল, যে-কোনও মত প্রতিষ্ঠার জন্য মৌলিক ধারণা প্রয়োজন হতে পারে, তবে প্রয়োজনে সেই ধারণা পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা যেতেই পারে। অর্থাৎ, একটিই মৌলিক ধারণা চিরকাল ধরে রাখার প্রয়োজন নেই।

কিন্তু বিপরীতভাবে, মৌলবাদ অন্যান্য ধারণা বা মতবাদকে স্বেচ্ছাচারিতার নিদর্শন বলেই মনে করে। মৌলবাদীদের মতে, বিপরীত মতগুলির কোনও সুসংহত মূলনীতি বা তাত্ত্বিক দায়বদ্ধতা নেই। সুতরাং, এসব মতবাদ এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতায় রূপান্তরিত হয়েছে মাত্র। এই বিচ্ছিন্ন ও ভিত্তিহীন ভাবনা সমাজ কিংবা ধর্মকে রক্ষা করতে পারে না। সেই যুক্তিতেই মৌলবাদ নিজেকে মূলের প্রতি আস্থাশীল, রক্ষণশীল একটি মতবাদ হিসেবে স্থাপন করে, এবং তা-ই শ্রদ্ধেয় ও গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত বলে মনে করে। ধর্মীয় সমাজকে মৌলবাদই রক্ষা করতে সক্ষম— এমন বিশ্বাস তাদের।

তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাদের ভিন্ন এক চিত্র দেখিয়েছে— সারা বিশ্বজুড়ে আমরা মৌলবাদের তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেছি। ভারতবর্ষেই জাতির জনক মহাত্মা গান্ধি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি এবং তাঁর পুত্র রাজীব গান্ধি— তিনজনেই মৌলবাদী হামলার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। মহাত্মা গান্ধি নিহত হন হিন্দু মৌলবাদীদের হাতে, ইন্দিরা গান্ধি শিখ মৌলবাদীদের গুলিতে, এবং রাজীব গান্ধি নিহত হন শ্রীলঙ্কার একটি মৌলবাদী সংগঠনের আত্মঘাতী হামলায়। আজ মৌলবাদের এই আক্রমণ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আমরা সব সময় এক অজানা সন্ত্রাসের আশঙ্কায় থাকি, বিশেষত ধর্মীয় মৌলবাদী আক্রমণের প্রসঙ্গে। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি— এই মৌলবাদ কখনোই পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হবে না। তবে আপাতত এর ফলাফল যতটা আশঙ্কাজনক, ভবিষ্যতেও তা একইরকম থাকবে কি না— সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

আমাদের বোঝা দরকার, ধর্মীয় মৌলবাদ কেন সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে, যদি আমরা ‘ধর্ম’ শব্দটিকে কেবল ইংরেজি ‘religion’ অর্থে না নিয়ে সংস্কৃত ‘ধৃ’ ধাতু থেকে আগত মূল অর্থ— ‘ধারণ করে যা’— এই ব্যাখ্যায় বুঝি, তাহলে দেখা যাবে ধর্ম হল এক রক্ষণশীল শক্তি, যা সমস্ত কিছুকে সংহত করে ধরে রাখে। কোনও ধর্ম যদি ভাঙন, লয় কিংবা সংঘর্ষ ঘটায়, তাহলে তা প্রকৃত অর্থে ‘ধর্ম’ নামে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্য নয়। যাঁরা অস্ত্র ধারণ করেন, তাঁদের মনে দেশপ্রেম বা ধর্মীয় গৌরবের একটি অনুভব হয়তো কাজ করে— এ কথা অস্বীকার করা যায় না। সেই আবেগের বশে তাঁরা সহজেই প্ররোচিত হন এবং ভয়ংকর মৃত্যুযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু কোনও ব্যক্তি যদি সত্যিকারের ধর্মজ্ঞান অর্জন করেন, তবে তিনি অন্যকে হত্যা করবেন— এমন সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

এখানে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন— স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তো অর্জুনকে যুদ্ধে উৎসাহিত করেছিলেন, তাহলে ধর্মের তাৎপর্য কোথায়? এই প্রসঙ্গে বলা যায়, এখানে উদ্দেশ্য নিছক হত্যা নয়, বরং আত্মরক্ষার্থে আক্রমণ প্রতিহত করাই গ্রহণযোগ্য হয়েছে। আধুনিক কালে একটি পত্রিকার সংবাদ নজরে পড়েছিল। একজন মহিলা তাঁর বাগানের বেড়া বাঁধছিলেন। সেই সময় একটি ছেলে হঠাৎ করে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। মহিলার পুত্র সামান্য দূরে কাজ করছিলেন। তিনি ছুটে এসে মায়ের হাতে থাকা দা কেড়ে নিয়ে সেই ছেলেটিকে হত্যা করেন। তৎক্ষণাৎ পুলিশ এসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং হেফাজতে নিয়ে যায়। পরে আদালতের রায় কী হয়েছিল, তা আমাদের জানা নেই। তবে ছেলেটি জানায়— যিনি তাঁর মায়ের শ্লীলতাহানি করেছে, তাকে সে হত্যা করেছে, এতে তার বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই; বরং সে মনে করে এটাই ছিল কর্তব্য।

অতএব, স্পষ্টতই বলা যায়— সাক্ষাৎ আততায়ীর হাত থেকে নিজেকে বা প্রিয়জনকে রক্ষার জন্য প্রতিহত করা যদি প্রাণঘাতীও হয়, তবে তা আত্মরক্ষার মধ্যে পড়ে। মহাভারতে অর্জুনও কৌরবদের পক্ষে থাকা শত্রু ও দুরাচারীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। এ ছিল আত্মরক্ষার ও ন্যায় রক্ষার জন্য যুদ্ধ, ধর্ম রক্ষার নামে হিংসা নয়। এই কারণে বলা যায়, এটি ছিল নৈতিক আচরণ, ধর্মীয় উন্মাদনা নয়। সেই সাধারণ ছেলেটিও যখন তাঁর মায়ের প্রতি অন্যায়ের প্রত্যাঘাত করে, তখন সে ধর্মীয় আবেগ নয়, বরং নৈতিক বোধ থেকেই কাজ করেছিল— সে ও তার মা যে ধর্মেরই অনুসারী হোন না কেন। এখানে মূল বিষয় হল— নৈতিকতার দায় থেকেই এই প্রতিক্রিয়া।

ফলে, ধর্ম রক্ষার নামে অস্ত্র ধারণ বা আক্রমণ চালানো কোনও ধর্মাবলম্বীর ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য নয়। হানাহানি বা সংঘর্ষকে ‘ধর্মযুদ্ধ’ বা ‘ধর্ম রক্ষার লড়াই’ হিসেবে অভিহিত করা যায় না। আত্মরক্ষার জন্য কিছু কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে যুদ্ধের প্রাসঙ্গিকতা থাকলেও, তা মৌলবাদের আওতাভুক্ত নয়। এইরূপ আচরণকে ধর্মীয় আচরণ না বলে নৈতিক আচরণ বলা অধিক যুক্তিসংগত। অতএব, আমাদের ধর্মীয় আচরণ ও নৈতিক আচরণের পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন।

তাহলে প্রশ্ন আসে— ধর্মীয় আচরণ ও নৈতিক আচরণের পার্থক্য কোথায়? সাধারণভাবে সত্যনিষ্ঠ হওয়া, ন্যায়পথে চলা, গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা ইত্যাদি নৈতিক আচরণের নিদর্শন। কিন্তু ধর্মীয় আচরণ বিভিন্ন ধর্মে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। যেমন— ইসলামে নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট স্থানে পুরুষেরা জামাতে নামাজ পড়েন, যেখানে মহিলাদের প্রবেশ সীমিত। মহিলারা গৃহে নামাজ আদায় করেন। ইসলাম ধর্মে অভুক্ত থেকে রোজা রাখা, মূর্তিপূজার পরিবর্তে এক আল্লার প্রতি নিষ্ঠা প্রদর্শন ধর্মীয় আচরণ বলে গণ্য। তেমনি, শিখ ধর্মেরও কিছু মৌলিক ধর্মীয় তত্ত্ব ও আচরণ আছে। হিন্দু ধর্মেও ঈশ্বরচিন্তা, উপাসনা, মননের চর্চা, কর্মবাদে বিশ্বাস ইত্যাদি ধর্মীয় আচরণরূপে চিহ্নিত।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, উপরোক্ত কোনও ধর্মই হিংসা, আক্রমণ বা হত্যাকে ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে স্বীকার করে না। ধর্মের মূল কাজ সমাজ ও সংসারকে সংহত রাখা, আর তা সম্ভব কর্তব্যপরায়ণতা ও নৈতিক আচরণের মাধ্যমেই।

যে-কোনও ধর্মেরই কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে— তবে তা মেনে চলা মানেই মৌলবাদী হওয়া নয়। একে আস্তিক্যবাদ (orthodoxy) বলা যেতে পারে, কিন্তু তা মৌলবাদের সমতুল নয়। যারা সত্যিকারের আস্তিক, তারা ধর্মের মূল তত্ত্ব ও নৈতিক দিকটি আত্মস্থ করেন এবং তা নিজেদের জীবনযাত্রায় প্রয়োগ করেন। এই ধরনের ধার্মিকতা সাধারণত অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে না। বরং সকলেই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহাবস্থানের মানসিকতা নিয়ে বসবাস করেন এবং চিন্তার আদান-প্রদান ঘটান।

যদি আমরা এ পি জে আবদুল কালামের শৈশবের কথা মনে করি, তাহলে দেখতে পাব— দক্ষিণ ভারতের ছোট্ট গ্রামে তাঁর জন্ম, যেখানে তাঁর পিতা, এক হিন্দু পণ্ডিত ও এক খ্রিস্টান যাজক বিকেলবেলা একত্র হয়ে ধর্মীয়, দার্শনিক ও মানবিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের ধর্মে নিষ্ঠাবান ছিলেন, কিন্তু একে অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এমন ধর্মনিষ্ঠ আচরণকে আমরা কট্টরপন্থা বলতে পারি— তবে তা কোনোভাবেই মৌলবাদ নয়। এইরকম সহনশীল সহাবস্থানের মাধ্যমে সমাজে ধর্মীয় পরিমণ্ডলও মঙ্গলময় হয়ে উঠতে পারে। বিপরীতভাবে, যখন ধর্মের নাম করে উগ্রতা ও অসহিষ্ণুতা চর্চা করা হয়, তখনই আমরা মৌলবাদের তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করি।

আধুনিক যুগে যদি আমরা ধর্মকে তার মৌলিক মানবিক ও নৈতিক অর্থে গ্রহণ করি, তাহলে মৌলবাদের অস্তিত্বই বাতিল হয়ে যায়। তখন সমাজ হয়ে উঠবে শান্তিপূর্ণ, সহনশীল এবং মানবিক গুণসম্পন্ন জীবনের উপযোগী। সুতরাং বলা যায়, মৌলবাদ হল মিথ্যা বা বিকৃত জ্ঞানের ফসল। এই বিষয়ে যথাযথ সচেতনতা ও বোঝাপড়া তৈরি হলে, মৌলবাদ ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হবে এবং মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান