এখন-তখনের খ্রিস্টধর্মীয় মৌলবাদ : একটি সহজপাঠ

মৃন্ময় মুখার্জি  

বিবর্তনবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ ও ঐশী বাণীর ঐতিহাসিক সমালোচনায় বিশ্বাস যখন টলে ওঠে, তখন ধর্ম ফিরে যেতে চায় তার হারানো গৌরবে। এমন এক সন্ধিক্ষণে, বিংশ শতকের শুরুতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রটেস্ট্যান্ট সমাজে জন্ম নেয় খ্রিস্টীয় মৌলবাদ— আধুনিকতার অভিঘাতে কাঁপতে থাকা বিশ্বাসের এক প্রতিক্রিয়াশীল আশ্রয়। ‘The Fundamentals’ নামক পুস্তকমালার মাধ্যমে এর আত্মপ্রকাশ; যুক্তির বদলে বিশ্বাস, আধুনিকতার বিপরীতে বাইবেলের আক্ষরিকতায় খোঁজে পরিত্রাণ। তবে ১৯৮০-এর দশকে, এটি ধর্মতাত্ত্বিকতা ছাড়িয়ে রূপ নেয় এক সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তিতে। Moral Majority ও Religious Right-এর হাত ধরে খ্রিস্টীয় মৌলবাদ ঢুকে পড়ে মার্কিন ডানপন্থার অন্দরে, মুছে দিতে থাকে রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সীমারেখা। ইতিহাসবিদ জর্জ মার্সডেন একে বলেন ‘reactionary modernism’— আধুনিকতার বিরোধিতা করেও আধুনিক কৌশলে ক্ষমতা অর্জনের প্রয়াস। এর পরিণতি এক ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সূচনা, যেখানে বহুসংস্কৃতি, অভিবাসন, ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতা হয়ে ওঠে লক্ষ্যবস্তু। কারেন আর্মস্ট্রং এক্ষেত্রে বলেন, এটি ঐতিহ্যে প্রত্যাবর্তন নয়, বরং তার এক চরমপন্থী পুনরাবিষ্কার— এক যুদ্ধং দেহি কল্পনা, যা শুধু মার্কিন সমাজের অভ্যন্তরেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রভাব বিস্তারে উদ্গ্রীব; আত্মার নামে সূচিত ক্ষমতার প্রতিযোগিতা।

বর্তমান প্রবন্ধে আমরা সেই খ্রিস্টীয় মৌলবাদের রূপান্তর ও বিস্তারের এক সহজ পাঠ উপস্থাপন করব— তৎকালীন ধর্মতাত্ত্বিক মূল থেকে শুরু করে বর্তমান বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে তার পরিণতি পর্যন্ত।

শুরু হয়েছিল একটি প্রত্যয়ের ঘোষণা দিয়ে— The Fundamentals। ১৯১০ থেকে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত বারো খণ্ডের এই ধর্মতাত্ত্বিক সংকলন ছিল যেন আধুনিকতার বিরুদ্ধে রচিত এক ধর্মীয় যুদ্ধের ম্যানিফেস্টো; একাধারে তা ছিল বাইবেলের আক্ষরিকতা, জিশুর অলৌকিকত্ব, এবং ঈশ্বরপ্রদত্ত সত্যের এক নিঃশর্ত স্বীকৃতি। ক্যালিফোর্নিয়ার তেল-ব্যবসায়ী লাইম্যান স্টুয়ার্ট এই রচনাগুলিকে প্রচার করতেন— হাজার হাজার যাজক ও ধর্মপ্রচারকের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করতেন সেই ঈশ্বর-প্রদত্ত একমাত্র সত্য। বাইবেলের নির্ভুলতা, কুমারী মাতৃত্ব, বিকারহীন ক্রুশমৃত্যু, শারীরিক পুনরুত্থান এবং অলৌকিকতার ঐতিহাসিকতা— এই পাঁচ ‘অপরিবর্তনীয়’ স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছিল এই আন্দোলনের দুর্গ, যার প্রাচীর যুক্তির কাছে নয়, বিশ্বাসের কাছে দায়বদ্ধ। তবে এই বিশ্বাস ছিল যুক্তিবাদের প্রতি এক অব্যক্ত সন্দেহের প্রতিফলন; James Barr যাঁকে বলেছিলেন ‘মৌলিক অবিশ্বাস’— যেখানে যুক্তি নয়, আত্মরক্ষামূলক আস্থা হয়ে ওঠে প্রধান অস্ত্র। জর্জ মার্সডেন দেখিয়েছেন, কীভাবে এই ধর্মতাত্ত্বিক প্রতিবাদ ক্রমে এক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধে পরিণত হয়, যা পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় মৌলবাদের রাজনৈতিক উত্থানের ভিত গড়ে দেয়।

এই প্রবাহের সবচেয়ে নাটকীয় মঞ্চায়ন ঘটে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের Scopes Trial-এ— যেখানে স্কুলপাঠ্যে বিবর্তনবাদ অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগে এক শিক্ষককে আদালতে টেনে আনা হয়। এ যেন যুক্তি ও বিশ্বাসের সম্মুখ-সংঘর্ষ! একদিকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, অন্যদিকে বাইবেলের আক্ষরিকতা— এই মামলার রুদ্ধশ্বাস নাট্যমঞ্চে ধর্মীয় মৌলবাদ রণহুঙ্কার তোলে, যেন নিজেই ঈশ্বরপ্রদত্ত সত্যের শেষ রক্ষাকর্তা। কিন্তু আদালত-পরবর্তী সামাজিক প্রতিক্রিয়া ছিল নির্মম— প্রেস ও বিশ্ববিদ্যালয় মৌলবাদকে পশ্চাৎমুখী, যুক্তিবিরোধী ও ধর্মান্ধ হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে খ্রিস্টীয় মৌলবাদ আশ্রয় নেয় এক অন্তর্মুখী জগতে; গড়ে তোলে এক আধ্যাত্মিক দুর্গ, যেখানে বাইবেল পাঠ, জিশুর পুনরাগমন প্রত্যাশা, ও নিজস্ব সম্প্রদায়ভিত্তিক জীবনযাপন হয়ে ওঠে আত্মরক্ষার পথ। মার্সডেন একে বলেছেন ‘a subcultural retreat’— এক আধ্যাত্মিক অন্তরিণতা। 

এই আত্মগোপনের যুগ পার করে, খ্রিস্টীয় মৌলবাদ আবার ফিরে আসে জনপরিসরে— তবে আগের মতো আত্মরক্ষার আবরণে নয়, বরং এক নতুন অভিযোজন ও কৌশলের হাত ধরে। এই প্রত্যাবর্তনের অন্যতম বাহন ছিল ইভ্যাঞ্জেলিক্যালিজম— একটি অপেক্ষাকৃত নমনীয় কিন্তু বিশ্বাসনিষ্ঠ ধারা, যা আধুনিকতার সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে না গিয়ে, তার ভাষা ও কাঠামোকে ব্যবহার করে বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ খোঁজে। Billy Graham এই ধারার প্রতিভূ হয়ে ওঠেন। তাঁর কণ্ঠে ‘The Bible says…’ বাক্যটি যেন শুধুই ধর্মীয় নির্দেশ নয়, এক নৈতিক নির্দেশনাও হয়ে ওঠে। গণমাধ্যম, রাষ্ট্রনেতা এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর সংলাপ নতুন এক রাজনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। জর্জ মার্সডেন এই ধারা ও মৌলবাদের মধ্যেকার সম্পর্ককে চিহ্নিত করেন ‘familial tension’ হিসেবে— একই উৎসভূমি, কিন্তু একে অপরের কৌশল নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। তবুও সময়ের প্রয়োজনে মৌলবাদী চিন্তাধারাও উপলব্ধি করতে শুরু করে— বিশ্বাস যদি সমাজ রূপান্তরের দাবি তোলে, তবে তাকে আর নিছক আত্মগোপন নয়, দৃশ্যমান প্রতিরোধ ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করতেই হবে।

এই উপলব্ধি থেকেই জন্ম নেয় এক নতুন অধ্যায়— Religious Right। ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় মৌলবাদ কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা গির্জার প্রাচীরে আবদ্ধ থাকে না, বরং সক্রিয় রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। Roe V Wade মামলার গর্ভপাত-সংক্রান্ত রায়, নারী ও যৌনস্বাধীনতার উত্থান, সমকামী অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা— এসবই মৌলবাদীদের কাছে শুধু সামাজিক ইস্যু থাকে না, বরং ‘ঈশ্বরহীন জাতি’-র হুমকি হিসেবে প্রতিভাত হয়। এই সংকটের প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠে Moral Majority— Jerry Falwell-এর নেতৃত্বে, যা ধর্মকে এক ‘মরাল আর্মি’ হিসেবে সাজিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রনীতিকে ধর্মীয় মূল্যবোধে সংজ্ঞায়িত করতে চায়। পরে Pat Robertson-এর Christian Coalition এবং Tim LaHaye-এর ভবিষ্যদ্বাণীমূলক সাহিত্য এই ধর্মীয় ডানপন্থী প্রবাহকে দেয় আরও জনপ্রিয় ও সাংগঠনিক রূপ।

এদের এজেন্ডা ছিল সুস্পষ্ট— গর্ভপাত নিষিদ্ধকরণ, সমকামী অধিকারের বিরোধিতা, স্কুলে প্রার্থনার প্রত্যাবর্তন, পরিবার ও লিঙ্গ পরিচয়ের ঐতিহ্য রক্ষা। এই আদর্শিক রূপরেখা রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় এবং ১৯৮০ ও ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে রোনাল্ড রেগনের বিজয়ে মুখ্য ভূমিকা রাখে। এখানেই খ্রিস্টীয় মৌলবাদ এক অভূতপূর্ব রূপান্তরে পৌঁছে যায়— একটি ধর্মীয় আন্দোলন থেকে পরিণত হয় এক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রকল্পে, যা কেবল আধ্যাত্মিক পবিত্রতা নয়, রাষ্ট্রীয় পরিত্রাতার ভূমিকা নিতে আগ্রহী। ‘Religious Right’ কেবল বিশ্বাসের নামে নয়, বরং জাতির ভবিষ্যতের নামে কথা বলে— যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ‘আত্মা’ রক্ষার নামে তারা আধুনিকতা, বহুত্ববাদ ও প্রগতিশীলতা বিরোধী এক নতুন জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। এই রূপেই খ্রিস্টীয় মৌলবাদ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এক স্থায়ী, প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠেছে— ধর্মের ছায়ায়, কিন্তু ক্ষমতার অভিমুখে।

২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটকেই বদলে দেয়নি, এটি ধর্মীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রেও এক গভীর সকটের সূচনা করে। খ্রিস্টীয় মৌলবাদীদের কাছে এই ঘটনা ছিল এক প্রকার ‘আত্মবোধের বিস্ফোরণ’— যেখানে ইসলামি মৌলবাদের উপস্থিতি কেবল একটি বিজাতীয় হুমকি নয়, বরং তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এক পবিত্র সভ্যতা-সংঘর্ষের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। এই ভাবনার কেন্দ্রে ছিল ধর্মীয় বিশ্বাসকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতি এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ভিত্তিতে রূপান্তর করার প্রয়াস। Samuel P Huntington-এর ‘The Clash of Civilizations’(1996)-এ যে সভ্যতাগত সংঘর্ষের বর্ণনা ছিল, তা ৯/১১-পরবর্তী মার্কিন খ্রিস্টীয় ডানপন্থীদের দৃষ্টিতে পরিণত হয় এক ঐশী ভবিষ্যদ্বাণীতে।

এই পর্যায়ে খ্রিস্টীয় মৌলবাদীদের চোখে ইসলাম হয়ে ওঠে এক চিরন্তন ‘অপর’। একইসঙ্গে, ইসরায়েলের প্রতি গড়ে ওঠে একধরনের প্রাকৃতিক ও ধর্মীয় পক্ষপাত— Christian Zionism-এর উত্থানে। এই মতবাদে ইসরায়েলের রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্ব কেবল রাজনৈতিক বাস্তবতা নয়, বরং জিশুর পুনরাগমনের জন্য ঈশ্বরনির্ধারিত পূর্বশর্ত। Paul Boyer ও Paul Charles Merkley-র বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই ধরনের বিশ্বাস মধ্যপ্রাচ্যনীতি, ফিলিস্তিন প্রশ্ন, এমনকি ইরাক যুদ্ধ পর্যন্ত গভীর প্রভাব ফেলে— যেখানে যুদ্ধ আর কেবল কূটনৈতিক বা কৌশলগত নয়, বরং এক ‘পবিত্র সংঘর্ষ’ বা cosmic war-এ রূপান্তরিত হয় (Juergensmeyer, ‘Terror in the Mind of God’, 2003)।

এই ‘পবিত্র ধর্মযুদ্ধ’-র ন্যারেটিভ খ্রিস্টীয় মৌলবাদকে রাজনীতির চেয়ে এক উচ্চতর নৈতিকতা ও ঐশী দায়িত্বের মঞ্চে দাঁড় করায়। রাষ্ট্র ক্ষমতার কাছে তাদের দাবি আর কেবল নীতির নয়, বরং ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’-র বাস্তবায়ন। ফলে রাজনীতি, কূটনীতি ও যুদ্ধ— সবকিছুই এক ধর্মীয় ছাঁচে ঢেলে নেওয়া শুরু হয়। এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে, খ্রিস্টীয় মৌলবাদীরা নিজেদের দেখে ঈশ্বরনির্ধারিত জাতি, যারা ‘নষ্ট সভ্যতা’-র শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে সত্য ও পবিত্রতার প্রহরী। এসময় এই আন্দোলন কেবল গির্জার অন্দরে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা প্রযুক্তির সাহায্যে এক বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক আন্দোলন হতে চেয়েছিল। Evangelical Media Ministries, যেমন CBN ও TBN, শুধু টিভিতেই নয়, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল অ্যাপ, ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দর্শক-শ্রোতা তৈরি করে। GodTube, Rapture Ready, Charisma News-এর মতো ওয়েবসাইটগুলো ভবিষ্যদ্বাণীমূলক ধর্মতত্ত্ব, ইসলামবিরোধী বক্তব্য এবং আধুনিকতার বিপরীতে এক বিকল্প ধর্মীয় বিশ্বদর্শন ছড়িয়ে দেয়।

তবে প্রযুক্তি যেমন এই মৌলবাদকে বিস্তারের সুযোগ দেয়, তেমনি এটি হয়ে ওঠে এক পালটা প্রতিরোধের ক্ষেত্র। YouTube, TikTok, Reddit, এবং একাডেমিক পডকাস্টগুলোতে তরুণ প্রজন্ম ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীবাদ, LGBTQ+ অধিকার, এবং পরিবেশ-আধিকার ভিত্তিক রাজনৈতিক যুক্তি তুলে ধরে। এই প্রতিরোধভূমি একদিকে যেমন খ্রিস্টীয় মৌলবাদের রক্ষণশীলতা, আধিপত্যবাদ ও কর্তৃত্ববাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তেমনি ধর্মীয় পরিচয়কে কেবল ঐশী নয়, নীতিনৈতিক ও মানবিকতার আলোচনায় টেনে আনে। ফলে, একবিংশ শতাব্দীতে খ্রিস্টীয় মৌলবাদ এক দ্বন্দ্বপূর্ণ যুগে প্রবেশ করে— একদিকে তার প্রযুক্তি-নির্ভর সম্প্রসারণ, অন্যদিকে বিরুদ্ধ প্রতিরোধের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক চাপ। এই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ‘কীভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস আধুনিক বিশ্বে নিজেকে রক্ষা করবে’— প্রতিরোধ, অভিযোজন না কি আত্মসমালোচনার দ্বারা?

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে খ্রিস্টীয় মৌলবাদ রূপ নেয় এক সর্বগ্রাসী সংস্কৃতিতে— যেখানে ধর্ম কেবল উপাসনার অনুশাসন নয়, বরং সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রনীতির ওপর আরোপিত এক নিয়ামক কাঠামো। তাদের লড়াই এখন গর্ভপাত বা বিবর্তনবাদের সীমা পেরিয়ে পৌঁছায় প্রযুক্তি, জাতিগত ন্যায়, স্বাস্থ্যনীতি ও জাতীয় পরিচয়ের জটিল সংকটে। এই সংঘাত প্রথম দৃশ্যমান হয় শিক্ষাক্ষেত্রে। Critical Race Theory, যা বর্ণবৈষম্যের শিকড় অন্বেষণ করে, খ্রিস্টীয় মৌলবাদীদের চোখে রূপ নেয় ঈশ্বরনির্মিত শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে এক বামপন্থী ষড়যন্ত্রে। Fox News, PragerU ও Turning Point USA-এর মাধ্যমে এটি পরিণত হয় এক সাংস্কৃতিক যুদ্ধ ঘোষণায়, শ্রেণিকক্ষ হয়ে ওঠে মতাদর্শিক রণক্ষেত্র। 

এরপর, COVID-19 মহামারি এই সংগ্রামে আনে নতুন মাত্রা— গির্জা বন্ধ, প্রার্থনায় নিষেধাজ্ঞা ও টিকার বাধ্যবাধকতা, এসবই মৌলবাদীদের কাছে ঈশ্বরের প্রতি অবজ্ঞা। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হয়ে ওঠে এক অলৌকিক আত্মরক্ষার যুদ্ধ। সবচেয়ে রহস্যময় সংঘাত ঘটে প্রযুক্তির গহ্বরে— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জেনেটিক প্রকৌশল ও ট্রান্সহিউম্যানিজমকে দেখা হয় ‘আধুনিক শয়তান’ রূপে। এখান থেকেই জন্ম নেয় ‘Technophobia Theology’—  যেখানে Harari ও Kurzweil-এর ভবিষ্যত-চিন্তা বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীকে অতিক্রম করে ফেলার আশঙ্কায় আচ্ছন্ন এক ধর্মতাত্ত্বিক আতঙ্ক।

এই সমস্ত সংঘাতের ছায়া আরও ঘনীভূত হয় এক রাজনৈতিক ব্যতিক্রমে— ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানে। তাঁকে অনেক খ্রিস্টীয় মৌলবাদী দেখে এক প্রকার অপ্রত্যাশিত ঈশ্বরদূত হিসেবে— যিনি তাদের ভাষায় ‘অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে প্রাচীর’, ‘বিশ্বাসীদের জন্য প্রতিরক্ষা’। ‘Jericho March’, ‘ReAwaken America Tour’— এই সমাবেশগুলোতে ধর্মীয় আবেগ ও রাজনৈতিক উন্মাদনা মিশে যায় একরকম নির্বাক পূজায়, যেখানে বাইবেল আর সংবিধান একাকার হয়ে যায়। এই প্রবণতা ‘খ্রিস্টীয় জাতীয়তাবাদ’ নামে এক নব্য মতাদর্শ সৃষ্টি করে— যা শুধু একটি ধর্মীয় আদর্শ নয়, বরং একটি পরিপূর্ণ জাতীয় প্রকল্প, যেখানে ‘ঈশ্বরের জাতি’ নির্মাণই একমাত্র লক্ষ্য। এইভাবে খ্রিস্টীয় মৌলবাদ এক রূপান্তরিত আন্দোলনের রূপ নেয়— যেখানে গির্জা জাতীয় পতাকার সামনে অবনত হয়, এবং বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী প্রযুক্তির আলো-আঁধারিতে নতুন ভাষায় পুনর্লিখিত হয়।

খ্রিস্টীয় মৌলবাদ আজ আর শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পিউরিটানিক অভ্যন্তরীণ আখ্যান নয়; এটি পরিণত হয়েছে এক বৈশ্বিক মহাকাব্যে;  যেখানে ধর্ম, ক্ষমতা ও জাতীয়তা ছড়িয়ে পড়েছে এক ‘পবিত্র’ আধিপত্যের রাজনীতিতে। বিংশ শতকের শেষ থেকে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে, এটি বিবর্তিত হয় এক পরিযায়ী মতবাদে, যা স্থানীয় সংকট ও ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকায় বিস্তার লাভ করে। ব্রাজিলে ইভ্যাঞ্জেলিক্যাল ও পেন্টেকোস্টাল গির্জাগুলি ‘নৈতিক শুদ্ধতা’-র নামে গরিব ও প্রান্তিকদের মন দখল করে, এবং সেই আবেগ রাজনীতির জ্বালানিতে পরিণত হয়। বলসোনারো তাঁর ‘God above all’ স্লোগানে ধর্ম, সেনাবাহিনী ও পরিবারকে একত্রিত করে গড়ে তোলেন ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ত্রিভুজ। আফ্রিকায়, বিশেষত নাইজেরিয়ায়, খ্রিস্টীয় রক্ষণশীলতা সহিংসতার ভাষায় প্রকাশ পায়। রাশিয়ায় পুতিন ও Russian Orthodox Church-এর জোট ধর্মীয় নৈতিকতাকে জাতীয় পরিচয়ের অস্ত্রে রূপান্তরিত করে। পোল্যান্ডে ‘Ordo Iuris’ গর্ভপাত, সমকামিতা ও লিঙ্গ পরিচয়কে নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়— ‘LGBT-free zones’ হয়ে ওঠে এক আধুনিক মধ্যযুগীয় প্রতিসরণ, যেখানে পবিত্রতার নামে মানবাধিকারের শ্বাসরোধ হয়।

এই আন্তর্জাতিক ধারা আবার ফিরে আসে যুক্তরাষ্ট্রে— আর এবার তা ভবিষ্যতের কোনো দূরাগত ধোঁয়াশা নয়, বরং এক ঘনঘোর বাস্তবতা। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার মার্কিন রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর দৃশ্যপটে আর কোনো আড়াল থাকে না; তাঁর প্রশাসন এক নগ্ন ও নিঃসংকোচ খ্রিস্টীয়-জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর দিকে যাত্রা করে, যেন ‘ঈশ্বরের নামে রাষ্ট্র’ গঠনের নিরাবরণ আয়োজন শুরু হয়েছে। Tucker Carlson-এর পুতিন ও ভিক্টর অরবানের প্রতি দুর্মর মোহ, অথবা CPAC (Conservative Political Action Conference)-এর মতো ডানপন্থী সম্মেলনের বৈশ্বিক প্রসারণ— এসব আজ নিছক মতবিনিময় নয়, বরং এক ঐশ্বরিক স্বপ্নে মোড়ানো রাজনৈতিক অভিসন্ধির অর্গলহীন ঘোষণা। এই অভিসন্ধির কেন্দ্রে রয়েছে ‘Project 2025’— Heritage Foundation-এর নেতৃত্বে পরিচালিত এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা, যা যুক্তরাষ্ট্রকে এক খ্রিস্টীয় নৈতিকতা-নির্ভর রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার জন্য তৈরি এক প্রশাসনিক চিত্রনাট্য। ‘Project 2025’ কোনো নির্বাচনি কৌশল নয়; বরং এক গোপন সংবিধান— এক ছায়া-ধর্মশাসনের ৯০০ পৃষ্ঠার মহাগ্রন্থ, যার পাতায় পাতায় লেখা আছে বিচারব্যবস্থা থেকে শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি থেকে অভিবাসন আইন পুনর্লিখনের হুকুম। 

এই ছায়া-শাসনের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে হোয়াইট হাউসের Faith Office, যা এখন শ্বেতাঙ্গ প্রোটেস্ট্যান্ট মৌলবাদের এক নীতিগত দুর্গ। এই অফিসের নেতৃত্বে আছেন টেলিভ্যাঞ্জেলিস্ট Paula White, যিনি ‘Black Lives Matter’ আন্দোলনকে ‘অ্যান্টিক্রাইস্ট’ বলেছিলেন (The Guardian, 2025)। তাঁর সহযোগী Jennifer Korn এবং Jackson Lane— দুজনেই Heritage Foundation ও ট্রাম্প প্রচারণার ধর্মীয় শাখার অংশ ছিলেন (Religion News, 2021)। ইতিহাসবিদ Kristin Kobes Du Mez সতর্ক করেন— Faith Office-এর বর্তমান রূপ কেবল মার্কিন ধর্ম-পরিমণ্ডলের প্রতিনিধিত্ব করে না; এটি এক ক্ষীণ, ডানপন্থী খ্রিস্টান মতবাদের প্রতিরূপ, যা ট্রাম্প ও তাঁর নীতিনির্ধারকেরা ‘খ্রিস্টধর্ম’ বলে বোঝেন। এটি তাই নিছক প্রশাসনিক কাঠামো নয়— এক আদর্শ-প্রতিষ্ঠান, যা আমেরিকান রাষ্ট্রের শিরা-উপশিরায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে এক মৌলবাদী তত্ত্ব: ‘তুমি যদি আমাদের মত না হও, তবে তুমি এই রাষ্ট্রের অংশ নও।’

এভাবেই খ্রিস্টীয় মৌলবাদ আর একক গির্জার স্তবধ্বনিতে সীমাবদ্ধ নেই; এটি হয়ে উঠেছে এক বিশ্বায়িত সিম্ফনি—  যেখানে বিভিন্ন ভাষা, বিভক্ত ভূগোল, এবং বিপরীতমুখী রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেও বেজে ওঠে এক অভিন্ন সুর: ঈশ্বরের নামে শাসন এবং নৈতিকতার নামে নিয়ন্ত্রণ। যদি একে কেবল বাইবেলের আক্ষরিক পাঠে ডুবে থাকা কিছু নিভৃত বিশ্বাসীর আন্দোলন বলে মনে করি, তবে তা হবে এক নির্মম সরলীকরণ। কারণ, এই আন্দোলনের শরীর গঠিত হয়েছে শুধু প্রার্থনা দিয়ে নয়— বরং জাতীয়তাবাদ, প্রযুক্তিভীতি, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ও ভূ-রাজনৈতিক উচ্চারণে। আজ এটি নিছক আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন নয়, বরং  এক  রাজনৈতিক চেতনা, এক চর্চিত শত্রুতাবোধ।

খ্রিস্টীয় মৌলবাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ঐশী বাক্যকে সযত্নে লালনের প্রয়াস দিয়ে, কিন্তু তা সময়ের প্রবাহে রূপ নিয়েছে এক বিপুল রাজনৈতিক তরঙ্গে। উপাসনালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে এই শক্তি প্রবেশ করেছে আইনসভা, বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদমাধ্যম ও রাষ্ট্রক্ষমতার অভ্যন্তরে। আধ্যাত্মিক নিষ্ঠার অন্তরালে এর অভিসন্ধি এখন অনেকটাই জাগতিক— যেখানে ধর্ম এক সাংস্কৃতিক অস্ত্র, নৈতিক শুদ্ধতার নামে প্রশ্নবিদ্ধ হয় নারী-স্বাধীনতা, LGBTQ+ অধিকারের স্বীকৃতি, বৈজ্ঞানিক মনন ও বহুত্ববাদী সমাজবোধ। এটি একপ্রকার ‘পবিত্র ভূখণ্ড’ নির্মাণের প্রয়াস, যেখানে ঈশ্বরের নামে মুছে ফেলা হয় মানবাধিকারের বহু সংগ্রামী অর্জন। ফলে খ্রিস্টীয় মৌলবাদকে বোঝার জন্য কেবল ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ নয়, প্রয়োজন তার সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক রূপান্তরকে একত্রে অনুধাবন করার সক্ষমতা।

এই প্রবন্ধে আমরা চেষ্টা করেছি সেই অনুধাবনের এক সহজ পাঠ নির্মাণে— যা ধর্মতত্ত্বের আন্তরিকতাকে অস্বীকার না করে বরং তুলে ধরে মৌলবাদের রাজনৈতিক কৌশল, ক্ষমতার বিন্যাস ও ভবিষ্যৎ বিস্তারের রেখাচিত্র। কারণ আধুনিক গণতন্ত্রের হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করে যখন ঈশ্বরের নামে শ্বাসরোধ শুরু হয়, তখন শুধু বিশ্বাস নয়, তার ব্যবহারের ধরনটিও গভীর পাঠের দাবি তোলে— এবং সেই পাঠ শুরু হতে পারে এখান থেকেই।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান