সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
যেখানে অসম বিভাজন রয়েছে সেখানে অনিবার্য নিয়ম এটাই যে, এ যদি ওপরে উঠে ও তবে নীচে নামবে। বাংলাদেশেও অবিকল তাই ঘটেছে। সাধারণীকরণ নানাভাবে করা যাবে, একটি হবে এই রকমের যে, স্বাধীনতার পরে আমাদের দেশে ব্যক্তি উঠেছে, নেমে গেছে সমষ্টি। কোনও একটি ক্ষেত্রে নয়, আলাদাভাবেও ঘটেনি, ঘটেছে সর্বত্র। ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির অসম বিভাজনটি নতুন নয়, অতি পুরাতন; এবং বহুকাল ধরেই সত্য এটা যে ব্যক্তিস্বার্থ যত উন্নত হয়েছে ততই অবনত হয়েছে সামগ্রিক স্বার্থ।
কিন্তু এ রকমটা হবার কথা ছিল না, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরে। মুক্তির লক্ষ্য অবশ্য ব্যক্তির উন্নতিই; যে কোনও অগ্রগতির চূড়ান্ত পরীক্ষা ওইখানেই ঘটে, ব্যক্তির লাভলোকসানে; কিন্তু সে ব্যক্তি অল্পকয়েকজন নয়, তারা হচ্ছে সবাই, সমগ্র জনগোষ্ঠী। লক্ষ্য ছিল সকল মানুষের মুক্তি, নইলে সকলে যোগ দেবে কেন, স্বাধীনতার আন্দোলন রূপ নেবে কেন জনযুদ্ধের? কিন্তু যুদ্ধ শেষে দেখা গেল নবীন আশা জয়ী হয়নি, কায়েম রয়েছে সেই পুরাতন নীতি; অল্পকিছু মানুষের উন্নতি, বাদবাকি মানুষদের অবনতি। এটা আগেও ঘটেছে, এবারও ঘটল। চকিতে তাকিয়ে দেখা যাক। ১৯৪৫-৪৬-এ এ দেশে একটি প্রায়-বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। মনে হচ্ছিল জনগণের অভ্যুত্থান ঘটবে, রাষ্ট্রক্ষমতা চলে যাবে সাধারণ মানুষের হাতে। সেটা যাতে না ঘটে তার জন্য তড়িঘড়ি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আন্দোলনরত মানুষকে ঠেলে-ধাক্কিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে নির্বাচনের সরু ও অন্ধ গলিতে। ফলে স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিণত হয়েছে কংগ্রেস ও লিগের ক্ষমতাদ্বন্দ্বে, এবং পরিণামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও বঙ্গবিভাগের মতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। লাভ হয়েছে কতিপয়ের, বোঝা বহন করতে হয়েছে জনগণকে।
তারপর পূর্ববঙ্গে বাহান্নোর ভাষা আন্দোলন; সে-আন্দোলন আরও অনেক দূর এগোত যদি আন্দোলনের ফলে গঠিত ও সুফলপ্রাপ্ত মুসলিম লিগ বিরোধী যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনবিজয়ী নেতারা ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে ভয়ংকর কলহ না বাধাতেন। সেটাও কতিপয়ের তৎপরতাই, অধিকাংশের সংগ্রামে বৈরী সুযোগকে কুক্ষিগত করবার; সংক্ষেপে লুটপাটের। ওই সুযোগে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল। এরপরে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে উনিশ শ’ উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। সেবারও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছিল জনগণকে শান্ত করতে, অখণ্ড রাষ্ট্রের আশা ছিল কতিপয়ের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা যাবে, বাদবাকিদেরকে বঞ্চিত করে। কিন্তু জনগণ রায় দিয়েছে আপসের বিপক্ষে এবং সংগ্রামের পক্ষে। নির্বাচন নয়, দাঙ্গা নয়, সামরিক শাসন মেনে নেয়া নয়। রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নির্ধারিত হয়েছে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি শাসকদের সব হিসাবনিকাশ এবং পরে গণহত্যা ও নৃশংসতাকে পরাভূত করে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। জনগণের দিক থেকে আশা ছিল মৌলিকপরিবর্তন ঘটবে। বিপ্লব আসবে সামাজিক ব্যবস্থায়, বদলে যাবে ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির পূর্ববর্তী সংঘাতপূর্ণ সম্পর্ক; সকলের উন্নতির মধ্য দিয়েই উন্নতি ঘটবে ব্যক্তিমানুষের। কিন্তু সেটা ঘটেনি। ব্যক্তি বড়ো হয়ে উঠেছে সমষ্টির প্রশস্ত ঘাড়ে পা রেখে। ফলে সমষ্টি তো নেমেছেই, ব্যক্তিও উঁচু হতে পারেনি। বাঙালি আগেও প্রান্তবর্তী ছিল এখনও সেই প্রান্তবর্তীই রয়ে গেল। ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সংঘর্ষের রূপ নেয়। একেবারে উঁচু থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র ওই একই ঘটনা, একই রকমের কলহ, দাঙ্গাহাঙ্গামা, ছিনতাই, খুনোখুনি। পথে ঘাটে ছিনতাই হয়, হবেই; রাষ্ট্রক্ষমতাও তো ছিনতাই হয়ে গেছে, একাধিক বার। এরশাদ যে রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনতাই করেছিলেন, সেটাও কতিপয়ের স্বার্থে, এবং রাজনীতিকদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সুযোগকে ব্যবহার করে। এরশাদ সরকারের পতন ঘটেছে গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে। পরিণতিতে নির্বাচন পাওয়া গেছে। একাধিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু তাতে পুরাতন নীতির কোনও বরখেলাপ ঘটেনি, জনগণের তেমন একটা লাভ হয়নি, লাভ হয়েছে কিন্তু মানুষের।
জনগণের শ্রমের সৃষ্ট ফসল আত্মসাৎ করে এই যে ব্যক্তির উত্থান একে আর যাই হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্মত বলবার কোনও উপায় নেই। উলটোটাই বলা সঙ্গত, যদিও বলা হয়নি। সত্য হচ্ছে এটা যে, মুক্তিযুদ্ধ অল্পকিছু মানুষের মুক্তি চায়নি, অন্য সবাইকে বন্দি রেখে। মুক্তি চেয়েছে সকলের, যাতে মুক্তি ঘটে প্রত্যেকের। সেটাই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যার অপর নাম প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। সে গণতন্ত্র অবৈধ স্বৈরাচারের জায়গাতে বৈধ স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা নয়, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠা বটে। কতিপয়ের যে শাসন দেশে প্রতিষ্ঠিত তা নির্বাচনের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হোক, কিংবা প্রতিষ্ঠা পাক জবরদখলের সাহায্যে, তাকে স্বৈরাচার ভিন্ন অন্যকিছু বলবার উপায় নেই, উপায় থাকে না।
এটা কেবল যে বাংলাদেশে ঘটছে তা নয়, ঘটছে সমগ্র পুঁজিবাদী বিশ্বে। পুঁজিবাদের মূল দর্শনটা এই রকমের যে, যোগ্যরা টিকবে, অযোগ্যদের হটিয়ে দিয়ে। তারাই যোগ্য যাদের পুঁজি আছে; কিংবা যারা পুঁজির সঙ্গে কোনও না কোনওভাবে জড়িত; যারা শ্রমজীবী তারা অবশ্যই অযোগ্য। ওই যোগ্যরা যে শাসন ব্যবস্থা চালু রাখে সেটা তাদের অর্থাৎ অল্পসংখ্যকের স্বার্থকেই পুষ্ট করে এবং জনগণের স্বার্থকে পদদলিত করে। যোগ্যদের এই শাসনের নানাবিধ কুফল জ্বলজ্বল করতে থাকে। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আদর্শস্থল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভোট কারচুপি হয়, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জাপানে প্রধানমন্ত্রী, সরকারের বড়ো বড়ো কর্তা ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়েন। অপরাধ ঘটে যত্রতত্র। পুঁজিবাদ নিজেই একটি অপরাধ, মস্ত বড়ো অপরাধ। তার শক্তি উদবৃত্ত মূল্য অপহরণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ওই উদবৃত্ত মূল্য আপনা আপনি সৃষ্টি হয় না, শ্রমজীবীরাই তা সৃষ্টি করে, নিজেদের শ্রম দিয়ে। শীর্ষ অপরাধী যে নিজেই তার পক্ষে অজস্র অপরাধের জন্ম দেয়াটাই স্বাভাবিক, এবং জন্ম সে দিচ্ছেও বটে। অপরাধীর শাস্তি দেবার দায়িত্বও আবার ওই ব্যবস্থারই হাতে; কিন্তু নিজেই যে অপরাধের জন্মদাতা, এবং জন্ম অপরাধী, সে কী করে অপরাধীকে শায়েস্তা করবে। পারছে না সেটা করতে যে জন্য অপরাধ বাড়তেই থাকবে, বৃদ্ধি পায় আদালত ও উকিলের সংখ্যা, হ্রাস পায় না অপরাধীদের ক্রমবর্ধমানতা। বাংলাদেশেও অবিকল সেটাই ঘটছে। ঘটতে থাকবে যদি রুখে না দাঁড়ানো যায়।
দুই
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি অবদান হচ্ছে মৌলবাদ, যা এখন বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, এবং সমগ্র বিশ্বের জন্যই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবান নামক দুর্বৃত্তরা ফ্যাসিবাদী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়ে তারা জনগণের সব মৌলিক অধিকারই হরণ করে নিয়েছে, মেয়েদেরকে বিশেষভাবে কোণঠাসা করেছে, টিকতে দিচ্ছে না প্রাচীন প্রস্তর মূর্তিগুলোকেও। দু-হাজার বছর আগের বৌদ্ধমূর্তিগুলো ধ্বংস করে নিজেদের বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল। তালেবানদের ওই কাজের নিন্দা করেনি, এমন দেশ নেই বললেই চলে। কিন্তু ওই দুর্বৃত্তরা দমেনি। ফ্যাসিবাদীরা দমে না। হিটলার যেমন করে বই পুড়িয়েছে, তালেবানরাও তেমনি করেই মূর্তি ভেঙেছে।
বিশ্বব্যাপী ধিক্কারধ্বনিতে এ সত্যটি যেন তলিয়ে না যায় যে, তালেবানরা উৎপাদিত হয়েছে পুঁজিবাদীদের কারখানাতেই। প্রত্যক্ষভাবে যেমন, তেমনি অপ্রত্যক্ষভাবেও। প্রত্যক্ষ যোগাযোগটা সকলেরই জন্য থাকবার কথা। সমাজতন্ত্রীদের উৎখাত করার জন্য মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ পাকিস্তানের মাদ্রাসাগুলোতে যে যুবকদেরকে লালনপালন করেছে, অর্থ দিয়েছে, সুযোগ দিয়েছে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের, তারাই পরে তালেবান নাম নিয়ে আফগানিস্তান দখল করে নিয়ে মৌলবাদী এক ব্যবস্থা কায়েম করেছে। তাদের শত্র ছিল সমাজতন্ত্রীরা; সমাজতন্ত্রীরা এখন মাঠে নেই, সেই শত্রুকে সামনে না পেয়ে তালেবানরা এখন উদারনীতিকদেরকে শত্রু করে তুলেছে।
এই ঘটনা প্রত্যক্ষ। দৈত্য যখন কাজ না পায় তখন মনিবের ঘাড়ে হাত দেয়। দৈত্যের সব কাজই অন্যায় ক্রিয়া, অন্যায় ছাড়া সে থাকতে পারে না, পারে না বলেই এখন তাদের দৌরাত্ম্য সভ্যতাবিধ্বংসী রূপ পরিগ্রহ করেছে। পুঁজিবাদী বিশ্ব এক দৈত্যকে নিবৃত্ত তো পরের কথা, নিয়ন্ত্রিতও করতে পারছে না। দৈত্য বড়োই বেয়াড়া। কিন্তু পুঁজিবাদের সঙ্গে মৌলবাদের যে দ্বন্দ্ব সেটা গভীর নয়, মৌলবাদের গভীর ও মৌলিক দ্বন্দ্ব হচ্ছে সমাজতন্ত্রের সঙ্গে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে মৌলবাদ এবং পুঁজিবাদের মধ্যে মিলবার কোনও জায়গা নেই। মৌলবাদ পশ্চাদ্পদ, পুঁজিবাদ হচ্ছে আধুনিক। চেহারাসুরৎ, পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী। কিন্তু দুয়ের মধ্যে আদর্শগত ঐক্য বিদ্যমান রয়েছে, এবং কেমন করে অস্বীকার করব এই সত্য যে আদর্শিক ঐক্যই হচ্ছে মূল ব্যাপার, তার বাইরে যা রয়েছে তা অমৌলিক, অনেকাংশে পোশাকি। আদর্শিক ঐক্যটা এইখানে যে, উভয় মতবাদই ব্যক্তির স্বার্থকে প্রধান করে তোলে সমষ্টির স্বার্থকে উপেক্ষা ও পদদলিত করে।
মৌলবাদীরা মোক্ষ খোঁজে। সে মোক্ষ অবশ্যই ব্যক্তিগত। তাদের ধর্ম চর্চাটাকে মনে হয় অলৌকিক, আধ্যাত্মিক। কিন্তু আসলে সেটা পুঁজি সঞ্চয়। তাদের পুণ্য এক প্রকারের পুঁজি বটে, ব্যক্তিগত পুঁজি; এর ক্ষেত্রে ইহকাল-পরকাল উভয় ভূমি পর্যন্ত প্রসারিত। তারাও মুনাফাতন্ত্রী। নিজের পুঁজি বৃদ্ধির জন্য মৌলবাদীরা অন্যের ওপর অত্যাচার করে, মানুষ মারতে পর্যন্ত পিছ পা হয় না, মূর্তি ভাঙতে তাদের হাত কাঁপে না। অন্ধকারকে লালন করে, অন্ধবিশ্বাসকে উত্তেজিত করে তোলে, সমষ্টিগত অগ্রগতিকে ঠেলতে থাকে পেছন দিকে। সকলকে পিছিয়ে দিয়ে নিজেরা এগুতে চায়। নিজেরা নয়, চূড়ান্ত বিচারে প্রত্যেক মৌলবাদীই ব্যক্তিগত, নিজের জন্য কাজ করছে; নিজের মুক্তি ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না।
মৌলবাদীরা আবার ভোগবাদীও বটে, তাদের স্বর্গ ভোগের উপকরণ দিয়ে ঠাসা। পুঁজিবাদীদের স্বর্গের সঙ্গে তাদের স্বর্গের মৌলিক কোনও ব্যবধান নেই। পুঁজিবাদের আদর্শিক মুখচ্ছবি দু-টি। একটি উদারনীতিক, অপরটি ফ্যাসিবাদী; উদারনীতি অত্যন্ত ভদ্র, ফ্যাসিবাদ ভয়ংকররূপে আক্রমণাত্মক। কিন্তু ভেতরে তাদের একই কারবার। উদারনীতি ভান করে নিরপেক্ষতার কিন্তু সংসারে নিরপেক্ষতা বলে তো কিছু নেই, বিশেষ করে সেই পরিস্থিতিতে– যেখানে লড়াই চলছে শুভের সঙ্গে অশুভের, ব্যক্তির স্বার্থের সঙ্গে সমষ্টিগত মঙ্গলের। এই যুদ্ধে উদারনীতি যদি বলে সে নিরপেক্ষ তাহলে বুঝতে অসুবিধা কোথায় যে, আসলে সে ব্যক্তির পক্ষেই, সমষ্টির পক্ষে নয়। উদারনীতি অবাধ প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করে, যার অর্থ সে প্রবলের সমর্থক, দুর্বলের বিপক্ষে।
ফ্যাসিবাদও তাই; সেও প্রবলকে বিকশিত করতে চায়, দুর্বলকে লাঞ্ছিত করে। দুয়ের মধ্যে তফাত ওই ভদ্রতারই। ফ্যাসিবাদ ভদ্রতার ধার ধারে না, সে নগ্ন উন্মোচিত, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতি তার সমর্থনটা উগ্র ও প্রত্যক্ষ, রাখঢাক করে না। ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীরাও পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকেই রক্ষা করতে চায়, তারাও ব্যক্তিস্বার্থ দেখে, সমষ্টি স্বার্থের বিপরীতে। তারাও উগ্র, তারাও ভয়ংকর।
মৌলবাদী ও পুঁজিবাদীরা যে পরস্পরের আপনজন সেটা পরিস্কার হয় সমাজতন্ত্রের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা লক্ষ্য করলে। উভয়েই সমাজতন্ত্রবিরোধী।
তার কারণ সমাজতন্ত্র ব্যক্তিকে বড়ো করে তোলে না; ব্যক্তিকে সে রক্ষা করতে চায় সমষ্টিকে বিকশিত করে। একের বোঝা সে দশের ওপর চাপায় না; বোঝাটিকে দশের সম্পত্তিতে পরিণত করে যাতে দশজনই চলতে পারে সমান বেগে, অগ্রগতি ঘটে সকলের। পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্রকে শত্রু মনে করে; পুঁজিবাদ চায় অল্পলোকের মঙ্গল, অন্য সকলের শোষণ ঘটিয়ে। ধর্মীয় মৌলবাদ বলে সমাজতন্ত্রকে সে ঘৃণা করে, কারণ সমাজতন্ত্র হচ্ছে বস্তুবাদী। কিন্তু মৌলবাদীরাও ভেতরে ভেতরে বস্তুবাদীই, তারাও সুখ চায়, যে সুখ বস্তুর দখলদারির ওপর নির্ভর করে, যে জন্য তালেবানরা মাদ্রাসায় থাকে না, অস্ত্র হাতে নিয়ে সিংহাসন দখলে লিপ্ত হয়। আর বিশ্বের সর্বত্রই দেখা যায়, দেখা গেছে অতীতেও যে ধর্মীয় মৌলবাদীরা ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে পবিত্র বলে মনে করে; ধনী ধনীই থাকবে, যেমন গরিব থাকবে গরিব, শুধু দেখতে হবে সকলেই ধর্মের পথে আসে কি-না, নাকি বিচ্যুত হচ্ছে।
ওদিকে পুঁজিবাদ যে মৌলবাদকে পুষ্ট করে সে ব্যাপারটাও অস্পষ্ট নয়, যদিও তাকে অস্পষ্ট রাখার চেষ্টা চলে। পুঁজিবাদ দারিদ্র্য ও বৈষম্য এবং অজ্ঞতা সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করে থাকে। দারিদ্র্য ও অজ্ঞতা মৌলবাদের প্রধান আশ্রয়। পুঁজিবাদী বৈষম্য দারিদ্র্য উৎপাদনের কারণ; এবং ওই বৈষম্য গরিব মানুষকে বিক্ষুদ্ধ করে তোলে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র সামাজিক বৈষম্যের প্রতিপালক; ওই রাষ্ট্রব্যবস্থা অধিকাংশ মানুষকে বঞ্চিত ও বিচ্ছিন্ন করে রাখে। বিশেষ করে প্রান্তিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে দেখা যায় শ্রমজীবী মানুষের জন্য রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে নিপীড়নের অতিনিষ্ঠুর যন্ত্র। পীড়িত মানুষ বিচার পায় না, আশ্রয় পায় না, প্রতিশ্রুতিও পায় না। সেই সঙ্গে তারা দেখে অল্পকিছু মানুষ যারা বলে তারা ইহজাগতিক, আচ্ছাদন নেই উদারনীতির, সেই মানুষগুলো পরম বিলাস ও অপচয়ের জীবনযাপন করছে; দেখে ক্ষিপ্ত হয় এবং তাদের ক্রোধ ও ক্ষোভপ্রকাশের কোনও গণতান্ত্রিক পথ যেহেতু খোলা পায় না তাই চলে যায় ধর্মের দিকে। ধর্ম ব্যবসায়ী মৌলবাদীরা এই ব্যবস্থার চমৎকার সুযোগ গ্রহণ করে থাকে; তারা সমর্থক পায়, অনুসারী পেয়ে যায়, তাদের হিংস্রতা আরও উগ্র হয়ে ওঠে।
তিন
বাংলাদেশে মৌলবাদ আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। একদিক দিয়ে এটা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত। কেননা বাংলাদেশের অভ্যুদয় ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান ও পরাভূত করে। কিন্তু পরাভূত শক্তি আবার ফিরে এসেছে। তার পরাজয়টা কেবল যে সশস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটেছিল তা নয়, ঘটেছিল আদর্শিকভাবেও। তাহলে কেন তার পুনরুত্থান? কেমন করে?
বোঝা যায় যে, মৌলবাদীরা তাদের আদর্শিক পরাজয়টিকে মেনে নেয়নি। দৈহিকভাবে হেরে গিয়ে এবং ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে ছিল মাত্র, পরে পরিস্থিতি আগের মতো প্রতিকূল নেই দেখে ফিরে এসেছে। এই যে পরিস্থিতি পালটে যাওয়া এর প্রধান উপাদান কী? সেটা হল পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ওই যে ব্যক্তি বড়ো হয়ে উঠছে সমষ্টির তুলনায়– এই নীতিটি আগের রাষ্ট্রগুলোতে কার্যকর ছিল, মনে হয়েছিল বাংলাদেশে তা থাকবে না, কেননা বাংলাদেশ হবে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক, সেখানে রাষ্ট্র হবে সকলের সাধারণ সম্পত্তি, যার দরুন রাষ্ট্র তার শোষণকারী ভূমিকা ছেড়ে রক্ষাকারীর ভূমিকা নেবে এবং সমাজে অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সেটাই ছিল স্বপ্ন। স্বপ্ন ভেঙে গেছে। যার ফলে অধিকাংশ মানুষের জীবনে দুঃস্বপ্ন নেমে এসেছে, এমন দুঃস্বপ্ন যা ছিল কল্পনার বাইরে, কারণ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় তাদেরকে আশা দিয়েছিল, ভাববার সাহস জুগিয়েছিল যে স্বপ্ন দূরে নয়, নিকটবর্তী বটে।
চোখ কচলে মানুষ দেখেছে যে যুদ্ধ করল সবাই, কিন্তু সুফল চলে যাচ্ছে ধনীদের গৃহে। উনিশ শ’ সাতচল্লিশের স্বাধীনতাতে যারা উপকৃত হয়েছিল, একাত্তরের স্বাধীনতাতে তারাই উপকার পাচ্ছে, দ্বিতীয়বার। কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে রাজাকার সেটা কোনও বিবেচনার বিষয় রইল না, সত্য হয়ে উঠল শ্রেণি। সাধারণ মানুষ আরও দেখল যে, মুক্তিযোদ্ধা নাম নিয়ে কিছু মানুষ এমন আচরণ করছে যে, তারা যেন পাকিস্তানিদের পরাজিত করেনি, যেন নিজেদের দেশকেই জয় করেছে; কাজেই দেশ তাদের, তারা এখন লুটপাট করবে, আগে পাকিস্তানিরা যেমন লুটপাট করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সর্বত্র ভূলুণ্ঠিত হল।
রাষ্ট্র আবার সেই পুরাতন পুঁজিবাদী পথ ধরে এগুতে থাকল। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় নিল, সমাজতন্ত্রকে ছেঁটে ফেলা হল, এবং গণতন্ত্রের পরিবর্তে কখনও বৈধ কখনও অবৈধ স্বৈরশাশন কায়েমি হয়ে বসে রইল। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও অজ্ঞতা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করল। অধিকাংশের স্বার্থ না দেখে কতিপয়ের স্বার্থ রক্ষা করবার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়াল পীড়নকারী প্রতিষ্ঠান যার কাছে আশ্রয় নেই, ভরসা নেই ন্যায়বিচারের।
কথা ছিল শিক্ষা হবে অভিন্ন ও সর্বজনীন। তা হয়নি। পাকিস্তানি রাষ্ট্রে এবং তারও আগে যে তিন ধরনের শিক্ষাধারা প্রচলিত ছিল তারা প্রবল বেগে ফিরে এসেছে। গরিব মানুষকে উৎসাহিত করা হয়েছে মাদ্রাসায় সন্তানদেরকে পাঠাতে। সেখানে গিয়ে তারা আরও গরিব হয়েছে, এবং ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থা হারিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে শাসক শ্রেণির অস্বস্তি ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তারা সকল ধর্মের অবাধ চর্চা বুঝেছে, এবং কার্যত ধর্মচর্চাকে উৎসাহিত করেছে।
এটাও দেখা গেছে যে, ধনীরা মনে করেছে যে তারা ধনী হয়েছে ভাগ্যগুণে। তারা আরও ধনী হতে চায়। আবার ভেতরে ভেতরে অপরাধবোধও কাজ করেছে, কেননা তারা জানে যে ধনার্জনের পথটা যে সৎ ছিল তা নয়, ছিল অপরাধাচ্ছন্ন। সে ভাগ্যের অত্যাশ্চর্য তৎপরতার জন্য কৃতজ্ঞতা এবং অপরাধবোধের বোঝা এই দু-য়ের তাড়নায় ধনীরা ধর্মকার্য ধরেছে। তারা মোটেই ধার্মিক নয়, ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাটাই করে, আধ্যাত্মিকতার বালাই নেই। কিন্তু তাদের দৃষ্টান্ত কম বিত্তবানদের অস্থির করে ধর্মের পথ ধরতে।
সমাজের প্রায় সবাই এখন পুঁজিবাদী। ব্যক্তিগত মুনাফা চায়। অন্যের ভালোমন্দ সম্পর্কে আগ্রহ কমছে, ক্রমাগত সংকীর্ণ, স্বার্থবুদ্ধিসর্বস্ব ও হতাশ হয়ে পড়ছে। হতাশা একটি ভয়ংকর ব্যাধি। ধর্মসহ নানাবিধ মাদকাসক্তি ওই ভূমিতে লালিত পালিত হয়।
প্রতিশ্রুতি ছিল যে, রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করবে। রাষ্ট্র তা করেনি। বস্তুত রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেবল যে সংবিধান থেকে বাদ দিয়েছে তা নয়, সেখানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে যুক্ত করেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের তৎপরতা তো রয়েছেই, জাতীয়তাবাদী বলে পরিচিত বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলও প্রায় প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতেই ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে চলেছে।
এসব মিলিয়েই বাস্তবতা। এই বাস্তবতা রাজ‣নতিক ধর্মনিরপেক্ষতা ও দার্শনিক ইহজাগতিকতাকে উৎসাহিত করছে না, বরঞ্চ মানুষকে প্ররোচিত করছে উলটো দিকে যেতে। ধর্মনিরপেক্ষতার ধারকেরা দু-ভাগে বিভক্ত, উদারনীতিক ও বামপন্থী। উদারনীতিতে বিশ্বাসী যাঁরা তাঁরা জনগণের ওপর প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেটা অস্বাভাবিক কোনও ব্যাপার নয়। কেননা তাঁরা ভদ্রলোক এবং জনবিচ্ছিন্ন। তদুপরি তাঁরা হচ্ছেন বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমর্থক, যে ব্যবস্থাকে শ্রমজীবী মানুষ মনেপ্রাণে ঘৃণা করে, যদিও প্রকাশ করবার পথ পায় না। উদারনীতিকরা ব্যক্তির বিকাশকে সমর্থন করেন, সমষ্টির বিপরীতে। তাঁরা রাষ্ট্রের অনুগ্রহপুষ্ট, নানাভাবে। তাঁদের দৃষ্টান্ত বা আদর্শ কোনোটাই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা ও ইহজাগতিকতার প্রকৃত সমর্থক হচ্ছেন বামপন্থীরা। কিন্তু কিছুটা নিজেদের দার্শনিক দুর্বলতা, কিছুটা পরদেশনির্ভরতা এবং অনেকটা রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার বৈরিতার কারণে তাঁরা প্রবল হতে পারেননি। স্মরণীয় যে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রীয় নীতি ছিল রাজাকারদের ক্ষমা করা এবং বামপন্থীদের প্রয়োজনে হত্যা করা। জনগণ বিক্ষুব্ধ, তাদের সেই বিক্ষোভ বামদিকে যাবে– এমন পথ এখনও তৈরি হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষ ডান দিকেই যাচ্ছে, এবং ডানপন্থীদেরও ডানে যাদের অবস্থান সেই মৌলবাদীরা সুবিধা করে নিচ্ছে।
চার
আসল অপরাধ পুঁজিবাদের। সেই দুর্বৃত্ত নানা অপরাধের জন্ম দিচ্ছে, এবং প্রায় কোনও অপরাধেরই যথোপযুক্ত বিচার নেই। বিচার ব্যবস্থা যে দুর্বল হবে তার নিশ্চিত পূর্বাভাস পাওয়া গেছে তখনি যখন দেখা গেছে যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর স্থানীয় রাজাকারদের বিচার হয়নি। বিচার হয়নি তো বটেই, বিচারের আগ্রহও দেখা যায়নি। যে রাষ্ট্রে অতবড়ো অপরাধীদের শাস্তি হয় না সেখানে অন্য অপরাধীরা শাস্তি পাবে এমন ভরসা জনগণ পায়নি। আসল সত্য তো এটাই যে, যাঁরা ক্ষমতা পেয়েছিলেন তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন নিজেদের স্বার্থ নিয়ে। সকলের স্বার্থ দেখার মতো সময়ের অভাব ছিল তাঁদের দিক থেকে। তাঁরা নিজেরাও তো সহযোগীই ছিলেন পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার। পুঁজিবাদী বিশ্ব বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করেছিল এই রাষ্ট্র সমাজতন্ত্রীদের হাতে চলে যাবে– এই রকমের আশঙ্কা থেকে। পরে তারা ঋণ, সাহায্য, পরামর্শ সর্বোপরি আদর্শ দানের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে টেনে নিয়েছে তাদের বৃত্তে। বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি সেই ব্যবস্থারই অধীনতা মেনে নিয়েছে, পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি যার অধীনে ছিল। তফাতটা আদর্শগত নয়। স্বার্থগত। পুঁজিবাদী আদর্শের অনুসারীরা ওই একই আদর্শের উগ্রসমর্থক যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের শাস্তি দিতে উৎসাহ পাবে, এটা স্বাভাবিক নয়। উৎসাহ তারা পায়ওনি। বরং ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের নৃশংস তৎপরতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের শাসনামলে।
তাহলে পথ কী? পথ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যে চেতনার মূল বিষয় ব্যক্তির নয়, সমষ্টির স্বার্থকে বিকশিত করা। সম্পদ উৎপাদন তো বটেই, সম্পদের সুষম বণ্টনও প্রয়োজন হবে। শত্রু চলে গেছে মনে করছি, কিন্তু শত্রু মোটেই যায়নি। শত্রু হচ্ছে ব্যক্তির স্বার্থকে বড়ো করে তোলা, এবং সেই গুরুত্বদানের পেছনে কাজ করছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও আদর্শ-শত্রু তারাও। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আসলেই শেষ হয়নি। সেই যুদ্ধে হেরে গেলে কেবলি পেছন দিকে হটতে থাকব, এখন যেমন হটছি ক্রমাগত।